১৫. অফিসের কাজ মীরার মনে ধরেছে

অফিসের কাজ মীরার মনে ধরেছে

অফিসের কাজ মীরার মনে ধরেছে।

তেমন কিছু করার নেই। সেজেগুজে বসে থাকাই মনে হচ্ছে কাজের প্রধান অংশ। দ্বিতীয় অংশ হচ্ছে অফিস পলিটিক্স। দুটি প্রধান দল আছে অফিসে। জি.এম. সাহেবের দল, এন্টি জি.এম. দল। দুদলই চেষ্টা করছে মীরার মন ফেরাতে। এন্টি জি.এম. দলের প্রধান–মোসাদেক সাহেব একদিন মীরাকে অফিস কেন্টিনে চা খাওয়াতে নিয়ে গেলেন এবং নানান কথার ফাঁকে এক সময় নিচু গলায় বললেন, আপনার বয়স অল্প, আপনাকে একটা কথা বলছি শুনে রাখুন, জি.এম. সাহেব যদি গাড়িতে লিফট দিতে চান–এভয়েড করবেন। কী জন্যে এভায়েড করতে বলছি জিজ্ঞেস করবেন না। আমার পক্ষে বলা সম্ভব না।

মীরা হেসে বলল, ঠিক আছে জিজ্ঞেস করব না।

মোসাদেক সাহেব খানিকটা বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। তিনি ভেবেছিলেন মীরা শোনার জন্যে অনুরোধ করবে, তখন রসিয়ে গল্পটা বলা যাবে।

মিস মীরা, আপনি আছেন যখন সবই শুনবেন। এইসব হচ্ছে ঘরের কথা। কাউকে বলাও যায় না—সহ্য করাও যায় না।

জি.এম. সাহেবকে মীরার বেশ পছন্দ হলো। ভদ্রলোক হাসিখুশি। মহিলা কর্মচারী আশপাশে থাকলে তার হাসিখুশির পরিমাণটা বেড়ে যায়। এছাড়া অন্য কোনো দোষ মীরার চোখে পড়ল না।

জি.এম. সাহেব মীরাকে বললেন, আপনি কি রিকশায় যাওয়া-আসা করেন?

জ্বি সার, তবে মাঝেমধ্যে ভাইয়ের গাড়িতে আসি।

ভবিষ্যতে আর রিকশায় যাওয়া-আসা করবেন না। অফিসারদের আনা-নেয়ার জন্যে গাড়ি আছে। ঐ গাড়িতে যাবেন-আসবেন। মাঝে মধ্যে আমার গাড়িতেও যেতে পারেন। কোনো অসুবিধা নেই। বললেই হবে। আমি ঐদিক দিয়েই যাই।

থ্যাংক ইউ স্যার।

কাজকর্ম কেমন লাগছে?

ভালো। অবশ্যি কাজকর্ম তেমন কিছু তো নেই।

হবে। ধীরে ধীরে হবে। আপনার পোস্টটা নতুন ক্রিয়েট করা হয়েছে। এই পোস্ট আগে ছিল না। মইন সাহেবের জন্যেই ক্রিয়েট করা। ইনি আপনার কে হন?

দূর সম্পর্কের আত্মীয়।

খুব চমৎকার মানুষ। তাই না মিস মীরা?

জ্বি চমৎকার মানুষ।

শুনলাম। তিনি বিদেশে ফিরে যাচ্ছেন না। দেশে সেটেল করবেন। শুনে ভালো লাগল। তার মতো একটিভ, ইনোভেটিভ মানুষ হচ্ছে দেশের সম্পদ। দেশ গড়ার কাজে এদের মতো লোক দরকার–তাই না?

