১৫
আধো তন্দ্রায় পুনমের ডাক শুনতে পাচ্ছিল দেররাজ। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল না দেবরাজের। নামে ফাল্গুন মাস হলেও দিল্লিতে এখনও ভাল ঠান্ডা। বেলা অবধি ঘুরন্ত পাখার নীচে কম্বল জড়িয়ে পড়ে থাকতে বেশ লাগে। তার ওপর কাল অনেক রাত অবধি জাগা, একখানা ছবি নিয়ে ঘষাঘষি চালাচ্ছিল স্টুডিয়োয়। শেষ করা হয়ে উঠল না, কোথায় যেন একটা খামতি থেকে যাচ্ছে। সেটা রঙে, না আইডিয়ায়, ভাবতে ভাবতে ঘুমের বারোটা। ভোরের দিকেই সবে গাঢ় হয়েছিল নিদ্রা, এত তাড়াতাড়ি বিছানা ছাড়া কী সোজা কাজ!
আবার পুনমের গলা, “হেই, গেট আপ, গেট আপ। নাস্তা তৈয়ার।”
দেবরাজ জড়ানো স্বরে বলল, “কিতনা বাজা?”
“নাইন ফর্টি। অলমোস্ট মাই ডেলি লাঞ্চ টাইম।”
“তুম খা লো। আই উইল টেক লেটার।”
“কাম অন রাজ। সিরফ ছুট্টি কা দিন হাম একসাথ নাস্তা লেতা হুঁ। ইউ হ্যাভ মেড দা রুল।”
“ওকে। ওকে। পহেলে টি।”
“অলরেডি সার্ভড। টেবলপে হ্যায়, আঁখ খোলকে দেখো।”
এভাবেই হিন্দি ইংরেজি মিলিয়ে বাক্যবিনিময় হয় দু’জনের। পুনমের পাঞ্জাবি বা দেবরাজের বাংলা এই ফ্ল্যাটে অচল।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও কম্বল হঠাল দেবরাজ। দায়হীন সহবাসেও কিছু কিছু দায় তো থাকেই। দুটো-চারটে নিয়মও তো মানতেই হয়। দু’ চুমুকে চা শেষ করে দেবরাজ সোজা বাথরুমে। ব্রাশ-টাস করে ঈষৎ স্খলিত পায়ে এসেছে ডাইনিং টেবিলে। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, “এত হল্লাগুল্লা করো কেন?”
জবাব না দিয়ে পুনম বলল, “আজ আলুপরোটা বানিয়েছি। ক’টা নেবে?”
“দুই।… লঙ্কার আচার আছে?”
“ফুরিয়ে গেছে। আনতে হবে। সস দেব?”
“একেবারেই না। বরং হরামির্চ চলতে পারে।”
উঠে ফ্রিজ থেকে চার-পাঁচখানা কাঁচালঙ্কা বের করে আনল পুনম। ফের বসে বলল, “লতা ভার্গব তোমার ফোন নাম্বার জানে না?”
চোখের কোণ দিয়ে পুনমকে একবার দেখল দেবরাজ। নিস্পৃহ স্বরে বলল, “জানার তো কথা নয়। … কেন?”
“তোমাকে পাচ্ছে না বলে আমায় ফোন করেছিল। আমি কিন্তু নতুন নাম্বারটা দিইনি।”
“বেশ করেছ।”
“লতা তোমায় যোগাযোগ করতে বলেছে। জরুরি দরকার।”
“কোনও কাজের ব্যাপারে?”
“হ্যাঁ। নতুন এয়ারপোর্টে কয়েকটা ম্যুরাল বসবে। যদি তুমি ইন্টারেস্টেড থাকো…”
“বলে দিলে না কেন, আমি আর ম্যুরাল করছি না?”
“তোমার সিদ্ধান্ত তুমি জানাবে। আমরা তো সেই নীতিতেই চলি, নয় কী?”
দেবরাজ আর কথা বাড়াল না। মনে মনে একটু গাল পাড়ল লতাকে। ভাল মতোই জানে, লতার দেওয়া কাজ দেবরাজ পারতপক্ষে আর নেবে না, তবু ওই মাগির ছুঁকছুঁকে স্বভাব গেল না। কাজের কমিশনও খাবে, দেবরাজকেও চুষবে…। পুনমকে ফোন করে একটু তাতিয়েও রাখল। হারামজাদি কাঁহিকা।
একটা লঙ্কা তুলে কামড়াল দেবরাজ। চিবোচ্ছে পরোটা। হঠাৎ খেয়াল হয়েছে কী যেন। জিজ্ঞেস করল, “কাল তো শনিবার ছিল… গিয়েছিলে বিড্ডুর কাছে?”
“হ্যাঁ।”
“আছে কেমন? ঠিকঠাক?”
“খারাপ থাকার তো কারণ নেই। বন্ধুবান্ধব আছে, বাপের পয়সা আছে, যা চাইছে তাই পাচ্ছে…।”
পুনমের গলায় চাপা ক্ষোভ। আট বছর আগে বরের সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে, সেই বর ব্যবসায়ী, এক্সপোর্ট ইমপোর্টের কারবারি। রক্ষণশীল পরিবারে ঘোমটা টানা বউ হয়ে থাকতে রাজি হয়নি পুনম, তার নাটক করা নিয়ে বরের সঙ্গে চূড়ান্ত অবনিবনা, শেষমেশ সম্পর্ক ছেড়ে বেরিয়ে এসে তবে মুক্তি। ছেলে বিড্ডু তখন বছর পাঁচেকের। বরের অঢেল পয়সা, পুনমের তখন রোজগার বলতে প্রায় কিছুই নেই, নাটক ছাড়া অনুবাদের কাজ করে কিছু কিছু, পাবলিশারদের কাছে যা মেলে, বলার মতো নয়। অল্প আয়ের কারণ দেখিয়েই পুনমকে কাস্টডির মামলায় হারিয়ে দিয়েছিল বিড্ডুর বাবা। এখন অবশ্য এক নামী বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করছে পুনম, মাইনেকড়িও ভালই। কিন্তু ছেলে তার নাগালের বাইরে চলে গেছে পুরোপুরি। ফি শনিবার বিড্ডুর সঙ্গে তার ঘণ্টাখানেকের মোলাকাত হয়। ওই ক্ষীণ যোগাযোগটুকুই পুনমের যা সান্ত্বনা।
দেবরাজ নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, “মার্চেই তো ওর জন্মদিন, তাই না?”
“হ্যাঁ। আঠাশে।”
“একটা গিফট পাঠাব ভাবছি। রিস্টওয়াচ কিংবা টি-শার্ট…। বিড্ডু নেবে?”
পুনমের চোখে বিস্ময়। এমন প্রস্তাব তো দেবরাজ দেয়নি কখনও! সহজ গলাতেই বলল, “না হয়তো বলবে না। তবে পরবে কি না বলতে পারি না।”
শুনে অবাক হল না দেবরাজ। কিন্তু সে হঠাৎ দিতে চাইলই বা কেন? আঁচলের সমস্ত কর্তব্য তার বাপি পালন করছে, বিড্ডুর সে বাপি কেন, কিছুই না, তাকে বিড্ডু চেনেই না, তবু সেরকমই একটা ভূমিকায় নিজেকে স্থাপন করতে আচমকা সাধ জাগছে নাকি? তা হলে তো বলতে হয়, এবারের কলকাতাবাস তার মনোভূমিটাই অনেক পালটে দিয়েছে!
পুনম খাচ্ছে মাথা নামিয়ে। চোখ তুলে বলল, “তুমি কি আবার রিসেন্টলি কলকাতা যাবে?”
দেবরাজের মুখ থামল, “কেন বলো তো?”
“তুমি বলছিলে কিনা, দাদার কন্ডিশন ভাল নয়… সবে রেডিয়েশন থেরাপি শেষ হল… কেমো স্টার্ট হবে…”
“হ্যাঁ। আপাতত টু উইকস মতো অবসারভেশনে রাখবে। তারপর তো নেক্সট স্টেপ।”
“তখন নিশ্চয়ই তোমার ওখানে থাকাটা জরুরি?”
দুনিয়ায় কোনটা যে জরুরি, কোনটা যে নয়, তা কী নিশ্চিত করে বলতে পারে দেবরাজ! সে শুধু নিশ্চিতভাবে জানে, দাদার মৃত্যু আর খুব দূরে নেই। তার চেষ্টা, বউদির উত্কণ্ঠা, বোনের দুশ্চিন্তা, কোনও কিছুই সেই অমোঘ নিয়তিকে বদলাতে পারবে না। তবু লড়াইটা তো জারি রাখতেই হয়।
দেবরাজ একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল, “হ্যাঁ। যেতে তো তখন হবেই।”
“গেলে কদ্দিন থাকবে? মানে… এবারের মতোই মাস দুই তিন?”
“ঠিক নেই। জানোই তো এই অসুখে রোগীর অবস্থা সর্বদাই আনপ্রেডিক্টেবল।”
“হুঁউউ।” পুনমের চল্লিশ পেরনো ফরসা মুখখানায় যেন হালকা ছায়া। একটু চুপ থেকে বলল, “তোমাকে জানানো হয়নি, নেক্সট মান্থে আমিও একটু বাইরে যাব। এক-দেড় মাসের জন্যে। বেশিও হতে পারে।”
“এত লম্বা ট্যুর? নাটকের গ্রুপ নিয়ে? কোথায় কোথায় যাচ্ছ? অফিস তোমায় ছাড়বে?”
“ওরে বাবা, অনেকগুলো প্রশ্ন করে ফেললে!” পুনম মৃদু হাসল, “নাটক নয়, অফিসের কাজেই যাব। সিঙ্গাপুরে। ওখানকার এক কোম্পানি আমাদের এজেন্সিকে টেকওভার করছে। আমায় পাঠাচ্ছে নতুন কোম্পানিতে সড়গড় হতে।”
“ভালই তো। কাজ শিখে এসো। পার্মানেন্টলি থেকে যেয়ো না।”
“সেটাই তো ভাবনা। শুনছি ওখানে আটকেও দিতে পারে। অবশ্য প্রসপেক্টও অনেক বেটার। বিগ হাইক ইন স্যালারি, প্রচুর অ্যামিনিটিজ…।”
দেবরাজ ধাক্কা খেল একটু। সামান্য বাঁকা সুরে বলল, “তোমার নাটক তা হলে ভোগে?”
“সেটাই তো ডায়লেমা। নাটক ছাড়া বাঁচব কী করে?”
দুঃখী দুঃখী মুখে পুনম বলছে বটে, কিন্তু কণ্ঠে যেন তেমন প্রত্যয় নেই। অর্থাৎ চাকরির উন্নতিও পুনমকে টানছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, নাটক নিয়ে পুনমের যেটুকু বা দোলাচল, দেবরাজকে নিয়ে তার কণামাত্রও নেই। সম্পর্কটা ছাড়া ছাড়া ভাবে শুরু হলেও অনেকটাই তো তারা ঘনিষ্ঠ এখন। অন্তত দেবরাজের তো সেরকমই ধারণা জন্মেছিল। পুনমের জীবনে যে দেবরাজ মোটেই মহার্ঘ প্রাপ্তি নয়, অপরিহার্য তো নয়ই, এটাই কি পরোক্ষে বুঝিয়ে দিল না পুনম? হয়তো সচেতনভাবে নয়, অজান্তেই। কিন্তু কথাটা তো সত্যি।
ধুস, কার জীবনেই বা অপরিহার্য হতে পেরেছে দেবরাজ? হতে চেয়েওছে কি কখনও? বরং তাকে আঁকড়ে ধরার সব চেষ্টা ছিঁড়ে ফেলে বারবার মুক্তির স্বাদ চেয়েছে সে। আজ তবে কেন এই দীর্ঘশ্বাস? বয়সের লক্ষণ? অকুল গাঙে না ভেসে নৌকো কি এবার নোঙর ফেলতে চায় কোথাও?
পুনম উঠে গেছে। রান্নাঘরে প্লেট রেখে স্টাডিতে ঢুকে পড়ল। একটা ইংরেজি ফিকশন অনুবাদের কাজ ধরেছে, ওটা নিয়েই বসবে বোধহয়। খাওয়া সেরে দেবরাজও এল রান্নাঘরে। প্রথম চা-টিতে তৃপ্তি হয়নি, বানাচ্ছে নিজের হাতে। ফ্লাস্ক ভরতি করল। তারপর সিগারেট-লাইটার নিয়ে চলেছে স্টুডিয়োয়। কাল শুয়ে শুয়ে কিছু ভাবনা আসছিল, তুলতে হবে অর্ধসমাপ্ত ছবির ক্যানভাসে।
কাজে ডুবলে সময়ের জ্ঞান থাকে না দেবরাজের। পুড়ছে সিগারেটের পর সিগারেট, অস্থির হাত তুলি টানছে ক্যানভাসে।
ধ্যানভঙ্গ হল পুনমের আবির্ভাবে। গজগজ করছে পুনম, “ব্যাপারটা কী? কখন থেকে ফোন বেজে চলেছে, তুমি ধরছ না…!”
“তাই নাকি? শুনতে পাইনি তো?”
“আশ্চর্য, তিন তিন বার বাজল!… প্রমিত না কে যেন ফোন করছে। কলকাতা থেকে।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ প্রমিত। তোমাদের লাইনের। নাটক করে।” বলতে বলতে তোয়ালেতে হাত মুছে সেলফোনটা নিল দেবরাজ। নিজেই টিপল প্রমিতের নাম্বার।
ওপ্রান্তে প্রমিতের গলা, “হ্যাঁ দাদা, আমি….. আপনাকে পাচ্ছি না কেন?”
“একটু ব্যস্ত ছিলাম… কেন, দরকার আছে কিছু?”
“ভীষণ ভীষণ। যে সাংঘাতিক কাণ্ডটা ঘটল, আমরা কি এরপরও চুপ করে থাকব?”
“কী হয়েছে?”
“সে কী? জানেন না আপনি? গোটা দেশ জুড়ে তোলপাড় হচ্ছে…! কাল চণ্ডীপুরে নিরীহ জনতার ওপর গুলি চলেছে… সাতজন স্পট ডেড, কতজন যে ইনজিয়োর্ড তার হিসেব নেই… পার্টির লোকাল রাফিয়ানরাও ছিল পুলিশের সঙ্গে। পুলিশের উর্দি পরে।”
দেবরাজ বেজায় চমকেছে। দিল্লিতে পা রাখার পর থেকে টিভিই দেখেনি। পলকের জন্য সেদিনের রাস্তা আটকানো যুবকদের মুখ দুলে গেল দেবরাজের চোখে। ভেসে উঠল শীতল সন্ত্রাস ছড়ানো মধ্যবয়সিটি। এবং অবশ্যই নির্বিকার পুলিশদেরও মনে পড়ল দেবরাজের। বাড়তে বাড়তে শেষে অ্যাদ্দূর? নাকি আরও বাড়বে ভবিষ্যতে? কলকাতায় কত যে ভয় দেখানো মেসেজ পেল গত দেড়-দু’মাসে! আশ্চর্য, তার ফোন নাম্বারটা যে এমন পাবলিক হয়ে গেল কী করে?
ফের প্রমিতের গলা, “দেবরাজদা, বলুন কিছু।”
“হ্যাঁ… ভাবছি… প্রতিবাদ তো করাই উচিত… একটা বড়সড়…”
“আমরা অলরেডি সেই ডিসিশন নিয়েছি। একটা মহামিছিলের আয়োজন হচ্ছে। কলেজ স্কোয়্যার থেকে ধর্মতলা। আগামী শনিবার বেলা দু’টোয়। কোনও পলিটিকাল ভেদাভেদ থাকছে না, শিল্পী সাহিত্যিক কবি নাটকের লোকজন, সাধারণ পাবলিক এভরিওয়ান ইজ ওয়েলকাম। সরকারকে একটা কড়া চেতাবনি দিতেই হবে।”
“ভেরি গুড। কিন্তু আমি তো জয়েন করতে পারছি না ভাই। আমি তো এখন দিল্লিতে।”
“সে কী? কবে গেলেন?”
“পরশু। সকালে। একটা জরুরি কাজ পড়ে গেল…”
“ও। তা শনিবার আসা যায় না? আপনারা থাকলে মিছিলের ওজন আরও বাড়ে।”
“সরি। পেরে উঠব না। সবে এলাম তো…। তবে মেন্টালি আমি থাকছি সঙ্গে। হানড্রেড পারসেন্ট।”
“সে তো আমরা জানি।… নেক্সট টাইম কলকাতায় এলে কাইন্ডলি ইন্টিমেট করবেন।”
“অবশ্যই। তা এখন ছাড়ি?”
ফোনের বোতাম টিপতে গিয়েও দেবরাজের আঙুল থমকাল ক্ষণেক। প্রমিত কাকে যেন চেঁচিয়ে বলছে, ‘এই, অসীমদার মালটা দিল্লি ভেগে গেছে রে!’ কপালে বিরক্তির ভাঁজ ফুটল দেবরাজের। ছেলেটিকে সভ্যভব্য বলেই তো মনে হয়েছিল…? সর্বদা সঙ্গে সঙ্গে না থাকলেও দেবরাজও একজন সহযোদ্ধা, তার সম্পর্কে কী অবলীলায় অমার্জিত মন্তব্য হানছে!
পুনম স্টুডিয়ো থেকে নড়েনি। হাসছে মিটিমিটি। দেবরাজের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, “তুমি তো হেভি লিডার বনে গেছ? কলকাতা থেকে ফোন করে করে ডাকছে…?”
ক্ষোভ চেপে দেবরাজও হাসল, “আরে না, খানিকটা জড়িয়ে গেছি বলতে পারো। ওই অসীমটার জন্যে।”
“তাই কী? মাঝে কবে যেন তোমার একটা ইন্টারভিউ এসেছিল ন্যাশনাল চ্যানেলে। তোমাকে কিন্তু সেদিন খুব ফিউরিয়াস দেখাচ্ছিল। আর বলছিলেও ভেরি কনভিনসিং টোনে।”
“আমি যখন যা বলি, বিশ্বাস থেকেই বলি। তাই হয়তো ওরকম একটা টোন এসেই যায়।”
“কিন্তু রাজনীতিতে তোমার বিশ্বাস আছে কি? বরং উলটোটাই তো…”
“এখনও তাই বলি। আই হেট পলিটিক্স। আই হেট গেম অফ পাওয়ার। কিন্তু আমি সর্বদাই মুক্ত চিন্তার পক্ষে। ইন আ ডেমোক্রেসি, প্রত্যেকটি সিটিজেনেরই নিজস্ব মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, এটাই তো নরমাল। কোনও ব্রুট পাওয়ার, সেটা সরকার হতে পারে, কোনও দলও হতে পারে… যদি সেই অধিকার কেড়ে নিতে চায়, আমি তার প্রতিবাদ করবই। এটা আমার ন্যাচারাল ইনস্টিংক্ট পুনম।” দেবরাজ কাঁধ ঝাঁকাল, “এটাকে যদি তুমি রাজনীতি বলো, তো আমি নাচার।”
“তোমার সঙ্গে ওয়েস্টবেঙ্গল গভর্নমেন্টের কী নিয়ে লাগল?”
“সেটা এমন কিছু বড় ইস্যু নয়। একটা রুটিন প্রোটেস্ট করেই হয়তো আমি চেপে যেতাম। কিন্তু তারপর থেকেই এমন একটা অ্যাটিটিউড দেখাল। সরকার। দল। আজেবাজে কমেন্ট করছে আমার সম্পর্কে। থ্রেটন পর্যন্ত করছিল।” দেবরাজের স্বরে সামান্য শ্লেষ এসে গেল, “ওরা জানে না, দেবরাজ শিল্পী যেমনই হোক, মানুষটা দু’নম্বরি নয়। সে কাউকে ডরায় না। সে যা ঠিক মনে করবে, সে তা করবেই। কেউ তাকে ধমক দিয়ে থামাতে পারবে না।”
“এনকোর, এনকোর, তুমি তো লম্বা লম্বা ডায়লগ মারছ আজকাল!” খুটখুট তালি দিচ্ছে পুনম। হাসতে হাসতে বলল, “কলকাতা ঘুরে এসে তুমি তো এবার বিলকুল বদলে গেছ রাজ!”
“মনে হচ্ছে?” দেবরাজও রঙ্গে মাতল। চোখ টিপে বলল, “সেটা ভালর দিকে, না খারাপের দিকে?”
