১৫. আখলাক শব্দের অর্থ

আখলাক শব্দের অর্থ জান?

মীরা আখলাক সাহেবের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বলল, জানি। আখলাক শব্দের অর্থ চরিত্র।

ঠিকই বলেছ, একটু শুধু ভুল করেছ— আখলাক হল সৎ চরিত্র। এখন বল দেখি চরিত্রের আর কী প্ৰতিশব্দ বাংলায় আছে?

মীরা বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকাল। তার কথা বলতে একেবারেই ইচ্ছা করছে না। রাতে জ্বর এসেছিল, সেই জুরের খানিকটা এখনো রয়ে গেছে। গাড়ির জানালার কাচ নামানো। জানালা দিয়ে হাওয়া আসছে। সেই হাওয়ায় শীত শীত লাগছে। এখন শীত লাগার কোনো কারণ নেই। শরীরে যে জ্বর আছে এটাই তার প্রমাণ।

আখলাক গাড়ি চালাচ্ছেন। মীরা বসেছে ড্রাইভারের পাশের সিটে। ক্যাসেট প্লেয়ারে মিউজিকের ক্যাসেট বাজছে। জলতরঙ্গের মত একটা বাজনা। মাঝে মাঝে বাজনা থেমে যায়, তখন খুবই অস্পষ্ট গলায় দুটা মেয়ে হামিং করে। পুরো বাজনোটার মধ্যে ভৌতিক কিছু আছে। মীরা বাজনা শুনছে। বাজনোটা এমন যে মন দিয়ে শোনা যায় না, আবার মন পুরোপুরি সরিয়েও নেয়া যায় না। ছায়ার মত কানে লেগে থাকে।

আখলাক বললেন, মীরা তোমার কি শরীর খারাপ?

সামান্য খারাপ। জ্বর এসেছে নাকি? চোখ এবং নাকের ডগা লালচে হয়ে আছে। সিমটমগুলি ইনফ্লুয়েঞ্জার।

জ্বর থাকতে পারে।

আখলাক হাত বাড়িয়ে মীরার কপালে হাত রাখলেন। হাত ভর্তি সিগারেটের গন্ধ। শরীর ভাল থাকলেই মীরা তামাকের গন্ধ সহ্য করতে পারে না। এখন শরীর খারাপ। রীতিমত গা গুলাচ্ছে। মীরা কিছু বলল না। নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল— কখন তামাক ভর্তি হাতটা সরে যায়। সরতে সামান্য সময় নেবে। কোনো পুরুষ যখন জ্বর দেখার জন্যে কোনো মেয়ের কপালে হাত রাখে। তখন সে যতটা সময় জ্বর দেখার জন্যে দরকার তারচে বেশি সময় নেয়। কপাল থেকে হাতটা সরাসরিও উঠিয়ে নেয় না। হাতটা গাল স্পর্শ করে উঠে। এটাই নিয়ম।  এই নিয়ম মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই। মীরা ক্লান্ত গলায় বলল, আমরা যাচ্ছি। কোথায়?

তোমাকে তো আগেই বলেছি, লং ড্রাইভ। উদ্দেশ্যবিহীন ঘুরে বেড়ানো। ঘণ্টা খানিক ঝড়ের গতিতে গাড়ি চালিয়ে নাৰ্ভ ঠাণ্ড করা। আমার নার্ভ উত্তেজিত হয়ে আছে, নাৰ্ভ ঠাণ্ডা করতে হবে।

গাড়ি তো ঝড়ের গতিতে চালাচ্ছ না।

একটু পরেই শুরু করব। তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব দাও নি।

তোমার প্রশ্নটা কী?

বাংলায় চরিত্র শব্দের কী কী প্ৰতিশব্দ তোমার জানা আছে?

প্ৰতিশব্দ জানা নেই।

আমি বেশ কিছু ডিকশনারি ঘেঁটেছি। আমার কাছে মনে হচ্ছে— বাংলা ভাষায় চরিত্রের তেমন কোনো লাগসই প্রতিশব্দ নেই। চলন্তিকায় চরিত্রের প্রতিশব্দ হল, সদাচার, স্বভাব, চালচলন, আচরণ। এর বেশি কিছু নেই।

না থাকলে কী আর করা!

