শুভাকাঙ্খীদের আনাগোনা বাড়ে শান্তিবাগের বাড়িতে। অনেকের মত রাকা আর আলতাফ ভক্ত হিসেবে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসে অচিরে বন্ধু বনে যান। দুজনেই শখের রবীন্দ্রসঙ্গীত গান, আলতাফ নিজে কবিও। দুজনে বেশি বয়সে বিয়ে করে বাচ্চাকাচ্চাহীন জীবন যাপন করছেন। আগে বিয়ে হয়েছিল দুজনের, আলাদা আলাদা করে ছেলে মেয়ে আছে, ছমাসে কি বছরে ছেলে মেয়েদের সঙ্গে দেখা করা ছাড়া তাঁদের বিশেষ কোনও কর্তব্য নেই। দশটা পাঁচটা চাকরি করেও অখণ্ড সময় পড়ে থাকে হাতে, বিশেষ করে সন্ধ্যেগুলো। সন্ধ্যেগুলোয় প্রায়ই আমার বাড়িতে চলে আসেন দুজন। গানে কবিতায় মুখরিত শান্তিবাগের বাড়িটিতে বসেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের ঘোরে একদিন বলি ‘চলুন শান্তিনিকেতনে বসন্তউৎসবে যাই।’ জীবনে কখনও শান্তিনিকেতন যাননি, অথচ রবীন্দ্রঅন্ত প্রাণ, খুশিতে লাফিয়ে ওঠেন রাকা আর আলতাফ। শান্তিবাগে বসেই শান্তিনিকেতনের জন্য আবেগ আমাদের উথলে ওঠে। এবার আর টাকা ধার করতে হয় না, প্রকাশকদের কল্যাণে পকেটে আমার যথেষ্ট টাকা। দুদিনের মধ্যেই রাকা আর আলতাফ টাকা যত খরচ হওয়ার কথা, তার চেয়ে দু হাজার বেশি পকেটে নিয়ে, সুটকেস গুছিয়ে তৈরি। দলের নেতা হলে দায়িত্ব অনেক। বেলাল চৌধুরীকে দিয়ে ভারতের ভিসা করিয়ে নিই তিনটি পাসপোর্টে। বেলাল চৌধুরী ভারতীয় দূতাবাসে ভারত বিচিত্রা পত্রিকাটি সম্পাদনার কাজ করেন। ভারত বিচিত্রায় আমার বেশ কিছু কবিতা তিনি ছেপেছেন। দেখা হলেই লেখা চান। দেখা প্রায়ই হয়, আরমানিটোলায় থাকা কালীন মাঝে মাঝে যখন করার কিছু থাকত না, তাঁর আপিসে গিয়ে গল্প শুনে সময় কেটেছে আমার। শান্তিবাগে অশান্তির সময়গুলোতেও অনেক সময় গিয়েছি ভারত বিচিত্রায়। বেলাল চৌধুরী আড্ডা দিতে পছন্দ করেন। ঝুড়ি ঝুড়ি গল্প আছে তাঁর, পছন্দের কোনও শ্রোতা পেলে ঝুড়ি উপুড় করেন। পুরোনো আমলের সাহিত্য-জগতের কথা, কলকাতার সাহিত্যরথীদের ছোট খাটো ব্যক্তিগত গল্প খুব রসিয়ে মজিয়ে পরিবেশন করেন। সুস্বাদু গল্প সব। দীর্ঘকাল কলকাতা ছিলেন বলে কলকাতার সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাঁর বেশ বন্ধুত্ব। কলকাতার কে কেমন, কে পাগল, কে ছাপল, কে উদার, কে উদাস জানতে জানতে , কলকাতার এ গলি ও গলির নানারকম গল্প শুনতে শুনতে মনে মনে কতবার যে কলকাতায় পৌঁছে গিয়েছি! বেলাল চৌধুরী কবিতা লেখেন কিন্তু তাঁর কবিতার চেয়ে বেশি ভাল লাগে তাঁর কথা। যে কোনও আড্ডা জমিয়ে তোলার অসম্ভব ক্ষমতা রাখেন তিনি। খুব একাকী মানুষ বেলাল চৌধুরী। খুব প্রাণখোলা। খুব আন্তরিক। খুব উদাসীন। খুব কবি। তিনি আমার দাদা- দাদা-বন্ধু হয়ে গেছেন অল্প কদিনের মধ্যেই। তিনিই একদিন আমাকে বলেছিলেন গিরিন্দ্রশেখর বসুর লাল কালো বইটির কথা। বাচ্চাদের জন্য এমন চমৎকার বই বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয়টি নেই। দুঃখ করে বলেছেন যে বইটি এখন কোথাও আর পাওয়া যায় না, কোনও প্রকাশকই বইটির পুনর্মুদ্রণ করছে না। লাল কালোর গল্প শুনে বইটি পড়ার ইচ্ছে জাগে। বেলাল চৌধুরীর কাছেই একটি জীর্ণ পুরোনো পোকা খাওয়া লাল কালো বইটি পাতা উল্টো উল্টো দেখি। একদিন বইটি বাড়ি নিয়ে এসে পড়ে মুগ্ধ হয়ে বইটির পূনর্মুদ্রণের সংকল্প করি। মুদ্রণ ব্যপারটির জন্য খোকার শরণাপন্ন হই। খোকা আমার অনুরোধ রাখেন। তিনি লাল কালো বইটি ছাপার কাজে হাত দেন। আমি নিজে প্রুফ দেখে দিই। বেলাল চৌধুরীকে দিয়ে একটি ভূমিকা লিখিয়ে নিই। আজ দেবেন কাল দেবেন বলে তিনি দীর্ঘ সময় পার করেছিলেন ভূমিকাটি লিখতে। ভেতরে পিঁপড়ের রঙিন ছবিগুলো দেখে খোকা বলেছিলেন, ‘লেখাগুলো গেলেই তো চলবে, ছবির কি দরকার আছে?’ আমি বলেছি, ‘আছে, বাচ্চাদের বইতে ছবি থাকবে না, এ কেমন কথা? লেখা পড়ার চেয়ে বাচ্চারা তো বেশি পড়ে ছবি!’ খোকা ছবিসহ হুবুহু লাল কালো বইটি ছেপে দিলেন। একটি কাজের কাজ বটে। কাজটি করে আমার বেশ আনন্দ হয়, নিজের বই বেরোলে যেমন আনন্দ হয়, তেমন আনন্দ। নাহ, নিজের বই বেরোনোর আনন্দর চেয়ে বেশি এ আনন্দ। নিজের বই বেরোলে উচাটন মন আমার আনন্দকে নাশ করে ফেলে। বই হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাতা উল্টো খুঁজতে থাকি ভুল। পাতায় পাতায় বাক্যের ভুল আর শব্দের ভুল গুনতে বসি, সংখ্যার পরিমাণ যত বাড়ে, তত আমার মন খারাপ বাড়ে। মন খারাপ বাড়লে আমার দ্বারা আর যাই হোক লেখালেখি যে হবে না এ ব্যপারে মোটামোটি নিশ্চিত হই।
শান্তিনিকেতনের বসন্তউৎসবে যাচ্ছি শুনে বেলাল চৌধুরী নিজের দেখা বসন্ত উৎসবের সুখদ বর্ণনা করলেন। বর্ণনা শেষে আমাকে বললেন একটি লাল কালো যেন শ্রীপান্থর জন্য নিয়ে যাই। শ্রীপান্থ আনন্দবাজারের কলকাতার কড়চায় বইটির একটি খবর দিয়ে দেবেন। লেখক শ্রীপান্থর নাম ঠিকানা বলে দিলেন। নাম নিখিল সরকার। শ্রীপান্থ তাঁর ছদ্মনাম। ঠিকানা আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট। শান্তিনিকেতনে সুবর্ণরেখা নামে একটি বইয়ের দোকান আছে, দোকানের মালিক ইন্দ্রনাথ মজুমদারের সঙ্গেও দেখা করতে বললেন। ইন্দ্রনাথের মত মানুষ নাকি পৃথিবীতে আর হয় না। শ্রীপান্থকে লাল কালো দেওয়া আর ইন্দ্রনাথের মত অসাধারণ মানুষটির সঙ্গে পরিচিত হওয়া, বেলাল চৌধুরীর দুটো আদেশ বা অনুরোধ আমি রক্ষা করব বলে কথা দিই।
তিনজনের দলটি মহানন্দে কলকাতা পৌঁছোই। প্রথমেই আমি সৌমিত্র মিত্রর খোঁজ করি পশ্চিমবঙ্গ তথ্যকেন্দ্রে। শাহরিয়ার একবার বলেছিল সৌমিত্র মিত্র হলেন কলকাতার ঈশ্বর। যে কোনও জটিল কাজই তিনি মুহূর্তে সরল করে দিতে পারেন। সৌমিত্র মিত্রই আমাদের বাসস্থান ঠিক করে দিলেন। কিডস স্ট্রিটের সরকারি অতিথিশালা। মাগনা থাকা নয়, তবে যে কোনও হোটেলের চেয়ে অর্ধেকের অর্ধেক টাকায় থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা ওখানে। সৌমিত্র মিত্রকে আমাদের আগমনের হেতুটি জানাই যে শান্তিনিকেতনের বসন্তউৎসব আমাদের দেখা হয়নি, তাই দেখতে আসা। দলবল নিয়ে সৌমিত্র মিত্রও যাচ্ছেন শান্তিনিকেতনে, বললেন এক সঙ্গেই যাওয়ার ব্যবস্থা করবেন তিনি। বসন্ত উৎসবে শান্তিনিকেতন চললাম সবাই। শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে রাজকীয় একটি কামরায় আমরা উঠে বসি। জানালায় পর্দা, চেয়ারে গদি, কাঠের আসবাবে নিপুণ কারুকাজ! রেলগাড়ির কোনও কামরা যে এমন সুন্দর হতে পারে তা আমার জানা ছিল না। সৌমিত্র জানালেন এই কামরায় বসে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কলকাতা বোলপুর যাওয়া আসা করতেন। আনন্দ ধরার জায়গা নেই আর, রবীন্দ্রনাথ সারা হৃদয় জুড়ে। সৌমিত্র মিত্রর দলে অশেষ, মোনা আর নাচের মেয়ে রেখা মৈত্র। অশেষ আর মোনা আমার কাছাকাছি বয়সের। রেখা মৈত্র কিছুটা বয়সে বড়। আমার দলে রাকা আর আলতাফ, আলতাফ লোকটি লাজুক, ভাবুক, উদাসীন হলেও রাকা খুব চটপটে, বুদ্ধিমতি, সাহসী, হিসেবী। রাকা রাজশাহীর মেয়ে, কথায় পাকা। আলতাফ ধীরে হাঁটেন, দাঁড়ালে ত্রিভঙ্গ দাঁড়ান, ধীরে বলেন,কম বলেন কিন্তু যখন বলেন ভাল বলেন। দুজনেরই আমার চেয়ে দশ বারো বছর বেশি বয়স। বয়স আসলে কোনও ব্যপার নয়। ছোট বড়তে বেশ ভাল বন্ধুত্ব হতে পারে। ভেবেছিলাম সাত জন মিলে আড্ডা দিয়ে পথ পার হব। কিন্তু কি করে কি করে যেন আমরা আলাদা হয়ে গেলাম, আমরা বাঙালরা একদিকে, ঘটিরা আরেকদিকে। নিরীহ তিনটি বাঙাল বেশির ভাগ সময় চুপচাপ বসে থেকে সৌমিত্র মিত্রর দলটির হৈ হল্লা দেখি। বাঙালরা খুব তাড়াতাড়ি ধরতে পারে না ঘটিদের সব আচরণ। ধরেন, বলেন, শোনেন, করেন, হাঁটেন বলে অভ্যস্ত আমরা, দমদমে নেমেই এ কারকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে হ্রস্ব উকারের কাঁধে সওয়ার হই বটে, তবে জিভ সবসময় কথা শোনে না। দু একটি হ্রস্ব উকারের পর আবার এ কার উড়ে এসে বসে। আমাদের উচ্চারণ নিয়ে, গ্রাম্যতা নিয়ে, অজ্ঞতা নিয়ে কসমোপলিটন শহরের আলট্রামডার্ন ক্যালকেসিয়ানদের সঙ্গে ঠিক খাপ খাওয়াতে পারি না। আমাদের জড়তা, কুণ্ঠা সবই ঘটিদের কাছে মজার জিনিস। মুখ খুললেই মজার জিনিস হয়ে উঠি বলে মুখ যথাসম্ভব বন্ধ করেই রাখা ভাল। যদি খুলতেই হয় মুখ, নিজেদের মধ্যেই খুলি। শান্তিনিকেতনে নেমে যেহেতু আমি আগে এসেছি এখানে, আমি অনেকটা বিশেষরি মত রাকা আর আলতাফকে রবীন্দ্রনাথের চারদিক দেখাই। রবীন্দ্রনাথের বাড়িঘর উঠোন আম্রকাননে হেঁটে বেড়াই। রাতে সৌমিত্র মিত্র আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেন। পাশাপাশি ঘরগুলোর একটিতে আলতাফ আর রাকা, একটিতে মোনা আর অশেষ, একটিতে রেখা মৈত্র আর আমি, আরেকটিতে একা সৌমিত্র মিত্র। গানের সূরে ঘুম ভাঙে ভোরবেলা। ‘ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল লাগল যে দোল,জলে স্থলে বনতলে লাগল যে দোলঞ্চ শুনে হৃদয়ে দোল লাগে। বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে হলুদ রঙের একটি শাড়ি পরে নিই। রাকা অনেক আগেই তৈরি হয়ে বসে আছেন। ঘটিরা তখনও ঘুমে। অনেক রাত অবদি অতিথিশালার ছাদে মদ্যপানের আসরে বসে ছিলেন, ঘুম থেকে উঠতে দেরি তো হবেই কিন্তু বাঙালদের তা সইবে কেন, আমরা তো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উৎসবের একটি কণাও অদেখা রাখতে চাই না। অস্থির হয়ে হাঁটাহাঁটি করি বারান্দায়। ডাকাডাকিতে সৌমিত্র মিত্র ওঠেন। স্নান সেরে কাপড় পরে নাস্তা খেয়ে বেরোন তিনি আমাদের নিয়ে। এই দেরীটুকু সয় না আমার। মন ভাল হয়ে যায় উৎসবের আনন্দ দেখে। বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে মেয়েরা সব উৎসবে মেতে আছে। মঞ্চে মঞ্চে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া