“দু’রকমই আছে।” পুনম স্টুডিয়োর বেঁটে টুলে বসল। চোখ-নাক-কপাল কুঁচকে বিচিত্র এক ভঙ্গি করে বলল, “যেমন ধরো, তোমার বড়ভাইয়ের অসুখ সম্পর্কে তুমি হাইলি কনসার্নড, চারপাশের জগৎ নিয়ে তুমি যা হোক ভাবনা চিন্তা করছ, এগুলো প্লাসের খাতাতেই যাবে। কিন্তু, তুমি আমায় আজেবাজে কৈফিয়ত দিয়ে ম্যানেজ করতে চাইছ..”
“দাঁড়াও, দাঁড়াও, তোমায় কী আলতুফালতু বললাম?”
“শুনে রেগে যাবে না তো?”
“বলো তো আগে।”
“সেদিন হঠাৎ ফোন করলে, কাল মর্নিং ফ্লাইটে দিল্লি ব্যাক করছি। তার দু’দিন আগেও কল করেছিলে, তখনও কিন্তু দিল্লি আসার কথাটা বলোনি। তুমি যেদিন এলে, ওইদিনই ছিল তোমার অতি অতি অতি প্রিয় মেয়ের বিয়ে। এসে বললে, ‘কাজ আছে।’ অথচ ঢোকার পর থেকে গত দু’দিন এই লক্ষ্মীনগরের ফ্ল্যাট ছেড়ে তুমি বেরোলেই না।” পুনমের চোখে প্রশ্নচিহ্ন, “কী মনে হয় রাজ? আমাকে ঠিকঠাক বলেছ?”
দেবরাজ টুঁ শব্দটি করল না। তার আসা না আসার অনিশ্চয়তা তো ছিলই। মানসীর নিষেধে ‘হ্যাঁ’ বলার পরেও যে কী অসম্ভব দোটানায় ছিল দেবরাজ! কত অজস্রবার ভেবেছে, কেন গুরুত্ব দেবে মানসীর আপত্তিকে? আঁচলকে একবার বউয়ের সাজে দেখবে না আঁচলের বাবা? একবারই তো… ওই একদিনই তো…। আর সে যদি হাজির হয়ই, ভরা হাটে মানসী সিনক্রিয়েট করবে না নিশ্চয়ই? মেয়ের সম্মানের কথা ভেবেই নীরব থাকবে সে। তারপর আঁচলের বিয়ে চুকে গেলে মানসী আর তাকে পাচ্ছে কোথায়? কিন্তু সেদিন রাতে হঠাৎ আঁচলও যখন ফোন করে বলল…।
তারপরও কলকাতা থেকে না পালিয়ে উপায় ছিল দেবরাজের?
কিন্তু পুনমকে কী এসব বলা যায়? যদি আঁচল সম্পর্কে কোনও ভুল ধারণা করে পুনম? সে তো আঁচলকে চেনে না, জানে না, আঁচলের মায়াকাড়া মনটাকে সে পড়বে কেমন করে?
পুনম স্থিরচোখে তাকিয়ে। হঠাৎ নরম গলায় বলল, “খুব মন খারাপ লাগছিল, তাই না?”
দেবরাজ বড় একটা শ্বাস ফেলে বলল, “হুঁ।”
“তা সেটা বললেই তো হয়।” পুনম হাত ধরল দেবরাজের। মৃদু চাপ দিয়ে বলল, “বি প্র্যাকটিকাল রাজ। মেয়ে তো একদিন পরের ঘরে যাবেই। আর তোমার মেয়ে তো বহুকালই পরের ঘরে। শুধু ঘরটাই যা বদল হল।”
দেবরাজ ম্লান স্বরে বলল, “হুঁ।”
“মেয়ের শ্বশুরবাড়ি তোমার কথা জানে নিশ্চয়?”
দেবরাজ ক্লান্ত স্বরে বলল, “হুঁ।”
“ওখানে গিয়ে মাঝে মাঝে মিট কোরো মেয়েকে।”
দেবরাজ দুঃখী স্বরে বলল, “হুঁ।”
দেবরাজের মনোবেদনার সরল সমাধান করে দিয়ে পুনম উঠে দাঁড়িয়েছে। টানল দেবরাজকে। সামান্য লঘু স্বরে বলল, “চলিয়ে জি। লাঞ্চকে বাদ ফির বেটিকি কি ইয়াদ মে খো যাইয়ে। ইন ফুল স্টমাক।”
ছুটির দিনেই যা একটু গুছিয়ে খাওয়ার ফুরসত মেলে পুনমের। রান্নার মেয়েটিও সেদিন এক-আধটা বাড়তি পদ বানায়। ফুলকপি, কালিডাল, কিমামটরের সঙ্গে বিন-গাজরের একটা সবজি রেঁধেছে আজ। আর টক দই তো থাকেই। পুনম স্যালাডও কেটেছে। কোনওটাই দেবরাজের অপছন্দের আইটেম নয়, কিন্তু আজ যেন স্বাদ পাচ্ছিল না দেবরাজ। তাও অল্প অল্প নিল সবই, রুটি খেল খান তিনেক। মধ্যাহ্নভোজটি শেষ করে আর ঢুকল না স্টুডিয়োতে, ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছে। দ্যাখ না দ্যাখ, তলিয়ে গেছে গভীর ঘুমে।
নিদ্রাভঙ্গ হল সন্ধে নাগাদ। পুনম নেই ফ্ল্যাটে। আজ কী কোনও শো আছে পুনমের? নাকি রির্হাসাল? বলে গেল না তো? নাকি বলেছিল, দেবরাজ শুনতে পায়নি? ভাবতে ভাবতে কিচেনে এসে চা বানাল দেবরাজ। মগভরতি চা নিয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যালকনিতে।
কম্পাউন্ডে আটখানা বাড়ি। সব ক’টাই চারতলা। মাঝে একটা মাঠ আছে বড়। কোণের বাস্কেটবল কোর্টে আলো জ্বেলে খেলছে ছেলেমেয়েরা। সান্ধ্যবিহারে বেরিয়েছে প্রবীণের দল। ট্র্যাকসুট পরে দৌড়ে গেল দুই তরুণী।
সমতা অ্যাপার্টমেন্টের ওই চলমান ছোট্ট জগৎটাকে দেখছিল দেবরাজ। অথবা দেখছিল না। একটা চিন্তা প্রবেশ করতে চাইছে মনে। নীচে তাকিয়ে প্রাণপণে তাকে রুখতে চাইছিল দেবরাজ। একবার দিল্লির ধোঁয়াটে আকাশটার পানে ও তাকাল। খুঁজছিল তারা। অথবা খুঁজছিল না।
মোবাইল বাজছে। বারান্দার বেতের টেবিলে মগ রেখে দৌড়ল দেবরাজ। মনিটরে দৃষ্টি পড়তেই বুকটা ধক। এই ফোনটার আশঙ্কাতেই না পরশু থেকে সে সিঁটিয়ে আছে! কেন যে আগেই আসেনি এটাই তো আশ্চর্য!
সাধ্যমতো স্বর সহজ রেখে দেবরাজ বলল, “হ্যাঁ রে বনো, কী খবর বল? দাদা এখন আছে কেমন?”
জবাবের বদলে ওপ্রান্তে গুমগুমে গলা, “কাজটা কিন্তু ভারী অন্যায় করলি ছোড়দা।”
দেবরাজ রসিকতার সুর ফোটাল, জীবনে ন্যায় কাজ আমি করলাম কবে!
“এটা তোর সবচেয়ে বড় অন্যায়। কাউকে কিছু না বলে শহর ছেড়েই হাওয়া মারলি?”
“আবার লেক গার্ডেনসে হানা দিয়েছিলি বুঝি?”
“ফাজলামি রাখ। বাবা তার বিয়েতে এল না… মেয়েটা যে কী কষ্টই পেল, আহা রে।”
“যাব কী করে? আমাকে তো কেউ নেমন্তন্নই করল না।”
“এখনও ইয়ার্কি? মেয়ের বাবার নেমন্তন্ন লাগে? গটগটিয়ে যাবি, মেয়ের মাথায় হাত রাখবি, চলে আসবি…। তোকে আটকায় কে!” বনো যেন রাগে ফুটছে, “এই অসভ্যতাটা কেন করলি বলবি দয়া করে?”
“আরজেন্ট কাজ পড়ে গেল রে।”
“মিথ্যে কথা। বিয়ের চারদিন আগে দাদার রেডিয়েশন শেষ হল… সেদিনও তুই বললি, দেখি সন্ধের পর ঘুরে আসব…।” হঠাৎই বনোর গলা চড়ে গেল, “আমি জানি তুই কেন আসিসনি। হিংসে। স্রেফ হিংসে। মানসী যে তোর মুখে ঝামা ঘষে, মেয়েটাকে মানুষ করে, একটা চমৎকার বিয়ে দিয়ে দিল, এটা দেখতে তোর বুক ফাটছিল।”
দেবরাজ বলতে চাইল, আমি ঘোর পাপিষ্ঠ, নরাধম, ন্যায়-অন্যায় মানি না, সমস্ত চরিত্রদোষই আমার মধ্যে প্রবলভাবে আছে। কিন্তু ওই হিংসে বস্তুটি আমার নেই রে। যারা আমাকে পিছনে ফেলে চড়চড়িয়ে ওপরে উঠে গেছে, তাদেরই কোনওদিন ঈর্ষা করতে পারলাম না, মানসী তো কোন ছার!
আওয়াজ ফুটল না দেবরাজের। বুঝি তাতেই বনানী খানিকটা প্রশমিত হয়েছে। একটু ভারী গলায় বলল, “আমি অবশ্য বুঝিয়েছি আঁচলকে। বলেছি, তোর বাবাকে তো জানিসই, এই নিয়ে মন খারাপ করিস না। আহা রে, ছলছল করছিল মেয়েটার মুখ। কী সুন্দর যে ওকে লাগছিল বিয়ের দিন… কেউ ওর দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছিল না।”
ঠকঠক পেরেক ফুটছে পাঁজরে। যিশুও কী এত যন্ত্রণা পেয়েছিল, বারাব্বাসের বদলে ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার সময়ে?
বনানী বলে চলেছে, “এই তো এখন বউভাতে যাচ্ছি। গিয়ে একটু কথাবার্তা বলি। যদি ফুলশয্যার রাতে মেয়েটার মন একটু ভাল করা যায়…”
গলায় একটা বিশ্রী জমাট ডেলা। ফুসফুসেও বড্ড চাপ। দেবরাজের দম আটকে যাবে নাকি!
১৬
আঁচলের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এবার সে একা। পরিপূর্ণভাবে একা। অন্য একটা পরিবারে সম্পূর্ণ নতুন এক জীবন শুরু হতে চলেছে, যেখানে মা-বাপি নেই, অলি নেই, নিজের প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিজেকেই নিতে হবে। পারবে কি সে? অচেনা রাস্তায় হাঁটতে? মা বলছিল, ঘাবড়ানোর কিছু নেই, মেয়েরা নাকি এই পথ চলতে আপনিই শিখে যায়। হবেও বা। কিন্তু হাজারো চোরা শঙ্কায় যে ধুকপুকুনি চলছে বুকে, তাকে কীভাবে থামায় আঁচল?
কেন হচ্ছে এমনটা? আঁচল না এই দিনটারই প্রতীক্ষায় ছিল? অমত তো নয়ই, বরং বিয়েটা হয়ে যাক, এটাই তো সে চেয়েছিল মনে মনে? কত অজস্র ছোট ছোট কুণ্ঠার অবসান, প্রতি পদে আর কাঁটা বিঁধবে না বুকে, অদৃশ্য এক লক্ষণরেখার মধ্যে আটকে থাকার দায় রইল না আর…! সেই দিকেই তো এবার গড়াবে আঁচলের জীবন, তবু যে কেন স্বস্তি নেই?
নাকি এ অস্বস্তি নয়, মন খারাপেরই এক রকমফের? এমন পরিস্থিতিতে তো আগে কখনও পড়েনি আঁচল, তাই হয়তো অনুভূতিটা ঠিকঠাক চিনে উঠতে পারছে না? এ তো আঁচলকে মানতেই হবে, চলে যাওয়ার সময়ে মা যখন তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল, মুক্তির পাশাপাশি একটা অসহ্য কষ্টও হচ্ছিল তার। অলি কাল থেকে এ বাড়িতে ছিল, আজ যখন যাওয়ার আগে ফোঁপাচ্ছিল, বুকটা কী হু হু করে ওঠেনি আঁচলের? বাপির মতো শক্ত মানুষেরও চোখ ছলছল, সেই ছবিটাও কি আঁচলকে ঝাপটা মারছে না? অনেকটা তফাতে দাঁড়িয়ে থাকা অম্বরদার নতশির মুখটাও তো চোখে ভাসে বারবার। যখন মা-বাপিদের গোটা দলটা হাত নেড়ে বেরিয়ে গেল, তক্ষুনি কি হাঁটুর জোর কমে যায়নি আঁচলের? কাল গড়িয়া ছেলে চলে আসার মুহূর্তেও প্রায় এরকমটা ঘটেছিল, কিন্তু আজ যেন উপলব্ধি অন্যরকম। খালি মনে হচ্ছে, সম্পর্কগুলো যেন এক লহমায় ছিঁড়ে গেল। ফুরিয়ে গেল। হারিয়ে গেল। তা এই সব কিছু মিলিয়ে মিশিয়েই কী হৃদয়ে এত বিশ্রী গুমোট?
আঁচল জানে না। আঁচল বুঝতে পারছে না।
জোর করে একটা বড় শ্বাস নিয়ে আঁচল নিজেকে স্থিত করতে চাইল। অন্যমনস্ক হওয়ার জন্য আর একবার চোখ বোলাল ফুলশয্যার ঘরটায়। ছত্রি লাগানো ইংলিশ ডবলবেড খাট ঘিরে ফুলের জাফরি, বিছানাতে ফুলের পাপড়ি ছড়ানো, বালিশে দু’খানা গোড়ের মালা। ফুল আঁচল ভালইবাসে, কিন্তু এই মুহূর্তে ফুলের দিকে দৃষ্টি পড়লেই কেমন শিরশির করে উঠছে গা। যেন অশ্লীল কোনও ইঙ্গিত হানছে ফুলগুলো।
ঝটিতে নজর ঘুরিয়ে নিল আঁচল। দেখছে সদ্য রং করা দেওয়াল, দেখছে ঝুলন্ত প্রকাণ্ড টিভি, ডি ভি ডি প্লেয়ার, দেখছে দেওয়ালজোড়া ওয়ার্ড্রোবের মাঝটিতে সুদৃশ্য ড্রেসিংটেবিল…
আসবাব দেখতে দেখতে আঁচল উঠল ডিভান ছেড়ে। এখন আর সে কনেবউয়ের সালংকারা জবরজং সাজে নেই, স্ত্রীআচারের আগেই বদলেছিল পোশাক। তাঁতের শাড়িতে সে এখন অনেকটাই স্বচ্ছন্দ। তবে দাঁড়িয়েই টের পেল, শরীরে বেজায় ক্লান্তি। সেই পরশু ভোরে দধিকর্মা থেকে শুরু করে যা অবিরাম ধকল যাচ্ছে! আজ সন্ধেবেলা তো ঠায় একভাবে বসে থাকতে হল, সেও কী কম পরিশ্রম! একটু আগেও নির্বাণের তুতো দিদি-বউদিরা নির্বাণ আর আঁচলকে নিয়ে যা আরম্ভ করেছিল, বাপস! ভাগ্যিস শাশুড়ি এসে থামাল, নইলে ওই মেয়েলি কাণ্ডকারখানা কতক্ষণ যে চলত কে জানে!
এখন তো আসল দুর্যোগটাই বাকি। মনে হতেই আঁচলের দমবন্ধ ভাবটা যেন ফিরে এল। একটু খোলা বাতাসের সন্ধানেই বুঝি গিয়ে দাঁড়িয়েছে জানলায়। গ্রিলের ওপারে নীচে শুনসান রাস্তা। জ্বলছে পথবাতি। গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে রাস্তায় যত না আলো, তার চেয়ে বেশি ছায়া।
আলোটাই দেখছিল আঁচল, কিন্তু বারবার ছায়াতেই চলে যাচ্ছিল চোখ। তখনই দরজায় মৃদু শব্দ। চমকে তাকিয়েছে আঁচল। না, নির্বাণ নয়। বিদিশা। পরনে এখনও সেই কালো জরিপাড় ঘিয়ে রং কাঞ্জিভরম সিল্ক। প্রসাধন চর্চিত ঈষৎ শ্রান্ত মুখখানায় এখনও রাজেন্দ্রাণীর দীপ্তি। স্মিত মুখে বিদিশা বলল, “কী করছ জানলায়?”
পায়ে পায়ে ফিরল আঁচল। হাসি হাসি ভাব ফোটাল ঠোঁটে, “কিছু না। এমনিই…”
“বাড়ির কথা মনে পড়ছে?”
জবাব দিল না আঁচল। মুখের হাসি হাসি ভাবটা ধরে রাখল শুধু।
“আরে, এইটাই তো তোমার বাড়ি এখন। বিদিশা হাত রেখেছে আঁচলের কাঁধে,” তোমাকে কালও বলেছি, “আবার বলছি, আমি সাত কাজের মানুষ। সংসার দেখাটেখা আমার পোষায় না। এবার থেকে তুমিই সব সামলাবে।”
এবারও আঁচলের উত্তর নেই। অল্প ঘাড় নড়ল শুধু।
বিদিশা জিজ্ঞেস করল, “বান্টির সঙ্গে তোমার কথা হয়েছে?”
আঁচলের ভুরুতে প্রশ্নচিহ্ন।
“বুঝেছি। এখনও বলেনি তোমায়।” বিদিশার কণ্ঠে হালকা সুর, “তোমরা ক’দিনের জন্য সিকিম বেড়িয়ে এসো। ট্রেনের টিকিট, হোটেলের বুকিং সব আমি করে দিয়েছি। অষ্টমঙ্গলার পরদিন তোমরা রওনা দিচ্ছো। দার্জিলিং মেলে।”
আঁচল সামান্য অবাকই হল। ছেলে-ছেলের বউকে হনিমুনে পাঠানোটাও কি মহিলা দায়িত্বের অঙ্গ মনে করছেন? তারা কোথায় যাবে, সেটাও উনিই স্থির করবেন? ব্যাপারটা মনোমতো না হলেও চুপই রইল আঁচল।
“ফিরে বাপের বাড়ি কিছুদিন থেকে আসতে পারো।” বিদিশা মৃদু চাপ দিল আঁচলের কাঁধে। স্বভাববিরুদ্ধ তরল ভঙ্গিতে বলল, “তারপর কিন্তু আর নো ছুটি। পুরোদমে পড়াশুনোয় লেগে পড়বে। ফাঁকে ফাঁকে সংসারের খবরদারিও। আমি তখন খুবই ব্যস্ত থাকব। পার্লামেন্ট ইলেকশন এসে যাচ্ছে তো, আমাকে অনেক জায়গায় ছুটতে হতে পারে।”
আঁচলের এবার স্বর ফুটেছে। মৃদু গলায় বলল, “হুঁ।”
“গুড গার্ল।” আলতো করে আঁচলের গালটা টিপে দিল বিদিশা। মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল, “কেমন হয়েছে ফুলশয্যার ডেকরেশন?”
কী বলবে আঁচল? সামান্য ঠোঁট ফাঁক করা ছাড়া?
“আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে করিয়েছি।” বিদিশার গর্বিত হাসি বেশ চওড়া হয়েছে। কবজি-ঘড়িতে আলগা চোখ বুলিয়ে বলল, “অনেক রাত হল। এবার তোমরা শুয়ে পড়ো।… আমি বান্টিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
বিদিশা বেরিয়ে যাওয়ার পরও আঁচল একটুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে। শাশুড়ির শেষ বাক্যটি তার বোধগম্য হয়নি। বান্টিবাবু কী কোথাও গল্পগুজবে মত্ত, সেখান থেকে উঠিয়ে এ ঘরে প্রেরণ করবেন শাশুড়ি? কিন্তু বাড়ি তো এখন প্রায় ফাঁকা, আত্মীয়স্বজন কেউ নেই আর। তা হলে কার সঙ্গে আড্ডা মারছে সে? নাকি শাশুড়ির নিজের কথাবার্তা সাঙ্গ হলে তবেই ফুলশয্যায় প্রবেশাধিকার মিলবে নির্বাণের? তাই কি স্ত্রীআচারের শেষে টুক করে সরে পড়ল? আশ্চর্য ছেলে, বিয়ের আগে একবারও যোগাযোগের চেষ্টা করেনি আঁচলের সঙ্গে! একটা ফোন পর্যন্ত না। কেন? লজ্জা? অলি-অম্বরদারা অবশ্য সেরকমই বলছিল। আঁচল এ বাড়িতে আসার পরও ছুতোনাতায় বউয়ের কাছাকাছি ঘুরঘুর করেনি। সেও কি লজ্জা? না মা বকবে, এই ভয়ে? কিন্তু শাশুড়ি তো মোটেই তেমন প্রাচীনপন্থী নন। ছেলে, ছেলের বউয়ের ফুলশয্যার খাট সাজাচ্ছেন, মধুচন্দ্রিমার ব্যবস্থা করছেন…! ছেলে তার নব পরিণীতা বউটির সঙ্গে দুটো কথা বললে তিনি কুপিত হবেন, এমনটা ভাবা বেশ কঠিন।
তা হলে বোধহয় লজ্জার তত্ত্বটাই ঠিক। মন্থর পায়ে আঁচল ফুলশয্যার খাটে এল। পুষ্পসজ্জা সরিয়ে বসেছে বিছানায়। ছেলেদের প্রকৃতি সম্পর্কে তার খুব একটা স্বচ্ছ ধারণা নেই, কলেজ-ইউনিভার্সিটিতেও ছেলেদের সঙ্গে তেমন মেলামেশা ছিল না। ওই বান্ধবীদের মুখে শুনে শুনেই যতটুকু যা আন্দাজ। তবে সে যে অনেক ছেলেরই লক্ষ্যবস্তু, সেটা টের পেয়ে বরাবরই একটা গাম্ভীর্যের দেওয়াল তুলে যথাসম্ভব তাদের এড়িয়ে চলেছে। কিন্তু বিয়ের নামে যে শুধু মেয়েরাই সংকোচ বোধ করে, এমন তো নাও হতে পারে। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে একটা ছেলের মনেও দ্বিধাদ্বন্দ্ব, সংশয় আসা কি একান্তই অসম্ভব?
আঁচল নিজের মনে হেসে ফেলল। এই তো, দিব্যি সপ্রতিভ চিন্তা করতে পারছে সে। যাকে নিয়ে তার টেনশন, সে যে আরও বেশি মানসিক চাপে নেই, তারই বা কী নিশ্চয়তা?
আবার দরজায় আওয়াজ। হ্যাঁ, নির্বাণই। পরনে সিল্কের পাজামা-পাঞ্জাবী। সে ঢোকামাত্র এতক্ষণের তিলে তিলে সঞ্চয় করা সাহস, শৌর্য, সহজতা মুহূর্তে উধাও। আবার ফিরছে সেই শ্বাস রুদ্ধ করা অনুভূতি। অতি কষ্টে চোখের কোণ দিয়ে আঁচল দেখল, বন্ধ হল দুয়ার, এক পা এক পা করে এগোচ্ছে নির্বাণ। নাহ, এদিক পানে এল না, সটান গিয়ে বসেছে ডিভানে। দু’ হাতের তালু মাথার পিছনে রেখে। চোখ বুজল। খুলেছে চোখ। আঁচলের দিকেই তাকাচ্ছে আড়ে আড়ে। পলকের জন্য দৃষ্টি মিলতেই ঘুরিয়ে নিল ঘাড়। এবার সম্পূর্ণ নিশ্চল।
এই মুহূর্তে তার কী করা উচিত ভেবে পাচ্ছিল না আঁচল। এভাবেই কী সে দুরুদুরু বুকে ঘটের মতো বসে থাকবে? নাকি ছোট্ট একটা হাই তুলে এক্ষুনি সটান শুয়ে পড়বে? এবং প্রতীক্ষা করবে শরীরী আক্রমণের? কিংবা যেচে কথা বলবে কোনও? যা হোক তা হোক? হাবিজাবি? আজ দিনটা কেমন… গরম না ঠান্ডা… আকাশে মেঘ করেছে কী না…! কিন্তু বাসরঘরেই যা মুখে কুলুপ এঁটে বসে ছিল ছেলেটা…! অলি তো কত ঠাট্টা ইয়ার্কি জোড়ার চেষ্টা করল, আঁচলের বন্ধুরাও রঙ্গরসিকতা কম করছিল না, অথচ সারাক্ষণ কেমন হুতোমপ্যাঁচার মতো বসে রইল নির্বাণ…!
মোবাইল বাজছে। নির্বাণের পকেটে নয়, ড্রেসিংটেবিলে পড়ে থাকা আঁচলের যন্ত্রটি মুখর হয়েছে। এত রাতে কে খোঁজে আঁচলকে?
সামান্য ইতস্তত করে আঁচল নামতে যাচ্ছিল, তার আগে নির্বাণই উঠে এনে দিয়েছে মোবাইল। মনিটরে দৃষ্টি পড়তেই আলগা চমক। অলি।
আঁচল গলা ঝাড়ল, “কী রে, তুই? এখন?”
“এ মা, ঘুমোসনি বুঝি?”
“সেটা জানতেই ফোন করলি?”
“জেগে জেগে কী করছিস রে তোরা? গল্প?”
ধমকাতে গিয়েও আঁচল নিজেকে সামলে নিল। সংক্ষেপে জবাব দিল, “হুঁ।”
“নির্বাণদা কথা বলতে পারে তা হলে?”
“হুঁ।”
“কী গল্প করছিস? খুব প্রাইভেট?”
এবার আঁচলের স্বরে উষ্মা এসেই গেল, “জানাটা কি খুব জরুরি?”
“তুই রেগে গেলি দিদিভাই? হিহি হিহি। নির্বাণদাকে একটু দে না, কথা বলি।”
“না। কাল সকালে যত ইচ্ছে ফোন করিস।”
“বেশ বাবা বেশ। ফোনটা তা হলে সুইচ অফ করে রাখ। নইলে কিন্তু আমি আবার জ্বালাব। হিহি হিহি।”
মোবাইলকে সত্যি সত্যি ঘুম পাড়িয়ে দিল আঁচল। বালিশের তলায় রাখছিল, নির্বাণের গলা শুনতে পেল, “কার ফোন ছিল? বন্ধু?”
“না।” আঁচল আলতো উত্তর দিল, “অলি।”
“অলি তো তোমার চেয়ে অনেকটাই ছোট, তাই না?”
“হুঁ। প্রায় সাত বছরের।”
“তোমায় খুব ভালবাসে?”
“হুঁ।”
“খুব মিস করছে?”
“হুঁ।”
“আমার তো কোনও ভাইবোন নেই, তাই এই ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝি না।”
নির্বাণের বাকভঙ্গিতে সামান্য খটকা লাগলেও আঁচল সহজ স্বরে বলল, “ও।”
দাঁড়িয়েই কথা বলছিল নির্বাণ। ফের ডিভানে গিয়ে বসেছে। একটু চুপ থেকে হঠাৎ প্রশ্ন, “মা তোমায় কী বলছিল? আমার সম্পর্কে কিছু?”
“না। আমাদের বেড়াতে যাওয়া নিয়ে… সিকিমে…”
“আমায় কিন্তু অ্যাকিউজ় কোরো না।” নির্বাণের স্বর ঈষৎ রুক্ষ, “আমি কিছু ঠিক করিনি। সব মায়ের ইচ্ছে।”
আঁচল কিঞ্চিৎ অবাক। নির্বাণকে আঁচল দোষারোপ করবে, এমন অদ্ভুত ভাবনারই বা কী কারণ?
আঁচল কিছু বলার আগেই নির্বাণ আবার সরব, “মায়ের প্রতিপত্তি দেখলে তো আজ? দু’ দু’জন মিনিস্টার এসেছিল। পাঁচ পিস এম এল এ। আর কুচোকাচা লিডারে তো থিকথিক করছিল বাড়ি।”
আশ্চর্য, আঁচলকে এসব বলছে কেন নির্বাণ? তাও কিনা ফুলশয্যার রাতে?
নির্বাণ ফের বলল, “মায়ের সঙ্গে কেউ পেরে ওঠে না। তুমিও পারবে না। হেরে ভূত হয়ে যাবে।”
নির্বাণ প্রলাপ বকছে নাকি? আঁচলের গা ছমছম করে উঠল। ছেলেটার মাথার গণ্ডগোল নেই তো? নাকি নেশা-টেশা করেছে? ড্রাগ-টাগ নিলে তো গন্ধও থাকে না!
তবু আঁচল বলেই ফেলল, “আমি তো তোমার মায়ের সঙ্গে লড়তে আসিনি।”
“হ্যাঁ, তাও তো বটে।” কেমন যেন একটা চোখে তাকাল নির্বাণ। ব্যঙ্গের সুরে বলল, “তুমি তো মায়ের লোক। মায়ের কাছে দাসখত লিখে এসেছ নিশ্চয়ই!”
এ কী ভাষা? আঁচল বিরক্ত হল। মা-ছেলেতে কোনও ঠোকাঠুকি আছে নির্ঘাত। তবে আজ রাতেই সেটা আঁচলকে না বোঝালে চলছিল না? সবচেয়ে বড় কথা, আঁচল সম্পর্কে মন্তব্য করে কোন সাহসে? কতটুকু জানে আঁচলকে? বিদিশাদেবীর মন রাখতে যে বিয়েটা হয়নি, নির্বাণের মা যতই আঁচলকে পছন্দ করুক, সে কণামাত্র ঘাড় টেড়া করলে মা-বাপি ও বিয়েতে এক কদম এগোত না… শুনিয়ে দেবে নাকি নির্বাণকে? শুধু তাই নয়, বিদিশাদেবী যতই কেউকেটা হন, তাঁকে শাশুড়ি পাওয়ার জন্যে আঁচল বিন্দুমাত্র লালায়িত ছিল না, স্রেফ পরিবারটার শিক্ষাদীক্ষা রুচি আছে অনুমান করে আঁচল সম্বন্ধটা নাকচ করেনি, এটাও বোধহয় স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া দরকার।
কিন্তু আঁচলের রুচিতে বাঁধছে যে। তা ছাড়া কথায় কথা বাড়ে, তর্কও লেগে যেতে পারে, ফুলশয্যার রাতে যা একান্তই অশোভন। সজ্ঞানে আঁচল এমন আচরণ করবে না, যাতে কেউ তার দিকে আঙুল তোলার সুযোগ পায়। তেমন ঘটলে, শুধু আঁচল কেন, তার মা-বাপিরও যে সম্মানহানি হবে।
বরং উপেক্ষার বর্ম দিয়ে নির্বাণকে প্রতিহত করাই শ্রেয়। যদি বোধবুদ্ধি থাকে, তা হলে ছেলেটা নিশ্চয়ই বুঝে যাবে এই ধরনের আলটপকা টিপ্পনি শুনতে আঁচল মোটেই উৎসাহী নয়।
শান্তভাবে আঁচল বলল, “তোমার কোনও বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলে না তো?”
আচমকা প্রসঙ্গের মোড় ঘুরে যাওয়ায় নির্বাণ যেন পলক থতমত। পরক্ষণে ঠোঁট উলটে বলল, “আমার কোনও বন্ধুবান্ধব নেই।”
“কেন?”
“এতে কেনর কী আছে? আমি মানুষটাই এরকম।”
“একজনও নেই? স্কুলের? কলেজের? পাড়ার? অফিসের?”
এবার যেন একটু ম্রিয়মাণ দেখাল নির্বাণকে। সাড়াশব্দ নেই। হঠাৎ উঠে ঢুকে গেল লাগোয়া বাথরুমে। বেরিয়ে কাচের জগ থেকে ঢকঢক জল খেল খানিকটা। স্বস্থানে জগ রেখে জানলায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। মিনিটখানেকের মধ্যেই ফিরল। ডিভানে বসব বসব করেও বসল না। খাটের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
হঠাৎ বলল, “যাঁর অসুখের অজুহাতে বিয়েতে এত তাড়াহুড়ো, তিনি আছেন কেমন?”
‘অজুহাত’ শব্দটা খট করে লাগল আঁচলের কানে। তাও বলল, “একেবারেই ভাল না। অ্যাডভান্স স্টেজ ক্যানসার তো, যে কোনও দিন কিছু একটা ঘটে যেতে পারে।” একটু থেমে থেকে আঁচল ফের বলল, “বিশ্বাস না হলে নিজের চোখে দেখে আসতে পারো।”
না, আঁচলের বাঁকা সুরে কোনও প্রতিক্রিয়া হল না। নির্বাণ একইভাবে বলল, উনি যেন তোমার কে হন?
এটাও কি শোনেনি? নাকি ইচ্ছে করে খোঁচাচ্ছে?
আঁচল কেটে কেটে বলল, “আমার জেঠু। বাবার একমাত্র দাদা।”
“তোমার এক জ্যাঠাকে দেখলাম যেন? উনি তা হলে কে?”
“আমার বাপির দাদা।”
“ও। বাপি… বাবা… বাবা… বাপি।” শব্দ দু’খানা নিয়ে বেশ কয়েকবার পাকলাল নির্বাণ। তারপর ভুরু কুঁচকে বলল, “বাবা মানে সেই আর্টিস্ট ভদ্রলোক? কী যেন নাম?”
“দেবরাজ সিংহরায়।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। একদিন বোধহয় টিভিতেও দেখেছি। মায়ের পার্টিকে তুড়ে গালাগাল করছিলেন।” নির্বাণের ভুরুর ভাঁজ ঘন হল, “উনি বিয়েতে এলেন না কেন? মায়ের ভয়ে?”
রাগ নয়, এবার হাসি পেয়ে গেল আঁচলের। নিজের মাকে কী ভাবে নির্বাণ? সর্বশক্তিমান গোছের কিছু? হা হা। দেবরাজ সিংহরায়কে নির্বাণ চেনে না। দুনিয়ায় সে কাকে ডরায়? ভগবানকে তো নয়ই, শয়তানকেও না। আসব বলে যদি সে মনস্থ করত, বিদিশা চৌধুরীর আপত্তি আছে কি নেই, থোড়াই পাত্তা দিত সে।
ভাবতে গিয়ে আঁচলের বুকটা টনটন। জগতে একজনেরই তো নিষেধবাক্য মান্য করে বাবা। শুধু তারই সামনে সিগারেট ধরাতে সাহস পায় না, আড়াল করে মদের বোতল। সে যখন বিয়েতে আসতে মানা করল, ওই প্রবল পুরুষটার স্বর কেমন ভিজে ভিজে শোনাচ্ছিল না?
কেন তাকে বাধা দিল আঁচল? অশান্তি এড়াতে? মা-বাপি ক্ষুণ্ণ হতে পারে এই আশঙ্কায়? নাকি সে চায়নি তার বাবাকে নিয়ে কোথাও কোনও ফিসফিস গুজগুজ হোক? কিংবা হয়তো বাবার সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ আছে, এটাই সে অপ্রমাণ করতে চেয়েছিল?
উঁহু, এর কোনওটাই নয়। আঁচলের শুধু মনে হয়েছিল, বিয়েতে বাবার না আসাই ভাল। ওই গড়পড়তা মানুষের ভিড়ে তার বাবাকে মানায় না।
তা এ কথা তো নিশ্চয়ই নির্বাণকে বলবে না আঁচল। আলগাভাবে ভাসিয়ে দিল, “বাবার কাজ ছিল। দিল্লি চলে গেছে।”
“উনি দিল্লিতে থাকেন বুঝি?”
“হ্যাঁ।”
“তোমার মায়ের সঙ্গে তো অনেককাল আগেই ছাড়াছাড়ি?”
“হুঁ।”
‘উনি কি আবার ওখানে ঘরসংসার করছেন? তোমার মায়ের মতো?”
আঁচল পলকের জন্য ভাবল, জবাবটা এড়িয়ে যায়। পরক্ষণে মত বদলাল। বিয়ের কার্ডে শান্তনু-মানসীর জ্যেষ্ঠা কন্যা বলেই তার পরিচয় দেওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু সে তো দেবরাজ সিংহরায়ের মেয়ে। কপটতা কি তাকে শোভা পায়? স্পষ্ট গলায় আঁচল বলল, “ঠিক সংসার নয়। একজন মহিলার সঙ্গে থাকেন। লিভ-টুগেদার।”
সরাসরি এমন একটা উত্তরের জন্যে বোধহয় প্রস্তুত ছিল না নির্বাণ। তিলেক থমকে রইল। তারপর এক বিচিত্র ভঙ্গিতে বলে উঠেছে, “ওয়াও, বহুৎ খলিফা আদমি! নো ঝঞ্ছাট, সির্ফ মস্তি!”
কী অমার্জিত বাচনভঙ্গি! গা রি রি করে উঠল আঁচলের। প্রশ্নগুলো তো শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে বহুক্ষণ, এবার তার বাবাকে অপমান করছে! এই পুরুষ তার জীবনসঙ্গী হবে? এক বিছানায় সারাটা জীবন…? মাগো!
নির্বাণ পায়চারি করছে ঘরে। আপন মনে বলে উঠল, “তোমরা হেভি মড ফ্যামিলি তো! মায়ের সেকেন্ড ম্যারেজ, বাবা লিভ-টুগেদার করছে… তুমিও দিব্যি বাপি, বাবা নিয়ে আছ… শালা, আমরাই বোধহয় ব্যাকডেটেড।”
আঁচলের কান ঝাঁ ঝাঁ করছিল। এ নাকি লাজুক? মুখ দিয়ে কথা ফোটে না? ফুলশয্যার রাতেই মুখোশ খুলে ফেলল ছেলেটা?
আবার নির্বাণের প্রশ্ন ধেয়ে এল, “আমার মা সব জানে, তাই না?”
আঁচল সামান্য ফুঁসে উঠল, “আমরা কিছুই লুকোইনি।”
“মা কেমন খোলা মনের মহিলা ভাবো। ছেলেকে কিচ্ছুটি না জানিয়ে এমন একটা ফ্যামিলির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে দিল।”
আঁচল স্থৈর্য হারাচ্ছিল। কোনওক্রমে স্নায়ুকে বশে এনে বলল, “আমি খুব টায়ার্ড। শুয়ে পড়ছি।”
“নো প্রবলেম। বিছানায় আজ নয় নাই এলাম। ডিভানেই কাটাব রাতটা।” বলেই হঠাৎ গলা খাদে নামিয়েছে নির্বাণ, “মাকে চুকলি খেয়ো না যেন।”
আঁচল হতভম্ব। নির্বাণ বলেটা কী?
“ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ কোরো না, আজ কিছু হয়নি। মানে ফুলশয্যার রাত্তিরে যেসব করতে হয় আর কী।” আঁচলকে স্তম্ভিত করে দিয়ে নির্বাণ চোখ টিপল, “অদ্যই তো শেষ রজনী নয়। তুমিও আছ, আমিও আছি, কী বলো?”
আঁচলের ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। এ কী জঘন্য এক পুরুষের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল সে? অসহ্য। অসহ্য। অসহ্য। রাত পোহালেই হাঁটা দেবে নাকি গড়িয়ায়? চুলোয় যাক বিদিশা চৌধুরী। জাহান্নমে যাক সামাজিক লাজলজ্জা। আঁচল দেবরাজ সিংহরায়ের মেয়ে, কোনও কিছুকে সে পরোয়া করে না।
আহ, গড়িয়ায় ফিরলে আবার কী নিশ্চিন্ত জীবন! শান্তিময়। নিরুদ্বেগ। টুকটুক করে কলেজ যাও, ডুবে থাকো বইয়ের পাতায়, ভেবেচিন্তে এগোও গবেষণার কাজে, অনেক রাত অবধি খুনসুটি করো বোনের সঙ্গে, কবিতা লেখা নিয়ে অম্বরদাকে যত খুশি খ্যাপাও। আর মাঝে মাঝে কলকাতায় এলে টুক করে দেখে এসো সেই মানুষটাকে…। ভাবলেই যেন নির্মল বাতাসে ভরে যাচ্ছে বুকটা।
কিন্তু… কিন্তু… কিন্তু…। তাকে পেয়ে মায়ের মুখখানা কী কণামাত্র উজ্জ্বল হবে? এত আশা নিয়ে, লাখ লাখ টাকা খরচ করে, বাপি বিয়েটা দিল…! শান্তভাবে তার ফেরাটাও হয়তো মেনে নেবে বাপি… তবু একটা নীরব যন্ত্রণা কী তাকেও কুরে কুরে খাবে না? ভুল তো আঁচলের নিজের। চোখকান বুজে পাহাড় চূড়া থেকে ঝাঁপ দিয়েছে সে। নীচে জল না পাথর, কিছুই সে দেখেনি। তার দায়ও বাপিকেই বইতে হবে? আবার?
রজনীগন্ধার মালা সরিয়ে আঁচল মাথা রাখল বালিশে। আলো নিভিয়ে দিয়েছে নির্বাণ। ফুলশয্যার ঘরে এখন শুধুই আঁধার।
১৭
আঁধার নেমে গেছে অনেকক্ষণ। দুপুর দুপুরই কলকাতা থেকে রওনা দিয়েছিল অম্বর, তবু কীভাবে যে দেরি হয়ে গেল! জানত, সময়টা এখন ভাল নয়, পথে একটু-আধটু বাধাবিঘ্ন ঘটতেই পারে। তাই বলে এমন পদেপদে বিপত্তি!
মেচেদায় ট্রেন থেকে নেমে অম্বর মোটেই সময় নষ্ট করেনি। চা-সিঙাড়া খেয়েই হাঁচোড়পাচোড় ছুটেছিল বাসস্ট্যান্ডে। উঠলও একখানা কাঁথিমুখো বাসে। কিন্তু লাভটা কী হল! বিশ্রী একটা গুমোট পড়েছে আজ, তারই মধ্যে পাক্কা একঘণ্টা কেঠো সিটে ঠায় বসা, নো নড়নচড়ন। আগের কোনও একটা বাসে নাকি একদল মস্তান উঠেছিল, দু’জন যাত্রীকে তারা জোর-জবরদস্তি নামিয়ে নিয়ে গেছে। প্রতিবাদে চণ্ডীপুর না কোথায় যেন পথ অবরোধ চলছে। তাই এক্ষুনি গাড়ি ছাড়তে সাহস পাচ্ছে না ড্রাইভার-কনডাক্টর।
অবশ্য বেচারাদের খুব একটা দোষ দেওয়া যায় কী? যা একটা বিচ্ছিরি অবস্থা চলছে এখন! পরশু না তার আগের দিন এ লাইনে তিন-তিনখানা বাস জ্বলেছে, দুই রাজনৈতিক দলে লাঠালাঠিও হয়েছে জোর। মারপিটের মধ্যে পড়ে আজও যে দু’-চার পিস পুড়বে না, এমন নিশ্চয়তা আছে? পুলিশও হয়েছে তেমন। কোথায় একটু লাঠিসোটা উঁচিয়ে গিয়ে রাস্তাঘাট পরিষ্কার করে দেবে তা নয়, উলটে কেমন যেন উদাসীন হয়ে গেছে হঠাৎ। ক’দিন আগের চণ্ডীপুরের বড় গোলমালটায় চতুর্দিক থেকে রাশি রাশি গাল খেয়ে কেমন যেন ভেবলে গেছে উর্দিধারীর দল। কোনও মারদাঙ্গাতেই তারা আর সহজে ভিড়তে চাইছে না। বোধহয় খানিক তফাতে থেকে ষাঁড় আর মহিষের লড়াই দেখাটাই এখন তাদের প্রধান কাজ।
অম্বরের তখনই মনে হচ্ছিল ফিরে যায়। কিন্তু বড় কাকা পইপই করে বলে দিয়েছে হাল হকিকত স্বচক্ষে দেখে আসতে, সুতরাং মাঝপথ থেকে প্রত্যাবর্তনটা মোটেই যুক্তিযুক্ত কাজ হবে কী? বিশেষত, হরিনগরের দায়দায়িত্ব অনেকটাই যখন তারই ঘাড়ে। কাকার আস্থার একটু মর্যাদাও সে রাখবে না, অম্বর কি এতটাই অপদার্থ? আরে বাবা, হরিনগরের ব্যবসাটা দাঁড়িয়ে গেলে অম্বরেরও তো এ জন্মের মতো একটা হিল্লে হয়ে যায়, নয় কী? বেশ ক’দিন ধরে শ্যামাপদর সাড়াশব্দ মিলছে না, মোবাইলেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না, আঁচলের বিয়েতেও লোকটা এল না, সুতরাং পরিস্থিতিটা একবার যাচাই করে আসাটা তো তার পরম কর্তব্যও বটে।
এই সব দোটানাতেই আটকে গেল অম্বর। যা হোক, শেষমেশ পাঁচটা নাগাদ শনৈঃশনৈঃ বাস তো ছাড়লও। যাত্রীবোঝাই হয়ে। ছাদেও উপচে পড়ছে মানুষ। কিন্তু এগোচ্ছে শামুকের গতিতে। একটু গিয়েই থেমে যাচ্ছে, থেমেই থাকছে। উলটোদিক থেকে আসা বাস থামিয়ে চলছে দুই কনডাক্টরের গোপন শলা-পরামর্শ, তারপর আবার গাড়িতে স্টার্ট দিচ্ছে ড্রাইভার। গড়াতে গড়াতে অবশেষে যখন চণ্ডীপুরে এল, দিনের আলো মুছে গেছে পুরোপুরি।
চন্ডীপুরে নেমেই অম্বরের মনে হচ্ছিল, গতিক সুবিধের নয়। এই সদাব্যস্ত মোড়টায় একটুও জমজমাট ভাব নেই। আলো, দোকানপাট, মানুষজনে সন্ধের সময়ে জায়গাটা কী গমগম করে, আজ যেন কেমন মিয়োনো চেহারা। বেশির ভাগ দোকানেরই ঝাঁপ বন্ধ, লোকও অস্বাভাবিক রকমের কম। বাতাসেও যেন হালকা বারুদের ঘ্রাণ। রাস্তা অবরোধের সময় কোনও বড়সড় মারামারি হয়েছে নাকি? এখন কি যুদ্ধবিরতি চলছে, আবার একটু পরেই বাঁধবে?
তাড়াতাড়ি হরিনগরে ঢুকে পড়ার মতলবে রিকশা ধরতে গিয়েই অম্বরের চক্ষু ছানাবড়া। স্ট্যান্ড যে ভোঁ-ভাঁ। রাত দশটা সাড়ে দশটা অবধি তো থাকেই রোজ, দল বেঁধে গেল কোথায় আজ? এও কি সংঘর্ষের কারণে?
মোড়ের পানবিড়ির স্টলটা খোলা। প্যাকেটের শেষ সিগারেটখানা ধরিয়ে অম্বর গুটি-গুটি পায়ে গেল দোকানটায়। একখানা একশো টাকার নোট বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “নেভি কাট হবে নাকি?”
মাঝবয়সি লুঙ্গিশার্ট দোকানি পান সাজছিল। চোখ না তুলেই বলল, “ক’টা?”
“পুরো প্যাকেটই দিন।” অম্বর চারদিকের থমথমে ভাবটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করল, “কী ব্যাপার বলুন তো? একটা রিকশাও দেখছি না…?”
“যাবেন কোথায়?”
দোকানি নয়, পাশে দাঁড়ানো অল্পবয়সি ক্রেতাটির কৌতূহল ধেয়ে এল। অযাচিত ভাবে। জিনস কালো টিশার্ট, হাতে মোটরসাইকেলের চাবি, গাঁট্টাগোট্টা ছেলেটির চোয়াড়ে মুখমণ্ডলে অমার্জিত হিংস্রতার আভাস।
এ ধরনের চেহারাপত্রকে একটু এড়িয়ে এড়িয়েই চলে অম্বর। বাঘ সিংহ জ্ঞান করে বলে নয়। মাঝরাতে পথের অচেনা কুকুরকে যে কারণে লোকে সামলেসুমলে চলে, খানিকটা সেই কারণেই।
আলগাভাবে অম্বর বলল, “এই তো, হরিনগর।”
“হরিনগরের কোথায়?”
“পশ্চিমপল্লিতে।”
“পশ্চিমপল্লির কোথায়? কার বাড়িতে?”
ছেলেটার বাচনভঙ্গি মোটেই পছন্দ হচ্ছিল না অম্বরের। কেমন একটা সর্দার সর্দার ভাব ঠিকরোচ্ছে যেন।
অম্বর ফস করে বলে বসল, “পশ্চিমপল্লির সবাইকে চেনেন বুঝি? আপনাকে তো কস্মিনকালে ও তল্লাটে দেখেছি বলে মনে পড়ে না?”
ছোকরার ঠোঁটের কোণে চিলতে হাসি ঝিলিক দিচ্ছিল এতক্ষণ। আচমকাই বদলে গেল তার মুখমণ্ডল। দোকানির হাত থেকে পানের খিলিটা নিয়ে কটকটে চোখে পলক জরিপ করল অম্বরের আপাদমস্তক। তারপরই টেরচা দৃষ্টি হেনে বিচ্ছিরি একটা তাচ্ছিল্যের সুরে দোকানিকে জিজ্ঞেস করল, “মালটা কে বে? চেনো নাকি?”
দোকানি যেন ঈষৎ সন্ত্রস্ত সহসা। ঝটপট বলে উঠল, “হাঁ হ্যাঁ, প্রায়ই দেখি তো।” বলেই অম্বরকে কী যেন ইশারা করল চোখে। ঝটিতি সিগারেটের প্যাকেটখানা অম্বরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে সামান্য গলা চড়িয়ে বলল, “ফালতু কথা বাড়াচ্ছেন কেন, অ্যাঁ? রিকশা দেখতে পাচ্ছেন না, মানে রিকশা নেই? হরিনগর যেতে হলে হাঁটা লাগান।”
দোকানিটি কি তাকে অবিলম্বে কেটে পড়তে বলছে। কেন? সম্ভবত ছোকরাটির মেজাজমর্জি সম্পর্কে তার সম্যক ধারণা আছে এবং সেই কারণেই সাবধান করতে চাইছে অম্বরকে। কিন্তু হরিনগর বেশ দূর, আড়াই-তিন কিলোমিটার তো বটেই। এখনই যাত্রা শুরু করলেও পৌঁছতে সাড়ে আটটা-ন’টা তো বাজবেই। শ্যামাপদকে গিয়ে যদি তখন না পায়? মাঝে মাঝেই তো সে রাতে বাড়ি চলে যায়…। আগে একবার বেশি রাতে হরিনগরে পৌঁছে মহা ঝঞ্ছাট হয়েছিল। শ্যামাপদ বেপাত্তা, মাছ-কারখানার গেটে তালা, অগত্যা রাতদুপুরে ছোটো শ্যামাপদর বাড়ি। সেখানে আরেক সিন। সে তার বড়কুটুমকে নিয়ে মস্তিসে আড্ডা জমিয়েছে, কয়েক পাত্র গিলে শালা-জামাইবাবু দু’জনেরই তখন রীতিমতো টলটলায়মান দশা। আসর থেকে তুলে শ্যামাপদকে দিয়ে কারখানার তালা খোলাতে সেবার কী যে নাজেহাল হয়েছিল অম্বর! সেদিনও শ্যামাপদর মোবাইল অচল ছিল, এবারে তো তার যন্ত্রটি বেশ ক’দিন ধরেই ঘুমোচ্ছে। হরিনগরে গিয়ে আজ কী দৃশ্য দেখবে কে জানে! নাহ, এখন এগোতে হলে একটু ভেবেচিন্তে পা বাড়ানোই ভাল।
দোকানি এবার যেন একটু খিঁচিয়েই উঠল, “হল কী আপনার? দাঁড়িয়ে রইলেন যে বড়?”
“না, মানে… ভাবছি…।” অম্বর চোরাচোখে একবার দেখে নিল ছোকরাকে। কচর-কচর পান চিবোতে-চিবোতে তারই পানে একদৃষ্টে তাকিয়ে। উঁহু তাকিয়ে নেই, মাপছে যেন। অম্বর মুখে একটা কাঁচুমাচু ভাব ফুটিয়ে বলল, “অনেকটা পথ তো… তাই… একটু…”
“অত ভাবাভাবির কী আছে? তা হলে ফিরে যান। এখানে খামোকা খাড়িয়ে থাকার যে কী প্রয়োজন!” দোকানি ঝেঁজে উঠল, “বলিহারি আক্কেল! বোধবুদ্ধি যে এদের কবে হবে…!”
অম্বরের কানে বুঝি জল ঢুকল এতক্ষণে। ছোকরাটি যথেষ্ট বিপজ্জনক, এটাই ঠারেঠোরে বলছে দোকানি। খবরের কাগজে ক’দিন ধরেই দিচ্ছে, এদিকের গোটা অঞ্চলটা নাকি বাইরে থেকে আমদানি করা গুন্ডা বদমাশে ছেয়ে গেছে। এই ছোকরা নির্ঘাত তাদেরই একজন।
পায়ে পায়ে খানিকটা সরে এল অম্বর। আবার সেই দোটানা। এগোবে, না ফিরে যাবে? ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন, অর মার্চ অ্যাহেড? বড়কাকাকে ফোন করবে, না নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে?
আপনাআপনিই হাত ঢুকল পকেটে, বের করল মোবাইল। মনিটরে চোখ পড়তেই বুকটা ছ্যাঁৎ। আজও সেই কেলো, একফোঁটা চার্জ নেই। কেন যে হরিনগরে আসার দিনগুলোতেই অম্বর মোবাইলে চার্জ দিতে ভুলে যায়!
কিন্তু এখন কী করবে সে? নিজেকে ঠাস-ঠাস চড়াতে ইচ্ছে করছিল অম্বরের। যত সে ভাবে এবার থেকে একটি সিদ্ধান্তও আর নিজে নেবে না, ততই যেন সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়টা তার ঘাড়ে চেপে বসে? এবং নিজেরই গোক্ষুরিতে?
মাথা ঠান্ডা করে অম্বর পলক ভাবল। পৌনে আটটা বাজে, এক্ষুনি যদি বাস পায়, তা হলেও মেচেদা পৌঁছতে পৌঁছতে অন্তত সোয়া ন’টা, সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন পেলেও হাওড়ায় এগারোটার আগে ঢোকার কোনও সম্ভাবনা নেই। সেখান থেকে গড়িয়া, মানে আরও কম সে কম একঘণ্টা। তাও যদি গাড়িঘোড়া জোটে। অত গভীর রাতে নিশীথের বাড়ি গিয়ে ডাকাডাকি করাটা কী খুব বুদ্ধিমানের কাজ হবে? এমনিতেই তো বাড়িটায় এখন একটু ঝিমমারা দশা। পরশু আঁচলরা অষ্টমঙ্গলায় এসেছিল, সে ফিরে যাওয়ার পর তো যেন ডবল নিঝ্ঝুম হয়ে গেল বাড়ি। অমন একটা ন্যাতানো পরিস্থিতিতে মাঝরাত্তিরে সক্কলের ঘুম ভাঙানো…?
বড্ড গরম লাগছে। ঘামে প্যাচপ্যাচ করছে গা। সবে চৈত্রমাস পড়েছে, এখনই কী তাত, সন্ধের পরেও একটা গনগনে আঁচ যেন ঠেলে উঠছে মাটি ফুঁড়ে। একখানা সিগারেট বার করে ধরাল অম্বর। দেশলাই কাঠিটা ফেলতে গিয়েই নজরে পড়ল এখনও সেই ছোকরা তাকেই লক্ষ করছে দূর থেকে।
মুহূর্তে অম্বর ইতিকর্তব্য স্থির করে নিল। অকারণে এই সব বজ্জাত চিড়িয়ার কৌতূহল উসকে দিয়ে অশান্তি ডেকে আনার দরকার নেই, চলো হরিনগর।
হনহনিয়ে চণ্ডীপুর বাজারটা পেরিয়ে এল অম্বর। আবার সেই দোলাচল। কাজটা ঠিক হল তো? আজ পর্যন্ত জীবনে নিজের নেওয়া কোন সিদ্ধান্তটা তার ভুল হয়নি? মাধ্যমিকে ফার্স্ট ডিভিশন জুটে গিয়েছিল বলে অমনি মনে হল সায়েন্স পড়বে! কী হাবুডুবু, কী নাকানিচোবানি! কেমিস্ট্রি বইয়ের পাতা খুললেই দু’ চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসে, ফিজ়িক্স মগজের ওপর দিয়ে সাঁইসাঁই উড়ে যাচ্ছে, আর অঙ্ক তো মূর্তিমান বিভীষিকা। ফেলই করার কথা, কীভাবে যে শেষপর্যন্ত এক দাঁড়ি মিলল অম্বরের কাছে তা এখনও বিস্ময়। তারপরও কলেজে কিনা কেমিস্ট্রিতে অনার্স নিল? পাশ করলেই নাকি কেমিস্টের চাকরি বাঁধা! কোত্থেকে যে এমন উদ্ভট ধারণাটা গজিয়েছিল!
তারপরও কী গলতি কম করেছে? স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় বসলই না। কেন? না, দিনভর মাদুরপাতা মেজকাকাকে দেখে তার নাকি স্কুলের চাকরিতে ঘেন্না ধরে গেছে, অমন একটা কুয়োর ব্যাং সে কিছুতেই বনবে না! অথচ তার বি এসসি-র রেজাল্ট এমনই খাজা, বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডর দিয়েও তাকে হাঁটতে দেবে না কোনও দিন। কোনও অগাবগা কোম্পানিতেও কেমিস্টের চাকরি তো দূরস্থান, ইন্টারভিউতে পর্যন্ত ডাক পাবে না অম্বর। অথচ হাত-পা ছড়িয়ে ঘরে শুয়েবসে না থেকে এক-দু’ বছর কোমর বেঁধে লড়ে গেলে একটা মাস্টারি কি সে জোটাতে পারত না? মনটাকে একটু মানিয়ে-গুনিয়ে নিতে পারলেই তো দিব্যি একটা সুস্থির জীবন। বাড়তি টাকার লোভ না করলে শান্তিই শান্তি। কত ঠান্ডা মাথায় কবিতা লিখতে পারত সে এখন! তার বদলে এই রাত্তিরবেলায় তাকে কিনা ছুটতে হচ্ছে এক শ্বাপদসংকুল অরণ্যে, যার পোশাকি নাম হরিনগর! ওফ, অসহ্য! ভাবলেই কান্না পায়।
রানিগড় ছেড়ে কলকাতা আসাটাও কি উচিত হয়েছে? এক এক সময়ে তো মনে হয় ওটাই বোধহয় অম্বরের সবচেয়ে বড় ভুল। দিব্যি তো নিস্তরঙ্গ জীবন কাটছিল। নিজেদের লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে হই-চই, নিয়মিত কবিতা লেখা… টিউশনিও তো আসছিল অল্পবিস্তর। না হয় বাবার মতোই মাজরাপোকা ধসারোগ ইউরিয়া ফসফেট নাইট্রোজেন ঘেঁটে ঘেঁটেই চলে যেত জীবনটা। তিন কাকার কেউই তো চাষবাসে নেই, জমিজিরেতের কাজটা নয় অম্বরই তুলে নিত কাঁধে। বাবা একটু বড়কাকার কাছে ঘ্যানঘ্যান করল, অমনি বড়কাকা পিঠ চাপড়ে বলল, “চল রে ব্যাটা, কলকাতায় বিজনেসে তুই হবি আমার রাইট হ্যান্ড…” ব্যস, অম্বরও সুড়সুড় করে চলে এল? কলকাতায় অম্বরের কী মোক্ষলাভ হয়েছে, অ্যাঁ? স্বাধীনতা তো গেছেই, গৃহভৃত্য আর অফিস কর্মচারীর মাঝামাঝি একটা অবস্থানে ত্রিশঙ্কু হয়ে ঝুলছে সে। কবিতা লেখার অবসরটুকু পর্যন্ত চৌপাট হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। একমাত্র সান্ত্বনা ছিল, আঁচলের অন্তত কাছাকাছি আছে, এখন তো সেটুকুও নেই।
আঁচলের কথা মনে হতেই অম্বরের বুকটা হঠাৎ ছলাৎ। একরাশ হিমেল হাওয়া যেন ঝাপটা মারল গায়ে।
আহ, মুখটা স্মরণ করতেই শরীরের তাপ যেন জুড়িয়ে গেল গো!
