এখনো আইনত সাবালক হয়নি নবীনকুমার, তবু সে বিপুল অর্থ তছনছ করার সুযোগ পেয়ে গেছে। সে এখনও অর্থের মূল্য বোঝে না। অর্থসম্পদ যে মানুষকে উপার্জন করতে হয়, এ জ্ঞানই যেন তার নেই। তার ধারণা, ও জিনিসটি চাইলেই পাওয়া যায়, এবং বরাবরই সে পেয়ে এসেছে।
বিধুশেখরের বিচক্ষণতায় নবীনকুমারের পিতৃ-সম্পত্তি ক্রমশই বর্ধিত হয়েছে এবং অর্থনীতির এক বিচিত্র নিয়মে তা বিনা আয়াসেই এখন এ রকম বধিত হতেই থাকবে। এক হিসেবে অর্থ জিনিসটা নবীনকুমারের কাছে মূল্যহীন, কারণ জল বা বাতাসের মতন চাওয়া মাত্র পাওয়া যায়।
নবীনকুমার এখন প্রায় প্রতিদিনই ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগরের সঙ্গী। এ বয়সেই সে অনেক জায়গায় ঘুরে, অনেক ব্যক্তিকে দেখে শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরচন্দ্ৰকেই সে তার সবচেয়ে বেশী আদর্শস্থানীয় মনে করেছে এবং মনে মনে তাঁকে বরণ করেছে গুরুর পদে। অন্যান্য ষোড়শ বৎসর বয়স্ক সদ্য যুবকদের মতন সেও দুঃসাহসের অনুরাগী, ঈশ্বরচন্দ্রের চেয়ে বেশী দুঃসাহসী মানুষ সে আর কারুকে দেখেনি। ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গে সঙ্গে থেকে সে বুঝেছে যে, এ দেশে বিধবা বালিকার পুনর্বিবাহ দেওয়া কত কঠিন কাজ। সরকারী আইন পাশ হলেও দেশের অধিকাংশ মানুষই এর ভয়ংকর বিরোধী, এমনকি মুখে যারা সমর্থন জানায়, তারাও অনেকেই কার্যকালে পশ্চাদপদ হয়। ইতিমধ্যে কয়েকটি বিধবার বিবাহ হয়ে গেলেও এখনো নানারকম বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এরই মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র জেদ ধরে আছেন, যদি কোনো বিধবা বালিকা পুনর্বিবাহ চায় এবং তার জন্য উপযুক্ত কোনো পাত্রের সন্ধান পাওয়া যায়, তা হলে তিনি নিজে উপস্থিত থেকে সে বিবাহ দেবেনই। নবীনকুমারেরও সেই একই জেদ। ঈশ্বরচন্দ্র যেমন নিজের অর্থ ব্যয় করেন, সেই রকম নবীনকুমারও প্রত্যেক বিবাহে এক সহস্ৰ মুদ্রা দিয়ে চলেছেন।
নিজের স্বাক্ষর করার অধিকার জন্মায়নি, তাই নবীনকুমার অর্থের জন্য যখন তখন দাবি জানায় তার জননী বিম্ববতীর কাছে। বিম্ববতী একবারও প্ৰত্যাখ্যান করেন না। যদিও পরলোকগত রামকমল সিংহের এস্টেটের আয়-ব্যয়ের প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখেন বিধুশেখর, তবু তিনিও নবীনকুমারের এই খেয়ালী-খরচের প্রতিবাদ করেন না।
নবীনকুমারের বদান্যতার সংবাদ রটে গেছে। সারা দেশে। প্রায় প্রতিদিন সকালেই নবীনকুমারের কাছে একাধিক প্রার্থী আসে। প্রথম প্রথম নবীনকুমার প্রত্যেককেই টাকা দিয়ে দিত বিনা বাক্যব্যয়ে। একদিন ঈশ্বরচন্দ্র তাকে ডেকে সাবধান করে দিলেন। গুড়ের সন্ধান পেলেই যেমন পিঁপড়ে ছুটে আসে, তেমনি টাকার লোভে অনেক দুষ্ট প্রবঞ্চক কিংবা হা-ঘরে হা-ভাতে বিধবা বিবাহের হুজুগে মেতেছে। অনেক সময় তারা কোনো বিধবা বালিকার সঙ্গে কোনোক্রমে নমো নমো করে বিবাহ সাঙ্গ করার পর দু-দশদিন বাদেই পত্নীকে অসহায় অবস্থায় ফেলে পালায়। টাকাটি আত্মসাৎ করাই তাদের উদ্দেশ্য। কেউ কেউ আবার টাকা নেয়। কিন্তু বিবাহও করে না। সুতরাং, ঠিকঠাক অনুসন্ধান না করেই অর্থ দান করা কোনো কাজের কথা নয়। অপাত্রে ব্যয় করলে মূল উদ্দেশ্যটাই নষ্ট হয়ে যাবে।
এক সকালে রাইমোহন এক ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলো নবীনকুমারের কাছে।
লম্বা শরীরটিকে অনেকখানি ঝুঁকিয়ে প্ৰণাম করে রাইমোহন বললো, হুজুর, পঞ্চাশ পূর্ণ কত্তে এলুম!
নবীনকুমার বুঝতে পারলো না। সে সকৌতুক বিস্ময়ে চেয়ে রইলো।
রাইমোহনের সঙ্গীটির বয়েস তিরিশের কাছাকাছি, পরনে মলিন ধুতি ও সাদা মেরজাই, মাথার চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা। মুখখানি চতুষ্কোণ ধরনের। সে একেবারে চিপ করে নবীনকুমারের পায়ে হাত দিয়ে প্ৰণাম করে ফেললো। ধরা গলায় বললো, হুজুর অতি মহান, অতি বিপদে পড়ে আপনার কাচে এয়িচি, আপনি না তরালে আর কোনো ভরসা নেই।
নিজের চেয়ে দ্বিগুণ বয়েসী একজন লোক পায়ে হাত দিয়ে প্ৰণাম করলেও নবীনকুমার বিচলিত হলো না। এই বয়েসেই সে বুঝে গেছে যে, চতুষ্পার্শ্বের অধিকাংশ মানুষের কাছ থেকে আনুগত্য ও সম্মান পাবার জন্যই সে জন্মেছে।
রাইমোহন তার সঙ্গীকে ধমক দিয়ে বললো, ইংলিশে বল, ইংলিশে বল।
তারপর নবীনকুমারের দিকে চেয়ে বিগলিতভাবে হেসে সে বললো, হুজুর, এ অতি রিফর্মড লোক। ইংলিশ জানে।
লোকটি বললো, মোস্ট নোবল সার, মী এ ভেরী আমবল ম্যান, আই প্রে টু ইয়োর বেনাভোলেন্স।
নবীনকুমার জিজ্ঞেস করলো, ব্যাপারটা কী?
রাইমোহন বললো, হুজুর, বেধবাদের জন্য এর মনে বড় দুঃখু! ধনুকভাঙা পণ করেছেল যে, বেধবা ছাড়া বে করবে না। ওর বাপ দাদারা ওর ওপর খড়্গহস্ত, তাই আমি বললুম, চ, হুজুরের কাচে চ একটিবার।
নবীনকুমার বললো, বিধবা বিয়ে করবে? বেশ ভালো কতা। পাত্রী কোথায়? ঠিক হয়েচে?
লোকটি বললো, পাত্রী রেডি সার। আমাদের নেবারের ডটার, সার। অ্যাট জয়নগর-মজিলপুর, মাই বার্থ প্লেস, সার!
রাইমোহন বললো, সব কথা শুনলে দুঃখে আপনার বুক ফেটে যাবে, হুজুর। সে মেয়েটির বে: হয়েছেল মাত্র তিন বচর বয়েসে, আর মাত্র ছা মাস যেতে না যেতেই তার কপাল পোড়ে, সে হতভাগী নিজের সোয়ামীকে চিনলোই না!
নবীনকুমার অস্ফুটভাবে বললো, বিধবার বিয়ের চেয়েও বেশী প্রয়োজন বাল্য বিবাহ বন্ধ করা।
তারপর আবার বললো, বেশ তো, বিদ্যেসাগর মশাইকে বলবো অখন। আজ বিকেলে তোমরাও এসো দেখবেন।
নবীনকুমারের পাশে দাঁড়ানো দুলাল বললো, তিনি মেদিনীপুর গ্যাচেন। কলকেতায় নেই এখুন।
নবীনকুমার বললো, তা হলে একটু রসো, তিনি ফিরে আসুন।
রাইমোহন পকেট থেকে একটি কাগজ বার করে বললো, অপিক্ষে করার আর উপায় নেই, হুজুর। পাত্তর ছাপানো হয়ে গ্যাচে। জানাজানি হয়ে গ্যাচে তো, আর অপিক্ষে করলে মেয়ের বাপ ও বেটীকে কাশী পাটিয়ে দেবে!
—কিন্তু বিদ্যাসাগর মশাই নেই, এখুন বিয়ে হবে কী করে?
—সেইজন্যই তো বললুম, হুজুর, আপনি নিজেই পঞ্চাশ পূর্ণ করুন।
–তার মানে?
–গুণে দেকিচি, এ যাবৎ মোট উনপঞ্চাশটি বেধবার বে হয়েচে এ দেশে। এই বেটি হলে পঞ্চাশ হবে। কাগজে কাগজে ফলাও করে আপনাদের জয়জয়কার বেরুবে। সাগর এখেনে নেই, আপনি নিজেই উদযুগ করে বেটা দিলে তিনি ফিরে এসে কত খুশী হবেন!
—পঞ্চাশ পূর্ণ হবে? তুমি হিসেব করে দেকেচো?
–আজ্ঞে হ্যাঁ, খপরের কাগচেই তো হিসেব বেরিয়েছেল কদিন আগে!
নবীনকুমারের তরুণ হৃদয় এই পঞ্চাশ পূর্ণ হবার সংবাদে বেশ উৎসাহিত হয়ে উঠলো। ইদানীং ইংরেজি ফ্যাসানে সিলভার জুবিলি, গোল্ডেন জুবিলির কথা প্রায়ই শোনা যায়, এও তো সেই রকমই একটা কিছু ব্যাপার। সে আগ্রহের সঙ্গে পড়ে দেখতে লাগলো নিমন্ত্রণ পত্রটি।
বিবাহ হবে বরাহনগর গ্রামে। বর্ষাকাল, পথঘাটের অবস্থা অতি শোচনীয়, নবীনকুমার নিজে বিবাহবাসরে যেতে পারবে কিনা ঠিক নেই, কিন্তু অনুষ্ঠানের যাতে কোনো ত্রুটি না হয়, সে জন্য সব বন্দোবস্তের ভার সে অৰ্পণ করলো রাইমোহনের ওপর। টাকা পয়সার ব্যাপারে কোনো কাপণ্য হবে না।
এর কয়েকদিন পর রাইমোহনকে ডেকে পাঠালেন বিধুশেখর। সিংহ বাড়িতে নয়, নিজের ভবনে। চলাফেরার শক্তি আবার আজকাল অনেকখানি কমে গেছে তাঁর, সহজে গৃহ থেকে নিৰ্গত হন না।
বাহির-বাড়ির বসবার কক্ষে আরাম কেদারায় শুয়ে আছেন বিধুশেখর, হাতে আলবোলার নল। রাইমোহন এসে বসলো তাঁর সামনে, মাটিতে।
কোনো রকম ভূমিকা না করে বিধুশেখর বললেন, তোর হাত-পা বেঁধে, চাবকে পিঠের ছাল-মাংস তুলে দেবো!
রাইমোহন একটুও চমকিত না হয়ে, বরং ঈষৎ হেসে বললো, ছাল-মাংস আর কোতায় হুজুর, আমার শরীরে তো শুধু কয়েকখানা হাড়। মেরে সুক হবে না!
—তোকে ডালকুত্তা দিয়ে খাওয়াবো! ডালকুত্তারা শুকনো হাড় পচুন্দ করে!
—হুজুর ডালকুত্তা পুষেচেন বুঝি? শুনিনি তো! তা সে কুত্তাগুলোর তো শুনিচি বকরাক্ষসের মতন খিদে, এই কখানা হাড়ে কি তাদের খিদে মিটবে?
—নিমকহারাম! আমার ঠেঙে মাস মাস বিশটা করে টাকা পাচ্চিস, আবার আমার সঙ্গেই ফেরেববাজি?
—হুজুর, আর যাই করি, ঐ নেমকহারামি কখুনো আমার কাচে পাবেন না। নুন খাই যার, গুণ গাই তার!
–তোকে বলিচি ছোট্কুর ওপর চোক রাখতে, আর তুই উল্টে তার মাতায় কাঁঠাল ভাঙচিস?
—আপনি নিজেই বলেছেলেন, হুজুর, বেধবার বেতে আপনার আপত্তি নেই, ও ব্যাপারে আপনার মন নরম।
—তা বলে তুই গণ্ডায় গণ্ডায় লোক এনে টাকা-পয়সা একেবারে নয়ছয় করবি! ছোট্কু ছেলেমানুষ, তাকে যা বোঝাবি সে তাই বুঝবে! কিন্তু আমি কি মরে গেচি! তুই কত করে ভাগ পাচ্চিস এক-একটা কেসে?
—একটা পয়সাও নয়। মা কালীর দিব্যি গেলে বলচি! আমার তিন কাল গিয়ে এককালে ঠেকেচে, এখুন। আর আমার টাকা-পয়সার প্রয়োজন কী?
—ঐ যে বরানগরের বিয়েটা।
—সে জন্য কম ঝক্কি পোহাতে হয়েচে আমায়? ও বাড়ির ছোট হুজুরকে তুষ্ট করার জন্যেই তো।
–বেধবা বের গোল্ডেন জুবিলি পূর্ণ হলো, কত হৈ-চৈ, বিদ্যেসাগরও খুশী হয়ে নবীনকুমারকে আশীর্বাদ করেচেন।
—তুই বিদ্যেসাগরকে পর্যন্ত ঠকিয়েচিস! অ্যাতখানি স্পর্ধা তোর! সে বামুন কালকেতায় ছেল না, তাই ফেরেববাজি ধত্তে পারেনি। বরানগরের ওটাকে কি বিয়ে বলে?
—রাইমোহন জিহ্বা কেটে, চোখ বিস্ফারিত করে বললো, বিয়ে নয়? আপনি কী বলচেন, হুজুর? কত লোক দেকেচে! দুশো আড়াইশো লোক—নবীনকুমার নিজে যেতে পারেননি কো, কিন্তু দুলাল গেসলো, সে দেকেচে-খাটতে খাটতে আমার জান কালি!
–চোপ!
—আপনি বিশ্বেস কচ্চেন না, হুজুর। সত্যিই ধুমধাম করে বে হয়েচে, কিসের কিরে কেটে বলবো, বলুন?
—হাঁ, বিয়ে হয়েচে! পাত্রী এক বেশ্যার মেয়ে, তার এই নিয়ে কতবার বিয়ে হলো তার ঠিক নেই। আর পাত্র এক নামকরা মাতাল। তোরই বাড়িতে আশ্রিত! এর নাম বিয়ে, না ফুর্তির খর্চা বাগানো? অ্যাঁ?
রাইমোহন স্তম্ভিত হয়ে গেল। গুণীর প্রতি সম্মান দেখানো উচিত। বিধুশেখরের মতন এত বড় গুণী সে দেখেনি আর। এ বৃদ্ধের এক চক্ষের দৃষ্টিশক্তি নেই, অন্য চক্ষুটিও নিষ্প্রভ, পা অশক্ত, তবু ঘরে বসে বসে এই বৃদ্ধ অতখানি সংবাদ রাখে? এ যে বিস্ময়কর ক্ষমতা!
সে বিধুশেখরের পা চেপে ধরে বললো, হুজুর, আমার জাত-কুল-মান-জ্ঞান কবেই ঘুচে গ্যাচে! বেশ্যার মেয়ে কিংবা চাঁড়ালের ছেলে আমার কাচে সব সমান। দুঃখী মানুষের জাত নেই। আপনি যা বললেন, ওরা তাই, ওরা জাত ভাঁড়িয়েচে, নাম ভাঁড়িয়েচে, কিন্তু ওরা সত্যি বে করতে চেয়েছেল, তাই আমি ওদের বে দিয়িচি!
—পা ছাড়, হারামজাদা! বেশ্যার মেয়ের আবার বিয়ে কী রে? আমন কত বেশ্যা আর তাদের দালালরাই তো স্বামী-স্ত্রী সেজে থাকে। তার জন্য তুই পুরুত ডাকিয়ে ধর্ম রসাতলে দিলি? ওফ!
—হুজুর, ওদেরও তো একটু সাধ হয়। ভদ্রলোকেদের মতন ধুমধাম করে, পাঁচজনকে ডেকে, মন্তর পড়ে বে করার!
—আর বলিসনি, শুনে আমার গা জ্বলে যাচ্চে। তোকে আমি পুলিশে ধরিয়ে দিচ্চিনি, কেন জানিস? এই বিয়ের কতা বেশী জানাজানি হলে বিদ্যেসাগরের মান যাবে। তাকে লোকে আরও বেশী করে টিটকিরি দেবে, তাতে আমাদের ছোট্কুও দুঃখ পাবে! সেইজন্যে! নাকে খৎ দে! নাকে খৎ দে।
—দিচ্চি হুজুর।
—ঐ দরজার চৌকাঠ থেকে এই আমার পা পর্যন্ত। পাঁচবার।
বিনা প্রতিবাদে রাইমোহন শুয়ে পড়ে নাক খৎ দিতে লাগলো। বিধুশেখর দেখতে লাগলেন স্থির দৃষ্টিতে। পাঁচবার হবার পর তিনি কঠোরভাবে বললেন, ফের যদি কখুনো তোকে আমার ওপর চালাকি কত্তে দেকি, তা হলে তোর ভবলীলে তখুনি সাঙ্গ হবে! আর একটা কতা! বিধবার বে নিয়ে ঢলাঢলি যথেষ্ট হয়েচে, আর দরকার নেই! তুই ছাড়াও আরও অনেকে ঠকাচে আর ঠকাবে ছোট্কুকে। তুই এবার ওর মন অন্য দিকে ফেরাবার চেষ্টা কর।
–বেধবা বের হুজুগ একেবারে বন্ধ করে দেবো, হুজুর?
–তুই তা পারবিনি! অতশত দরকার নেই, চলচে চলুক, তুই সুধু ছোট্কুর মন অন্যদিকে ফেরাবার করা!
—দেখুন না। আমি কত কী পারি আর না পারি!
কয়েকদিনের মধ্যেই এক দারুণ গুজবে সারা শহর ম মা করতে লাগলো। সকলের মুখে ঐ এক কথা, অচিরেই, এর নাম হলো, মড়া ফেরার হুজুক।
নদীয়ার রাম শর্মা নামে কে এক পণ্ডিত নাকি গুণে বলেছেন যে, আগামী পনেরোই কার্তিক মড়া ফেরার দিন। অর্থাৎ দশ বছরের মধ্যে যে সব মানুষের মৃত্যু হয়েছে তারা সকলেই সশরীরে ফিরে আসবে।
বড় বড় উৎসব উপলক্ষে রাজা-মহারাজারা যেমন কিছু কয়েদীকে খালাস করে দেন, সেই রকমই স্বর্গের এক দেবতার পুত্রের বিবাহ উপলক্ষে যমালয় থেকে কিছু অতৃপ্ত আত্মাকে ফেরত পাঠানো হবে পৃথিবীতে।
তুষার মণ্ডের মতন, এই সব গুজব যত গড়াতে থাকে তত বড় হয়। সকলের মুখে মুখে ঐ এক কথা! ১৫ই কার্তিক রবিবার মড়া ফিরে আসবে। নদীয়ার পণ্ডিত যখন বলেছেন, তখন তো আর মিথ্যে হতে পারে না। অনেক শোকসন্তপ্ত পরিবার সত্যি সত্যি আশায় আশায় রইলো। যে জননীর সন্তান অকালমৃত, কিংবা যে নারীর স্বামী গেছে, এই সংবাদ শোনার পর তাদের আর রাত্রে ঘুম আসে না! তবে কোনো এক রহস্যময় কারণে, পুরুষ মড়ারাই শুধু ফিরে আসবে বলে শোনা যাচ্ছে, মেয়েদের কথা কেউ বলে না। মৃত নারীরা ফিরে আসুক, তা বোধ হয় কেউ চায়ও না।
নবীনকুমার এই গুজবের কথা নিয়ে হাস্য পরিহাস করছিল, এমন সময় রাইমোহন সে ঘরে প্রবিষ্ট হয়ে বললো, আপনি হাসচেন হুজুর, কিন্তু এদিকে যে লোকে আপনার গুরু ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগরের গুষ্টির তুষ্টি নাশ কচ্চে!
নবীনকুমার দারুণ অবাক হয়ে বললো, সে কি! এর সঙ্গে বিদ্যেসাগর মশাইয়ের সম্পর্ক কি?
—আপনি বুজলেন না? বিদ্যেসাগরের কতায় মেতে যে অ্যাত লোক বেধবা বে কল্পে, এখন মড়া ফিরলে কী হবে?
–তার মানে?
—এক নারীর দুই স্বামী হবে? বেধবা ফের একজনকে বে কল্লে, তারপর আগের স্বামীও ফিরে এলো, তখুন ধুন্ধুমার কাণ্ড হবে না? ধৰ্মই বা কোতায় থাকবে? সব নারী অসতী হয়ে যাবে না!
—দূর, অদ্ভুত কতা যত সব! মড়া কখনো ফেরে? শ্মশানে যাকে দাহ করা হয়েচে, সে আবার ফিরতে পারে!
—আপনি বিশ্বেস না কল্পে কী হবে হুজুর, পথেঘাটে লোকে এই কতাই বলচে! ধরুন, যদি মড়া ফিরেই আসে–
—ধরো যদি কখুনো মাসীর গোঁপ গজায়, তা হলে মেসোর কী হবে? এ যে সেই ধারার কতা!
—হুজুর, আপনি পথেঘাটে একটু সাবধানে বেরুবেন। লোকে আপনাকেও বেধবা বের একজন মুরুব্বি বলে জানে! কী জানি যদি কেউ রাগের বশে আপনাকে হুট করে ইটপাটকেল ছুঁড়ে মারে!
বিকেলবেলা নবীনকুমার সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে দেখলো, ঈশ্বরচন্দ্ৰ অত্যন্ত বিরক্ত, বিরস মুখে বসে আছেন। পথে কিছু লোক সেদিনই তাঁকে টিটকিরি দিয়েছে। এমন সব গালিগালাজ করেছে যে, তা কানে একেবারে আগুনের মত লাগে। মড়া ফেরার মতন একটা হাস্যকর, ছেলেমানুষী গুজবও যে এত সংখ্যক বয়স্ক মানুষ সত্যি সত্যি বিশ্বাস করতে পারে, তা কিছুতেই যেন বিশ্বাস করা যায় না।
আগামী সপ্তাহেই আর একটি বিধবা বিবাহের অনুষ্ঠানের কথা ছিল, লোকজনকে নিমন্ত্রণও করা হয়ে গেছে, কিন্তু হাঙ্গামার ভয়ে তা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। দল বেঁধে লোকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে আর মুণ্ডপাত করছে বিদ্যাসাগরের।
ঈশ্বরচন্দ্র নিরাশভাবে বললেন, হবে না, এ দেশের কিছু হবে না! এমনিতে সবাই নিষ্কমার টেকি, কিন্তু তুমি কোনো সৎ কর্ম করতে যাও, অমনি বাধা দিতে ছুটে আসবে! অনেকে বলছেন, বিধবা বিবাহের ব্যাপার থেকে আমার নাকি এবার সরে দাঁড়ানো উচিত। লোকে নিজের ইচ্ছেয় বিয়ে করে তো করবে!
রাজকৃষ্ণবাবু বললেন, আগে দরকার শিক্ষা বিস্তারের। যতদিন সাধারণ মানুষ নিজের ভালো না বুঝবে…
ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, সেইজন্যই তো আমি ইস্কুল খোলার জন্য গ্রামে গ্রামে দৌড়ে মরছি। কিন্তু তাও বা কাটি? সমুদ্রের তুলনায় এক গণ্ডূষ জল মাত্র!
উপস্থিত অন্য একজন বললো, এই যে বিধবা বিবাহের একটা উল্টো হাওয়া বইলো, আর লোকে সহজে বিধবা বিবাহ করতে চাইবে না।
আর একজন লোক বললো, কিন্তু বিদ্যাসাগর মশায় নিজে গিয়ে গিয়ে বিবাহ দেবেন, তবে লোকে বিধবা বিবাহ করবে, এটাই বা কেমন রকম কথা? এমনভাবে উনি কটি বিয়েই বা দিতে পারবেন!
ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, আমি সারা দেশ ঘুরে ঘুরে বিবাহ দিতে পারবো না তা জানি! আমি বেশী দিন বেঁচেও থাকবো না। কিন্তু আমাদের কয়েকজনের উদ্যোগে পরপর অনেকগুলি বিবাহ সংঘটিত হওয়ালে তারপর লোকের ভয় ভেঙে যাবে, স্বাভাবিকভাবেই বিধবা বিবাহের প্রচলন হবে—এটাই আমি চেয়েছিলাম।
নবীনকুমার বললো, ১৫ই কার্তিকের আর তো বেশী দিন দেরি নেইকো! সে দিনটি কেটে গেলেই লোকে বুজবে যে, ও কতা কত ভুয়ো! একটাও মড়া ফিরবে না!
রাজকৃষ্ণবাবু হাসতে হাসতে বললেন, তা বলা যায় না। দু-চারটি মড়া ফিরতেও পারে!
নবীনকুমার বললো, অ্যাঁ?
ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, তা ঠিক বলেছে, রাজকৃষ্ণ ভায়া। গোছালো গোছালো জায়গায় কিছু ফন্দিবাজ, বুজরুগ প্রাক্তন মড়া সেজে যাবে, দেখো, তাই নিয়ে অনেক শোরগোল হবে। আর সস্তার কাগজওয়ালারা এই সব ঘটনা নিয়ে নাচবে!
নবীনকুমার তখনই মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো।
১৫ই কার্তিক দিনটি এক রবিবার। সেদিন সকাল থেকেই নবীনকুমারের নেতৃত্বে বিদ্যোৎসাহিনী সভার তরুণ সদস্যরা ঘুরতে লাগলো কলকাতার পথে। শহরের বহু লোক সেদিন পথে নেমে এসেছে, উৎসুক চোখ মুখ, মাঝে মাঝেই শোনা যাচ্ছে সমবেত চিৎকার ও হাস্যারোল। কোনো কোনো বাড়ির সামনে মড়া ফিরেচে, মড়া ফিরেচে বলেও ধ্বনি উঠলো।
নবীনকুমার তার দলবল নিয়ে অমনি ঢুকে পড়ে সেই বাড়িতে। সঙ্গে আরও চার-ছজন পেয়াদা এবং একজন উকিল। সিমুলিয়ার এক বাড়িতে এক মুস্কো জোয়ান এক বিধবা নারীর মৃত পতি সেজে ফিরে এসেছে, নবীনকুমারের উকিল তাকে জেরা করতে শুরু করলো। বেশীক্ষণ লাগলো না, আধ ঘণ্টার জেরার মুখে পড়েই জাল মড়া হঠাৎ এক সময় মুক্তকচ্ছ হয়ে পলায়ন করলো।
সারাদিন ঘুরে ঘুরে এরকম নটি জাল মড়াকে সনাক্ত করা হলো। তাদের মধ্যে তিনজনকে সমর্পণ করা হলো পুলিশের হাতে। তখন দেখা গেল, হুজুগে কলকাতার নাগরিকগণ অনেকে আবার নবীনকুমারকেই সমর্থন করছে। তারা নবীনকুমারের দলটির পিছু পিছু যায়, আর ভুয়ো মড়া দেখলেই দুয়ো দেয়।
১৫ই কার্তিকের রাত নির্বিঘ্নে পার হয়ে গেল, কোনো পুনর্বিবাহিতা নারীরই মৃত প্রথম স্বামী ফিরে এলো না।।
এর কয়েকদিন পর নবীনকুমার অসুখে পড়লো।
শীতে শহরের স্বাস্থ্য ভালো থাকে, কিন্তু এ বৎসর শীত বিলম্বিত। অঘ্রাণ মাস এসে গেল, তবু রোদুরের দাহ কমে না যেন। সেই কারণেই বোধ হয় এক উৎকট উদরাময় ছড়াতে লাগলো। পল্লীতে পল্লীতে। এবং টপটপ মানুষ মরতে লাগলো। সেই রোগে।
নবীনকুমারও আক্রান্ত হলো ঐ উদরাময়ে। যা কিছু আহার করে, সঙ্গে সঙ্গে বমি হয়ে যায়। আর বমির পরই উদরে অসহ্য যন্ত্রণা। তিনদিনের মধ্যেই যেন নবীনকুমারের দেহ একেবারে মিশে গোল শয্যার সঙ্গে।
কলকাতার সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসকদের আনা হয়েছে নবীনকুমারের চিকিৎসার জন্য। সারাদিনের মধ্যে সৰ্বক্ষণই পালা করে একজন না। একজন চিকিৎসক থাকলেন গৃহে। তবু দুশ্চিন্তার শেষ নেই। চিকিৎসা ব্যবস্থা নিখুঁতভাবে পরিচালনা করবার জন্য বিধুশেখর এসে রইলেন বিম্ববতীর পাশের কক্ষে। বিম্ববতীকে সান্ত্বনা দেওয়াও তাঁর প্রধান কাজ। তিনি ছাড়া আর কেউ সান্ত্বনা দিতে পারবে না।
মধ্য রাত্রে ঘুম ভেঙে নবীনকুমার দেখলো, তার শিয়রের পাশে তার বালিকা পত্নী সরোজিনী স্থির হয়ে বসে আছে। দ্বারের কাছে বসে ঢুলছে দুজন দাসী। বাইরে চেয়ারের ওপর উপবিষ্ট মেডিক্যাল কলেজের একজন ছাত্র।
তৃষ্ণায় কণ্ঠ এমনই শুষ্ক যে, নবীনকুমার কোনো কথা বলতে পারছে না। হাতের ইঙ্গিতে সে জল চাইলো। সরোজিনী অমনি কাচের জার থেকে মিছরি ভেজানো জল ছোট পাথরের গেলাসে ঢেলে এনে দিল স্বামীকে।
সেই জল পান করে নবীনকুমার সভয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। এখুনি বুঝি বমি হবে। জল পেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যথা শুরু হয়ে গেছে।
একটুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও বমি হলো না, পেটের মধ্যে ব্যথাটা অবশ্য চলতেই লাগলো। আরও একটু জল পান করলো নবীনকুমার। বমি হয় হোক, তবু এই তৃষ্ণা সহ্য করা যায় না।
তারপর মাথাটা একটু উঁচু করে বললো, সরোজ, তুমি শুয়ে পড়ে। আর কত রাত জগবে?
সরোজিনী বললো, না, না, আমি ঠিক আচি। আপনি ঘুমোন!
—তুমি কতক্ষণ ঠায় বসে থাকবে? তুমি আমার পাশে শুয়ে পড়ে।
—না, না, আমি ঘুমোবো না। আপনার কষ্ট হচ্চে?
—খুব! পেটে অসহ্য ব্যথা।
—পেটে হাত বুলিয়ে দিই?
সরোজিনী এগিয়ে এসে তার কচি, নরম হাত নবীনকুমারের বুকে-পেটে বুলিয়ে দিতে লাগলো। কিন্তু এ এমনই ব্যথা যে, ওপর থেকে সেবা-যত্ন করলেও তার কোনো হেরফের হয় না। জাগরণের বদলে নিদ্ৰাই নবীনকুমারের ভালো ছিল। জেগে উঠলেই তৃষ্ণা, তারপর তৃষ্ণা-নিবৃত্তির জন্য জল পান করলেই এই ব্যথা। এই জন্য নবীনকুমারের আর জগতেই ইচ্ছে করে না।
এক সময় সে সরোজিনীর হাতটা চেপে ধরে বললো, সরোজ, তোমায় একটা কতা বলবো?
–কী?
—তুমি শুনবে?
—ওমা, আপনার কতা শুনবো না?
—শুধু শোনা নয়। আমি একটা অনুরোধ কর্বো, তুমি রাকবে?
—নিশ্চয়ই।
—তুমি আমার গা ছুঁয়ে শপথ করো।
—এই তো, আপনার হাত ছুঁয়েই তো রয়িচি। আপনার সব কতা রাকিবো—
ব্যথার মধ্যে ঈষৎ হাঁপাতে হাঁপাতে নবীনকুমার বললো, সরোজ, আমি যদি হঠাৎ মরে যাই তুমি সারা জীবন বিধবা হয়ে থেকে না। তুমি আবার বে করো। এই আমার দিব্যি রইলো। আমি যদি মরেই যাই, তা হলে আবার বে কল্পে আমার আত্মা তৃপ্তি পাবে!