প্রথম ভাগ
দ্বিতীয় ভাগ

১৫. উনিশ শ’ ছয় থেকে ছত্রিশ

পঞ্চদশ অধ্যায়

উনিশ শ’ ছয় থেকে ছত্রিশ

উনিশ শ’ ছয় থেকে ছত্রিশ –এ তিরিশ বছরের ইতিহাস মুসলমানদের আযাদী আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তবুও বলতে হবে এ তিনটি দশকে তারা চিল আশা-নিরাশার দ্বন্দ্বে জর্জরিত এবং কখনো দেখতে পাই তাদের রাজনৈতিক মানস নৈরাশ্যে ঝিমিয়ে পড়েছে।

এ দশকত্রয়ের দুটি প্রান্তসীমা ছিল দুটি বৈমিষ্ট্য উজ্জ্বল ও প্রাণন্ত। ১৯০৬ সালে মুসলমানদের স্বতন্ত্র জাতীয়তার উন্মেষে আশার উজ্জ্বল আলোকে উদ্ভাসিত এবং ছত্রিশে ভারত শাসন আইন (India Act of 1935) অনুযায়ী স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে পৃথক নির্বাচনের ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণে তৎপর। মাঝের সময়কালটুকু কেটেছে প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে দ্বন্দ্ব কলহে, আত্ম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ও প্রতিযোগিতায়, ব্রিটিশ সরকারের কাছে মুসলমানদের আত্মপ্রত্যয় বিশ্লেষণে এবং তার সাথে সাথে চলেছে আযাদী আন্দোলনও।

১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বংগ বিভাগের প্রস্তাব দিয়েছিলেন শাসনতান্ত্রিক সুবিধার জন্যে। কিন্তু বংগ বিভাগ যখন হলো এবং মুসলিম অধ্যুসিত পূর্বাঞ্চলের অবহেলিত মানুষের শিক্ষাদীক্ষঅ ও বৈষয়িক উন্নতির দ্বার উন্মুক্ত হলো, তখন এ বিভাগের তীব্র বিরোধিতা শুরু করলো গোটা হিন্দু সমাজ। তাদের এ অন্ধ বিরোধিতায় এ সত্যটিই উদঘাটিত হলো যে হিন্দু মুসলমান দুটি স্বতন্ত্র জাতি, তাদের আশাআকাঙ্খা, ধর্মকর্ম, জীবনের দৃষ্টিভংগী, সমাজ সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনিতর গতিধারা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও পৃথক। এ চেতনায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে ১৯০৬ সালে একটি শক্তিশালী মুসলিম প্রতিনিধিদলের পক্ষ তেকে পৃথক নির্বাচনের দাবী সরকার সমীপে পেশ করা হয়। জাতীয় স্বাতন্ত্রের জন্যে রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য অপরিহার্য বিধায় ১৯০৬ সালে ‘মুসলিম লীগ’ নামে ঢাকার বুকে মুসলমানদের একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান –নতুন রাজনৈতিক ও জাতীয় চেতনার অবশ্যম্ভাবী ফল।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের গালভরা বুলি ছিল এক –জাতীয়তাবাদরে। কিন্তু বংগভংগ রদের জন্যে সমগ্র হিন্দুজাতির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন তাদের এক-জাতীয়তাবাদের মুখোশ উন্মোচন করে দেয়। হিন্দু মুসলমানের স্বাতন্ত্র্য পরিস্ফুট হয়ে পড়ে, পারস্পরিক তিক্ততা উত্তরোত্তর বর্ধিত হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের রূপ ধারণ করে। পলাশীর বিয়োগান্তক নাটকের পর থেকে উনবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ পাদ পর্যন্ত ইংরেজ কর্তৃক যে মুসলিম দলন চলেছিল, তাতে হিন্দুরা ছিল ইংরেজদের একান্ত বশংবদ ও প্রিয়পাত্র। পক্ষান্তরে মুসলমানরা ছিল তাদের কাছে অবিশ্বাস্য ও শত্রু। কিন্তু বংগভংগ, পৃথক নির্বাচন প্রভৃতির দ্বারা তাদের মনে যখন এ ধারণার সৃষ্টি হয় যে, মুসলমাদের প্রতি ব্রিটিশের মনোভাব পরিবর্তিত হয়েছে এবং তারা হয়েছে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল, তখন হিন্দুদের আক্রোশ তাদের ব্রিটিশ প্রভুতের উপরেও পড়ে। তারপর শুরু হয় ব্রিটিশ বিরোধী সন্ত্রাসবাদ।

রাজ পঞ্চম জর্জ ও রাণী মেরী ১৯১১ সালে ভারত ভ্রমণে আসেন। তাঁদের আগমণ উপলক্ষে দিল্লীতে বিরাট আড়ম্বরপূর্ণ এক দরবার অনুষ্ঠিত হয়। দরবার শেষে রাজা সকলকে স্তম্ভিত করে দিয়ে ঘোষণা করলেন, ভারতের রাজধানী কোলকাতা থেকে স্থানান্তরিত হবে দিল্লীতে।পরের ঘোষণাটি অধিকতর বিস্ময়কর ও অপ্রত্যাশিত। তিনি ঘোসনা করেন যে, বংগভংগ রদ করা হলো। এছিল মুসলমানদের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা এবং মুসলমানদের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধিতা তীব্রতর হয়ে উঠে।

পক্ষান্তরে বংগভংগ রদে হিন্দুরা উল্লাসে ফেটে পড়ে। এর ফলে একদিকে যেমন হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে আদর্শিক ও রাজনৈতিক পার্থক্য ও দূরত্ব বাড়তে থাকে, তেমনি বাড়তে থাকে মুসলমানদের ব্রিটিশ বিরোধিতা। মুসলিম লীগের তিন দফাউদ্দেশ্যের মধ্যে প্রথম দফাতেই ব্রিটিশের প্রতি আনুগত্য সৃষ্টির উল্লেখ। কিন্তু রাজা পঞ্চম জর্জের দ্বিতীয় ঘোষণাটি তাদের চিন্তাধারাকে প্রবাহিত করলো ভিন্ন খাতে। ১৯১২ সালে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ অধিবেশনে মুসলমাদের ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সংগঠনের উদ্দেশ্যকে প্রসারিত করার প্রস্তাব গৃহীত হলো। এ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব। এ পরিবর্তিত প্রস্তাব লীগের সম্মুখে পূর্ণ আযাদী অর্জনে স্থির লক্ষ্যকে প্রতিষ্ঠিত করলো। ফলে মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দৃষ্টিও এদিকে আকৃষ্ট হলো।

উল্লেখ্য যে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ লীগের উক্ত অধিবেশনে যোগদান করেছিলেন। তবে লীগের সংগঠন সম্পর্কে তাঁর মধ্যে তখনো কোন উৎসাহ উদ্দীপনা দেখতে পাওয়া যায়নি। লীগের প্রতি তাঁর অনীহা প্রদর্শনের কারণ এই ছিল যে, তখন পর্যন্ত তাঁর মনে এ ধারণা ছিল যে লীগের নীতি ছিল সম্প্রদায় কেন্দ্রিক। তিনি ছিলেন কংগ্রেসের একজন অত্যুৎসাহী সদস্য এবং বিশ্বাসী ছিলেন হিন্দু মুসলিম ঐক্যে। তিনি রাজনীতিতে দীক্ষা গ্রহণ করেন গোপাল কৃষ্ণ গোখেলের কাছে। গোখেল মন্তব্য করেছিলেন, “হিন্দু মুসলিম ঐক্যের দূত হওয়ার যোগ্যতা জিন্নাহর আছে”।

আনুষ্ঠানিকভাবে লীগের সদস্য হওয়াকে তিনি কংগ্রেসের সদস্য থাকার বিরোধী মনে করেননি বলে লীগের সদস্য হন। তাঁর একান্ত বাসনা ছিল লীগ ও কংগ্রেসের সদস্য থেকে তিনি হিন্দু মুসলমানকে  ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করবেন। আপ্রাণ চেষ্টাও করেন তিনি। কিন্তু তাঁর অক্লান্ত মিলন প্রচেষ্টায় তিনি লক্ষ্য করেন যে
, হিন্দু মুসলমানের মিলন ত দূরের কথা সাম্পদায়িক সংঘর্ষের মাধ্যমে তাদের স্বাতন্ত্র্য সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। তাদের উভয়ের রাজনৈতিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পৃথক এবং তাদের কর্মধারাও পৃথক পৃথক খাতে প্রবহমান।

উনিশ শ’ চৌদ্দতে প্রথম বিশ্ব মহাযুদ্ধ শুরু হলে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়েই এ সময়ে ব্রিটিশকে সাহায্য করে। এ সময়ে হিন্দু মুসলিম মিলনের প্রচেষ্টা খুব জোরদার হয়। ১৯১৬ সালে কংগ্রেস-লীদের এক যুক্ত কমিটিতে লক্ষ্ণৌ চুক্তি সম্পাদিত হয়। এ চুক্তির দুটি ফল হয়েছিল। এক –এ চুক্তি পরবর্তীকালের খেলাফত আন্দোলন কালীন কংগ্রেস লীগ ঐক্যের পূর্বসূত্র চিহ্নিত করে। দুই –এ চুক্তির ভিতর দিয়ে একজাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস লীগের রাজনৈতিক অস্তিত্ব ও গুরুত্ব স্বীকার করে নেয়। কংগ্রেস ভারতীয় আইন পরিষদের অস্তিত্ব ও গুরুত্ব স্বীকার করে নেয়। কংগ্রেস মুসলমানদেরকে দিতে রাজী হয়। বাংলাদেশে তারা পারে শতকরা ৪০টি, পাঞ্জাবে ৫০টি, বিহারে ২৫টি, যুক্ত প্রদেশে ৩০টি, এর সাথে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা মেনে নিয়ে কংগ্রেস মুসলিম স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করে নেয়।

কিন্তু লক্ষ্ণৌ চুক্তির বিরুদ্ধে হিন্দুদের পক্ষ থেকে প্রবল বিরোধিতা শুরু হয় এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক হাংগামাও শুরু হয়।

এ জিনিসটি কয়েকবার লক্ষ্য করা হয়েছে যে, যখনই কোন কিছুর ভিত্তিতে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে মিলনের প্রচেষ্টা করা হয়েছে তখনই সংখ্যাগুরু দল সাম্প্রদায়িক হাংগামার সূত্রপাত করে মিলন প্রচেষ্টাকে বানচাল করেছে।

এ কালের তিনটি ঘটনা ইতিহাসে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। খেলাফত আন্দোলন, মোপলা বিদ্রোহ ও হিজতর আন্দোলন। তার পটভূমিকা বর্ণতা করাও প্রয়োজন বোধ করি।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ব্রিটিশের সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করে। তার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তারা আশা করেছিল ব্রিটিশ সরকার তাদের নিম্নতম দাবীসমূহ মেনে নিবে। ১৯১৭ সালে হাউস অব কমন্সে তদানীন্তন সেক্রেটারী অব স্টেট যে ঘোষণা পাঠ করে শুনান, তাতে ভারত উপমহাদেশে একটি দায়িত্বশীল সরকারের ক্রমপ্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু ১৯১৯ সালে যে মন্টেগু চেমন ফোর্ড সংস্কার পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়, তা ছিল লক্ষ্ণৌ চুক্তির বিশ্লেষিত দাবীসমূহের পটভূমিতে খুবই অপ্রতুল। এ সালের আর একটি বিধিবদ্ধ আইন, যা বড়োলাট আইন বলে পরিচিত, ভারতীয়গণকে বিস্মিত ও বিক্ষুব্ধ করে। এ আইনে জুরীর পরামর্শ ব্যতিরেকেই রাষ্ট্রবিরোধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণেল অধিকর সরকারকে দেয়া হয়েছিল। ভারতে যে কোন আন্দোলন দমন করার জন্যেই যে এ আইন পাশ করা হয়েছিল, তা আর কারো বুঝতে বাকী রইলো না। যুদ্ধকালীন অকুণ্ঠ সমর্থনের এই পুরস্কার দেয়া হলো ভারতবাসীকে। এ আইন পাশ হলো ১৮ই মার্চ, গান্ধী তার প্রতিবাদে দেশব্যাপী হরতাল আহবান করলেন ৩০শে মার্চ। হরতাল করতে গিয়ে প্রচন্ড সংঘর্ষ হলো পাঞ্জাবে। তার ফলে নৃশংস হত্যকান্ড অনুষ্ঠিত হলো জালিয়ানওয়ালাবাগে। জেনারেল ডায়ার নির্মমভাবে ১৬৫০ রাউন্ড গুলী চালিয়ে ৩৭৯ জনকে নিহত ও ১১৩৭ জনকে আহত করে এ দেশে ব্রিটিশ শাসনের এক অতি কলংকময় অধ্যায় সংযোজন করে।

খেলাফত আন্দোলন

এসব ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত খেলাফত আন্দোলন। তবে এ সম্পর্কে আরও কিছু কথা বলে রাখা দরকার। ভারতীয় মুসলমারা এ দেশের শাসনক্ষমতা হারিয়ে মনোবেদনা ও আত্মাভিমানে দিন কাটাচ্ছিল। তারা তাদের এ মনোবেদনায় কিছুটা সান্ত্বনা লাভের চেষ্টা করেছিল তুরস্কের সুলতানকে অবলম্বন করে। তুরস্ক শুধু মুসলিম রাষ্ট্রমাত্র ছিলনা, বরঞ্চ তুরস্কের সুলতানকে মুসিলম জাহানের খলিফা ও মুসলিম জাহানের ঐক্যের প্রতীক মনে করা হতো। অবশ্য যতোদিন ভারতে মুগল সম্রাজ্য শক্তিশালী ছিল, ততোদিন তুরস্কের সুলতানকে এ মর্যাদা দেয়া হয়নি। যাহোক, পরবর্তীকালে মুসলমানদের মধ্যে প্যানইসলামী চেতনা তুরস্ককে মুসলিম ঐক্যের প্রতীক হিসাবে গ্রহণ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক ব্রিটিশের বিপক্ষ দলে যোগদান করে। ভারতীয় মুসলশান আশা করেছিল, ব্রিটিশকে তাদের অকুন্ঠ সমর্থনের কারণে তুরস্ককে কোন প্রকার শাস্তি থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে। লয়েড জর্জ সে ধরনের আশ্বাসও দিয়েছিলেন। কিন্তু মুসলিম বিশ্বের ঐক্যপ্রতীক বিনষ্ট করাই ছিল ব্রিটিমের উদ্দেশ্য। তার জন্যেই লরেন্সকে পাঠানো হয় আরবদের মধ্যে আরব জাতীয়তার বিষাক্ত মন্ত্রপ্রচারক হিসাবে। মক্কার শেরিফ শরীফ হুসাইন হাশেমী লরেন্সের প্রচারণায় প্রভাবিত হেয় ‘আরবদদের জাতীয় স্বাধীনতার’ নামে বিশ্বমুসলিম ঐক্য উপেক্ষা করে মুসলমানদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ শুরু করে এবং এভাবে তুরস্কের পৃষ্ঠে ছুরিকাঘাত করে। বাভাভিত্তিক সংকীর্ণ আঞ্চলিক জাতীয়তার বিষবাষ্পে তুরস্কের সুলতানাত তথা মুসলিম বিশ্বের ঐক্যপ্রতীক বিনষ্ট করাই ছিল ব্রিটিশের লক্ষ্য এবং তা ফলপ্রসূ হলো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সম্মিলিত শক্তির জয় হলো এবং তারা যুদ্ধে জয়ী হবার সাথে সাথেই একটি গোপন চুক্তির মাধ্যমে বিরাট তুরস্ক সাম্রাজ্যকে বাঁদরের পিঠা বন্টনের ন্যায় ভাগ বন্টন করে ফেলে। ১৯১৯ সালের মে মাসে উসমানী রাজধানীতে নমসর্বস্ব সুলতান রয়ে গেলো। আলজিরিয়া থেকে বাহরাইন পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চল খন্ডবিখন্ড করে ফ্রান্স, গ্রীস ও বৃটেনের মধ্যে বিতরণ করা হলো।

এভাবে উসমানীয় রাষ্ট্রকে খন্ডবিখন্ড করার কারণে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। মুসলিম নেতৃবৃন্দ ভারতের ভাইসরয়ের কাছে তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন। মওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর এবং সাইয়েদ সুলাইমান নদভী প্রমুখ নেতৃবৃন্দের একটি প্রতিনিধি দল লন্ডন গমন করে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের নিকটে তাঁদের মনোভাব ব্যক্ত করেন। প্রত্যুত্তরে বলা হলো যে, শুধু তুরস্কের ভূখন্ড ব্যতীত অন্যান্য অঞ্চল তুরস্ককে দেয়া যাবে না। তার জন্যে তুরস্ককে খেলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যে ভারতে শুরু হয় প্রচন্ড খেলাফত আন্দোলন।

ভারতে শক্তিশালী খেলাফত কমিটি গঠিত হলো। মুসলমানদের দেড় শতাব্দী ব্যাপী পুঞ্জিভূত ব্যথা-বেদনা খেলাফত সংকটকে সম্মুখে রেখে প্রচন্ড বিক্ষোভের অগ্নিশিখা লেলিহান করে। মুসলিম মানসের জাগরণ প্রচেষ্টার পথিকৃৎ ছিলেন মওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর। তিনি ছিলেন ‘মুক্ত ভারতে মুক্ত ইসলাম’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নদিশারী। তিনি Comrade নামক একটি ইংরাজী পত্রিকার মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে নবজাগরণ সঞ্চারে সচেষ্ট ছিলেন। খেলাফত আন্দোলনে সাড়া দেয়াকে তিনি প্রতিটি মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য বলে উল্লেখ করেন।

কংগ্রেস ও কংগ্রেস সমর্থক জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ খেলাফত আন্দোলনের প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করলো। ১৯১৯ সালের ১০ই আগষ্ট সারা দেশে খেলাফত দিবস পালনের আবহান জানানো হলো। সারাদেশে হরতাল, বিক্ষোভ প্রদর্শন ও সভাসমিতির মাধ্যমে অভূতপূর্ব ও অপ্রতিহত পাণচাঞ্চল্য শুরু হলো। এক মাসের মধ্যে বিশ হাজার মুসলমান কারাদন্ডের জন্যে নিজেদেরকে পেশ করলো। হাটে হাটে মাঠে, শহরে বন্দরে গ্রামেগঞ্জে মানুষের মুখে শুধু খেলাফত আন্দোলনের কথা এবং তার জন্যে যে কোন ত্যাগ ও কুরবানী করার প্রস্তুতি।

নভেম্বর মাসে দিল্লীতে খেলাফত কমিটির অধিবেশন শুরু হয়। মিঃ গান্ধী এতে যোগদান করেন। তিনি তার বক্তৃতায় ব্রিটিশ সরকারের সাথে ‘অসহযোগিতার’ নীতি অবলম্বনে পরামর্শ দেন।

১৯২০ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত খেলাফত কমিটির সম্মেলনে ‘অসহযোগ আন্দোলন’ (Non-Cooperation Movement) করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ তীব্রতর হতে থাকে।

আমি বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত পল্লীর বিদ্যালয়ে ১৯২২ সালে সর্বপ্রথম হাতেখড়ি গ্রহণ করি। যতোটা মনে পড়ে, সেই শৈশবকালে দেখেছি ছাত্র শিক্ষক, চাষীমজুর ও ইতরভদ্রের মধ্যে খেলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংকল্পে আপামর জনসাধারণ সুদৃঢ় ও অবিচল। যে কোন ত্যাগ স্বীকার এবং হাসিমুখে জীবন দান করতে সদাপ্রস্তুত।

কিন্তু এতকিছুর পরেও এ প্রানবন্ত খেলাফত আন্দোলন অপমৃত্যুর সম্মুখীন হয়। তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বের সাথে ইংরেজদের হাত হতে বহু অঞ্চল পুনর্দখল করেন। তুর্কীজাতিকে করেন ঐক্যবদ্ধ এবং তুরস্ককে পুনরায় গৌরবের মর্যাদায় ভূষিত করেন। কিন্তু ক্ষমতা লাভ করার সাথে সাথেই ১৯২২ সালের নভেম্বর সুলতান মুহাম্মদ হাশেমকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে তুরস্কের সর্বশেষ ও কাষ্ঠপুত্তলিকাবৎ খলিফা সুলতান আবদুল মজিদকে দেশ থেকে নির্বাসিত করে খেলাফতের উচ্ছেদ সাধন করেন। ভারতে খেলাফত আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। মুসলমাদের মধ্যে নেমে আসে হতাশা। ডক্টর মঈনুল হক বলেন, “ভারত উপমহাদেশে খেলাফত আন্দোলনের সাষে সংশ্লিষ্ট মুসলমানদের প্রাণে চরম আঘাত করে কামাল আতাতুর্কের পদক্ষেপ। সকলের চেয়ে বেশী প্রাণে আঘাত পান মওলানা মুহাম্মদ আলী। কারণ তিনিই ছিলেন এ আন্দোলনের উৎস ও প্রাণকেন্দ্র। যে শরীফ হুসাইন ছিল ব্রিটিশের তাবেদার এবং যে তার কার্যকলাপের দ্বারা মুসালিম বিশ্বের নিকটে অপ্রিয় হ’যে পড়েছিল, সে এখন কেলাফতের দাবীদার বলে ঘোষণা করলো। এ ব্যাপারে ব্রিটিশ তাকে কোন প্রকার সাহায্য করলোনা। ওদিকে ওহাবী নেতা ইবনে সউদের অভিযান ব্যাহত করার শক্তিও তার হলোনা। বছর শেষ হবার সাথে সাথেই ইবনে সউদ মক্কা ও তায়েফের উপর অভিযান চালিয়ে তা হস্তগত করেন এবং এভাবে হেজাজের অধিকাংশ অঞ্চলের উপরে তিনি অধিকার বিস্তার করেন”।

-(Dr. Moyenal Huq, History of Freedom Movement Vol. 3. Part. 1; আবুল আফাক –একটি জীবন, একটি চিন্তাধারা, একটি আন্দোলন –(উর্দুগ্রন্থ) পৃঃ ৬৯)

হিজরত আন্দোলন

খেলাফত আন্দোলনের সময়ে ভারতে হিজরত আন্দোলন শুরু হয়। মওলানা আবুল কালাম আজাদ রাঁচী জেল থেকে মুক্তিলাভের পর হিজরত আন্দোলন শুরু করেন। আলেমগণ ফতোয়া দেন যে ভারত দারুল হরব এবং এখান থেকে হিজরত করে কোন দারুল ইসলামে যেতে হবে। আফগানিস্তানের বাহশাহ আমীর আমানুল্লাহ খান এক জনসভায় ঘোষণা করেন যে, “ভারতীয় মুসলমানগণ হিজরত করে অবশ্যই আমাদের দেশে আসতে পারেন”। মওলানা আজাদের প্রস্তাবে একেবারে চক্ষু বন্ধ করে মুসলমাগণ হিজরতের জন্যে বদ্ধপরিকর হয়। দিল্লীতে হিজরত কমিটি প্রতিষ্ঠিত হলো এবং যথারীতি অফিস খোলা হলো। এ আন্দোলনের ফলে, যার প্রেরণাদানকারী ছিলেন স্বয়ং মওলানা আবদুল কালাম আজাদ, হাজার হাজার মুসলমান তাদের যথাসর্বস্ব বিক্রি করে আফগানিস্তানের পথে রওয়ানা হলো। ১৯২০ সালের কেবলমাত্র আগষ্ট মাসেই আঠারো হাজার লো হিজরত করে চলে যায়। পাঁচ লক্ষ থেকে বিশ লক্ষ মুসলমান এ আন্দোলনের ফলে বাস্তুহারা হয়েছে এবং তাদের ভাগ্যে জুটেছে বর্ণনাতীত দুর্গতি।

কিন্তু এ আন্দোলনের মূল ছিল নিছক একটি ঝোঁকপ্রবণতা। কোন একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনা ছাড়াই এবং হিজরতের ফলাফল বিচার বিশ্লেষণ না করেই এ আন্দোলনে ঝাঁপ দেয়া হয়েছিল।

আলী সুফিয়ান আফাকী বলেন, “মওলানা মওদূদী এবং তাঁর ভাই হিজরত করতে মনস্থ করেন। হিজরত কমিটির সেক্রেটারী মিঃ তাজাম্মল হোসেন ছিলেন তাঁদের আত্মীয়। তিনি ভ্রাতৃদ্বয়কে হিজরতের জন্যে উদ্বুদ্ধ করেন। কিন্তু আলোচনায় জানা গেল যে হিজরত কমিটির এ ব্যাপারে কোন সুষ্ঠু পরিকল্পনা নেই। দলে দলে লোক আফগানিস্তানে চলে গেলেও আফগান সরকারের সাথে এ ব্যাপারে কোন কথা বলা হয়নি। মুফতী কেফায়েতুল্লাহ ও মওলানা আহমদ সাঈদ এ ব্যাপারে কোন কথা বলা হয়নি। মুফতী কেফায়েতুল্লাহ ও মওলানা আহমদ সাঈদ এ ব্যাপারে ছিলেন অগ্রগামী। মওদূদী সাহেব এ দুজনের সাথে দেখা করে একটি পরিকল্পনাহীন ছিলেন  অগ্রগামী। মওদূদী সাহেব এ দুজনের সাথে দেকা করে একটি পরিকল্পনাহীন আন্দোলনের ত্রুটি বিচ্যুতির প্রতি অংগুলি সংকেত করেন। তাঁরা ত্রুটি স্বীকার করার পর মওদুদী সাহেবকে একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্যে অনুরোধ করেন। মওদুদী সাহেব বলেন যে সর্বপ্রথম আফগান সরকারের নিকটে শুনতে হবে যে তাঁরা হিন্দুস্তান থেকে হিজরতকারীদের পুনর্বাসনের জন্যে রাজী আছেন কিনা এবং পুনর্বাসের পন্থাই বা কি হবে। আফগান রাষ্ট্রদূতের সংগে আলাপ করা হলো। তিনি বলেন যে
‘তাঁর সরকার বর্তমানে খুবই বিব্রত বোধ করছেন। যাঁরা আফগানিস্তানে চলে গেছে তাদেরকে ফেরৎ পাঠাতে অবশ্য সরকার দ্বিধাবোধ করছেন। কিন্তু তথাপি তাদের বোঝা বহন করা সরকারের সাধ্যেল অতীত’। এভাবে হিজরত প্রশ্নটির এখানেই সমাপ্তি ঘটে”।

-(আবুল আফাকঃ ‘একটি জীবন, একটি চিন্তাধারা একটি আন্দোলন’, পৃঃ ৭৭-৭৮)।

এভাবে ভারতে খেরাফত আন্দোলন ও হিজরত আন্দোলনের প্রবল গতিবেগ হঠাৎ স্তব্ধ হ’য়ে গেল এবং দুটি আন্দোলনই ব্যর্থ হলো। এ ব্যর্থতার জন্যে ভারতীয় মুসলমানরা দায়ী ছিলনা মোটেই। তুরস্কের জন্যেই তাদের এ ব্যর্থতা। কামালপাশা শুধু খেলাফতেরই অবসান করেননি। দু’বছর খলিয়াকেও নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন। ভারতে খেলাফত আন্দোলনকে উপলক্ষ করে  যে লেরিহান শিখা জ্বলে উঠ ভারত সরকারকে সন্ত্রন্ত করে তুলেছিল তা অনেকটা ধুম্রজালের ভিতর দিয়েই নিভে গেল মুসলমানদের আশা ও উদ্দীপনাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে।

এ আন্দোলনের ভিতর দিয়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে ঐক্যপ্রচেষ্টা চলছিল, আন্দোলনের ব্যর্থতার সাথে তাও ব্যর্থ হ’য়ে গেল। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে আবার শুরু হলো রক্তাক্ত সংঘর্ষ। খেলাফত আন্দোলনে গান্ধীর সহযোগিতার মধ্যে আন্তরিকতা থাক বা না থাক, এ আন্দোলনকে মন দিয়ে সমর্থন কংগ্রেসের অনেক হিন্দু সদস্যই করতে পারেননি। তাঁদের অনেকের মনেই এ প্রশ্ন ছিল যে মুসলমানদের খেলাফতের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তাদের কি লাভ! তাই খেলাফত আন্দোলত তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ প্রবণতা কিছু দিনের জন্যে দাবিয়ে রাখলেও খেলাফথ আন্দোলনের ব্যর্থতার পর তা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। মসজিদের সামনে জোরজবরদস্তি বাজনা বাজানোর উপলক্ষ করে দাংগা-হাংগামার সূত্রপাত করলো তারা এবং এ দাংগা রক্তাক্ত সংঘর্ষের রূপ ধারণ করে চারদিকে বিস্তার লাভ করতে লাগলো। সম্প্রদায়গত পার্থক্যটা তাদের মধ্যে স্পষ্টতর হতে লাগলো। বিগত দেড় শতাব্দীর অবহেলিত ও পশ্চাদপদ মুসলমান জীবনক্ষেত্রে কোন সুযোগ সুবিধা চাইতে গেলেই সংখ্যাগরিষ্ঠ ও শক্তিশারী সম্প্রদায়ের সাথে বিরোধ হ’য়ে পড়তো অপরিহার্য। বাংলার হিন্দু জমিদারগণ এবং পাঞ্জাবের ব্যবসায়ীগণ এ সময়ে তাদের মুসলমান প্রজা ও খাতকদের উপর চরম নির্যাতন শুরু করেছিল। খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন মানুষের মনে যে বিক্ষোভ প্রকাশের প্রেরণা জাগিয়েছিল, আন্দোলন দুটি স্তব্ধ হ’য়ে যাওয়ার পর সে বিক্ষোভ প্রেরণা সাম্প্রাদায়িক সংঘর্ষের ভিতরদি য়ে প্রকাশ লাভ করলো।

মোপলা বিদ্রোহ

খেলাফত আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত তৎকালীন মোপলা বিদ্রোহ। এই মোপলা বিদ্রোহ দমনে ইংরেজ শাসকদের হিংস্ররূপ যেমন একদিকে পরিস্ফুট হয়েছে, তেমনি মুসলমানদের প্রতি হিন্দুদেরও হিংসাত্মক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

গ্রন্থের প্রারম্ভে মোপলাদের কিছু পরিচয় দেয়া হয়েছে। তারা চিল দাক্ষিনাত্যের মালাবার অঞ্চলের মুসলমান অধিবাসী, তারা নিজেদেরকে আরব বণিকদের বংশদ্ভূত বলে দাবী করে। তারা ছিল অত্যন্ত সাহসী ও ধর্মভীরু। তারা ইংরেজদের দ্বারা শোষিত নিষ্পেষিত হওয়ার কারণে ১৮৭৩, ১৮৮৫, ১৮৯৪ এবং ১৮৯৬ সালে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ফলে ব্রিটিমদের হাতে বার বার নির্যাতিত হয়। চাষ ও মৎস্য ব্যবসা ছিল তাদের প্রধান উপজীবিকা। শিক্ষাদীক্ষায় তারা ছিল অনগ্রসর এবং হিন্দু জমিদার, মহাজন ও তহসিলদার তাদের উপর চরম অত্যাচার উৎপীড়ন করতো। ব্রিটিশ শাসকদের কাছে আবেদন নিবেদন করেও তারা কোন ফল পায়নি। অতএব তাদের নির্যাতনের কাহিনী দীর্ঘদিনের। ব্রিটিশ ও হিন্দু জমিদার মহাজনের নিষ্পেষণে তারা যুগ যুগ ধরে ধুঁকে ধুঁকে মরছিল। তারপর বিংশতি শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শেষে ভারতে শুরু হলো খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন। এ আন্দোলনের ঢেউ মালাবারেও গিয়ে পৌঁছলো। আগেই বলা হেয়ছে মোপলাগণ ছিল স্বাধীনচেতা, সাহসী ও ধর্মভীরু। ইসলামী খেলাফতের পুনরুদ্ধার ও সেইসংগে ভারতে স্বাধীনতা অর্জনের ফলে তাদের দীর্ঘদিনের নির্যাতন নিষ্পেষণের অবসান হবে মনে করে তারাও প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনা সহকারে খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করে। তারপরই তাদের  সংঘর্ষ শুরু হয় শাসকদের বিরুদ্ধে। প্রতিবেশী হিন্দু জনসাধারণ তাদের দমন করার কাজে সর্বতোভাবে সাহায্য করে শাসকশ্রেণীকে। ফলে মোপলাদেরকে একসংগে শাসকগোষ্ঠী ও হিন্দুসম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়।

মোপলা দমন করতে গিয়ে ব্রিটিশ সরকার যে বর্বরতা ও নৃশংসতা প্রদর্শন করেছিল, সে লোমহর্ষক ও মর্মন্তুদ কাহিনী বর্ণনা করার ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় না। তাদের উপর অত্যাচার নির্যাতন চলাকালে সরকার সমগ্র মালাবারে জনসভায় অনুষ্ঠান, বাইর থেকে সংবাদ ও সংবাদপত্রের প্রবেশ এবং মালাবার থেকে বাইরে বিনা সেন্সারে সংবাদাদি, টেলিগ্রাম ও পত্রাদি প্রেরণ নিষিদ্ধ ঘোসণা করে। মালাবারকে এক লৌহ যবনিকার অন্তরালে রাখা হয়। তবুও যদি কোন প্রকারে তাদের নির্যাতনের কাহিনী বাইরে প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং বহির্জগতের মানুষ বিশেষ করে মুসলমান তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়ে, তার জন্যে মোপলাদের বিরুদ্ধেই স্বার্থান্ধ মহল তীব্র প্রচারণা শুরু করে। সেসব প্রচারণা ছিল অমূলক, বানোয়াট ও কল্পনাপ্রসূত। ১৯২২ সালে সাহারানপুর ও অমৃতশহর থেকে হিন্দুদের দ্বারা দু’খানি প্রচার পত্রিকা প্রকাশিত হয়।

অমৃতশহর থেকে প্রকাশিত ‘দাস্তানে জুলুম’ শীর্ষক পুস্তিকায় মোপলাদের পক্ষ থেকে হিন্দুদের উপর অকথ্য অত্যাচার-কাহিনী বর্ণনা করে হিন্দু সম্প্রদায়কে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, হিন্দু নারী হরণ, বলপূর্বক ইসলাম ধর্মে দীক্ষিতকরণ প্রভৃতি অভিযোগ করা হয় মোপলাদের বিরুদ্ধে। বিবরণে বলা হয়েছে যে –উৎপীড়নের শিকার যদি হিন্দু পুরুষ হয় তাহলে তাকে প্রথমতঃ গোসল করিয়ে মুসলমানী ধরনে চুল কেটে দেয়া হয় অতঃপর মসজিদে নিয়ে কালেমা পাঠ করতে বাধ্য করা হয়, খৎনা করানো হয় এবং মুসলমানী পোষাক পরিধান করানো হয়। মহিলা হলে শুধু তাকে এক ধরনের রঙিন মোপলা পোষাক পরিধান করানো হয় এবং এক ধরনের কানবালা পরিয়ে দেয়া হয়।

সাহারানপুর থেকে প্রকাশিত ‘মালাবার কি খুনী দাস্তান’ পুস্তিকায় বলা হয়েছে যে, মোপলাগণ প্রতিবেশী হিন্দুদেরকে খেলাফত আন্দোলনে যোগদানের আহবান জানায়। যোগদান করলে ভালে, নচেৎ অস্বীকারকারীকে মোপলাদের ঘরে আবদ্ধ করে তাদের বলপ্রয়োগ গোমাংস ভক্ষণ করানো হয়। অতঃপর তার আত্মীয় স্বজনকে তার সম্মুখে হত্যা করা হয়। এতেও রাজী না হলে তাকে হত্যা করে তার খন্ডবিখন্ড মৃতদেহ কোন কূপের মধ্যে নিক্ষেপ করা হয় এবং তার বাড়ীঘর ভস্মীভুত করা হয়।

একদিকে যেমন হিন্দু-মুসলিম মিলনের প্রচেষ্টা চলছিল, হিন্দু-মুসলিমের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের মনমানস তৈরীরকাজ চলছিল, অপরদিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দু সম্প্রদায়কে ক্ষিপ্ত করে শুধু খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন থেকেই তাদের নিবৃ্তত করা হচ্ছিল না, বরং সারাদেশে পাইকারী হারে মুসলিম নিধনযজ্ঞের আহবান জানানো হচ্ছিল। স্বাদীনতা অর্জন অপেক্ষা মুসলিম নিধন একশ্রেণীর লোকের কাছে অধিক প্রিয় ছিল। তাই তারা কাল্পনিক কাহিনী প্রচার করে সাম্প্রদায়িক আবহাওয়া বিষাক্ত করে তোলে, যার ফলে নুতন আকারে ভারতব্যাপী দাংগাহাংগামার সূত্রপাত হতে থাকে।

এসব মারাত্মক প্রচারণা খেলাফত আন্দোলনকারী মুসলমানদের দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। কেন্দ্রীয় খেলাফত কমিটি মোপলাদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহের জন্যে একটি কমিটি নিয়োগ কতের পাঠান এবং তারা যে রিপোর্ট পেশ করেন তাতে মোপলা বিদ্রোহের জন্যে স্থানীয় সরকারী কর্মচারীদেরকে প্রধানতঃ ও প্রথমতঃ দায়ী করেন। তারা বলেন যে, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও শান্ত ছিল এবং বিদ্রোহের কোন চিহ্নই পরিলক্ষিত হয়নি। ভারতের অন্যাণ্য অঞ্চলের মুসলমানদের ন্যায় মোপলা মুসলামানগণও খেলাফত আন্দোলনে যোগদান করে এবং স্থানীয় সরকার তা কঠোর হস্তে দমন করার জন্যে উঠেপড়ে লাগে। পুলিশের বর্বরতা তাদেরকে বিদ্রোহ করতে বাধ্য করে। সংঘর্ষের সূচনা এভাবে হয় যে, স্থানীয় খেলাফত কমিটির সেক্রেটারীকে পুলিশ গ্রেফতার করে একটি গাছের সাথে বেঁধে রাখে। অতঃপর তার স্ত্রীকে তাঁর সম্মুখে এনে বিবস্ত্র করা হয় এবং তিনি অসহায়ের ন্যায় সেদিকে তাকিয়ে থাকেন। পুলিশ কনস্টেবল চপেটাঘাত করে। অতঃপর অন্য একজন খেলাফত কর্মীকে অস্ত্র নির্মাণের কল্পিত অভিযোগ অভিযুক্ত করা হয়। অবশেষে পুলিশ মোপলাদের বাড়ীঘরের উপর চড়াও হয়, তাদের যাবতীয় জিনিসপত্র লুণ্ঠন করে এবং কোথাও বাড়ীর লোকজনের উপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। এতেও নিরস্ত্র না হয়ে তারা মোপলাদের উপর বেপরোয়া  গুলীবর্ষণ করে। মোপলাগণ স্বভাবতঃই চিল স্বাধীনচেতা
, সাহসী ও বীর যোদ্ধা। তাদের উপর যখন এরূপ নির্মম অত্যাচার চালানো হয়, তখন তারা মরণপণ করে পুলিশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং শেষ পর্যন্ত সংগ্রামের জন্যে বদ্ধপরিকর হয়। অতঃপর যে সংগ্রাম শুরু হয়, সে সংগ্রামে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মিলিত শক্তি পরাজয় বরণ করে এবং কর্মস্থল থেকে বিতাড়িত হয়। তারা বহু অস্ত্রশস্ত্র ছেড়ে পলায়ন করে। অতঃপর পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে মোপলাদের আয়ত্তাধীন হয়। এযাবত হিন্দুদের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিল ভালো। উত্তেজনাময় পরিস্থিতিতে মোপলাগণ হিন্দুদের জীবন ও ধনসম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ করে। ১৯২১ সালের আগষ্ট মাসে মোপলাগণ দস্তুরমত স্বাধীনতা ঘোষণা করে। বিদ্রোহ শুরু হওৱয়া এক সপ্তাহের মধ্যেই মোপলাগণ ব্রিটিশ সরকারের নিকট থেকে এরনা এবং ওয়ালুভানাদ নামক দুটি বৃহৎ তালুক ছিনিয়ে নিয়ে সেখানে একটি স্বাধীন খেলাফূত রাজ্য স্থাপন করে।

দু’সপ্তাহ পরে ব্রিটিশ সরকার মালাবারে শত শত সৈন্য, ছোটবড়ো ট্যাংক, কামান, বোমা, কয়েকখানি গানবোট এবং রণপোত প্রেরণ করে এমন এক অব্সথার সৃষ্টি করে যেন কোন বিরাট শক্তির বিরুদ্ধে এক মহাযুদ্ধ শুরু হয়েছে। প্রথম সংগ্রামের সময় পুলিশের ন্যায় কয়েকজন অত্যাচারী জমিদার মহাজন জনতার রুদ্রোরোষে পড়ে প্রাণ হারায়। ব্রিটিশ সরকার একে সম্পদায়িক রূপ দিয়ে হিন্দুদেরকে মোপলাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। তখন হিন্দু জনসাধারণ ও  জমিদার মহাজন সৈন্য ও পুলিশের সহায়তায় এগিয়ে আসে। হিন্দুদের অধিকাংশই মোপলাদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি শুরু করে এবং অন্যায়ভাবে তাদেরকে ধরিয়ে দিতে থাকে। ফলে ব্রিটিশ এবং হিন্দু উভয়ের বিরুদ্ধেই সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। কিন্তু হতভাগ্য মোপলাগণ বিরাট সুসংহত ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে কতক্ষণই বা লড়তে পারে
? ভারত থেকে আর্যসমাজের শত শত স্বেচ্ছাসেবক সাহায্য বিতরণের নাম কের মালাবারে গিয়ে পুলিশ ও সৈন্যদেরকে নানাভাবে সাহায্য করতে থাকে।

মোপলাগণ অসীম সাহসিকতার সাথে একমাস কাল ব্রিটিশ ও হিন্দুদের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম চালায়, সরকার মোপলা এলাকাসমূহের উপর আকাশ থেকে বোমা রণতরী ও কামান থেকে নির্বিচারে গোলাবর্ষন করে প্রায় দশ হাজার নরনারীর প্রাণনাশ  করে
, তাদের বাড়ীঘর, দোকান পাট ও ক্ষেতখামার ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। তারপর হিন্দু জনসাধারণের সহায়তায় শুরু হয় পাইকারী হারে ধরপাকড়, পৈশাচিক অত্যাচার ও নির্যাতন । সরকারের পৈমাচিকাত ও বর্বরতার দৃষ্টান্ত একটি ঘটনার দ্বারা প্রমাণ পাওয়ো যায়। প্রায় একশ’জন বিশিষ্ট মোপলা নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার করে একটি মালগাড়ীতে বোবঝাই করা হয় এবং দরজা বন্ধ করে তাদেরকে কালিকট প্রেরণ করাহয়। গন্তব্যস্থানে দরজা খোলা হলে দেখা গেল ষাটজন মৃত্যুবরণ করেছে এবং অবশিষ্টজন মুমূর্ষু অবস্থায় রয়েছে। তাদের মৃতদেহের প্রতিও কোন সম্মান প্রদর্শন করা হয়নি, মানুষের প্রতি মানুষের এ ধরনের পৈমাচিক ও নৃশংস ব্যবহার সত্যযুগে ত দূরের কথা আদিম যুগের ইতিহাসেও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

ব্রিটিশ সরকারের পুলিম ও সৈন্যদের অত্যাচার নির্যাতনের পর যারা বেঁচে রইলো তাদের বিচার শুরু হলো। প্রায় বিশ হাজার মোপলা নরনারীকে গ্রেফতার করা হয়। জেল হাজ্জতেও এদের উপর অমানুষিক অত্যাচার করা হয়। তাদের বিচারের জন্যে সরকার স্পেশাল কোর্ট গঠন করে। বাইরে থেকে কোন আইনজীভীকে মালাবারে প্রবেম করতে দেয়া হয়নি বলে হতভাগ্য মোপলাগণ আত্মপক্ষ সমর্থনেও সুযোগ পায়নি। বিচার চলাকালে বিচারাধীন আসামীদের ঘরে ঘরে অন্নবস্ত্রের হাহাকার শুরু হয়। অন্নাভাবে বুহ নরনারী ও শিশু মৃত্যুবরণ করে। এ সময়ে উৎপীড়িতের মর্মন্তুদ হাহাকার ও ক্রন্দন রোলে মালাবারের আকাশ বাতাস ধ্বনিত ও মতিত হয়। প্রায় এক হাজার লোকের প্রাণদন্ড হয়। যাবজ্জীবন কারাদন্ড, দীর্ঘমেয়াদী সশ্রম কারাদন্ড প্রাপ্ত ও দ্বীপান্তরিত মোপলাদর সংখ্যা দু’হাজারে উপর। অতি অল্প সংখ্যক মোপলাকে খালাস দেয়া হয়। পাঁচ থেকে দশ বছর সশ্রম কারাদন্ড লাভ করেছিল প্রায় আট হাজার মোপলা। অবশিষ্টদের মধ্যে কারও কারাদন্ড ছয় মাসের কম ছিলনা। উপদ্রুত এলকাসমূহের সমজিদগুলির প্রায় সকল ইমামইর রাজদ্রোহিতায় অভিযুক্ত হন। এভাবে মসজিদগুলিকেও ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া হয়। দন্ডপ্রাপ্ত মোপলাগণ দ্বীপান্তরে কয়েক বৎসর বর্ণনাতীত দুঃখকস্ট ভোগ করার পর সরকার তাদের পরিবারবর্গকে আন্দামান গিয়ে তাদের সংগে বসবাসের অনুমতি দেয়। এভাবে মালাবার থেকে মোপলাদের একেবারে প্রায় উচ্ছেদ করে ব্রিটিশ সরকার আত্মপ্রসান লাভ করে।

ভারতের খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের ইতিহাসে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক মোপলাদের উপর অত্যচার নির্যাতনের কাহিনী সর্বাপেক্ষা মর্মন্তুদ ও হৃহয়স্পর্শী। গান্ধী ও কংগ্রেস এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব ভূমিকা পালন করে।

খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের প্রবল প্লাবনে সে সময়ে মুসলিম জীবন্মৃত অবস্থায় ছিল এবং তাদের ক্ষীণকণ্ঠের আওয়াজ ব্রিটিম সরকারের কর্ণকুহরে পৌঁছায়নি। বহু কষ্টে একমাত্র খেলাফত কমিটি অসহায় মোপলাদের কিছু সাহায্যদান করতে পেরেছিল। নতুবা আরও বহু মোপলা নরনারী ও শিশু অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো। মোপলাদের প্রতি কংগ্রেসের আচরণে কংগ্রেসের বহু মুসলিশ সদস্য বেদনাবোধ করেকংগ্রেসের সমর্থন ছিল বলেই কংগ্রেস নীরবতা অবলম্বন করে।

ব্রিটিশ সরকার ও হিন্দু মুসলিমকে পাশাপাশি রেখে বিগত কয়েক শতাব্দীর ভারতের ইতিহাস আলোচনা করে একথাই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এ উপমহাদেশে ব্রিটিশ ও হিন্দুসম্প্রদায় মুসলমানদের পরম শত্রুরূপে তাদের ভূমিকা পালন করতে কোন দিক দিয়ে ত্রুটি করেনি। এ উপমহাদেশ থেকে মুসলিশ জাতির উচ্ছেদ সাধনই ছিল তাদের একমাত্র লক্ষ্য। পরবর্তী ইতিহাস আলোচনায় এ সত্য অধিকতর সুস্পষ্ট হবে।

(Muslim Separatism in India. Abdul Hamid এবং আমাদের মুক্তি সংগ্রাম, মুহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ দ্রষ্টব্য)।

চরম নৃশংসতার সাথে মোপলাদের বিদ্রোহ দমন, খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতা এবং মোপলাদের প্রতি কংগ্রেস ও গান্ধীর সম্পূর্ণ উদাসীনতা হিন্দুমুসলিম সম্পর্কে পুনরায় ফাটল সৃষ্টি করে। ১৯২৪ সালে মিঃ গান্ধী কর্তৃক প্রেরিত ডাঃ মাহমুদ মালাবারের হিন্দুসম্প্রদায়ের নিকট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে গান্ধীকে যে রিপোর্ট দেন তাতে বলা হয় যে মোপলাদের অভিযোগ আছে। হিন্দুদেরকে বলপ্রয়োগে মুসলমান করার অভিযোগ সম্পূর্ণ অমূলক ও ভিত্তিহীন। তদুত্তরে গান্ধী বলেন, “প্রকৃত সত্য কারোই জানা নেই”।

-(Tha Indian Quarterly Register, 1942, Vol.1.No.2.p.645; Muslim Separatism in India, A Hamid.p.160)

গান্ধীর উপরোক্ত উক্তিতে এ কথারই প্রমাণ পাওয়া যায় যে, মুসলমানদের কোন কথাই তাঁর বিশ্বাস্য নয় এবং হিন্দু যা কিছুই বলুক তা তিনি বেদবাক্যরূপে গ্রহণ করতে রাজী।

এসব দুঃখজনক ঘটনার পর যা ঘটলো, তা অধিকতর দুঃখজনক। ১৯২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মুলতানে মহররমকে কেন্দ্র করে হিন্দুরা মুসলমানদের উপর আক্রমণ চালায়। পরের বছর অবস্থার চরম অবনতি ঘটে সাহরানপুরে যেখান থেকে –আগের বছর ‘মালাবার কি খুনী দাস্তান’ শীর্ষক পুস্তিকা বিতরণের মাধ্যমে হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দেয়া হচ্ছিল। সাহরানপুরের এ সাম্পদায়িক সংঘর্সে ৩০০ জন নিহত হয় এবং তার অধিকাংশ ছিল মুসলমান। ১৯২৪ সালে বিভিন্ন স্থানে ১৮টি দাংগাহাংগামা সংঘটিত হয়। এ সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ দ্রুত গতিতে বিহার ও বাংলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এবং ১৯২৬ সাল পর্যন্ত ব্যাপক আকার ধারণ করে।

ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদের উপর সুপরিকল্পিত হামলা

ভারতীয় মুসলিম লীগ ক্রমশঃই তাদের জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলছিল। খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে তারা জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে আগেই পিছিয়ে পড়েছিল। সারাদেশে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাংগাহাংগামার সময় পুলিশ সাহায্যপুষ্ট হিন্দুদের সাথে তারা পেরে উঠছিল না। অতএব হাংগামায় মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য সাহায্য করাও তাদের সাধ্যের অতীত ছিল। এদিকে অহিংসাবাদী ও সাম্প্রদায়িক মিলনে আস্থাবান বহু কংগ্রেসী সদস্য দাংগা-হাংগামায় উস্কানী দিতে থাকায় কংগ্রেসও মুসলমানদের কাছে ঘৃণার পাত্র হয়ে পড়ে। মুসলমানরা সাম্প্রদায়িক মিলনের আশায় অতিরিক্ত উদারতা প্রদর্শন করতে গিয়ে ইসলামের চিরাচরিত নীতি ভংগ করে। আর্যসমাজের নেতা স্বামী শ্রদ্ধানন্দকে তারা দিল্লী জামে মসজিদের পবিত্র মিম্বর থেকে বক্তৃতা করার অনুমতি প্রদান করে। মসজিদের পবিত্রতা ক্ষুণ্ণ করে তাঁকে তথা হিন্দুসমাজকে মুসলশানরা যে অভূতপূর্ব উদারতা প্রদর্শন করলো তার প্রতিদান স্বামী শ্রদ্ধানন্দ এমনভাবে দিলেন যে তা বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাসে এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত হিসাবে অটুট রইলো।

উল্রেখ্য যে এই আর্যসমাজী নেতা কংগ্রেসেরও একজন বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন এবং অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করে কারাবরণ করেন। লাহোর জেলে থাকাকালীন পাঞ্জাবের জনৈক উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারীর সাথে তাঁর গোপন শলাপরামর্শ হয় এবং মিয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই মুক্তিলাভ করেন। জেল থেকে মুক্তি লাভ করেই তিনি মুসলমানেরকে হ্নিদুধর্মে দীক্ষিত করে তাদেরকে এক নুতন অস্পৃশ্য নিম্নজাতিতে পরিণত করাই ছির তাঁর উদ্দেশ্য। এভাবে মুসলমান জাতিকে একটা অপবিত্র জাতির পর্যায়ে ঠেলে দিবার প্রচেষ্টায় তিনি মেতে উঠলেন। গুরগাও, আলোয়ার, ভরতপুর প্রভৃতি স্থানে বুহ সংখ্যক অশিক্ষিত মুসলমানকে নানা প্রলোভন ও ভীতি প্রদর্শন করে ধর্মান্তরিত করা হতে থাকে। ধর্মান্তরের পূর্বে মুসলমাদেরকে গোবরের পানি খেতে এবং গোবর পানিথে আপাদমস্তক ধুয়ে অবগাহন করতে বাধ্য করা হতো। বলপ্রয়োগে এভাবে নিরীহ ও নিরক্ষর মুসলমানদেরকে হিন্দুধর্মে দীক্ষিত করার কাজ পূর্ণউদ্যমে চলতে লাগলো।

মুসলমান এবং তাদের ধর্শের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের কোনকালেই কোন শ্রদ্ধার মনোভাব ছিলনা। নতুবা ইচ্ছা করলে এ ধর্মীয় উৎপীড়ন তারা অনায়াসেই বন্ধ করতে পারতো। কিন্তু তারা সম্পূর্ণ নীরবতা অবলম্বন করে রইলো। আর্যসমাজীদের এ অশুভ তৎপরতা, (সম্ভবতঃ কতিপয় শক্তিশালী ইংরেহ রাজকর্মচারীর ইংগিতে) মুসলমানদেরকে এতখানি বিক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত করে তুলেছিল যে, জনৈক আবদুল রশীদ প্রকাশ্য দিবালোকে শ্রদ্ধানন্দনকে হত্যা করে এ অশুভ তৎপরতার সমাপ্তি ঘটায়। বিচারে এই অজ্ঞাতকুলশীল আবদুর রশীদের প্রাণদন্ড হলে সে হাসিমুখে ফাঁসিমঞ্চে আরোহণ করলো।

এ ঘটনার পর স্বয়ং গান্ধীজি প্রকাশ্যে ইসলাম ধর্মের প্রতি কটুক্তি করা শুরু করেন। তিনি প্রকাশ্যে জনসভায় বলতে থাকেন, “ইসলাম অন্য ধর্মাবলস্বীকে হত্যা করার মন্ত্রে দীক্ষা দেয় এবং এটাকে মুসলমানরা মনে করে পরকালের মুক্তির উপায়”।

গান্ধীর উপরো্কত উক্তিতে মুসলিম ভারত মর্মাহত ও বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। মওলানা মুহাম্মদ আলী দিল্লীর জামে মসজিদে একদা বক্তৃতা প্রসঙ্গে দুঃখ প্রকাশ করে বলেণ “গান্ধীজির এ উক্তির দাঁতভাঙা জবাব দেয়া দরকার। কারণ তাঁর এ উক্তিতে ইসলামের পবিত্র ও মহান জেহাদের অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে”।

অতঃপর মওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী “আল জিহাদু ফিল ইসলাম” নামক একখানি অতীব যুক্তিপূর্ণ প্রামাণ্য গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। এ গ্রন্থে তিনি ইসলামের মূলনীতি, তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ, ইসলামী যুদ্ধ ও সন্ধি, আন্তর্জাতিক নীতি ও সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয়ে বিশদ পান্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা করেন এবং ইসলাম ও ইসলামী জেহাদ সম্পর্কে গান্ধীজি তাঁর উক্তির দ্বারা যে ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা করেন তা খন্ডন করা হয়।

এ গ্রন্থটি সম্পর্কে কিছু কথা পাঠকবর্গের গোচরীভূত করা অপ্রাসাংগিক হবেনা করে মনে করি।

এ বিরাট গ্রন্থখানির প্রথম পাঁচটি অধ্যায়ে ইসলামী জিহাদের মর্যাদা, আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ, সংস্কারমূলক যুদ্ধ, ইসলাম প্রচার ও তরবারী এবং যুদ্ধ ও সন্ধি সম্পর্কে ইসলামী আইন কানুনের উপর বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে।

ষষ্ঠ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্মের যুদ্ধ নীতি।

সপ্তম অধ্যায়ে বর্তমান সভ্যতার অধীনে পরিচালিত যুদ্ধ ও সন্ধিকে আলোচনার বিষয়বস্তু করা হয়েছে। এ কথা দ্বিধাহীন চিত্তে বলা যেতে পারে যে, বিষয়টির ওপর এমন তথ্যবহুল, যুক্তিপূর্ণ ও প্রামাণ্য গ্রন্থ আজ পর্যন্ত দুনিয়ার কোন ভাষায় কারো দ্বারা লিখিত হয়নি।

এ সম্মান আল্লাহ তায়ালা দান করেন, একমাত্র মওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীকে।

আল্লাহ ইকবাল গ্রন্থটির ভূয়সী প্রশংসা করেন। গ্রন্থটি বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়েছে, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৫৯২।

সংগঠন আন্দোলন

‘সংগঠন আন্দোলনের’ নেতা লালা হরদয়াল প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন যে, মুসলমানদেরকে হয় হিন্দুধর্মে দীক্ষিত হতে হবে, নতুবা তাদেরকে পাততাড়ি গুটিয়ে ভারত ত্যাগ করতে হবে।

১৯২৫ সালে জনৈক হিন্দুনেতা সত্যদেব ঘোষণা করেন, “আমরা যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসাবে শক্তিশারী, তখন মুসলমানদের নিকটে নিম্ন শর্তাবলী পেম করবঃ

“কোরআনকে ঐশীগ্রন্থ হিসাবে মানা চলবে না, মুহাম্মদকে নবী বলেও স্বীকার করা হবে না। মুসলমানী উৎসবাদি পরিত্যাগ করে হিন্দু উৎসব অনুষ্ঠান পালন করতে হবে। মুসলমানী নাম পরিহার করে রামদীদ, কৃষ্ণখান প্রভৃতি নাম রাখতে হবে। আরবী ভাষার পরিবর্তে হিন্দি ভাষায় উপাসনা করতে হবে”।

-(A History of Freedom Movement, Bengali Muslim Public Opinion Reflected in the Bengali Press -1901-30 Mustafa Nurul Islam.)

আর্যসমাজীয় শুদ্ধি আন্দোলনের সমসাময়িককালে ডঃ মুঞ্জে ও ভাই পরমানন্দ ‘সংগঠন’ আন্দোলনের মাধ্যমে হিন্দুদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তোলেন। ফলে বিভিন্নস্থানে রক্তক্ষয়ী সাম্পদায়িক সংঘর্ষের উৎপত্তি হয়। অবস্থা চরম অবনতির দিকে ধাবিত হলে ডাঃ সাইফুদ্দীন কিচলু আন্দোলনসহ ময়দানে নেমে পড়েন। তাঁদের অক্লান্ত ‘প্রচেষ্টায়, ‘শুদ্ধি’ ও ‘সংগঠন’ আন্দোলনের মারাত্মক গতিবেগ খানিকটা প্রশমিত হয়।

কিন্তু হিন্দুদের অন্তর থেকে সাম্প্রদায়িক অগ্নিশিখা নির্বাপিত হয়নি কিছুতেই। লাহোরের রাজপাল নামক জনৈক আর্যসমাজী মুসলিম-বিদ্বেষাগ্নি পুনরায় প্রজ্জ্বলিত করে। ‘রঙিলা রসূল’ নামে একখানি পুস্তক সে প্রকাশ করে যার মধ্যে বিশ্বনবী মুহাম্মদ মুস্তাফার চরিত্রে জঘন্য ও কৃৎসিত কলংক আরোপ করা হয়। এর দ্বারা মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতির উপর চরম আঘাত করা হয়। এবার ইলমুদ্দীন নামক জনৈক মুসলমান রাজপালকে হত্যা করে সহাস্যে ফাঁসীর মঞ্চে গমন করেন।

মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলের স্বাতন্ত্র দাবী

সাম্প্রদায়িক দাংগা-হাংগামার গতিবেগ প্রশমিত না হয়ে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এক ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ১৯২৭ সালে কানপুরের মওলানা হসরত মোহানী ভারতের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলের স্বাতন্ত্রের দাবী সম্বলিত একটি প্রস্তাব সংবাদপত্রে বিবৃতির মাধ্যমে পেশ করেন। একে বলা যেতে পারে পাকিস্তান আন্দোলনের প্রথম পথের দিশারী।

সর্বদলীয় সম্মেলন

এদিকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যে মওলানা মুহাম্মদ আলী, মিঃ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, হাকিম আজমল খান, মিসেস সরোজিনী নাইডো, রাজা গোপালাচারিয়া, ডাঃ আনসারী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু দাংগা প্রতিরোধের কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অবশেষে ১৯২৮ সালে কোলকাতায় অনুষ্ঠিতব্য কংগ্রেস অধিবেশনের প্রাক্কালে এক সর্বদলীয় সম্মেলন আহুত হয়। ভারতের নেতৃস্থানীয় হিন্দু, মুসলমান ও শিখ সম্মেলনে যোগদান করেন। কংগ্রেসের বিদায়ী সভাপতি ডাঃ মুখতার আহমদ আনসারী সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। কিন্তু উগ্রপন্থী হিন্দুদের হঠকারিতায় সম্মেলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে মুসলমানরা তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলির আইন পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ থেকে তাদের প্রাপ্য আসন সংখ্যার কিছু সংখ্যক আসন অমুসলমানদেরকে ছেড়ে দিতে আগ্রহী হয় এবং এর বিনিময়ে কেন্দ্রীয় আইন সভায় তাদের ন্যায্যা প্রাপ্য আসন অপেক্ষা শতকরা তিনটি আসন সংখ্যার কিছু সংখ্যক আসন অমুসলমানদেরকে ছেড়ে দিতে আগ্রহী হয় এবং এর বিনিময়ে কেন্দ্রীয় আইন সভায় তাদের ন্যায্যা প্রাপ্য আসন অপেক্ষা শতকরা তিনটি আসন অতিরিক্ত দাবী করে। এ ছিল অধিক সংখ্যক আসন ছেড়ে দিয়ে কেন্দ্রে সামান্য কিছু লাভ করার দাবী। কিন্তু সম্মেলনের হিন্দু এবং শিখ নেতৃবৃন্দের অধিকাংশই এ প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে এবং অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। মুসলমানদের পক্ষ থেকে বৃহত্তর উদারতার বিনিময়ে সামান্য উদারতা প্রদর্শনের জন্যে মিঃ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর পুনঃ পুনঃ আবেদন ব্যর্থ হয়। ফলে সর্বদলীয় সম্মেলন কোন সিদ্ধান্ত ব্যতিরেকেই চরম ব্যর্থতার সাথে শেষ হয়।

মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঐতিহাসিক চৌদ্দ দফা

মিঃ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রথমে কংগ্রেসের একজন অতি উৎসাহী ও একনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন এবং তিনি ছিলেন হিন্দু মুসলিম মিলনের দূত। কিন্তু তাঁর দীর্ঘদিনের মিলন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তিনি কংগ্রেসের হিন্দু সদস্যদের আচরণ এবং মুসলমানদের প্রতি তাদের বৈরী নীতিতে অত্যন্ত ব্যথিত হন। অতঃপর ১৯২১ সালের ডিসেম্বর কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে কংগ্রেসের সাথে তাঁর দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিন্ন করেন। কিন্তু ১৯২৮ সালে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সম্মেলনের পূর্ব পর্যন্ত প্রকাশ্যে কংগ্রেসের বিরোধিতা থেকে বিরত থাকেন। এ সম্মেলনে হিন্দু ও শিখদের বিদ্বেষাত্মক মনোভাব লক্ষ্য করে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হন। তার পর পরই দিল্লঈতে অনুষ্ঠিত মুসলিম কনফারেন্সে তিনি তাঁর চৌদ্দ দফা প্রস্তাব পেশ করেন। এ চৌদ্দ দফার বিশেষ উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল বোম্বাই থেকে সিন্ধুকে পৃথক করে সিন্ধুপ্রদেশ গঠন, বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশে শাসন সংস্কার প্রবর্তণ, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলির আইন পরিষদে জনসংখ্যার অনুপাতে আসন বন্টন এবং দেশের স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলিতে প্রতিনিধি নির্বাচনে মুসলমানদের জন্যে পৃথক নির্বাচন প্রবর্তন। তখন থেমে মিঃ জিন্নাহ (পরবর্তীকালে কায়েদে আজম) কংগ্রেস বিরোধিতায় হ’য়ে পড়েন সোচ্চার। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মিঃ রামজে ম্যাকডোনাল্ডের সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদে (Communal Award) ‘চৌদ্দ দফার’ অধিকাংশ দফা স্বীকৃতি লাভ করে। এ চৌদ্দ দফার বাইরে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ উড়িষ্যা এবং আসাম দুটি পৃথক প্রদেশের মর্যাদা লাভ করে।

সাইমন কমিশন

ভারত শাসন সম্পর্কে ভবিষ্যৎ নীতি নির্ধারণের উদ্দেশ্যে অথবা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন দাবিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার ১৯২৮ সালে ভারতে একটি রয়েল কমিশন প্রেরণ করেন। এ কমিশনের সভাপতি ছিলেন স্যার জন সাইমন। কমিশনে কোন ভারতীয় সদস্য নেয়া হয়নি বলে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি এ কমিশন বর্জনের সিদ্ধান্ত করে। কমিশনের সদস্যগণ বোম্বাইয়ে অবতরণ করলে তাঁদেরকে কৃষ্ণ পতাকা দেখানো হয়। যাহোক, সাইমন কমিশন লন্ডনে একটি গোলটেবিল বৈঠকের সুপারিশ পেশ করে।

গোলটেবিল বৈঠক

সাইমন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ১৯৩০ সালে লন্ডনে গোলটেবিল বৈঠক আহুত হয়। কংগ্রেস এ বৈঠকে যোগদান করা থেকে বিরত থাকে। আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন মওলানা মুহাম্মদ আলী, মিঃ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মিঃ এ, কে, ফজলুল হক, স্যার মুহাম্মদ ইসমাইল, আগা খান, স্যার আবদুল কাইয়ুম, স্যার আবদুল হালিম গজনবী, স্যার হায়দারী, স্যার মুহাম্মদ শফি, স্যার শাহ নওয়াজ ভুট্টু প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। মুসলিম সদস্যগণ লন্ডনে পৌঁছে মহামান্য আগা খানকে তাঁদের নেতা নির্বাচিত করেন।

প্রায় দু’মাসকাল বৈঠক স্থায়ী হয়। মওলানা মুহাম্মদ আলী ভগ্নস্বস্থ্য নিয়ে বৈঠকে যোগদান করেন এবং অসুস্থ অবস্থায় আসনে উপবেশন করেই তাঁর নব্বই মিনিটব্যাপী দীর্ঘতম ভাষণ দান করেন। এই অগ্নিপুরুষের জ্বালাময়ী ভাষণ যেমন একদিক দিয়ে ছিল একটি উচ্চাংগের সাহিত্য, তেমনি অপর দিক দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠমত অবদান। তিনি সম্রাট পঞ্চম জর্জের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে যে ভাষায় ব্রিটিশ সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন, তা শুধুমাত্র তাঁর কাছে ছিল জীবনের সর্বাপেক্ষা প্রিয়তম বস্তু। তিনি তাঁর বক্তৃতায় এক পর্যায়ে অতি আবেগময় কন্ঠে বলেন, “আমি ভারতের স্বাধীনতার সারাংশ নিয়ে স্বদেশে ফিরে যেতে চাই। যতি তোমরা স্বাধীনতা না দাও, তাহলে দেশে ফিরে যাওয়ার চেয়ে একটি স্বাধীন দেশে মৃত্যুবরণকে আমি শ্রেয়ঃ মনে করি”।

তাঁর এ আন্তরিকতাপূর্ণ উক্তি চিল একটি ভবিষ্যদ্বানী যা অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হতে মোটেই বিলম্ব হলো না। তাঁকে আর তাঁর প্রিয় জন্মভূমিতে ফিরে আসতে হয়নি। ভারতের স্বাধীনতা হয়নি, হয়েছে তাঁর জীবনের অবসান লন্ডনেরবুকেই ক’দিন পরে।

মওলানা মুহাম্মদ আলী বারবার কারাবরণ করে এবং দীর্ঘদিন কারাগারে অতিবাহিত করে একেবারে ভগ্নস্বাস্থ্য হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর অকস্মাৎ মৃত্যু ভারতের কোটি কোটি নরনারীকে শোকসাগরে নিমজ্জিত করে। ‌১৯৩০ সালে ৪ঠা জানুয়ারী তিনি মৃত্যুবরণ করেন  এবং এ নিদারুণ সংবাদ তড়িৎগতিতে সারা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর সুধী সমাজ মর্মাহত হয়ে ভারতের এ সিংহপুরুষের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করে তারবার্তা প্রেরণ করতে থাকেন।

মওলানা মুহাম্মদ আলী বারবার কারাবরণ করে এবং দীর্ঘদিন কারাগারে অতিবাহিত করে একেবারে ভগ্নস্বাস্থ্য হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর অকস্মাৎ মৃত্যু ভারতের কোটি কোটি নরনারীকে শোকসাগরে নিমজ্জিত করে। ১৯৩০ সালে ৪ঠা জানুয়ারী তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং এ নিদারুণ সংবাদ তড়িৎগতিতে সারা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর সুধী সমাজ মর্মাহত হয়ে ভারতের এ সিংহপুরুষেল প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করে তারবার্তা প্রেরণ করতে থাকেন।

মওলানা মুহাম্মদ আলীর অস্তিম ইচ্ছানুযায়ী তাঁর মৃতদেহকে পরাধীন ভারত ভূমিতে না এনে বায়তুল মাকদেসে অবস্থিত খলিফা ওমরের মসজিদ প্রংগনে সমাধিস্থ করা হয়।

দেশপ্রেমিক, কবি ও সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও বাগ্মী মওলানা মুহাম্মদ আলী জওহরের মৃত্যুতে ভারতবর্ষের রাজনীতিক্ষেত্রে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তা আর পূরণ হয়নি। তবে লন্ডন যাত্রাকালে তাঁকে যখন স্ট্রেচারের সাহায্যে বোম্বাই বন্দরে জাহাজে তোলা হয়, তখন অনেকেই অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন –“ভারতে আপনার স্থলাভিষিক্ত কে হবে”। তখন তিনি বলেছিলেন “তোমাদের মধ্যে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ রইলো”। তাঁর এ অন্তিম ইচ্ছাও পূরণ হয়েছিল। পরবর্তীকালে মুসলমানদের আশা-আকাংখার বাস্তবায়ন হয়েছিল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর অক্লান্ত প্রচেষ্টায়।

দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক

প্রথম গোলটেবিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস বর্জন করেছিল। উপরন্তু মিঃ গান্ধী লবণ আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করে ভারতে ব্রিটিশ সরকারকে বিব্রত করে তোলেন। সরকারও আন্দোলনকারীদের কঠোর হস্তে দমন করার চেষ্টা করেন। এমতাবস্থায় সরকারের সাথে একটা আপোষ নিষ্পত্তিতে উপনীন হবার জন্যে স্যার তেজবাহাদুর সাপ্রু, ভূপালের নবাব হামীদুল্লাহ খান, শ্রীনিবাস শাস্ত্রী এবং শ্রী জয়াকর প্রমুখ নেতৃবৃন্দ মিঃ গান্ধীর সাথে আলোচনায় মিলিত হন। আলোচনায় একটি আপোষেল ক্ষেত্র তৈরী হয়। বড়োলাটের সাথে গান্ধীজির সরাসরি আলাপ আলোচনার পর কংগ্রেস দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করতে সম্মত হয়।

‌১৯৩১ সালের আগষ্ট মাসে অনুষ্ঠিতব্য গোলটেবিল বৈঠকে কংগ্রেসের একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে মিঃ গান্ধী লন্ডন যাত্রা করেন। লন্ডনে পৌঁছে তিনি জানতে পারেন যে সরকার মুসলমানদের ন্যায় তফশিলী সম্প্রদায়কেও একটা স্বতন্ত্র সম্প্রদায় হিসাবে গণনা করতে বদ্ধকর। গান্ধী তা মেনে নিতে রাজী ছিলেন না এবং তিনি তার প্রতিবাদে ভারতে প্রত্যাবর্তণ করেন। গান্ধী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকারীদে সাথে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন।

গান্ধীর গোলটেবিল বৈঠক ত্যাগের পর দু’মাসকাল যাবত বৈঠক চলে এবং বৈঠকে অনেকগুলি সাব কমিটি গঠিত হয়। এসব কমিটির রিপোর্ট বিবেচনার জন্যে পরবর্তী বৎসরের আগষ্ট মাসে গোলটেবিল বৈঠকের তৃতীয় অধিবেশন আহুত হয়।

তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠক

বিভিন্ন আইন সভায় মুসলমানদের আসন সংখ্যা ও নির্বাচন প্রথা নিয়ে হিন্দু সদস্যগণ তাদের চিরাচরিত বৈরী ভূমিকাই পালন করেন। ১৯২৮ সালে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে হিন্দুগণ যে আপোষহীন মনোভাব ব্যক্ত করে সম্মেলন ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন, গোলটেবিল বৈঠককে অনুরূপভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করার চেষ্টা তাঁরা করেছিলেন। কিন্তু আগা খানের সুযোগ্য নেতৃত্বে মুসলমান নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে মিঃ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এমন যোগ্যতা ও  যুক্তিতর্কের মাধ্যমে তাঁদের ন্যায্যা দাবীদাওয়াগুলি পেশ করেছিলেন যে তার অধিকাংশই ব্রিটিশ সরকার মেনে নিতে রাজী হন। আগা খান ও মিঃ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ব্যতীতও স্যার মুহাম্মদ শফি
, স্যার আবদুল হালিম গজনভী, স্যার আকবর হায়দারী প্রমুখ নেতৃবৃন্দের ভূমিকাও ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। যুক্তিতর্কে হার মেনে নিয়ে পন্ডিত মদনমোহন মালব্য, ডাঃ মুঞ্জে, শ্রীজয়াকর প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অন্যান্য হিন্দু সদস্যগণের সাথে পরামর্শক্রমে উপরোক্ত প্রশ্নটির (আইনসভায় মুসলমানদের আসন বন্টন ও নির্বাচন প্রথা) মীমাংসার ভার অর্পন করেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রামজে ম্যাকডোনাল্ডের উপর।

ম্যকডোনাল্ড অতীতে হিন্দুপ্রীতির পরিচয় দিয়েছিলেন এবং কংগ্রেসের দৃঢ় সমর্থক ছিলেন বলে তার উপর হিন্দুদের গভীর আস্থা ছিল। কিন্তু তিনি যে সাম্প্রদায়িক  রায়েদাদ (
Communal Award) ঘোষণা করেন তাতে বিভিন্ন আইনসভায় মুসলমান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের জন্যে আসন সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। পৃথক নির্বাচন প্রথাকেও স্বীকৃতি দেয়া হয়। শুধু আসন সংখ্যায় কিছু রদবদল করে উভয়ের গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা করা হয়।

ম্যাকডোনাল্ডের ঘোষণায় হিন্দুগণ বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে পড়েন। কারণ তারা কখনো এরূপ আশা করেননি। বিশেষ করে তফশিলী সম্পদ্রায়ভুক্ত হিন্দুদের জন্যেও পৃথক নির্বাচনের প্রস্তাবে তাঁরা খুব মর্মাহত হয়ে পড়েন। মিঃ গান্ধী তখন জারবেদা জেলে কারাজীবন যাপন করছিলেন। তিনি পৃথক নির্বাচনের প্রতিবাদে আমরণ অনশন ধর্মঘটের কথা ঘোষণা করেন।

পুনাচুক্তি

একদিকে হিন্দু নেতৃবৃন্দ পুনায় গমন করতঃ গান্ধীকে অনশন থেকে প্রতিনিবৃত্ত করার জন্যে বারবার আবেদন জানাতে থাকেন এবং অপরদিকে বর্ণ হিন্দুগণ তফশিলীদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন বাঁটোয়ারা সংশ্লিষ্ট অংশের রদবদল করতে। কবি রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তফশিলী সম্প্রদায়ের নেতা ডঃ আম্বেদকর বর্ণহিন্দুদের কাছে নতি স্বীকার করেন এবং স্থিরীকৃত হয় যে বিভিন্ন আইন সভায় তফশিলীদের জন্যে আসন সংরক্ষিত থাকবে বটে, তবে মিশ্র নির্বাচন  প্রথার সাহায্যে তাদেরকে নির্বাচিত হতে হবে। এ চুক্তিটি ইতিহাসে পুনা চুক্তি নামে খ্যাতি লাভ করে।

উল্লেখ্য যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস তথা ভারতীয় বর্ণহিন্দুদের উদ্দেশ্য ছিল সমগ্র ভারতবাসীকে একজাতীয়তার যাঁতাকলে নিষ্পিষ্ট করে এমন এক জাতীয়তার উদ্ভব করা যার কর্তৃত্ব নেতৃত্ব থাকবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের হাতে। ফলে মুসলিম জাতিকে কৃত্রিম জাতীয়তার সাথে একাকার করে তাদের স্বাতন্ত্র্য বিলুপ্ত করে দেয়া হবে। কিন্তু মুসলমানদের জন্যে সরকার কর্তৃক পৃথক নির্বাচনের স্বীকৃতির মাধ্যমে তাদের জাতীয় স্বাতন্ত্র্যও স্বীকার করে নেয়া হয়। এতে বর্ণহিন্দুদের বহুদিনের স্বপ্নসাধ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় এবং তাদের সমস্ত আক্রোশটা গিয়ে পড়ে তাদের এককালীন পরম বন্ধু, হিতৈষী ও অভিভাবক ব্রিটিশ সরকারের উপর। তার জন্যে  সৃষ্টি হয় সন্ত্রাসবাদের। ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ
, অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, রাজনৈতিক হত্যা প্রভৃতি নিত্যনতুন ঘটনা ঘটতে থাকে। এ সময়ের কয়েক বছরের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো হিন্দু সন্ত্রাসবাদী সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, গোয়েন্দা বিভাগের অন্যতম অফিসার খান বাহাদুর আহসান উল্লাহর হত্যা, ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ ও কয়েকজন নর-নারীর হত্যা, মেদিনীপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হত্যা, ডিনামাইট ষড়যন্ত্র প্রভৃতি। লন্ডনে গোলটেবিল বৈঠক চলাকালীন তু’তিন বছরের মধ্যেই এ সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী ঘটনাগুলি সংঘটিত হয়।

ভারত শাসন আইন

পরের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন। প্রদেশে কিছুটা দায়িত্বশীল সরকার এবং কেন্দ্রে ফেড়ারেল সরকার প্রতিষ্ঠা ছিল –এ আইনের বিষয়বস্তু বা উদ্দেশ্য। মন্টফোর্ড শাসন সংস্কারে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের হাতে যে পরিমাণ ক্ষমতা দিয়েছিলেন, ভারত শাসন আইনে তার চেয়ে অধিক ক্ষমতা বড়োলাট ও প্রাদেশিক গভর্ণরদের হাতে রয়ে যায়। ১৯৩৭ সালের এপ্রিল মাস থেকে এ নতুন ভারস শাসন আইন চালু হবে বলেও ঘোষণা করা হয়।

কংগ্রেস কর্তৃপক্ষ এই সংকুচিত বা নিয়ন্ত্রিত ক্ষমতায় (Controlled Power) মোটেই সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তবুও নানান টালবাহানার পর নতুন আইনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে কিভাবে ভারতের সাতটি প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রীত্ব গঠন করে এবং তাদের আড়াই বছরের শাসনে কিভাবে মুসলমানদের উপর অন্যায় অবিচার ও নিষ্পেষণ চালায়, যার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ মুসলমানদের পাকিস্তান আন্দোলনের পথ উন্মুক্ত হয়, পরবর্তীতে তার বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ঘোষিত হলে মিঃ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ সকলকে মুসলিম লীগের পতাকাতলে সমবেত হওয়ার উদাত্ত আহবান জানান। ১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে কিছু সংখ্যক সদস্য মুসলিম লীগে নির্বাচিতও হয়েছিলেন। তখন পর্যন্তও মুসলিম লীগের আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ লাভ করেনি। নির্বাচনের পর মিঃ জিন্নাহ কংগ্রেসের সাথে সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত করেন। কিন্তু কংগ্রেস তা প্রত্যাখ্যান করে। জিন্নাহর মতো একজন তেজস্বী ও খ্যাতনামা আইনবিদের পক্ষে কংগ্রেসের উপরোক্ত ঔদ্ধত্যের কাছে নতি স্বীকার করা সম্ভব হয়নি। বহু মানঅভিমানের পর বড়োলাট লিনলিথগোর আশ্বাসবাণীর পর কংগ্রেস মন্ত্রীসভা গঠন করতে রাজী হলে, মিঃ জিন্নাহ লীগ সদস্যগণকে তার বিরোধিতা করার নির্দেশ দেন।

লীগ-কংগ্রেসে দ্বন্দ্বকলহের মধ্য দিয়েই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন চলতে থাকে। মুসলমানদের প্রতি হিন্দুদের বিমাতাসুলভ আচরণ, মুসলমানদের তাহজীব তামাদ্দুনের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করেন কংগ্রেস শাসিত প্রদেশগুলিতে হিন্দু রামরাজ্য স্থাপনের প্রচেষ্টা এবং মুসলমানদের প্রতি হিন্দু কংগ্রেসের অন্যায় অবিচার মুসলমানদেরকে স্বতন্ত্র আবাসভূমি লাভের সংগ্রামে বাধ্য করে। সে সংগ্রামের পরিসমাপ্তি ঘটে ‌১৯৪৭ সলে ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মের ভিতর দিয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *