১৫. উপসংহার
হে সাংসদগণ! ভারতমাতার ভাস্কর,
আমাদের আলোকের দিকে নিয়ে চলো,
মাদের জীবনকে সম্পদশালী করো।
তোমাদের সৎ পরিশ্রম আমাদের আলোকদিশা,
যদি তুমি কঠিন পরিশ্রম করো, আমরা সবাই সমৃদ্ধ হতে পারি।
২০০৭ সালে যখন আমি রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার থেকে অব্যাহতি পেলাম, সংসদের উদ্দেশে আমি একটি ভাষণ দিয়েছিলাম। আগের পৃষ্ঠাগুলিতে আমি যা বলেছি, আমি অনুভব করি আমার ভাষণ সে-বিষয়ে ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক এবং মনে রাখার মতো আরও কিছু সূত্রও দেয়। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিকতার অভিজ্ঞতা বিশ্বস্ততার একটি অনবদ্য ক্রিয়া। যখন ১৯৫১ সালে সার্বভৌমিক ভোটাধিকার অধিগ্রহণ করা হয় তখন সারা বিশ্ব জুড়ে এমন একটিও নজির ছিল না যেখানে লক্ষ-কোটি অশিক্ষিত দরিদ্র মানুষ এক শান্ত এবং সমান গতিতে অগ্রসরমান সামাজিক আন্দোলন উদ্ভাবনার আশা নিয়ে রাতারাতি ভোটদানের অধিকারপ্রাপ্ত হয়েছেন। সমস্ত নাগরিককে আশ্বস্ত করা হয় তাঁদের যে অধিকারের অঙ্গীকার করা হয়েছে তা সমস্তই সংবিধানস্বীকৃত। এক মহত্তর জাতীয় ঐক্যের পরিবেশ আনা এবং শতাব্দীর পর শতাব্দীর বৈদেশিক শাসনে অধীনে থাকবার ইতিহাসের যে-কোনও সময় অপেক্ষা অনেক বেশি জাতীয় সুরক্ষা, সুস্থিত ও সমৃদ্ধির প্রশ্নে আশ্বাস প্রদান করে।
রাষ্ট্র হিসেবে বিশেষত সাম্প্রতিককালে, ঐতিহাসিক অতীতের তুলনায় অর্থনৈতিক কার্যকলাপে আমরা তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য লাভ করেছি। যদিও আমাদের সাফল্যের সিংহভাগ প্রকৃতিনির্ভর কারণ মানবোন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের ক্রিয়াকর্ম যতটুকু সম্ভব হয়েছে তাতে আরও দীর্ঘ পথ চলতে হবে। আমাদের দেশের মানুষের জন্য সংগ্রামে ব্রতপালনের উদ্দীপনার জাতীয় মানসিকতা পুনরুদ্ধারের জন্য একটা নতুন দর্শন এবং সত্যদ্রষ্টা নেতৃবৃন্দের প্রয়োজন কারণ এভাবেই আমরা বিশ্বের জন্যও যুদ্ধ করে যাচ্ছি।
সংসদ নিঃসন্দেহে ভারতবর্ষের প্রধান প্রতিষ্ঠান, প্রতিনিধিসুলভ গণতন্ত্রের প্রতিরূপ। শাসনকার্যের পদ্ধতি হিসেবে সংসদীয় গণতন্ত্র ও এক জাতীয় রাজনীতিক ব্যবস্থা, স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলিকে বজায় রেখে এবং গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের সুযোগ বর্ধন করে ভারতীয় সমাজের ঐতিহাসিক ক্ষমতা-কাঠামোকে শিথিল করে মহৎ উদ্দেশ্য প্রদর্শন করেছে। একুশ শতকের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সংসদ একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে যে কঠিনতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে তা ১৯৫১ সালের প্রতিষ্ঠাকালের পরে কখনও হয়েছে কি না তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। বিশেষত যেখানে বিষয়গুলি মানব উন্নয়ন এবং শাসনব্যবস্থা সম্পর্কিত।
কিন্তু আমাদের স্পষ্টভাবে দেখতে হবে যে, ‘সংসদ নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান’ এই মনোভাবের পরিবর্তে শাসনব্যবস্থার প্রতিষ্ঠানগত যন্ত্র হিসেবে সংসদের কার্যকারিতা এবং আইন উদ্ভাবন ও বিবেচনার ক্ষমতা এবং রাষ্ট্র ও সরকারকে দূরদর্শী নেতৃত্ব প্রদান করার ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক বিভিন্ন দলের সক্রিয়তা, সক্ষমতা ও হিসেবনিকেশের ওপর নির্ভরশীলতা ভীষণভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাষ্ট্র যে-যে চ্যালেঞ্জ, তার মধ্যে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সংসদও যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে আপনার সঙ্গে তা ভাগ করে নেওয়া কেন এত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করি এটাই তার মূল কারণ। ভারতবর্ষকে ২০২০ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এগোনোর নানা পথের পরামর্শ দিই।
সাধারণভাবে অনুভব এবং মূল্যায়ন করা হয় যে, ভারতের শাসনব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ এবং বহিঃস্থ পরিবেশ দ্রুত এবং আপাত অপরিবর্তনীয় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে, বিশেষত গত দুই দশকে। জাতীয় সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধি যা পরিবেশগত পরিবর্তনের দ্বারা উপস্থাপিত হয় তার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জের সুসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং দ্রুত মোকাবিলা করা প্রয়োজন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আয়তন ও জটিলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সামাজিক সংগঠনগুলোর অবনমন ঘটে এবং সংকটপ্রবণ হয়ে ওঠে। সামাজিক সত্তা হিসেবে, ভারতবর্ষের শাসনব্যবস্থা মনে হয় সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে এবং এই সময়েই আত্ম-নবীকরণ এবং পরিবর্তনের তূর্যনিনাদ বেজে উঠেছে।
ভারতবর্ষের সৌভাগ্য যে, সে সরকারে এবং সংসদে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন, যোগ্যতাসম্পন্ন ও দূরদর্শী নেতাসমূহকে পেয়েছে। এই দেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নানাবিধ সাফল্যের জন্য যথেষ্ট গর্বিত হতে পারে। অনেকে অনুমান করেন ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতবর্ষ বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠবে। কিন্তু গণতন্ত্র বা অর্থনৈতিক পুনরুত্থান কোনওটাই স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেওয়া উচিত নয়। অবিচল সতর্কতা হল স্বাধীনতার মূল্য। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং ব্যাবহারিক উপযোগিতা উপরিতলে যতই সন্তোষজনক মনে হোক-না কেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা এক জায়গায় স্থাণু হয়ে থাকতে পারে না এবং হওয়া উচিতও নয়। আমরা অতীতের সাফল্যে আত্মসন্তুষ্ট হয়ে থেমে থাকতে পারি না এবং যেভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রকে চালনা করি সেই পথের পরিবর্তনের জন্য যে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি তাকে উপেক্ষা করতে পারি না। স্বাধীনতা লাভের পরে যে আর্থিক উন্নতি এবং ইতিবাচক বিকাশের ধারা বয়ে চলেছে তা প্রধানত সরকারি এবং জাতীয় সংস্থাগুলির বাইরে সংঘটিত হচ্ছে এবং আমাদের সামনে মহত্তম চ্যালেঞ্জ হল ওই প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনঃসঞ্জীবিত করা ও পুনর্জীবিত করা।
সরকারি এবং সরকার অধীনস্থ ক্ষেত্রে শুধু উৎপাদন, লাভ এবং জনসঞ্চয়ের পরিপ্রেক্ষিতে নয়— শিল্প, স্বাস্থ্য, জল এবং পরিবহণের মতো অপরিহার্য জনসেবা ক্ষেত্রের সংস্থানের ভিত্তিতে আমরা চাই উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন। বহু প্রখ্যাত পণ্ডিত সংসদের ক্রিয়াকলাপ পর্যালোচনা করেন এবং ভারতীয় সংসদ যে ব্যাপক বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় তা চিহ্নিত করেন। আমি মনোনিবেশ সহকারে তা পর্যালোচনা করে তাঁদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ এবং উদ্বেগ সম্বন্ধে কিছু বলব।