আখলাক সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, তুমি হয়ত শুনে একটু অবাক হবে। আমি বাংলা ভাষা নিয়ে কিঞ্চিৎ পড়াশোনা করছি। লোকে শিখে ফ্রেঞ্চ, আমি সংস্কৃত শিখব বলে মন ঠিক করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ও পালী বিভাগের একজন শিক্ষক আছেন। তঁর কাছে শিখব। ভদ্রলোক ইন্টারেস্টিং মানুষ। একাহারী। একাহারী মানে জান?

না।

একবেলা খান। দুপুরবেলা। তাও নিরামিষ। গরম ভাত, এক চামচ ঘি, বেগুন ভর্তি এইসব। রাতে যখন ক্ষিধে লাগে। তখন ফল খান। একটা কলা, একটা শশা।

ভালোতো।

তুমি মনে হচ্ছে আমার কথা মন দিয়ে শুনছ না।

বলেছি তো আমার শরীরটা ভাল না। তাছাড়া কথাগুলিও এমন কিছু ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে না।

আখলাক সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, তোমার স্নায়ুতে আমি যদি এখন বড় ধরনের একটা ধাক্কা দিতে পারি তাহলে তোমার জ্বর জ্বল্প ভাব চলে যাবে। শরীর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে। আমার সাধারণ কথাও ইন্টাব্রেস্টিং মনে হবে। ধাক্কা দেব?

কীভাবে ধাক্কাটা দেবে?

স্নায়ুতে ধাক্কা দেবার অনেক টেকনিক আছে। আমি সহজ একটা টেকনিক ফলো করব। খুবই এফেকটিভ টেকনিক- আমি নিজে নিজে চিন্তা করে বের করেছি। আখলাকস টেকনিক নামে টেকনিকের নামকরণ করা যেতে পারে। টেকনিকটা আগে জানতে চাও না direct action-এ যেতে চাও?

টেকনিকটা আগে বল।

আমি করব কী জান? আমি গাড়ির স্পিড় বাড়াতে থাকব। যখন স্পিড় প্রায় একশ কিলোমিটারের কাছাকাছি চলে আসবে তখন লক্ষ করব। উল্টোদিক থেকে আমার কাছাকাছি স্পিডে কোনো ট্রাক বা বাস আসছে কি-না; এরকম কোনো বাস বা ট্রাককে টার্গেট করব। তারপর হঠাৎ চোখের পলকে আমাবু গাড়ি সেই বাসের বা ট্রাকের সামনে নিয়ে চলে যাবে। এত দ্রুত বেগে দুটো গাড়ি আসছে। চট করে এদের থামানো সম্ভব না। কাজেই আমাকে প্ৰস্তুত থাকতে হবে গাড়ি নিয়ে রাস্তার বাইরে চলে যাবার জন্যে। তোমাকে ব্যাপারটা বুঝাতে পেরেছি?

হ্যাঁ।

করব এরকম কিছু? রাজি থাকলে সিট বেল্ট বেঁধে নাও। আর ক্যাসেট প্লেয়ার বন্ধ কর। মোটামুটি রিস্কি খেলা খেলিব তো। নাৰ্ভ ঠাণ্ডা থাকা দরকার।

মীরা সিট বেল্ট পরল। ক্যাসেট প্লেয়ার বন্ধ করল। আখলাক সাহেব বললেন, জানালার সব কাচ নামিয়ে দাও। দরজা আনব্লক করা। গাড়ি যদি উল্টে যায় দরজা ফুলক থাকলে বের হওয়া যাবে না। তোমার ভয় লাগছে নাতো?

না।

আমি তৈরিই আছি।

তুমি সময়মত ট্রাকের সামনে থেকে সরে আসতে পারবে তো?

অবশ্যই পারব। শুধু যদি ট্রাক ড্রাইভার তার সামনে হঠাৎ একটা গাড়ি চলে আসতে দেখে ভড়কে গিয়ে ব্রেকের বদলে একসিলেটরে চাপ দেয় বা আমি যেদিকে গাড়ি সরাচ্ছি। সেও সেদিকে সরায়। সে রকম কিছু ঘটলে ভিন্ন কথা।

এ রকম কিছু ঘটলে তুমি কী করবে? বিকল্প ব্যবস্থা কি ভাবা আছে?

হ্যাঁ আছে। জরুরি বিকল্প ব্যবস্থাগুলি নির্ভর করে পরিস্থিতির উপর।

মীরা লক্ষ করল তার পাশে স্টিয়ারিং হুইল ধরে থাকা মানুষটা বড় বড় করে নিঃশ্বাস ফেলছে। এবং গাড়ির স্পীড ক্রমেই বাড়ছে। মীরা বলল, তুমি এ রকম করে নিঃশ্বাস নিচ্ছ কেন?

আখলাক বলল, বেশি করে অক্সিজেন নিয়ে নিচ্ছি। ব্ৰেইনে যেন প্রচুর অক্সিজেন থাকে সেই ব্যবস্থা। অক্সিজেনের অভাব হলে লজিক্যালি চিন্তা করা যায় না। দূরে তাকিয়ে দেখ একটা ট্রাক আসছে। এই ট্রাকটাকে আমি টার্গেট করলাম।

মীরা লক্ষ করল আখলাকের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। হাত সামান্য কাঁপছে। চোখের দৃষ্টি স্থির। মাথা স্টিয়ারিং হুইলের দিকে সামান্য ঝুঁকে এসেছে; মানুষটা অতি বিপদজনক একটা খেলা খেলতে যাচ্ছে। যে খেলা যত বিপদজনক ততই তার মজা। গভীর বনে মানুষ বাঘ শিকার করতে যায়। সে জানে যে-কোনো মুহুর্তে একটা বাঘ উল্টো দিক থেকে এসে তার ঘাড়ে ঝাপিয়ে পড়তে পারে। সে বিপদের ব্যাপারটা জানে বলেই শিকার শিকার খেলাটা তার কাছে মজার বলে মনে

হয়।

ট্রাক প্রায় চলে এসেছে। মীরা লক্ষ করল তার মুখ দিয়ে গরম বাতাস বের হচ্ছে। আখলাক বলল, মীরা ভয় লাগছে?

মীরা বলল, সামান্য লাগছে। তবে যতটা লাগবে ভেবেছিলাম ততটা লাগছে না। I am enjoying the game.

মীরা চোখ বন্ধ করে রাখ। আমি এক্ষুণি গাড়ি নিয়ে ট্রাকটার সামনে চলে যাব। তারপর ট্রাকটাকে পাশ কাটিয়ে উল্টো দিকের মাঠে গাড়ি নিয়ে যাব। খানিকটা ফাঁকা জায়গা পাওয়া গেছে, কাজেই কোনো সমস্যা নেই। বিসমিল্লাহ বলতে চাইলে বলতে পায়। রেডি গোট সেট গো।

গাড়ি ঝড়ের মত ট্রাকের সামনে চলে গেল। মীরা কোনো দিকে তাকাচ্ছে না। সে তাকিয়ে আছে হতভম্ব ট্রাক ড্রাইভারের দিকে। ট্রাক ড্রাইভার এমন বিস্ময়কর দৃশ্য অনেকদিন দেখে নি।

 

মীরাদের গাড়ি রাস্তার পাশের ফাঁকা জায়গাটায় কান্ত হয়ে আছে। মীরা এবং আখলাক সাহেব দুজনই গাড়ির বাইরে। বিশ পঁচিশ গজ দূরে ট্রাকটা থেমে আছে। মীরাদের ঘিরে ছোটখাট একটা ভিড়। আখলাক সিগারেট টানছেন। তাঁর মুখ বিষণ্ণ। তিনি ট্রাক ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ভাই হঠাৎ করে আমার মাথাটা ঘুরে গেছে। চোখের সামনে দেখি অন্ধকার। এরপর আমার কী হয়েছে কিছুই মনে নাই। আপনি যে হার্ডব্রেক করতে পেরেছেন এটা বিরাট ব্যাপার।

ট্রাক ড্রাইভার অল্প বয়েসী। এত বড় বিপদের মুখোমুখি সে সম্ভবত আগে কখনো হয় নি। তার চোখে ঘোর লেগে আছে। সে পিচ করে থুথু ফেলল।

আখলাক সিগারেটের প্যাকেট ট্রাক ড্রাইভারের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বললেন, নেন ভাই আমার কাছ থেকে একটা সিগারেট খান।

ট্রাক ড্রাইভার সিগারেট নিতে নিতে বলল, আপনে ভাল ড্রাইভার। আমি হার্ড ব্ৰেক দেওনের আগেই আপনি গাড়ি নিয়া মাঠে নেমেছেন। শখের ড্রাইভার এই কাজ পারবে না।

আখলাক বললেন, আল্লাহ বাঁচায়ে দিয়েছে।

ট্রাক ড্রাইভার বলল, এইটা সত্য। আল্লাহ না বাঁচালে বাঁচা সম্ভব না। আপনের কী হয়েছিল বললেন— আন্ধাইর দেখছেন?

জ্বি অন্ধকার। হঠাৎ সব অন্ধকার হয়ে গেল।

এর নাম আঁধি লাগা। মাঝে মাঝে গাড়ির ড্রাইভাররা আন্ধাইর দেখে। বেশির ভাগ সময় রাইতে হয়। হাই বীম দিয়া হেড জ্বালাইয়া চলতেছেন। হঠাৎ মনে হইব- হেড লাইট নিভা। চউখে কিছুই দেখা যায় না। চউখের উপর পর্দা পাইরা যায়।

আখলাক বললেন, আপনার দেরি করায়ে দিলাম। আপনি চলে যান। আমি এখানে কিছুক্ষণ থাকব। মাথাটা ঠাণ্ডা হলে তারপর যাব।

চা খান। গরম চা খেলে উপকার হবে। আর ভাই সাহেব শুনেন বাড়িতে গিয়া একটা মুরগি সদাগ দেন।

আখলাক কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, মুরগি সদগা। অবশ্যই দেব। যাই দেখি চায়ের দোকান পাই কি-না।

ট্রাক ড্রাইভার বলল, একটু সামনে গেলেই পাইবেন। ইদারিসের একটা দোকান আছে, ভাল চা বানায়।

ধন্যবাদ। দেখি ইদারিসের দোকানেই যাই। আপনি কি আরেকটা সিগারেট নেবেন?

 

মীরা ইদারিসের দোকানের সামনে একটা বেঞ্চিতে বসে আছে! আখলাক চা খাচ্ছেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। আখলাক বললেন— মীরা তোমার অসুস্থ ভাবটা দূর হয়েছে না?

মীরা বলল, হ্যাঁ।

সত্যি সত্যি দূর হয়েছে, না-কি এমনি বলছ?

সত্যি সত্যি দূর হয়েছে।

আমার বাকি চিকিৎসা কেমন দেখলে?

ভাল।

আমি তোমার সাহস দেখেও মুগ্ধ হয়েছি। আমি কল্পনাও করি নি তুমি রাজি হবে। এবং শেষ পর্যন্ত চোখ খোলা রেখে তাকিয়ে থাকবে।

আমি সাহসী মেয়ে। অবশ্যি তেলাপোকা দেখে এখনো ভয় পাই।

আখলাকের চা শেষ হয়েছে। তিনি আরেক কাপ চা নিতে নিতে বললেন, মীরা তোমাকে নিয়ে আমি আজ যে বেড়াতে বের হয়েছি তার একটা কারণ আছে। কারণটা বলব?

বল।

গাড়িতে যেতে যেতে বলি– না-কি এখানেই বলব?

এখানেই বল। এখানের পরিবেশটিাতো আমার কাছে খারাপ লাগছে না। রাস্তার পাশে গ্ৰাম্য ধরনের চায়ের দোকান। আকাশ মেঘমেদুর। এই রোদ এই মেঘ। আমার শরীরটাও এখন ভাল। শরীরটাকে নতুন কেনা গাড়ির মত ফিট মনে হচ্ছে।

মনের অবস্থা কী? মনটা কি ফিট?

আমার মন সব সময়ই ফিট। শরীর খারাপ থাকলেও ফিট। শরীর ভাল থাকলেও ফিট। আমার মনের সঙ্গে শরীরের সম্পর্ক নেই। বল তোমার কথা।

আমি বিয়ে করার কথা ভাবছি।

কেন?

বয়স হয়েছে সেই কারণেই বোধহয়। রাত দুপুরে ঘুম ভাঙলে খুবই লোনলি লাগে। কথা বলার মানুষের জন্যে মন টানে।

তোমার বিছানার পাশেই তো টেলিফোন। একগাদা নাম্বার তোমার মুখস্থ। যে কাউকে টেলিফোন করলে সে খুব আগ্রহ নিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলবে।

যার সঙ্গে কথা বলব তাকে ছুঁতে ইচ্ছা করে। মুখে কথা বলব। কিন্তু একটা হাত থাকবে তার গায়ে; তুমি মেয়ে বলে আমার ফিলিংসটা বুঝতে পারছ না। পুরুষদের এই ফিলিংস শুধুমাত্র পুরুষরাই বুঝতে পারে।

মীরা বলল, তোমাকে আমি একটা বুদ্ধি শিখিয়ে দেই। গভীর রাতে তোমার যদি কথা বলার ইচ্ছা করে তুমি টেলিফোনে তোমার পছন্দের কোনো মেয়ের সঙ্গে কথা বলবে। তখন গায়ে হাত রাখার জন্যে তোমার কাজের মেয়েটিকে রাখবে সামনে। সাপও মরাল, লাঠিও ভাঙল না।

আখলাক বললেন, তোমাকে সরাসরি কথাটা বলি। জল স্পর্শ না করে জলের উপর উড়াউড়ি আমার ভাল লাগছে না। I want to marry you. আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।

কেন তুমি কি আমার প্রেমে পড়েছ?

না। আমি তোমার প্রেমে পড়ি নি। প্রেমে কীভাবে পড়তে হয় আমি জানি না। তোমাকে আমার পছন্দ এইটুকু বলতে চাই। বেশ পছন্দ। May be তোমার শরীরটাই আমার পছন্দ।

তোমাকেও আমার পছন্দ।

তাহলে বিয়েতে বাধা কোথায়?

মীরা বলল, বাধা আছে। বিশাল বাধা। সেই বাধাটা হল শুভ্ৰ।

শুভ্র বাধা হবে কেন? Is he in ove with you?

না। শুভ্ৰর স্বভাবও অনেকটা তোমার মত— সেও কাউকে ভালবাসতে পারে না। শুভ্রর সঙ্গে তোমার অনেক মিল আছে।

আখলাক শান্ত গলায় বললেন, হ্যাঁ তা আছে। আমরা দুজন সম্পূর্ণ দুমেরুতে বাস করছি। তারপরেও আমাদের মধ্যে অনেক মিল। একটা সময় ছিল যখন আমি খারাপ পাড়ায় রাত কাটাতাম। নেশা টেশা করতাম। এখন শুনছি শুভ্রও তাই করছে। শুভ্রর সাম্প্রতিক কাণ্ডকারখানা কি তুমি জান?

হ্যাঁ, জানি।

মীরা হাসতে হাসতে বলল, চল গাড়িতে উঠি। তোমার সঙ্গে লং ড্রাইভে এসে খুব ভাল হয়েছে। শরীরটা ঘেমে গেছে। আমার নিজের শরীরটার জন্যেও ঝাঁকি দরকার ছিল। আমি শরীর নির্ভর মানুষ। আমার শরীর চলে যাওয়া মানে সবই চলে যাওয়া। থ্যাংক য়্যু।

 

ইয়াসিন সাহেব ঘুমুতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। প্রস্তুতি পর্ব বেশ দীর্ঘ। দাঁত ব্রাশ করেন। সুতা দিয়ে ফ্লস করেন। গরম পানি দিয়ে হাত মুখ ধোন। মেপে মেপে ওয়ান পয়েন্ট ফাইভ লিটার পানি খান। পানি খাবার পর এক পেগ রোড ওয়াইন খান। তাঁর মদ্যপানের নেশা নেই। রেড ওয়াইন খান হার্ট ঠিক রাখার জন্যে। অষুধ হিসেবে রেডিওয়াইন খেতে হয়। ঘুমুতে যাবার আগে। এইসব নিয়ম কানুন তিনি পেয়েছেন। Natural Heading নামের একটা বিখ্যাত বই থেকে। বইটি তিনি আমেরিকা থেকে এনেছেন। সেখানে এই বই টু মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে। টু মিলিয়নের একটি আছে তাঁর কাছে। শুধু যে আছে তা না। তিনি বইটা মন দিয়ে পড়ছেন। নিয়ম কানুন মেনে চলছেন। নিজস্ব কিছু নিয়মও তার সঙ্গে যুক্ত করেছেন। যেমন ঠিক ঘুমুতে যাবার আগে আগে নিম গাছের ডাল দিয়ে শেষবার দাঁত মাজেন।

ঘুমুতে যাবার সব প্ৰস্তুতি তিনি শেষ করেছেন। নিমগাছের ডাল দিয়ে দাঁত মাজা শেষ হয়েছে। এখন তিনি অপেক্ষা করছেন যে দুগ্ৰাস পানি খেয়েছেন সেই পানি বের হয়ে যাবার জন্যে। পেট ভর্তি পানি নিয়ে ঘুমুতে গেলে মাঝ রাতে ঘুম ভাঙবে। একবার ঘুম ভাঙলে তাঁর আর ঘুম আসে না। একা জীবন যাপন করার এই সমস্যা। একাকীত্বটা ধরা পড়ে। শুধু রাতে ঘুম ভাঙার পর।

দরজার পর্দা সরিয়ে মীরা ঢুকল। বাবার সামনে বসতে বসতে বলল, আজকের মত Natural Healing treatment কি শেষ হয়েছে?

হুঁ।

ঘুমুতে যাচ্ছে না কেন? অপেক্ষাটা কীসের? শেষ বাথরুম এখনো হয় নি?

না।

গল্প করতে এসেছি।

বিশেষ কোনো গল্প?

হ্যাঁ। আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি বাবা।

সেই ভাগ্যবান মানুষটা কে? আমি চিনি? শুভ্ৰ?

না শুভ্ৰ না। আর্কিটেক্ট আখলাকুর রহমান।

মনস্থির করে ফেলেছিস?

হ্যাঁ।

বিয়েটা কবে?

আগামীকাল। দুজনে মিলে কোনো একটা কাজি অফিসে যাব। তুমি হবে সাক্ষীদের একজন।

কোনো উৎসব হবে না?

না। এই বিয়ে টিকবে না বাবা। কাজেই হাস্যকর উৎসবের কোনো অর্থ হয় না।

যে বিয়ে টিকবে না। সেই বিয়েটা না করলে হয় না?

উঁহু। হয় না।

বিয়েটা করতে চাচ্ছিস কেন?

জানি না কেন?

না জেনে তুই কিছু করবি বিশ্বাস হচ্ছে না।

মীরা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বাবা আমি জানি। কিন্তু তোমাকে বলতে চাচ্ছি না।

আমার মেয়ে তাহলে বিয়ে করতে যাচ্ছে!

হ্যাঁ।

My good wishes for you.

মীরা উঠে দাঁড়াল। আবার বসে পড়ল। মীরা বলল, বাবা শোন ছোটবেলা থেকে আমি তোমাকে নিয়ে একটা খেলা খেলতাম। খেলাটার নাম দিয়েছিলাম–Marking game. বিভিন্ন সময়ে বাবা হিসেবে তোমাকে নাম্বার দিতাম। একশর ভেতর নাম্বার দেয়া হত। সব সময় তুমি আমার কাছ থেকে কম নম্বর পেতে। একশতে চল্লিশের উপায় নম্বর আমি তোমাকে কখনোই দিতে পারি নি।

Sorry to hear that.

আজ তোমাকে আমি শেষ বারের মত নাম্বার দিতে এসেছি। কাল আমার বিয়ে হয়ে যাবে। আমি আর কখনোই তোমাকে নাম্বার দেব না। তোমার পরীক্ষা শেষ।

শেষ পরীক্ষায় কত পেলাম রে মা?

শেষ পরীক্ষায় আমি তোমাকে দিলাম। একশতে একশ দশ। একশতে একশ তুমি এম্নিতেই পেয়েছ। দশ আমি দিলাম নিজের থেকে। খুশি হয়ে।

মীরা কাঁদছে। ইয়াসিন সাহেব অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে আছেন। ক্ৰন্দসী। কন্যাকে তার দেখতে ইচ্ছা করছে না। কন্যার ক্রান্দসী রূপের সঙ্গে তার পরিচয় নেই।

কফি খাবি মা? আজ বিশেষ এক রাত কাজেই Natural heading বই এর নিয়ম ভঙ্গ করে কফি খাওয়া যায়। কফি খেতে খেতে গল্প করা।

কফি খেতে ইচ্ছা করছে না বাবা।

ইচ্ছা না করলেও খা।

মীরা বলল, তুমি বোস আমি বানিয়ে আনছি।

ইয়াসিন সাহেব বললেন, ঘরে না বসে ছাদে বসলে কেমন হয়? আকাশে চাঁদ আছে কিনা জানি না। চাঁদ থাকলে খুব ভাল লাগবে।

আমার সিঁড়ি ভেঙে ছাদে উঠতে ইচ্ছা করছে না। তোমার যখন ইচ্ছা— চল।

 

আকাশে চাঁদ নেই। আর থাকলেও চাঁদ দেখা যেত না। আকাশ মেঘে ঢাকা। বাতাস দিচ্ছে। বাতাস মেঘ উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে না, বরং আরো মেঘ জড় করছে।

ইয়াসিন সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, আজ প্রচণ্ড বর্ষণ হবে। বুঝলি মীরা এসি ঘরে বাস করার জন্যে ঝুম বৃষ্টি কখনো বুঝতেই পারি না। আমি ভেবে রেখেছিলাম তোর বিয়ের পর গ্রামে গিয়ে থাকব। টিনের ঘর থাকবে। টিনের ছাদে বৃষ্টি – অসাধারণ ব্যাপার।

আমার কারণে তোমার এই শখ মিটাতে পারছিলে না?

তা না। তবে তুই নিশ্চয়ই— আমার সঙ্গে গ্রামে গিয়ে থাকতে রাজি হতি না।

মীরা কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলল, গ্রামে টিনের ঘরে গিয়ে থাকার শখটা তোমার না বাবা। এই শখটা মার। তুমি ছাদে তার শখ মিটাতে।

ইয়াসিন সাহেব চুপ করে রইলেন। মীরা বলল, আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে মারি প্রতি তোমার এই ভালবাসা কতটুকু সত্য।

সত্য হবে না কেন?

সত্য না হবার সম্ভাবনা আছে। মানুষ অনেক সময় দায়িত্ব পালনের মত ভালবাসে। সে বিশ্বাস করে তার ভালবাসা সত্য ও সুন্দর। আসলে তা না।

ইয়াসিন সাহেব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমি তোর মত জ্ঞানী না মা। তোর কথা সত্যি হতেও পারে। তবে তোর মা প্রায়ই বলত গ্রামে টিনের ঘরে বর্ষ। কাটাতে। কথাটা আমার মাথার মধ্যে ঢুকে গেছে। সত্য ভালবাসার কারণে ঢুকেছে, না দায়িত্ব পালনের জন্যে ঢুকেছে তা জানি না। জানতেও চাই না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *