১৫. উসমানিয়া নগরী

১৫. উসমানিয়া নগরী 

জেরুসালেমের লোকজন স্বস্তির সাথে উসমানিয়াদের স্বাগত জানিয়েছিল। মামলুক সাম্রাজ্যের পতন হওয়ায় নগরীটি অবহেলার শিকার হচ্ছিল : ওয়াকফ সম্পত্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, অর্থনৈতিক অবস্থা মন্দা হচ্ছিল, রাস্তাগুলোতে বেদুইনেরা সন্ত্রাস চালাচ্ছিল। উসমানিয়ারা তত দিনে অভিজ্ঞ সাম্রাজ্য নির্মাতায় পরিণত হয়েছে। তারা একটি শক্তিশালী, কেন্দ্রীভূত প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। মামলুকদের মতো তারাও মূলত ছিল সামরিক শক্তি। তাদের সেনাবাহিনী ও তাদের রাষ্ট্রের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল জাননেসারি নামের এলিট পদাতিক বাহিনী। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে প্রবল আগ্রহই ছিল এই বাহিনীর সবচেয়ে বড় শক্তি। ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সাম্রাজ্য তার ক্ষমতার শীর্ষে থাকাবস্থায় ১২ থেকে ১৫ হাজার জাননেসারি ছিল। উসমানিয়ারা ফিলিস্তিনে আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছিল : বেদুইনদের দমন করা হয়েছিল, তারা পল্লী এলাকার ক্ষতি করা বন্ধ করা মাত্র কৃষি খাতে অগ্রগতি হচ্ছিল। প্রাথমিক সময়ে উসমানিয়ারা আরব প্রদেশগুলোর প্রতি উদার ছিল। তারা দক্ষ প্রশাসন প্রবর্তন করেছিল, অর্থনীতি উন্নত হয়েছিল, ব্যবসা-বাণিজ্য সমৃদ্ধ হয়েছিল। ফিলিস্তিনকে জেরুসালেম, নাবলুস ও গাজাভিত্তিক তিনটি জেলায় (সানজাক) বিভক্ত করা হয়েছিল। এগুলো ছিল দামাস্কাস প্রদেশের (বিলায়েত) অংশ। তুর্কিদের দিয়ে জেরুসালেমের জনসংখ্যা চিত্র বদলানোর কোনো চেষ্টা ছিল না। উসমানিয়ারা স্রেফ একজন গভর্নর (পাশা), বেসামরিক কর্মকর্তা, ও ছোট সামরিকবাহিনী পাঠাত। এই বাহিনী দুর্গে মোতায়েন থাকত। 

সুলতান মহান সোলায়মানের আমলে (১৫২০-৬৬) জেরুসালেমের অবস্থা নাটকীয়ভাবে উন্নতি ঘটে। তিনি ইউরোপে যুদ্ধ করেছেন, পাশ্চাত্যে সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ করেছেন, তারপর এর অভ্যন্তরীণ উন্নয়নে মনোনিবেশন করেছেন। সোলায়মানের আমলে উসমানিয়া সাম্রাজ্য সাংস্কৃতিক পুনঃজীবন উপভোগ করে, জেরুসালেম ছিল এর অন্যতম সুবিধাভোগী। তুর্কি যুদ্ধগুলো সহজাতভাবেই ইউরোপে ইসলাম-সম্পর্কিত ঘৃণা নতুন করে জোরদার করে। নতুন ক্রুসেড নিয়ে কথাবার্তা চলছিল। কথিত আছে, সোলায়মান স্বপ্ন দেখেছেন যে নবী মুহাম্মদ (সা.) নিজে জেরুসালেম রক্ষার ব্যবস্থা করার জন্য তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আসল ঘটনা যা-ই হোক না, ১৫৩৬ সালে সোলায়মান নগর-প্রাচীর পুনঃনির্মাণের নির্দেশ দেন। এটি ছিল বিশাল প্রকল্প। এতে বিপুল ব্যয় ও ব্যাপক দক্ষতার সম্পৃক্ততা ছিল। খুব কম নগরীতে উসমানিয়ারা এত বিশাল সুরক্ষামূলক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। এখনো টিকে থাকা প্রাচীরটি ছিল দুই মাইল লম্বা ও প্রায় ৪০ ফুট উঁচু। ৩৪টি টাওয়ার ও সাতটি উন্মুক্ত ফটক-সংবলিত প্রাচীরটি নগরীকে পুরোপুরি ঘিরে ফেলেছিল। মহান রাজদরবারি স্থপতি সিনান নির্মাণকাজের সময় ‘নগরী সফর করেছিলেন বলে বলা হয়ে থাকে। নগরীর উত্তরের দামাস্কাস ফটকটির নক্সা ব্যক্তিগতভাবে করেছিলেন। ১৫৪১ সালে প্রাচীর নির্মাণ শেষ হলে জেরুসালেম তিন শতাধিক বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো যথার্থভাবে সুরক্ষিত হয়েছিল। 

জেরুসালেমের পানিব্যবস্থায় বিপুল বিনিয়োগ করেছিলেন সোলায়মান। নগরীতে ছয় শত সুন্দর ঝর্ণা নির্মাণ করা হয়েছিল, খাল ও পুকুর খনন করা হয়েছিল এবং নগরীর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ‘সুলতানের সরোবর’ নতুন করে সংস্কার, কৃত্রিম পানি-ব্যবস্থা মেরামত করা হয়। জেরুসালেমকে আরো শক্তিশালী করার জন্য সোলায়মান তার প্রজাদেরকে সেখানে বসতি স্থাপনে উদ্বুদ্ধু করার চেষ্টা করেছিলেন। বিশেষ করে ১৪৯২ সালে খ্রিস্টান স্পেন থেকে বিতাড়িত হয়ে উসমানিয়া সাম্রাজ্যে আসা ইহুদি উদ্বাস্তুদেরকে তিনি সেখানে বাস করতে উৎসাহিত করেন। উসমানিয়াদের আদমশুমারি থেকে আমরা জানতে পারি যে ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে জনসংখ্যা প্রায় তিনগুণ বেড়েছিল। ১৫৫৩ সালে সেখানে লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ১৩,৩৮৪ জন। ইহুদি ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রত্যেকের সংখ্যা ছিল প্রায় ১,৬৫০ জন করে। বেশির ভাগ মুসলিম ছিল আরব সুন্নি। অবশ্য উত্তর আফ্রিকা, মিসর, পারস্য, ইরাক, বসনিয়া, ভারতবর্ষ ও মধ্য এশিয়ার মুসলিমরা ছিল। নগরীটি এখন নতুন সমৃদ্ধি উপভোগ করছিল। বাজারগুলো উন্নত ও বড় করা হয়েছিল, পণ্যের দাম বেড়েছিল। এগুলো জীবনযাত্রার সাধারণ মান বৃদ্ধির সূচক। নগরীতে পাঁচটি প্রধান শিল্পের মধ্যে ছিল খাদ্য, বস্ত্র, সাবান, চামড়া ও ধাতবসামগ্রী। সাবান রফতানি করা হতো মিসরে, খাদ্য রফতানি করা হতো মিসর, রোডস ও দুবরোভনিকে। বস্ত্র ও চাল আমদানি করা হতো মিসর, পোশাক ও কফি আনা হতো দামাস্কাস থেকে, বস্ত্র ও কম্বল আনা হতো ইস্তাম্বুল, চীন ও হিজাজ থেকে। জেরুসালেমের বিভিন্ন শিল্প ও পেশাগুলো প্রায় ৪০টি গিল্ডে (তাইফা) সঙ্ঘবদ্ধ ছিল। প্রতিটিতে একজন শেখ ও তার সহকারী ছিলেন। এমনকি গায়ক ও নৃত্যশিল্পীদেরও নিজস্ব তাইফা ছিল। জনসংখ্যা, আয় ও নগরীর ধর্মীয় মর্যাদার কারণেও ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এর প্রশাসনিক মর্যাদা বাড়ানো হয়। এটি এখন মুতাসারিফলিক (সম্প্রসারিত প্রশাসনিক ইউনিট, যার মধ্যে ছিল নাবলুস ও গাজার সানজ্যাকগুলোও)। জেরুসালেম শাসনকারী পাশার পদবি ছিল মুতাসারিফ। আল-কুদসের কাজির এখতিয়ার ছিল অনেক বেশি, গাজা থেকে হাইফা পর্যন্ত বিস্তৃত। ঘটনাক্রমে এই দুই কর্মকর্তার বেতন ছিল একই। 

প্রাথমিককালের উসমানিয়াদের জেরুসালেমের প্রতি প্রতিশ্রুতি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল সোলায়মানের রাজসিক নগর-প্রাচীর নির্মাণের মাধ্যমে। এসব প্রাচীর এখনো পুরনো নগরীর সবচেয়ে বিখ্যাত স্মারক হিসেবে বিবেচিত হতো। 

সোলায়মান হারামকেও অবহেলা করেননি। ডোম অব দি রকের বাইরের দিকের উপরের অংশে মোজাইক আবার করা হয়, নিচের অংশে মার্বেল দিয়ে জৌলুষ বাড়ানো হয়েছিল। ডোম অব দি চেইনেরও সুন্দর চিনামাটির আবরণ দেওয়া হয়। সোলায়মান আল আকসার সামনের আঙিনায় চমকপ্রদ একটি ওজুখানা নির্মাণ করেন। হারামের ওয়াকফ আবারো গড়ে তোলা হয়, এর কয়েকটি মাদরাসা ছিল। ডোম অব দি রকে বছরব্যাপী কোরআন তেলায়াতকারীর ব্যয়ভার মেটানোর জন্য সুলতান তীর্থযাত্রীদের প্রবেশ-করে তার অংশে ছাড় দেন। ওয়াকফ সম্প্রসারিত করায় চাকরি ও দাতব্য কাজের পরিধি বাড়ে। সুলতানের রুশ- বংশোদ্ভূত স্ত্রী রোক্সেলানা ১৫৫১ সালে তাকিয়া লঙ্গরখানা নির্মাণ করেন। এই বিশাল কমপ্লেক্সে একটি মসজিদ, একটি রিবাত, একটি মাদরাসা একটি সরাইখানা ও একটি লঙ্গরখানা ছিল। লঙ্গরখানা থেকে ছাত্র, সুফি ও গরিবদের খাবার সরবরাহ করা হতো। ওয়াকফ হিসেবে রামাল্লা এলাকার কয়েকটি গ্রাম দান করে দেওয়া হয়। লঙ্গরখানাটি ফিলিস্তিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাতব্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। 

উসমানিয়াদের সৃষ্ট নতুন স্থিতিশীলতা জিম্মিদের ভাগ্যও পরিবর্তন করে। বেশির ভাগ ইহুদি তাইবেরিয়াস বা সাফেদে বাস করাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। তবে সোলায়মানের আমলে জেরুসালেমে ইহুদি সম্প্রদায় বাড়তে থাকে। অবশ্য তবুও সেখানে আনুষ্ঠানিক কোনো ইহুদি মহল্লা ছিল না। নগরীর রিশা, শারাফ ও মাসলাখ এলাকার আবাসিক স্থানগুলোতে ইহুদিরা বাস করতে চাইত। এখানে তারা মুসলিমদের সাথে মিলেমিশে বাস করত। ইউরোপ থেকে সফরে আসা ইহুদিরা ফিলিস্তিনি ইহুদিদের ভোগ করা স্বাধীনতায় অবাক হয়ে যেত। ১৫৩৫ সালে ইতালিয়ান ইহুদি ডেভিড দাই রোসি উল্লেখ করেছেন যে ইহুদিরা এমনকি সরকারি পদেও রয়েছে, যা ইউরোপে ছিল অভাবনীয় : ‘এখানে আমরা নির্বাসিত নয়, নিজ দেশের মতো আছি। এখানে… শুল্ক ও কর বিভাগে ইহুদিদেরই নিয়োগ করা হয়। ইহুদিদের ওপর বিশেষ কর নেই।’ উসমানিয়ারা ইহুদিদের ব্যাপারে প্রযোজ্য আর্থিকব্যবস্থা-সংক্রান্ত শরিয়াহ আইন কড়াকড়িভাবে আরোপ করেনি। জেরুসালেমের সব ইহুদিকে জিজিয়া কর দিতে হতো না, আর যাদেরকে দিতে হতো, তারাও দিত সর্বনিম্ন সরকারি হারে। বিচারালয়গুলো ইহুদিদের রক্ষা করত, তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করত, উসমানিয়া কর্মকর্তারা ইহুদি সম্প্রদায়কে উৎসাহিত ও সুরক্ষা দিতেন।২ 

উন্নত মর্যাদাভোগের প্রেক্ষাপটে ইহুদিরা ১৫২৩ সালে মেসাইয়া হওয়ার দাবি করে জেরুসালেমে আগত এক অদ্ভূত তরুণ ইহুদিকে নিয়ে চরমভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল : তারা আশঙ্কা করত যে তার কার্যক্রম উসমানিয়া কর্মকর্তারা বিদ্রোহ হিসেবে গণ্য করবে, এটি তাদের অবস্থানকে বিপজ্জনক করবে। ডেভিড রেউভেনি বলতেন যে তিনি ছিলেন সুদূর অতীতে ইসরাইলের হারিয়ে যাওয়া ১০ গোত্রের এক ইহুদি রাজ্যের প্রিন্স। সব গোত্র শিগগিরই জেরুসালেমে ফিরবে, তবে প্রথমে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে। রাজা সোলায়মানের আমলে বিদ্রোহী জেরোবোয়াম পৌত্তলিক মন্দির থেকে একটি পাথর টেম্পল মাউন্টের পশ্চিম দিকের দেয়ালে রেখেছিলেন। এটি যত দিন সেখানে থাকবে, তত দিন পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না। জেরুসালেমের ইহুদিদের অত্যন্ত বিপজ্জনক ও নিশ্চিতভাবে জঘন্য কাজটির ব্যাপারে কিছুই করার ছিল না : কথিত প্রাচীরটির অস্তিত্ব সুলতান সোলায়মান আমলে ছিল না। রেউভেনি ইতালির উদ্দেশে রওনা হওয়ার পর জেরুসালেমের এক রাব্বি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, এ লোককে নিয়ে ইতালির ইহুদিদের করার কিছু নেই। তবে গাজা, মিসর ও স্যালোনিসা থেকে ইহুদিদের ঢল আসন্ন বলে ঝামেলাপূর্ণ গুজব আসছিল। বলা হচ্ছিল, ইহুদিরা তাদের সব সম্পত্তি বিক্রি করে মেসাইয়াকে স্বাগত জানাতে পাসওভারে জেরুসালেমে আসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাব্বি মর্মপীড়ায় বলেন, ‘ঈশ্বর আমাদের প্রতি রহম করুন।’ এই বিশাল লোকের আগমন কেবল কর্তৃপক্ষকেই ঝামেলায় ফেলত না, এত লোককে বাস করতে দেওয়া বা খাবার যোগান দেওয়াও হতো অসম্ভব ব্যাপার। 