মীরা কিছু বলল না।

মইন ফিরে যাচ্ছে না, দেশেই থাকছে–এই খবর তার জানা ছিল না। মীরার সঙ্গে শেষ দেখা জার্মান কালচারাল সেন্টারে। মীরার ধারণা ছিল। উনি চলে গেছেন। মীরা অবশ্যি খোঁজ নেয় নি। একবার খোঁজ নেয়া উচিত ছিল। কেন জানি খোঁজ নিতে ইচ্ছা! করে নি।

মানুষের জীবনে মাঝে মাঝে কিছু সময় আসে যখন কোনো কিছুই ভালো লাগে না। মীরার এখন এই সময় যাচ্ছে। ভালো লাগার একটা ভঙ্গি করে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিন্তু তার কিছু ভালো লাগছে না। কখনো কখনো তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হয়–আমার কিছু ভালো লাগছে না। কিছু না। সে অনেক চিন্তা করেছে, এরকম হচ্ছে কেন? মনজুরের অভাব কি সে বোধ করছে? তা তো না। তার জীবনের শূন্য অংশ মনজুর ভরাট করতে পারে নি। কাজেই তার অভাবে কাতর হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। অন্য কোনো ব্যাপার। কী ব্যাপার তা সে ধরতে পারছে না। নিজেকে সে যতটা বুদ্ধিমান ভাবত এখন মনে হচ্ছে সে ততটা নয়। তার সমস্যাটা কেউ ধরে দিতে পারলে চমৎকার হত। একজন সাইকিয়াট্রিন্টের কাছে গেলে কেমন হয়। আছে এমন কেউ? তাকে গিয়ে সে কী বলবে? ছোট বাচ্চাদের মতো বলবে–‘আমার কিছু ভালো লাগছে না।’ রোগ হয়েছে। আপনি সারিয়ে দিন।

 

মীরার অফিস ছুটি হয় চারটায়।

ছুটির পরপর তার বাসায় ফিরতে ইচ্ছা করে না–বাসায় ফিরে সে কী করবে? নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকবে?

বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে যেতে ইচ্ছা করে না। তাঁর বন্ধুবান্ধব নেই। যারা আছে তাদের সঙ্গে গল্প বেশিদূর চালানো যায় না। মেয়েলি গল্পের বাইরে তারা যায় না কিংবা যেতে পারে না।

আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে সে সব সময় দূরে দূরে থেকেছে। এখন আরো বেশি দূরে থাকতে ইচ্ছা করে। তাদের কারো সঙ্গে দেখা হলেই অস্বস্তি, চট করে বিয়ে ভাঙা সমস্যায় চলে আসেন। সমস্ত চোখে-মুখে বিষাদের ভঙ্গি এনে বলেন–বুঝলি মীরা সবই কপাল। যা হবার হয়ে গেছে। এখন আবার নতুন করে জীবন শুরু করা। কী আর করবি? বেঁচে তো থাকতে হবে।

নতুন সংসার যাতে শুরু করতে পারে সেই দুশ্চিন্তাতেও তার আত্মীয়স্বজন অস্থির। প্রায়ই খোঁজ আনছেন, ছেলের ছবি নিয়ে আসছেন। যে ছেলে আগে বিয়ে হয়ে যাওয়া একটি মেয়েকে বিয়ের ব্যাপারে আগ্ৰহী।

মীরার ছোট ফুপু এক ছেলের খোঁজ আনলেন–খুব নাকি চমৎকার ছেলে। ভালো বংশ, ভালো টাকা পয়সা, ভালো চেহারা। ছেলের আগে বিয়ে হয় নি, এখন বিয়ে করতে চায়। তবে কুমারী মেয়ে নয়, বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্তা।

মীরা বলল, এই ছেলে তো পাগল। আপনি শেষ পর্যন্ত একটা পাগল ছেলের খোঁজ আমার জন্যে নিয়ে এলেন?

ফুপু চোখ কপালে তুলে বললেন, পাগল বলছিস কী? স্মার্ট ইয়াং ছেলে, সুন্দর চেহারা।

স্মার্ট ইয়াং ছেলে বিধবা ছাড়া বিয়ে করতে চায় না–এর মানে কী? ছেলে কি বিদ্যাসাগরের চ্যালা?

