১৫ আগস্ট, রবিবার ১৯৭১
আমাদের সবার মন খুব খারাপ। গতকাল ভোর ছটায় জুবলী ফোন করে জানাল যে, রাত দেড়টার সময় মিলিটারি এসে রফিককে ধরে নিয়ে গেছে। কোনমতে মুখ-হাত ধুয়ে এককাপ চাপ খেয়ে জুবলীদের বাসায় গেলাম। ঘণ্টাখানেক চুপচাপ বসে থাকলাম। বসে ছিল আরো অনেকে–আতিক, বুলু, রেণু, চামু, প্রতিবেশী কয়েকজন। জুবলী মেঘলা, বর্ষণকে কোলের কাছে নিয়ে শূন্য চোখে স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল। কারো মুখে কথা ছিল না।
আজ ধলুরা ইসলামাবাদ ফিরে গেল।মা ও লালুকে নিয়ে এয়ারপোর্টে গিয়েছিলাম। একটি বোনের সঙ্গে তবু দেখা হলো, আরেকটি বোন বেলু, তার স্বামী আজিজ, তিনটি ছেলেমেয়ে ইসলামাবাদে রয়েছে। তাদের এখন ছুটিতে আসার কোন সম্ভাবনা নেই। তাদের সঙ্গে কবে দেখা হবে, কে জানে। আদৌ হবে কি না তাই বা কে জানে?
এয়ারপোর্ট থেকে ফেরার পথে জুবলীদের বাসায় গেলাম। রফিকের সাথে একই রাতে আরো তিনজন অধ্যাপককে ধরেছে, তারা হলেন–গণিত বিভাগের শহীদুল্লাহ, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সাদউদ্দিন, আর ইতিহাসের আবুল খায়ের।
মা আর লালুকে জুবলীদের বাসায় রেখে আমি আর শরীফ নিউ মার্কেটে গেলাম।
কদিন থেকে সময় পেলেই বিভিন্ন দোকানে একটা জিনিস খুঁজে বেড়াচ্ছি ওয়াটার প্রুফ সিগারেট কেস। ওয়াটার প্রুফ ঘড়ি বাজারে পাওয়া যায় কিন্তু ওয়াটার প্রুফ সিগারেট কেস আজ পর্যন্ত কোন কোম্পানি বানিয়েছে বলে শুনি নি। কদিন আগে রুমী বলেছিল,
আম্মা দেখো তো এমন একটা সিগারেট কেস পাও কি না, যেটার ডালা খুব চেপে লেগে থাকে। মানে পানিতে পড়লে যাতে পানি না ঢোকে। আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, কেন, এরকম সিগারেট কেস কেন?
আমাদের না, অ্যাকশানে গেলে পাক আর্মি বা রাজাকারদের তাড়া খেয়ে অনেক সময় দৌড়ে পালাতে হয়। কখনো পুকুরে বা নদীতে ঝাপ দিতে হয়, কখনো পানির মধ্যে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে শত্রুর দিকে এগোতে হয়, তখন সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই ভিজে গেলে বড় কষ্ট হয়–তাই। কয়েকটা লাইটারও কিনো। তবে দেখো, কোনটাই যেন বেশি চকে বা ফ্যান্সি চেহারার না হয়। তাহলে লোভে পড়ে কোন ছেলে নিয়ে নিতে পারে।
অতএব, আমরা কদিন থেকে ওয়াটার প্রুফ আর পুরনো ঘটা চেহারার সিগারেট কেস আর লাইটার খুঁজে বেড়াচ্ছি। জিন্না এভিনিউতে এক দোকানে একটা পেয়েছিলাম, ডালাটা বেশ শক্ত হয়ে লেগে থাকে কিন্তু চেহারা বড় চর্চকে। তাই নিই নি। নিউ মার্কেটে পেলাম না। বললাম, জিন্না এভিনিউরটাই নিয়ে নেব কালকে। ঝামা দিয়ে ঘষে বাইরেটা ম্যাটমেটে করে নেব। আজ আর ভাল্লাগছে না। বাড়ি চল।
ফেরার পথে এক কার্টন ৫৫৫ সিগারেট কিনে নিলাম পাড়ার রশীদের দোকান থেকে। বিকেলে রুমী বলল, আম্মা, চল তোমাকে এক বাসায় নিয়ে যাই। তোমার মন একদম ভালো হয়ে যাবে।
কোথায়?
আগে থেকে বলব না। সারপ্রাইজ।
মগবাজার চৌমাথা থেকে তেজগাঁও ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ার দিকে একটু এগিয়েই রেললাইন পার হয়ে গাড়ি খানিক সামনে গিয়ে ডাইনে একটা গলিতে ঢুকল। আরো একটুখানি গিয়ে আবার ডাইনে ঢুকে থামল একটা একতলা বাড়ির সামনে–২৮ বড় মগবাজার। দুধাপ সিঁড়ি উঠেই ছোট্ট একটা বারান্দা-রেলিংঘেরা। বারান্দায় চেয়ারে বসে আছে স্বাস্থ্যবান একটি যুবক। উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে আদাব দিল। রুমী বলল, মা, এহলো আজাদ। একেতুমি ছোটবেলায় দেখেছ। অনেক বছর আগে এদের বাসায় আমরা অনেক দাওয়াত খেয়েছি।
মনে করতে পারলাম না কিন্তু ঘরে ঢুকে তার মাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলাম। অনেক বছর আগে–তা দশ-বারো বছর তো হবেই–এঁদের বাড়িতে কতো গিয়েছি, কতো খেয়েছি। আজাদের বাবা মিঃ ইউনুস আহমদ চৌধুরী ব্যবসায়ী ছিলেন, তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছিল আমাদের এক ভাগনে মেহেরের মাধ্যমে। আজাদের মা খুব ভালো রাধতেন। আমরা প্রায় প্রায়ই ছুটির দিনে ওঁদের বাড়িতে দাওয়াতে যেতাম আর আজাদের মার হাতের অপূর্ব রান্না খেয়ে খুব উপভোগ করতাম। ওঁরা প্রথমদিকে পুরনো ঢাকায় থাকতেন। তারপর মিঃ চৌধুরী নিউ ইস্কাটন রোডে বাড়ি বানালেন। বিরাট বাড়ি–আগাপস্তলা মোজাইক, ঝকঝকে দামী সব ফিটিংস, আজাদের মায়ের ড্রেসিং রুমটাই একটা বেডরুমের সমান বড়। সামনে অনেকখানি ভোলা জমি–বাগানের জন্য। এক পাশে হরিণের ঘর, সেখানে চমৎকার এক হরিণ। আজাদ তখন দশ-বারো বছরের ছেলে। তারপর মাঝখানে বেশ কয়েক বছর কেমন করে জানি যোগাযোগটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। লোকমুখে শুনেছিলাম মিঃ চৌধুরী আরেকটা বিয়ে করেছিলেন।
এখন আজাদের মা নিজেই পুরো ব্যাপারটা বললেন, স্বামী আবার বিয়ে করাতে উনি একমাত্র সন্তান আজাদকে নিয়ে স্বামীর সংসার ছেড়ে চলে আসেন বেশ কবছর আগে। আজাদ গত বছর এম.এ পাস করেছে। অনেক দুঃখধান্দা করে ছেলেকে মানুষ করেছেন। এখন আজাদ চাকরি করবে, এখন আর কোন দুঃখকষ্ট থাকবে না।
আজাদের মার দিকে চেয়ে রইলাম। বরাবরই দেখেছি বাইরে স্র মৃদুভাষিণী এবং ভেতরে ভেতরে খুব দৃঢ়চেতা কিন্তু এতটা একরোখা তা জানতাম না। এখন অনেক শুকিয়ে গেছেন, পরনে সরু পাড়ের সাদাসিদে শাড়ি, গায়ে কোন গহনা নেই। আগে দেখেছি–ভরাস্বাস্থ্যে গায়ের রং ফেটে পড়ছে, হাতে-কানে-গলায় সোনার গহনা ঝকমক করছে, চওড়া পাড়ের দামী শাড়ির আঁচলে চাবি বাধা, পানের রসে ঠোট টুকটুকে, মুখে সবসময় মৃদু হাসি, সনাতন বাঙালি গৃহলক্ষ্মীর প্রতিমূর্তি। সেই মিসেস চৌধুরী স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহের প্রতিবাদে তীব্র আত্মসম্মানবোধে এককথায় প্রাচুর্য ও নিরাপত্তার ঘর ছেড়ে চলে এসেছেন।
একটা নিঃশ্বাস চাপলাম। ইস্কাটনের বাড়িটা আজাদের মায়ের নামে। সেই বাড়ি তিনি ফেলে এসেছেন ছেলের হাত ধরে। থাকছেন ভাড়াবাড়িতে।
ছেলেটিকে দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। স্বাস্থ্যবান সুদর্শন যুবক মায়ের মতই সবসময় হাসিমুখ।
আমরা থাকতে থাকতেই একটি ছেলে এল সেখানে, রুমী মৃদুস্বরে পরিচয় করিয়ে দিল, কাজী কামাল উদ্দিন, প্রভিন্সিয়াল বাস্কেটবল টিমের নামকরা খেলোয়াড়। মেলাঘরে পরিচয় হয়েছে। জানো আম্মা, কাজী ভাইকে এবার ন্যাশনাল বাস্কেটবল টিম ক্যাম্পে ডেকেছিল, কিন্তু কাজী ভাই যায় নি।