পরক্ষণেই ভুল ভেঙেছে। নাহ, আঁচল নয়, প্রকৃতি ঠান্ডা বাতাস পাঠাচ্ছে আচমকা। সোঁ-সোঁ আওয়াজ উঠছে, শুকনো পাতারা পাগলের মতো ছোটাছুটি করছে এলোমেলো। আরও জোরে ধাক্কা মারল হাওয়া। আরও জোরে। চোখ নাক মুখে বিঁধে যাচ্ছে ধুলোবালি। কালবৈশাখী এল।
ঝড়ের আকস্মিকতায় অম্বর ক্ষণিকের জন্য দিশেহারা। মুখের সামনে দু’ হাত মেলে, ধুলোর তাণ্ডব ঠেকাতে ঠেকাতে এগোচ্ছিল কোনও মতে। বেশিদূর যেতে পারল না। মার্বেলের মতো বড় বড় দানা নেমে আসছে আকাশ থেকে, মাথায় পড়ে ছেতরে যাচ্ছে। দ্যাখ না দ্যাখ, ঝমঝমিয়ে শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি।
সরু পিচরাস্তা ধরে উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়ল অম্বর। আশ্রয়ও পেয়ে গেছে কপালজোরে। পথের ধারেই সিমেন্টের খাঁচায় টিনের চাল বসানো একটা আধ পুরনো ঘর, বোধহয় মুদিখানার সামনে একটু দাওয়া, সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়েছে কুঁকড়ে-মুকড়ে। ছাটে ভিজে যাচ্ছে বটে, তবে মাথাটি তো রক্ষে পেয়েছে।
আর একজনও ঠাঁই নিয়েছে দাওয়ায়। সাইকেল সমেত। সাইকেলের পিছনে প্রকাণ্ড দু’খানা ফাঁকা ঝুড়ি আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা।
বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল ঘনঘন। আকাশের চকিত আলোয় লুঙ্গি হাফপাঞ্জাবি ছাগলদাড়ি আধবুড়ো লোকটাকে চেনা চেনা ঠেকল অম্বরের। হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। বড়কাকার ফিশারির পিছনভাগের জমিতে সবজি চাষ করে। মুলো, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, উচ্ছে, ঝিঙে, কাঁচালঙ্কা কিছুই বাদ দেয় না। নিজের খেতের ওপারে বাড়ি লোকটার, নাম শেখ ইয়াসিন।
বিকট আওয়াজ হল একখানা। বোধহয় কাছেপিঠে কোথাও বাজ পড়ল। শব্দের রেশ মেশানোর আগেই আবার একটা। থামতে না থামতেই ফের পিলে চমকানো ধ্বনি।
আকাশের গুড়গুড়-গুড়গুড় যেন আর থামছেই না, বজ্রপাতও হচ্ছে মুহুর্মুহু।
অম্বর আপনমনে বিড়বিড় করল, “সৃষ্টির আজই শেষ। প্রলয়ের দিন বোধহয় এসে গেল।”
ইয়াসিনও তক্ষুনি বলে উঠল, “শুধুমুদু ভয় পাচ্ছেন গো বাবুমশায়। আকাশ যতটা গর্জায়, ততটাই কি বর্ষায়?”
“আজ এ বৃষ্টি থামবে না ইয়াসিনদাদা। যা মুষলধারে পড়ছে…”
“মুষল ধারায় ঢালতেছে বলেই তো ত্যাড়াতাড়ি ধরে যাবে। পিটির-পিটির চললেই বরং ভাবনা ছিল। অনেক রাত অবধি ভোগাত।”
“ভরসা দিচ্ছেন তা হলে?” চুলে আঙুল চালাতে-চালাতে অম্বর হেসে ফেলল। ঠাট্টার সুরে বলল, “আজই তা হলে কয়ামত আসছে না?”
“কয়ামত যে সত্যি সত্যি কবে আসবে সে কী খোদাতালাও জানেন?” ইয়াসিনও হাসছে, “আমরা মানুষরাই তো কয়ামতকে ডেকে আনি।”
“বটে?”
“হ্যাঁ গো বাবুমশাই। পাপের ঘড়া পূর্ণ হলে আপনাআপনিই কয়ামতের দিন ঘনিয়ে আসে।”
“বেড়ে বলেছেন তো।” অম্বর খুকখুক হাসল, “তা এখন কোত্থেকে আসা হচ্ছে? ফাঁকা ঝুড়ি নিয়ে?”
“হেড়িয়ার হাটে গেছিলাম গো। মাচার শশাগুলো গস্ত করে এলাম।” বলে ইয়াসিন একটুক্ষণ থেমে রইল। তারপর হঠাৎ একটু গলা নামিয়ে বলল, “তা আপনি আজ এদিকপানে? শ্যামাপদর খবর পেয়েই আসছেন বুঝি?”
“খবর? কই না তো।” জোর চমকেছে অম্বর। অস্ফুটে বলল, “ইন ফ্যাক্ট, ওর কোনও খবর পাচ্ছি না বলেই তো কলকাতা থেকে ছুটতে ছুটতে…”
“ও, কিছুই জানেন না তা হলে?”
“না। কী হয়েছে শ্যামাপদর?”
ইয়াসিন দু’-এক সেকেন্ড কী ভাবল যেন। তারপর পায়ে পায়ে অম্বরের কাছে এসে একটু তাকাল এদিক ওদিক। বৃষ্টির একটানা ঝমঝম সত্ত্বেও প্রায় ফিসফিস করে বলল, “আজ ভোরে তো শ্যামাপদর লাশ মিলেছে।”
অম্বরের গলা দিয়ে চিত্কার ঠিকরে এল, “লাশ?”
“হ্যাঁ, গো বাবুমশাই। খালের জলে। বোধহয় জোয়ারের সময় নদীর স্রোতে ভেসে এসেছে।”
“সে কী! শ্যামাপদ খুন!” অম্বরের প্রায় বাকরোধ হওয়ার দশা। ফ্যাসফেসে গলায় বলল, “কে মারল? কেন মারল? কবে মারল?”
“অতশত কী করে জানব বাবুমশাই?” ইয়াসিন একটুক্ষণ গোঁজমুখে দাঁড়িয়ে রইল। কী ভেবে ফের মুখ খুলেছে, “আমার কথা ধরবেন না… তবে উড়ো কথা যা শুনতে পাই… শ্যামাপদ তো ভূমিরক্ষা কমিটির নেতা ছিল… লালপার্টির বাবুরা নাকি পঞ্চায়েত ভোটে হারার পর থেকেই তাল করছিল শ্যামাকে নিকেশ করার… ওই যেদিন গুলিগোলা চলল, তার দু’দিন আগেই নাকি ওকে উঠিয়ে নিয়ে গেছিল মালক্ষ্মী ইটভাটায়… তারপর তো এই অ্যাদ্দিনে তার সন্ধান মিলল।”
“একেবারে মেরেই ফেলল লোকটাকে। এখনও যেন প্রত্যয় হচ্ছিল না অম্বরের। অবিশ্বাসের সুরে বলল, “একটা সাদামাঠা লোক, সংসারি মানুষ, আমোদ-টামোদ করে…”
“অত সাধারণ ওকে ভাববেন না বাবুমশাই। শ্যামার খুব জোশ ছিল। এমন বক্তৃতা দিত, খুন গরম হয়ে যেত সব্বার। তা ছাড়া বলতে নেই… লালপার্টির বাবুদের এখন পাগলা কুকুরের দশা। মাথার ঠিক নেই। যাকে তাকে যখন তখন কামড়াচ্ছে… হিত-অহিত জ্ঞানটাই পুরো লোপ পেয়ে গেল গো। আপনাদের কী একটা কথা আছে না, মরণকালে বুদ্ধিনাশ, এ হল গিয়ে সেই…। দ্যাখেন না, এবার লোকসভা ভোটে এরা ছারেখারে যাবে।”
রাজনীতি থেকে চিরটাকাল শতহস্ত দূরে থেকেছে অম্বর। তবে সে তো ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না। চোখকানও তার খোলাই আছে। দেখছে তো পথেঘাটে, লোকজন কী ভয়ানক খেপে গেছে এই সরকারের ওপর। বিশেষত চাষিরা। এত বচ্ছর কলকারখানায় ঝান্ডা উড়িয়ে হঠাৎ এদের শিল্পের বাই চেপেছে, তার জন্য নিজেদের এতকালের নীতিফীতি ভুলে ডান্ডার জোরে সব্বাইকে ঠান্ডা করতে চাইছে, শহরের মানুষরাও এটাকে মোটেই ভাল চোখে দেখছে না। তা ছাড়া এমনিতেই তো এরা পার্টিকে এমন ভাবে সর্বত্র চারিয়ে দিয়েছে, খাস নিজেদের লোক না হলে পিয়োন-বেয়ারার চাকরি মেলাও মুশকিল। সাধে কী গত হপ্তায় অত বড় মিছিল হল কলকাতায়!
আঁচলের বউভাতের পর ক’দিন একটু ফাঁক মিলেছিল, তখন অম্বরও টুকুস করে চলে গিয়েছিল সেই মিছিলে। দেখছিল, কত নামজাদা সব শিল্পী-সাহিতিক-কবি-নাট্যকার-গাইয়ে-বাজিয়ে জড়ো হয়েছে একসঙ্গে। বছর দেড়েক আগে নাকি সবাই মিলে আরও বড় একটা মিছিল করে এই সরকারকে ধিক্কার জানিয়েছিল। আশ্চর্য, তারপরও এদের হুঁশ ফেরেনি, উলটে সব্বাইকে এখন শত্রু ভাবছে! আজ শ্যামাপদকে মারল, কাল হয়তো এই শেখ ইয়াসিনকেই কোতল করবে। অথচ এরাই না একসময়ে ছিল পার্টির মূল বল ভরসা! ঝান্ডা উঁচিয়ে এরাই না জান কবুল করত! এখন এদের জান নিয়েই ছিনিমিনি! ইয়াসিনের গলার এমন বাঁকা সুর কীসের লক্ষণ! নরেশ বেরাও মোটেই সুবিধের লোক নয়, ধান্দাবাজিতেও ওস্তাদ, কিন্তু খড়কুটো ভেবে ওদেরই হয়তো এবার আঁকড়ে ধরবে ইয়াসিনরা। মানুষের বিশ্বাস ভেঙে গেলে ভালমন্দর বাছবিছারও কি নষ্ট হয়ে যায় না?
এই জন্যই বোধহয় ছোটকাকাকে এবার এত মনমরা দেখাচ্ছিল। বিয়ে-থা করেনি, পার্টিই মানুষটার ধ্যানজ্ঞান, সর্বদাই একটা উত্তেজনায় টগবগ ফুটত, নিজে কখনও কোনও সুযোগ-সুবিধের প্রত্যাশী ছিল না, এখন যেন কেমন দ্বিধায় ভুগছে সারাক্ষণ। আঁচলের বিয়ের হইহুল্লোড়ও যেন উপভোগ করল না, বউভাতের আগেই তড়িঘড়ি ফিরে গেল রানিগড়। পায়ের নীচে মেদিনী কাঁপছে বলেই কি…?
বৃষ্টির তোড় কমেছে। হাত বাড়িয়ে ধারাপাতের তীব্রতা পরখ করল ইয়াসিন। টানছে সাইকেলটা। অম্বরকে বলল, “তা হলে চলি গো বাবুমশাই।”
অম্বর মৃদুগলায় বলল, “হুঁ।”
“আপনে কি এখন ফিশারিতে যাবেন? শ্যামা তো নেই, আপনার কাছে চাবিপত্র আছে তো?”
অম্বর ভাঙল না। জবাব না পেয়ে ইয়াসিন কী আন্দাজ করল কে জানে, কোমরের গামছা মাথায় ছড়িয়ে বলল, “সাবধানে থাকবেন কিন্তু। রাতে কেউ ডাকলে হুট করে বেরোবেন না। বাইক-টাইক ঘুরছে খুব, ওরা কেউ এলে দরজায় খিল এঁটে বসে থাকবেন।”
এবারও অম্বর চুপ। চলে গেল ইয়াসিন। আস্তে আস্তে রাস্তায় এল অম্বর। আর তো কলকাতা ফেরারও উপায় নেই, এখন কী করবে সে? চণ্ডীপুরের দিকেই যাবে আবার।
যদি সেই বজ্জাতটার সঙ্গে ফের মোলাকাত হয়ে যায়?
এত রাতে তাকে পেলে একেবারে নিরামিষ আপ্যায়ন করবে কী?
যদি সটান কমণ্ডলুর সম্পাদকের বাড়ি গিয়ে হাজির হয়? প্রবীর ভুঁইয়া লোকটা মন্দ নয়, প্রত্যক্ষ রাজনীতিও করে না, শুধু একটু বকে বেশি এই যা সমস্যা। এত রাতে তাকে দেখে হরিনগর হাই স্কুলের ভুগোলস্যারটি চমকাবে জোর, হয়তো শান্তিতে ঘুমোতেও দেবে না, তবে মাথার ওপর ছাদ তো একটা মিলবে। একেবারে হরিমটরেও থাকতে হবে না সম্ভবত।
‘জয় মা’ বলে আবার হন্টন শুরু। একটু জোরেই পা চালাচ্ছিল অম্বর। প্রবল গর্জন তুলে ছুটে গেল একটা মোটরসাইকেল, রাস্তার জমা জল ছিটকে এল জামায়। মুখ দিয়ে গালাগাল প্রায় বেরিয়ে যাচ্ছিল, ইয়াসিনের সতর্কবাণী মনে পড়তেই অমনি সামলে নিল নিজেকে। আবার হাঁটছে। বেজার মুখে। সামান্য একটা আশ্রয়ের আশায়।
এমনই বিশ্রী সময়ে হঠাৎ আঁচলকে মনে পড়ল। এবং সেই সঙ্গে নির্বাণকেও। কেন যে এখনই…! নিশ্চয়ই দু’জনে এখন গ্যাংটকে। রাজসিক কোনও হোটেলের নিভৃতকক্ষে আঁচলকে সোহাগের কথা শোনাচ্ছে নির্বাণ! কিংবা… কিংবা… আঁচলকে নিয়ে নির্বাণ…
উফ, একেই বুঝি বলে কপাল! কারুর সুখ থই-থই, কারুর বা বগলে মই! এহেন এক কল্পদৃশ্যেও অম্বরের চিত্তে ঈর্ষা জাগবে না, অম্বর কী এতটাই জিতেন্দ্রিয়! তা হলে নপুংসকের সঙ্গে তার পার্থক্য কোথায়!
১৮
নির্বাণ উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে হাঁটছিল। শহরের মধ্যিখানের চওড়া রাস্তাখানি ধরে। দু’পাশে অজস্র ঝাঁ চকচকে দোকান। নামী দামি দেশি বিদেশি ব্র্যান্ডের চোখধাঁধানো উজ্জ্বল সাইনবোর্ড। নানা কিসিমের ট্যুরিস্টের সমাগমে এতক্ষণ থইথই করছিল চক মতন জায়গাটা, এবার যেন ফাঁকা হচ্ছে ক্রমশ। মনোহারি পশরায় ভরা শপিং উইনডোগুলো চলে যাচ্ছে শাটারের অন্তরালে। শুধু লিকারের ঠেকেই যা ভিড় কমেনি এখনও। ফুর্তি করতে এলে ওই বস্তুটির চাহিদা খুব বেড়ে যায় কিনা। বিশেষত গ্যাংটকের মতো এমন রংদার শৈলনগরীতে।
দাঁড়িয়ে পড়ল নির্বাণ। সিকিমিজ় রামের খুব নাম শোনা যায়, আজ চেখে দেখবে নাকি? মদে তার প্রবল আসক্তি আছে এমন নয়, বরুণদের পাল্লায় পড়ে খেত কখনও-সখনও। মহুয়াকে নিয়ে এদিক-সেদিক কোথাও গেলে তখন পান করে অল্পস্বল্প। নইলে মহুয়ার সঙ্গে জমে না যে। দু’জনেই চুকুর-চুকুর চুমুক মারবে, দু’জোড়া আঁখিই বেশ ঢুলুঢুলু হয়ে আসবে, তবেই না বেশ রসে টুসটুস হয়ে উঠবে পরিবেশটা।
তবে হ্যাঁ, নেশাটিকে নির্বাণ সেভাবে রক্তে গেঁড়ে বসতে দেয়নি। বাবা প্রায়ই বেহেড হয়ে বাড়ি ফিরে নানান অনর্থ বাঁধাত, সেই স্মৃতিই কী তাকে সতর্ক করেছে? নাকি দৃষ্টিকটু দশায় হের মমের মুখোমুখি পড়ে যাবে সেই আশঙ্কায়? যদিও স্বামীকে দেখেও মদ্যপানে বিদিশাদেবীর মোটেই বিদ্বেষ জন্মায়নি, বরং নিজের কাবার্ডে দু’-চারটে মহার্ঘ সুরার বোতল সাজিয়েই রাখে। উজির নাজির গোছের কেউ বাড়িতে এলে সেই পানীয় পরিবেশনও হয়। তাই বলে নিজের অপদার্থ ছেলেটির ঘরে বসে ঢুকুঢুকু, অথবা মাল টেনে পেঁচো মাতালটি হয়ে ফেরা, দুটোর কোনওটাই তার বরদাস্ত নাও হতে পারে। না সে প্রতিভাধর, ক্ষমতাধর তো নয়ই, বিদিশা চৌধুরী তার বেচালপনা কেনই বা সহ্য করবে?
নির্বাণ অবশ্য মাকে পরখ করে দেখেনি কখনও। সাহসেই কুলোয় না যে। তবে আজ তো এক-দু’ পেগ চড়ানোই যায়। এই হিম হিম গ্যাংটকে একটু ঝিমঝিম ভাব আনলে ক্ষতি কী?
আঁচল কিছু মনে করবে? তার আর্টিস্ট বাবাটি তো নির্ঘাৎ মদের পিপে। ব্যবসায়ী পিতৃদেবও কি একেবারেই টানুস-টুনুস করে না? সুতরাং বিদিশাদেবীর আদরের পুত্রবধূটির গোঁড়া শুচিবাই থাকার কথা নয়। আর থাকলেই বা নির্বাণের কী? নিজেকে মহৎ প্রতিপন্ন করতে নির্বাণের ভারী দায় পড়েছে। গত দশ দিনে নিশ্চয়ই এই পতিবরটি সম্পর্কে আঁচলের কোনও উচ্চ ধারণা জন্মায়নি। না হয় সে আঁচলের চোখে আর এক ধাপ নামবে। আরে বাবা, মেয়েটা যদি তাকে ঠিকমতো ঘেন্না করতে পারে, নির্বাণ তো বেঁচে যায়!
কিন্তু তাকে নিয়ে কী ভাবছে আঁচল? আদৌ কিছু ভাবছে কি? বোঝা দায়, বোঝা দায়। তেমন কোনও প্রতিক্রিয়াই তো ফোটে না ও মেয়ের চোখেমুখে। গত দশ-এগারো দিন ধরে কম বিসদৃশ আচরণ তো করল না নির্বাণ। বাক্যালাপ তো প্রায় হচ্ছেই না, আদর-সোহাগ তো দূরস্থান, মেয়েটাকে তো সে ছুঁয়েও দেখল না। ফুলশয্যার পরদিনই নির্বাণ অফিসে জয়েন করে গেল, বাড়ি ফিরেও নো টক, যা ইচ্ছে টিভি প্রোগ্রাম চালিয়ে দিচ্ছে গাঁকগাঁক করে… কোনও কিছুতেই যেন আঁচলের তাপ উত্তাপ নেই। হয় নীচে গিয়ে মনিকাকা কিংবা অনিমা কারওর না কারওর সঙ্গে গল্প জুড়ে দিচ্ছে। আর নয়তো বা ওই ঝিংঝাং আওয়াজ কানে নিয়েই কোনও একটা কেতাব মুখে বিছানায় আধশোওয়া। রাতেও দিব্যি দেওয়ালমুখো হয়ে ঘুমিয়েও পড়ছে অনায়াসে। পাশে নির্বাণ এল কী এল না, ঘরে নির্বাণ আছে কী নেই, তা নিয়ে যেন কণামাত্র ভাবিত নয়। রাতে এক-আধবার ঘুম ভেঙে যায় নির্বাণের, তখনও সে লক্ষ করেছে, ভারী নিশ্চিন্ত নিদ্রায় ডুবে আছে আঁচল।
আশ্চর্য, কী করে যে পারে! বালিশে মাথা রাখা শান্তশিষ্ট মেয়েটা নতুন বউ, না বিশ-পঁচিশ বছরের পুরনো এক পোড়খাওয়া গিন্নি, ঠাহর করাই যে মুশকিল হয় তখন।
সকালের জলখাবার কিংবা রাতের আহারটা কিন্তু এ বাড়ির নিয়মমতো একসঙ্গেই সারছে আঁচল। তখনও একেবারেই স্বাভাবিক গলায় নির্বাণকে জিজ্ঞেস করছে, সে আর রুটি নেবে কিনা, কিংবা স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতেই এগিয়ে দিচ্ছে ডালের বাটি, না বলতেই নুন-গোলমরিচ ছড়িয়ে দেয় ওমলেটে। নৈশাহারে বিদিশাদেবী তো মজুত থাকেনই, তাঁর কথা বলার সময় ঠোঁটের কোণে ভারী নিখুঁত একফালি হাসি ধরাই থাকে আঁচলের। মা আজকাল ডিনার টেবিলে বড় বেশি বকছে। কলেজের গপ্পো, বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটের নানান কিস্সা, অধ্যক্ষদের সমিতির খুচখাচ উপাখ্যান…। সব কাহিনির অবশ্য একটাই লক্ষ্য। বাইরের জগতে নিজের কতখানি প্রতাপ, সুকৌশলে জাহির করা। তখন আঁচলকে দেখে মনে হয়, ভক্ত প্রহ্লাদটি হয়ে শাশুড়ির অমৃতবচন গভীর মনোযোগে শুনছে সে। টুকটাক প্রশ্নও করে দু’-একটা, মা যেন তাতে আরও জোশ পেয়ে যায়, দ্বিগুণ উদ্যমে আরও বকে চলে। একা একাই।
অষ্টমঙ্গলার দিন বাপের বাড়ি গিয়েও তো পরিপূর্ণ স্বাভাবিক। বিয়ের পরপরই প্রথমবার পিতৃগৃহে পা রাখলে একটি সদ্য পরিণীতা মেয়েকে যেমনটি দেখানো উচিত, আঁচলকে কি ঠিক তেমনই লাগছিল না? একটু লাজুক-লাজুক, আবার যেন হাসিখুশি ভাবটাও বেশ বজায় আছে…। বাচাল বোনটা তো কত কী হুটুর-পাটুর টিপ্পনি কাটল, আঁচলের স্মিত মুখখানায় একটাও কি ভাঙচুর হয়েছিল? না, অন্তত নির্বাণের তো চোখে পড়েনি। উলটে নির্বাণকে নিয়ে বোনের উত্কট রসিকতাও উপভোগ করছিল যেন। মা-বাপির সঙ্গেও এমন স্বচ্ছন্দ সুরে কথা চালাচ্ছিল, যেন এক পরিপাটি সংসারে মসৃণভাবে মিশে গেছে সে। মাত্র ক’দিনেই।
আচ্ছা এমন নয়তো, বিয়ের পর জীবনটা খানিক খাপছাড়া হবে জেনেশুনেই ছাদনাতলায় এসেছিল আঁচল? নাকি নির্বাণের অভব্যতাকে সে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনতে চায় না? নিজের মতো করে নিজের মধ্যে ডুবে থেকেই সে তৃপ্ত। নাকি আঁচলের এই অচঞ্চল রূপ নেহাতই অভিনয়? উপেক্ষার এক অতি সূক্ষ্ম বর্ম পরে নিয়ে ভাবছে, এভাবেই চাপ সৃষ্টি করা যাবে নির্বাণের ওপর? অবশ্য চাপটা যে কী অথবা কেন, তা ঠাহর করা বেশ মুশকিল।
এই সবই এতাল-বেতাল ভাবতে-ভাবতে কখন যে মদের দোকানের কাউন্টারে পৌঁছে গেছে নির্বাণ। বোতলখানা কাগজে মুড়ে বেরিয়ে এল দোকান ছেড়ে। ঘড়ি দেখল। ন’টা বাজে প্রায়। এম জি রোডে অনেক তো চক্কর কাটা হল, এবার যে রুমে ফিরতেই হয়।
হোটেলটা খানিক ওপরে। রাজপথ ছেড়ে চড়াই ধরল নির্বাণ। হাঁটতে হাঁটতেই হাসি পেয়ে গেল হঠাৎ। ওফ, হানিমুন একটা চলছে বটে! গতকাল নিউ জলপাইগুড়ি নেমেই একটা গাড়ি নিয়েছিল, তবু গ্যাংটক পৌঁছতে প্রায় সন্ধে হয়ে গেল। কপালে গেরো থাকলে যা হয়! পরশু নাকি সিকিমে জোর বৃষ্টি হয়েছিল। চৈত্রের গোড়ায় অকালবর্ষণ বোধহয় পছন্দ হয়নি পাহাড়ের, আচমকা ধস নেমেছিল রাস্তায়। পাক্কা কুড়ি-বাইশ ঘণ্টা বন্ধ ছিল সড়ক। নির্বাণরা যখন তিস্তাবাজার পেরোল, তখনও সেই রংপো পর্যন্ত কাতারে-কাতারে ট্রাক-জিপ-বাস দাঁড়িয়ে, নির্বাণ তো তখনই কায়মনোবাক্যে চাইছিল রাস্তা যেন না খোলে। তা হলে নির্বিবাদে হনিমুন শিকেয় তুলে ফেরার ধান্দা করতে পারে। প্রস্তাবটা হয়তো আঁচলকে পেড়েও বসত, কিন্তু তখনই একটা-একটা করে গাড়ি ছাড়তে শুরু করল যে! ঢিকুর-ঢিকুর করে গ্যাংটকে ঢুকতে গোটা দিনটাই কাবার। যেতে-যেতেই মনস্থ করে নিয়েছিল, গ্যাংটকে হোটেলে ঢুকেই বডি ফেলে দেবে, রুম থেকে আর নড়বেই না, শুয়ে-বসে-খেয়ে-ঘুমিয়ে পার করে দেবে দু’-তিনটে দিন। তাই বা হল কই? রাত্তিরে খাওয়ার সময় কী যে মতিভ্রম হল, নিছক ভদ্রতা করে আঁচলকে শুধিয়ে বসল, কাল লোকাল সাইট-সিইং-এ যাবে কিনা? অবশ্য নির্বাণ কি জানত, এক কথায় ঢক করে ঘাড় নেড়ে দেবে আঁচল? আর কী, নিজের গোক্ষুরির সাজা ভোগ করো, আঁচলের লেজুড় হয়ে টোটো করো ঘোরো সারাদিন। আঁচলের জ্ঞানপিপাসারও বলিহারি যাই। রুমটেক গুম্ফা, চোগিয়ালের প্রাসাদ, মিউজিয়ম, যেখানেই পা দিচ্ছে সেখানেই ফেভিকল হয়ে সেঁটে যাচ্ছে। কী জ্বালা! শেষমেশ ফিরে হোটেলে ঢুকিয়ে দিয়ে তবে না শান্তি!
তাও তো প্রায় দু’-আড়াই ঘণ্টা হয়ে গেল! এতক্ষণ মেয়েটা ঘরে একা-একা… সঙ্গে নিয়ে বেরোলে হয়তো একটু শপিং-ফপিং করত! মনে মনে শাপ-শাপান্ত করছে কিনা তাই বা কে জানে! হাজার হোক, মধুচন্দ্রিমা বলে কথা! হোক না সে চাঁদ পোকায় কাটা!
হোটেলের গেটে এসে একটু দম নিল নির্বাণ। ঝলক দেখল বহিরঙ্গের খোলতাই রূপ। আঁচলের দৌলতেই বোধহয় এমন ঘ্যামচ্যাক হোটেলে থাকার সৌভাগ্য হয়ে গেল নির্বাণের। বুকিংয়ের কাগজের সঙ্গে করকরে পঞ্চাশ হাজার টাকা নির্বাণের হাতে মা গুঁজে দিচ্ছে, তাও কিনা মাত্র দিন তিনেকের বেড়ানোর জন্য, ভাবা যায়! মা নিশ্চয়ই পুত্রবধূটিকে শুনিয়ে দিয়েছে, ভ্রমণের যাবতীয় খরচ তাঁর তহবিল থেকেই ব্যয়িত হবে? ছেলের বউয়ের চোখে নিজের ভাবমূর্তি আরও এক পোঁচ উজ্জ্বল হল নির্ঘাত। ছেলে হয়তো বউয়ের চোখে দু’ পোঁচ মলিন হবে। তা হোক গে, বিদিশাদেবীর তাতে কীই বা আসে যায়!
ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে ঝকঝকে দারুণ সাজানো-গোছানো লাউঞ্জটা পেরোল নির্বাণ। সিঁড়ি নয়, লিফট ধরে এল দোতলায়। বেরিয়েই সিনেমার বাহারি হোটেলগুলোর মতো টানা লম্বা করিডর, একেবারে শেষপ্রান্তে তাদের স্যুট। কাল এসেছে বটে, তবে এখনও রইস পরিমণ্ডলটা যেন মগজে সেঁধোয়নি পুরোপুরি। মা যে ছেলে-ছেলের বউয়ের জন্য এমন পাঁচতারা স্বাচ্ছন্দ্যের বন্দোবস্ত করল, নিজেও কাজেকম্মে হিল্লি-দিল্লি গেলে এরকমই কেতায় থাকে নিশ্চয়ই? নাহ, নির্বাণের মা এখন সত্যিই অনেক হাই-ফাই জগতে চলে গেছে। শুধু কলোনিবাসী নিজের আত্মীয়দেরই নয়, বালিগঞ্জীয় শ্বশুরকুলকেও ছাপিয়ে বিদিশা চৌধুরী এখন ঢের ঢের উঁচুতে।
দরজায় এসে বেল বাজাতেই আঁচল পাল্লা খুলে দাঁড়িয়েছে। বাইরের পোশাক বদলে এখন তার পরনে নাইটি হাউসকোট। নির্বাণকে দেখে আবার ফিরে যাচ্ছে ধীর পায়ে। কোণের চেয়ারটেবিলে বসে কী একটা বুঝি লিখছিল ডায়েরিতে, আবার গিয়ে মন দিয়েছে কাজে।
আহ স্বস্তি! এই বিদ্যেবতী দোকানপাটে ঘুরে আনন্দ পেত বলে মনে হয় না, চার দেওয়ালের অন্দরেই বুঝি এর বেশি সুখ। আধুনিক প্যাটার্নের ছিমছাম সোফাসেট সুসজ্জিতকক্ষে মজুত, কাচবসানো সুদৃশ্য সেন্টার টেবিলে বোতলটা রাখল নির্বাণ। সামান্য গলা উঠিয়ে বলল, “কিছু খেয়েছ সন্ধেবেলায়?”
“না।” আঁচলের সংক্ষিপ্ত জবাব।
“চা-কফিও খাওনি?”
“শুধু এক কাপ চা।”
“কেন?” নির্বাণ একটু রক্ষণাত্মক সুরে বলল, “বেয়ারাকে অর্ডার দিলেই হত। সঙ্গে কিছু নিলেই পারতে।”
সাড়াশব্দ নেই। মাথা নামিয়ে কলম চালাচ্ছে আঁচল। তার এই নিশ্চুপ থাকাটাই ভারী অস্বস্তিতে ফেলে নির্বাণকে। জোর করেই অল্প লঘু সুর ফোটাল, “কী লিখে চলেছ এত মনোযোগ দিয়ে?”
“আজ যা যা দেখলাম।”
“যখন যেখানে যা দেখো, সব লিখে রাখো নাকি?”
জবাব নেই।
“বেড়িয়ে আজ ভাল লাগল?”
কোনও উত্তরই এল না। এবার যেন একটু বিরক্ত বোধ করল নির্বাণ। স্বরে আবছা অপ্রসন্নভাব বেরিয়েই এল, “ঘরে থাকলে হয় লেখা নয়তো পড়া… ভাল লাগে সারাক্ষণ?”
ঘাড় বেঁকিয়ে তাকাল আঁচল। শান্ত শীতল চোখে। কণামাত্র অসন্তোষ নেই, ক্রোধ নেই, তবু কী যেন একটা আছে। বেশিক্ষণ ওই চোখে চোখ রাখা যায় না, আপনা আপনিই নেমে আসে দৃষ্টি, আচমকা ধড়াস করে ওঠে বুক।
বুঝি নাড়ির গতি সমে আনতেই নির্বাণ হাত বাড়িয়ে টানল বোতলটা। কাগজের মোড়ক খুলছে দেখিয়ে দেখিয়ে। ভুরু বেঁকিয়ে আঁচলকে বলল, “খাবে নাকি?”
“না। আঁচলের স্বরে কোনও ওঠাপড়া নেই, “আমার চলে না।”
“আমারও কি চলে নাকি? বাইরে এসেছি বলেই না… জাস্ট মস্তি…”
“সরি। আমি ওতে আনন্দ পাব না। আমি জানি।”
“ফুহ, তুমি সব জেনে বসে আছ! এত লোকে খায়… সে কি এমনি এমনি? অকারণে?” নির্বাণের স্বরে ব্যঙ্গ, “অত ছুঁইমুই না করে চুমুক মারো, দেখবে কেমন শিথিল হয়ে গেছে নার্ভগুলো… দুনিয়াটাই তখন অন্যরকম লাগবে।”
“ঠিক কীরকম?”
নির্বাণ হোঁচট খেল। মহা তেএঁটে মেয়ে তো? মাল খেয়ে কেমনটা লাগে তাও একে ব্যাখ্যা করতে হবে? তপ্ত স্বরে বলল, “ন্যাকামো কোরো না। ভাল্লাগে না। আমি কিন্তু আজ খাবই। সে তুমি যাই মনে করো না কেন।”
আঁচল নীরব।
“আমি কিন্তু আউটও হয়ে যেতে পারি।” নির্বাণ কেটে-কেটে বলল, “তখন উলটোপালটা কিছু ঘটিয়ে ফেললে কিন্তু অবাক হোয়ো না।”
আঁচল যেন আমলই দিল না। চোখ আবার সেই ডায়েরির পাতায়।
নির্বাণ কয়েক মিনিট ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে রইল সেদিকে। তারপর ঝপ করে উঠে গিয়ে বেল বাজিয়েছে রুম সার্ভিসের। সোফায় এসে ফের বসার আগেই দরজায় টকটক।
নির্বাণ গলা ভারিক্কি করল, “কাম ইন।”
মাথায় রঙিন পাগড়ি, উর্দিধারী পাহাড়ি বেয়ারার সসম্ভ্রম প্রবেশ। বিনয়ী ভঙ্গিতে বলল, “ইয়েস স্যার।”
“আভি কুছ স্ন্যাকস মিলেগা কেয়া?”
“শিওর স্যার। ভেজ পকোড়া, চিকেন পকোড়া, প্রন পকোড়া, ফিংগার চিপস, প্রন গোল্ড কয়েন…।” বলতে বলতেই বোতলটা লক্ষ করেছে লোকটা, স্যালাড ভি মিলেগা স্যার। বাটার ভি।”
“হুম। প্রন গোল্ড কয়েনই দিয়ে যাও।” অপাঙ্গে আঁচলকে দেখল নির্বাণ। জিজ্ঞেস করল, “রাতের খাওয়ার অর্ডারটাও দিয়ে দিই? নাকি ডাইনিং হলে যাবে?”
মৃদু জবাব ভেসে এল, “তোমার যা ইচ্ছে।”
“আজ ঘরেই খাই।… তা কী বলব? চাইনিজ? মোগলাই? কন্টিনেন্টাল?”
“যা খুশি। তবে আমার জন্যে বেশি না।”
“কেন? সারাদিন এত চরকি মারলে। দুপুরে তো শুধু ক’টা মোমো খেয়েছ… রাত্রে একটু জমিয়ে ডিনার করো।”
আঁচল আবার নিরুত্তর।
একটুক্ষণ প্রতীক্ষায় থেকে নির্বাণ টেবিলে পড়ে থাকা মেনুকার্ডখানা টানল। মিলিয়ে মিশিয়ে অর্ডারও দিয়ে দিল একটা। খেলে খাবে, না খেলে নষ্ট হবে। নির্বাণের তাতে বয়েই গেল।
যাওয়ার সময়ে দেওয়ালে ঝুলন্ত কাচের শোকেস থেকে দু’খানা পানপাত্র বের করে টেবিলে রেখে গেল বেয়ারা। একখানা জলের বোতলও। মনে মনে তারিফ করল নির্বাণ। বেয়ারা ওয়েটাররা এসব সহবত জানে বলেই না এমন গলাকাটা চার্জ নেয় এই হোটেলগুলো। কলকাতার লাগোয়া যেসব ঠেকগুলোতে মহুয়াকে নিয়ে সে যায়, এই ধরনের আদবকায়দা সেখানকার কর্মচারীরা জানেই না। বেচারা মহুয়া, নিকিরি-নিকিরি পরিবেশের বাইরে কিছুই আর দেখানো হল না মেয়েটাকে!
ফস করে একটা শ্বাস ফেলে নির্বাণ বোতল খুলল। খানিকটা কালচে লাল পানীয় ঢালল পাত্রে। আবার ঘাড় হেলিয়ে দেখল আঁচলকে। কী নিমগ্নভাবে কলম চালাচ্ছে! ঘরে যে আর একটা প্রাণী মজুত, গ্রাহ্যের মধ্যেই আনছে না যেন। এও কি উপেক্ষা? নাকি স্থৈর্য? অথবা ভান?
আঁচলকে একটা ঠোক্কর দিতে নির্বাণের জিভ শুলিয়ে উঠল। বিদ্রুপের সুরে বলল, “এত লেখালিখি করছ কেন, অ্যাঁ? ফিরে গিয়ে মাকে দেখাবে বলে?”
“না।”
“বললেই মানব? আমি সব বুঝি। মাকে ইমপ্রেস করার জন্যে ছটফট করছ।”
“কেন?”
“যে কারণে মাও তোমাকে ইমপ্রেস করতে চায়। তুমি যে কেউকেটা শাশুড়ির যোগ্য পুত্রবধূ, প্রমাণ করতে হবে না? রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী, ইমেজটা পোক্ত করতে হবে তো। বাড়িতে দুপুরে না ঘুমিয়ে মায়ের লাইব্রেরিতে বইপত্র ঘাঁটো… পড়াশোনার জগতে গলা অবধি ডুবে থাকো… এতে শাশুড়ি ঠাকরুন মুগ্ধ না হয়ে পারে!”
“ওঁকে মুগ্ধ করে আমার লাভ?”
নির্বাণের মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, আমার পিছনে আর একটু বাম্বু যাক এটাই হয়তো চাও। কোঁত করে কথাটা গিলে নিয়ে বলল, “মেয়েমানুষদের পেটে পেটে কী মতলব থাকে, তা বোঝা কি আমার কম্মো।”
“আমি মেয়েমানুষ নই। একটা মেয়ে। ভাষাটা সংযত করো।”
এমন প্রতিআক্রমণের জন্য আদৌ তৈরি ছিল না নির্বাণ। পলকে লাল হয়ে গেল ফরসা গোলগাল মুখখানা। কী বললে কাঠেকাঠে জবাব হয়, খুঁজে না পেয়ে পাত্রে ঢালা সমস্ত পানীয়টাই একবারে চালান করেছে মুখে। অমনি দম আটকে গেল যেন। কণ্ঠনালি দিয়ে আগুনের হলকা নামছে, নাড়িভুড়ি বুঝি পুড়ে খাক হয়ে যাবে এক্ষুনি। বিচ্ছিরি একটা কাশি কোত্থেকে যেন ঠেলে উঠল। খকখক কমছে না কিছুতেই। একটু বাতাসের জন্য ছটফট করছে নির্বাণের ফুসফুস।
তখনই আঁচলের গলা পেল নির্বাণ, “খুব কষ্ট হচ্ছে?”
নির্বাণ জোরে জোরে মাথা নাড়ল। কোনওমতে বলল, “আমি ঠিক আছি।”
“যা সহ্য করার ক্ষমতা নেই, এমন জিনিস খাওয়া কেন?”
প্রশ্ন নয়, নেহাতই বক্রোক্তি । মাথাটা তেতে আগুন হয়ে গেল পলকে। গলা ফাটিয়ে নির্বাণের বলতে ইচ্ছে করল, তোমাকে সহ্য হবে না জেনেও তো আমায় গিলতে হয়েছে, নয় কী? সেই শ্বাসরোধ করা কাশি তুমি দেখতে পাচ্ছ না, এই যা…।
নির্বাণ একটি শব্দও উচ্চারণ করল না। উচ্চণ্ড কাশির অভিঘাত সামান্য প্রশমিত হতেই ফের ঢালল পানীয়। একটু সময় নিয়ে চুমুকও দিল পাত্রে। এবার ক্রিয়া করছে সিকিমিজ রাম। রক্ত চলাচল যেন আচমকাই বেড়ে গেল, চনমন করছে শিরা উপশিরা।
ঈষৎ স্খলিত পায়ে উঠে দাঁড়াল নির্বাণ। মগজের দুলুনি সামলে জানলায় এল। বন্ধ বাতায়ন। পাহাড়েও, কেন কে জানে, এসি চলছে। কাচের পাল্লায়, একটু বা ছায়া ছায়া, বিম্বিত হচ্ছে আঁচল। বিষমাথা শর ছুড়ে আবার নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় কাজে মনোযোগী! মাথাটা দপদপ করে উঠল নির্বাণের। ওই নিরীহ মুখ করে বসে থাকা মেয়েমানুষটাই, হ্যাঁ হ্যাঁ মেয়ে নয়, মেয়েমানুষ, তার জীবনের শনি এখন। ওর জন্যই না মহুয়ার মতো এক অতি সাধারণ মেয়ের চোখেও এখন সে প্রতারক!
জানলার কাচ ফুঁড়ে নির্বাণের দৃষ্টি চলে গেল বহুদূর। বাগুইহাটির সেই সরু গলিটায়। মহুয়া কী করছে এই মুহূর্তে? সব ভুলে আবার মায়ের পাশে বসে টিভি গিলছে? নাকি বিছানায় শুয়ে তাকে এখনও মনে মনে গালমন্দ করে চলেছে একটানা। অথবা দীর্ঘশ্বাস গিলে চোখের জল মুছছে দোপাট্টায়? ওই দিনটার মতো?
ওহ, কী ভয়ংকর যে গিয়েছিল দিনটা?… ফুলশয্যার পর অফিসে গিয়েই ফোন করেছিল মহুয়াকে। যদি তুইয়ে-বুইয়ে একটু শান্ত করা যায়। বড় আঘাত পেয়েছে মেয়েটা, বিয়ের মাসখানেক আগে থেকে নির্বাণের মুখদর্শন বন্ধ করে দিয়েছে…। তার সাফ কথা, মাকে অমান্য করার মুরোদ যখন নির্বাণের নেই, ফালতু-ফালতু কেন আর সম্পর্কটাকে টানবে নির্বাণ? তাই নির্বাণেরও গোঁ চেপে গিয়েছিল, বিয়েটা ঘটে যাওয়ার পর মহুয়ার সঙ্গে ফের যোগাযোগ করে সে দেখিয়ে দেবে, মহুয়াকে সে সত্যিই কতটা চায়?
কিন্তু পারল কী? মহুয়া তো তার ফোনই ধরল না। প্রথমবার রিং হওয়ার পর সেই যে কেটে দিল, তারপর থেকেই সুইচড অফ। তাও হাল ছাড়েনি নির্বাণ, অফিস থেকেই ছুটেছিল মহুয়ার বাড়ি। লাভ কী হল? চাঁচাছোলা ভাষায় একগাদা খিস্তি করল বিমল পাল, মহুয়ার মা ক্যাটক্যাট করে রাশিরাশি কথা শোনাল, পারলে দু’জনেই গলাধাক্কা মেরে বার করে দেয় নির্বাণকে।
তা সত্ত্বেও সেদিন খুঁটি আঁকড়ে বসে ছিল নির্বাণ। অধোবদন হয়ে। টুঁ শব্দটি না করে। বুঝি তখনও আশা করছিল, মহুয়াকে দেখাতে পারবে হৃদয়টা। কিন্তু বাড়িতে ঢুকেই মহুয়া তাকে যে অপমানটা করল…! …ও, এসে গেছ দেখছি.. আমাকে পুরোপুরি ফেলে দিচ্ছ না তা হলে, মিস্ট্রেস করে রাখতে চাও… তা ভাল, আফটার অল তুমি হবে আমার চেনা ক্লায়েন্ট, দাদার বুজম ফ্রেন্ড ছিলে, আমাকেও কত প্রেম দিয়েছ, তাই লাইনে নামলে তুমিই তো হবে আমার প্রথম খদ্দের… তা কীরকম দেবে মাসে মাসে.. দেখো নির্বাণদা, পরিচিত বলে যেন অ্যামাউন্টটা কমিয়ো না, তা হলে কিন্তু আমাকে আরও বাবু ধরতে হবে…।”
নরম নরম সুরে মিষ্টি করেই বলছিল মহুয়া। কিন্তু মহুয়ার তীক্ষ্ণ শ্লেষ গলন্ত সিসের মতো আঘাত হানছিল নির্বাণের পাঁজরে। ভাবলেই এখনও বুকটা ব্যথিয়ে উঠছে। সে মহাপাপিষ্ঠ, মহুয়ার বিশ্বাস ভেঙেছে, তার অপরাধের ক্ষমা নেই…
কতক্ষণ যে নিথর দাঁড়িয়ে ছিল, নির্বাণ জানে না। কখন যে বেয়ারা স্ন্যাকস ডিনার দিয়ে গেছে টেরও পায়নি। হুঁশ ফিরল আঁচলের স্বরে, “তোমার ভাজাভুজি কিন্তু ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
ঘুরল নির্বাণ। দেখল, টেবিল ছেড়ে উঠছে আঁচল। ডায়েরিখানা ট্রলি ব্যাগে ঢোকাতে গিয়েও কী মনে করে থামল। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কাল কি কোথাও বেরোনো হচ্ছে?”
“সে তোমার ইচ্ছে।” সামান্য অবসন্ন স্বরে বলল নির্বাণ, “চাইলে ছাঙ্গু লেক যেতে পারো। আরও ওপরে কী এক মন্দির আছে, সেখানে গিয়ে পুজোটুজোও…”
“সরি। পুজো-আর্চায় আমি নেই। আমি ঠাকুরদেবতা মানি না।”
বটে? নির্বাণের বাঁকা সুর এসেই গেল, শুধুই অসুর-রাক্ষস মানো বুঝি?
“তাও মানতাম না।” কয়েক লহমা চুপ থেকে আঁচলের স্বরও যেন বঙ্কিম সহসা, “মনে হচ্ছে এবার থেকে মানতে হবে।”
হয়তো তেমন কিছু না ভেবেই বলেছিল আঁচল। হয়তো বা সামান্য পরিহাসই ছিল তার মন্তব্যে। কিন্তু কথাটা যেন হঠাৎই একটা বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়ের মতো সপাটে আছড়ে পড়ল নির্বাণের গালে।
কী যে হল নির্বাণের, খ্যাপা ষাঁড়ের মতো ধেয়ে এল আচমকা। এই প্রথম স্পর্শ করল আঁচলকে। তার কাঁধদুটো ধরে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, “কী বললে? আমি অসুর? রাক্ষস?”
কাঁধ থেকে নির্বাণের হাত নামিয়ে দিয়ে মৃদু ধিক্কার দিল আঁচল, “ছিঃ, মাতলামি কোরো না।”
“আমি মাতাল?” গলা আরও চড়ে গেল নির্বাণের। নাকের পাটা ফুলছে, “দেখতে চাও মাতাল কাকে বলে?”
“থাক, আর আমার ঘেন্না বাড়িয়ো না। পদে পদেই তো প্রমাণ করে দিচ্ছ তুমি আদতে কী?”
নির্বাণ জ্ঞান হারাল। কোত্থেকে আর এক নির্বাণ এসে দখল নিল চিরকালের ভীতু নির্বাণের। সে বেড়ির মতো পেঁচিয়ে ধরল আঁচলকে। হ্যাঁচকা টানে শুইয়ে দিল বিছানায়। পাগলের মতো নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করছে আঁচল, শক্তি দিয়ে তাকে পেড়ে ফেলল সে। জোর করে উন্মোচিত করল আঁচলের শরীর, সর্বাঙ্গে পাগলের মতো মুখ ঘষছে, হিংস্র চুমুতে ছেয়ে যাচ্ছে আঁচলের বরতনু। সমস্ত প্রতিরোধ ব্যর্থ করে দিয়ে আঁচলের দেহে নিজেকে প্রোথিত করছে নির্বাণ।
মিলন নয়, সংগম নয়, এ যেন প্রতিশোধ নিচ্ছে নির্বাণ।
কিন্তু কার ওপর? মা? আঁচল? নাকি নিজেরই অক্ষম পুরুষকার?
১৯
একটা জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দিচ্ছিল ধীরেন সরকার। সামনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা আসছে একের পর এক, কীভাবে অশান্তি কম রেখে পরীক্ষার হলে নজরদারি চালানো যায় সেই ব্যাপারেই ব্যক্ত করছিল নিজের মতামত। কর্মক্ষেত্রে অন্যের কথা মন দিয়েই শোনে বিদিশা, নিদেনপক্ষে শুনছে এমন ভানটুকু অন্তত করে। আজ সেটুকুও পারছিল না। বারবার চোখ চলে যাচ্ছে কবজিঘড়িতে, কিংবা টেবিলে পড়ে থাকা মোবাইলে। বুকটাও ধড়াস করে উঠছে হঠাৎ হঠাৎ। ওফ, কেন যে এখনও আসে না ফোনটা?
গভর্নিং বডির মিটিং চলছে কলেজে। অধ্যক্ষের ঘরের লাগোয়া বড়সড় চেম্বারটায়। শিক্ষক-অশিক্ষক-ছাত্র প্রতিনিধিরা তো হাজিরই, এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় আর সরকারি প্রতিনিধিরাও। শুধু সভাপতি কাম শাসকদলের এম এল এ মনোজ বসুই যা অনুপস্থিত। বিধানসভার অধিবেশন চলছে কিনা। মনোজের বদলে ধীরেন আজ পৌরোহিত্য করছে সভার। সে শুধু সরকার মনোনীত কলেজ পরিচালন সমিতির সদস্যই নয়, অধ্যাপক সমিতির একজন নেতাও বটে।
পদাধিকার বলে অবশ্য বিদিশাই চালাচ্ছিল মিটিং। বক্তৃতা শেষ করে ধীরেন বলল, “আমার পরামর্শটা কেমন ম্যাডাম? শুধু পুলিশের ওপর ভরসা না করে ছাত্রসংসদকেও যদি দায়িত্ব দেওয়া যায়…”
কলেজ চালানোর ব্যাপারে এই সব ফোপর দালালি বিদিশার বিলকুল না-পসন্দ। তবু নিজের দলের লোক বলে কিছু মন্তব্য করল না। অল্প হেসে বলল, “ভালই তো। তবে এটা নিয়ে না হয় নেক্সট মিটিংয়ে আলোচনা হোক। আজকের টপিকগুলো এবার শুরু করা যাক।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। তবে মনে করে এই অ্যাজেন্ডমটা কিন্তু দেবেন পরের দিন।”
ঘাড় দোলাল বিদিশা। হাসল মনে মনে। পরের মিটিং তিন মাসের আগে হচ্ছে না। ততদিনে পরীক্ষার পাট শেষ। সেটা আর না বলে আজকের আলোচ্যসূচি একবার শুনিয়ে দিল সবাইকে। তেমন গুরুতর কিছু নেই, সবই প্রায় ধরাবাঁধা ব্যাপার। পেনশন পেপার পাঠানো, ছুটি মঞ্জুর, প্রভিডেন্ট ফান্ড লোনের সম্মতি জ্ঞাপন…। শুধু কয়েকটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে যা জটিলতা আছে সামান্য। বেশ কয়েকজন অশিক্ষক কর্মচারী প্রয়োজন, সরকারের ভাঁড়ারের যা হাল, তাদের অনুমতির অপেক্ষায় থাকলে বছর গড়িয়ে যাবে। অথচ পার্টির কিছু কর্মীকে এক্ষুনি চাকরিও দেওয়া দরকার। তাই আইন ভেঙেই কাগজে একটা নামকা ওয়াস্তে বিজ্ঞাপন দিয়ে ইন্টারভিউ মতো নেওয়া হয়েছে, এবার তাদের ঢোকাতে হবে কলেজে।
এই ধরনের বিতর্কিত ব্যাপারস্যাপার অবশ্য মিটিংয়ে আলোচনা হয় না বড় একটা। সভা বসার আগেই নিজস্ব লোকদের সঙ্গে আলাদাভাবে মিনি বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেওয়া থাকে, তারপর সভায় তো সেটা পাশ হবেই।
আজও সেই দিকেই গড়ানোর কথা। কিন্তু দুম করে ঝামেলা বেঁধে গেল। কলেজেরই শিক্ষক প্রতিনিধি দীপিকা চ্যাটার্জি আচমকা আপত্তি জুড়েছে। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ম্যাডাম প্রিন্সিপাল, আট আটজন স্টাফ নেবেন, তাদের মাইনেকড়ি ঠিক হয়েছে কি?”
এই আশঙ্কাটা বিদিশার ছিলই। দীপিকার সঙ্গে প্রায়শই তার মতে মেলে না। কলেজের ওপর পার্টির দখলদারি নিয়ে দীপিকা হরবখত গাল পাড়ে স্টাফরুমে। শিক্ষকদের মধ্যে তার একটা ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা আছে, সেই জোরেই প্রতিবার ভোটে জিতে গভর্নিং বডিতে আসে দীপিকা। নানাভাবে দীপিকাকে ব্যতিব্যস্ত করেছে বিদিশা। রিফ্রেশার্স কোর্সে যাওয়া আটকানো, প্রমোশনের কাগজপত্র ঝুলিয়ে রাখা, সরকারি ট্যাঁক থেকে শুধু দীপিকারই বকেয়া আদায়ে গড়িমসি… উঁহু, তবু এই অবাধ্য ঘোড়াটাকে শায়েস্তা করতে পারেনি এখনও।
তবে গভর্নিং বডির মিটিংয়ে দীপিকাকে নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই বিদিশার। সে আইনি কাজই করুক কী বেআইনি, মেজরিটির জোরে সে ঠিক পাশ করিয়ে নেবে। একেই না বলে গণতন্ত্রের গুঁতো!
বিদিশা ভুরু কুঁচকে বলল, “ঠিক করার আছেটা কী? সরকারি স্কেলেই ওরা মাইনে পাবে।”
“কেন? সরকারি নিয়ম মেনে তো ওদের নেওয়া হচ্ছে না? সরকার কি ওদের মাইনের টাকা দেবে?”
“আমরা সরকারের কাছে আবেদন করব। কলেজের স্টাফ শর্টেজের কথা বলব।” বিদিশা হাসি হাসি মুখে সভার বাকি উপস্থিত সদস্যদের পানে তাকাল। যা ভেবেছে তাই, কেউই দীপিকাকে আমল দিতে রাজি নয়। বিদিশা শান্তস্বরে বলল, “সরকার একান্তই যদি আমাদের কথা না মানে, তখন নয় কলেজ ফান্ড থেকেই…”
“তা কি আমরা পারি? সরকার কি সে অনুমতি দিয়েছে? অডিটও তো আটকে দেবে…”
“সে দেখা যাবেখন। আমরা যা করছি সে তো কলেজের স্বার্থে, শিক্ষার স্বার্থে…”
“সোজা কথা সোজাভাবে বলুন না। আসলে তো করছেন পার্টির স্বার্থে।”
বিদিশার মুখ পলকে লাল। কড়া গলায় জবাব দিতে যাচ্ছিল, তখনই মোবাইলে টুংটাং।
তাড়াতাড়ি বিদিশা উঠে দাঁড়াল, “এক মিনিট। আপনারা ডিসকাস করুন, আমি আসছি।” বলেই মোবাইল হাতে নিয়ে নিজের চেম্বারে। মনিটরে না তাকিয়েই বলল, “হ্যাঁ, বিদিশা বলছি। খবর হল কিছু?”
“খুব খারাপ খবর ম্যাডাম। পে বিলে অবজেকশন পড়েছে।”
যাচ্চলে, এ তো পারিজাত মল্লিক নয়, কলেজের ক্লার্ক পরেশ দে। আকাশ থেকে দড়াম মাটিতে পড়ল বিদিশা। গলাটাকে ভারিক্কি করে বলল, “কেন?”
“দু’ জায়গায় ভুল রয়েছে। …আমি কি বিলটা ফেরত নিয়ে চলে আসব?”
“নয়তো আর কী করার আছে?” বিদিশা প্রায় ধমকে উঠল।
“না মানে… আপনি যদি ডি পি আই অফিসে এসে কারেকশন করে দেন…”
“আমার অত সময় নেই। আপনি ফেরত আনুন।”
ফোন কেটে দিল বিদিশা। আবার মিটিংয়ে যেতে গিয়েও থমকাল। সে কি নিজেই রিং করবে পারিজাতকে? বেশি হ্যাংলামো দেখানো হয়ে যাবে না? যথেষ্ট উমেদারি করেছে বিদিশা, এবার কি তার একটু স্থির হয়ে বসে থাকা উচিত নয়? কপালে না থাকলে জুটবে না, এই বলে মনকে প্রবোধ দেওয়াই তো শ্রেয়।
উঁহু, নাচতে নেমে ঘোমটা পরলে চলে না। পারিজাতকে নয় আরও একবার খোঁচালই। চোরা টেনশনে আয়ুক্ষয় করার তো কোনও মানেই হয় না। আর পারিজাতকে ফোন করলে নতুন করে মান খোওয়ানোরই বা কী আছে? পারিজাত মোটেই হেঁজিপেঁজি নেতা নয়, দলের রাজ্য কমিটির সদস্য, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গেও তার যথেষ্ট দহরম-মহরম। বারবার ডাকাডাকিতে এই সব ওজনদার মানুষদের অহং তৃপ্ত হয়, জানে বিদিশা।
দোনামোনা কাটিয়ে বিদিশা করেই ফেলল ফোন। রিং হচ্ছে, ঠাঁই ঠকাঠক নেহাই পড়ছে বুকে। যাহ, কেটে গেল! আপনাআপনি? কী হল ঘটনাটা! বিদিশার নামটা থ্রু করতে পারেনি বলেই কি এভাবে অপ্রস্তুত পরিস্থিতি এড়াল? কিন্তু সে তো শুধু পারিজাতের ওপরেই ভরসা করে হাত পা গুটিয়ে বসে নেই, অন্য খুঁটি ধরেও চেষ্টাচরিত্র চালাচ্ছে বই কী। সেই মোতাবেক, বিদিশার তো বিফল হওয়ার কথা নয়।
বেশ তো, সময় তো ফুরোয়নি। খারাপ খবরও আসেনি। সুতরাং এক্ষুনি হতাশ না হয়ে আর খানিকক্ষণ নয় অপেক্ষা করলই। মনের বিক্ষিপ্ত ভাবটা বশে এনে বিদিশা আবার ফিরেছে মিটিংয়ে। এবং ঢুকেই দেখল, বাকি সদস্যরা একজোট হয়ে প্রায় পেড়ে ফেলেছে দীপিকাকে। তিন শিক্ষক-প্রতিনিধি স্মিতা-তপতী-সুরঞ্জনা তর্জনী উঁচিয়ে চেল্লাচ্ছে, অশিক্ষক কর্মচারীদেরও চোখ লাল, দীপিকা ঘাড় গোঁজ করে বসে।
মুখে হাসি এনে বিদিশা নিরীহ স্বরে বলল, “আমরা তা হলে কর্মী নিয়োগের পয়েন্টে ঐকমত্যে এলাম তো?”
“সরি।” দীপিকা সোজা হল, “আমার আপত্তি থাকছেই। কলেজের ফান্ড যদি বিধিবহির্ভূতভাবে খরচ করা হয়…”
“এই, আপনি থামুন তো।” হঠাৎ স্টুডেন্ট ইউনিয়নের নেত্রী গর্জে উঠল, “তখন থেকে কেন আলতুফালতু বকে যাচ্ছেন? প্রিন্সিপাল ম্যাডামের প্রত্যেকটা ভাল কাজে কাঠি করাটা আপনার স্বভাব হয়ে গেছে।”
“আহ তানিয়া, কী হচ্ছে।” বিদিশা ছোট্ট করে ধমক দিল। যা বলার, তানিয়া তো বলেই দিয়েছে, এবার তাকে চুপ করানোর পালা। গলায় কর্তৃত্বের সঙ্গে মাপমতো ব্যঙ্গ মিশিয়ে বিদিশা বলল, “তোমরা তো জানোই দীপিকা ম্যাডাম একটু আজেবাজে বকেন। তার জন্য প্রতিবাদ করতে পারো। কিন্তু ভাষাটা সংযত রাখো। আফটার অল, উনি তোমাদের দিদিমণি, তুমি ওঁকে ইনসাল্ট করতে পারো না। তুমি ওঁকে সরি বলো। এক্ষুনি।”
“সরি ম্যাম।”
দীপিকার পানে কথাটা ছুড়ে দিয়ে মুখ টিপে হাসছে তানিয়া। বিদিশার পরোক্ষ প্রশ্রয়ে ঘটে যাওয়া ছোট্ট নাটিকাটা টের পেয়ে দীপিকার মুখ কালো হয়ে গেছে। সেদিকে না তাকিয়েই বিদিশা বলল, “আমি তা হলে প্রস্তাবটা পাশ হল বলেই ধরে নিচ্ছি। …দীপিকা ম্যাডাম কি লিখিত নোট অব ডিসেন্ট দেবেন? সেটাই তা হলে আমরা…”
“প্রয়োজন নেই।” দীপিকার স্বর একটু যেন স্তিমিত, “পরের আইটেমে প্রসিড করুন।”
বিদিশা মনে মনে একটু হেসে নিল। দীপিকা বুঝে ফেলেছে, প্রথামতো তার বিরুদ্ধমতটা লিখিত আকারে নেওয়া হলেও সেই কাগজটার ঠাঁই হবে ওয়েস্টপেপারের ঝুড়িতে। পরে ছোবল খাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই যে বিদিশা চৌধুরী জমিয়ে রাখে না, এটা আন্দাজ করার মতো ঘিলু দীপিকার আছে বই কী।
ঝটাঝট বাকি আইটেমগুলো পার করল বিদিশা। মিটিং চুকিয়ে আজ আর গালগপ্পে বসল না, ফিরেছে নিজের কক্ষে। পার্ট টুর ফর্ম ফিল আপ শুরু হয়েছে, রাশি রাশি সই করতে হবে এখন। তা ছাড়া পারিজাতকে একবার টোকা মারাটাও কম জরুরি কাজ নয়।
মোবাইল টেপার অবকাশ মিলল না। ঘরে ঢুকতেই দরজায় মিহি গলা, “ম্যাডাম, আসতে পারি?”
মধুবন্তী। বাংলার অতিথি অধ্যাপক। বিদিশার ভুরুতে ভাঁজ পড়ল। নীরস গলায় বলল, “আজ এসেছ তা হলে?”
মধুবন্তী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নখ খুঁটছে, “না, মানে… ভেবেছিলাম সোমবারেই জয়েন করব, বেড়িয়ে ফেরার দিনই হঠাৎ জ্বরে পড়ে গেলাম…”
“সে তোমার কী হয়েছিল আমার জানার দরকার নেই। কিন্তু কলেজে না এলে খবর দেওয়ার একটা নিয়ম আছে, সেটা নিশ্চয়ই জানো?”
“আমি তো প্রকৃতি ম্যাডামকে ফোন করেছিলাম… উনি বোধহয় আপনাকে…”
“কলেজটা কে চালায়? তোমায় অ্যাপয়েন্টমেন্টই বা কে দিয়েছিল? আমি না প্রকৃতি ম্যাডাম?”
“সরি। আর কক্ষনও এমন হবে না।”
“না হলেই ভাল। কলেজের এই চাকরিটা যে নিজের যোগ্যতায় পাওনি, এ কথাটা মাথায় রেখো। নইলে কিন্তু ভবিষ্যতে বিপদও ঘটতে পারে।”
ঢক করে মাথা নাড়ল মধুবন্তী। ভীতু ছাত্রীসুলভ কাঁপা গলায় বলল, “এখন তা হলে যাই ম্যাডাম।”
“এসো। এখন কিন্তু আর ঘনঘন কামাই কোরো না।”
জোরে জোরে মাথা দুলিয়ে প্রায় দৌড়ে পালাল মধুবন্তী। মেয়েটাকে দাবড়ে বিদিশার মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল। হায়ার সেকেন্ডারি, গ্র্যাজুয়েশনে নম্বরের যা ছিরি, একে চাকরিতে নেওয়ার মোটেই ইচ্ছে ছিল না বিদিশার। পার্টির এক জোনাল কমিটির সেক্রেটারির ভাগনি বলে ঢেঁকি গিলতে হয়েছে। কিস্যু পড়াতে পারে না মেয়েটা, তার ওপর বিয়ের ছুতোয় ডুব দিয়ে বসে রইল পাক্কা একমাস। তবু ছাঁটাই তো করা যাবে না। দোষগুণ যাই থাক, নিজের পার্টির লোক তো! তা ছাড়া অযোগ্য বলেই না এদের ওপর ইচ্ছেমতো চোটপাট করা যায়!
জমে থাকা ফর্মের পাহাড় টানল বিদিশা। পারিজাতকে ফোনের কথা আর স্মরণে নেই, সই সারছে যন্ত্রের মতো। কাজের মাঝেই মধুবন্তীর মুখখানা মনে পড়ল আচমকা। টিপ-সিঁদুরে বেশ দেখাচ্ছিল মেয়েটিকে। তেমন সুন্দরী নয়, তবু একটা ঢলঢলে ভাব এসেছে। এমনটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু আঁচলকে যেন কেমন শুকনো শুকনো লাগছে আজকাল। অমন ডাকসাইটে রূপসি হওয়া সত্ত্বেও সদ্য বিয়ে হওয়া ঝলমলে ভাবটা যেন আসেনি এখনও। হানিমুন সেরে আসার পরও। বান্টির সঙ্গে কি মিলমিশ হয়নি আঁচলের?
কিন্তু হবে নাই বা কেন? বান্টি নিশ্চয়ই কোনও বেগড়বাঁই করেনি। ওই রকম একটা ডানাকাটা পরি পেয়ে সে তো বর্তে গেছে নির্ঘাত। আঁচলই কি তবে বান্টিকে…?
আঁচল মেয়েটা যেন কীরকম! কথায় বার্তায় খুবই শিষ্ট বটে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে বেশ ঢ্যাঁটা। বিয়ের আগে বিদিশা ঠারেঠোরে বলেছিল, অতিথি অধ্যাপকের চাকরিটা ছেড়ে রিসার্চেই যেন পুরোপুরি মন দেয় আঁচল। মুখ দেখে তখন মনে হয়েছিল প্রস্তাবটায় তার আপত্তি নেই। কিন্তু গ্যাংটক থেকে ফিরে সেই আবার ছুটল পুরনো চাকরিটায়। যুক্তিটা কী! পড়ানোর মধ্যে থাকলে নাকি গবেষণার সুবিধে হবে! বোঝো! রিসার্চের ছুতোয় আজকাল সকলেই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নিত্যনৈমিত্তিক ঝঞ্ছাটগুলো এড়াতে চায়, কিন্তু আঁচল যেন উলটো পথে হাঁটতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। যাক গে, মরুক গে, আঁচলের ইচ্ছে অনিচ্ছের ওপর জোর ফলানোর কোনও বাসনা নেই বিদিশার। ছেলের বউয়ের কাছে তো তার একটাই চাওয়া। বান্টির যেন ফের মতি না বিগড়োয়।
হেডক্লার্ক ঢুকেছে ঘরে। জিজ্ঞেস করল, “ম্যাডাম, আরও কিছু ফর্ম আছে, দেব সই করতে?”
“কতগুলো?”
“এই ধরুন, একশো তিরিশ-চল্লিশখানা।”
বিদিশার ক্লান্ত লাগছিল। সকাল থেকে তিন তিনটে মিটিং করতে হয়েছে। তার ওপর ভিতরে একটা চোরা টেনশন…। বিদিশার মনে পড়ে গেল, পারিজাতকে ফোনটা করা হয়নি।
অল্প মাথা নেড়ে বিদিশা বলল, “আজ থাক। কাল ফার্স্ট আওয়ারে করব। …সীতাকে পাঠিয়ে দিন, এই ফর্মগুলো নিয়ে যাক।”
বছর পঞ্চান্নর দেবানন্দ ঘোষ বেরিয়ে যাচ্ছিল, তাকে ফের ডাকল বিদিশা, “শুনুন…”
ঘুরেছে দেবানন্দ, “কিছু বলছেন ম্যাডাম?”
“হ্যাঁ। আউটসাইড মেম্বার যারা আজ জি ব মিটিংয়ে এসেছিল, তাদের টি এ দেওয়া হয়েছে?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ ম্যাডাম।”
“কত করে দিলেন?”
“আপনি যা বলেছিলেন। সাতশো।”
“হঠাৎ দু’শো বাড়ল… তাই নিয়ে কেউ কিছু বলল?”
“না। তবে সবাই যেন খুব খুশি। শুধু ধীরেনবাবুই যা একটু রসিকতা করছিলেন।”
“কী বলছিলেন?”
“সাধে কি আপনাদের ম্যাডামের মিটিং মিস করি না…। আরও তো দুটো জি বিতে আছি, কোত্থাও তিনশো’র বেশি ঠেকায় না…। ম্যাডামকে বলতে হবে আরও যেন ঘন ঘন মিটিং ডাকেন…।”
“হুঁ।” বিদিশার ঠোঁটের কোণে হাসির আভাস। অধ্যাপকদের মাইনে এখন নেহাত কম নয়। সম্প্রতি এক ধাক্কায় তিরিশ হাজার করে বেড়েছে। তবু এই বাড়তি এক দু’শো টাকার জন্যে কী ছোঁকছোকানি! পলকা হাসিটুকু মুছে ফেলে বিদিশা ফের গম্ভীর, “ঠিক আছে, ভাউচারগুলো পাঠিয়ে দিন।”
দেবানন্দ বেরিয়ে যেতেই বিদিশা টেবিল থেকে মোবাইলখানা তুলল। ফোন করতে গিয়ে থমকাল। মেসেজ এসেছে একটা। ইনবক্স খুলেই মৃদু ভূকম্পন। পারিজাতের বার্তা! ফোন কোরো না। আলোচনা চলছে। টাইমলি জানাব।
এ কি কোনও বিপদসংকেত? তার নামটা ওঠাতে গিয়ে কি কোনও সমস্যায় পড়ল পারিজাত? টিপটিপ দুশ্চিন্তা নিয়েই অফিসের টুকিটাকি কাজগুলো সেরে ফেলল বিদিশা। এবার বাড়ি ফিরলেই হয়। নাকি অধ্যক্ষ সমিতির দফতরে যাবে? তেমন কোনও প্রয়োজন নেই, তবে গেলে অনেক কলেজ সম্পর্কে নানান খোঁজখবর মেলে। তা ছাড়া ওখানে থাকতে থাকতেই যদি সুখবরটা এসে যায়, প্রচুর স্তুতিবাক্যও মিলবে। দু’-চারটে হালকা-ফুলকা দীর্ঘশ্বাসও টের পাওয়া যাবে বাতাসে, তারও সুখ নেহাত কম নয়।
নাহ, শরীরটা বইছে না। ঘরই চলো এখন। দোনামোনা ভাবটা ঝেড়ে ফেলে বিদিশা গাড়িতে গিয়ে উঠল। সিটে হেলান দিতেই আপনাআপনি বুজে এসেছে চোখ। কত তো হরমোন বড়ি গিলছে, তবু কেন যে এত শ্রান্তি আসে আজকাল? এমন এক গুরুত্বপূর্ণ দিনেও কেন যে বিদিশা চনমনে থাকতে পারছে না? মেয়েদের জন্যে কী যে আজব নিয়ম তৈরি করেছে প্রকৃতি, হাঁটু ঝনঝন কোমর কনকন সবই যেন উঁকি দিচ্ছে একে-একে। উঁহু, আর নিজে-নিজে চিকিত্সা নয়, ভাল একজন গাইনির কাছে যেতে হবে এবার। নিজেকে পুরোপুরি কর্মক্ষম না রাখতে পারলে ক্ষমতার স্বাদটাই পানসে মেরে যাবে না?
ব্যাগে মোবাইল বাজছে। চমকে চোখ খুলে মনিটরে নামটা দেখেই ক্লান্তি যেন বেড়ে গেল চড়চড়িয়ে। কেটেই দিচ্ছিল, কী ভেবে গুমগুমে গলায় বলল, “কী হল পল্টুদা? নীলুর তো সব কিছু হয়ে গেছে…”
“হ। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারও পাইসে। হেই তো গেল শুক্রবার।” পল্টুর স্বরে রীতিমতো গদগদ ভাব, “তোর জন্যই হইল রে বোনটি। কী বইল্যা তোরে ধন্যবাদ দিমু…?”
“থাক। জানো তো ওই ধরনের ন্যাকান্যাকা ডায়লগ আমার সহ্য হয় না।”
“ঠিকই তো। এরেই না কয় মহত্প্রাণ!” পল্টুর গলা জবজব করছে। এক-দু’ সেকেন্ড নীরব থেকে বলল, “কিন্তু আরেকটা বিপদ হয়েছে যে বোনটি?”
“আবার কী হল?”
“আমার নীলুরে পোস্টিং দিয়েসে সেই ঝাড়গ্রাম।”
“ভাল তো। বাসা ভাড়া করে থাকবে… প্রকৃতির শোভা উপভোগ করবে…”
“আর আমার পোঙায় হামপু। আরে, ও যদি চইলাই যায়, তাইলে অর চাকরি পাওনে আমার কী লাভ? আমরা বুড়াবুড়ি যে তিমিরে আছিলাম, সেই তিমিরেই তো রইয়্যা যামু… তার উপর ওইহানে যা মাওবাদী উৎপাত…”
“তো?” বিদিশা প্রায় তেড়ে উঠল, “দ্যাখো পল্টুদা, সরকারি চাকরি করতে গেলে ওইসব বাহানা চলে না। প্লাস, আমি সাফসাফ বলে দিচ্ছি, নীলুর পোস্টিং ট্রান্সফার সংক্রান্ত ব্যাপারে আমি নেই। এবং ভবিষ্যতেও থাকব না। ক্লিয়ার?”
বলেই কেটে দিল লাইন। রুমালখানা কপালে বোলাতে বোলাতে নির্দেশ ছুড়ল, “মানিক, এসিটা ফুল করে দাও তো।”
“আজ্ঞে, ফুলই তো আছে।”
“তা হলে ঠান্ডা হচ্ছে না কেন?”
“মনে হয় এসিতেই গড়বড়। গ্যাস কমে গেছে।”
“তো আবার ভরে নাও। সামনেই গরমকাল… আমি যতক্ষণ না ঠ্যালা মারব, কিছুই কি করবে না?”
“তা নয়.. বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান চলছিল তো…”
“বাহানা দেখিয়ো না। সেই অনুষ্ঠানের পর একমাস প্রায় ঘুরে গেছে…”
আরও একটু হয়তো ধমকাত বিদিশা, কিন্তু আবার ফোন। ফের পল্টুদা? ঘ্যানঘ্যান করেই চলবে, যতক্ষণ না প্রতিশ্রুতি আদায় হয়? তীব্র বিরক্তির পাশাপাশি এই কৃপা প্রার্থনাটা তাকে ভারী তৃপ্তি দেয় বটে, কিন্তু এই মুহূর্তে একটু কড়া করেই ধাতাতে হবে দাদাটিকে।
কিন্তু পল্টুদা তো নয়, বনানী। এমনি হাই হ্যালো? নাকি এরও কোনও প্রয়োজন?
মেজাজ নিয়ন্ত্রণে এনে বিদিশা স্বাভাবিক স্বরে বলল, “হ্যাঁ বনানী, বলো। আছ কেমন?”
“চলছে মোটামুটি। আপনি ভাল তো বিদিশাদি?”
“ওই আর কী। এত কাজের চাপে থাকি, ভাল আছি না মন্দ ভাবার অবকাশ পাই না।”
“এখন একটু কথা বলা যাবে? এক-দু’ মিনিট?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।” বলেই যেন সামান্য গুটিয়ে গেল বিদিশা। সতর্কভাবে বলল, “কী হয়েছে?”
“তেমন সিরিয়াস কিছু না। বলছিলাম কি… বড়দা তো রেডিয়েশন থেরাপির পর খুবই কাহিল হয়ে পড়েছিল, এখন মারজিনালি বেটার। কথাটথা বলছে, ঘরের মধ্যে হাঁটাচলা করছে…”
“বাহ, ভাল খবর। তা এবার কি কেমোথেরাপি শুরু হবে?”
“হ্যাঁ দিদি। নেক্সট উইকে। বড়দা তার আগে একবার আঁচলকে দেখতে চাইছিল। উইথ নির্বাণ। আমি আঁচলকে বলেছিলাম। ও বলল আপনাকে জানাতে।”
“ওমা, এর মধ্যে আমি কেন? ও তো যেতেই পারে। যখন খুশি।” বিদিশা সেকেন্ড থামল, “ঠিক আছে, বাড়ি গিয়েই আঁচলকে বলছি। ওরা দু’জনেই যাবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।”
“থ্যাংক ইউ দিদি। আর সময় নষ্ট করব না। ছাড়ি তা হলে?”
গাড়ি সল্টলেকে ঢুকছে। ফোন মুঠোয় রেখে বিদিশা বাইরে তাকাল। একটা চৈত্রের বিকেল ফুরিয়ে আসছে। নিজের ছন্দে। গাছগাছালি ঢাকা পথে ছায়া-ছায়া ভাব। তেমন একটা গাঢ় আবছায়া নয়, তবু কেমন যেন বিষণ্ণতা চারিয়ে দেয় বুকে। মনে হয় কাজকর্ম ছেড়েছুড়ে ঘরের নিরালা কোণে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকি সারাক্ষণ। কেন যে এমন ইচ্ছে জাগে হঠাৎ হঠাৎ? এও কি ক্লান্তির রকমফের? নাকি নিজের সঙ্গে কোনও গোপন যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে বিদিশা?
আবার মোবাইল ফোনের আহ্বান। শিথিল চোখ মনিটরে ফেরাল বিদিশার। পলকে স্নায়ুতে প্রবল আলোচনা। প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও স্বরে উত্তেজনা এসেই গেল, “হ্যাঁ পারিজাতদা, বলো বলো। কী হল শেষ পর্যন্ত?”
‘রক্তিম অভিনন্দন।” ও প্রান্তে পারিজাতের মাঠঘাট চষা গমগমে গলা, “ইউ হ্যাভ ওন দা গেম।”
“বলছ? বলছ?”
“হ্যাঁ গো হ্যাঁ। ভাইস চ্যান্সেলার পোস্টের জন্য পার্টি তিনটে নাম সিলেক্ট করেছে। তুমি, বাসুদেব চ্যাটার্জি আর পবন ঘোষাল।”
“তা হলে… আমি তো এখনও ফাইনাল নই।”
“আহা, ঘাবড়াচ্ছ কেন। নিয়মকানুন বজায় রাখার ব্যাপারটাও তো মানতে হয়। রাজ্যপাল যদি ভুল করেও ওদের কাউকে বাছেন, হি উইল ডিক্লাইন দা পোস্ট। একান্ত ব্যক্তিগত কারণে। দু’জনকেই কড়া ডিকটাম দেওয়া আছে কিনা। অবশ্য তেমনটা ঘটার এক পারসেন্ট সম্ভাবনাও নেই। শিক্ষামন্ত্রী আগেই রাজ্যপালের সঙ্গে বাতচিত করে নেবেন। সব কিছু সেট করার জন্য অনেক লড়তে হয়েছে… যাকে বলে রীতিমতো সংগ্রাম…”
“থ্যাংক ইউ পারিজাতদা। তুমি আজ আমার জন্যে যা করলে…” অবিকল পল্টুদার ভাষাই বেরিয়ে এল বিদিশার কণ্ঠ থেকে, “কী বলে যে তোমায় ধন্যবাদ দেব…”
“আরে ঠিক আছে, ঠিক আছে। দেওয়া নেওয়া মিলিয়েই তো দুনিয়াটা চলছে।” পারিজাত খিকখিক হাসল, “যাক গে, শোনো, কারওকে এখন বলে বেড়ানোর দরকার নেই। যদিও কাল পরশুর মধ্যে সবাই জেনে যাবে। প্রেসকেও নো বাইট। মুখে কুলুপ এঁটে থাকো। আজ তো নাইন্থ এপ্রিল, আগামী ষোলোই ফরমালি রেকমেন্ডেশন পাঠাবে রাজ্য সরকার। এবং ওই দিনই তোমার নাম ডিক্লেয়ার্ড হবে। অফিশিয়ালি। তখন তুমি তোমার মতো করে সাজিয়ে-গুছিয়ে…”
রীতি-প্রকরণ বোঝাচ্ছে পারিজাত। বিদিশা যেন আর শুনতে পাচ্ছিল না। নাইন্থ এপ্রিল শব্দটা ঝাং ঝাং ঘা মারছে মস্তিষ্কে। আশ্চর্য, সারাটা দিন এত গাদাগুচ্ছের সই করল তারিখ দিয়ে, অথচ দিনটাকে সে খেয়ালই করেনি!
আজ সজলের মৃত্যুদিন। এপ্রিলের ন’ তারিখেই তো সেই বিফল অক্ষম হেরে যাওয়া মানুষটা গলায় দড়ি দিয়ে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলে পড়েছিল। কত বছর আগে যেন? আঠেরো? উনিশ? কুড়ি? মাথায় আর থাকে না ঠিকঠাক। কেন যে থাকে না? মরার ঢের আগেই তাকে জীবন থেকে ছেঁটে ফেলেছিল বলে? নাকি সামনে তাকাতে গেলে পিছনের দুঃস্বপ্নকে ভুলে থাকতে হয়?
জানে না বিদিশা। কিন্তু মনটা খচখচ করছে যে। আজকের দিনেই পেতে হল এত বড় সুসমাচারটা?
এ কী নেহাতই কাকতালীয়? নাকি নিয়তির পরিহাস? বিদিশা তাও জানে না।