রাষ্ট্রে এক সর্বব্যাপী অনুভব বর্তমান যে জবাবদিহির দায়বদ্ধতা এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সংসদের কার্যকারিতায় উন্নয়নের উপযুক্ত সময় এসে গেছে। সংসদ সরকারি কার্যক্রমের জবাবদিহির দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে অনেকরকম হাতিয়ার ব্যবহার করতে পারে। যেমন সংসদ কক্ষে প্রস্তাব আনা, তত্ত্বাবধান ক্ষমতা এবং কমিটি গঠন প্রক্রিয়া। কিন্তু এই হাতিয়ারেরও বর্ধিত হারে পুনরুজ্জীবন প্রয়োজন। ভারতীয় অর্থনীতির বিশ্বায়নের ফলে আমাদের অর্থনীতি শক্তিশালী হয়েছে একথা সত্য। রাষ্ট্র সমৃদ্ধতর, কিন্তু সংসদের ক্ষমতাকে দু’ভাবে বাড়ানোর জন্য ব্যাপক সতর্কতা প্রয়োজন। বেশিরভাগ অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগ্রহণ আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ‘বিশ্বের সামান্য কিছুসংখ্যক সংসদের মধ্যে ভারতীয় সংসদ হল অন্যতম যার কোনও কার্যকরী চুক্তির তত্ত্বাবধান ব্যবস্থা নেই।’ সংসদে আসার আগেই চুক্তিগুলি সাধারণভাবে স্বীকৃতি পেয়ে যায়। তাই বিদেশি রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে এই চুক্তি এবং সমঝোতাপত্র দেখাশোনা ও আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষমতা সংসদের পক্ষে খুব জরুরি।
অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো ভারতীয় রাষ্ট্রেও নিয়ন্ত্রক কাঠামো পুনর্গঠন করা হচ্ছে অনির্বাচিত সংগঠনগুলিতে আরও ক্ষমতা অভিযোজন করে। এই ক্ষমতা অভিযোজন কার্যকরীভাবে বহু বছর ধরে কার্যে পরিণত হয়ে স্বচ্ছতা এবং দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি করেছে, বিশেষত উদারীকরণের পর। অতএব সংসদীয় দায়বদ্ধতার সঙ্গে গতিময়তা বজায় রাখতে গেলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সংসদীয় তত্ত্বাবধান শক্তিশালী করতে হবে। সাংসদদের আরও কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে বৃদ্ধি করতে হবে ক্রিয়ার প্রয়োজনীয়তার জন্য আইন প্রণয়ন এবং দুর্বল আর্থিক তত্ত্বাবধানের ফলে বিকল্প অধ্যাদেশের সংখ্যা হ্রাস করে।
দৈনন্দিন আর্থিক বিষয়ে কার্যনির্বাহীতে সংসদীয় তত্ত্বাবধান এমন এক ক্ষেত্র যেখানে অধিকতর গুরুত্ব এবং চূড়ান্ত ফোকাসের দরুন সংসদীয় কার্যকলাপের মূল্য ব্যাপক হারে বৃদ্ধি করবে এবং প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা প্রদান করবে বিশেষত বর্ধনশীল সংখ্যক তরুণ এবং প্রথমবারের নতুন সদস্যদের কাছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রাণপ্রাচুর্যের ফলে সক্রিয় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা দ্রুতহারে বৃদ্ধি পেয়েছে— প্রথম লোকসভার পাঁচটি রাজনৈতিক দল থেকে ১৪তম লোকসভার প্রায় ৫০টি দলে পৌঁছনোর মাধ্যমে। সংসদে রাজনৈতিক দলগুলির সংখ্যাধিক্যর সুবিধা গ্রহণ করা উচিত; এবং সংসদে রাজনৈতিক দলগুলির ক্রিয়াকলাপ এমনভাবে সহজসাধ্য করা উচিত যার ফলে সংসদ এবং দল উভয়েরই শক্তিবৃদ্ধি করে এবং মিলিতভাবে কাজ করার প্রতিবন্ধকতা দূর হয়। একদিকে সাংসদদের ওপর জটিল চাহিদার দায়িত্ব অন্যদিকে সেই আইন অবধাবনে তাঁদের ধারণক্ষমতা ও প্রবণতার মধ্যেকার ক্রমবর্ধমান পার্থক্য এই মানদণ্ডগুলি দ্বারা শীঘ্র হ্রাসপ্রাপ্ত হবে।
সংসদে ভাল কাজের জন্য সাংসদদের স্বতন্ত্রভাবে সচেতনভাবে স্বীকৃতি পাওয়া উচিত এবং তাঁদের নিজের নির্বাচনক্ষেত্রে, রাজনৈতিক দল এবং জোটের পক্ষ থেকে রাজনৈতিকভাবে পুরস্কৃত করা প্রয়োজন। এর দ্বারা ভাল সংসদীয় কার্যকলাপের উদ্দীপনা বৃদ্ধি পাবে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে যেরকম হয়েছিল সেইরকম সংসদকে আবার আর-একবার কার্যকরী কণ্ঠস্বর হতে হবে সরকারি রাজস্ব সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনে, অর্থনীতিতে, সামাজিক নীতিতে এবং ভারতবর্ষের বিশ্ব অর্থনীতি একীকরণের পরিপ্রেক্ষিতে। সংসদের কণ্ঠস্বর জোরালো করার বন্দোবস্তের পথে কোনও অনিয়ন্ত্রণযোগ্য, বহিরাগত উপকরণ বাধা সৃষ্টি করছে না। ইতিবাচক উৎসাহপ্রদান, দূরদর্শী নেতৃত্ব অবশ্যই সাংসদদের দায়বদ্ধতা ও দক্ষ শাসনব্যবস্থার জন্য নতুন এবং চ্যালেঞ্জপূর্ণ দায়িত্বভার গ্রহণে উৎসাহিত করবে।
কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কয়েক বছর ধরে সংসদের কার্যকলাপ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। তার মধ্যে কিছু কিছু প্রয়োগের জন্য গভীরভাবে বিবেচনা করা প্রয়োজন।
১. রাজনৈতিক ক্ষেত্রে
ক. যেমনভাবে বিশেষ কোনও দলের এক বা একাধিক সদস্যর দলত্যাগ রোধ করতে যে বিধিনিয়ম বর্তমান আছে, তেমনিভাবে কোনও ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দলের জোট সরকারকে অস্থায়ীকরণের ভীতি প্রদর্শনের প্রতিবাদে বন্দোবস্ত অধিগ্রহণ করা দরকার। একটি ক্ষুদ্র দল (মনে করা যাক, লোকসভায় ১০ বা ১৫ শতাংশের কম আসনসংখ্যা-সহ) প্রথমে জোট সরকারে যোগদান করার সিদ্ধান্ত নেবে, এবং পরে বেরিয়ে যাওয়া মনস্থ করলে, অযোগ্য বিবেচিত হবে।
খ. সমস্ত দলগুলি যখন জোটবদ্ধ তখন সংসদীয় কার্যপ্রণালী পরিচালনার ক্ষেত্রে একক সংসদীয় দল হিসেবে কর্মপ্রক্রিয়া চালানো উচিত।
গ. মন্ত্রকসমূহ বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে নেবে এবং মন্ত্রীগণ অবশ্যই সংসদে ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রার দিকে লক্ষ রেখে প্রকৃত কার্য নিষ্পন্ন করতে দায়বদ্ধ থাকবেন।
ঘ. সংবিধানের সংশোধনী সম্পাদন করে যাতে সংসদের সংখ্যাগুরু সরকার ইচ্ছা হলে ক্যাবিনেটের ২৫ শতাংশ সদস্য সংসদের বাইরে থেকে নিযুক্ত করতে সক্ষম হবে।
ঙ. নির্বাচনের বেসরকারি তহবিল প্রচলন করা উচিত।
চ. আইন প্রণয়ন করা উচিত যে, তালিকাবদ্ধ কার্যপ্রণালী যদি সমাপন না হয় তবে কোনও কক্ষই সপ্তাহে দু’দিনের বেশি মুলতুবি রাখা যাবে না।
ছ. কোনও বিল অনুমোদন বা আইনগত কার্যপ্রণালীতে ‘ধ্বনি ভোট’-কে পদ্ধতিগতভাবে অনুমোদন দেওয়া উচিত নয়। ভোটগণনা আবশ্যিক করা উচিত।
জ. স্পিকার/চেয়ারম্যানের উচিত যে-সমস্ত সদস্যরা প্রায়শই কক্ষে কার্যসম্পাদনের ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটান তাঁদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত বা বহিষ্কার করা।
২. শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে
ক. কেন্দ্রীকরণ: অভ্যন্তরীণ সুরক্ষার ক্ষেত্রে ক্ষমতা রাজ্য থেকে কেন্দ্রে স্থানান্তর করা।
খ. বিকেন্দ্রীকরণ: আর্থিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের ক্ষমতা এবং দায়িত্ব কেন্দ্র থেকে রাজ্যে স্থানান্তরণ।
গ. একটি কেন্দ্রীয় কমিশন গঠিত করা যা কেন্দ্রীয় সহায়তা প্রাপ্ত সমস্ত অনুমোদিত দারিদ্র্য দূরীকরণ কার্যক্রম রাজ্য সরকারকে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এবং এই হস্তান্তর প্রকৃত বাস্তব কার্যনির্বাহের ভিত্তিতে গঠিত হবে।
ঘ. স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, সরকারি ক্ষেত্রের জন উদ্যোগ, ব্যাঙ্কসমূহ, আর্থিক, শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে সবরকম নিয়োগের জন্য UPSC-র মতো স্বশাসিত নিয়ামক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার প্রয়োজন।
ঙ. বেসরকারি ক্ষেত্র পুনরুত্থানশীল হয়ে ওঠার দরুন সামগ্রিক বিকাশের হার ত্বরান্বিত হয়েছে বলে সরকারের অভ্যন্তরীণ সংস্কার জরুরিভিত্তিতে করা দরকার।
চ. সরকারি পরিষেবার সুদক্ষতা প্রয়োগের জন্য একজন মন্ত্রীকে দায়িত্বশীল করার ক্ষেত্রে নতুন প্রতিষ্ঠানগত পদক্ষেপ করা জরুরি।
ছ. প্রস্তাবিত বার্ষিক প্রকৃত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বাস্তবায়িত কর্মসম্পাদনের রিপোর্টের জন্য সংসদের কাছে পরিকল্পনা কমিশনকে দায়বদ্ধ রাখা উচিত।
জ. অন্ততপক্ষে মন্ত্রীত্ব পর্যায়ে দুর্নীতি বিষয়ে সহনশীলতায় একটা ইতি টানা উচিত।
ঝ. সবশেষে বিচার সংক্রান্ত ক্ষেত্রে আইনব্যবস্থার কোনও সংস্কার দীর্ঘকাল ধরে মুলতুবি থাকতে পারে না।
আমি আগেই উল্লেখ করেছি, ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে কর্মসম্পাদনে বহুদলীয় জোটের বিধিসম্মত সরকার গঠনের উত্থানের এক তাৎপর্যময় ইঙ্গিত আছে। সংসদীয় কার্যপ্রণালীর ভূমিকা এবং কার্যকারিতা এতে আনুপাতিক হারে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে। সংসদের মহিমাময় ভূমিকা বর্ধন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, যাতে সংসদের তত্ত্বাবধানে বৃহত্তর দায়িত্বভার গ্রহণের মাধ্যমে এর কার্যনির্বাহকরা তার বিষয়গুলি পরিচালনায় আরও মূল্য যোগ করতে পারে। অতএব, আমাদের সংবিধানের চরম প্রত্যাশাপূরণের জন্য সংসদীয় ব্যবস্থাকে আরও স্থিতিশীল ও বাস্তবোপযোগী করার জন্য এই ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। সর্বোপরি, এই ধরনের উদ্বেগ বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস এবং দেশের অভ্যন্তরে অরাজকতার সঙ্গে মোকাবিলায় অভ্যন্তরীণ সুরক্ষার শক্তি বর্ধনের জরুরি আবশ্যকীয়তাকে গুরুত্বহীন করে দিচ্ছে।
উচ্চহারে বিকাশ পর্যায়ে অর্থনৈতিক অসাম্য আরও বিস্তৃতি লাভ করেছে। শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রীগণের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে ফলে তাঁদের দায়বদ্ধতাও বহুগুণ বৃদ্ধি পাওয়া অপরিহার্য হয়ে ওঠে। বাণিজ্য সংক্রান্ত এবং অন্যান্য বিধিবদ্ধ নিয়ম সংক্রান্ত ক্ষমতার প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাদের বিস্তৃত সতর্কতায় যাতে সরকারি তহবিলের অপব্যবহার এবং গতিমুখ পরিবর্তন না ঘটে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। শাসনব্যবস্থা পুনর্বিন্যাস করতে হবে যাতে রাজনৈতিক পদগুলির উচ্চপর্যায়ে চাহিদা এবং জোগানের মধ্যে অসামঞ্জস্যতা না থাকে যার ফলে এই পদগুলির দুষ্প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পেতে পারে।
আর্থসামাজিক লক্ষ্যসমূহের পরিকল্পনা ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে সাংসদদের আরও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণে উৎসাহদানের ফলে আরও বিস্তৃত ক্ষেত্র থেকে সংসদীয় নেতাদের আগমন ঘটবে এবং ক্ষমতা ব্যবহার এবং লাভের ‘একচেটিয়া’ উপভোক্তাদের প্রভাব হ্রাস পাবে। এর ফলে ইতিবাচক নেতৃত্বদানের পরিস্থিতি তৈরি হবে, যা দণ্ডনীয় অপরাধ এবং অন্যান্য আইন লঙ্ঘনের মতো অপরাধে অপরাধী ব্যক্তির রাজনীতিতে প্রবেশের সুযোগ কমিয়ে দেবে। সাংসদদের আরও কার্যকরীভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়সাধন করায় আর্থসামাজিক বিকাশ নিশ্চিত হবে। এবং এও সুনিশ্চিত হবে বহুবিধ এজেন্সি এবং সরকারি বিভাগগুলো যাতে কার্যক্ষেত্রে একে অপরের বিরুদ্ধে কাজ না করে। প্রকল্প রূপায়ণের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি এবং নীতিগত পার্থক্য সঠিক সময় এবং সঠিক পর্যায়ে বসে মীমাংসা করতে হবে এবং প্রস্তাবের জন্য উচ্চ থেকে উচ্চতর স্তরে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হবে না। এর ফলে ক্যাবিনেট কমিটি এবং গ্রুপ অফ মিনিস্টারস যথার্থ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির প্রতি মনোযোগ নিয়োগ করতে পারবে যেখানে ক্ষমতাপ্রাপ্ত সাংসদদের পক্ষেও বিষয়গুলোর সমাধান সম্ভব হয় না। ঘন ঘন রাষ্ট্র-রাজ্য এবং প্রতিষ্ঠানব্যাপী নির্বাচন এবং কোনও দলের স্বল্পমেয়াদি অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সাংসদদের বর্ধিত ভূমিকা সামগ্রিক শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কার্যকরী কর্মসম্পাদনে নিশ্চয়তা দেবে এবং আশ্বস্ত করবে যে, রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা বারংবার সংকটের সম্মুখীন হওয়ার প্রয়োজন নেই।
সংসদকে এখন এক নতুন লক্ষ্যে এবং নেতৃত্বে বিকশিত হতে হবে যা শুধু আমাদের রাষ্ট্রকে জ্ঞানসমৃদ্ধ, ঐক্যবদ্ধ, সংগতিপূর্ণ, সচ্ছল এবং সমৃদ্ধই করবে না, সর্বোপরি সীমান্তবর্তী এলাকায় অনুপ্রবেশ ও আক্রমণে চির-অভেদ্য একটি সুরক্ষিত রাষ্ট্র করবে। আমি মনশ্চক্ষে ২০২০ সালের ভারতবর্ষের জন্য এই বিশেষ রেখাচিত্র দেখি— এক দৃঢ়, সমৃদ্ধ এবং সুখী রাষ্ট্র, যদি সংসদ আজ মিশন ইন্ডিয়া ২০২০ প্রয়োগ করার সংকল্প গ্রহণ করে।
উন্নত ভারত ২০২০ লক্ষ্য উপলব্ধির চ্যালেঞ্জ, শাসনব্যবস্থা এবং আইনগত কর্মপ্রক্রিয়ার প্রতিটি ক্ষেত্রে উদ্ভাবনার সুযোগ তৈরি করে। যখন আমরা একুশ শতকে শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং আইনগত প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করি তখন প্রযুক্তিগত আন্দোলন, জাতীয় এবং বিশ্বব্যাপী সংযোগস্থাপন, বিশ্বায়ন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতার সম্পূর্ণ সুযোগ এবং তাৎপর্য গণ্য করতে হবে।
সাংসদগণ রাষ্ট্রের জন্য এক স্বপ্ন নিয়ে ঐক্যবদ্ধ এবং সুসংবদ্ধ নেতৃত্ব-সহ এই পরামর্শ নিয়ে বিতর্ক করতে পারেন এবং বিকশিত হতে পারেন ঠিক যেমনভাবে আমাদের সংবিধান প্রথম রচিত হওয়ার সময় হয়েছে। ভারতবর্ষের জন্য এই একুশ শতকের সংসদীয় স্বপ্নর ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিপ্রেক্ষিত থাকা প্রয়োজন। জাতীয় সমৃদ্ধি সূচককে মাপকাঠি ধরে এবং ২০৩০-এর আগে শক্তি স্বনির্ভরতা অর্জন-সহ ভারতবর্ষকে ২০২০-র মধ্যে একটা উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তর করার জন্য প্রায়োগিক কৌশল, অখণ্ড কাঠামো এবং কর্মপরিকল্পনা জোরালো করা প্রয়োজন।
এটাই সেই অনন্য সংসদীয় লক্ষ্য এবং এর কার্যকরী প্রয়োগ আমাদের কোটি কোটি দেশবাসীর মুখে হাসি আনবে। জাতীয় লক্ষ্যের জন্য আমাদের সাংসদদের এই মুহূর্তে ঐক্যবদ্ধ এবং সুসংবদ্ধভাবে কাজ করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবশ্যিকতা।
দুর্নীতি, শাসনপদ্ধতি এবং অন্যান্য বিষয়ে জাতীয় জাগরণ সংসদকে তৎপরতা এবং অন্তর্দৃষ্টি-সহ সক্রিয় হওয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে।
.