কিন্তু পাসওভারের সময় ইহুদিরা দৃশ্যমান কিছু প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়। তবে ডেভিড রেউভেনি ইতালিতে বেশ ভালো সংখ্যক অনুসারী আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি সেখানে নিজেকে নতুন রাজা দাউদ হিসেবে জাহির করেন। তিনি জেরুসালেমে তার অবস্থান নিয়ে উদ্ভট গল্প বলতেন : তিনি তার শিষ্যদের জানাতেন যে মুসলিম এস্টাবলিশমেন্ট তাকে সম্মানের সাথে স্বাগত জানিয়েছিল, তাকে মর্যাদার সাথে হারামে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে তিনি পাঁচ সপ্তাহ রকের নিচের একটি গুহায় বাস করেছিলেন। ডেভিরের স্থানে এই প্রার্থনা ও উপবাস একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। শাভুথের প্রথম দিনে ডোম অব রকের শীর্ষে নতুন চাঁদ পূর্বমুখী হয়ে যায়, একে ঠিক করা যায়নি। ডেভিড এটিকে তার রোমের উদ্দেশে যাত্রার সময় হিসেবে চিহ্নিত করেন। 

ডেভিডের মেসাইনিক আন্দোলন নিস্প্রভ হয়ে পড়েছিল। স্পেন থেকে বহিষ্কারের পর ইহুদি বিশ্বে এটি ছিল চরম মর্মপীড়ার বহিঃপ্রকাশ। ইসলামের অধীনে ইহুদিরা আল-আন্দালুসে সোনালি যুগ উপভোগ করছিল। স্প্যানিশ ইহুদিদের ক্ষতি বিশ্বজুড়ে শোক বয়ে আনে। কারণ টেম্পল ধ্বংসের পর থেকে এটিই ছিল সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। পঞ্চদশ শতকে ইউরোপে সেমিটিকবিরোধী নির্যাতন ব্যাপকভাবে দেখা যায়। ইহুদিদেরকে এক নগরী থেকে আরেকটিতে বহিষ্কার করা হতে থাকে। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ইহুদিদের অবস্থা অনেক বেশি খারাপ হতে থাকে, অনেকে বাড়ি ও অতীত থেকে এই বেদনাদায়ক বিচ্ছিন্নতার নাটকীয় অবসান হতে পারে বলে স্বপ্ন দেখতে থাকে। উসমানিয়াদের, তারা ইহুদি নির্বাসিতদের প্রতি বন্ধত্বপূর্ণ ছিল, জেরুসালেম জয় বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী ইহুদিদের মধ্যে বিপুল উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এক শ’ বছরের বেশি সময় ধরে তা অব্যাহত থাকে। 

জেরুসালেমে ডেভিড রেউভেনির মিশনে হারামের পশ্চিম দিকের সহায়ক প্রাচীরের ওপর নিবদ্ধ ছিল। এটি শুরুতে নির্মাণ করেছিলেন রাজা হেরড। এটি বাস্তবে ছিল হারানো টেম্পলের শেষ অবশিষ্টাংশ। মামলুক আমলে মাদরাসাগুলো এই প্রাচীরজুড়ে নির্মিত হয়, ব্যতিক্রম ছিল কেবল তারিক আল-সিলসিলা (স্ট্রিট অব দি চেইন) ও মাগরিবি গেটের মধ্যকার প্রায় ২২ মিটার বিস্তৃত এলাকা। প্রাচীরের এই অংশের প্রতি ইহুদিরা আগে কখনোই বিশেষ কোনো আগ্রহ দেখায়নি। হেরডের আমলে স্থানটি ছিল একটি শপিং সেন্টারের অংশ, এর কোনো ধর্মীয় তাৎপর্য ছিল না। এই সময় পর্যন্ত ইহুদি তীর্থযাত্রীরা মাউন্ট অলিভেস ও হারামের গেটগুলোতে প্রার্থনার জন্য জড়ো হতো। ক্রুসেডার আমলে নগরী থেকে তাদেরকে যখন বের করে দেওয়া হলো, তখন তারা টেম্পল মাউন্টের পূর্ব দিকের প্রাচীরেও অনেক সময় প্রার্থনা করত। তবে মামলুক শাসনের শেষ বছরগুলোতে পরিবর্তন দেখা যেতে থাকে। হয়তো ঘন ঘন বেদুইন হামলার কারণে নগরীর বাইরে মাউন্ট অলিভেসে জমায়েত হওয়াটা ইহুদিদের জন্য নিরাপদ মনে হচ্ছিল না। এর বদলে তারা হারামের পশ্চিম প্রাচীরের খালি স্থানটির দিকে নজর দিতে থাকে। তারা অতীতের সাথে একে সংযুক্ত করার দিকে ঝোঁকে। 

নগর প্রাচীর নির্মাণের সময় সম্ভবত সিনানের বাসভবন থাকায় এবং তিনি দামাস্কাস গেট নিয়ে কাজ করতে থাকায় সোলায়মান ওয়েস্টার্ন ওয়ালে প্রার্থনা করার অনুমতি দিয়ে দেন। সোলায়মান ফরমান জারি করে ওয়েস্টার্ন ওয়ালের একটি স্থানে ইহুদিদেরকে প্রার্থনা করার ব্যবস্থা করে দেন। সিনান এ স্থানটির নক্সা করেছিলেন বলে কথিত রয়েছে। তিনি নিচের দিকে খনন করে প্রাচীরটির উচ্চতা বাড়িয়ে দেন এবং মাগরিবি কোয়ার্টার থেকে ইহুদি উপাসনা স্থানটিকে আলাদা করতে সমান্তরাল একটি প্রাচীর নির্মাণ করেন। স্থানটি ছিল খুবই সংকীর্ণ, মাত্র প্রায় ৯ মিটার চওড়া। তবে প্রাচীরটি উপাসনাকারীদের বেশ ভালো জমায়েতের সৃষ্টি করত। ওয়েস্টার্ন ওয়ালের ছোট্ট উপাসনা স্থানটি শিগগিরই জেরুসালেমে ইহুদি ধর্মীয় জীবনের কেন্দ্রে পরিণত হয়। আনুষ্ঠানিক কোনো ভক্তি না থাকলেও ইহুদিরা বিকেলটা সেখানে কাটাতে পছন্দ করত, সাম পড়ত, পাথরগুলোতে চুমু খেত। জেরুসালেমে স্রেফ আরো ইহুদি আকৃষ্ট করতে ইচ্ছুক সোলায়মানকে ইসরাইলের বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে অভিনন্দিত করা হয়। ইহুদি কিংবদন্তি অনুযায়ী, তিনি নিজে স্থানটি পরিষ্কার গোলাপ পানি দিয়ে এটি পরিশুদ্ধ করেছেন বলে বলা হয়ে থাকে, যেভাবে উমর ও সালাহউদ্দিন টেম্পল মাউন্ট নতুন করে পরিশোধনের কাজ করেছিলেন। ৬ 

ওয়েস্টার্ন ওয়ালের ছোট প্রার্থনা অংশটির ব্যাপারে অনুমতি দিয়েছিলেন সোলায়মান। বলা হয়ে থাকে যে এর নক্সা করেছিলেন ইস্তাম্বুলে উসমানিয়া সাম্রাজ্যের প্রধান স্থপতি সিনান। 

ওয়েস্টার্ন ওয়াল অল্প সময়ের মধ্যেই পবিত্র স্থানের সাথে সম্পর্কিত স্বাভাবিক মিথগুলোর কয়েকটির সাথে সম্পর্কিত হয়ে যায়। দেভিরের পশ্চিম প্রাচীর-সম্পর্কিত তালমুদের ঐতিহ্যের সাথেও এটি স্বাভাবিকভাবেই সংশ্লিষ্ট হয়। তাতে রাব্বিরা বলেছেন, শেখিনা কখনো পরিত্যক্ত হননি এবং ঈশ্বর এ স্থানটি চির দিনের জন্য সংরক্ষিত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’ এখন তালমুদের ওইসব ভাষ্য হারামের পশ্চিম দিকের সহায়ক প্রাচীরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে লাগল। ঐশী উপস্থিতি সেখানে দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় ইহুদিরা সেখানে প্রবেশ করার আগে জুতা খুলে ফেলত। তারা তাদের আর্জি কাগজের টুকরায় লিখে তা পাথরের ফাঁকে ফাঁকে গুজে রাখত, যাতে ঈশ্বরের কাছে ধারাবাহিকতা থাকে। এটি টেম্পলের খুব কাছে থাকায় বলা হয়ে থাকে যে গেট অব হেভেন ঠিক ওয়েস্টার্ন ওয়ালের উপরে এবং প্রার্থনা সরাসরি ওই স্থান থেকে ঐশী সিংহাসনে পৌছে যায়। কারাইতে মোসেস ইয়েরুশালমি ১৬৫৮ সালে লিখেছিলেন, ‘ওয়েস্টার্ন ওয়ালে বিপুল পবিত্রতা রয়েছে, এতে থাকা মূল পবিত্রতা তখন ও চিরদিনের জন্য লেগে আছে।’ তারা যখন সংকীর্ণ স্থানটিতে পা বাড়াত, তাদের দিকে দৃঢ়ভাবে ও সুরক্ষিতভাবে উঁচু হয়ে থাকা দেয়ালের দিকে তাকাত, ইহুদিরা তখন ঐশী উপস্থিতির মধ্যে নিজেদের অনুভব করত। প্রাচীরটি ঐশী প্রতীকে পরিণত হয়। সেইসাথে তা ইহুদি জনগণের প্রতীকও হয়ে যায়। সব রাজসিকতা নিয়ে, প্রাচীরটি ছিল ধ্বংসাবশেষ- ধ্বংস ও পরাজয়ের প্রতীক। মোসেস ইয়েরুশালমি আরো বলেন, ‘টেম্পল থেকে মাত্র একটি, ও মাত্র একটি প্রাচীরই টিকে ছিল।’ এটি একইসাথে অনুপস্থিতি ও উপস্থিতির স্মৃতি জাগিয়ে তুলত। ইহুদিরা যখন ওয়েস্টার্ন ওয়াল আঁকড়ে ধরত, পাথরগুলোতে চুমু খেত, তারা তখন অনুভব করত যে তারা অতীত প্রজন্মগুলো ও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া গৌরবের স্পর্শ পাচ্ছে। ইহুদিদের মতো প্রাচীরটি ছিল টিকে থাকা সত্তা। তবে এটি তাদের টেম্পলের পবিত্রতাহানির কথাও স্মরণ করিয়ে দিত। এটি ইসরাইলের পঞ্জিভূত মর্মান্তিকতার প্রতীকীভাবে ফুটিয়ে তুলত। প্রাচীরে কান্না করার সময় ইহুদিরা অতীতে ও বর্তমানে তাদের হারানো সবকিছুর জন্যই প্রার্থনা করতে পারত। টেম্পলের মতোই ওয়েস্টার্ন ওয়ালও ঈশ্বর ও খোদ ইহুদি উভয়ের প্রতিনিধি হিসেবে ধরা দিত। 

উসমানিয়া জেরুসালেমে ইহুদিদের জীবন পুরোপুরি মনোমুগ্ধকর ছিল না। রোমান সিনাগগের পাশে থাকা আল-উমারি মসজিদ কর্মকর্তাদের সাথে তাদের উত্তেজনা তখনো চলছিল। ১৫৩০ ও ১৫৪৯-এর দশকে দুবার মুসলিমরা সিনাগগটি বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ইহুদিদের পক্ষে রায় দিয়েছেন কাজি। ১৫৫৬ সালে সিনাগগে এত বেশি ইহুদি উপাসনাকারী ছিল যে তাদের মুসলিম প্রতিবেশীরা তাদেরকে উৎখাত করার জন্য আরেকটি চেষ্টা করেছিল। তারা অভিযোগ করেছিল যে ইহুদিরা মুসলিম পোশাক নিয়ে হাস্যকর অনুকরণ করে আইন লঙ্ঘন করছে, তারা কেফিয়া দিয়ে প্রার্থনা শাল বানিয়ে উপাসনা করে। তারা জোরে জোরে প্রার্থনা করে পাশের মসজিদে থাকা মুসুল্লিদের নামাজে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ১৫৮৭ সালে সিনাগগটি স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়, যদিও বন্ধ করার কাজটি করা হয় নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে।’ ইহুদিদের তাদের স্কুলগুলো রাখার, নিজেদের বাড়িতে প্রার্থনা করার অনুমতি দেওয়া হয়। নবী স্যামুয়েলের কবর নিয়েও একই সমস্যা দেখা দেয়। জেরুসালেম থেকে ৯ মাইল উত্তরে অবস্থিত এ স্থাপনাটি ইহুদি ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কাছে শ্রদ্ধেয় ছিল। ইহুদিরা সেখানে একটি সিনাগগ রেখেছিল, তারা সেখানে নিয়মিতভাবে তীর্থযাত্রা করত। স্থানীয় মুসলিমরা অভিযোগ করত যে ইহুদিরা স্থানীয় দখল করে নিয়ে পবিত্র স্থানে মুসলিম জেয়ারতকারীদের প্রতি আক্রমণাত্মক আচরণ করে। অবশ্য এবার কাজি স্থায়ীভাবে ইহুদিদের পক্ষে আদেশ জারি করে তাদের সিনাগগটি বহাল রাখেন। 

উত্তেজনাটি গভীরভাবে বিরাজমান নিরাপত্তাহীনতাই প্রকাশ করে। একই পবিত্র স্থানে প্রতিদ্বন্দ্বী ধর্মীয় মতবাদের নৈকট্য চরমভাবে ঝামেলাপূর্ণ হতে পারে। বিপুলসংখ্যক ইহুদির উপস্থিতিকে মুসলিমরা হুমকিপূর্ণ মনে করে, ইহুদিদের উপাসনা তাদের মধ্যে অস্বস্তি সৃষ্টি করে। একই স্থানে দুই সম্প্রদায়ের একত্রিত হওয়াটা, প্রত্যেকের জোর দাবি যে তারাই সত্যের একমাত্র দাবিদার, কঠিন প্রশ্ন সৃষ্টি করে। তাদের কোনটা ঠিক? ইহুদি প্রার্থনা শাল সম্পর্কিত অভিযোগটি স্পষ্ট ও স্বতন্ত্র মুসলিম পরিচিতি প্রতিষ্ঠা এবং এই বিভ্রান্তি থেকে ইসলামকে আলাদা করা আকাঙ্ক্ষার কথাই প্রকাশ করে। বিশ শতকের ক্রমবর্ধমান হারে বহুত্ববাদী হয়ে ওঠা বিশ্বে একই ধরনের অনেক সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হয়েছিল, বিশেষ করে ধর্মীয় গ্রুপগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধও দেখা যায়। এ ধরনের সবচেয়ে বিখ্যাত ঘটনাটি হলো পূর্ব গাঙ্গেয় সমভূমির অযোধ্যায় বর্তমান মুসলিম-হিন্দু সঙ্ঘাত। উভয় সম্প্রদায়ই একে পবিত্র স্থান গণ্য করে। ইহুদিরা উসমানিয়া জেরুসালেম অরক্ষিত অনুভব করা শুরু করতে থাকে। সোলায়মানের রাজত্বের শেষ দিকে তারা নগরী ত্যাগ করতে আরম্ভ করে। তারা রিশা ও মাসলাখ জেলাও ত্যাগ করতে থাকে। এখানে তারা মুসলিমদের পাশাপাশি বাস করত। এখন তারা শারাফ জেলার দিকে সরে যেতে থাকে। এটি ওয়েস্টার্ন ওয়ালের আরো কাছাকাছি ছিল। একটি নতুন ইহুদি ছিটমহল সৃষ্টি হচ্ছিল। ষোড়শ শতকের শেষ নাগাদ শারাফ বিবেচিত হতো ইহুদি মহল্লা হিসেবে। এটি আশপাশের মুসলিম এলাকাগুলো থেকে বেশ আলাদা ছিল। 

জেরুসালেমে মুসলিম ও পাশ্চাত্যের খ্রিস্টানদের মধ্যেও নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। উসমানিয়া বিজয় বিভিন্ন খ্রিস্টান গ্রুপের তুলনামূলক মর্যাদায় বিরাট পার্থক্য সৃষ্টি করে। গ্রিক অর্থোডক্স, সিরিয়ান ও আর্মেনিয়ান খ্রিস্টানরা সবাই ছিল উসমানিয়া প্রজা। তারা ছিল স্বীকৃত ধর্মীয় তাইফার সদস্য। তবে ফ্রান্সিসক্যানেরা ছিল স্রেফ আবাসিক বিদেশী। তারা তখনো মাউন্ট সায়নের ঘিঞ্জি মহল্লায় বাস করছিল। দাউদের কবর তাদের হাতে না থাকলেও কেন্যাকল চার্চ তাদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল। মামলুক সাম্রাজ্যের শেষ বছরগুলোতে ফ্রান্সিসক্যানেরাও হলি সেপালচার চার্চে স্থান করে নিতে পেরেছিল। ফলে এখন আটজন পাদ্রি ও তিনজন অনুচর অন্ধকার, বদ্ধ ভূগর্ভস্ত অ্যাপার্টমেন্টে বাস করত, সবসময় মাথাব্যথা ও জ্বরে ভুগত। তারা যেভাবেই হোক না কেন, উসমানিয়ারা পৌঁছার আগে হলি সেপালচারের প্রধান স্থানগুলোর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে পেরেছিল। এই বিনিময় সম্পর্কে কোনো তথ্য আমাদের হাতে নেই। তবে ফ্রান্সিসক্যানেরা পদবির প্রমাণ হিসেবে নথিপত্রের মূল্য বুঝতে পেরেছিল। এ কারণে তারা দক্ষতার সাথে সরকারি দলিল ও ফরমান সংগ্রহ করতে শুরু করেছিল। 

তারপরও ১৫২৩ সালে অবস্থার অবনতি ঘটে। তখনো ইউরোপে যুদ্ধে ব্যস্ত সোলায়মান শুনে আতঙ্কিত হলেন যে কিছু ‘ধার্মিক ফ্রাঙ্ক’ দাউদ নবীর কবরের ঠিক ওপরে একটি চার্চ দখল করে আছে, তারা তাদের ভুয়া উপাসনার সময় বাদ্য বাজায়।’ তিনি সেন্যাক্যাল চার্চকে বন্ধ করে একে মসজিদে পরিণত করার একটি ফরমান জারি করেন। সেন্যাক্যালের পূর্ব দিকের দেয়ালে এখনো লেখা রয়েছে : সম্রাট সোলায়মান, উসমানের বংশধর, এ স্থানটিকে পবিত্র করার ও কাফিরদের বিতাড়িত করে একে শ্রদ্ধার সাথে আল্লাহর নাম উচ্চারণের জন্য মসজিদে পরিণত করার নির্দেশ দিয়েছেন।’ ফ্রান্সিসক্যানেরা মাউন্ট সায়নের একটি বেকারিতে চলে গেল। তাদের পক্ষ থেকে ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিস ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। তবে সুলতান তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে জেরুসালেমের অন্য সব খ্রিস্টান পবিত্র স্থান নিরাপদ ও সুরক্ষিত রয়েছে। 

ইউরোপের পরাশক্তিগুলোর সমর্থন জেরুসালেমে ফ্রান্সিসক্যানদের নাজুক অবস্থার বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভারসাম্যের ব্যবস্থা করত। ১৫৩৫ সালে সোলায়মান ইউরোপিয়ান সম্রাট পঞ্চম চার্লসের বিরুদ্ধে প্রথম ফ্রান্সিসের সাথে একটি চুক্তি করেন। ফ্রান্সের প্রতি শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে অপেক্ষাকৃত বেশি শক্তিশালী সোলায়মান ক্যাপিচুলেশনের (শর্তাধীন সমর্পণ) ব্যবস্থা করেন। এর ফলে ফরাসি বণিকদেরকে উসমানিয়া এখতিয়ারের আওতামুক্ত থেকে সাম্রাজ্যের বাণিজ্য করার সুবিধা লাভ করে। ফ্রান্সিস মুসলিম আইনিব্যবস্থার কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ ছাড়াই উসমানিয়া ভূখণ্ডে ফরাসি বণিক অন্যান্য প্রজার মধ্যকার দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা বিচার করার জন্য ফরাসি ‘বেইলিফ’ বা ‘কাউন্সিল’ নিয়োগ করতে পারতেন। ক্যাপিটুলেশন জেরুসালেমের পবিত্র স্থানগুলোর প্রধান 

স্থানগুলোর প্রধান রক্ষক হিসেবে ফ্রান্সিসক্যানদের অবস্থানও নিশ্চিত করে। ১২ এসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে সামান্যই। পাশ্চাত্যের কোনো কাউন্সিলের জেরুসালেমে স্থায়ীভাবে বসবাস করার তিন শত বছর আগেকার ঘটনা এটি। সোলায়মান সদাশয়তার চেতনায় ক্যাপিটুলেশনের আয়োজন করেছিলেন। তখন উসমানিয়া সাম্রাজ্য ছিল ক্ষমতার শীর্ষে। পরে তার উত্তরসূরিরা ফ্রান্স ও অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশের সাথে একই ধরনের চুক্তি করেছিলেন। তবে সোলায়মান ভুল হিসাব কষেছিলেন। উসমানিয়া সাম্রাজ্য যখন ক্ষয়ে আসছিল, তখন এ ধরনের ব্যবস্থা তুর্কি সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করার মতো করে সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য সুযোগটি কাজে লাগিয়েছিল পাশ্চাত্য। 

স্বাভাবিকভাবেই পবিত্র স্থানগুলোর ফ্রান্সিসক্যানদের নিয়ন্ত্রণ গ্রিক অর্থোডক্সের সাথে উত্তেজনার সৃষ্টি করে। কারণ গ্রিক অর্থোডক্স ক্রুসেডের সময় থেকে ল্যাতিন চার্চের প্রতি সদয় দৃষ্টিতে তাকাতে সক্ষম হয়নি। ক্রুসেডারেরা কেবল বলপূর্বক হলি সপালচার থেকে তাদের বিদায়ই করেনি, সেইসাথে ১২০৪ সালে চতুর্থ ক্রুসেডের সেনাবাহিনীর কনস্টানটিনোপল লুণ্ঠন ছিল পুরো ক্রুসেড ইতিহাসের অন্যতম লজ্জাজনক ঘটনা। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, ক্রুসেডারদের এই আক্রমণ থেকে বায়জানটিয়াম আর কখনো আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারেনি। ফলে গ্রিকরা ল্যাতিনদের তাদের শত্রু গণ্য করবে, এমনটিই স্বাভাবিক। কিন্তু তবুও গ্রিকরা শিখতে পারেনি কিভাবে উসমানিয়া কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করতে পারেনি কিংবা সর্বোচ্চ প্যাট্রিয়ার্কের উসমানিয়া সাম্রাজ্যের রাজধানী ইস্তাম্বুলে (ওই সময়ে বলা হতো কনস্টানটিনোপল) বাস করার সুযোগটিও কাজে লাগাতে পারেনি। ১৫৪১ সালে জেরুসালেমের প্যাট্রিয়ার্ক জারমানাস অর্থোডক্স খ্রিস্টবিশ্বের পক্ষ থেকে পবিত্র স্থানগুলোর আনুষ্ঠানিক অভিভাবক হিসেবে হলি সেপালচারের হেলেনিক কনফেডেরেসি প্রতিষ্ঠা করে। একই সময়ে পবিত্র স্থানগুলোর সুরক্ষা দিতে ফ্রান্সিসক্যানেরা নিজেদের নিয়ে ল্যাতিন খ্রিস্টবিশ্বের পক্ষ থেকে একটি জাতীয় সম্প্রদায় গঠন করে। যুদ্ধরেখা টানা হলো এবং প্রাথমিক সঙ্ঘাতের মাধ্যমে খ্রিস্টের সেপালচারের নিয়ন্ত্রণের জন্য গ্রিক ও পাশ্চাত্য খ্রিস্টানদের মধ্যে দীর্ঘ, ধর্মীয় যুদ্ধ শুরু হয়। ১৫৫১ সালে আরেকটি যুদ্ধে জয়ী হয় ফ্রান্সিক্যানেরা। ভেনেশিয়ানরা হলি সেপালচারের পশ্চিমে ছোট্ট একটি কনভেন্ট প্রতিষ্ঠার জন্য সোলায়মানের কাছে অনুমতি চায়। ওই সময় বাড়িটিতে কয়েকজন জর্জিয়ান নান বাস করতেন। জর্জিয়ান খ্রিস্টানেরা প্রতিবাদ জানায়। কিন্তু অর্থে অনেক কিছু হয়। ফলে নানদেরকে চলে যেতে হয়। ১৫৫৯ সালের জুলাই মাসে ফ্রান্সিসক্যানেরা ব্যবস্থা গ্রহণ করে নতুন নামকরণ করে কনভেন্ট সেন্ট স্যাভিয়র্স নাম দেয়। এটি জেরুসালেমে তাদের প্রধান সদরদফতরে পরিণত হয়। তারা আশপাশের কিছু বাড়িও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে শুরু করে। ১৬০০ সাল নাগাদ একটি কাঠমিস্ত্রি ও মুচির দোকানসহ সেন্ট স্যাভিয়ার্স একটি প্রাণবন্ত কম্পাউন্ডে পরিণত হয়। ১৬৬৫ সাল নাগাদ একটি ছেলেদের স্কুল, একটি লঙ্গরখানা, একটি পাঠাগার, একটি আরোগ্যালয় (এখানে নগরীর সেরা চিকিৎসাসেবা প্রদান করার ব্যবস্থা করা হয়) প্রতিষ্ঠা করা হয়। 

সোলায়মানের মৃত্যুর পর, ১৫৬৬ সালে, তার সম্রাজ্যে দুর্বলতা ফুটে ওঠতে থাকে। সামন্তবাদীব্যবস্থা ধীরে ধীরে অবনতির দিকে যেতে থাকে। একবার বিজয়ের যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর যুদ্ধলব্ধ সামগ্রী হারানোর ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য সিপাহিরা, সামন্তপ্রভুরা তাদের এলাকায় কৃষকদের শোষণ করার চেষ্টা করতে থাকে। এতে করে কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। এতে অপ্রত্যাশিতভাবে সাম্রাজ্য সঙ্কটে পড়ে যায়। উসমানিয়া সাম্রাজ্য পতনের অন্য যেসব কারণ রয়েছে সেগুলো হলো ভারতবর্ষগামী সমুদ্র রুটের সূচনা, নতুন বিশ্ব আবিষ্কারের পর রৌপ্য 

মুদ্রার মান কমে যাওয়া, জাননেসারিদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোস, তুরস্ক ও অন্যান্য প্রদেশের কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকা। ১৫৭১ সালে লেপান্তোর যুদ্ধে উসমানিয়াদের হার দিয়ে এসবের শুরু হয়। সাম্রাজ্যও তার সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব হারায়। ক্রমবর্ধমান সঙ্কট প্রতিফলিত হয় জেরুসালেমে পাঠানো উসমানিয়া কর্মকর্তাদের মানের অবনতি। পাশারা মুসলিম ও জিম্মি উভয়দের নির্যাতন করতে থাকে : ১৫৭২ ও ১৫৮৪ সালে ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিমরা নগরী ত্যাগ করতে থাকে। জন-নিরাপত্তায় অবনতি ঘটে, বিশেষ করে নগরগামী রাস্তাগুলো আবার বেদুইনরা ক্রমবর্ধমান হারে উৎপাত করতে থাকে। ষোড়শ শতকের শেষ নাগাদ বেদুইনরা নিয়মিতভাবে হেবরন ও নবী মুসা সফরকারী তীর্থযাত্রীদের ওপর হানা দিতে থাকে, মসজিদগুলোতে ইমামদেরকে খুতবা দিতে বাধা দেওয়া হতে থাকে। সরকার একটি সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেছিল : তারা বেদুইনদের প্রতিভূ করে জায়গিরদার হিসেবে শেখদের নিয়োগ করে। তীর্থযাত্রীদের কাফেলার কর আদায়ের দায়িত্ব দিয়ে তাদের সহায়তা পাওয়ার চেষ্টা করেছিল। তারা এমনকি গ্রামীণ এলাকার বেদুইনদের জন্য পল্লী বসতি স্থাপনের ব্যবস্থাও করেছিল। দুর্গ ও সেনাবাহিনী মোতায়েনও করা হয়। ১৬৩০ সালে সুলতান চতুর্থ মুরাদ বেথলেহেম ও সুলতানের সরোবরের কাছে বিশাল দুর্গ নির্মাণ করেন। কিন্তু তারা তখন পরাজয়ের যুদ্ধে লড়ছিল। ইস্তাম্বুল এখন ইউরোপ ও রাশিয়ার উভয়ের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। প্রদেশগুলোতে আইন প্রয়োগের মতো জনশক্তির অভাব দেখা দেয়। 

তবে সুলতানেরা হারামকে অবহেলা করেননি। ১৫৯৭ সালে সুলতান তৃতীয় মুহাম্মদ, ১৬০৩ সালে প্রথম আহমদ ও ১৬১৭ সালে প্রথম মোস্তফা ডোম অব দি রক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তারা পবিত্র স্থানগুলো সম্পর্কে প্রতিনিয়ত ফরমান জারি করতেন। পাশারাও হারামকে সুষ্ঠু রাখাকে তাদের প্রধান কর্তব্য মনে করতেন, স্থানটি যাতে পরিচ্ছন্ন ও যথাযথভাবে মেরামত হয়, তা নিশ্চিত করতেন। ওয়াকফ রাজস্ব রক্ষণাবেক্ষণ কাজে ব্যবহৃত হতো। তবে সরকার প্রয়োজন পড়লে সবসময় ব্যয়ভার বহন করতে রাজি থাকত। 

কিন্তু তা সত্ত্বেও সতের শ’ শতকে জেরুসালেমের পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। অবশ্য নগরীটি তখনো ছিল আকর্ষণীয়। তুর্কি পর্যটক ইভলিই চেলেবি ১৬৪৮ সালে আল-কুদস সফরের সময় দুর্গ, হারামে মুগ্ধ হয়েছিলেন, তিনি অর্থনীতির প্রশংসাও করেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন, হারাম, আশপাশের মাদরাসার জন্য বেতনভোগী আট শ ইমাম, ধর্মপ্রচারক, মোয়াজ্জিন ও হাফেজ রয়েছেন। মুসলিম তীর্থযাত্রীরা তখনো হারামের চারপাশ জেয়ারত করতেন, এর চূড়ান্ত ‘মঞ্জিলগুলোতে’ দোয়া পড়তেন। চেলেবি ছোট ডোম অব প্রফেটে বেশি অভিভূত হয়েছিলেন। তিনি বলেন, এর কালো পাথরটি মূলত ছিল রুবির মতো লাল। তবে চোখের পানির ঢলে তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তিনি ডোম অব চেইনে নামাজ পড়েন, উজ্জ্বল নীল রঙে রঙিন এর অনন্য কাশেম টাইলসের প্রশংসা করেন। এগুলোর রং ছিল উজ্জ্বল নীল। হারাম ছিল তীব্র আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্র। বারান্দাগুলো ভারতবর্ষ, পারস্য, কুর্দিস্তান ও এশিয়া মাইনরের দরবেশে পরিপূর্ণ ছিল। সারা রাত তারা পবিত্র কোরআন তেলায়াত করতেন, জিকির করতেন, সুর করে আল্লাহর নাম জপতেন। আর এসব করা হতো স্তম্ভশ্রেণিগুলোতে নিয়মিত ব্যবধানে জ্বালানো বাতিগুলোর আলোতে। ফজরের নামাজের পর আরেক দফা জিকির হতো হারামের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে থাকা মাগরিবি মসজিদে। চেলেবির এই কাজকে হইচই আর পাগলামিময় কাণ্ড মনে হয়েছে। 

তিনি জানিয়েছেন যে জেরুসালেমের পাশার কমান্ডে ছিল পাঁচ শ’ সৈন্য। তাদের অন্যতম দায়িত্ব ছিল প্রতি বছর দামাস্কাস প্রদেশের হজ কাফেলাকে মক্কায় পাহারা দিয়ে নিয়ে যাওয়া। তখনো কাজি ও পাশা সমান বেতন পেতেন, হজ বাণিজ্য থেকে অতিরিক্ত ৫০ হাজার পিয়াস্ত্রে পেতেন। কেবল ইস্টারেই নগরীতে পাঁচ হাজার থেকে ১০ হাজার খ্রিস্টান তীর্থযাত্রী থাকতেন। প্রবেশ ফি হিসেবে প্রত্যেকে ১০ থেকে ১৫ পিয়েস্ত্রা করে না দিলে কেউ হলি সেপালচারে প্রবেশ করতে পারত না। নবি মুসা বা হেবরন জিয়ারতে গেলে সড়ক নিরাপত্তা বাবদ মুসলিম জেয়ারতকারীদেরকেও কর দিতে হতো। চমৎকার পাথরের বাড়িঘর আর মনোরম প্রাচীরঘেরা জেরুসালেমকে চেলেবির কাছে দুর্গ নগরী মনে হয়েছিল। তিনি বলেন, এখানে ৪৩টি আঙুর বাগান ছিল। জেরুসালেমবাসী বছরে তিন মাস এসব ফল উপভোগ করতে পারত। এছাড়া ছিল অনেক ফুলবাগান আর সবজি খামার। আশপাশের পাহাড়গুলো ঢাকা ছিল জলপাই উদ্যানে। নগরীর বাতাস ছিল টাটকা, পানি ছিল মিষ্টি। মুহতাসিব (সুক তদারককারী) অফিসের নথিপত্র পরীক্ষা করে তিনি উল্লেখ করেন, জেরুসালেমে রয়েছে ২,০৪৫টি দোকান, ছয়টি সরাইখানা, ছয়টি হাম্মামখানা, বেশ কয়েকটি চমৎকার বাজার। তবে সর্বোপরি এটি ধর্মীয় শহর। আর্মেনিয়ানদের রয়েছে দুটি চার্চ, গ্রিকদের তিনটি, ইহুদিদের আছে দুটি সিনাগগ : 

নগরীটি ছোট মনে হলেও এতে আছে ২৪০টি মিরহাব, হাদিস শেখানোর সাতটি প্রতিষ্ঠান, কোরআন শেখানোর ১০টি প্রতিষ্ঠান, ৪০টি মাদরাসা, সুফিদের ৭০টি খানকাহ।১৩ 

নিরাপত্তাগত কারণে প্রতি রাতে ফটকগুলো বন্ধ থাকে, মাউন্ট সায়ন ছাড়া নগর-প্রাচীরের বাইরে কোনো বাড়ি নেই। মাউন্ট সায়নকে তিনি ‘দাউদের উপকণ্ঠ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।১৪ 

চেলেবি অবশ্যই অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন। তবে সোলায়মানের আমলে প্রাণবন্ত উন্নয়নের পর নগরীটির অবস্থা অবনতি ঘটতে থাকে। বেশির ভাগ নির্মাণকাজ ছিল সংস্কারমূলক, উদ্ভাবনমূলক নয়। রাজকীয় সঙ্কটের কারণে ইস্তাম্বুলের সাথে সরাসরি যোগাযোগ ছিল সামান্য। স্থানীয় আরব অভিজাত ব্যক্তিদের অনেক সময় জেরুসালেমের গভর্নর নিযুক্ত করা হতো। অষ্টাদশ শতকে এই রীতি বেশি করে অনুশীলন চলে। কাজি সাধারণত ইস্তাম্বুল থেকে আসতেন। তবে তার অধস্তন পদগুলো সাধারণ জেরুসালেমের শীর্ষস্থানীয় পরিবারগুলো থেকে পূরণ করা হতো। আবুল লুতফ পরিবার থেকে চারজন মুফতি নিয়োগ করা হয়েছিল, দাজানি পরিবার থেকে একজন। প্রধান প্রধান শিক্ষক পদেও পরিবারগুলো লোক যোগান দিত। এগুলো ঐতিহ্য পরম্পরা হয়ে পড়েছিল। এর ফলে অনিবার্যভাবেই মানের পতন ঘটেছিল। ১৬৭০ সালে পর্যটক আল-খিয়ারি ব্যাখ্যা করেন যে তিনি পুরো আল-কুদসে তিনি একজন খ্যাতিমান আলেমও খুঁজে পাচ্ছেন না। তবে তখনো মাদরাসাগুলো খোলা ছিল : চেলেবি উল্লেখ করেছেন যে ৫৬টি মামলুক মাদরাসার মধ্যে ৪০টি সক্রিয় রয়েছে। তবে টানাপোড়েন দেখা যাচ্ছিল। শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের বেতন তখনো রাষ্ট্র বহন করে যাচ্ছিল। তবে সপ্তদশ শতক নাগাদ অনেক সময় ছাত্রের চেয়ে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি হয়ে যেত। আকসা মসজিদের সংস্কার মানসম্পন্ন হয়নি, ফলে দরবেশদেরকে বারান্দায় থাকার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। ওয়াকফ ব্যবস্থার অবনতি হয়েছিল : অবহেলা, অসততা ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ছিল। 

উসমানিয়া সাম্রাজ্যের পতনে ভারসাম্য বিধান করেছিল ইউরোপিয়ান শক্তিগুলোর উত্থান। তারা এখন সুলতানদের শর্ত বেঁধে দিতে পারত। এর পরিণামে ফ্রান্সিসক্যানদের অবস্থা অব্যাহতভাবে ভালো হতে লাগল’। উসমানিয়া ও ইউরোপের মধ্যে প্রায় প্রতিটি সামরিক ও বাণিজ্য চুক্তিতে হলি সেপালচার-সংক্রান্ত কোনো না কোনো ধারা অন্তর্ভুক্ত থাকতই। ইউরোপের রাজারা অবশ্য যতটুকু চাইতেন, জেরুসালেমের বিষয়াদিতে ততটুকু প্রভাব বিস্তার করতে পারতেন না। ১৬২১ সালে ফ্রান্স ও সুলতান প্রথম মোস্তফার মধ্যে বাণিজ্য চুক্তির পর প্রথম ফরাসি কনসাল হিসেবে এম জ্যাঁ লেম্পায়ারকে জেরুসালেমে পাঠানো হয়েছিল। তার দায়িত্ব ছিল ফ্রান্সিসক্যান ও পাশ্চাত্যের তীর্থযাত্রীদের অধিকার সুরক্ষা করা। তিনি ফি, জরিমানা ও ঘুষের আকারে তীর্থযাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৬৩১ সাল নাগাদ পাশারা সত্যিই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। তারা কনসালকে ক্ষতির উৎস হিসেবে দেখতে পেলেন : জাফা বন্দর ছিল মাত্র আট ঘণ্টা দূরে। আর কত পাশ্চাত্য ‘কনসাল’ লেপেরারের পর এসে তাদের শুল্কে হস্তক্ষেপ করতে থাকবে? রাজকীয় ডিক্রি বাতিল করা হলো, কনসাল দেশে ফিরে গেলেন। আর কোনো কনসালকে জেরুসালেমে অনুমোদন দেওয়া হয়নি। তবে ১৬৬১ সালে ফ্রান্স তাদের দাবি বজায় রাখতে সক্ষম হলো যে সিডন ও একরে তাদের কনসাল জেরুসালেমে ল্যাতিনদের দায়িত্ব গ্রহণ করবে। তারা শর্ত দিলো যে প্রতিটি ইস্টারে তীর্থযাত্রীদের রক্ষা করতে এবং কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন নিশ্চিত করতে তিনি জেরুসালেমে আসার অনুমতি পাবেন। 

গ্রিক অর্থোডক্সরা আরো দক্ষতার সাথে তাদের বিষয়াদি সংগঠিত করতে শুরু করল। ইস্তাম্বুলের সর্বোচ্চ প্যাট্রিয়ার্ক রাজদরবারে বিষয়গুলো টেনে আনতে সফল হলেন, সুলতান ও উজিরদের ঘুষ দিতে সক্ষম হলেন। ১৬৩৪ সালে সুলতান চতুর্থ মুরাদের সাথে সাক্ষাতকালে জেরুসালেমের প্যাট্রিয়ার্ক থিওফ্যানি ৬৩৮ সালে প্যাট্রিয়ার্ক সোফ্রোনিয়াসকে দেওয়া খলিফা উমরের পত্র উত্থাপন করেন। এতে পবিত্র স্থানগুলোর ওপর গ্রিকদের নিয়ন্ত্রণ প্রদান করা হয়েছিল। ইস্তাম্বুলের ফরাসি রাষ্ট্রদূত সাথে সাথে ঘোষণা করলেন যে পত্রটি জাল। এর জবাবে থিওফ্যানিকে সাম্প্রতিক সময়ে আরো কিছু উসমানিয়া নথিপত্র উপস্থাপন করেন। এগুলো প্রথম সেলিম ও সোলায়মানের প্রদত্ত বলে দাবি করা হলো। সুলতান মুরাদ গ্রিকদের অনুকূলে একটি ফরমান ইস্যু করে তাদেরকে বেথলেহেমের ন্যাটিভিটি চার্চ এবং হলি সেপালচার চার্চের বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ স্থানের কর্তৃত্ব দিয়ে দিলেন। তবে পোপ, ফ্রান্স ও ভেনিসের চাপে সুলতান ২৬ হাজার পিয়েস্ত্রা পরিশোধের পর ফরমানটি বাতিল করেন। ফলে ফ্রান্সিসক্যানেরা ক্ষমতা ফিরে পায়। অবশ্য তা দীর্ঘ সময়ের জন্য নয়। উসমানিয়ারা এখন আয়ের একটি মূল্যবান উৎস পেয়ে গেল : পবিত্র স্থানগুলো সর্বোচ্চ দরপত্রদাতার কাছে চলে যেত। ১৬৩৭ সালে গ্রিকরা নতুন ফরমান পেয়ে হলি সেপালচারে অপেক্ষাকৃত শ্রেয় অবস্থানে চলে আসে। 

এটি শ্রেষ্ঠত্বের জন্য লড়াইয়ের জন্য অশোভন স্থান ছিল। কারণ খ্রিস্টান বিশ্বাস অনুযায়ী এখানেই ঈশ্বর-মানুষ স্বেচ্ছায় ক্ষমতা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে মৃত্যুকে বরণ করেছিলেন। ফ্র্যান্সিসক্যানেরা বিশেষভাবে খ্রিস্টের আগের প্রতি ভক্তিময় থাকলেও তারা নিজেদের জীবনে এই শিক্ষা প্রয়োগ করতে দৃশ্যত অসমর্থ্য ছিল। তারা ইসলামের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে বিষাক্ত প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিল : ষোড়শ শতকে আরো দুই ফ্রান্সিসক্যান হারামে প্রবেশ করে নবী মুহাম্মদকে গালিগালাজ করলে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। শহিদ হওয়ার এই আগ্রাসী আকাঙ্ক্ষা ছিল মৃত্যুর দিকে খ্রিস্টের পদাঙ্ক অনুসরণের নিজস্ব পন্থা, যদিও এটি ভালোবাসার চেয়ে ঘৃণায় উদ্দীপ্ত ছিল বেশি। খ্রিস্টের মৃত্যুর সাথে শনাক্ত করার তাদের আরেকটি পদ্ধতি ছিল ক্রুশের কেন্দ্রগুলোর প্রতি নতুন ভক্তি। এগুলো তখন জেরুসালেম দৃশ্যপটের অংশবিশেষ হয়ে পড়েছিল। সপ্তদশ শতকের শুরুতে ফ্রান্সিসক্যানেরা প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায় ভায়া ডোলোরোসায় শোভাযাত্রা বের করত। এসময় খালি পায়ে তারা পথজুড়ে আটটি ‘মঞ্জিলে’ তারা অ্যাভ ও প্যাতেরনস্তার বলত। এটি শুরু হতো ‘এসে হোমো আর্চের’ ‘পিলেত হাউস’ থেকে। তারপর তারা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলত, যেখানে ক্রুশের ভারে ক্রিস্ট পড়ে গিয়েছিলেন, তার মায়ের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন, সেরেনের সাইমন সহায়তা করেছিলেন, নগরীর নারীদের কাছে জেরুসালেম ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, সেসব স্থানে যাত্রাবিরতি করত। তারপর তারা গলগোথায় যাওয়ার আগে হলি সেপালচার চার্চের খ্রিস্টের কারাগার’ পরিদর্শন করত। অন্য তীর্থযাত্রীদের তাদের নিজস্ব ধরনের মঞ্জিল ছিল। তাদের অনেকে খ্রিস্টের তীর্থযাত্রার তাদের দেশের চার্চগুলো চালু করেছিল। শেষ পর্যন্ত চার্চ দেয়ালজুড়ে বিভিন্ন ছবির মাধ্যমে ১৪টি মঞ্জিলের দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল। ঊনিশ শতকে জেরুসালেমের ভায়া ডোলোরোসার মঞ্জিলগুলোর সংশ্লিষ্ট স্থানগুলোতে আরো ছয়টি মঞ্জিল যোগ করা হয়। এটি ছিল পাশ্চাত্য ভক্তির বিশেষত্ব। গ্রিক অর্থোডক্স প্যাসন অব খ্রিস্টের চেয়ে পুনরুত্থানের ওপর বেশি গুরুত্ব দিত। তবে মঞ্জিলগুলো ছিল ঐশী পথ বেয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত দুর্ভোগ থেকে জনগণকে ঊর্ধ্বে উঠাতে সহায়ক। 

ইহুদিরাও একই ধরনের শাস্ত্রীয় আচার-আচরণ তৈরি করেছিল। স্পেন থেকে বহিষ্কারের পর ইহুদি উদ্বাস্তুদের অনেকে শেষ পর্যন্ত স্যাফেদে বসতি স্থাপন করেছিল। সেখানে কাব্বালিপন্থী আইজ্যাক লুরিয়ার প্রভাবে তারা নির্বাসনের অভিজ্ঞতার ওপর জোর দিয়ে নতুন ধরনের আধ্যাত্মিকতা বিকশিত করেছিল। লুরিয়ানিক কাব্বালাহ কিংবদন্তিতে বলা হতো, একেবারে শুরুতে ঈশ্বর সৃষ্ট বিশ্বের জন্য জায়গা করে দিতে নিজের একটি অংশকেই নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন। একটি প্রাথমিক বিপর্যয়ের সময় শেখিনা, ঈশ্বরের কণে, ঈশ্বর-প্রকৃতি থেকে আলাদা হয়ে পড়েছিল। ঐশী সত্তা এখন সব দিকে ছড়িয়ে পড়ে নিকৃষ্ট বস্তুতে বন্দি হয়ে পড়ে। এর ফলে সত্তার নিজের কেন্দ্রেই বিচ্যুতি ঘটে। কোনো কিছুই ঠিক মতো হচ্ছিল না। ইহুদিদের নির্বাসন ঈশ্বর ও মানুষের একই ধরনের মহাজাগতিক গৃহহীনতার বিষয়টিই প্রতীকীভাবে ফুটিয়ে তুলেছিল। তবে ইহুদিরা সতর্কভাবে তাওরাত অনুসরণ ও আধ্যাত্মিক উপাসনার মাধ্যমে শেখিনার নির্বাসনের অবসান ঘটাতে পারত। এসব কাব্যিক কল্পকথা- প্রাচীন পৌত্তলিক কিংবদন্তির পুনঃসৃষ্টি- অনেক ইহুদি লোকের কাছে সরাসরি বলা হতো। তারা এসব অন্ধকার বছরগুলোর অভিজ্ঞতা নির্বাসনে নতুন করে অর্জন করত। শিকড় থেকে উচ্ছেদ হওয়া ইহুদিরা বিশ্বকে ভৌতিক বিশ্ব হিসেবে দেখত, জীবনকে দেখত অশুভ শক্তির সাথে সংগ্রাম হিসেবে। লুরিয়ার কল্পলোক আদি ঐক্যের সাথে চূড়ান্ত প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে তাদের নিজেদের দুর্দশা অতিক্রম করে যেত। এটি সময়ের শুরুর সময়কার অস্তিত্ব প্রকাশ পেত। 

ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি থেকে স্যাফেদ ও জেরুসালেমের কাব্বালপন্থীরা এমন এক শাস্ত্রীয় আচরণের মাধ্যমে শেখিনার পরিত্রাণ উপভোগ করত- সময়োচিতভাবে- যেটাকে তারা ঐশী সত্তার প্রতিক্রিয়া মনে করত। প্রতি শুক্রবার বিকেলে তারা ঈশ্বরের ঐশী কণে শেখিনাকে স্বাগত জানাতে নগরীর বাইরে মাঠে সাদা কাপড় পরে শোভাযাত্রা সহকারে অপেক্ষা করত। তারা তারপর ঐশী উপস্থিতিকে তাদের বাড়ি নিয়ে যেত। প্রতিটি বাড়িতে খাবারের ঘরে বিবাহ চাঁদোয়া, মদ, ধূপদানি রাখা হতো। এগুলো টেম্পলের কথা স্মরণ করিয়ে দিত। অর্থাৎ শেখিনা প্রতীকীভাবে দেভিরে প্রবেশ করতেন, ঐশীভাবে পবিত্র স্থানে ঈশ্বরের সাথে পুনর্মিলিত হতেন। আইজ্যাক লুরিয়া একটি ভজন রচনা করেছিলেন। এটি সাবাতের খাবারের পর সবসময় গাওয়া হতো : 

দক্ষিণ দিকে আমি মরমি মোমদানি রাখি,
আমি উত্তরে জায়গা রাখি রুটি রাখার টেবিলের জন্য…
শেখিনাকে ছয় সাবাত রুটি দিয়ে ছয় দিক থেকে ঐশী পবিত্রতা দিয়ে
ঘিরে রাখার জন্য।
দুর্বল ও অচ্ছ্যুৎ অশুদ্ধ শক্তি বের করে দেবে
তাণ্ডবকারী দানবগুলোর
পায়ে বেড়ি পরানো হবে। ৫ 

প্রতিটি বাড়ি টেম্পলের প্রতিকৃতিতে পরিণত হয়েছিল; প্রতিটিই এর মাধ্যমে প্রতীকীভাবে ঈশ্বরের ঐশী বাসস্থান ঐশী জেরুসালেমের সাথে সম্পর্কিত ছিল। শেখিনার শাস্ত্রাচারগত প্রত্যাবর্তনের অর্থ হতো প্রতি সপ্তাহে এক রাতের জন্য সবকিছু যথার্থ স্থানে চলে যেত, অশুভ শক্তি নিয়ন্ত্রণে থাকত। এর মাধ্যমে সাবাত সাময়িক তীর্থে পরিণত হতো। এর মাধ্যমে জীবন যেমন হওয়া উচিত তেমন ছবি প্রকাশ করা হতো। শুক্রবার রাতের শাস্ত্রাচারও ঐশী সত্তার চূড়ান্ত প্রত্যাবর্তনের ভাবমূর্তি প্রকাশ করত। মিলনের বিষয়টি লুরিয়ানিক কাব্বালাহর যৌন কল্পনার কথা প্রকাশ করত। 

স্যাফেদে টেম্পলের জন্য শোক শাস্ত্রাচার নতুন এক তাগিদ সৃষ্টি করে। লুরিয়ার অন্যতম শিষ্য আব্রাহাম হ্যালেভি বারুখিম একবার স্বপ্নবিভাবে কালো পোশাক পরে শেখিনাকে কাঁদতে দেখেন, আর এর ছাপ ওয়েস্টার্ন ওয়ালে রয়ে যায়। প্রতি দিন মধ্য রাতে তিনি জেগে স্যাফেদের রাস্তায় রাস্তায় দৌড়াতেন, চিৎকার করতেন বলতেন, ‘ঈশ্বরের দোহাই জাগো, শেখিনা নির্বাসনে, আমাদের প্রার্থনা গাহ পুড়ে গেছে, ইসরাইল মহা যন্ত্রণায় রয়েছে।’ অন্যরা আরো বিস্তারিত মধ্যরাতের শাস্ত্রাচার পালন করত। মরমি সাধক ‘রাচেলের অনুষ্ঠান’ পালন করার জন্য জাগতেন, পোশাক পরতেন। এতে তিনি কল্পনাপ্রসূতভাবে শেখিনার নির্বাসনে প্রবেশ করতেন। শেখিনার মতো করে কাঁদতেন তিনি, জুতা খুলে মুখে ধুলা মাখতেন। এটি ছিল ঈশ্বরের অনুকরণ। এটি মহাজাগতিক পর্দা উন্মোচনে তার অংশগ্রহণের বিষয়টি প্রকাশ করত। তবে লুরিয়া তার শিষ্যদের কখনো কষ্টে ফেলেননি। তিনি আনন্দ আর উদযাপনের ওপর গুরুত্ব দিতেন। সূর্যোদয়ের সময় তিনি ‘লেহর আচার’ পালন করতেন : তিনি শেখিনার চূড়ান্ত পরিত্রাণ বর্ণনা করতেন, ঈশ্বর-প্রকৃতির কথা ভাবতেন, যতক্ষণ না তার মনে হতো তার দেহটি চ্যারিয়ট-থর্নের আকার ধারণ করেছে। প্রতিরাতে কাব্বালিরা সত্তার উৎসের সাথে উল্লাসপূর্ণ পুনঃএকত্রিত হতো। তিনি ঐশী উপস্থিতির (অবতার জেরুসালেম ও দেহ-মন্দির) মানব উপাসনালয়ে পরিণত হয়েছিলেন।১৭ 

লুরিয়ানিক কাব্বালাহ ছিল পুরনো পৌরাণিকতত্ত্বের আধ্যাত্মিক সংস্করণ। জেরুসালেমে দৈহিক আলিয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। ইহুদিরা ওই নগরীকে মূল্যবান করা সত্যের সাথে তাদের নিজের বাড়িতে ও নিজের সত্তার মধ্যেই মুখোমুখি হতে পারত। ন্যাচমানিডেদের মতো লুরিয়া ইহুদিবাদী ছিলেন না। তার আইডিয়াগুলো ইউরোপে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। তার ঐশী নির্বাসনের দর্শন দুর্ভোগ ও বাস্তুচ্যুত ইহুদিদের কথা বলত। প্রাচীন বিশ্বের ঐশী ভূগোলের মতো এই ধরনের আধ্যাত্মিকতা ছিল অনিবার্যভাবে কল্পনাশক্তিমূলক অনুশীলন। এটি নির্ভর করত তাদের আয়ত্ত্বের বাইরে থাকা সত্যকে প্রতীকের আকারে দেখার সামর্থ্যের ওপর। মানুষের পক্ষে যতটা উপলব্ধি করা সম্ভব ততটা অসম্পূর্ণভাবে প্রতিনিধিত্ব করে তারা অদেখা আধ্যাত্মিকতায় অবগাহন করেছিল, যাতে তারা উপাসনাকারীদের সংস্পর্শে দুই সত্তা পরিণত হতে পারে একক সত্তায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কাব্বালার মিথ আক্ষরিকভাবে উপলব্ধি করা হয়ে থাকলে এগুলো হয় ছিল স্পষ্টভাবে অযৌক্তিক বিষয় কিংবা এমনকি ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে চালিত করতে পারত। শাব্বাতাই জেভির ঘটনায় বিষয়টি ফুটে ওঠে। এই বিঘ্ন সৃষ্টিকারী ইহুদি এমনসব লক্ষণ প্রকাশ করতেন, যেগুলোকে বর্তমান সময়ে আমরা মানসিক-বৈকল্য হিসেবে অভিহিত করতে পারি।১৮ তিনি তার ‘বাতিকগ্রস্ত’ অবস্থায় ঈশ্বরের নামে পুরোপুরি নিষিদ্ধ খাদ্য বিধান লঙ্ঘন করেছেন, ঘোষণা করেছিলেন যে তাওরাতকে বাতিল করা হয়েছে। এসবের পর এসেছিল ঘোর হতাশা। ভ্রাম্যমান জীবনে শাব্বেইতির সাথে সাক্ষাত হয়েছিল গাজার তরুণ কাব্বালপন্থী রাব্বি নাথানের। এই রাব্বি ধ্যানমগ্ন হয়ে তাকে মেসাইয়া ঘোষণা করেন। বিষণ্নতায় ডুবে গেলে শাব্বেতাই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ভুতুরে রাজ্যে প্রবেশ করতেন। তিনি শেখিনাকে ধুলা থেকে তুলে এনে নির্বাসনের অবসান ঘটাতেন। তার ‘বাতিক’ পর্যায় ছিল পরিত্রাণের (যেখানে তাওরাতের আর প্রয়োজন পড়ে না, কোনো কিছুই নিষিদ্ধ থাকবে না) পর মেসাইনিক মেয়াদের পূর্ব লক্ষণ। 

শাব্বেতাই ১৬৬৫ সালের ৩১ মে নিজেকে মেসাইয়া ঘোষণা করে জানালেন যে তিনি জেরুসালেম পর্যন্ত রওনা হচ্ছেন। তিনি তার শিষ্য হিসেবে ১২ জন তরুণ রাব্বিকে বাছাই করেন, ইসরাইলের প্রতিটি গোত্রের প্রতিনিধি হিসেবে একজন মনোনীত হলেন। তার পরিকল্পনা ছিল টেম্পল মাউন্ট গিয়ে সেখানে উৎসর্গ শাস্ত্রাচার আবার শুরু করা : নাথান নিযুক্ত হলেন উচ্চ পুরোহিত। খবরটি জেরুসালেমের ইহুদিদের কাছে পৌঁছাল তাদের মধ্যে আতঙ্ক ও সন্ত্রস্ত্রতা সৃষ্টি করল। তাদের অবস্থান ইতোমধ্যেই নাজুক হয়ে পড়েছিল। ফলে শাব্বেতাই যদি হারামের পবিত্রতা লঙ্ঘন করেন, তবে মুসলিম প্রতিশোধ ভয়ঙ্কর হতে পারে। তারা পরিকল্পনা পরিত্যাগ করার জন্য শাব্বেতাইয়ের কাছে অনুনয় করল। তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন। মুক্তি এত কাছে এসে গেলেও এখন আবারো তা বিলম্বিত হচ্ছে! তিনি সত্যিই জেরুসালেমে গিয়েছিলেন। তিনি সেখানে ঘোষণা করেন, তাওরাত বাতিল হয়ে গেছে, তাকে ইসরাইলের রাজা ঘোষণা করা হয়েছে। রাব্বিরা তাকে কাজির হাতে তুলে দিলেন, তিনি তাকে বিদ্রোহের অভিযোগ থেকে খালাস দিলেন। সন্দেহাতীতভাবে কাজির মনে হয়েছে, লোকটির মাথা ঠিক নেই। কিন্তু শাব্বেতাই মনে করলেন, এটি তার মিশনের প্রমাণ। তিনি সবুজ জোব্বা পরে ঘোড়ার পিঠে চড়ে নগরীর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। এটি ছিল আরেকটি বেয়াদবিপূর্ণ কাজ। কারণ জিম্মিদের ঘোড়ায় চড়ার অনুমতি ছিল না, আর সবুজ ছিল নবীর রঙ। 

শাব্বেতাই জেরুসালেম ত্যাগ করলেন। তবে এই মরমি মেসাইয়ার বাতিকগ্রস্ত উন্মাদনা পুরো উসমানিয়া সাম্রাজ্যে এবং সেইসাথে ইতালি, হল্যান্ড, জার্মানি, পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়ায় ইহুদি সমাজগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে শেষ পরিণতি হলো খুবই খারাপ। ১৬৬৬ সালে শাব্বেতাই ইস্তাম্বুলে পৌঁছে সুলতানকে বললেন ইহুদিদের রাজা ঘোষণা করে জেরুসালেম নগরীতে তাকে প্রতিষ্ঠা করতে। সুলতান এর বদলে ইহুদি বিদ্রোহের শঙ্কা নিয়ে তাকে বিবেচনা করলেন। তাকে ইসলামে ধর্মান্তর কিংবা মৃত্যু-এর কোনো একটি বেছে নিতে বললেন। শাব্বেতাই ধর্মান্তরই গ্রহণ করলেন। তিনি দৃশ্যত নিবেদিতপ্রাণ মুসলিম হিসেবে ১০ বছর পর মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বিস্ময়কর সংখ্যক অনুসারী রেখে গিয়েছিলেন। তবে বেশির ভাগ ইহুদি মুরতাদ মেসাইয়ার কেলেঙ্কারিতে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তারা কেবল শাব্বেতাইয়ের প্রতিই নয়, সেইসাথে তার আবেদনের চালক শক্তি লুরিয়াবাদী আধ্যাত্মিকতার ব্যাপারেও মোহমুক্ত হয়েছিল। অবশ্য লুরিয়াবাদী পুরাণতত্ত্ব ছিল অন্তরাত্মার সাথেই সম্পর্কিত। এর মানে এই নয় যে আক্ষরিক অর্থেই রাজনৈতিক দুনিয়ার বাইরে বাস করতে হবে। লুরিয়া ইহুদিদের শারীরিকভাবে জায়নে ফেরার জন্য কাজ করতে বলেননি। তিনি বরং তাদের জন্য আধ্যাত্মিক পথ বাতলে দিয়েছেন। এটি সত্তার উৎস থেকে সরে যাওয়া ও বাস্তুচ্যুতের কথা বলা হয়েছে। পুরানতত্ত্ব দুনিয়াবি বাস্তবতার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হলে এর কোনো অর্থ হয় না। 

ইউরোপের লোকজন ক্রমবর্ধমান হারে বুঝতে পারছিল যে ঐশী ভূগোলের পুরনো কিংবদন্তির আবেদন তাদের কাছে আর নেই। তারা যে বৈজ্ঞানিক বিপ্লব শুরু করেছিল তা শেষ পর্যন্ত বিশ্বকে বদলে দিয়েছিল। নতুন বাস্তবতার বীজ বপণ করা হলো, যা অদেখার প্রতীক হিসেবে দেখার বদলে ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট উভয় সম্প্রদায়কেই প্রপঞ্চের বস্তুগত গুণগুলোকে পরীক্ষা করতে উৎসাহিত করল। তারা অবশ্যই এ ধরনের অপ্রমাণিত ও অসম্ভাব্য সম্পৃক্ততা নির্দয়ভাবে বর্জন করেছিল এবং তাদের বস্তুরাজি ও আক্ষরিকভাবে কী দিয়ে গঠিত সে দিকে মনোনিবেশন করেছিল। তাদের আবিষ্কারগুলো লোকজনকে বিশ্বের মানচিত্রের দিকে বৈজ্ঞানিকভাবে এগিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধু করে, জেরুসালেমকে পৃথিবীর কেন্দ্র বলাকে মূর্খতা মনে করতে থাকে। ইউরোপিয়ানদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাওয়ায় তারা আগের কল্পকাহিনী, উপাখ্যান, রহস্যময়তার বদলে আরো যৌক্তিক ধর্মের দিকে তাকাতে শুরু করে এবং আরো যৌক্তিকভাবে তুলে ধরতে পারে, এমন বিশ্বাসের তথাকথিত বাস্তবতার দিকে মনোনিবেশন করে। কল্পনার ধর্মের জন্য তাদের হাতে কোনো সময় ছিল না। লোকজন যুক্তির কঠিন পাথরে সেগুলোকে যাচাই করা শুরু করায় ধীরে ধীরে বিশ্বাসের প্রতীক ও ছবিগুলো বিপুল তাৎপর্য বহন করা বন্ধ করে দেয়। এগুলো স্রেফ প্রতীকে পরিণত হয়, এগুলো যে অদেখা বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করছিল, তা থেকে একেবারেই আলাদা হয়ে যায। শাস্ত্রাচার নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়; উপাসনা পদ্ধতি আর তাতে থাকা আধ্যাত্মিক গতিশীলতা থেকে আলাদা থাকে না। প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কারকরা ইতোমধ্যেই ঐশী বাস্তবতা থেকে প্রতীককে সরিয়ে দিয়েছিল। ইউচারিস্টের রুটিকে খ্রিস্টের দেহ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে স্রেফ প্রতীক হিসেবে দেখেছেন জ্বিনগলি। ক্যাথলিকদের ব্যাপক আনুষ্ঠানিক উপাসনা পদ্ধতি ছিল সত্য থেকে অর্থহীন বিহ্বলতা সৃষ্টিকারী। কোনো অনুকরণই বর্তমানে কালোত্তীর্ণ আধ্যাত্মিকতাকে বয়ে আনতে পারছিল না। যিশুর জীবন, মৃত্যু ও পুনরুত্থান ছিল এমনসব ঘটনা যা অতীতে ঘটেছিল, এগুলোর বাস্তবতার কোনো শ্বাশত মাত্রা নেই। 

স্বাভাবিকভাবেই এটি পুরনো ঐশী ভূগোলকে অর্থহীন করে ফেলেছিল। ‘পবিত্র স্থানগুলো’ স্বর্গীয় দুনিয়ার সাথে সংযোগ প্রতিষ্ঠা করতে পারছিল না। ঈশ্বর স্রেফ একটি স্থানে সীমিত থাকতে পারছিলেন না। কারণ তিনি অসীম। ফলে নির্দিষ্ট কোনো স্থান কেবল ‘ঐশী’ হতে পারে যদি এর ধর্মীয় উদ্দেশ্যের জন্য আলাদা করে রাখা হয়। পিউরিটিয়ান জন মিলটন তীর্থযাত্রার প্রতি তার তাচ্ছিল্য প্রকাশ করেছিলেন এভাবে : 

…যা ঘুরে বেড়াতেই থাকে,
যে স্বর্গে বাস করে সে গলগোথায় মারা যায়। ১৯ 

তবে ক্যাথলিকরাও ইউরোপের বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সাথে সমান সংশ্লিষ্ট ছিল। আর তারা ক্রমবর্ধমান হারে বুঝতে পেরেছিল যে তাদের কাছে প্রার্থনা স্থানের ভিন্ন একটি অর্থ রয়েছে। 

ফেলিক্স ফ্যাবরি ইতোমধ্যেই নতুন ইউরোপের উদীয়মান সংশয়বাদ দৃষ্টিগোচরীভূত করেছিলেন। সপ্তদশ শতক নাগাদ ইউরোপিয়ানরা তীর্থযাত্রী হিসেবে নয়, বরং পর্যটক হিসেবে জেরুসালেমে আসতে শুরু করে। ১৬০১ সালে ব্রিটিশ পর্যটক জন স্যান্ডারসন হলি সেপালচার দেখে কান্না করেননি বা মুর্ছা যাননি। তিনি স্রেফ ধীরে সুস্থে চার্চটি ঘুরে দেখেছেন, সংশ্লিষ্টতাহীন কৌতূহলের সাথে ক্যাথলিক বা অর্থোডক্স উত্তাপ নিরক্ষণ করেছেন। আলেপ্পোতে ইংলিশ লেভেন্ট কোম্পানির চ্যাপলিন হেনরি মন্ড্রেল ১৬৯৭ সালে ফিলিস্তিন সফর করেছিলেন। তিনি তার পূর্বপুরুষদের কাঁপিয়ে দেওয়া ‘ফালতু অতীত স্মৃতির আবর্জনার’ প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করেন। তিনি বাইবেলের স্থানগুলো হিসেবে থাকা গ্রিক ও রোমান প্রত্নসামগ্রীগুলোর প্রতি আগ্রহী ছিলেন। হলি ফায়ার অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে তিনি দর্শকদের আধ্যাত্মিক সিদ্ধিলাভের অনুভূতিতে আতঙ্কবোধ করেছিলেন। তার কাছে এসবকে পুরোপুরি ‘পাগলা গারদের পাগলামি’ বলে মনে হয়েছিল।২১ 

তিনি খ্রিস্টের সমাধিতে গ্রিক ও ল্যাতিনদের বিবাদে বিশেষভাবে বিতৃষ্ণ হয়েছিলেন। তারা প্রচণ্ডতম ক্রোধ ও উন্মাদনা প্রকাশ করত যা সংযত যুক্তির সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ১৬৮৮ সালে বেলগ্রেড যুদ্ধে উসমানিয়াদের বিরুদ্ধে অস্ট্রিয়া, পোল্যান্ড ও ভেনিসের জয়ের পর হলি সেপালচারে সম্প্রতি আরেক দফা ব্যবস্থাপনাগত পরিবর্তন হয়েছিল। ফ্র্যান্সিসক্যানেরা আবার দায়িত্ব ফিরে পায়। মন্ট্রিল ব্যাখ্যা করেছেন যে তারা ও তাদের গ্রিক অর্থোডক্স প্রতিদ্বন্দ্বীরা 

অনেক সময় হাতাহাতি, কাটাকাটিতে মেতে ওঠে, এমনকি সেচালচারের একেবারে প্রতিটি দরজাও তাদের করা উৎসর্গ বস্তুর রক্ত মাখামাখি হয়ে যায়। [ফ্রান্সিসক্যান] ফাদার গার্ডিয়ান ক্রোধের কারণ হিসেবে আমাদেরকে তার বাহুতে একটি বড় দাগ দেখালেন। তিনি জানান, এ ধরনের কোনো একটি অপবিত্র যুদ্ধের সময় বলশালী গ্রিক পাদ্রি এই আঘাত দিয়েছিলেন তাকে। ২২ 

এসব ‘পবিত্র স্থান’ মুক্ত করতে নতুন ক্রুসেডের স্বপ্ন দেখা ছিল ভিত্তিহীন। কারণ তাদের সৃষ্ট এ ধরনের অখ্রিস্টান ক্রোধ ও বৈরিতার ঘটনায় তাদরে বন্দিদশা দেখে উপলব্ধি করা যেতে পারে যে ‘এগুলো মুক্ত করা হলে, এগুলো নিয়ে কী মাত্রায় দুঃখজনক প্রতিযোগিতা হবে।’২৩ 

অষ্টাদশ শতক নাগাদ উসমানিয়া সাম্রাজ্য দৃশ্যত অনিবার্য পতনের দিকে যেতে থাকে। সুলতানেরা ছিলেন দুর্বল, তারা ব্যক্তিগত বিলাসে নিয়োজিত ছিলেন। তারা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিক্রি করে প্রমোদের ব্যয় মেটাতে থাকেন। প্রদেশ ও সানজেকগুলোর গভর্নরেরা আর তাদের সক্ষমতার আলোকে নিয়োগ পেতেন না, তারা ক্ষমতায় যেতেন ঘুষ দিয়ে। সুলতানেরা যখন দেখলেন, তারা পাশাদের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন, তখন তাদেরকে প্রায় বার্ষিক ভিত্তিকে পরিবর্তন করতেন। প্রদেশগুলোতে এর পরিণাম হয়েছিল মারাত্মক। পরের বছর যদি কারো বদলি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তবে সে কোনোভাবেই ভবন মেরামত বা স্থানীয় প্রশাসন সংস্কারকাজ করবে না। আর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পাশার সম্পত্তি অনেক সময়ই বাজেয়াপ্ত করা করা হতো বলে গভর্নরেরা প্রায়ই অন্যায়ভাবে করারোপ, শোষণ, ভূমি অবৈধভাবে বাজেয়াপ্তকরণসহ অন্য সব পন্থা ব্যবহার করে তারা যতটুকু সম্ভব তাদের জেলাগুলো থেকে অর্থ সংগ্রহ করতেন। ইস্তাম্বুল কার্যত অনৈতিক কর্মকর্তাদের কাছে সাম্রাজ্য ছেড়ে দিয়েছিল। লোভী পাশাদের হাত থেকে রক্ষা পেতে কৃষকেরা তাদের গ্রাম ত্যাগ করতে লাগল। এতে করে বেদুইন হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ভূমি আরো ক্ষতির মুখে পড়ল। ১৬৬০ সালে ফরাসি পর্যটক এল. ডি অ্যারিয়াক্স উল্লেখ করেন যে বেথলেমেরে আশপাশের এলাকা প্রায় পুরোপুরি জনহীন হয়ে পড়েছে, জেরুসালেমের কৃষকেরা পাশাদের হাত থেকে রক্ষা পেতে পালাচ্ছে। 

জেরুসালেমের লোকজন ১৭০৩ সালে নগরীর গভর্নর জারজি মুহাম্মদ পাশার নির্দয় করারোপের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। মুহাম্মদ ইবনে মোস্তফা আল-হোসাইনি দুর্গে এক আক্রমণে তাদের নেতৃত্ব দেন। তারা সব বন্দিকে মুক্ত করে, পাশাকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। আল-হোসাইনি প্রতিনিধি হিসেবে গভর্নর হন। নগরীর নিয়ন্ত্রণ আবার গ্রহণ করতে উসমানিয়াদের দুই বছর লেগেছিল। পরিণঅমে ১৭০৫ সালের নভেম্বরে এখন দামাস্কাসের প্রাদেশিক গভর্নর (ওয়ালি) জারজি মুহাম্মদ দুই হাজার জাননেসারি নিয়ে জেরুসালেম আক্রমণ করেন। তুর্কিরা সহজে নগরী দখল করতে পারেনি : তাদেরকে কয়েক ঘণ্টা তীব্র ও মরিয়া লড়াই করতে হয়েছিল। 

তুর্কি গভর্নরেরা ক্রমবর্ধমান হারে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ছিলেন। অনীহ লোকজনের কাছ থেকে তারা কর পর্যন্ত আদায় করতে পারতেন না। প্রতি বছর দামাস্কাসের ওয়ালিকে লোকজনকে কর দিতে বাধ্য করার জন্য সৈন্য নিয়ে আসতে হতো। কিন্তু তারপরও সবসময় তারা সফল হতেন না। অষ্টাদশ শতকে কার্যত উসমানিয়া নথিপত্রে নগরীর রাজস্ব সম্পর্কে কোনো উল্লেখ দেখা যায় না। এর কারণ সম্ভবত করের পরিমাণ এতই কম ছিল যে তারা তা উল্লেখ করার দরকার মনে করতেন না।৪ বেদুইনদের ঘুষ না দিয়ে পাশারা তাদের নিজস্ব সানজাকে অবাধে চলাচল করতে পারতেন না। এর ফলে ইস্তাম্বুলের কাছে গভর্নর হিসেবে স্থানীয় আরবদের নিয়োগ করা সুবিধাজনক মনে হতে থাকে। নাবলুসের তুরকান ও নিমর পরিবার জেরুসালেমের কয়েকজন গভর্নর সৃষ্টি করতে থাকে। উমর আর-নিমর (১৭১৭-৩১) ছিলেন বিশেষভাবে কার্যকর। ১৭৩৩ সালে তাকে দ্বিতীয় মেয়াদেও নিয়োগ করা হয়। তিনি জেরুসালেমের অভিজাতদের সাথে সহযোগিতা করেন, হজ রুটকে বেদুইন থেকে মুক্ত রাখেন, এমনকি যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে খ্রিস্টানদের বিবাদ থেকে দূরে রাখতে সক্ষম হন। তবে বেশির ভাগ গভর্নরই ছিলেন অথর্ব। তারা এমনকি প্রাচীরের ভেতরেও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে চরমভাবে ব্যর্থ হন। জেরুসালেমবাসী তাদের মর্জিমতো না হলে অনেক সময় গভর্নরকে নগরীতে প্রবেশ করতে দিত না। 

গভর্নরদের দুর্বলতার সুযোগে জেরুসালেমের প্রধান প্রধান পরিবার ক্ষমতার শূন্যতা পূরণ করতে এগিয়ে আসে। হোসাইনি, খালিদি, আবুল লুতফরা ক্রমবর্ধমান হারে নগর প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করতে থাকে। তারা ছিল স্থানীয় জনসাধারণ ও ক্ষমতাসীন অংশের একমাত্র যোগসূত্র। তারা ১৭০৩ সালের বিপ্লবের পর থেকে দামাস্কারস ও ইস্তাম্বুলের প্রভাবশালী লোকদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে থাকে। পুরস্কার হিসেবে তাদেরকে বিশাল বিশাল ভূসম্পত্তি ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়। অষ্টাদশ শতকে আবুল লুতফ পরিবার অব্যাহতভাবে মুফতি সরবরাহ করতে থাকে, হোসাইনিরা শরিয়াহ আদালতে সভাপতিত্ব করে। কয়েক প্রজন্ম ধরে খালিদিরা ডেপুটি জাজ ও শরিয়াহ আদালতের প্রধান কেরানির দায়িত্ব পালন করে। ইসলামি আইনশাস্ত্রের প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব মুসা আল খালিদি (১৭৬৭- ১৮৩২) ছিলেন ইস্তাম্বুলে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন। তিনি আনাতোলিয়ার প্রধান কাজি হয়েছিলেন। এটি ছিল সাম্রাজের তিনটি সর্বোচ্চ বিচারিক পদের অন্যতম। 

জেরুসালেম তখনো সিরিয়া ও মিসরের সুফি ও আলেমদের আকৃষ্ট করত। সত্যিকার অর্থেই সপ্তদশ শতকের চেয়ে এই সময় নগরীটিতে অনেক বেশি আলেম ছিলেন। অনেক আলেম নগরীতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিলেন। তবে মাদরাসাগুলো দ্রুত ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছিল। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝিতে মাত্র ৩৫টি মাদরাসা টিকে থাকে। পরে তাদের কোনোটিই টিকে থাকেনি। অর্থনৈতিক দুর্দশা গভীর হওয়ায়, নগরী ও লোকজন গরিব হতে থাকায় ওয়াকফ সম্পত্তিও বিলুপ্ত হতে থাকে। অনেক সম্পত্তি ভেঙে যায়, হাতছাড়া হয়ে যায। মুসলিমরা ওয়াকফ সম্পত্তি লিজ নিয়ে, এমনকি সেগুলো অমুসলিমদের কাছে বিক্রি করে হলেও ক্ষতি পূরণ করার চেষ্টা করেছিল। 

জিম্মিরাও মুসলিমদের মতো খুবই খারাপ অবস্থায় পড়ে গিয়েছিল। অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে ইউরোপ থেকে আসা আশকেনাজিক ইহুদিরা সংখ্যায় এত বেশি হয়ে গিয়েছিল যে তারা পাশাকে ঘুষ দিয়ে একটি সিনাগগ, একটি ইয়েশিভা ও জেরুসালেমের দক্ষিণে গরিবদের জন্য ৪০টি আবাসিক ভবন নির্মাণের অনুমতি সংগ্রহ করে নেয়। কিন্তু এর পরপরই তারা ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে, মাত্রাতিরিক্ত সুদ দিতে বাধ্য হয়। আশকেনাজিক ইহুদিরা জেরুসালেমে নানা জটিলতায় পড়ছিল। কারণ তারা আরবি ভাষা জানত না, এই ব্যবস্থার সাথে পরিচিত হতে শেখেনি। ফলে তারা বাড়ি থেকেই বের হতে ভয় পেত, কারণ তারা আশঙ্কায় থাকত, বাড়ি থেকে বের হলেই ঋণদাতারা তাদেরকে ধরে কারাগারে নিক্ষেপ করবে। ১৭২০ সালে তারা বকেয়া পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে তুর্কিরা তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। তারা শেষ পর্যন্ত নগরী ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। দুই শ পরিবার হেবরন, স্যাফেদ ও দামাস্কাসের উদ্দেশে রওনা হয়ে যায়। এসব নগরীতে তাদের অবস্থা কিছুটা ভালো ছিল। ২৫ জেরুসালেমে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে আশকেনবাদীদের আরেকটি শতাব্দী অপেক্ষা করতে হয়েছিল। জেরুসালেমের ইহুদি তাইফা এখন পুরোপুরি সেফারদিক। তারা শারাফ এলাকায় থাকত। শতাব্দীর যন্ত্রণা ও উসমানিয়া সঙ্কট গভীরতর হতে থাকায় এলাকাটির অবস্থা অবনতি ঘটতে থাকে। সেফারবাদীরা চারটি পরস্পরযুক্ত সিনাগগে প্রার্থনা করত। এগুলো রাব্বি ইয়োহানান বেন জাক্কাইয়ের ইয়েশিভা এলাকায় তৈরি হয়েছিল : বেন জাক্কাই সিনাগগের পাশে আরো তিনটি ছোট সিনাগগ ছিল। এগুলো হচ্ছে প্রফেট ইলিজা, কেহাল জায়ন ও ইস্তাম্বুলি। অষ্টাদশ শতক নাগাদ এগুলোর অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছিল। পুরো ইহুদি মহল্লা ছিল অবহেলিত বাড়িঘরে ভরা। এর রাস্তাগুলো পচা জঞ্জালে পরিপূর্ণ। সিনাগগগুলো ছিল পড়ো পড়ো। ভবনগুলো ভেঙ্গে পড়ছিল, বৃষ্টির সময় ছাদ দিয়ে পানি পড়ত, সিনাগগগুলো বন্যায় ভেসে যাওয়ার আগে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হতো। জমায়েতের লোকজনকে কান্নায় স্থান ত্যাগ করাটা বিরল ছিল না। 

ল্যাতিন খ্রিস্টানেরা ছিল অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায়। কারণ বিদেশের ধনী সম্প্রদায়গুলো তাদের সতায়তা করত। ১৭২০ সালে, যে বছর আশকেনাজিরা তাদের সম্পত্তি খুইয়েছিল, ফ্রান্সিসক্যানেরা হলি সেপালচার চার্চের মোজাইকগুলো আবার সাজাতে সক্ষম হয়, সেখানে তাদের ভূগর্ভস্থ কনভেন্ট সম্প্রসারণ করে। তবে গ্রিকদের বিপরীতে কপ্ট ও আর্মেনিয়ানরা, চার্চে তাদেরও অ্যাপার্টমেন্ট ছিল, কার্যত বন্দি হয়ে পড়েছিল। তুর্কি কর্তৃপক্ষ চাবি হাতে রাখত, দখল অধিকার হারানোর ভয়ে খ্রিস্টানেরা ভবনটি ত্যাগ করতে সাহস করত না। সামনের দরজায় থাকা বড় একটি ছিদ্র দিয়ে তাদেরকে খাবার সরবরাহ করা হতো। প্রতিটি গ্রুপ চার্চের বিভিন্ন অংশ নিয়ন্ত্রণ করত। ১৭২০ সালেও ফ্রান্সিসক্যানেরা সবচেয়ে পছন্দের স্থানটি দখলে রেখেছিল। ফ্রান্স ১৭৩২ সালে সুলতানের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়, তাদেরকে স্থায়ীভাবে নতুন ক্যাপিচুলেশন প্রদান করা হয়। ফরাসিরা এখন উসমানিয়া সাম্রাজ্যে রোমান ক্যাথলিকদের সরকারি ‘রক্ষাকর্তা হিসেবে স্বীকৃতি পেল, হলি সেপালচারে ফ্রান্সিসক্যানদের অভিভাবত্ব আবার নিশ্চিত করা হলো। ১৭৫৭ সালে ফ্রান্সিসক্যানদেরকে কিদরন ভ্যালিতে ভার্জিন টম্বও দেওয়া হলো। 

গ্রিক অর্থোডক্স আরো বেশি ক্রোধে এসব ঘটনার ওপর নজর রাখছিল। অবশেষে এসব কিছু তাদের সহ্যের সীমার বাইরে চলে গেল। ১৭৫৭ সালে পাম সানডের আগে এক দিন তারা বলপূর্বক রোতান্দায় প্রবেশ করে ল্যাতিন আসবাবপত্র ও বাতি ভাংচুর করে। রক্তপাত ঘটে, বেশ কয়েকজন মারাত্মক আহত হয়। ফ্রান্সিসক্যানেরা সেন্ট স্যাভিয়র্সে আশ্রয় নিলে অর্থোডক্স চার্চের গ্রিক ও আরব সদস্যরা সেটিও অবরোধ করে। প্যাট্রিয়ার্ক দ্রুত ইস্তাম্বুলে রাজদরবারে ছুটে যান। এদিকে ফরাসিরা ইউরোপে সেভেন ইয়ার্স যুদ্ধে অত্যাধিক ব্যস্ত থাকায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে তুরস্ককে সহায়তা করতে পারছিল না। এতে গ্রিকদের অনুকূলে ফরমান ইস্যু করার ব্যাপারে নিজেকে বাধ্যবাধকতামুক্ত বলে মনে করলেন সুলতান। এই অতি গুরুত্বপূর্ণ নথিটি বর্তমান সময়েও বলবৎ রয়েছে। গ্রিকরা এখনো হলি সেপালচারের প্রধান অভিভাবক। ১৭৭৪ সালে উসমানিয়া সাম্রাজ্যে অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের আনুষ্ঠানিক অভিভাবক হিসেবে রাশিয়ার নাম ঘোষিত হওয়ার পর তাদের হাত আরো শক্তিশালী হয়। 

অষ্টাদশ শতকের শেষ নাগাদ জেরুসালেম নিঃস্ব নগরী হয়ে পড়েছিল। ফরাসি পর্যটক কনস্টানটিন ভলনি ১৭৮৪ সালে ফিলিস্তিন সফরে গিয়ে যা দেখেছেন, তা নিজের চোখেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। নাবলুসে ত্যাগের দু’দিন পর তিনি এমন এক শহরে পৌঁছেন, যেখানে দেখা গেল মানবীয় দুরাবস্থার অবাক করা উদাহরণ : আমরা এর দেয়ালগুলো ধরলে সেগুলো পড়ে গেল, এর খাদগুলো ভরে গেছে, এর ভবনগুলো লজ্জাজনকভাবে ধসে পড়েছে, আমরা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে আমরা একটি বিখ্যাত নগরীতে আছি, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যগুলোতে সে রুখে দিয়েছে, জেরুসালেমকে চিনতে আমাদের কষ্ট হচ্ছিল। ২৬ 

ভলনে ছিলেন ইউরোপের নতুন লোকজনদের একজন। তিনি তীর্থযাত্রায় আসেননি, এসেছিলেন জেরুসালেমে প্রথম বৈজ্ঞানিক জরিপ পরিচালনা করার জন্য, প্রস্তুত করা একটি প্রশ্নপত্র পূরণ করার জন্য। তার উদ্দেশ্য ছিল নগরীর ভূগোল, জলবায়ু, সমাজ জীবন, অর্থনীতি নিয়ে সমীক্ষা চালানো। এর পবিত্রতার প্রতি তার ওইটুকুই আগ্রহ ছিল, যতটুকু ছিল অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত। ভলনে উল্লেখ করেন, খ্রিস্টানদের মূর্খতা থেকে তুর্কিরা বিপুলভাবে মুনাফা লুটে নিচ্ছে। গ্রিক, কপ্ট, আবিসিনিয়ান, আর্মেনিয়ান ও ফ্রাঙ্করা নিজেদের জন্য কিছু সুবিধা আদায় কিংবা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে তা কেড়ে নিতে’ ঘুষ হিসেবে গভর্নরের হাতে নিয়মিতভাবে ব্যবহৃত হতো। 

প্রতিটি গ্রুপ অনিয়মের ব্যাপারে একে অন্যের বিরুদ্ধে স্থায়ীভাবে অভিযোগ করে যেত। কেউ কি গোপনে চার্চ মেরামতের কাজ করেছে; কিংবা স্বাভাবিক সীমার বাইরে কোনো দখলা করা হয়েছে কিনা; কোনো তীর্থযাত্রী প্রথা লঙ্ঘন করে কি ভিন্ন দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছে? এসব ছিল গভর্নরের কাছে অভিযোগে বিষয়। আর গভর্নর জরিমানা ও উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে লাভবান হওয়ার সুযোগ কখনো হাতছাড়া করতেন না।২৭ 

.

দখল অধিকারের জন্য নিরর্থক সংগ্রাম এখন জেরুসালেমের খ্রিস্টানেরা ব্যস্ত থাকায় পবিত্র নগরীতে তাদের অবস্থান ও মর্যাদা সত্যিকার অর্থেই ক্ষয়ে যাচ্ছিল। 

ভলনে উল্লেখ করেছেন, ইউরোপ থেকে খুব কম তীর্থযাত্রীই আসে জেরুসালেমে। এ তথ্যটি নগরীর অন্যান্য সম্প্রদায়কে কেলেঙ্কারিতে ফেলে দিয়েছিল। অনেক পর্যটক জেরুসালেমের ভয়াবহ বর্ণনা শুনে সেখানে যেতে ভয় পেয়ে থাকবেন। সত্যিই কঠিন সময়ে পড়েছিল নগরীটি। তবে তিনি যেভাবে বলেছেন, ছবিটি তত বিবর্ণ ছিল না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রাচীরগুলো তার দাবি অনুযায়ী মাটিতে মিশে যায়নি। অবশ্য এর চারপাশের অবস্থা সম্পর্কে তিনি যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা ঠিকই ছিল। নগরীর ভেতর ও আশপাশে এলোমেলোভাবে জঞ্জাল ছড়িয়ে ছিল। পাথর, মাটি, ছাই, মৃৎপাত্রের টুকরা, পচা কাঠ নগরীর নিচে গভীর উপত্যকাগুলো পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল, অনেক সময় এগুলো ৪০ ফুট স্তুপ হয়ে ছিল। বস্তুত, নগরীর বেশির ভাগ অংশই নির্মিত হয়েছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জমে থাকা জঞ্জালের উপর। প্রাচীরবদ্ধ নগরীর উত্তরে সাবান কারখানাগুলোর কৃত্রিম আবর্জনা জমে ছিল। ২৮ জেরুসালেম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য পরিচিত ছিল। কোনো পয়োঃনিষ্কাষণব্যবস্থা ছিল না, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ছিল বাজে, দারিদ্রতার ছাপ ছিল প্রকট। তবে এটিই একমাত্র কাহিনী ছিল না। ৯টি সাবান কারখানা পুরো দমে উৎপাদনে ছিল; সিরামিকও গুরুত্বপূর্ণ শিল্পে পরিণত হয়েছিল, বাজারগুলোতে মজুতও ছিল বিপুল। ইভলিয়ে চেলেবি নগরী ও আশপাশের এলাকায় আঙুর বাগান ও উদ্যান দেখে হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। এগুলো তখনো ছিল জেরুসালেমের বৈশিষ্ট্য, বিশেষ করে নগরীর জনবিরল উত্তর-পূর্বের বেজেথা এলাকায়। শেখ মুহাম্মদ আল-খালিলির ওয়াকফিয়া দেখাচ্ছে যে প্রাচীরগুলোর ভেতরে ও বাইরে অনেক ডুমুর, জলপাই, আপেল, ডালিম, মালবেরি, এপ্রিকট ও কাঠবাদামের উদ্যান ও খামার ছিল। শহরের আকার হ্রাস পাচ্ছিল। তবে জেরুসালেমের প্রধান পরিবারগুলোর সুন্দর ভিলা ও ম্যানসনও ছিল। শেখ নিজে নগর-প্রাচীরের বাইরে দুটি বিশাল বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন। তিনি বাড়িগুলো যথাযথভাবে মেরামত করা ও অমুসলিমদের হাতে না পড়ার ব্যাপারে জোর দিতেন। এসব বাড়ির দিকে অমুসলিমরা লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত।২৯ অপেক্ষাকৃত সচেতন অধিবাসীরা নতুন ফরাসি ও রুশ ‘অভিভাবকত্ব’ নিয়ে অস্বস্তিতে ছিল। বিশেষ করে ফ্রান্স আবারো জেরুসালেমে কনসাল প্রতিষ্ঠার চেষ্টাকে তারা সুনজরে দেখেনি। স্থানীয় মুসলিমরা চেয়েছিল, তাকে সরিয়ে দিতে। তবে কনস্টানটিন ভলনি ও তার বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা আরো প্রবল পাশ্চাত্য উপস্থিতির পূর্বাভাস দিচ্ছিল। নেপোলিয়ন ১৭৯৮ সালে বেশ কয়েকজন প্রাচ্যবিদ নিয়ে মিসর যাত্রা করেন। তারা উপনিবেশ স্থাপনের প্রস্তুতি হিসেবে অঞ্চলটি নিয়ে বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা চালানোর দায়িত্ব পেয়েছিল। নেপোলিয়নের লক্ষ্য ছিল ভারতবর্ষে ব্রিটিশ দখলদারিত্ব চ্যালেঞ্জ করতে প্রাচ্যে ফরাসি উপস্থিতি প্রতিষ্ঠা করা। তিনি তার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ আরো এগিয়ে নিতে নতুন ‘প্রাচ্য’ বিজ্ঞান ব্যবহারের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। ১৭৯৯ সালের জানুয়ারিতে নেপোলিয়ন ১৩ হাজার সৈন্য পাঠান ফিলিস্তিনে। তারা আর আরিশ ও গাজায় উসমানিয়া সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে। তারপর তারা ফিলিস্তিনের প্রধান নগরী অ্যাকর উপকূলের দিকে অগ্রসর হয়। তিনি তার সেনাবাহিনীর সাথে মানচিত্র প্রস্তুতকারী ও অনুসন্ধানী নিয়ে এসেছিলেন। সৈন্যরা যখন উপকূলীয় সড়কগুলোতে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন তারা পাহাড়ি এলাকায় তথ্যানুসন্ধান মিশনে নেমে পড়ে। রামলেতে নেপোলিয়ন ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিমদেরকে উসমানিয়া জোয়াল ঝেড়ে ফেলে বিপ্লবী ফরাসি মুক্তির বাণী গ্রহণের আহ্বান জানান। কিন্তু স্থানীয় লোকজন এই স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতিতে অভিভূত হয়নি। তাদের কাছে এই প্রতিশ্রুতি এক পাশ্চাত্য শক্তির কাছে অধীনতা কবুল করা বলে মনে হয়েছে। জেরুসালেমে আতঙ্ক আর ক্রোধ ছিল। মুসলিমরা সেন্ট স্যাভিয়র্সে হামলা করে, ফরাসিদের অনুসারী ফ্রান্সিক্যানদের কয়েকজনকে পণবন্দি হিসেবে সাথে নিয়ে যায়। তবে সুলতান জোর দিয়ে বলেন, তারা যতক্ষণ পর্যন্ত জিজিয়া দেবে, ততক্ষণ তাদের চার্চ আর সম্পত্তি রক্ষা করতে হবে। জেরুসালেম-বংশোদ্ভূত আনাতোলিয়ার কাজি শেখ মুসা আল-খালিদি ফরাসিদের বিরুদ্ধে দেশকে রক্ষার জন্য ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। আর জেরুসালেমের সব সক্ষম আরব দামাস্কাসের ওয়ালির নেতৃত্বে যুদ্ধ করার জন্য উসমানিয়া সেনাবাহিনীতে নাম লেখায়। নেপোলিয়নের সেনাবাহিনী প্লেগের শিকার হয়। তবে তিনি অ্যাকর ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। তবে সেখান থেকে কেবল ব্রিটিশ নৌবহরের মাধ্যমেই বিতাড়িত হননি, সেইসাথে সিডনের ওয়ালি আহমদ জেজার পাশার সেনাবাহিনীও এতে অংশ নিয়েছিল। এই বাহিনী দৃষ্টান্তমূলক সাহসিকতা ও কার্যকারিতা প্রদর্শন করেছিল। একটি প্রাচ্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার নেপোলিয়নের চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল। তিনি ইউরোপে ফিরে যেতে বাধ্য হলেন। তবে তার অভিযান ফিলিস্তিনে পাশ্চাত্য আধুনিকতা ও বিজ্ঞানের প্রবর্তন ঘটায়। এখান থেকেই বিজয় ও সাম্রাজ্যবাদের ইউরোপিয়ান স্বপ্নের সূচনা হয়। অন্য উপনিবেশবাদীরা অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের অনুসরণ করেছিল, জেরুসালেমকে টেনে আধুনিক যুগে নিয়ে গিয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *