১৫. ঈশপের সেই কাক
পাখিদের জন্যে আমাদের এক ধরনের স্নেহ আছে। কী চমৎকারভাবে তারা ডানা মেলে আকাশে ওড়ে, তাদের গায়ে কত বিচিত্র রং। গাছের ডালে পাখি যখন কিচিরমিচির করে ডাকে আমরা তখন সাগ্রহে এবং সস্নেহে তাদের দিকে তাকাই।
কিন্তু কাক? সর্বনাশ! আমরা কাককে কেউ দুই চোখে দেখতে পারি না। কাকও পাখি কিন্তু পাখির জন্যে রাখা এতটুকু স্নেহ কাকের কপালে জোটে না। কেন জুটবে? তাদের কালো কুৎসিত গায়ের রং, কর্কশ গলার আওয়াজ। কা কা করে ডেকে তারা কান ঝালাপালা করে দেয়। আচার আচরণ মোটেও সুবিধে নয়। রাজ্যের নোংরা ঘাটাঘাটি করায় তাদের কোনো ক্লান্তি নেই, উচ্ছিষ্ট খাবার কিংবা মরা ইঁদুর–কোনো কিছুতেই তাদের অরুচি নেই। এ রকম একটা প্রাণীর জন্যে বুকের ভেতর কী ভালোবাসা জন্মানো যায়? কেউ কী কাকদের সম্পর্কে একটি ভালো কথাও বলতে পারবে?
সত্যি কথা বলতে কী কাকদের সম্পর্কে একটি ভালো কথা পৃথিবীর সব বিজ্ঞানীরাই বলে থাকেন, আর সেটি জানার পর আমার ধারণা আমরা সবাই কাককে একটু অন্য চোখে দেখব। সেটি হচ্ছে কাকদের অস্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তা! হ্যাঁ, শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে কিন্তু কাকদের বলা হয় পাখিদের আইনস্টাইন!
ইংরেজতে “বার্ড-ব্রেইন” বলে একটা কথা চালু আছে, বোকা ধরনের মানুষদের বুদ্ধি নিয়ে খোটা দিতে হলে এই কথাটা ব্যবহার করা হয়। কিন্তু মজার কথা হচ্ছে পাখিরা কিন্তু মোটেও বোকা নয়। পাখিদের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে মানুষের মাঝে এক ধরনের ভুল ধারণা ছিল, তার কারণ বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষা করার জন্যে সবসময়ই প্রাণীটির কোনো কিছু ধরার জন্যে হাত বা হাতের কাছাকাছি কোনো ধরনের অঙ্গ আছে সেটা ধরে নেয়ার দরকার হতো–যদি কোনো কিছু ধরতেই না পারল তাহলে সে বুদ্ধির পরীক্ষাটা দেবে কেমন করে? কিন্তু পাখিদের সেই সৌভাগ্য নেই। তাদের হাত নেই হাতের জায়গায় তাদের রয়েছে পাখা–সেই পাখা মেলে আকাশে ওড়া যায় কিন্তু কিছু ধরা যায় না। কোনো কিছু ধরার জন্যে তাদের ব্যবহার করতে হয় তাদের ঠোঁট, সেগুলো তো আর আঙ্গুলের মতো নয়, সেগুলো শক্ত, অনমনীয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে শারীরিক এত অসুবিধে নিয়েও কিন্তু বুদ্ধির পরীক্ষায় পাখি অনেক এগিয়ে আছে।
প্রাণীরা মস্তিষ্কের যে অংশটুকুকে তাদের বুদ্ধিমত্তার জন্যে নিয়ন্ত্রণ করে তার নাম সেরেব্রাল করটেক্স। যে প্রাণীর সেরেব্রাল করটেক্স যত বড় তার বুদ্ধিমত্তা তুলনামূলকভাবে তত বেশি। তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে পাখিদের সেরেব্রাল করটেক্স খুবই ছোট, বলতে গেলে নেই–তাহলে তাদের বুদ্ধিমত্তাটা আসছে কোথা থেকে? 1960 সালে স্ট্যানলি কব নামে একজন নিউরোলজিস্ট আবিষ্কার করলেন পাখিরা বুদ্ধিমত্তার জন্যে তাদের মস্তিষ্কের এমন একটা অংশ ব্যবহার করে যেটা স্তন্যপায়ী প্রাণীদের নেই! শুধু তাই না, দেখা গেছে যে পাখির মস্তিষ্কে এই অংশটা যত বড় সেই পাখি তত বুদ্ধিমান এবং অবাক হবার কিছু নেই কাক (এবং কাক জাতীয় পাখিদের) মস্তিষ্কের এই অংশটুকু পাখিদের মাঝে সবচেয়ে বড়!
বুদ্ধিমত্তার হিসেব-নিকেশ করার সময় শরীরের সাথে মস্তিষ্কের ওজনের তুলনা করা হয়, যে প্রাণী যত বুদ্ধিমান শরীরের তুলনায় তার মস্তিষ্কের ওজন তত বেশি। বলাই বাহুল্য এই হিসেবে সবচেয়ে এগিয়ে আছে মানুষ এবং মানুষের কাছাকাছি শিম্পাঞ্জি, ওরাংউটান, বানর জাতীয় প্রাণী। তারপরেই আসে ডলফিন এবং তিমি মাছ। (তিমিকে মাছ বলা হয়েছে কিন্তু সেটি আসলে মোটেই মাছ নয়। তিমি কিংবা ডলফিন দুটোই স্তন্যপায়ী প্রাণী।) পাখিদের মস্তিষ্কের ওজন তাদের শরীরের তুলনায় ডলফিন, তিমি কিংবা প্রায় মানুষের মতো! কাজেই পাখির বুদ্ধি যে অন্য দশটা প্রাণী থেকে বেশি হবে তাতে অবাক হবার কী আছে?
মানুষের বুদ্ধিমত্তা কেমন করে মাপতে হয় সেটি বিজ্ঞানীরা মোটামুটিভাবে জানেন–কিন্তু অন্য প্রাণীর বুদ্ধিমত্তা মাপার জন্যে তারা সেই পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করতে পারেন না। তাই পাখিদের বুদ্ধিমত্তা মাপার জন্যে তারা পাখিদের কিছু কিছু বিশেষ ধরনের কাজ করার ক্ষমতা আছে কি না সেটা বের করার চেষ্টা করছেন।
সে রকম একটা ক্ষমতা হচ্ছে গোনার ক্ষমতা। শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু বিজ্ঞানীরা দেখেছেন পাখি গুনতে পারে। কাক যদিও পাখিদের মাঝে সবচেয়ে বুদ্ধিমান কিন্তু গোনার বেলায় তারা সবচেয়ে এগিয়ে নেই, তারা তিন পর্যন্ত গুনতে পারে। টিয়া পাখি গুনতে পারে পাঁচ পর্যন্ত। চীনা জেলেরা মাছ ধরার জন্যে পানকৌড়ি ধরনের পোষা পাখি ব্যবহার করে, সেই পাখিগুলো পরপর সাতটা মাছ ধরে আনলে অষ্টম মাছটা জেলেরা পাখিটাকে খেতে দেয়। দেখা গেছে পাখিগুলো নিজেরাই তার হিসেব রাখে। সাতটা মাছ ধরে আনার পর অষ্টম মাছটা তাদের খেতে না দেয়া পর্যন্ত তারা পানিতে নামে না, রীতিমতো ঝগড়াঝাটি করে।
বুদ্ধিমত্তার আরেকটা পরিমাপ হচ্ছে শেখার ক্ষমতা। বেশিরভাগ প্রাণী তাদের সহজাত প্রবৃত্তি ব্যবহার করে বেঁচে থাকে–পাখিরা কিন্তু শিখতেও পারে। পাখির বাচ্চারা বেঁচে থাকার অনেক কায়দা-কানুন তাদের মা-বাবার কাছ থেকে শেখে! শক্ত কোনো ফল ভেঙে ভেতরের শাঁস বের করার জন্যে উপর থেকে শক্ত পাথরে ফেলে দেয়া পাখিদের জন্যে খুব সাধারণ একটা কাজ। জাপানের ব্যস্ত রাস্তায় মাঝে মাঝে মজার একটা দৃশ্য দেখা যায়। শক্ত খোসার বাদাম, যেটা ঠোঁট দিয়ে ভাঙা যায় না, কাকেরা সেগুলো ব্যস্ত রাস্তায় ফেলে রাখে। চলন্ত গাড়ির চাকার নিচে সেগুলো ভেঙ্গে যায়, তারপর ট্রাফিকের লাল বাতি জ্বলার পর যখন সব গাড়ি থেমে যায় তখন কাকেরা ছুটে গিয়ে সেই বাদামগুলো খেতে শুরু করে। যার অর্থ তারা শুধু যে তাদের জানা পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে তা নয়, নূতন নূতন বুদ্ধিও বের করে কাজে লাগাতে শুরু করে।
বুদ্ধিমত্তার আরেকটা পরিমাপ হচ্ছে ভাষা। যে প্রাণীর বুদ্ধিমত্তা যত বেশি তার ভাষা তত সহজ। পাখিদের কিচিরমিচির শুনে আমাদের সন্দেহ হতে পারে যে সেগুলো বুঝি নেহায়েতই অর্থহীন চেঁচামেচি কিন্তু গবেষকরা বলেন অন্য কথা। পাখিরা একে-অন্যের সাথে রীতিমতো কথা বলে যোগাযোগ করতে পারে। পাখিরই মিষ্টি গান গাওয়ার ক্ষমতা আছে, সেই গান তারা অন্য পাখিদের আকর্ষণ করার জন্যে ব্যবহার করে। কাকের কর্কশ কা কা শব্দ মোটেও গানের মতো নয় এবং সেটা শুনলে আমরা দূর দূর করে তাদের তাড়িয়ে দেই, কিন্তু কেউ কী জানে যে পাখির জগতের রীতিমতো এই কাকের রীতিমতো একটা ভাষা আছে। ডুয়িট চ্যাম্বারলিন নামে এক বিখ্যাত কাকবিশারদ বহু বছর গবেষণা করে কাকের ভাষার 23টি ভিন্ন ভিন্ন শব্দের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছেন। এই 23টি ভিন্ন ভিন্ন শব্দ আবার ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বোঝায়, কাজেই কাক যদি এই শব্দগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করে তাহলে রীতিমতো তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলতে পারে।
দেখা গেছে বুদ্ধিমান প্রাণীরা দল বেঁধে সামাজিক পরিবেশে থাকতে পছন্দ করে। পাখিদের বেলায় এটা সত্যি–তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে শীতকালের পাখি! শীতের সময় শীতল দেশের পাখিরা দল বেঁধে উড়ে উড়ে আমাদের দেশে চলে আসে। এই হাজার হাজার মাইল উড়ে আসার সময় পাখিরা যে শৃঙ্খলা দেখায় তার কোনো তুলনা নেই। দল বেঁধে থাকা পাখিদের মাঝে কাক যে একেবারে এক নম্বর সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কেউ যদি আমার কথা অবিশ্বাস করে তাহলে তাকে বলব কোনোভাবে একটা কাককে জ্যান্ত অবস্থায় ধরে ফেলতে, তাহলে সেই কাককে উদ্ধার করার জন্যে সারা শহরের যত কাক রয়েছে সবাই ছুটে এসে তারস্বরে চিৎকার করা শুরু করবে, তাদের আপনজনকে ছুটিয়ে নেয়ার জন্যে এমন কাণ্ড শুরু করবে যে তার থেকে মুক্তি পাবার কোনো উপায় নেই!
একটা প্রাণী যখন বুদ্ধিমত্তায় উপরের দিকে থাকে তখন কিন্তু শুধু খাওয়া আর বংশবৃদ্ধিতে তারা সন্তুষ্ট থাকে না, তারা আনন্দও করতে চায়। আনন্দ করার একটা প্রধান উপায় হচ্ছে খেলা–এবং পাখিরা প্রায় সময়েই নিজেরা নিজেরা খেলে। একটা ঢালু জায়গায় ছোট বাচ্চারা এসে গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ত, একটা কাক গভীর মনোযোগ দিয়ে সেটা লক্ষ করল। তারপর যখন কেউ নেই! তখন দেখা গেল কাকটা একটা টিনের কৌটা এনে সেই ঢালু জায়গায় ছেড়ে দিচ্ছে–সেটা গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ে যাবার পর কাকটা আবার উপরে তুলে এনে ছেড়ে দিচ্ছে, টিনের কৌটাটা তখন আবার গড়িয়ে পড়ছে। হাত নেই বলে সেই কাক হাততালি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করতে পারে নি কিন্তু যারা দেখেছে তারা সেই আনন্দটুকু সত্যিই অনুভব করতে পেরেছে!
পাখিদের বুদ্ধিমত্তার যতগুলো উদাহরণ আছে তার মাঝে সবচেয়ে চমকপ্রদ উদাহরণটি তৈরি করেছে ল্যাবরেটরিতে পোষা একটি কাক, তার নাম হচ্ছে বেটি। বুদ্ধিমত্তার নানা পরীক্ষা করার কারণেই কী না কে জানে, বেটির বুদ্ধির কোনো তুলনা নেই। তার বুদ্ধির পরীক্ষা করার জন্যে একটা কাচের সরু গ্লাসের ভেতর আরেকটা কৌটা রাখা হলো, তার উপরে একটা আংটার মতো রয়েছে। গ্লাসটা একটু গভীর তাই কাক ঠোঁট দিয়ে আংটাটা নাগাল পায় না, নানাভাবে চেষ্টা করেও সে হাল ছেড়ে দিল না। খুঁজে পেতে এক টুকরো তার নিয়ে এসে সেটা মুখে লাগিয়ে আংটাটা টেনে তোলার চেষ্টা করল–কিন্তু সোজা তার আংটাতে আটকানো যায় না, চেষ্টা করে কোনো লাভ হলো না।
তখন বেটি নামের কাকটি যে কাজ করল সেটি অবিশ্বাস্য, তারটার এক মাথা এক জায়গায় আটকে চাপ দিয়ে সেই অংশটা বঁড়শির মতো বাঁকিয়ে ফেলল। তারপর ঠোঁট দিয়ে বঁড়শির মতো অংশটা নিচে নামিয়ে সেটা দিয়ে আংটাটা ধরে টেনে বের করে আনল! পুরো ঘটনার ভিডিওটা ইন্টারনেটে আছে, কেউ যদি আমার কথা বিশ্বাস না করে সেটা নিজের চোখে দেখতে পারে।
আমরা সবাই কলসির তলায় একটুখানি পানি এবং তৃষ্ণার্ত কাকের সেই গল্পটি পড়েছি যেখানে তৃষ্ণার্ত কাক কলসির ভেতর পাথরের টুকরো ফেলে পানিটাকে উপরে নিয়ে এসে সেই পানি খেয়েছে। আমরা এতদিন জানতাম এটা ঈশপের কাল্পনিক গল্প।
এখন বিজ্ঞানীরা ভাবছেন এটা হয়তো কাল্পনিক গল্প নয়। ঈশপ হয়তো আসলেই এরকম কিছু একটা দেখেছিলেন।