আরও এক বৎসর পর রঙলাল ডাক্তার তাঁকে বিদায় দিলেন।
হঠাৎ চিকিৎসা ছেড়ে দিলেন। বললেন–আর না। এইবার শুধু পড়ব আর ভাবব। জীবন এবং মৃত্যু। লাইফ অ্যান্ড ডেথ, তার পিছনের সেই প্রচণ্ড শক্তি—তাকে ধারণা করবার চেষ্টা করব। আর দেশী গাছ-গাছড়া নিয়ে একখানা বই লিখব।
জীবনকে বলেছিলেন—তোমার ডাক্তারি শেখাটা বোধহয় ঠিক হল না জীবন। ওইসব বিচিত্র অবিশ্বাস্য মুষ্টিযোগ নিয়ে যদি গবেষণা করতে পারতে! কিন্তু তাও ঠিক পারতে না তুমি। তোমার সে বৈজ্ঞানিক মন নয়। কার্য হলেই তোমার মন খুশি। কেন হল—সে অনুসন্ধিৎসা তোমার মনে নাই। যাক। তুমি বরং ডাক্তারি, কবিরাজি, মুষ্টিযোগ তিনটে নিয়েই তোমার ট্রাইসাইকেল তৈরি কর। ওতে চড়েই যাত্রা শুরু কর। নিজের একটা স্টেথোেসকোপ তিনি তাঁকে দিয়েছিলেন, থারমোমিটার দেন নি, কিনতেও বারণ করেছিলেন। বলেছিলেনওর দরকার নেই তোমার।
এর পরও জীবন দত্ত মধ্যে মধ্যে যেতেন। রঙলাল ডাক্তার দেখা করতেন, কিন্তু চিকিৎসা সম্পর্কে কোনো আলোচনা করতেন না। প্রশ্ন করলে বলতেন-ভুলে গিয়েছি। এখন বাগান করছি, গাছ-গাছড়ার সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন থাকলে কর।
আসল উদ্দেশ্য ফুলের বাগান নয়, রঙলাল ডাক্তার নিজের সমাধিক্ষেত্র তৈরি করছিলেন। ওইখানেই তাকে মৃত্যুর পর সমাধিস্থ করা হয়েছে। তাঁর ইচ্ছানুসারেই হয়েছে। তিনি উইল করে গিয়েছিলেন। সেই উইলে তিনি লিখেছিলেন—তাকে যেন সমাধি দেওয়া হয় এই বাগানের মধ্যে।
একা ঘরের মধ্যে মরেছিলেন। মৃত্যুকালে ঘরের মধ্যে কাছে কেউ ছিল না। সেও তার অভিপ্রায় অনুসারে। মনা হাঁড়ি ছিল দরজায় পাহারা। মনা অঝেরঝরে কেঁদেছিল কিন্তু ঘরে কাউকে ঢুকতে দেয় নি। বলেছিল—সে পারব না। বাবার হুকুম নাই।
ওই রঙলাল ডাক্তারের দেওয়া স্টেথোসকোপ নিয়ে তিনি অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা শুরু করলেন। কবিরাজি ত্যাগ করলেন না। মুষ্টিযোগও রইল। সেইবারই দত্ত মশায়দের চিকিৎসালয়ের নামকরণ করলেন—আরোগ্য-নিকেতন।
নবগ্রামে তখন হরিশ ডাক্তার খুলেছে হরিশ ফার্মেসি।
ধনী ব্রজলালবাবু দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করে নাম দিয়েছে—পিয়ারসন চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি।
হোমিওপ্যাথ এসেছে একজন। পাগল ছিল লোকটা, নাম বলতকে. এম. ব্রারোরী অর্থাৎ ক্ষেত্রমোহন বাড়ুরী। তার ডিসপেনসারির নাম ছিল—ব্রারোরী হোমিও হল।
জীবন দত্ত কলকাতায় অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ কিনতে গিয়ে ওই সাইনবোর্ডটা লিখিয়ে এনেছিলেন।–আরোগ্য-নিকেতন।
ওঃ-উদ্যোগপর্বে আতর-বউয়ের সে কী রাগ।
অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ, আলমারি এবং সরঞ্জামপাতি কিনবার জন্য পাঁচশো টাকায় পাঁচ বিঘে জমি বিক্রি করেছিলেন তিনি। রাগ ক্ষোভ তার সেই উপলক্ষ করে, নইলে ওটা ভিতরে ভিতরে জমাই ছিল।
ক্ষোভের দোষ ছিল না। জগৎ মশায়ের আমল থেকে তার আমল পর্যন্ত তখন লোকের কাছে ওষুধের দাম পাওনা তিন-চার হাজার টাকারও বেশি। সচ্ছল অবস্থার লোকের কাছেই পাওনা বেশি। কিন্তু তার মধ্যে এই প্রয়োজনে শতখানেক টাকার বেশি আদায় হল না।
এর জন্য ক্ষোভ তার নিজেরও হয়েছিল। কিন্তু আতর-বউয়ের ক্ষোভ স্বতন্ত্র বস্তু। সে ক্ষোভ তার ওপর এবং সে ক্ষোভ ক্ষমাহীন; আতর-বউয়ের বাহ্যিক ক্ষোভের আপাত উপলক্ষ যাই হোক, ক্ষোভ প্রকাশ হলেই মুহূর্তে মূল কারণ বেরিয়ে পড়ে; সেটা হল তার বিরুদ্ধে একটা
অনির্বাণ চিতার মত অসন্তোষের বহ্নিদাহ!।
তখন ওই জমি বিক্রির উপলক্ষ নিয়ে তার মনের আগুন জ্বলেছিল। মনে পড়ছে, পাওনা টাকা আদায় করতে গিয়েটাকা পাওনা দূরে থাক কটুকথা শুনে তখন তাঁর নিজের মনেও ক্ষোভ জমেছিল। ওষুধের বাকির প্রসঙ্গে লোকে বলেছিল-পঞ্চাশ টাকা? ওষুধের দাম? কী ওষুধ হে? সোনাভস্ম না মুক্তাভস্ম না মানিকভকী দিয়েছিলে? পঞ্চাশ টাকা? গাছ-গাছড়া আর গিয়ে এটা-ওটা টুকিটাকি-আর তো তোমার রসসিন্দুর—এর দাম পঞ্চাশ টাকা? যা ইচ্ছে তাই খাতায় লিখে রেখেছ? হরি-হরি-হরি!
এ নিয়ে আর বাদপ্রতিবাদ করেন নি জীবন ডাক্তার। ক্ষুব্ধ হয়ে ফিরে এসেছিলেন। এবং ফেরবার পথেই সাহাদের শিবু সাহাকে ডেকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। ডাক্তারখানা তিনি করবেনই। বুকের ভিতর তখন অনেক আশা। অনেক আকাঙ্ক্ষা। রঙলাল ডাক্তারের স্থান তিনি পূর্ণ করবেন। তিনি যাবেন—রোগীর বাড়িতে আশার প্রসন্নতা ফুটে উঠবে। তিনি নাড়ি ধরবেন—রোগীর দেহে রোগ সচকিত হয়ে উঠবে। নবগ্রামের অহঙ্কারী জমিদার-সমাজ সমে বিনত হবে। শুধু নবগ্রাম কেন? সারা অঞ্চলের ধনী-সমাজ জমিদার-সমাজ বিনত হবে। বড় ঘোড়া কিনবেন। সাদা ঘোড়া। পালকিও রাখবেন একখানা। বেশি দূরের পথে যাবেন পালকিতে। এ অঞ্চল বলতে সীমানা তো কম নয়—পূর্বে গঙ্গার ধার পর্যন্ত কান্দী পাথুপি। এ দিকে অজয়ের ধার পর্যন্ত। কান্দী গেলে ভূপীর সঙ্গে দেখা করে আসবেন। চিকিৎসা করে তাকে সারিয়ে তুলবার নতুন আকাঙ্ক্ষা হয়েছে তাঁর। জীবনের তখন অনেক আশা। ছেলে বনবিহারীর বয়স মাত্র বছর তিনেক। তাকে ডাক্তারি পড়াবেন। বড় ডাক্তার করে তুলবেন। মেডিকেল কলেজ থেকে এল. এম. এস. পাস করে আসবে সে।
আজ যারা অবজ্ঞা করে তার পাওনা টাকা দিলে না, উপরন্তু ইঙ্গিতে অসাধুতার অপবাদ দিলে, তারাই তাঁর কাছে আসবে বিপদের দিনে। সে দিন তিনি তাদের! না–ফিরিয়ে দেবেন না, কটু বলবেন না। যাবেন। তার বংশের নাম হয়েছে মশায়ের বংশ-বংশের মহাশয়ত্ব ক্ষুণ্ণ করবেন না।
তিনিই পথেই দামদর করে জমি বিক্রির কথাবার্তা পাকা করে বাড়িতে এসে বললেন, তুমি বোসো শিবু। আমি দুটো মুখে দিয়ে নি। তারপর বের হব। কাগজ কিনে লেখাপড়া শেষ করে বাড়ি ফিরব। রেজিস্ট্রির সময় তো তিন মাস।
শিবু বলেছিল—দেখুন দেখি, লেখাপড়াই বা তাড়া কিসের গো? আপনি মশায়ের বংশের সন্তান, আজ আপনিই মশাই। আমি টাকা এনে গুনে দিয়ে যাচ্ছিলেখাপড়া রেজেষ্ট্রি হবে পরে।
শিবু পাঁচশো টাকা এনে দিয়ে গিয়েছিল সেই দিনই সন্ধ্যাবেলা।
ওদিকে বাড়িতে তখন আতর-বউ আগুন ছড়াতে শুরু করেছেন। অদৃষ্ট! অদৃষ্ট! সবই অদৃষ্ট! মা খেয়েছি, বাপ খেয়েছি, সারা বালিকা বয়সে মামা-মামির বাঁদীগিরি করেছি বিনা মাইনেতে। শ্বশুরবাড়িতে শাশুড়ি খেলাম, শ্বশুর খেলাম। এইবার লক্ষ্মী বিদেয় হবেন তার আর আশ্চর্য কী? আমি দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি—মেয়ে হয়েছে ছেলে হয়েছে ওদের হাত ধরে ভিক্ষে করতে হবে আমাকে। পথে বসতে হবে।
জীবন দত্তের মাথার মধ্যেও আগুন জ্বলে উঠেছিল। তবু সে আগুনকে কঠিন সংযমে চাপা দিয়ে তিনি বলেছিলেন–ছি আতর-বউ! ছি!
–কেন? ছি কেন? আমার অদৃষ্ট তো এই বটে। কোনখানটা মিথ্যে বল? শ্বশুর দেহ রাখবার আগের মাসেও এ বাড়িতে জমি এসে ঢুকেছে। আজ সবে চার বছর তিনি গিয়েছেন এরই মধ্যে জমি বেরিয়ে গেল।
—এই বছর যেতে-না-যেতে আমি পাঁচ বিঘের জায়গায় দশ বিঘে কিনব।–
–তা আর কিনবে না? কত বড় ডাক্তার হয়ে এলে, একেবারে বিলাতি পাস সায়েব ডাক্তার।
এবার আর সহ্য করতে পারেন নি জীবন ডাক্তার। কঠিন কণ্ঠে বলেছিলেন-আতর-বউ!
চমকে উঠেছিলেন আতর-বউ সে ডাকে। কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর শুরু করেছিলেন কান্না। জীবন ডাক্তার সে কান্না গ্রাহ্য করেন নি। কাঁদতেই ওঁর জন্ম। ওই ওঁর বোধ করি প্রাক্তন। কাদুন উনি। তিনি কী করবেন?
সেই রাত্রেই তিনি কলকাতা রওনা হয়েছিলেন।
কলকাতা থেকে ওষুধ-আলমারি কিনে এনে ওই সাইনবোর্ডটা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন–আরোগ্য-নিকেতন।
সেতাব মুখুজ্জে এনে দিয়েছিল একটি গণেশ-মূর্তি।
সুরেন সিন্দূর দিয়ে তার নিচে লিখেছিল—শ্ৰীশ্ৰীগণেশায় নমঃ।
পাগলা নেপাল তাঁকে একখানা সে-আমলের বাঁধানো নোটবুক এনে দিয়েছিল। নেপাল তখন কাজ করত নবগ্রামের ধনী ব্রজলালবাবুর বাড়িতে। ব্রজলালবাবুর জামাই ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার; তার সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল নেপালের। খাতাখানা সে তার কাছ থেকে সংগ্রহ করে এনে দিয়ে বলেছিলনে, রঙলাল ডাক্তারের মত নোট করে রাখবি। আরও এসেছিল সেদিন স্থানীয়। ডাক্তারেরা। কৃষ্ণলালবাবুর বাড়ির ডাক্তার হরিশ ডাক্তার এসেছিল; এখানকার স্কুলের হেডমাস্টার এসেছিল। এসেছিল থানার দারোগা।
আর এসেছিল শশীকে নিয়ে শশীর পিসিমা।
–বাবা জীবন!
–আপনি? কী হয়েছে? জীবন দত্ত ভেবেছিলেন শশীরই কোনো অসুখ হয়েছে।
–বাবা, শশীর বড় ইচ্ছে, খানিক-আধেক চিকিৎসা শেখে। লেখাপড়া তো হল না। একটু-আধটু শিখিয়ে দিলে করে-কৰ্ম্মে খাবে।
শশী তখন নিতান্ত কচি। কত বয়স হবে? সতের-আঠার বছর। একটু পাগলাটে ভাব। ওই নেপালের মত। ফিকফিক করে হাসত।
ওঃ–সে এক মনোহর রাত্রি। খাওয়াদাওয়া, খেলাধুলা, গান-বাজনা। এরই মধ্যে পাগল নেপাল এক কাণ্ড করেছিল। ওষুধের সঙ্গে কয়েক বোতল গোলাপজল ছিল। নেপাল লুকিয়ে গোলাপজল মাখতে গিয়ে তাড়াতাড়িতে মাথায় দিয়েছিল ফ্রেঞ্চ বার্নিশ! আসবাবে দেবার জন্য জীবন দত্ত ওটা এনেছিলেন। তারপর সে এক কাণ্ড! মাথার চুলগুলিতে গালা জমে নেপালের আর দুর্গতির সীমা ছিল না। সে কী হাসি সকলের! শশী হেসেছিল সবচেয়ে বেশি। নিতান্ত তরুণ বয়স, তার ওপর সেদিন সে জীবন মশায়ের মনস্তুষ্টির জন্যে ছিল অতিমাত্রায় ব্যস্ত।
***
সেই শশী বিরক্তি প্রকাশ করে গেছে, তার নিদান হকার ভগ্নঃ কটু কথা বলে গেছে!–একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন বৃদ্ধ।
—মশায়! কে যেন ডাকলে।
বৃদ্ধ জীবন দত্ত চকিত হয়ে ফিরে তাকালেন। অন্ধকারের মধ্যেই তো বসে ছিলেন তিনি–হঠাৎ একটা আলোর ছটা এসে পড়েছে। কে তাঁকে ডাকছে। ওঃ, তিনি একেবারে যেন ড়ুবে গিয়েছিলেন অতীতকালের স্মৃতিতে। এতক্ষণে বর্তমানে ফিরে এলেন। হা—লোক এসেছে; তাঁকে ডাকছে। লোকটার হাতের আলোটা নিচের দিকে আলো ফেলেছে। উপরের দিকটায় হারিকেনের মাথার ঢাকনির ছায়া পড়েছে।
—কে? প্রশ্ন করলেন জীবন দত্ত। পরক্ষণেই মনে হল সম্ভবত রতনবাবুর বাড়ির লোক। বিপিনের অসুখ হয়ত বেড়ে উঠে থাকবে।
না। রতনবাবুর বাড়ির লোক তো নয়। যে গন্ধ লোকটির শরীর এবং কাপড়চোপড় থেকে ভেসে আসছে তাতে মনে হচ্ছে সাধু-সন্ন্যাসী গোষ্ঠীর কেউ। গাঁজা, ভস্ম, ধূলি-ধোঁয়া, রুক্ষ দেহচর্ম এবং চুলের গন্ধ মিশিয়ে একটা বিশেষ রকমের গন্ধ ওঠে এদের গায়ে, এ সেই গন্ধ। সম্ভবত চণ্ডীমায়ের মহান্তের দূত। কিছুদিন থেকেই বুড়ো সন্ন্যাসীর অসুখের কথা শুনেছেন জীবন দত্ত।
জীবন দত্তের অনুমান মিথ্যা নয়। লোকটি চণ্ডীমায়ের মহান্তের চেলাই বটে। বললে–সাধুবাবাকে একবার দেখতে যেতে হবে।
—এই রাত্রে?
আজ্ঞে হ্যাঁ। সন্ধ্যা থেকে রক্তভেদ হচ্ছে। বড় কষ্ট। দুর্বল হয়ে পড়েছেন। বললেন– জীবনকে একবার খবর দে! মালুম হোয় কি আজই রাতমে ছুটি মিলবে। সে একবার দেখুক।
বৃদ্ধের প্রাণ বড় শক্ত প্রাণ। কতবার যে এমন হল! অন্তত বিশ-পঁচিশ বার। রক্তভেদ নিদারুণ হিক্কানাড়ি ছেড়ে যাওয়া, এ সব হয়েও বৃদ্ধ বেঁচে উঠেছে।
একমাত্র কারণ গাঁজা। কিন্তু গাঁজা বুড়ো কিছুতেই ছাড়বে না। মদ খায় না এমন নয়। খায় কিন্তু পর্বে-পার্বণে অতি সামান্য। তন্ত্রের নিয়ম রক্ষা করে। মদ্যপানকে বলে—ঢুকু ঢুকু। জীবন। দত্তই তাকে বরাবর ভাল করেছেন। ডাক্তারি ওষুধ বুড়ো খায় না। ইনজেকশনকে বড় ভয়। মশায়বাড়ির টোটকার ওপরেই তার একমাত্র বিশ্বাস। তাও খুব কঠিন হয়ে উঠলে তবে বুড়ো জীবনকে ডাকে, বলে, দেখ তো ভাই জীবন। তলব কি আইল? বুড়ো আবার পড়েছে। আজকাল বড় ঘন ঘন পড়ছে।
জীবন দত্ত উঠলেন।
বৃদ্ধ বয়স, রাত্রি প্রহর পার হয়ে গিয়েছে; বোধহয় সাড়ে দশটা। শ্রাবণ মস, দিন বড় রাত্রি ছোট, হবে বৈকি সাড়ে দশটা। তবু যেতে হবে। উপায় কী? চল। বাড়ির দিকে মুখ ফিরিয়ে তিনি ডাকলেন-আতর-বউ!
–কী? ভিতর থেকে রুক্ষস্বরেই জবাব দিলেন আতর-বউ।
–বেরুতে হচ্ছে। ঘুরে আসি একবার।
—এই রাত্রে কোথায় যাবে? কার বাড়ি? না, যেতে হবে না তোমাকে। অনেক ডাক্তার আছে। অল্প বয়স, বিদ্বান, বড় বড় পাসকরা। তারা যাক। এই বয়েস তোমার—তোমাকে ডাকতে এসেছে শুধু টাকা দেবে না বলে। যেয়ো না তুমি।
জীবন ডাক্তার কোমল স্বরেই বললেন––চণ্ডীতলায় সাধুবাবার অসুখ আতর-বউ।
ওই কথাতেই অনেক কিছু বলা হয়ে গেল। আতর-বউও মুহূর্তে নরম হয়ে গেলেন। তাই বা কেন? একেবারে অন্য মানুষ হয়ে গেলেন। বললেন–সাধু বাবার অসুখ? কী হয়েছে?
–কী হবে? সেই যা হয়। রক্তভেদ-পেটে যন্ত্ৰণা।
–এবার তা হলে বাবা দেহ রাখবেন। বয়স তো কম হল না।
–দেখি! বলে তো পাঠিয়েছেন–জীবনকে ডাকতলব আইল কি না দেখুক। দেখি! ভারী জুতোর শব্দে স্তব্ধ পল্লীপথের দুপাশের বাড়ির দেওয়ালে প্ৰতিধ্বনি তুলে বৃদ্ধ হস্তীর মত জীবন ডাক্তার চললেন গ্রাম পার হয়ে স্বল্প বিস্তৃতির একখানি মাঠ পার হয়ে নবগ্রামের। পূর্বপ্রান্তে ঘন জঙ্গলে ঘেরা দেবাশ্রমের দিকে। বর্ষার রাত্রি-অবশ্য অনাবৃষ্টির-বর্ষা—তবুও রাস্তা পিছল, একটু সাবধানেই পথ চলতে হচ্ছিল। আলো নিয়ে সাধুর অল্পবয়সী চেলাটি দ্রুতপদে চলেছে—ডাক্তার প্রায় অন্ধকারেই চলেছেন। তাতে ডাক্তারের অসুবিধে নাই। অন্ধকারে ঠাওর করে পথ চলা তার অভ্যাস আছে। কিন্তু সাধুর চেলার হাতের আলোটা দুলছে, অসুবিধে হচ্ছে তাতেই। মধ্যে মধ্যে চোখে এসে লাগছে। ডাক্তার বললেন–আলোটা এমন করে দুলিয়ো না হে ভোলানাথ। চোখে লাগছে। চল, চল, দাঁড়াতে হবে না। চল তুমি। আলোটা দুলিয়ো না।
—কে? মশায় নাকি?
সম্মুখের দেবস্থলের প্রবেশপথের ঠিক মুখ থেকে কে প্রশ্ন করলে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। কণ্ঠস্বরটা চেনা। তবু জীবন দত্ত ধরতে পারলেন না। অন্যমনস্ক হয়ে সাধুর কথাই ভাবছিলেন তিনি। বহুকাল এখানে আছেন সাধু। অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
—রোগীকে আমি ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি। হাসতে লাগল সে।
–শশী! চমকে উঠলেন ডাক্তার।–কী দিয়ে ঘুম পাড়ালি?
পাগলা শশী হাসতে লাগল—অসুখের চিকিৎসা আসুরিক।
–কিন্তু তোকে খবর দিলে কে?
—এসে পড়লাম হঠাৎ। গিয়েছিলাম গলাইচণ্ডী, রামহরি লেটকে দেখতে। বেটার খুব অসুখ। দুপুরবেলা আপনাকে কল দিতে গিয়েছিলাম, কিন্তু ওই মতির মায়ের নিদানের কথা বলতে গিয়ে ভুলেই গেলাম। বউ-ঠাকরুন বলেন নি আপনাকে? কাল একবার রামহরিকে দেখতে যেতে হবে মশায়।
—সে তো পরের কথা। কাল হবে। এখানকার খবর বল। কী চিকিৎসা করলি মহান্তের উৎকণ্ঠা অনুভব করছিলেন তিনি। শশীকে যে তিনি জানেন।
শশী বললে—আর কী! গলাইচণ্ডী থেকে ফিরবার পথে ঢুকলাম ভিজে শরীরটা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল, আর কেমন ছমছম করছিল বুঝেছেন—তাই বলি মাকে একবার প্রণাম করি আর
শরীরটাকে তাড়া করে নি। বুড়োর কাছে একটান গাঁজা খেয়ে যাই।
–হুঁ, তারপর?
—দেখলাম বুড়ো পুঁকছে। রক্তদাস্ত হয়েছে। নাড়ি নাই। যাতনায় ছটফট করছে। শুনলাম তিন দিন গাঁজা খায় নাই। বললাম—যেতে তোমাকে হবে। তা গজা না খেয়ে যাবে কেন–একটানা গাঁজা খেয়ে নাও। তা বললে–না। তু বেটা বদমাশ শয়তান। আরে ওহি গাঁজা তো আমার মরণ আসবার পথ তৈয়ার করেছে। এক পাও পথ বাকি; সে আসুক নিজেই ওটুকু পথ তৈয়ার করে। আর গাঁজা কেন? আমি মশায়, এক ডোজ কানাবিসিন্ডিকা দিয়েছি। সঙ্গেই ছিল। আমি খাই তো। বাস–খেয়ে দু-তিন মিনিটের মধ্যে বুড়ো ঘুমিয়ে পড়ল। দেখুন, বোধহয় নাড়িও টিপটিপ করে উঠেছে। গাঁজা-খাওয়া ধাত তো। লেগে গিয়েছে।
হি-হি করে হাসতে লাগল পাগলা।