চলছে, এদিকে রবীন্দ্রনাথের নৃতনাট্য তো ওদিকে কবিতা পাঠ। চারদিক ছুটে বেড়াই। গান হচ্ছে, গায়ে গায়ে আবীর ছড়ানো হচ্ছে। আমার মুগ্ধ চোখ কোনও গানে ও আবীরে উচ্ছ্বসিত মানুষ থেকে সরেনি। এত গভীর করে এর আগে বসন্তকে গ্রহণ করিনি আমি। এর আগে বসন্তের উতল হাওয়া এমন লাগেনি গায়ে। এমন বাসিনি ভাল পৃথিবীর আলো, হাওয়া, মাটি ও মানুষ। গা পেতে সকলে সকলের আবীর নিয়েছে। মাঠে, আম্রকুঞ্জে, কলাভবনে, সঙ্গীত ভবনে আবীর ছড়ানোর উৎসবে সকলের কণ্ঠে ছিল গান, সকলের শরীরে ছিল নৃত্য। শান্তিনিকেতনের আলাদা একটি ঘ্রাণ আছে, জানি না কোত্থেকে এক ঘ্রাণ এসে প্রাণ ভরিয়ে দেয়। আমি রবীন্দ্রনাথে ডুবে থাকি, আবীরে ডুবি। এত কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথকে দেখলে আশ্চর্য এক অনুভূতি হয়। আমার অনুভবগুলোর আবীর আমাকে রাঙিয়ে তোলে। রঙ খেলায় অভ্যস্ত নই, কাউকে রঙ না ছিটোলেও আমার গায়ে অচেনা অচেনা মানুষেরা রঙ ছিটিয়ে দেয়। অন্য দিন হলে ভীষণ রাগ করতাম, সেদিন রাগ করিনি। দেখি আরও আরও কবিরা রঙে ডুবে আছেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও। কখন যে রাকা আর আলতাফকে হারিয়ে ফেলেছি ভিড়ে জানি না। তবে একা হয়ে যাই না। অনেকে যেচে আমার সঙ্গে আলাপ করতে এসে আন্তরিক হয়ে ওঠে। রাতে গানের উৎসবে দেখা হয় তিন তরুণ কবি সৈয়দ হাসমত জালাল, গৌতম ঘোষ দস্তিদার আর চৈতালি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। চৈতালির কবিতা আমি সেই কতকাল আগে সেঁজুতিতে ছাপতাম। অনেক রাত অবদি আমরা রিক্সা করে ঘুরে বেড়াই শান্তিনিকেতনের আশেপাশে। কোপাই নদীর ধারে বসে পূর্ণিমা রাতের মোহন রূপ দেখি। ঢাকা শহরে থেকে পূর্ণিমা কখন যায়, কখন আসে তার কিছুই টের পাই না। ঢাকার বাইরে সুদূর বোলপুরে আমি যেন আমার কৈশোরটি ফিরে পাই। জালাল, গৌতম, গৌতমের প্রেমিকা উর্মিলা আর আমি যখন ঘুরে বেড়াচ্ছি, সৌমিত্র মিত্র তাঁর দল নিয়ে তারাপীঠের মন্দির ঘুরে এসেছেন। আমার ভাবতে অবাক লাগে সৌমিত্র মিত্র ধর্মে বিশ্বাস করেন। আমি হয়ত ভেবেই নিয়েছিলাম আমার কলকাতার বন্ধুরা কেউই আস্তিক নয়। অবশ্য আস্তিক না হলে যে উপাসনালয় দেখতে যাওয়া যায় না, তার কোনও কথা নেই। আমি নিজেই তো কত মন্দির মসজিদ দেখতে গিয়েছি, অবশ্য গিয়েছি ভেতরের কাণ্ড কারখানা দেখতে। কে কী উদ্দেশ্য নিয়ে মন্দির মসজিদে যায় সেটি বোঝা দায়। গোপনে গোপনে কার মনে কি আছে কে জানে! ঢাকাতেও এরকম, মাঝে মাঝে কারও কারও ধর্ম বিশ্বাসের খবর শুনে আঁতকে আঁতকে উঠি। আল মাহমুদের মত শক্তিশালী কবিও একদিন শুনি পাঁড় ধার্মিক। পান্না কায়সার মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনে জড়িত, তিনিও ভক্তিভরে কোরান পড়েন। বুদ্ধিজীবী মুনতাসির মামুন শুক্রবার মসজিদে যান জুম্মাহর নামাজ পড়তে।
গভীর রাতে শান্তিনিকেতনের সেই অতিথিশালায় আমার ঘুম ভেঙে যায়। একটি পুরুষকণ্ঠ শুনি রেখা মৈত্রর সঙ্গে চাপা স্বরে কথা বলছে। বিছানায় ধস্তাধস্তির মত একটি শব্দ পেতে থাকি। আমি চোখ বুজে পড়ে থাকি, কাউকেই বুঝতে দিই না আমি যে জেগে আছি, আমার জেগে থাকা, আমার টের পাওয়া যেন কাউকে বিব্রত না করে। একসময় দুটি প্রাণীর ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার শব্দ শুনি। নিঃশব্দে উঠে ভেজানো দরজাটি বন্ধ করে দিই ভেতর থেকে। বাকি রাত আমি ঘুমোতে পারি না। কি অদ্ভুত রহস্যে মোড়া এই জগত! দিনের আলো ফুটলে সব আবার পরিস্কার হয়ে ওঠে। মানুষগুলোকে অনেক চেনা লাগে। নতুন হওয়া বন্ধুদের আরও প্রাণবান মনে হয়। শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতা ফিরে যাওয়ার পর জালালের সঙ্গে আমার দেখা হয়ে বেশ কয়েকবার। জালাল আমাকে এত সহজে আপন করে নেয় যে মনে হয় তার সঙ্গে আমার অনেককালের বন্ধুত্ব। কলকাতার মানুষগুলো দ্রুত তুমি করে সম্বোধন করে ফেলে, তাইতেই এমন মনে হয়। তুমি সম্বোধনটির কাঁধে চড়ে এক লাফে দুশ কিলোমিটার দূরত্ব পার হওয়া যায়। কিডস স্ট্রিট থেকে খুব বেশি দূরে থাকে না জালাল। এসি মার্কেটের মাথায় একটি ছোট্ট ঘরে থাকে, মার্কেটের সিকিউরিটি অফিসারের চাকরি করে। আমাকে নিয়ে একদিন সে বেরোয় ময়দানে হাঁটতে। তার দাদার বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যায়। পার্ক সার্কাসের ঘিঞ্জি এলাকায় যাওয়া হয়নি আগে কখনও, কলকাতার এক অন্য রূপ দেখা হয় আমার। জালাল মুসলমান ছেলে, মুসলমান ধর্মে নয়, নামে। মুসলমান নামের কারণে কি করে ভুগতে হয় জালালকে, তার দাদাকে, তার আত্মীয় স্বজনকে তার করুণ কাহিনী সে বর্ণনা করে। তার দাদা সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ বড় লেখক, কিন্তু তাঁকে যেমন করে ওপরে ওঠানো হয়েছিল, তেমন করেই নাকি ভূতলে ফেলেও দেওয়া হয়েছে। যে কোনও একজন মুসলমান লেখক হলেই চলে আনন্দবাজারের, তাই মুস্তফা সিরাজকে বাদ দিয়ে আবুল বাশারকে নিয়ে চলছে হৈ চৈ। ফুলবউ নামে একটি উপন্যাস লিখেছেন তিনি। বইয়ের প্রচারও হচ্ছে খুব। জালাল আমাকে ভেতরের কথা শোনায়, মুস্তফা সিরাজকে সরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশেই নাকি আবুল বাশারকে তোলা হচ্ছে। কদিন পর বাশারকে পছন্দ না হলে তাঁকেও বসিয়ে দেওয়া হবে। বাংলা সাহিত্যের আকাশে কোন নক্ষত্র জ্বলজ্বল করবে, আলো নিবিয়ে দিয়ে কোন নক্ষত্রকে চুপসে ফেলা হবে তা নির্ধারণ করার মালিক হচ্ছে দেশ আর আনন্দবাজার গোষ্ঠী। জালালের হতাশার গহ্বর থেকে ছিটকে বেরোতে থাকে ক্ষোভ। শামসের আনোয়ারের বাড়ি গিয়েছিলাম একবার, শামসের আনোয়ার নামী কবি, তাঁরও দেখেছি রাগ হিন্দু বুদ্ধিজীবিদের ওপর। যত হিন্দু আর মুসলমান নামের সাহিত্যিকদের আমি দেখি কলকাতায়, কেউই ধর্ম মানেন না। কিন্তু তারপরও হিন্দু সাহিত্যিকদের প্রতাপে মুসলমান সাহিত্যিকরা কোণঠাসা বোধ করেন। এ কেবল সাহিত্যের জগতে নয়, সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই একই চিত্র। সংখ্যাগুরু হিন্দু সংখ্যালঘু মুসলমানকে মোটেও সভ্য মানুষ বলে গণ্য করে না। জালালের বর্ণনা শুনি আর বাংলাদেশের হিন্দুদের কথা মনে হতে থাকে আমার। এখানে মুসলমান আর ওখানে হিন্দু একইরকম যন্ত্রণা ভোগ করছে। আমার কাছে কে হিন্দু, কে মুসলমান সে কখনই কোনও বিষয় নয়। কোনও শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে, সে কোনও ধর্ম নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। পিতামাতার ধর্মকে নিজের ধর্ম হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয় যে কোনও মানুষই। কোনও এক কালে মুত্যুভয়ে, অনিশ্চয়তার আশঙ্কায়, ক্ষমতার লোভে কিছু বুদ্ধিহীন এবং কিছু কুবুদ্ধির লোক ধর্ম নামক একটি জিনিস তৈরি করেছে। ধর্ম ছড়িয়েছে এক গোত্র থেকে আরেক গোত্রে, এক সমাজ থেকে আরেক সমাজে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে। মানুষ সব সময় যে য়েচ্ছ!য় কোনও ধর্ম গ্রহণ করেছে তা নয়, জোর জবরদস্তি করে ধর্ম চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে মানুষের ওপর। ধর্মের কারণে যুদ্ধ বেঁধেছে, লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে । ভারতবর্ষে হিন্দুত্ব, ইসলাম, ক্রিশ্চান ধর্ম সবই ভারতবর্ষের বাইরে থেকে এসেছে। সেই কত কাল আগে কিছু লোক ভারতবর্ষে ঢুকেছিল, বেদ রচনা করেছিল! বসে বসে এরপর অসভ্য কিছু নিয়ম তৈরি করেছে, শ্রেণী ভেদ করেছে, জাত বর্ণ ভাগ করেছে, মানুষের মনে ঘৃণার সৃষ্টি করেছে, মেয়েদের নিকৃষ্ট আখ্যা দিয়ে পুঁথি রচনা করেছে। কত সহস্র বছর কেটে গেছে, আজও সেই নিয়ম ভারতবর্ষের অধিকাংশ লোক পরম শ্রদ্ধাভরে পালন করছে। কত নির্বোধ হলে উঁচু জাত আর নিচু জাতের সংজ্ঞায় মানুষ বিশ্বাস করতে পারে! এই জাত ভেদের আবর্জনায় ধর্মের ব্যাধি আরও জেঁকে বসেছে। একসময় নিম্নবর্ণ হিন্দুরা উচ্চবণগ হিন্দুর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে নিজ ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম বা খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে। মুসলমান বাঙালিদের মধ্যে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে কেউ কেউ দাবি করে তারা আশরাফ, তারা আতরাফ নয়। আতরাফ হল নিচু জাত। আশরাফ বড় জাত, মধ্যএশিয়া থেকে আগত মুসলমানের উত্তরসুরি। আশরাফদের অনেকে সে কারণে উর্দু চর্চা করে। যেসব মুসলমান বাংলা বলে, তারা নিম্নবর্ণ হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হওয়া। বাংলা বলতে তাই উঁচু মুসলমান জাতের বড় আপত্তি। আমার বলতে কোনও সংকোচ হয় না যে আমি উঁচু শ্রেণীর নই, আমি আতরাফ, নিম্নবর্ণ হিন্দু, হিন্দু জমিদার বা হিন্দু রাজার অত্যাচারে কোনও এক কালে হিন্দুধর্ম ছেড়ে আমার পূর্বনারী বা পূর্বপুরুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। বাংলা আমার ভাষা, আমার সংস্কৃতি। আমি গৌরব বোধ করি আমার বাঙালিত্ব নিয়ে। ভারতবর্ষের বেশির ভাগ মানুষই ইতিহাস ঘাঁটে না। ঘাঁটলে মানুষে মানুষে ধর্মের বিভেদ, জাত বর্ণের বিভেদের মত বর্বরতা অনেক আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। এই ভারতবর্ষের মুক্তচিন্তার মানুষেরা বলে গেছেন সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। দুশ বছর আগে লেখাপড়া না জানা লালন ফকির নামের এক লোক জাতের বিভেদকে তুচ্ছ করে মানবতার গান গেয়ে গেছেন। আর আজ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা লোক জাত নিয়ে মাথা ঘামায়! দেখলে অবাক লাগে। মানুষ তো জানি সামনের দিকে এগোয়, আলোর দিকে। পেছনের অশিক্ষা অজ্ঞতা আর অন্ধকার আঁকড়ে রেখে কী সুখ পায় তারা!