পরবর্তীকালে
যতদিন না আমি আচার্য মহাপ্রজ্ঞার দর্শন পেয়েছি আমার মনে সবসময় এক অনুভূতি হত যে, পারমাণবিক অস্ত্রের ক্ষেত্রে আমি যা করেছি তা বিশ্বাস, দর্শন এবং মহান মানবকীর্তির পরিপন্থী। আচার্য মহাপ্রজ্ঞা ছিলেন জ্ঞানের উৎস, তাঁর সংস্পর্শে আসা প্রতিটি আত্মা তাঁর দ্বারা শুদ্ধ হবে। ১৯৯৯ সালের অক্টোবর মাস, প্রায় মধ্যরাত্রি, আচার্য তাঁর আশ্রমবাসী ভিক্ষুদের নিয়ে দেশ এবং দেশবাসীর কল্যাণের জন্য তিনবার প্রার্থনা করেছিলেন। প্রার্থনা শেষে তিনি আমার দিকে ফিরে যে কথাগুলি বলেছিলেন তা আজও আমার মনে প্রতিধ্বনিত হয়। তিনি বলেছিলেন, ‘কালাম, তুমি তোমার টিমের সঙ্গে মিলে যা কাজ করেছ তার জন্য ঈশ্বর তোমায় আশীর্বাদ করবেন। কিন্তু পরমেশ্বর তোমার জন্য আরও বড় কোনও লক্ষ্য স্থির করে রেখেছেন এবং সে কারণেই তুমি আজ আমার সঙ্গে রয়েছ। আমি জানি আমাদের দেশ আজ একটি পারমাণবিক রাষ্ট্র। কিন্তু তুমি এবং তোমার সহকারীরা মিলে যে কাজ করেছ তোমার লক্ষ্য তার চেয়েও মহত্তর, যে কোনও মানবকীর্তির চাইতেও মহত্তর। পারমাণবিক অস্ত্র বিশ্বে অতি দ্রুত হারে বর্ধিত হচ্ছে। আমি আমার সমস্ত ঐশ্বরিক আশীর্বাদ-সহ তোমায় আদেশ করছি— তুমি এবং শুধুমাত্র তুমি এমন একটি শান্তিপূর্ণ পদ্ধতির বিকাশ করো যাতে প্রত্যেকটি পারমাণবিক অস্ত্র নিষ্ক্রিয়, তাৎপর্যহীন এবং রাজনৈতিকভাবে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।’
যখন আচার্যজি তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন তখন সভাকক্ষে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল। আমার মনে হয়েছিল সমগ্র প্রকৃতি যেন ওই পুণ্যশ্লোক মহাত্মার কথার সুরে সুর মেলাচ্ছে। জীবনে প্রথমবার আমি যেন কেঁপে উঠেছিলাম। তখন থেকে আচার্যর বার্তা আমার জীবনের পথপ্রদর্শনকারী আলোকশিখা আর তাকে বাস্তবায়িত করা আমার জীবনের একটা চ্যালেঞ্জ, যা আমার জীবনকে নতুন অর্থ দিয়েছে।
প্রথম অধ্যায়ে একটি ছোট মেয়ের চিঠির কথা উল্লেখ করেছিলাম। ওই চিঠি পড়ে আমরা যে ব্যবস্থা নিয়েছিলাম তাতে বেশ বিস্ময়কর ও আনন্দজনক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। এক ব্যাঙ্ককর্মীকে আমরা তাকে সহায়তার জন্য নিযুক্ত করেছিলাম। তিনি ওই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে মিলে সমস্ত অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব হয়েছিল। মেয়েটি এখন সুখী বিবাহিত জীবনযাপন করছে। আমরা আনন্দিত যে আমাদের ব্যবস্থাগ্রহণ তাকে তার স্বপ্নপূরণে সহায়তা করেছে।
.
পরিশিষ্ট-১ : সাক্ষাৎকার
২০০৬ সালে বেশ কিছু রাজ্য পরিদর্শনের পর আমি যখন মিজোরামে তখন এনই টিভি চ্যানেলের মনোরঞ্জন সিং আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। ওই সাক্ষাৎকার আমি পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই কেননা সেটা বেশ কিছু বিষয়, উদ্বেগ এবং কার্যকলাপের ওপর আলোকপাত করেছিল।
১. আপনার প্রদত্ত রাজ্যগুলির বিস্তারিত উন্নয়নমূলক মিশন অনুযায়ী রাজ্য সরকার কর্ম সম্পাদন করছে কি না আপনি কি তারও তদারকি করেন? এখানে কি কার্যকরী তদারকির সুসংগঠিত কর্মপ্রক্রিয়া আছে?
পরিকল্পনা কমিশন, রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রক থেকে পরিযোজন ও স্বাধীন মূল্যায়ন দ্বারা রাজ্য পরিদর্শনের মাধ্যমে যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলাম সেগুলো ব্যবহার করে আমি পথনির্দেশিকা দিয়েছি। এই প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে আমার টিম বিনিদ্র রাত্রিযাপন করেছে। আমি জোর দিয়েছিলাম যে রাজ্যের উন্নয়ন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং রাজ্য রাজনৈতিক দল থেকে অনেক বড়। অংশগ্রহণকারী সদস্যদের এই মিশনের ওপর আলোচনা করতেও আমি অনুমতি দিয়েছিলাম। আমার প্রেজেন্টেশন পেশ করার পর বেশ কিছু রাজ্য বিধানসভা প্রস্তাবিত মিশনের রূপায়ণ পরিকল্পনা আলোচনার জন্য পুরোদস্তুর অধিবেশন পরিচালনা করেছিল। এ ছাড়াও পরে যখনই সেই রাজ্যে গেছি ও বিশ্ববিদ্যালয়, বণিকসভা ও অন্যান্য বাণিজ্য ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে অভিভাষণ দিয়েছি, আমি সবসময় মিশনের উল্লেখ করেছি ও প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে রাজ্য মিশনের যোগসূত্র তৈরি করেছি। উদাহরণস্বরূপ কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ, বিহার সমস্ত মিশন পরবর্তী প্রক্রিয়া শুরু করেছে। কেরলে প্রচারমাধ্যমও প্রাথমিক পদক্ষেপ নিয়ে সরকার, বুদ্ধিজীবী ও অন্যান্য অংশীদারের সঙ্গে আলোচনা সহজসাধ্য করেছে। তারা মিশনের রূপায়ণের জন্য একটা কর্মপরিকল্পনা দিয়েছে। এভাবে প্রচারমাধ্যম রাজ্য সরকারের অন্যতম অঙ্গ হয়ে উঠেছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আমি সিকিম, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশ এবং মেঘালয়কে মিশনগুলি প্রদান করেছিলাম। এই রাজ্যগুলিকে বিশেষভাবে জলবিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনে এবং জলাশয়গুলির সংযুক্তিকরণে মনোযোগ দিতে হবে এবং বাঁশগাছে ফুল ধরার সময় কৃষি উৎপাদনে ক্ষয়ক্ষতি রোধ করায় সক্রিয় হতে হবে।
২. পরিকল্পিত উন্নয়নে আপনার পথনির্দেশিকা কি অতিরিক্ত হিসেবে বার্ষিক এবং পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় স্থান পেয়েছে? এই দুয়ের মধ্যে কি কোনও বিরোধ আছে?
যখন পথনির্দেশিকা তৈরি করছিলাম তখন সমস্ত মন্ত্রক, রাজ্য সরকার এবং পরিকল্পনা কমিশন থেকেও আমরা বিস্তারিত বিবরণ জানতে চেয়েছিলাম। পরিকল্পনা কমিশন এক আট সূত্রের মানদণ্ডের (an eight point criteria) উন্নয়নমূলক র্যাডার প্রস্তুত করেছিল যা আমরা গ্রহণ করেছিলাম। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল উন্নয়ন র্যাডারের সমস্ত মাপকাঠির উৎকর্ষ ঘটানো এবং সমস্ত উন্নয়নমূলক কার্যকলাপের সমন্বয় সাধন করা যা অভীষ্টের ত্বরান্বিত উপলব্ধির দিকে নিয়ে যায়। আমরা যে মিশনগুলির প্রস্তাবনা করেছিলাম তা রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কর্মদক্ষতাভিত্তিক এবং রাজ্য পরিকল্পনা ও পরিকল্পনা কমিশনের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সম্পূরক। ২০১৫-এর আগে উন্নত এক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে আমরা এক দীর্ঘমেয়াদি পরিপ্রেক্ষিত দিয়েছিলাম, কারণ উন্নত রাজ্যগুলিই ভারতবর্ষকে ২০২০-র আগেই উন্নত বানাবে।
৩. আপনার বুদ্ধিমত্তার প্রশস্ততা ও সুগভীর অন্তর্দৃষ্টি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত প্রয়োগের হাতেকলমের অভিজ্ঞতা পথনির্দেশিকার আকার দান করতে এক গুরুতর ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। আপনার এই বৈশিষ্ট্য কি মহান দপ্তরে আপনার উত্তরসূরিদের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে প্রতিফলিত হয় না?
আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, যে-কোনও সুব্যবস্থা কোনও নির্ভরতা নির্বিশেষে টিকে থাকে। গত চার বছরে আমি দেখেছি দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এক সর্বব্যাপী জাগরণ ঘটেছে। কিছু সু-সাফল্য লাভ করেছে। আমি মনে করি সেইজন্যই বেশ কিছু রাজ্য বিধানসভা আমার উন্নয়ন মিশনগুলি আলোচনা করার সুযোগ দিয়েছে। যখন আমি একটা বা দুটো বিধানসভায় কাজ শুরু করেছিলাম, অন্যান্য রাজ্য বিধানসভাগুলিও তখন আমায় আমন্ত্রণ করে, আমি সেখানে যাই এবং অভিভাষণ দিই। ফলে আমি দেখি যে ভারতীয় জনগণ এবং ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা, জাতীয় বিকাশের জন্য মিশন-কেন্দ্রিক উন্নয়নের কার্যক্রমের ধারণায় বিশ্বাসী হতে শুরু করেছে। এরজন্য প্রয়োজন পথনির্দেশিকা এবং একটি কার্যনির্বাহী পরিকল্পনা, যা হয়তো মধ্যপথে পর্যালোচনা দ্বারা সুসমন্বিত হবে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, রাষ্ট্রপতির দপ্তরে এক পেশাদার কর্মীবৃন্দ থাকা উচিত যাঁরা বিধানসভায় নানা ধরনের নথিপত্র প্রস্তুত করবেন। আপনি ঠিকই বলেছেন রাষ্ট্রপতির দপ্তরের অবশ্যই এ এক নতুন পদক্ষেপ এবং সেটা খুবই উদ্দেশ্যমূলক জাতীয় মিশন এবং সেসঙ্গে রাষ্ট্রপতিকে দেশের নাগরিকের চাহিদার সঙ্গে নিত্য যোগাযোগ রাখার জন্যও এক সুযোগ দেয়।
৪. যদিও সংবিধানে রাষ্ট্রপতি এবং সরকারের দায়িত্বসমূহ সংজ্ঞায়িত করা আছে, বিগত চার বছরে আপনি কি রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে অনেক সমাপতিত ক্ষেত্র খুঁজে পেয়েছেন, সম্পর্কে কি দ্বন্দ্ব এবং অস্পষ্টতার জায়গা আছে?
এই ব্যবস্থা অত্যন্ত সুন্দর ও স্থিতিস্থাপক যা একসঙ্গে কাজ করার পর্যাপ্ত সুযোগ দেয়। দেশ যে-কোনও একজন ব্যক্তির চাইতে গুরুত্বপূর্ণ, এই দর্শন মনে রেখে যদি কোনও কাজ করা হয় তা হলে কোনও সম্পর্কসম্বন্ধীয় সমস্যা থাকে না। রাজ্যপালদের সঙ্গে দুটো অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর একত্রিত হয়ে কাজ করার ধরন প্রকাশিত হয়েছে।
৫. লাভজনক পদ আইন প্রণয়ণের ক্ষেত্রে যে মতপার্থক্য ছিল তা জনগণের সামনে প্রকাশিত হয়েছিল। আপনার অসম্মতি থাকা সত্ত্বেও বিলটি ফেরত এল এবং আপনার উত্তমতর বিবেচনাকে বিচার না করে আপনাকে যে বাধ্য করা হল স্বাক্ষর করতে, সে-বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
লাভজনক পদ বিলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি যথেষ্ট স্বচ্ছ। আমরা আক্ষরিক এবং বিষয়াগতভাবে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তা দৃঢ়ভাবে সাংবিধানিক নির্দেশের অনুবর্তী। আপনি লক্ষ করবেন যৌথ সংসদীয় কমিটি বা জেপিসি (Joint Parliamentary Committee) গঠন করার ক্ষেত্রে সংসদের উভয় কক্ষের এবং জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলির সাধারণ মনোভাব আমাদের অবস্থানের যাথার্থ্য প্রতিপাদন করেছিল। সাংসদদের লাভজনক পদ বিলের সংজ্ঞাদান করার জন্য নির্দেশিকা তৈরির কারণে জেপিসি-র গঠনের পর আমি বিলে স্বাক্ষর করেছিলাম।
৬. আপনার প্রিয় বিষয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সুযোগের প্রতি তরুণ হৃদয়ে জাগরণে আপনার লক্ষণীয় উদ্যোগ আছে, আপনার মতানুসারে আর কী কী নতুন পদক্ষেপ সরকারের নেওয়া উচিত?
ক. ছাত্রছাত্রীদের সৃজনশীল করে তোলার পরিপ্রেক্ষিতে সমগ্র প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থার এক পুনর্গঠন প্রয়োজন। অবশ্যই সংসদে শিক্ষার অধিকার বিল অনুমোদন পেয়েছে রাজ্য বিধানমণ্ডলগুলিতে আলোচনার মাধ্যমে। পরিশেষে, শিক্ষার অধিকার আইন দেশের সমস্ত ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সি ছেলেমেয়েদের আবশ্যিক এবং বিনামূল্যে শিক্ষার সুযোগ করে দেবে।
খ. প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় প্রভূত সংস্কার প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞ দল প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় এক সৃজনশীল পাঠ্যক্রম, সৃজনশীল ক্লাসরুমের উদ্ভাবনা করবেন এবং সর্বোপরি প্রশিক্ষিত সৃজনশীল শিক্ষক নিয়োগ করবেন।
গ. বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি ইন্ডিয়া ২০২০ মিশন উপলব্ধির উদ্দেশ্য অভিমুখী হওয়া উচিত।
ঘ. বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম তরুণদের মধ্যে গবেষণা এবং অনুসন্ধান, সৃজনশীলতা এবং নৈতিক নেতৃত্বের সক্ষমতা অবশ্যই গড়ে তুলবে যাতে তাঁদের ইন্ডিয়া ২০২০ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অবদান থাকে।
ঙ. প্রতিবছর এক হাজারজন তরুণ ছাত্রছাত্রী যাতে বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে জীবিকার লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে সেই উপায় উদ্ভাবন করার বিশেষ পথ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। পরে এই বিজ্ঞান গোষ্ঠীর কর্মনিয়োগের সুবিধা প্রয়োজন।
৭. বলা যায়, যেখানে চিকিৎসা, প্রযুক্তিবিদ্যা এবং ম্যানেজমেন্ট প্রশিক্ষণ কলেজগুলো আবেদনকারীর দ্বারা পূর্ণ যেখানে মৌলিক বিজ্ঞান পাঠ্যক্রমগুলো কোনও ছাত্র পায় না। সেক্ষেত্রে কী বিশেষ কর্মপন্থা বা কৌশল থাকা প্রয়োজন যা ছাত্রদের মৌলিক বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে এবং গবেষণা করতে উৎসাহিত করবে?
আপনি হয়তো জানেন, বিজ্ঞান-গবেষণা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (Institute of Science, Research and Education) সরকার দুটো রাজ্যে প্রচলন করেছেন। আমাদের একটা বিশ্বব্যাপী মানবসম্পদ সংগঠন গড়ে তোলার জন্য ক্রমান্বয়ে কাজ করার প্রয়োজন যা তরুণসমাজকে হয় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং গবেষণার জন্য উচ্চতর শিক্ষা প্রদান করবে নয়তো শিল্পক্ষেত্রে নিয়োগযোগ্য সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ দক্ষতা নিবেদন করবে, যা রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে। আমি মনশ্চক্ষে দেখতে পাই ২০৫০-এর মধ্যে ভারতীয় যুবসমাজের ৩০ শতাংশ ক্রমবর্ধনশীলভাবে উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিত হবে, এখনকার ১০ শতাংশের তুলনায়। এবং বাকি ৭০ শতাংশের শিল্প, সেবামূলক ক্ষেত্র ও কৃষিতে উন্নত দক্ষতা থাকবে।
৮. সরকারের ১০০ কোটি টাকা আইআইএসসি-তে বিনিয়োগ করে বিশ্বমানের রিসার্চ এবং ডেভলপমেন্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ গড়ে তোলা নিশ্চয়ই প্রশংসার্হ কাজ, কিন্তু এত বড় একটা লক্ষ্যপূরণের জন্য বিজ্ঞানীরা নিজেদের যথেষ্ট অপ্রতুল মনে করছেন। MIT এবং স্ট্যানফোর্ডে তাদের নিজস্ব বৃহত্তর সম্পদ ছিল, অন্যদিকে আইআইএসসি বলে, পর্যাপ্ত ডক্টোরাল ছাত্র গবেষণা বিভাগগুলিতে পাওয়া যায় না।
সরকার পক্ষ থেকে এ এক অন্যতম পদক্ষেপ। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলিতেও সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছিল। পরিকাঠামোগত উৎকর্ষসাধনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ নানা উৎস থেকেও আসতে পারে। বিজ্ঞান সংগঠনে যে পরামর্শ দিয়েছিলাম, আমি নিশ্চিত এর দরুন বেশ কিছুসংখ্যক তরুণ ছাত্র বিশুদ্ধ গবেষণাকার্য করতে চাইবেন।
৯. ন্যানো প্রযুক্তি, জৈব প্রযুক্তি, কার্বন বিমিশ্র, ধাতুবিদ্যা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন ক্ষেত্রে ভারত বিশ্বমানের গবেষণা করেছে, বিজ্ঞান গবেষণা নিয়ে সম্প্রতি আমাদের এই দাবি সত্ত্বেও দেশের এই কাজের জন্য বিগত ষাট বছরে একটাও নোবেল পুরস্কার আমরা পাইনি। এতে প্রশ্ন ওঠে আমরা কি সত্যি বিশ্বমানের গবেষণা করছি নাকি আমাদের কাজ অন্য কোনও কারণে স্বীকৃতি পাচ্ছে না। আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
বেশিরভাগ নোবেল পুরস্কার মৌলিক গবেষণার জন্য দেওয়া হয়। বর্তমানে মৌলিক গবেষণার জন্য বরাদ্দ বিপুল পরিমাণ অর্থ ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রয়োজন তরুণ ছাত্রদের মধ্যেকার সৃজনশীলতার বন্ধনমুক্তি ঘটানো যাতে তাঁরা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় নবতম উন্মেষ ঘটাতে পারেন এবং তাঁদের প্রচেষ্টা ভিন্ন ভিন্ন দিকে বিক্ষিপ্ত না করে নির্দিষ্ট বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে সংহত করতে পারেন। আমি ন্যানো প্রযুক্তি, জৈব প্রযুক্তি এবং তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রযুক্তিসমূহের অভিসরণ ঘটিয়ে নির্দিষ্ট কেন্দ্রাভিমুখী গবেষণার পরামর্শ দেব। ভারতবর্ষ গভীর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং উচ্চতর প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোয় নির্দিষ্ট গবেষণা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কর্মদক্ষতা এবং অর্থভাণ্ডার থাকতেই হবে। যদি আরও গবেষক অধ্যাপক এবং বিজ্ঞানীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ দ্বারা প্রতিপালিত হন তা হলে আরও গবেষক ছাত্ররা আকর্ষণ বোধ করবেন। এর দরুন উদ্ভাবনী গবেষণার সফলতা বৃদ্ধি পাবে এবং দেশীয় প্রযুক্তিতে এর প্রভাব রাখবে। কিছু কিছু গবেষণা হয়তো পুরস্কার বিজয়ী গবেষক গড়ে তুলবে। এখানে আমি এক অভিজ্ঞতার কথা বলব যে, কীভাবে বৈজ্ঞানিক মহানুভবতা গবেষণা-পরিবেশের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে ওঠে।
বৈজ্ঞানিক মহানুভবতা: ২০০৫ সালের ১৫ মার্চ দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে এক প্রখ্যাত কৃষিবিজ্ঞানী এবং ভারতের প্রথম সবুজ বিপ্লবের অংশীদার, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক নর্ম্যান ই বোর্লগ এম এস স্বামীনাথন পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন। ৯১ বছরের অধ্যাপক বোর্লগের প্রতি উপস্থিত সবাই প্রশস্তিবাক্য বর্ষণ করছিলেন। যখন ওঁকে বলতে অনুরোধ করা হল, উনি উঠে দাঁড়িয়ে কৃষিবিজ্ঞান এবং উৎপাদনে ভারতবর্ষের অগ্রগতির কথা বললেন, আরও বললেন রাজনৈতিক দূরদ্রষ্টা সি সুব্রাহ্মনিয়াম এবং ড. এম এস স্বামীনাথন ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম সবুজ বিপ্লবের মূল রূপকার। তিনি গর্বের সঙ্গে ভার্গিস ক্যুরিয়েনকে স্মরণ করলেন, যিনি ভারতবর্ষের শ্বেতবিপ্লবের অগ্রগমন ঘোষণা করেছিলেন। ড. বোর্লগ দর্শকদের মধ্যে তৃতীয়, পঞ্চম এবং অষ্টম সারিতে বসা বিজ্ঞানীদের দিকে ফিরে গম বিশেষজ্ঞ ড. রাজা রাম, ভুট্টা বিশেষজ্ঞ ড. এস কে ভাসাল এবং বীজ বিশেষজ্ঞ ড. বি আর বারওয়ালেকে চিহ্নিত করলেন। তিনি বলেছিলেন এইসমস্ত বিজ্ঞানীরা ভারতবর্ষ এবং এশিয়ার কৃষি সংক্রান্ত বিজ্ঞানে অবদান রেখেছেন। তাঁদের তিনি দর্শকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং নিশ্চিত করলেন যাতে দর্শকরা উঠে দাঁড়িয়ে এই বিজ্ঞানীদের অভিনন্দন জানান। এই দৃশ্য আমাদের দেশে আমি আগে কখনও দেখিনি। ড. বোর্লগের এই মনোভাবকে আমি বৈজ্ঞানিক মহানুভবতা বলি। বন্ধু, যদি আপনি জীবনে মহৎ কিছু পাবার আকাঙ্ক্ষা করেন আপনার প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক মহানুভবতা। আমার অভিজ্ঞতা বলে মহান কার্য এবং মহৎ হৃদয় যুগপৎ চলে। এই বৈজ্ঞানিক মহানুভবতা বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়কে অনুপ্রাণিত করবে। বৈজ্ঞানিকদলের সমষ্টি চেতনাকে প্রতিপালন করে নানা গবেষণা ক্ষেত্রে নতুনতর আবিষ্কার ও উদ্ভাবনার দিকে তাঁদের নিয়ে যাবে।
১০. আপনি কি মনে করেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিভিন্ন বন্ধুরাষ্ট্র সফর কোনও বাস্তবিক উদ্দেশ্যসাধন করে, নাকি সেগুলো শুধুমাত্র সীমিত মূল্যের আনুষ্ঠানিকতা?
এই পরিদর্শনের সাফল্য সম্পূর্ণ নির্ভর করে ভারতবর্ষ কী অর্জন করতে চায় তার ওপর। আমি ১৪টি রাষ্ট্রে গেছি এবং তাদের জাতীয় সভা ও সংসদে অভিভাষণ দিয়েছি। এই সফরগুলোতে পারস্পরিক বোঝাপড়া আরও ভাল হয়েছে এবং সহযোগিতা ও ভাববিনিময়ের নতুনতর পথে নিয়ে গেছে। এর ফলে উভয় রাষ্ট্রই দীর্ঘমেয়াদি সুফল ভোগ করবে।
উদাহরণ হিসেবে, আমি দক্ষিণ আফ্রিকায় প্যান আফ্রিকীয় সংসদে অভিভাষণ দিয়েছিলাম। ওখানে আমি প্যান আফ্রিকীয় ই-নেটওয়ার্ক স্থাপনার প্রস্তাব দিয়েছিলাম যার প্রাথমিক খরচ ছিল ৫০ মিলিয়ন ডলার। আপনি শুনে সুখী হবেন যে, প্রকল্পটির ভালভাবে অগ্রগতি হচ্ছে এবং এর ফলে আফ্রিকীয় ইউনিয়ন এবং ভারতীয় বিশেষজ্ঞদলের মধ্যে ঘনিষ্ঠ প্রযুক্তিগত সহযোগিতা গড়ে উঠেছে। আমি একে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য হিসেবে গণ্য করি।
আমি যখন সুদান গেছিলাম ওএনজিসি-র পাইপ লাইন প্রকল্পটি শুরু হচ্ছিল। আজ সেই প্রকল্পটি ওএনজিসি বিদেশ দ্বারা সম্পূর্ণ হয়েছে এবং উভয় রাষ্ট্র এর সুফল ভোগ করছে।
ফিলিপিনস আমাদের দেশের উদাহরণ গ্রহণ করে জাত্রোফা চাষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার জন্য তাঁরা ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এ ছাড়াও ভারতবর্ষ এবং ফিলিপিনসের ভেষজ শিল্পের মধ্যে সক্রিয় সহযোগিতা গড়ে ওঠে যার দরুন মানুষ ব্যয়সাধ্য মূল্যে ওষুধ পায়। ন্যাসকম (NASSCOM) ফিলিপিনসের সঙ্গে আইটি, আইটিইএস এবং বিপিও পরিষেবা গড়ে তোলার জন্য কাজ শুরু করেছে।
সহৃদয়তার নিরিখে আমরা বেশ কিছু হৃদ্রোগীর চিকিৎসা করতে রাজি হয়েছিলাম, বিশেষত তানজানিয়ার কিছু হৃদ্রোগাক্রান্ত বাচ্চাদের। আমার বলতে আনন্দ লাগছে যে, সেই বাচ্চাদের ভারতবর্ষে এনে চিকিৎসা করে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। এর পাশাপাশি অনেক তানজানিয়ার চিকিৎসককে হৃদ্রোগ মোকাবিলায় প্রশিক্ষিত করা হয়েছে।
সিঙ্গাপুর এবং দক্ষিণ কোরিয়া ভ্রমণ কালে আমি দুই অংশীদারী রাষ্ট্রে বিশ্ব জ্ঞানমঞ্চ সৃজনের প্রস্তাবনা দিয়েছি। এই কার্যক্রম আধুনিকতম দ্রব্যের নকশা, উন্নয়ন এবং উৎপাদনের সম্ভাব্যতা কল্পনা করে অংশীদার রাষ্ট্রের বারোটি ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ কর্মদক্ষতা ব্যবহার করে, যা আন্তর্জাতিকভাবে বিপণন হতে পারে। এইসমস্ত রাষ্ট্রগুলি সক্রিয়ভাবে এক বিশ্ব জ্ঞানমঞ্চ প্রয়োগের বিবেচনা করছে।
১১. এখন যে আপনি আপনার মেয়াদের গুরুত্বপূর্ণ অংশ সমাপন করেছেন সেখানে আপনি কি এমন কিছু কার্যক্রমের তালিকা রচনা করবেন যার প্রাথমিক পদক্ষেপ আপনি নিয়েছেন এবং যেগুলি আপনাকে গভীর সন্তুষ্টি দিয়েছে? যেমন PURA-র উদাহরণ?
সন্তোষজনক কিছু কার্যক্রমের উল্লেখ আমি করতে চাই—
গ্রামীণ উন্নয়ন: গ্রামীণ উন্নয়ন মন্ত্রক সমগ্র দেশ জুড়ে ৩৩ টি PURA গুচ্ছ প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা করেছে। কিছু বেসরকারি শিক্ষা ও সামাজিক সংগঠন PURA-কে গ্রহণ করেছিল পল্লিগ্রাম গুচ্ছ উন্নয়নের জন্য।
শক্তি: পাঁচটি রাজ্য জৈব ডিজেল উৎপাদনের জন্য জাত্রোফা চাষ শুরু করেছে। একটি শক্তি প্রকল্প ঘোষিত হয়েছে।
নলেজ গ্রিড: জাতীয় জ্ঞান কমিশন বা NKC (National Knowledge Commission) পরিকল্পনা করছে সমগ্র দেশ জুড়ে নলেজ গ্রিড প্রতিষ্ঠা করবে কমপক্ষে ৫০০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ১০০ mbps নেটওয়ার্কের নেটওয়ার্কিং দ্বারা।
ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয়: ১৫০ বছরের পুরনো তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয় প্রচলন করেছে এবং আমি ভার্চুয়াল শ্রেণিকক্ষের মাধ্যমে উদ্বোধন করেছি ও ২০,০০০ ছাত্রছাত্রীর উদ্দেশে অভিভাষণ দিয়েছি।
গ্রামীণ জ্ঞান কেন্দ্র: যোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রক বা এমসিআইটি (মিনিস্ট্রি অফ কমুনিকেশনস অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি) দ্বারা ১০০,০০০ সাধারণ সেবাকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে যাতে গ্রামীণ নাগরিকদের মূল্যভিত্তিক পরিষেবা দেওয়া যায়।
ই-গভর্ন্যান্স: জাতীয় আইডি বা পরিচয়পত্র এবং G২G এবং G২C পরিষেবার জন্য ই-গভর্ন্যান্স গ্রিড স্থাপনা গতি অর্জন করছে। ভারত সরকার G২C ই-গভর্ন্যান্স পরিষেবার জন্য ২৩,০০০ কোটি টাকা ঘোষণা করেছিল এবং রাজ্য বিস্তৃত ক্ষেত্র নেটওয়ার্ক বা SWAN (State Wide Area Network) স্থাপনা করেছে।
১২. দপ্তরভার ছেড়ে দেবার পরে আপনার বিপুল প্রতিভা, উৎসাহ এবং মহান আত্মোৎসর্গতা কি আপনার কোনও প্রিয় পরিকল্পনায় নিবেদন করার অভিপ্রায় রাখেন? যেমন বিজ্ঞান গবেষকদের পথপ্রদর্শন ও ডক্টোরাল ছাত্রদের শিক্ষাদান করা? আন্না বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার আগের কাজ কি আপনি আবার শুরু করবেন?
২০২০-র পূর্বে উন্নত ভারত স্বপ্ন উপলব্ধি করায় আমি অক্লান্তভাবে কাজ করে যাব। শিক্ষকতা এবং গবেষণাকার্য করব। ছাত্রছাত্রী ও তরুণ সমাজের সঙ্গে আমার ভাববিনিময় চলতেই থাকবে।
এ ছাড়াও প্রতি বছর বেশ কিছু সময় আমি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য ব্যয় করব। ওখানকার জনজীবনের মানোন্নয়নের সময়-নির্দিষ্ট উন্নত প্রভাব বিস্তারকারী প্রকল্পের প্রয়োগের সক্ষমতা এবং উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ গঠনের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। ফলে ওই অঞ্চলের যুবসমাজকে উচ্চ পারিশ্রমিকযুক্ত কর্মনিয়োগের অজস্র সুযোগ নিবেদন করা যাবে।
১৩. ওই বিশিষ্ট পদ আপনি সম্মানের সঙ্গে বহন করা সত্ত্বেও আপনার সবচেয়ে বড় অসন্তুষ্টির কারণ আপনি কি ব্যক্ত করবেন?
আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আমি গভীরভাবে আশাবাদী। আমি শুধুমাত্র অগ্রগতির হার সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। রাষ্ট্রের যুবসমাজকে সক্ষম করার জন্য যদি সমস্ত অংশীদাররা একই লক্ষ্যে সমন্বিত ছন্দে কাজ করে তবে আমরা ইন্ডিয়া ২০২০-র উন্নয়নমূলক লক্ষ্য আরও দ্রুত উপলব্ধি করতে পারব। আমাদের প্রত্যেকের এই মনোভাব নিয়ে কাজ করা উচিত যে, রাষ্ট্র ব্যক্তিমানুষের চাইতে অনেক বড়। আমাদের ৫৪০ কোটি তরুণদের প্রতি আমার অসীম বিশ্বাস আছে।
১৪. আপনি উত্তর-পূর্বাঞ্চল পরিদর্শন করেছেন এবং তাদের উন্নয়নের জন্য পথনির্দেশিকা-সহ উপদেশ দিয়েছেন। কিন্তু যেখানে প্রায় প্রতি রাজ্যে অসংখ্য সন্ত্রাসবাদী দল রয়েছে সেখানে আপনার এ ধরনের উপদেশ যথেষ্ট নয় বলে কি আপনি বিবেচনা করেন না? এই সন্ত্রাস বিনিয়োগের স্রোতকে অবরুদ্ধ করে, বিনিয়োগের অভাব যুবমানসে অসন্তোষ সৃষ্টি করে বা সন্ত্রাসবাদীদের পুষ্ট করে, ফলে উন্নয়নমূলক কাজকর্মে অচলাবস্থার উদ্ভব ঘটে। এই পরিস্থিতিতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পীড়িত জনগণের জন্য কোনও আশা রয়েছে কি?
উত্তর-পূর্ব রাজ্যসমূহ আমাদের অনেক সুযোগ ও চ্যালেঞ্জের সুযোগ দেয়। আমিও দেখেছি, জনসাধারণ উপলব্ধি করতে শুরু করেছে যে, সন্ত্রাসের ঘটনাগুলি যুবসমাজের ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে কাজ করছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চল এক উদ্যমশীল উন্নয়ন গ্রহণ করেছে, প্রগতির পথে যে-কোনও চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে মানুষ তৈরি হবে। অতএব আমি রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে এই বার্তা দেব যে, রাজ্যের যুবসমাজকে সক্ষম করে উদ্যমশীল উন্নয়নের জন্য অগ্রসর হতে হবে। সন্ত্রাস এবং উগ্রবাদী হিংসা সত্ত্বেও আমাদের দক্ষতা সম্পন্ন, জ্ঞান সমৃদ্ধ এবং শিল্পোদ্যোগে উন্নয়ন করতে হবে।
১৫. উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলি থেকে পূর্ব ভারতে বাণিজ্য, যোগাযোগ এবং সড়ক-রেল যাত্রাপথ সুগম হওয়া সম্বন্ধে আপনার কী মতামত? অর্থনীতিতে এগুলো কি উদ্দীপনা সৃষ্টি করে এবং আরও কর্মসংস্থান এবং সুযোগ সৃষ্টি করে?
উন্নয়নের জন্য এ আবশ্যিক। রাজনৈতিক দলগুলির উচিত পূর্বদিকে বাণিজ্য, যোগাযোগ এবং সড়ক-রেল যাত্রাপথের মতো সম্ভাবনার উন্মোচন যত শীঘ্র সম্ভব সহজসাধ্য করা। সীমান্ত বাণিজ্য উন্নয়ন সম্বন্ধে আমি রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারি আধিকারিকদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম যা যুবসমাজের কর্মনিয়োগ সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে।
১৬. আমাদের শক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রচলিত উৎস থেকে অপ্রচলিত উৎস পরিবর্তনে রাষ্ট্রপতি ভবন কি কোনও দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে যা আপনি করবেন বলে ঘোষণা করেছিলেন?
বর্তমানে, রাষ্ট্রের শুধুমাত্র এক কিলোওয়াট ধারণক্ষমতা সম্পন্ন সৌরশক্তি ব্যবস্থার অভিজ্ঞতা আছে। রাষ্ট্রপতি ভবনের জন্য আমরা ৫ মেগাওয়াট সৌরশক্তিকেন্দ্রের পরিকল্পনা করছি। যত শীঘ্র সম্ভব এই শক্তিকেন্দ্র স্থাপনা করার জন্য শক্তিমন্ত্রক এবং অপ্রচলিত শক্তি উৎস মন্ত্রক সক্রিয়ভাবে এই প্রকল্পের জন্য কাজ করছে।
১৭. শক্তি সংক্রান্ত পরিস্থিতি নিয়ে আপনার উদ্বেগের কারণে আপনি কি আপনার প্রভাব রাষ্ট্রে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি এবং জোয়ার-ভাটা উদ্ভূত শক্তি ইত্যাদির দিকে বদল করার প্রচেষ্টা করবেন?
আপনি লক্ষ করেছেন আমার বক্তৃতায় আমি সৌরশক্তি কেন্দ্রের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সিএনটি (Carbon nanotube) ভিত্তিক সৌর আলোক উদ্বায়ী কোষ সহিত সৌরশক্তি ক্ষেত্রে গবেষণার পরামর্শ দিয়েছিলাম। এ ছাড়াও থোরিয়াম ব্যবহারের মাধ্যমে পারমাণবিক শক্তির পরামর্শ দিয়েছিলাম। পরিবহণ ক্ষেত্রে, জৈব ডিজেল উৎপাদনের জন্য ব্যাপক হারে জাত্রোফা বাগিচা নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছিলাম। আমাদের বিজ্ঞানীরা এইসমস্ত ক্ষেত্রে কাজ করেছেন।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের তিনটি রাজ্যে আমার সফর সেই রাজ্যগুলির জৈববৈচিত্র্য এবং উদ্ভিদবিজ্ঞান, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও বস্ত্রশিল্পের বিশেষায়িত উৎপাদন সম্ভাব্যতা সম্বন্ধে আমার মনে বিশ্বাস জাগায়। এই পরিদর্শনের দ্বারা এই রাজ্যগুলির তরুণদের জীবনে সফল হওয়ার অনুপ্রেরণা সম্পর্কে আমার মনে বিশ্বাস গড়ে ওঠে। প্রয়োজন শুধু ওদের মধ্যে উন্নয়নের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠা। পাশাপাশি, রাজ্যগুলির ত্বরান্বিত বিকাশ অর্জনের জন্য যুবসমাজকে বহির্বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হবে। এর জন্য দরকার সহজসাধ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং গতিশীল পরিকাঠামোর বৃদ্ধি।
.
পরিশিষ্ট-২
মিশনের প্রয়োগপদ্ধতি
রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার ছেড়ে আসবার সময় আমি যে বক্তৃতা দিয়েছিলাম তাতে সংসদকে শক্তিশালী করার জন্য একটা বিস্তারিত পরিকল্পনা জ্ঞাপন করেছিলাম। প্রতিটি দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য, লক্ষ্য এবং অন্যান্য যে চ্যালেঞ্জগুলি একযোগে সংসদ এবং সরকার রূপায়ণ করবে বলে আমি মনে করি, প্রয়োজনানুসারে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে, নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় সময় এবং সংস্থান, বিভিন্ন মন্ত্রক, বিভাগের সীমা অতিক্রম করে, তাকে ‘মিশন-কার্য প্রণালী’ হিসেবে বর্ণনা করার পরামর্শদান করেছিলাম। আমি আশাপোষণ করেছিলাম যে, প্রতিটি মিশনের জন্য সংসদের প্রতিভাবান সদস্যদের মধ্যে থেকে দূরদর্শী নেতৃত্বর উত্থান ঘটবে। এই পথে সমস্ত সদস্যরা রাজনৈতিক দলের মতাদর্শের ভিন্নতা অগ্রাহ্য করে কার্যকরী শাসনব্যবস্থায় প্রকৃত অংশগ্রহণে সক্ষম হবেন। নির্দিষ্ট মিশনের নেতৃত্ব গ্রহণ করলে দায়বদ্ধতা এসে যায়।
মিশন ব্যবস্থাপনে সংগঠনমূলক কাঠামো
অগ্রবর্তী ক্ষেত্রের মিশন ব্যবস্থাপনের জন্য প্রতিভূস্বরূপ আদর্শের দ্বারা যেতে গিয়ে আমি মনশ্চক্ষে দেখি
• যখন নির্বাচিত সাংসদরা মিশনের সমন্বয়সাধন করবেন, সংশ্লিষ্ট শাসনতান্ত্রিক বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী একই মিশনে প্রয়োজনীয় পরিধিতে এবং নিজের নিজের মন্ত্রক/বিভাগের সীমারেখার মধ্যে যতদূর সম্ভব সরাসরি নেতৃত্ব দান করবেন।
• কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ‘মিশন মন্ত্রী’ কে প্রয়োজনীয় মন্ত্রক/বিভাগীয় সংস্থানকে দায়িত্বভার অর্পণ করবেন যাঁকে তাঁর মিশনের জন্য বার্ষিক কর্মসূচি এবং আর্থিক লক্ষ্যপূরণের উপলব্ধির জন্য দায়ী করা হবে।
ইন্ডিয়া ২০২০ স্বপ্ন উপলব্ধি করতে বহুগুণিত মিশনের ম্যাট্রিক্স কাঠামোর একটা ধারণামূলক রেখাচিত্র দেখানো হল
মিশনে কার্যপ্রণালী ব্যবস্থাপনের জন্য মন্ত্রক বা বিভাগীয় বাজেটের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বিকেন্দ্রীকরণ এবং মিশন অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ বরাদ্দের প্রয়োজন। কোনও বিশেষ মিশনের জন্য প্রতিটি মন্ত্রকের অভ্যন্তরীণ দায়িত্বভার অধিকর্তা/ যুগ্মসচিব পদমর্যাদার নির্দিষ্ট আধিকারিকের ওপর ন্যস্ত করা হবে। এভাবে মিশন— মন্ত্রীর একটা দল হবে বিভিন্ন মন্ত্রকের কয়েক জন যুগ্ম সচিব/অধিকর্তা নিয়ে এবং মিশনের লক্ষ্য সফল করার দিকে তাঁদের মনোনিবেশ করাবে। মিশন ব্যবস্থাপন দলের প্রতিটি সদস্য শাসনতান্ত্রিকভাবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কাছে কিন্তু কর্তব্যগতভাবে মিশন পরিচালকের কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন।
তা হলে সহজেই দেখা যাচ্ছে ‘ম্যাট্রিক্স ব্যবস্থাপন’-এ সাংসদদের এ ধরনের বিস্তৃত অংশগ্রহণে নিম্নলিখিত সংগঠনের নীতিসমূহ এবং দায়বদ্ধতার প্রয়োজন হবে।
ক. মিশন মন্ত্রীরা রাজ্যের মন্ত্রী হতে পারেন বা তাঁদের সংসদ থেকে আনা হতে পারে। এমনকী শাসন রূপরেখায় অবস্থান না করা কোনও রাজনৈতিক দলেরও হতে পারেন।
খ. নির্দিষ্ট মিশনসমূহ, কার্যক্রমগুলি এবং প্রকল্পগুলির জন্য মিশন মন্ত্রীদেরকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের দ্বারা সংস্থান ও ক্ষমতার উপর থেকে নীচে ক্ষমতার দায়িত্ব বিতরণ।
গ. মিশন মন্ত্রীদের দ্বারা বিভাগীয় সীমা অতিক্রম করে মিশন ব্যবস্থাপন টিমের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট মিশনের সমান্তরাল একীকরণ।
ঘ. সামগ্রিক মিশন পরিকল্পনা এবং সংস্থান বিলিবণ্টনের জন্য পরিকল্পনা কমিশন এবং প্রতিটি মন্ত্রক/বিভাগের ইন্ডিয়া ২০২০ স্বপ্ন পরিকল্পনা টিম গড়ে তুলতে হবে।
ঙ. প্রতিটি মন্ত্রক এবং মিশন পরিকল্পনা দল দ্বারা সযত্নে বিস্তৃত মিশন ২০২০ পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে হবে।
চ. মিশনগুলিকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অর্থসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে এবং মিশনগুলির কার্যকালের মেয়াদ সংসদ ও সরকারের কার্যকালের মেয়াদের পরিধির বাইরে অবধি বিস্তৃত করতে হবে।
ছ. ই-গভর্ন্যান্স নেটওয়ার্ক ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতে হবে।
জ. মিশন-মন্ত্রীরা সংসদের কাছে সরাসরি দায়বদ্ধ থাকবেন।
ঝ. কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা মন্ত্রিসভার কাছে এবং মন্ত্রিসভা সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন।
ঞ. বহুলসংখ্যক মিশন-মন্ত্রীরা ইন্ডিয়া ২০২০ স্বপ্ন ম্যাট্রিক্স-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে হবে, এর ফলে সংসদের ভূমিকা ও দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি পাবে এবং নির্দিষ্ট মিশনগুলোর জন্য উচ্চ সরকারি পদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
গণতন্ত্র বজায় রাখতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। যদিও একে শুধুমাত্র উন্নতির জন্য একটা যান্ত্রিক কৌশল হিসেবে দেখা উচিত হবে না। শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে এর সফল ব্যবহার সামাজিক মূল্যবোধ এবং জনগণের কার্যকরী অংশগ্রহণের ওপর নির্ভর করে। এবং নিয়মমাফিক পরিবর্তনের জন্য অনুঘটক হিসেবে জাতীয় বিতর্কের সময় এসে গেছে।