জালালের ক্ষোভের সঙ্গে যে কোনও অত্যাচারিতের ক্ষোভই মেলে। কিডস স্ট্রিটের বাড়িটির বারান্দায় বসে অন্ধকার কলকাতার দিকে কালো চোখ মেলে তাকিয়ে থাকি। ভোর হলেই কলকাতা আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠবে। কলকাতা এত সুন্দর, এত আন্তরিকতা মানুষের, এত প্রাণের ছোঁয়াচ চারদিকে, এত ভালবাসি কলকাতাকে কিন্তু একটি তথ্য শুনে আমার মন খারাপ হয়ে যায় যে এ শহরে হিন্দু আর মুসলমান পাশাপাশি বাড়িতে বাস করে না। বেশির ভাগ মুসলমানই একটি নির্দিষ্ট এলাকায় থাকে। বাড়িঅলা হিন্দু হলে কোনও মুসলমানকে বাড়িভাড়া দেয় না। বাংলাদেশে এরকম কোনও নিয়ম নেই। হিন্দু মুসলমানের জন্য আলাদা আলাদা এলাকা নেই। যে কারও অধিকার আছে যে কোনও এলাকায় বাস করার। বড় বড় দালান উঠছে ঢাকা শহরে। দোতলায় হিন্দু, তিনতলায় মুসলমান, চারতলায় বৌদ্ধ, পাঁচতলায় খ্রিস্টান বাস করছে। এতে কারও কোনও আপত্তি করার কিছু নেই। বাংলাদেশে যে কোনও হিন্দুর কাছে মুসলমানের ধর্মানুষ্ঠান, রীতি নীতি কিছুই অপরিচিত নয়। মুসলমানের কাছে হিন্দুর বারো মাসে তেরো পুজোর কিছুই অজ্ঞাত নয়। অজ্ঞাত নয় কারণ তারা একজন আরেকজনের প্রতিবেশী। কলকাতার মুসলমানরা হিন্দুর পরব অনুষ্ঠান সম্পর্কে জ্ঞান রাখলেও হিন্দুরা জানে না মুসলমানের সব আচার অনুষ্ঠানাদির খবর। কলকাতায় একটি প্রশ্ন অনেকে করে, তুমি মুসলমান না বাঙালি? যেন মুসলমান হলেই অবাঙালি হতে হবে, যেন বাঙালি মানেই হিন্দু! কলকাতায় অনেক অবাঙালি মুসলমান বাস করে, তা ঠিক। কিন্তু বাঙালি মুসলমানের সংখ্যা তো কম নয়। মুসলমান নাম দেখেই তাকে অবাঙালি ভাবার রেওয়াজ অশিক্ষিত হিন্দুদের মধ্যে খুব বেশি। মেলামেলা না থাকলে এ-ই হয়। বাংলাদেশে যাদের আনাগোণা আছে, বাঙালি হিন্দু যারা বাঙালি মুসলমানদের সংস্পর্শে এসেছে, তারা এই ভুলটি সহসা করে না। তারপরও আমি দেখেছি কলকাতার বাঙালি মুসলমানের ক্ষোভের শেষ নেই। ক্ষোভের কারণটি আমি বুঝি। সংখ্যালঘু হিসেবে বেঁচে থাকার হাজারো সমস্যা। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরা কি কম নির্যাতন ভোগ করছে! যদি আমি তুলনা করি, বলব, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলমানরা অনেক আরামে আছে বাংলাদেশের বাঙালি হিন্দুদের চেয়ে। দীর্ঘবছর যাবৎ বামপন্থী সরকারের শাসন চলছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে। এই সরকার সংখ্যালঘু মুসলমানের সবরকম নিরাপত্তার ব্যবস্থা করছে। মুসলমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের কোনও ব্যবস্থা নেই ভারতে, কিন্তু বাংলাদেশে রাষ্ট্রই সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে গণ্য করে। রাষ্ট্র থেকেই সংখ্যালঘুদের জন্য কোনও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয় না। বাংলাদেশ হতে পারত একটি সাম্প্রদায়িক কলহমুক্ত দেশ। কারণ দেশটিতে হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি বাস করছে, কারণ মুসলমানের ধর্মগ্রন্থ কোরানে কি লেখা আছে তা নিরানব্বই ভাগ মুসলমানই জানে না যেহেতু তাদের ভাষা আরবি নয়, জানে না বলেই তারা জানে না বিধর্র্মীদের উপেক্ষা করার কথা, জানে না বলেই জানে না বিধর্মীদের কচুকাটা করার কথা, কারণ পাশাপাশি বাস করলে সহমর্মিতা গড়ে ওঠে পরষ্পরের মধ্যে, কারণ হিন্দু মুসলমানের জন্য কোনও ইশকুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা নয়, কারণ হিন্দু মুসলমানে বিয়ে হয়, কারণ হিন্দু মুসলমানে বন্ধুত্ব হয়, কারণ তারা বাঙালি, কারণ তাদের ভাষা এক, কারণ তাদের সংস্কৃতি এক, কারণ কোনও অবাঙালি মুসলমানের সংষ্কৃতি বাঙালি মুসলমানের ওপর বর্ষিত হয়নি, কারণ বাঙালি মুসলমানের পুর্বপুরুষ নিম্নবর্ণ হিন্দু, কারণ দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গে রয়ে যাওয়া হিন্দু বেশির ভাগই জমিদার নয়, জমিদারের প্রজা, প্রজায় প্রজায় মিল হয় রাজায় প্রজায় মিলের চেয়ে বেশি, কারণ বেশির ভাগ হিন্দুই ওদেশে দরিদ্র অথবা হিন্দু মুসলমানের ভেদ না মানা আদর্শবাদী মানুষ। এত সব কারণ থাকা সত্ত্বেও থেকে থেকে মুসলমান নামের মানুষেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে হিন্দুদের ওপর, লুটপাট, ধর্ষণ ইত্যাদি চলে অবাধে। এর কারণ কি? কারণ নিশ্চয়ই আছে। কারণ সাপ বেরিয়েছে গর্ত থেকে। ধর্মান্ধ সাপ। একাত্তরে যুদ্ধের সময় যে সাপেরা পাকিস্তান কায়েম করতে চেয়েছিল, যে সাপগুলোর পূর্বপুরুষ ধর্মের নামে ভারতের ভাগ চেয়েছিল; সেইসব বিষাক্ত সাপ। একটি সাপই পারে একশ মানুষকে পিছু হটাতে। সংখ্যায় কত তারা! খুব বেশি নয়। কিন্তু সংখ্যা বাড়ছে, সংখ্যা বাড়ার শব্দ পাই, হিশহিশ শব্দ শুনি বাতাসে।
আমি ভারত ভাগ দেখিনি, ভারত ভাগের কষ্ট আমার ভেতরে গভীর করে বাসা বাঁধার কথা নয়। কিন্তু বাসা বাঁধে। ধর্ম নামক একটি মিথ্যের জন্য বিশাল একটি দেশের বিভক্ত হওয়ার কষ্ট আমি লালন করি, কষ্ট আরও ঘন হয় যখন পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের দেখি, বেশির ভাগই পূর্ববঙ্গে সহায় সম্পত্তি বাড়িঘর ফেলে চলে আসা উদ্বাস্তু। শূন্য থেকে গড়ে তুলেছে আবার সব। অনেকে সেই যে সাতচল্লিশ সালে দেশভাগের সময় চলে এসেছিল পশ্চিমবঙ্গে, ফিরে আর যায়নি পূবে। কেবল স্মৃতি রয়ে গেছে পুকুর ভরা মাছের, গোলা ভরা ধানের, দিগন্ত অবদি যত দূর চোখ যায় আম কাঁঠালের বনের। কলকাতার শহুরে বস্তিতে গাদাগাদি করে বাস করে পূর্ববঙ্গের স্মৃতি মধূর ঠেকে নিশ্চয়ই। কিন্তু কজন ভাবে ওদেশে যারা রয়ে গেছে, দারিদ্র বা আদর্শের কারণে যারা ওপার থেকে এপারে আসেনি, তারা কেমন আছে! এই ভাবার দায়িত্বটি বাংলাদেশ নামের নতুন একটি দেশের নতুন মানুষের। কেবল ভাবা নয়, প্রচুর কাজও আছে করার। প্রথম ভারত ভ্রমণের পরই উথলে পড়া আবেগ থেকেই কয়েকটি কবিতা লিখেছিলাম দুই বাংলার অভিন্নতা নিয়ে, কাঁটাতারের নির্মমতা নিয়ে, ভারত ভাগের মিথ্যে নিয়ে। ধর্ম ধর্ম করে যে ভারত ভাগ হল, মুসলমানের জন্য পাকিস্তান নামে দুই খণ্ডের একটি দেশ হল, কই মুসলমানরা তো এক দেশে বাস করতে পারেনি! একাত্তরের যুদ্ধে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হওয়াই তো প্রমাণ করেছে ভারত ভাগের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। আমার কবিতাগুলো ছাপা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিষাক্ত সাপের দল আমাকে অবলীলায় দেশদ্রোহী হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। মৌলবাদিদের পত্রিকায় আমাকে গালাগাল করে প্রায়ই লেখা বেরোয়। কখনও পড়া হয়, কখনও হয় না। যার যা ইচ্ছে লিখুক, আমার কিছু যায় আসে না। আমি আমার অনুভবের কথা লিখে যাবো। আমি আমার অন্তর্গত বিষাদের কথা, বেদনার কথা লিখে যাবো। আমি আমার স্বপ্নের কথা অসংকোচে লিখে যাবো। একটি অখণ্ড ভারতবর্ষের স্বপ্ন আমি গোপনে গোপনে দেখি, না হলেও অখণ্ড একটি বাংলার স্বপ্ন আমার হৃদয় যমুনায় সাঁতার কাটে।
কলকাতায় এসেই চেনা পরিচিত বন্ধুদের জন্য আনা উপহার বাড়ি বাড়ি গিয়ে দিয়ে আসি। খুব ভাল লাগে উপহার দিতে মানুষকে। সুভাষ মুখোপাধ্যায় যখন শিশুর মত খুশি হয়ে ওঠেন ফতুয়া পেয়ে, দেখে খুব আনন্দ হয়। উপহার দেওয়ার স্বভাবটি, আমার বিশ্বাস, আমি মার কাছ থেকে পেয়েছি। মাকে যতই অপছন্দ করি আমি, রক্ত বলে একটি ব্যপার আছে, রক্তের মধ্যে তিনি খানিকটা হলেও আছেন। মা এরকম নিজের যা কিছু আছে অন্যকে বিলিয়ে দিয়ে সুখ পান। নিজের খুব বেশি কিছু নেই মার। না টাকা পয়সা, না গয়নাগাটি, না শাড়ি কাপড়। নিঃস্ব মাকে বারবারই দেখি আরও নিঃস্ব হতে। মার এই বেহিসেবী উদার হওয়া দেখে মার ওপর সময় সময় রাগ করি আমি। একটি শাড়ি হয়ত দিলাম মাকে, মা দুদিন খুব খুশি হয়ে শাড়িটি পরলেন, কদিন পরই দেখি সেই শাড়ি গদার মার গায়ে। গদার মার শাড়ি নেই, ত্যানা পরে ভিক্ষে করতে আসে, দেখে মা দিয়ে দিয়েছেন শাড়িটি। ইয়াসমিনেরও দেখি হাত হয়েছে দেওয়ার। কিন্তু মার মত এমন নিজেকে নিঃস্ব করে নিঃস্বার্থ হতে আমি বা ইয়াসমিন কেউই পারি না। দাদা আর ছোটদা পেয়েছেন বাবার স্বভাব, পাই পয়সার হিসেব করেন। তাঁরা বাবার চেয়েও কয়েক কাঠি ওপরে। বাবা অন্তত গরিব রোগীদের বিনে পয়সায় চিকিৎসা করেন। আসলে চিকিৎসা করা বাবার নেশা। পয়সা পাবেন না বা কম পাবেন বলে তিনি প্রেসক্রিপশন লেখা থেকে নিজেকে বিরত রাখেন না। শহরের ধনী গরিব সকলেই বাবার চিকিৎসায় ভাল ফল পেতেন, এখনও পান, কিন্তু বাবার চেম্বারে ভিড় এখন আগের চেয়ে অনেক কম, বেশির ভাগই দূর দূরান্ত থেকে আসা চেম্বারের বারান্দায় পাতা চেয়ারগুলোয় চামড়া- ফাটা পা তুলে বসে থাকা গরিব রোগী। ময়মনসিংহে নতুন নতুন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আসার পর ধনী রোগীরা এখন তাঁদের কাছেই যান। পুরোনো অভিজ্ঞ ডাক্তার বাবার কাছে অবশ্য আসেন কেউ কেউ, বিশেষজ্ঞের চিকিৎসায় সুস্থ না হলে তবে আসেন। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার মূল্য অনেক, চেহারা দেখেই বলে দিতে পারেন যক্ষা হয়েছে, এক্সরে করার দরকার পড়ে না। বাবার মেডিকেল কলেজে অধ্যাপনার চাকরি, চেম্বারে রাত বারোটা পর্যন্ত রোগী দেখার ব্যস্ততা, তারপরও ফাঁক পেলেই তিনি তাঁর পুরোনো ডাক্তারি বই পড়েন। যেদিন ক্লাস থাকে, তার আগের রাতে বাড়িতে রাত দুটো তিনটে পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। বাবার ব্যস্ত জীবনটি আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করেছে। আমার নিজের জীবনটিকে বসে থাকা শুয়ে থাকার আলস্য না দিয়ে এই যে ব্যস্ত করে তুলেছি, ব্যস্ততায় বাবার মত আনন্দ পাচ্ছি, সেটি তো বাবার কাছ থেকেই পাওয়া। বাবা মার কত রকম স্বভাব যে আমাদের রক্তে আর মস্তিস্কে ঘাঁপটি মেরে থাকে, ধীরে ধীরে সেই স্বভাবগুলো আমাদেরই অজান্তে আমাদের চরিত্রের অন্তর্গত হয়ে যায়। আমার নিজের চরিত্রটির ব্যাখ্যা আমি অনেকসময় করতে পারি না। একসময়ের লাজুক মেয়ে, যে মেয়ে অচেনা মানুষ দেখলে লুকোতো, দিব্যি সে নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে, কথা কম বলা মানুষটি মুখে খই না ফোটাতে পারলেও দিব্যি গড়গড় করে কথা বলছে। আগের আমি আর এই আমিকে মোটেও মেলাতে পারি না। কলকাতায় চেনা পরিচিতদের সংখ্যা বাড়ছে। কলকাতাকেও ঢাকার মত আপন মনে হয়। বড় বড় লেখক শিল্পীদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, কিন্তু সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি বেশি। বিশেষ করে যদি হৃদয়বান কেউ হয়। ইন্দ্রনাথ মজুমদারের মুখের সরল হাসিটি দেখে তাঁকে বড় আপন মনে হয় আমার। চমৎকার আলাভোলা মানুষ এই ইন্দ্রনাথ। সুবর্ণরেখা নামে কলকাতার কলেজ স্ট্রিটেও একটি বইয়ের দোকান আছে তাঁর। দোকানটি খুঁজে পেতেই আমার সময় লেগেছে অনেক। দোকান পাওয়া গেল কিন্তু সেটি এত ছোট যে দাঁড়াবার জায়গা নেই। পুরোনো বইয়ে ঠাসা ঘরটি। পুরোনো বই বিক্রি করেন ইন্দ্রনাথ, নতুন বইও ছাপেন, তবে আলতু ফালতু কোনও বই নয়, বইএর মত বই হলেই ছাপেন। ব্যবসার চেয়ে আদর্শই বেশি কাজ করে বই ছাপার পেছনে। একটি ভাল বই পেলে সে বই হয়ত বিক্রি হবে না খুব, তবু আর কেউ না ছাপলেও তিনি ছাপেন। যেদিন দুপুরে গেলাম ইন্দ্রনাথ মজুমদারের সঙ্গে দেখা করতে, তিনি বেরিয়ে পড়লেন আমাকে নিয়ে কড়া রোদ্দুরে। বললেন ‘খাচ্ছেন তো বড় বড় জায়গায়, আজ চলুন আপনাকে একটা খুব ভাল জায়গায় নিয়ে যাই।’ ভাল জায়গাটি কোথায়? ভাল জায়গাটি হল এক এক উড়ের দোকান। উড়ের দোকানে বসে কলাপাতায় মাছভাত খাই দুজন। খুব অল্প পয়সায় খাওয়া। এই খাওয়াতে যে আনন্দ পেয়েছি, তা ঝকঝকে দামি রেস্তোরাঁয় বসে পাইনি।
কলকাতায় অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। রবীন্দ্র সদনে, শিশির মঞ্চে, কলা মন্দিরে, একাডেমিতে কিছু না কিছু হচ্ছেই। রবীন্দ্রসদনে কবিদের কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান হল একদিন। সৌমিত্র মিত্র আলতাফ হোসেন আর আমাকে ঢুকিয়ে দিলেন কলকাতার কবিদের সঙ্গে মঞ্চে বসে কবিতা পড়ার জন্য। কলকাতার মঞ্চে আগে কবিতা পড়েছি, আড়ষ্টতা তাই কমই ছিল এবার। আলতাফ হোসেনের জন্য প্রথম পড়া কলকাতায়, লাজুক মানুষটি স্বর ওঠাতে পারলেন না তেমন, গালে আর গলায় ওঠানো আঙুলকেও নামাতে পারলেন না কবিতা পড়ার সময়। বাংলাদেশের কবিদের কলকাতায় বেশ খাতির করা হয়। মুসলমান নামের মানুষগুলো অন্য দেশ থেকে এসে বাংলায় কথা বলছে, বাংলায় কবিতা পড়ছে, দেখতে হয়ত অনেকে মজা পায়। কারও কারও আছে করুণার চোখ। বেচারা বাংলাদেশিদের পিঠে দাদাগিরির কয়েকটি চালিয়ে যাও, মন্দ হচ্ছে না জাতীয় স্নেহের চাপড় পড়ে। কেউ কেউ আবার বাংলাদেশের যে কোনও ব্যপারে অতিমাত্রায় উচ্ছ্বসিত। বাংলাদেশের ধুলো বালি জল কাদা এনে দিলেও গায়ে মাখবে। পশ্চিমবঙ্গের কিছুই ভাল নয়, যত ভাল সব ওই বাংলাদেশ নামের দেশটিতে, আবেগের তাড়নায় এমন কথাও বলে ফেলে। বাঙালদের খানিকটা চিড়িয়া, খানিকটা মানুষ, সরল সহজ, আন্তরিক, অতিথিপরায়ণ, দুহাতে খরচ করতে পারা, বেহিসেবী, অলস, আরামপ্রিয়,খানেঅলা, দানেঅলা, পকেট ভারিঅলা, কিছু কম জানেঅলা, কিছু কম বুঝনেঅলা বলে মনে করা হয়। অনুষ্ঠানে নতুন অনেক কবি আর আবৃত্তিকারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন সৌমিত্র মিত্র। জয় গোস্বামীর মত প্রতিভাবান কবির সঙ্গে সামান্য হলেও কথা হয়। গায়ে মেদ মাংস নেই আধা সন্ন্যাসী গোছের মানুষটি আজকাল কী চমৎকার কবিতা লিখছেন! শরীরে প্রতিভা থাকে না। প্রতিভা মস্তিস্কের কোষে কোষে জন্ম থেকেই বাস করে। আমার অনুর্বর মস্তিস্কে যতই জল সার ঢালি না কেন, জয়ের প্রতিভার শতভাগের একভাগও গজাবে না। যার হয় তার হয়। সকলের হয় না। সকলের হলে সকলেই কবি হত। প্রতিভা থাকলে শরীরে মাংস কমাবার বা বাড়াবার দরকার পড়ে না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মত বিশাল বপুর লোকও প্রতিভার কারণে সুদর্শন হয়ে ওঠেন। হাড়গিলে জয়কে হাড়গিলে বলে মনে হয় না। নিজের পেচ্ছ!বের অসুখ নিয়ে যতই তিনি দুঃখ করুন, তাঁকেই মনে হয় একশ লোকের মধ্যে সবচেয়ে স্বাস্থ্যবান।
সৌমিত্র নিজে আপাদমস্তক ঘটি হয়েও বাঙালদের জন্য সময় না থাকলেও সময় তৈরি করে সময় দেন। সৌমিত্রর সঙ্গে মিত্রতা না থাকলে কলকাতায় স্বচ্ছন্দে চলাফেরা সহজ হত না। আমাদের সারাক্ষণের সঙ্গী না হলেও অন্তত তিনি বলে দেন কী প্রয়োজন হলে কোথায় যেতে হবে। একা একা ঘুরে ঘুরে পথ হারাতে হারাতে আর খুঁজে পেতে পেতে শহর চেনা যায়, গাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে শহর সত্যিকার চেনা যায় না। আমার ভাল লাগে ভিড় ভাট্টায় হেঁটে বেড়াতে, সরু সরু পুরোনো গলিতে ঢুকে মানুষের জীবন দেখতে, রাস্তার কলের জলে স্নান করা মানুষ দেখতে, ভাল লাগে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে মাটির ভাঁড়ে চা খেতে, কলেজ স্ট্রিটের বই পাড়ায় হেঁটে হেঁটে বই কিনতে, গড়িয়াহাটের ফুটপাত থেকে শাড়ি কিনতে। কত কী যে করার আছে কলকাতায়! সাধ মেটার আগে সময় ফুরিয়ে যায়। কেবল তো শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসব দেখতে আর রবীন্দ্র সদনে কবিতা পাঠ উপভোগ করতে পশ্চিমবঙ্গে আসিনি। কিছু দায়িতও্ব আছে কাঁধে। লাল কালো বইটি পৌঁছে দিতে হবে শ্রী শ্রীপান্থকে, বেলাল চৌধুরী বলে দিয়েছেন। কাঁধের দায়িত্বটি নিয়ে প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটে আনন্দবাজার আপিসে রাকা আর আলতাফকে নিয়ে ঢুকি, উদ্দেশ্য দুটো, শ্রীপান্থকে লাল কালো বইটি দেওয়া আর শংকর লাল ভট্ট াচার্যকে একটি নির্বাচিত কলাম দেওয়া। শংকর লাল ভট্টাচার্য সানন্দা পত্রিকায় চাকরি করেন, একবার ঢাকা গিয়েছিলেন, তখন পরিচয় হয়েছিল, কলকাতাতেও দেখা হয়েছিল আগের বার। তিনি আনন্দবাজারর ছাদে বসে সাহিত্যিক অনেক বিষয় নিয়ে অনর্গল বলছিলেন, যার বেশির ভাগই আমার মাথায় ঢোকেনি। তবে একটি জিনিস ঢুকেছিল, তা হল মানুষটি বিদেশি সাহিত্য বেশ পড়েছেন, মাথায় কিলবিল করছে বিদ্যে। পড়ুয়া লোক যত দেখি কলকাতায়, তত কিন্তু ঢাকায় দেখি না। বাঙালি হিন্দুর পড়ার অভ্যেস অনেককালের। বিদ্যাচর্চায় বাঙালি হিন্দু বাঙালি মুসলমানের চেয়ে একশ বছর এগিয়ে আছে। মেঘচ্ছদের ভাষা পড়ব না বলে বাঙালি মুসলমান অহংকার করেছিল, বাঙালি হিন্দু করেনি। সেটির প্রভাব তো কিছুটা থাকবেই। শ্রীপান্থ কোন ঘরে বসেন, বারান্দায় হাঁটতে থাকা একজনকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিই। ঘরের দরজা ঠেলি ভয়ে ভয়ে, ভয়ে ভয়ে এ কারণে যে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ঘরগুলোয় জ্ঞানের ভাণ্ডারগুলো গম্ভীর গম্ভীর মুখ করে বসে থাকেন, আবালের মত ঢুকে কোনও গভীর কিছুতে কারও তন্ময় হয়ে থাকাকে নষ্ট করে দিই যদি! ঘরে ঢুকে দেখি গোল মুখের একটি ছোটখাটো লোক আর দুজন গোল মুখের চেয়ে অল্প বয়সের, বসা। তিনজনই লিখছেন।
‘এখানে কি শ্রীপান্থ বলে কেউ আছেন?’ জিজ্ঞেস করতেই গোল মুখের মধ্যবয়ষ্ক লোকটি কাগজ থেকে মাথা তুলে কলম থামিয়ে বললেন, আমি শ্রীপান্থ।’
‘আমি ঢাকা থেকে এসেছি। বেলাল চৌধুরী আপনার জন্য একটা বই পাঠিয়েছেন।’
‘কি বই?’
‘লাল কালো।’
‘লাল কালো?’
বইটি তাঁর হাতে দিলে তিনি আমাকে বসতে বললেন। ভেবেছিলাম, বই পেয়ে ‘ঠিক আছে, ধন্যবাদঞ্চ বলে তিনি আমাকে বিদায় দেবেন। সে তো দিলেনই না, রাকা আর আলতাফকেও বসতে বললেন তিনি। বইটি হাতে নিয়ে শ্রীপান্থ বেশ খুশি। পাতা উল্টো ছবিগুলো দেখে মুখে হাসি ফুটছে তাঁর। বললেন ‘কলকাতায় তো লাল কালোর রিপ্রিন্ট নেই, বাংলাদেশ থেকেই শেষ অবদি বইটি বেরোলো। কলকাতার কড়চায় আমি এর একটি খবর করে দেব।’ আনন্দবাজার পত্রিকায় কলকাতার কড়চা বিভাগটি শ্রীপান্থই দেখেন। তাছাড়া তিনি পত্রিকার সম্পাদকীয় লেখেন প্রায়ই। ঘরের টলটল করা প্রতিভা অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় আর গৌতম রায়কে শিখিয়ে পড়িয়ে তুখোড় সাংবাদিক বানাচ্ছেন। কি নাম আপনার, কোথায় বাড়ি, কি করেন ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর তসলিমা, ময়মনসিংহ, ডাক্তারি সবিনয়ে উল্লেখ করি। রাকা আর আলতাফের পরিচয়ও দেওয়া হয়।
চা আসে। দুধ চা। খেতে খেতে শ্রীপান্থ বললেন তাঁর বাড়িও ময়মনসিংহে। দেশভাগের সময় চলে এসেছেন এপারে।
‘ময়মনসিংহের কোথায়?’ আমার কণ্ঠে সিংহের আগ্রহ।
‘ধোবাউড়া।’
ধোবাউড়া ছেড়ে সেই যে চলে এসেছেন আর ফিরে যাননি কোনওদিন। পূর্ববঙ্গ থেকে ভারত ভাগের পর যারা চলে এসেছিলেন এদেশে, তাদের অনেকের মত শ্রীপান্থেরও আর ফিরে যাওয়া হয়নি দেশের মাটিতে। ইচ্ছে করেন যাবেন একবার, দেখে আসবেন কেমন আছে দেশটি। ইচ্ছে থাকলেও সকলের হয় না যাওয়া। বাাংলাদেশ থেকে এলে পূর্ববঙ্গের কিছু লোক বেশ খাতির করেন। শ্রীপান্থও আমাকে খাতির করলেন। খাতির করা মানে বসতে বলা, নাম ধাম জিজ্ঞেস করা। বাড়ি কোথায়, কি করি, জিজ্ঞেস করা, চা খাওয়ানো। সবই করেছেন তিনি। এবার বিদায় নেবার পালা। যখন বিদায় নেব, জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি লেখেন টেখেন নাকি?’
শুনে আমার কান লাল হয়ে উঠল। যৎসামান্য লিখি বটে, কিন্তু তা নিশ্চয়ই উল্লেখ করার মত নয়, বিশেষ করে এমন পণ্ডিত ব্যক্তির সামনে। আমার পক্ষে বলা সম্ভব হয় না যে আমি লিখি। আলতাফ বলেন, ‘ও লেখে। ও তো বেশ বিখ্যাত হয়ে উঠেছে বাংলাদেশে।’ ‘তাই নাকি!’
শ্রীপান্থ ওরফে নিখিল সরকার মুচকি হাসলেন।
আমি লজ্জায় নখ খুঁটতে থাকি।
‘হাতে কোনও বই টই আছে?’
‘বই!’
‘আপনার লেখা কোনও বই আছে আপনার কাছে?’
ব্যাগের ভেতর একটি নির্বাচিত কলাম আছে। বইটি শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্য। বড় সংকোচে ব্যাগ থেকে বইটি দেখতে দিই নিখিল সরকারকে। তিনি হাতে নিয়ে উল্টো পাল্টো বললেন, ‘আমার কাছে থাকুক এটা।’
মৃদু স্বরে বলি, ‘শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্য এনেছিলাম।’
‘আমাদের সানন্দার শংকর তো! ওকে পরে একটা দিয়ে দেবেন।’
ফটো তোলার এক লোককে ডেকে তিনি বললেন, ‘মেয়েটার একটা ছবি তুলে দাও তো! বাংলাদেশের মেয়ে, ওর বইয়ের একটা খবর করে দেব কড়চায়।’
সাদা আবার সাদাও নয়, সুতোয় আঁকা ছোট ছোট লাল কালো ফুলের তসরের শাড়ি পরা, কপালে একটি লাল টিপ, মুখে মলিন হাসি, ওভাবেই— ক্লিক। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় আমার বইয়ের খবর ছাপা হবে, তাও আবার ছবি সহ! আনন্দ করব কি, বিস্ময়ে বোবা হয়ে থাকি। বাংলাদেশের কবি সাহিত্যিকদের জন্য দেশ আনন্দবাজারে চিরকালই নাগালের বাইরে। কখনও দেশ পত্রিকায় কারও কবিতা ছাপা হলে নাক এমন উঁচুতে ওঠে, যে বছর পার হলেও সে নাক স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরে না। এই যখন অবস্থা, তখন আমার মত পুঁচকে নতুন লেখক বিস্ময়ে বোবা হবে না কেন!
বিস্ময়ে বোবা কত আর হয়েছি সেদিন! আমার জন্য সহস্রগুণ বিস্ময় অপেক্ষা করছিল কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে আসার কিছুদিন পর। ফিরে এসে হাসপাতালের ডিউটি, ফাঁকে চার পাঁচটে পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখা, মাঝে মাঝে প্রকাশকের তাগাদার উপন্যাস রচনা করা, এসব নিয়ে চলছিল। হঠাৎ চিঠি। চিঠি আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে। নির্বাচিত কলাম বইটির জন্য দেশ আনন্দবাজারের ১৯৯২ সালের আনন্দ পুরষ্কার আমাকে দেওয়া হচ্ছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারি নি। আবার পড়ি চিঠি। আবারও। চিঠি কি ভুল করে আমার কাছে এসেছে! কিন্তু আমার নামটিই তো লেখা চিঠির ওপর। স্বপ্ন দেখছি না তো! না, স্বপ্নেরও তো সীমা আছে, আমার স্বপ্ন এত সীমা ছাড়িয়ে কখনও যায়নি। আমি যে আনন্দ-চিৎকারে বাড়ি ফাটাবো, সে জিনিসটিও করতে পারি না। বোবা হয়ে আছি। রক্ত চলাচল থেমে আছে বিস্ময়ে। বাংলা সাহিত্যে আনন্দ পুরষ্কার হচ্ছে সবচেয়ে বড় পুরষ্কার। সবচেয়ে নামী। সবচেয়ে দামী। বাংলাদেশের কেউই এ পর্যন্ত এ পুরষ্কার পায়নি। আর আমি সেদিনের এক লেখক, তাও শখের লেখক, শখে কবিতা লিখি, প্রয়োজনে কলাম লিখি, আমি কি না পাচ্ছি এই পুরষ্কার! কী করে সম্ভব এটি! অসম্ভব অবিশ্বাস্য একটি ঘটনা। আমি ঠিক বুঝে পাই না আমি কি করব। একবার বসি, একবার দাঁড়াই। একবার আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে অবাক চোখে দেখি, এ ঠিক আমি তো! পেচ্ছ!ব চাপে। মাথা ঘুরতে থাকে। বোবা হয়ে থাকার পাট চুকলে বাড়িতে এক মিলনই ছিল, তাকেই হাঁপাতে হাঁপাতে বলি, ‘মিলন আমি আনন্দ পুরস্কার পাইছি।’ আনন্দ পুরস্কার ঠিক কি জিনিস, মিলন জানে না। এটি যে যায় যায় দিনের রচনা পুরস্কার জেতার মত নয়, এ যে অন্য কিছু খুব বড় কিছু অসম্ভব রকমের বড় তা বুঝিয়ে বলার পর মিলন হাঁ হয়ে থাকে। মিলন বোনের স্বামী হলেও আমার কাছে ঠিক বোনের স্বামী নয়, ছোট ভাই গোছের কিছু। চিঠিটি হাতে নিয়ে মিলনকে বলি, ‘তাড়াতাড়ি রেডি হও।’ মিলন দ্রুত লুঙ্গি ছেড়ে প্যান্ট পরে নেয়। প্রথমেই খোকার বাড়িতে যাই। খোকা ডাকাডাকি শুনে বাইরে বেরোলে চিঠিটি হাতে দিয়ে উল্লসিত কণ্ঠে বলি, ‘আনন্দ পুরষ্কার, খোকা ভাই। আমি আনন্দ পুরষ্কার পাচ্ছি।’ খোকা মলিন হাসেন। কেন হাসিতে মালিন্য, বুঝি না। খোকার তো খুশিতে উন্মাদ হয়ে যাওয়ার কথা। আমার যে কোনও সাফল্যে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন খোকা। সেই খোকার কেন এই অখুশি মুখ! কেন প্রাণহীন একটি হাসি তিনি উপহার দিলেন আমাকে! খোকা কি তবে ভাবছেন, আমি আকাশ ছুঁয়ে ফেলছি, এত বেশি উঁচুতে ওঠায় তাঁকে খুব ক্ষুদ্র লাগছে দেখতে! খোকা কি ভাবছেন তিনি আর কখনও আমার নাগাল পাবেন না! জানি না কেন। খোকার নির্লিপ্তি আমার মন খারাপ করে দেয়। সুখবরটি বেলাল চৌধুরীকে জানানোর জন্য আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা আমার সইছিল না। রাত হয়ে গেছে, তবুও খুঁজে খুঁজে বেলাল চৌধুরীর বাড়ি বের করে ঢুকি। আমাকে দেখে চমকালেন তিনি, আগে কখনও তাঁর বাড়ি যাইনি। এত রাতে হন্তদন্ত হয়ে তাঁর বাড়ি যাওয়ার কারণ তিনি বুঝতে পারছেন না। ‘বেলাল ভাই, আমাকে আনন্দ পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। চিঠি এসেছে। আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। কি রকম যেন লাগছে।’
চিঠিটি বেলাল চৌধুরীর হাতে দিই। তিনি পড়ে উচ্ছঅ!স প্রকাশ করেন। বউকে বলেন আমাকে মিষ্টি মুখ করাতে। ব্উ মিষ্টি খেতে দেন। আমার কি আর মিষ্টিতে মন! বেলাল চৌধুরীর হাতে আমার এই বিস্ময় আর আনন্দ ভাগ করে দিয়ে আমি হালকা হই। কখনও কোনও কোনও আনন্দের বোঝা একা আমার পক্ষে বহন করা দুঃসহ হয়ে ওঠে।
‘আমি কি এত বড় পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য বেলাল ভাই?’
‘নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। তুমি ভাল লিখছো। নিশ্চয়ই তুমি যোগ্য। ওরা তো আর তোমার মুখ দেখে পুরষ্কার দেয়নি! বুঝলে, আনন্দ পুরষ্কার হচ্ছে বাঙালি সাহিত্যিকদের জন্য স্বপ্নের বিষয়। আনন্দ পুরষ্কার হচ্ছে গিয়ে বাংলার নোবেল প্রাইজ।’
খোকার নির্লিপ্তি যতটা আমাকে যে কষ্টটুকু দিয়েছিল, বেলাল চৌধুরীর উচ্ছঅ!সে সেই কষ্ট মুছে যায়। কিন্তু বাড়ি ফিরে সারারাত আমার ঘুম হয় না। অনেক রাত্তির পর্যন্ত একা একা জেগে বসে থাকি। আজ যদি রুদ্র বেঁচে থাকত! রুদ্র নিশ্চয়ই আমার জন্য গর্ববোধ করত। পূর্বাভাসে আমার কলাম পড়ে রুদ্র একবার চিঠি লিখেছিল , সে চিঠি ছাপাও হয়েছিল পূর্বাভাসের চিঠিপত্র কলামে। লিখেছিল তার সঙ্গে যা হয়েছে আমার তার দায় সে বহন করছে, আমি যেন তাকে ক্ষমা করে দিই এবং সমস্ত পুরুষজাতিকে আমি যেন নিস্তার দিই এমন হেনস্থা থেকে। আহা রুদ্র! আমি তোমার ওপর রাগ করে একটি বাক্যও লিখছি না। সমস্ত পুরুষজাতির বিরুদ্ধে আমি লড়ছি না। আমি কেবল সমাজের নষ্ট নিয়মের বিরুদ্ধে লড়ছি, যে নিয়ম নারীকে দাসী করে, পণ্য করে, যৌনসামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করে, নারীকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা না দেওয়ার জন্য সমাজ, রাষ্ট্র আর ধর্মের ষড়যন্ত্রের আমি প্রতিবাদ করছি। যখন লিখি আমি কাঁদি, আমার জন্য নয়, কাঁদি ওই সুফিয়া খাতুনের জন্য, যাকে ধর্ষণ করে মাটির তলায় জ্যান্ত পুতে ফেলেছে কিছু লোক, ফরিদার জন্য, যে মেয়ে প্রেমের প্রস্তাবে রাজি হয়নি বলে পাড়ার এক ছেলে ফরিদার মুখে এসিড ছুঁড়ে পুড়িয়ে দিয়েছে মুখ, সখিনা বানুর জন্য যার বাবা বিয়েতে যথেষ্ট যৌতুক দিতে পারেনি বলে স্বামী তাকে মেরে হাত পা ভেঙে তালাক দিয়েছে, শরিফা খাতুনের জন্য, কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধে যাকে দা দিয়ে কুপিয়ে মেরেছে স্বামী, কাঁদি নুরজাহানের জন্য, যে মেয়ে এক পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলেছে বলে পাথর ছুঁড়ে মেরেছে লোকেরা, ফুলমতির জন্য, যে মেয়েকে প্রেম করার অপরাধে লোকেরা আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে। আমি তো ভালই আছি, শহরের বড় হাসপাতালে ডাক্তারি করি, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি, জীবনের যে কোনও সিদ্ধান্ত আমি নিজেই নিই, নিজে যেমন পছন্দ করি, তেমন জীবন যাপন করি। আমার মত কজন মেয়ে এমন প্রচণ্ড বেঁচে আছে! কিন্তু আমি কখনও ভুলে যাই না যে আমি সুফিয়া খাতুনের মত, নুরজাহানের মত, সখিনা বানুর মত একজন। আমারও হতে পারত যা হয়েছে ওদের।
পুরস্কার আনতে এবারের আমন্ত্রণ অন্যরকম। যাওয়া আসার টিকিট, কলকাতায় থাকা সবই এখন আনন্দবাজারের দায়িত্ব। আহলাদে মাটিতে পা পড়ে না আমার। মুই যেন কি হনুরে জাতীয় একটি ভাব যখন আমাকে গ্রাস করছে,তখনই বইটির দুটো কলামের কথা মনে করে আঁতকে উঠি। কেউ যেন ধারালো একটি সুই দিয়ে খোঁচা দিয়ে আমার ফুলে ওঠা অহংকারকে চুপসে দিল। বেদ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে, যদিও আমার কাছে সব কটি বেদ এর খণ্ড ছিল তারপরও বেদ বিশেষজ্ঞ সুকুমারী ভট্টাচার্যের প্রাচীন ভারত ও বৈদিক সমাজ বই থেকে না টুকে পারিনি। কী এক ঘোরের মধ্যে বাক্যের পর বাক্য টুকে নিয়েছি। বইটি আমাকে এমনই প্রভাবিত করেছে যে আমি পারিনি নিজেকে সুকুমারী থেকে মুক্ত করে নিজের আলাদা কোনও মত প্রকাশ করতে। সুকুমারী থেকে বেদের অনুবাদটুকুই নিতে পারতাম, কিন্তু তাঁর মন্তব্যও চুরি করতে গেলাম কেন! চুরি করতে গেলাম এই জন্য যে তাঁর মতের সঙ্গে আমার মত হুবুহু মিলে যায়। এমন সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি বেদএর শ্লোকের যে বইটি না পড়লেও ঠিক এমনই ব্যাখ্যা আমার মনে উদয় হত। আমার কথাই যেন তিনি আমার বলার আগে বলে দিয়েছেন। কলাম দুটো পত্রিকায় ছাপা হওয়ার পর ক্ষীণ একটি গ্লানি আমাকে নিস্তার দেয়নি। ব্যপারটি এক বালতি খাঁটি দুধের মধ্যে দুফোঁটা চোনা মিশিয়ে পুরো দুধকেই নষ্ট করে দেওয়ার মত। আনন্দ পুরস্কারের খবর পেয়ে প্রথম আমার মনে পড়েনি আমার এই চুরির কথা। হঠাৎ যখন মনে পড়ে, গ্লানি আর লজ্জা আমাকে কেঁচোর মত নিজের গর্তে ঢুকিয়ে রাখে। ঘৃণায় নিজের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না। সে রাতেই বেরিয়ে পড়ি টেলিফোন আপিসে গিয়ে কলকাতায় জরুরি একটি ফোন করার জন্য। নিখিল সরকারকে ফোনে জানাই যে আমার এই নির্বাচিত কলাম পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য নয়, কারণ বইটির ভেতরে দুটো কলাম আছে, যেখানে সুকুমারী ভট্টাচার্যের বই থেকে অনেক কিছু নেওয়া হয়েছে। আমার এই স্বীকারোক্তি শোনার পর যদি তিনি বলতেন যে তিনি পুরস্কার কমিটিকে ব্যপারটি অবগত করে আনন্দ পুরস্কারটি আমাকে যেন না দেওয়া হয় তার জন্য তদবির করবেন, হালকা হতে পারতাম। তাঁকে মনে হল না তিনি আদৌ আমার এই চুরি নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন। জানি চুরি অনেকেই করে। সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম লেখাটি, তিনি নিজেই বলেছেন, চুরি করে লেখা। দাঁড়ি কমাও বাদ দেননি চুরিতে। কিন্তু আমার তো এটি প্রথম লেখা নয়। রীতিমত যখন নাম করে ফেলেছি লিখে, তখন চুরি করা। আমাকে আমিই ক্ষমা করতে পারছি না, অন্যরা কি করে করবে! পুরস্কার পেলে মানুষের আনন্দ হয়, আমার হচ্ছে লজ্জা। নিখিল সরকারকে সুকুমারী-তথ্যটি জানিয়ে তাঁর কোনও প্রতিক্রিয়া না দেখে লজ্জার ওপর ভয় এসে ভর করে। তবে কি পুরস্কারটি আমাকে নিতেই হবে! কী করে মুখ দেখাবো আমি! কী করে এই লজ্জা আমি ঢাকবো! চেতনার জানালা দরজায় শব্দ হতে থাকে প্রচণ্ড, আমি কী এমন লেখক যে এত বড় একটি পুরস্কার পাবো! এতকাল যাঁরা আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন তাঁরা আমার চেয়ে কয়েক লক্ষ গুণ ভাল সাহিত্যিক। তাঁরা জ্ঞানের সমুদ্র, আমার জ্ঞান নেই, গুণ নেই, তুলনায় আমি এক বিন্দু জল। বাংলাদেশের কাউকে যদি পুরস্কার দিতে হয়, তবে আর যাকেই হোক, আমাকে তো দেওয়ার প্রশ্ন ওঠার কথা নয়। এত বড় মাপের সাহিত্যিক এ দেশে আছেন, এত বড় কবি আছেন, তাঁদের সাহিত্যের সঙ্গে আমার কোনও গদ্য পদ্যের কোনও তুলনা করাও হাস্যকর। শওকত ওসমান, রশীদ করীম, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সেলিনা হোসেন, রাহাত খান, বশীর আল হেলাল —-এঁদের পায়ের ধূলার যোগ্য নই আমি। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কবিতার ধারে কাছে কি আমার কবিতা স্থান পেতে পারে! নিঃসন্দেহে বলতে পারি, না। তবে আমি কেন নির্বাচিত হলাম! পুরস্কার কমিটির মাথাটি নিশ্চয়ই খারাপ হয়ে গেছে, অথবা বাংলাদেশের লেখকদের সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই, তা না হলে পুরস্কারের জন্য আমাকে নির্বাচন করতেন না। কমিটিতে খুব বড় বড় লেখক বুদ্ধিজীবী আছেন, এ কেমন বুদ্ধির নমুনা! জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, রফিকুল ইসলাম, হুমায়ুন আজাদের মত বড় প্রাবন্ধিক যদি এই পুরস্কার না পান, তবে কী যোগ্যতা বলে আমি এই পুরস্কার পাই! কিছু শখের কবিতা লিখেছি, পত্র পত্রিকায় কিছু কলাম লিখেছি, এরকম তো কত কেউ লেখে, সাহিত্যিক জগতের অনেকের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় আছে আমার, তাই বলে তো আমি সাহিত্যিক হয়ে যাইনি! সে স্পর্ধাও আমি করি না। কলকাতার কত বড় বড় লেখকও এখন পুরস্কারের মুখ দেখেন নি, আর আমাকে কি না নিজে উপস্থিত থেকে নিজে হাতে নিতে হবে পুরস্কার! পুরস্কারের ঘোষণাটি আমাকে হঠাৎ যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল কত ক্ষুদ্র আমি, কত অযোগ্য আমি, লেখক হিসেবে কত তুচ্ছ আমি, কত অপাংক্তেয় আমি! মেয়েদের স্বাধীনতার জন্য লিখি, কিন্তু আমি তো নতুন লিখছি না, অনেকেই মেয়েদের অধিকারের পক্ষে লিখেছেন, লিখছেন। আমাকে তো কোনও স্বার্থত্যাগ করতে হয়নি, আমাকে ভুগতে হয়নি, পথে নামতে হয়নি, সংগ্রাম করতে হয়নি, অনেকে তো কত রকম সংগঠন করেছেন নির্যাতিত মেয়েদের সাহায্য করার জন্য। এনজিও খুলেছেন, ইশকুল বানিয়েছেন, নিজের যা কিছু আছে সবই বিসর্জন দিয়েছেন নারী উন্নয়নের জন্য। আমি কিছুই করিনি। এখনও পরিবেশ প্রতিবেশ থেকে শেখা বাড়ির কাজের মেয়েদের গালে চড় কষানোর, পিঠে ধুমাধুম কিল দেওয়ার বদভ্যাস ছাড়তে পারিনি। সুফির দেড়বছর বয়সী মেয়েটি প্যানপ্যান করে কাঁদত বলে, চতুর হাসি হাসত বলে সুফির আড়ালে আমি একদিন তার হাতদুটো মুচড়ে দিয়েছিলাম। আমার এই হাত কলুষিত হাত, এই হাতে এত বড় সম্মানের প্রতীক ওঠা মানায় না। যে সব আদর্শের কথা শুনে আমি মুগ্ধ হয়েছি বার বার, সেইসব আদর্শের কতটুকু জীবনে চর্চা করেছি! সমাজতন্ত্রের রূপরেখা পড়ে আমি উৎসাহিত হই, কিন্তু নিজের জীবনে তা প্রয়োগ করার উৎসাহ কোনওদিন পাইনি। দেশের আশি ভাগ মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছে জেনেও নিজের আরাম আয়েশের কিছু ছাড় দিই না। হাজার হাজার মানুষ ফুটপাতে বা তক্তপোষে ঘুমোচ্ছে জেনেও তো আমি নিজে নরম গদিতে ঘুমোবার লোভ ছাড়তে পারি না। কেউ না খেয়ে আছে বলে নিজেকে তিনবেলা খাওয়া থেকে বঞ্চিত করি না। সমাজতন্ত্র নিয়ে যা কিছু আমার মনে, সবই মধ্যবিত্তের রোমান্টিকতা। মেয়েদের নিয়ে যা কিছু এ যাবৎ লিখেছি, নিজের দিকে থুতু ছিটিয়ে বলি, হয় টাকা কামাবার জন্য, নয় নাম কামাবার জন্য! লেখক হিসেবে যেমন নিকৃষ্ট আমি, মানুষ হিসেবেও তেমন।
সব জেনে বুঝেও কলকাতা রওনা হই। পুরস্কারের চিঠি পাওয়ার পর পরই পুরস্কার গ্রহণ করার সম্মতি জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলাম আনন্দ বাজারে। পাঠিয়েছিলাম বলে যে আমার করার কিছু ছিল না তা নয়। আমি ইচ্ছে করলেই কি বলতে পারতাম না যে না আমি যোগ্য নই এই পুরস্কারের, আমি নেব না পুরস্কার! পুরস্কার নিতে অস্বীকার করার জন্যও যে স্পর্ধা দরকার হয়, সেই স্পর্ধাটি আমার নেই কেন! জীবনে স্পর্ধা করে তো অনেক কিছুই করেছি। ভেতরে ভেতরে কি একটি লোভ কাজ করছে না আমার! আমি যত নিজেকে বলতে চাই, না করছে না, কিন্তু নিজের খুব গভীরে কোথাও সূক্ষ্ম সুপ্ত বাসনার গন্ধ পাই। লজ্জা ভয় সব কিছুর তলে খুব গোপন একটি লোভ আমাকে নিভৃতে কামড়ায়। অপরাধীর মত একটি অন্যায়ের দিকে আমি যেতে থাকি, চোখ কান বন্ধ করে একটি সর্বনাশা নদীতে আমি ঝাঁপ দিই, নিজেকে সংবরণ করার কোনও শক্তি আমার মনেতে নেই। নিঃশক্তি, নিঃসহায় আমিটি সজোরে নিঃশ্বাস নেয় নির্লোভ হতে। আমি অশ্লীল শব্দ লিখি, আমি যৌন-লেখিকা, নগণ্য লেখিকা, লেখালেখির কিছুই জানি না, আমি কিছু না, আমি কিμছু না শুনে শুনে, অবমাননা আর অসম্ভ্রম পেয়ে পেয়ে নিজে ভুগতে ভুগতে আত্মীয় স্বজনকে ভোগাতে ভোগাতে যদি হঠাৎ শক্ত কিছু মাটি পাই মাথাটি, যে মাথাটি বার বার নুয়ে নুয়ে যায় লোকের ভৎসর্না আর বিদ্রূপে, উঁচু করে দাঁড়াবার, অসম্মাননা ছুঁড়ে ছুঁড়ে যারা আমাকে অμছুত করেছে, তাদের যদি দেখানোর সুযোগ হয় নিজের সামান্যও সম্মান, তবে আমি সুযোগটি কেন ছেড়ে দেব! পায়ের তলার মাটি যতটা শক্ত হলে দাঁড়ানো যায়, তার চেয়েও বেশি শক্ত করে মেয়েমানুষকে দাঁড়াতে হয়, নিজের যোগ্যতার প্রমাণ পুরুষকে যতটা দিতে হয়, তার চেয়ে বেশি দিয়েই মেয়েমানুষকে কাতারে দাঁড়াতে হয়— আমার মেয়েমানুষ পরিচয়টিতে তাই আমি একটি অহংকার জুড়ে দিতে চাই, যে অহংকারটি আমাকে কারও ধাককা দিয়ে ফেলে দেওয়া থেকে, দূর দূর করে তাড়ানো থেকে, চোখ মুখ নাচিয়ে কৌতুক করা থেকে বাঁচাবে, বাঁচাবে আর সাহিত্যের জগতে, যে জগতে আমার বিচরণ, যে জগতটি মূলত পুরুষের, স্থান দিতে বাধ্য হবে। আমি নির্লোভ হতে পারি না।
কলকাতায় পৌঁছে দেখি আমার জন্য একটি সুন্দর হোটেল ঠিক করা আছে। সুন্দর হোটেলে সুন্দর একটি ঘর। আনন্দ পাবলিশার্সে আমাকে ডাকলেন বাদল বসু। আনন্দ থেকে আমার নির্বাচিত কলাম বইটি ছাপা হবে। এত কিছু কি সইবে আমার! এত প্রাপ্তি! কালো পাহাড়ের মত শরীর বাদল বসুর; তাঁর হাসিহীন গম্ভীর মুখটি দেখলেই অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়। বাদল বসু কঠিন কঠিন মুখে কঠিন কণ্ঠে আমাকে বই প্রকাশের নানা রকম কাগজে সই করতে বললেন। এসব সইয়ে আমার অভ্যেস নেই। ঢাকায় বই ছাপা হয়, কোনও লিখিত ব্যপার থাকে না, সবই মৌখিক। কত পারসেন্ট রয়্যালটি দেওয়া হবে লেখককে, কত পারসেন্ট প্রকাশক নেবে, কখনও উল্লেখ করা হয় না। কাগজে টাকার অংকের কোনও ঘরের দিকে তাকাই না আমি। যেখানে যেখানে সই করতে বলা হয়, মুখ বুজে সই করি। সবকিছু আনুষ্ঠানিক এখানে। সবকিছুতেই একশ রকম নিয়ম। আমার বই ছাপা হতে যাচ্ছে বাংলা সাহিত্যের সব চেয়ে বড় প্রকাশনী থেকে, এই সুখেই তো আমি বগল বাজাবো। আমার কাছে পারসেন্ট কোনও বিষয় হবে কেন! আনন্দপুরষ্কারের টাকা ছিল এর আগে পঞ্চাশ হাজার, এ বছর বেড়ে এক লাখ হয়েছে। সেই টাকার জন্যও কয়েকটি সই নিলেন আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে সুবীর মিত্র। এক লক্ষ টাকার চেক পাব আমি, যে আমি জীবনে এত টাকা একসঙ্গে দেখিনি কোনওদিন। তবু এক লক্ষ টাকা আমার কাছে নিতান্তই গৌণ। পুরস্কারের মূল্যই সবচেয়ে বেশি। টাকার অংক দিয়ে এই পুরষ্কারের বিচার করা যায় না। টাকা পড়ে থাকে টাকার মত। যখন শেষ সইটি করি বই প্রকাশনার কাগজে, তখনই খবর আসে সত্যজিৎ রায় মারা গেছেন। বাদল বসু বেরিয়ে যান তক্ষুনি। আমার সারা শরীর শোকে অবশ হতে থাকে। ছবি দেখা আমার নেশা, যত ছবি সারা জীবনে দেখেছি আমি, সবচেয়ে ভাল লেগেছে সত্যজিৎ রায়ের ছবি। এক পথের পাঁচালিই আমি দেখেছি পনেরোবার। তবু সাধ মেটেনা। যতবার দেখি ততবারই দুর্গার জন্য কাঁদি, ততবারই অপুর জন্য মায়া হয়, ততবারই ইন্দির ঠাকুরণের জন্য হৃদয় ভেঙে যায়। ঢাকার অনেক লেখক কবিই সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা করেছেন কলকাতায় এসে। নিজে যেচে আজ অবদি বড় কোনও লেখক শিল্পীর সঙ্গে পরিচিত হতে যাইনি। সাহস বা স্পর্ধা কোনওটাই হয়নি। সত্যজিৎ রায়কে দেখা হয় আমার স্বচক্ষে, নন্দনে যখন তিনি শুয়েছিলেন ফুলের বিছানায়, তখন। আর তিনি ছবি বানাবেন না, আর তিনি ক্যামেরায় লুক থ্রো করবেন না। আর তিনি ছবি আঁকবেন না, গল্প লিখবেন না। মৃত্যু জিনিসটির মত ভয়ংকর কিছু আর নেই পৃথিবীতে। জীবনের কী অর্থ যদি একদিন হঠাৎ করে মরেই যেতে হয়! সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুর কারণে আনন্দ পুরস্কার অনুষ্ঠান পিছিয়ে দেওয়া হল একদিন।
কলকাতার গ্র্যাণ্ড হোটেলের বলরুমে আনন্দ পুরষ্কারের অনুষ্ঠানের আয়োজন হচ্ছে। মঞ্চ সাজানো জুঁই ফুল দিয়ে, দেয়ালের কালো পর্দায় জুঁই ফুলে আঁকা মস্ত বড় কলম। এমন সুন্দর মঞ্চ আগে আমি কোথাও দেখিনি কখনও। ফুলের ঘ্রাণে ভরে আছে পুরো ঘর। আমন্ত্রিত রথী মহারথীরা আসন গ্রহণ করেছেন। ঘর ভরে আছে পণ্ডিতে, বিদ্যানে, বিশাল বিশাল লেখকে, কবিতে, শিল্পীতে। আনন্দ পুরষ্কার প্রতিবছর তিনজন পান। এবার দুজন কেবল। লেখক বিমল কর আর আমি। মঞ্চে আনন্দবাজারের সম্পাদক প্রকাশক অভীক সরকার, দেশ এর সম্পাদক সাগরময় ঘোষ এবং কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বসে আছেন। আরেকদিকে বসেছেন বিমল কর, আমাকেও বসতে হল তাঁর পাশে। অযোগ্য আমি কুণ্ঠিত আমি লজ্জিত আমি না পারছি চোখ তুলে মঞ্চ দেখতে, না পারছি দর্শকের দিকে তাকাতে। পুরষ্কার নেবার পর কিছু বলতে হবে আমাকে, ছেঁড়া একটি কাগজ আমার হাতের মুঠোয়, কাগজটি ঘামে ভিজে উঠছে, কাগজটিতে কাটাছেঁড়া লেখা, আগের রাতে লিখেছি পুরস্কার পাওয়ার পর বলার জন্য যা হোক কিছু। মঞ্চের বড় বড়রা এক এক করে বলছেন। ছোটটির বলার সময় যত ঘনিয়ে আসে, তত তার বুকের মধ্যে শব্দ করে বাজতে থাকে বিপদঘণ্টি। মাইকের সামনে দাঁড়ালে পা ঠকঠক করে কাঁপবে না তো! গলা কাঁপবে না তো কিছু বলতে নিলে! ভয়ে আবার মুর্ছা যাই কি না কে জানে। যখন ডাকা হল আমাকে, হাতের ঘামে ভেজা দলামোচা করা ছেঁড়া কাগজটি খুলে পড়ি, প্রথম নমস্কার শব্দটিও আমাকে কাগজের দিকে তাকিয়ে পড়তে হয়। গলা কাঁপা থামাতে গিয়ে উচ্চারণের ভুলগুলোকে থামাবার আমার উপায় থাকে না। পায়ের ঠকঠক বন্ধ করতে গিয়ে ছেঁড়া কাগজের শব্দগুলো একটি আরেকটিকে ঠোকরাতে থাকে। পড়ছি, যেন আল্লাহতায়ালার আদেশে পুলসেরাতে দাঁড়িয়ে বেহেস্ত বাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছি। .. আমাকে অনেকেই বলে আমি নাকি খুব আকাশ কুসুম কল্পনা করি। অলীক সব স্বপ্ন দেখি। গরম সইতে পারি না বলে নেপচুন গ্রহে চলে যাবার কথা ভাবি। ঘরে বসে পিঠে ডানা মেলে আকাশে উড়ে বেড়াবার স্বপ্ন দেখি। ধরা ছোয়াাঁর বাইরে আমার এরকম নানা স্বপ্ন আছে। কিন্তু আমি কখনও এই স্বপ্ন দেখবার স্পর্ধা করিনি যে আমি হঠাৎ একদিন আনন্দ পুরস্কার পাবো। সুধীবৃন্দ, আমি আনন্দিত আমি অভিভূত। যে গ্রন্থটি আনন্দ পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছে সেটি মূলত নারীর ওপর ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার অসভ্যতা আর অশালীনতা সম্পর্কে রাখঢাকহীন সরল উচ্চারণ। শাস্ত্র এবং সমাজ আমাদের এমন শিক্ষাই দেয় যে নারীর কোনও স্বাধীনতা থাকতে নেই। কিন্তু সেই নারী অবশ্যই মানুষ হিসেবে সম্পূর্ণ স্বাধীন নয় যে নারী মনে এবং শরীরে সম্পূর্ণ স্বাধীন নয়। মানুষের প্রধান প্রয়োজন স্বাধীনতা। নারীর এই স্বাধীনতাকে রাষ্ট্র অবরোধ করছে, নারীর স্বাভাবিক বিকাশে ধর্ম এখন প্রধান অন্তরায়। ধর্মের শৃঙ্খল আছে বলেই অধিকাংশ নারী আজ নিরক্ষর, উত্তরাধিকার বঞ্চিত, অধিকাংশ বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, তালাক ও বৈধব্যের নির্যাতনের শিকার। পুরুষ নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নারীত্ব, সতীত্ব, মাতৃত্ব ইত্যাদির সংজ্ঞা এবং মাহাত্ম্য তৈরি করেছে। এগুলো টিকিয়ে রাখতে পারলে সমাজে নারীর মূল্য বেশি। মূল্য এই অর্থে যে লোকে তাকে অপাংক্তেয় বা অস্পৃশ্য ঘোষণা করবে না। পৃথিবীতে প্রচলিত প্রতিটি ধর্মেই নারীর সতীত্ব রক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কিন্তু কোনও ধর্মেই পুরুষের জন্য কোনও সতীত্বের ব্যবস্থা করেনি। এর অর্থ এই, একগামিতা শুধু নারীর জন্য অবশ্য পালনীয়, পুরুষের জন্য নয়। তার জন্য আছে গণিকালয়ে যাবার অবাধ সুযোগ, তার জন্য চার বিয়ে হালাল করা হয়েছে ইসলাম ধর্মে, তার ভোগের জন্য ঘরের দাসিকেও বৈধ করা হয়েছে। পুরুষ নারীকে সাজিয়েছে অসংখ্য কুৎসিত অভিধায়। তাকে বন্দি করবার জন্য তৈরি করেছে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র, উদ্ভাবন করেছে ঈশ্বর, নিয়ে এসেছে প্রেরিত পুরুষ, লিখেছে ধর্মগ্রন্থ, অজস্র দর্শন, কাব্য, মহাকাব্য, সৃষ্টি করেছে সমাজতত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান ও আরও অসংখ্য শাস্ত্র। উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে বাংলায় নারীশিক্ষার যে ধারা শুরু হয়েছে, এর উদ্দেশ্য নারীকে স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত করা নয়, এর লক্ষ উন্নত জাতের স্ত্রী বা শয্যাসঙ্গিনী উৎপাদন। নারী শিক্ষাও প্রভু পুরুষেরই স্বার্থে। বিবাহ এখানে নারীদের পেশা। মনে করা হয় নারীর কল্যাণ শুভবিবাহে, সুখী গৃহে, স্বামীর একটি মাংসল পুতুল হওয়াকেই তারা মনে করে নারী জীবনের স্বার্থকতা। ইহুদি খিস্টান ও মুসলমানের মতে নারীর জন্ম পুরুষের পাঁজরের বাঁকা হাড় থেকে। মুসলমান মেয়েরা জানে স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেস্ত। জানে স্বামীকে তুষ্ট রাখতে পারলে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা খুশি হন তাই বেহেস্তের লোভ দেখিয়ে স্বামীর পদসেবায় স্ত্রীদের নিয়োজিত রাখা একধরনের কৌশল, ধর্মের এবং সমাজের। বাঙালি মেয়েরা স্বামীর এঁটোকাঁটা খেয়ে ধর্মীয় পূণ্য অর্জন করে, এতে স্বামী সেবাও হয়, ধর্ম রক্ষাও হয়, কিন্তু যা হয় না তা হচ্ছে পুষ্টি রক্ষা। পুষ্টির অভাবে বাঙালি মেয়েরা অধিকাংশই স্বাস্থ্যহীন, শ্রীহীন এবং কিছুটা মেধাহীনও বটে। নারী কেবল পুরুষের যৌনসামগ্রী হিসেবে বিবেচিত হয়। ইসলাম ধর্মে নারীর যৌন অঙ্গ হিফাজত করবার কথা বলা হয়েছে। এও বলা হয়েছে নারী হচ্ছে পুরুষের শস্যক্ষেত্র, এই শস্যক্ষেত্রে পুরুষেরা যেন যেমন ইচ্ছে গমন করে। নারীকে অবাধ ভোগের কথা সকল ধর্মই বলেছে। নারীকে মূল্যবান সামগ্রী হিসেবে উপঢৌকন দেবার কথা, যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত অঞ্চলের নারীকে ভোগের বস্তু করা সকল ধর্মেই স্বীকৃত। বাঙালি নারী কপালে ও সিঁথিতে সিঁদুর পরে, হাতে চুরি বা শাঁখা পরে এয়োতির চিহ্ন বহন করে। যদিও পুরুষের শরীর বিবাহের কোনও চিহ্ন বহন করে না। বৈধব্যের চিহ্নও নারী একা লালন করে। বিধবা নারীকে নানা রকম ব্রত পালন করতে হয়। পোশাক ও আহারে আমূল পরিবর্তন আনতে হয় কিন্তু বিপত্নীক কোনও পুরুষকে সঙ্গীহীনতার কোনও গ্লানি ভোগ করতে হয় না। নিরামিষ আহারের মূল কারণ বিধবা মেয়ের স্বাস্থ্যহীনতা ও শ্রীহীনতার পাশাপাশি যৌনাকাঙক্ষা নিবারণ করা, যদিও বিপত্নীকের জন্য এই সব অনাচার জরুরি নয়। সভ্যতার শুরু থেকে সমাজ ও ধর্ম মানুষকে পরিচালিত করেছে। সমাজ ও ধর্মের পরিচালক হিসেবে যুগে যুগে পুরুষেরাই কর্তৃত্ব করেছে। সমাজ ও রাষ্ট্র তো বটেই, নারীকে সবচেয়ে বেশি অমর্যাদা করেছে ধর্ম। সামাজিক, অর্থতৈনিক ও রাজনৈতিক ভাবে যে হারে নারী নির্যাতিত হচ্ছে তাতে পুরো সমাজ ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় কাঠামো পরিবর্তন ছাড়া যেমন নারীর মুক্তি নেই, তেমনি ধর্মের শৃঙ্খল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা ছাড়াও নারীর মুক্তি অসম্ভব। মূলত এসবই আমার লেখার বিষয়। সমাজের পীড়িত, নিগৃহীত, দলিত, দংশিত নারীর জন্য লিখি। আমার এই ক্ষীণ কণ্ঠস্বর সীমান্ত পেরিয়ে এই বাংলায় কিছু মানুষের কানে পৌঁচেছে দেখে আমি উদ্বুব্ধ বোধ করছি। কারণ নারীর উক্তি সাধারণত কারও কানে পৌঁছতে চায় না, এমনকী নারীর কানেও নয়। সে কারণেই আমি চমকিত এবং অভিভূত। পশ্চিমবঙ্গকে কখনও আমার পৃথক একটি দেশ বলে মনে হয়না। একই ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষ আমরা, আমরা একই জল হাওয়ার মানুষ, একই নদীর পাড়ে আমরা ঘরবাড়ি গড়েছি। এখানে এলেই আমার বুকের মধ্যে তীব্র এক যন্ত্রণা হয়, দেশ ভাগের যন্ত্রণা। আমার হৃদয়ে কোনও কাঁটাতার নেই। আমরা বাঙালি। বাংলা আমাদের ভাষা। আমরা আমাদের স্বজন আত্মীয়।
আজ এই আনন্দের দিনে আপনাদের জন্য নিবেদন করছি আমার ছোট্ট একটি কবিতা–
সাত সকালে খড় কুড়োতে গিয়ে আমার ঝুড়ি উপচে গেছে ফুলে
এত আমার কাম্য ছিল না তো!
এখন আমি কোথায় রাখি, কোথায় বসি, কোথায় গিয়ে কাঁদি!
পুরো জীবন শূন্য ছিল, ছিল!
কারও তো আর দায় পড়েনি দেবে।
তুমি এমন ঢেলে দিচ্ছ ভরে দিচ্ছ কাছে নিচ্ছ টেনে
এত আমার প্রাপ্য ছিল না তো!
আমাকে ক্ষমা করবেন।
আমি ক্ষমা চেয়েছি নিতান্তই ক্ষুদ্র হয়ে আকাশ ছোঁয়া একটি সম্মান নেওয়ার মত সাহস দেখিয়েছি বলে। আমি ক্ষমা চেয়েছি আমার স্পর্ধার জন্য, যে স্পর্ধায় যোগ্য না হয়েও এত বড় পুরস্কার আমি গ্রহণ করেছি। জানি না আমাকে কেউ ক্ষমা করেছেন কি না। আনন্দ পুরস্কার অনুষ্ঠানে অনেক লেখক শিল্পী আমাকে অভিনন্দন জানান। অনেকের সঙ্গে কথা হয়, যাঁদের সঙ্গে কখনও কোনওদিন কথা বলার সুযোগ হবে, কল্পনাও করিনি আগে। পরদিন আনন্দবাজারের প্রথম পাতায় বেরোলো আনন্দ পুরষ্কার অনুষ্ঠানের খবর, অনুষ্ঠান মাতালেন তসলিমা ও ভীমসেন। চারদিকে আমাকে নিয়ে উৎসব শুরু হয়ে গেল। সৌমিত্র মিত্র খুবই আনন্দিত আমার আনন্দ প্রাপ্তিতে। তিনি আমাকে নিয়ে এদিক সেদিক যাচ্ছেন। একদিন চমকে দিলেন কণিকা বন্দোপাধ্যায়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে। কণিকার গানের পাগল আমি। চোখের সামনে কণিকাকে দেখে আনন্দধারা বইতে থাকে আমার ভূবনে। বসন্ত উৎসবের সঙ্গী অশেষ আর মোনা আমার সঙ্গে দেখা করতে এল হোটেলে। পটাপট কিছু ছবি তুলে নিয়ে গেল আমার সঙ্গে। আমি খুব মূল্যবান মানুষ হয়ে উঠলাম হঠাৎ। আনন্দবাজার পত্রিকার বারান্দায় আমাকে জড়সড় হয়ে হাঁটতে হয় না। দেখলেই লোকে চেনে আমি কে। সাগরময় ঘোষ দেশ পত্রিকায় আমাকে ধারাবাহিক উপন্যাস লেখার প্রস্তাব দিলেন। প্রস্তাবটি শুনে লজ্জায় মনে হয় মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছি। আমি যে উপন্যাস লিখতে পারি না তা বললাম, তিনি হাসলেন। দাবিটি ছাড়লেন না। নিখিল সরকার তাঁর সল্টলেকের বাড়িতে আমাকে নেমন্তন্ন করলেন। আমাকে তিনি চিঠি দিয়ে পাঠালেন কিছু মূল্যবান মানুষের সঙ্গে দেখা করতে। বড় পুরস্কার পাওয়া ছোট লেখক চিঠি হাতে নিয়ে বড় সংকোচে বড় বড় মানুষের দ্বারস্থ হল। মহাশ্বেতা দেবী, মীরা মুখোপাধ্যায়….। আকাশে পৌঁছলে আকাশের নক্ষত্রদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করা সম্ভবত ভদ্রতা। কিন্তু আমি কি সত্যিই আকাশে পৌঁছেছি, নাকি যে পাতালের আমি সে পাতালেই আছি! বেশ টের পাই আমি সেই পাতালেই আছি। নক্ষত্রদের সামনে আমি আমার তাবৎ অন্ধকার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। কলকাতায় গুরুজনদের বিশেষ করে খুব বড় লেখক শিল্পীদের সকলে ঢিপঢিপ করে প্রণাম করে। আমি সামনে এসে বাঁশের মত দাঁড়িয়ে থাকি। প্রণামের অভ্যেস নেই বলে করতে পারি না। কদমবুসি নামে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে যে প্রণাম প্রচলিত, সেটিও আমি করতে অভ্যস্ত নই। অশেষ শ্রদ্ধা মনে, অথচ হাত বাড়াচিছ না পায়ের ধুলোর দিকে, বয়োজ্যেষ্ঠ গুরুরা আমাকে একটি বেয়াদব মেয়ে বলে মনে মনে গাল দেন হয়ত, কিন্তু আমি কী করতে পারি!হঠাৎ করে আমাকে যদি বলা হয় তুমি হাল চাষ কর, আমি তো স্থবির দাঁড়িয়েই থাকব। যে জিনিস আমার দ্বারা হয়নি, তা হবেও না জানি। হাল চাষ করতে না পারি, কিন্তু গ্রাম্যতা আমার চরিত্রের গভীরে। ঢাকা থেকে আনা ছোটখাটো উপহার কলকাতার অনেককে দিতে আমার ভাল লাগে। অভীক সরকার আনন্দ পুরস্কার দিলেন আমাকে, তাঁকে তো বিনিময়ে একটি উপহার আমাকে দিতে হয়, এই গ্রাম্য সৌজন্য রক্ষা করতে গিয়ে যে শাড়িটি পরে পুরস্কার নিয়েছিলাম, সেই নানাবর্ণের চমৎকার জামদানি শাড়িটির আঁচল কেটে পার্ক স্টিটের একটি ভাল বাঁধাইএর দোকান থেকে দ্য বেস্ট সোনালী ফ্রেমে বাঁধাই করে নিয়ে মহা উৎসাহে দ্য বেস্ট উপহারটি নিয়ে যেদিন আনন্দবাজারে পৌঁছই, নিখিল সরকার আমার স্পর্ধা দেখে জিভ কাটলেন। মাথায় আমার যে বুদ্ধিটি ধরেনি তা হল অভীক সরকারের মত উচ্চ রুচির শিল্পবোদ্ধার ঘরে ভারতবর্ষের কোনও শিল্পীর আঁকা চিত্র যদি স্থান পায়, সে বড়জোর মকবুল ফিদা হোসেন, তাছাড়া বাকি সব নামী দামী পশ্চিমি শিল্পীদের চিত্রকলা, জামদানি শাড়ির আঁচল সে আঁচল যত সুন্দরই হোক না কেন, এটি তাঁর ঘরে স্থান পাওয়ার যোগ্য নয়। মনে মনে বলি, যে মেয়েরা এই অপূর্ব সুতোর কাজগুলো করেছে, তারাও তো খুব বড় শিল্পী। শিল্পী হোক, ধনী এবং রুচিবানরা এসব তুচ্ছ জিনিসকে মূল্য দেন না। ভাল যে আমি অভীক সরকারের ঘরে উদ্ভট জামদানি চিত্রকলা নিয়ে উপস্থিত হইনি আগেই। নিখিল সরকার আমাকে বললেন, এটি যদি দিতেই চাই আমি তবে যেন অভীক সরকারের স্ত্রীকে দিই। শেষ অবদি লজ্জার মাথা খেয়ে তাঁর স্ত্রীর জন্য আমার অতিতুচ্ছ উপহারটি দিয়ে বিশাল আনন্দবাজারের বিশাল অভীক সরকারকে বিশাল অপমানের হাত থেকে বাঁচাই।
বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কর্মকর্তা কিছু লেখককে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তাঁর বাড়িতে, আমাকেও জানিয়েছেন। মূলত আমার সম্মানে। আমি উপস্থিত হবার পর আমাকে ঘিরে বসে পড়ল কলকাতার কবি লেখকরা। এক একজন প্রশ্ন করছে, নানা কিছু নিয়ে প্রশ্ন— রেনেসাঁস, রেভ্যুলুশান, ফেমিনিজম, ব্যাকল্যাশ, মডার্নিজম, পোস্ট মডার্নিজম, আমার সাহিত্যিক ভাবনা, রাজনৈতিক আদর্শ, শ্রেণী সংগ্রাম ইত্যাদি ইত্যাদি। মানুষগুলোর চোখ আমার দিকে আগ্রহে উত্তেজনায় অপেক্ষায় অপলক হয়ে আছে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি জ্ঞানী জ্ঞানী মানুষগুলোর দিকে। প্রশ্নগুলো বড় কঠিন লাগে আমার কাছে। আমার ফ্যালফ্যাল দেখে এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। সংকোচে শামুকের মত গুটিয়ে যেতে থাকি। যদি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারতাম এই সুধী সমাবেশ থেকে! যদি হঠাৎ নেই হয়ে যেতে পারতাম! আমাকে কোনও প্রশ্ন কোরো না, আমি কোনও প্রশ্নের উত্তর জানি না। মনে মনে বলি, তার চেয়ে আমাকে রহিমা বেগমের গল্প শোনাতে বল, কন্যাসন্তান জন্ম দিয়ে কি করে হতাশায়, বেদনায় ঘৃণায় আশঙ্কায় চিৎকার করে কেঁদেছিল রহিমা। আমাকে বল, আমি তেমন কেঁদে তোমাদের দেখাই। আমি বুদ্ধিজীবী নই। আমি মোটা মোটা বই পড়ে পৃথিবীর ইতিহাস ভুগোল, রাজনীতি, সমাজ, সাহিত্য সংস্কৃতির জ্ঞান অর্জন করিনি। আমি বক্তা নই। গুছিয়ে কিছু বলতে পারি না। কায়ক্লেশে কিছু লিখি, রহিমা বেগমের আর্তনাদ আমাকে কাঁদায় বলে লিখি। এমন বড় বড় আসরে বড় বড় বক্তৃতা দেওয়ার যোগ্য আমি নই। আমি ময়মনসিংহের সাধারণ ঘরে সাধারণ ভাবে বেড়ে ওঠা সাধারণ মেয়ে। আমি গভীর তত্ত্বকথা বুঝি কম। আমার ঘটে বুদ্ধি কিছু কম ধরে। চিরকালই।