এখনই এত রেগে যাচ্ছিস কেন? আগে ছেলের সঙ্গে কথা বল। তারপর রাগারাগি করবি।

আমি ঐ ছেলের সঙ্গে কথা বলব না। তোমার সঙ্গেও না। তুমি আর এ বাড়িতে এস না।

তোর নিজেরই মাথাটা খারাপ হয়েছে মীরা।

তা ঠিক। মাথা আমার নিজেরই খারাপ।

এই সন্দেহ আজকাল মীরার হচ্ছে। তার কি মাথা খারাপ? এমন কিছু কি তার মধ্যে আছে যার জন্যে তার লজিক মাঝে মাঝে এলোমেলো হয়ে যায়? আছে। নিশ্চয়ই আছে। মস্তিষ্কের সেই অংশটা কি ঠিক করা যায় না?

জি.এম. সাহেব বললেন, মিস মীরা আজ আমি সাড়ে তিনটার দিকে অফিস থেকে বেরুব। একটা বিয়ের পার্টি আছে। গিফট কিনতে হবে। ভলো গিফট কোথায় পাওয়া যায় বলুন তো?

মীরা বলল, ভালো বলতে আপনি কী বোঝাচ্ছেন?

ভালো মানে, যা দেখে তারা এপ্রিসিয়েট করবে। আমার রুচির প্রশংসা করবে।

মীরা বলল, আজকাল রুচিটুচি কেউ দেখে না। উপহারটার দাম কত তাই দেখে। আপনি দামি একটা কিছু কিনে দিন তাহলেই হবে।

কী দেব বলুন তো?

আপনার বাজেট কত স্যার?

হাজার খানিক। এরচে’ কম হলেই ভালো।

শাড়ি দিয়ে দিন।

আপনি কি আমাকে পছন্দ করে দিতে পারেন? অবশ্যি আপনার যদি সময় থাকে। আমার আবার রুচি বলে কিছু নেই। একবার আমার স্ত্রীর জন্যে একটা শাড়ি কিনেছিলাম। শাড়ি দেখে সে বলল–এটা লুঙ্গির কাপড়। আমি নাকি থান থেকে সাড়ে তিন গজ লুঙ্গির কাপড় কিনে এনেছি।

মীরা হাসল।

পুরনো রসিকতা। সব স্বামীই স্ত্রীর জন্যে শাড়ি কেনা নিয়ে এই একটি রসিকতাই করে। এবং মনে করে খুব উচ্চ শ্রেণীর রসিকতা করা হলো।

মিস মীরা।

জ্বি স্যার।

আমার স্ত্রী, অন্য দশজন মানুষের স্ত্রীর মতো না। অন্য দশজন শাড়িটাকে লুঙ্গির কাপড় বলে খানিকক্ষণ চিৎকার চেচামেচি করবে, তারপর অনুতপ্ত হয়ে সেই শাড়ি পরে বলবে–পরার পর তো ভালোই দেখাচ্ছে! তোমার রুচি খুব খারাপ না।

আপনার স্ত্রী কী করলেন?

সে ঐ শাড়ি কেটে আমার জন্যে তিনটা লুঙ্গি বানিয়ে দিল। সে লুঙ্গি আমাকেই পরতে হলো।

মীরা কিছু বলল না। সাধারণ রসিকতার গল্প এখন সেনসেটিভ পর্যায়ে চলে গেছে। এখন কিছু না বলাই ভালো।

আপনার কি সময় হবে মিস মীরা? জ্বি স্যার হবে। তাহলে চলুন যাই। শাড়ি কোথায় পাওয়া যায় তাও তো জানি না–শাড়িটাড়ি মধ্যে আর ঐ কেনে। খুব আগ্রহ নিয়ে কেনে। তবে আজকেরটা কিনবে না। কারণ কি জানেন?

জ্বি না।

অনুমান করতে পারেন?

না—তাও পারছি না।

যে মেয়েটির বিয়ে হচ্ছে সে আমার দিকের আত্মীয়। আমার দিকের আত্মীয়ের কোনো কর্মকাণ্ডে সে থাকবে না। বিয়েতেও সে যাবে না–সাজগোজ সে করবে। ঠিকই। গাড়িতে উঠার আগ মুহূর্তে বলবে–মাথা ধরেছে, বমি বমি লাগছে। বলেই ছুটে বাথরুমে ঢুকে গলায় আঙুল দিয়ে হড়হড় করে বমি করবে। তখন বাধ্য হয়ে আমাকে বলতে হবে–থাক যেতে হবে না। এই হচ্ছে আমার জীবন। অনেক কথা আপনাকে বলে ফেললাম, চলুন যাওয়া যাক।

শাড়ি কেনা হয়ে গেল পনের মিনিটে। দোকানদার কয়েকটা শাড়ি মেলে ধরল। মীরা সাদা জামদানির উপর নীল লতাপাতা আঁকা একটা শাড়ি তুলে নিয়ে বলল— এইটা নিন স্যার। চমৎকার।

জি.এম. সাহেব বললেন, আরেকটু ঘুরেফিরে দেখলে হয় না?

শুধু শুধু হাঁটহঁটি করে কোনো লাভ নেই–এটা ভালো শাড়ি। আপনি আমার রুচির উপর ভরসা করেছেন–এটাই নিন। আমি এখান থেকে বিদায় নেব। বইয়ের দোকানে খানিকক্ষণ ঘুরব।

আমি খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে পারি।—তারপর আপনাকে নামিয়ে দেব।

স্যার কোনো দরকার নেই।

মীরা বইয়ের দোকানগুলাতে বেশ কিছু সময় কাটাল। তিনটা বই কিনল— তিনটিই কবিতার। বই তিনটিই তার আছে। তবু কিনল কেন কে জানে? মানুষের কিছু কাজকর্ম আছে চট করে যার ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব হয় না। অবচেতন মনে কোনো ব্যাখ্যা হয়তো আছে যা এই মুহুর্তে মীরা নিজেও জানে না।

মীরা ঘড়ি দেখল। মোটে চারটা বাজে। কী করা যায়? মনজুরের খোঁজে কি একবার যাবে? অফিস ছুটি হয়ে গেছে। তাকে এখন অফিসে পাওয়া যাবে না। আগের বাসায় গেলেও তাকে পাওয়া যাবে না। বাসা বদলে সে তার মেজো মামার কাছে গিয়ে উঠেছে নিশ্চয়ই। সেখানে যাওয়া যেতে পারে। তবে ঐ লোকটিকে তার নিতান্তই অপছন্দ। অশিক্ষিত, অশালীন গ্ৰাম্য ধরনের মানুষ। মনজুরের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করে মীরা যখন তার বাবার বাড়িতে চলে এসেছে তখনকার ঘটনা। বদরুল আলম এক সন্ধ্যাবেলায় দুই কেজি মিষ্টি নিয়ে উপস্থিত। অতি নম্র গলায় বললেন, মা’র কাছে ছেলের একটা আবদার। আবদার রক্ষা না করলে ছেলে এই বাড়ি থেকে যাবে না। মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে। হাতি দিয়ে টেনেও ছেলেকে নড়াতে পারবে না মা।

মীরা শুকনো গলায় বলেছে— বলুন কী আবদার।

মনজুরের কাছে শুনলাম–তুমি ওকে ছেড়ে এই বাড়িতে চলে এসেছি। এখন মা জননী তুমি আমার সঙ্গে চল। বাইরে একটা বেবীট্যাক্সি আছে। দাঁড় করিয়ে রেখেছি।

বাইরে বেবীট্যাক্সি আছে?

হ্যাঁ মা।

দেখুন মামা, আমি রাগের মাথায় হুট করে চলে আসি নি। আমি পুরো এক বছর এটা নিয়ে চিন্তা করেছি। ভেবেছি। রাতের পর রাত নির্মুম কাটিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মনজুরের সঙ্গে কথা বলেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মনজুর কি আপনাকে এখানে পাঠিয়েছে?

না–আমি নিজেই এসেছি। মনজুর যদি শোনে সে রাগ করবে। তাকে তুমি এই বিষয়ে কিছু বোলো না।

আমি কিছুই বলব না। আপনি চা খান। চা খেয়ে চলে যান।

বদরুল আলম সাহেবের নিশ্চয়ই অনেক কিছু বলার ছিল। সব গুছিয়ে রেখেছিলেন। মীরার শীতল চোখের সামনে সব এলোমেলো হয়ে গেল। চা না খেয়েই চলে গেলেন।  দ্বিতীয় দিন আবার এলেন সঙ্গে দু কেজি মিষ্টি। তৃতীয় দিন আবার সঙ্গে সেই মিষ্টি।

মীরা বাধ্য হয়ে মনজুরকে বলল সে যেন তার মামাকে সামলায়। নির্বোধ ধরনের মানুষকে সামলানো বড়ই কঠিন কাজ।

সেই মামার কাছে মনজুরের খোঁজে যাওয়ার কোনো অর্থই হয় না। ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ একটা ব্যাখ্যা দাঁড়া করবেন। ভেবে বসবেন–সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে; আবারো হয়তো লোক পাঠিয়ে দু কেজি মিষ্টি আনাবেন। কোনো দরকার নেই। তারচে’ মইনের কাছে যাওয়া যেতে পারে। তাকে পাওয়ার সম্ভাবনাও খুব কম। তবু চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। এই চাকরিটি তার কারণেই হয়েছে। সেই হিসেবে ধন্যবাদ তো তার প্রাপ্য।

নিউ মার্কেট থেকে বের হয়ে মীরা রিকশা নিল। রিকশায় উঠতে উঠতে মনে হলো–ভালো লাগছে না। কিছু ভালো লাগছে না। বেঁচে থাকা, খাওয়া, ঘুমানো, বেড়ানো–সব অর্থহীন মনে হচ্ছে–কী যেন সেই কবিতাটা?

অর্থ নয় কীর্তি নয় সচ্ছলতা নয়…

রিকশাওয়ালা বলল, কই যাইবেন আম্মা?

মীরা চমকে উঠল। এত মিষ্টি গলায় অনেক দিন তাকে কেউ আম্মা ডাকে নি। অজানা অচেনা অপুষ্টিতে জড়োজড়ো বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা এত মিষ্টি করে তাকে আম্মা ডাকিল? এত মমতা ছিল তার গলায়?

মীরা বলল, আপনি সোজা যেতে থাকুন। আমি আপনাকে বলব।

জ্বি আচ্ছা আম্মা। মীরার মন ভালো হতে শুরু করেছে। কেন?

মীরা জানে না। মইনের বাসায় যাবার আগে একবার কি মনজুরের অফিস দেখে যাবে? এত বড় কোম্পানির মালিক সে, নিশ্চয়ই পাঁচটা বাজতেই বাসায় চলে যায় না। তাকে নিশ্চয়ই অনেক কাগজপত্র সই করতে হয়।

আসব?

মনজুর হাসিমুখে বলল, এস।

তোমার বসগিরি দেখতে এলাম।

খুব ভালো করেছ।

শরীর কেমন?

ভালো। মাঝখানে খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ডায়ালিসিস করার পর ঠিক আছে। সেই সঙ্গে চলছে আয়ুৰ্বেদী চিকিৎসা—‘নলাদি ক্বাথ’ খাচ্ছি।

‘নলাদি ক্বাথ’টা কী জিনিস?

গোবর পানিতে গুললে যে বস্তু হয় তার নাম নলাদি ক্বাথ, কিডনির মহৌষধ বলতে পার।

এখন তাহলে আয়ুৰ্বেদী চিকিৎসাও চলছে?

যে যা বলছে তাই করছি। একজন হালুয়া ঘাট থেকে পীর সাহেবের পানি পড়া এনে দিলেন–তাও খেলাম।

কেন করছ এসব?

আগ্রহ করে তারা নানান চিকিৎসার কথা বলে। তাদের খুশি করার জন্যে কিছুতেই না করি না। মানুষকে খুশি করতে আমার ভালো লাগে। তুমি কিছু খাবে মীরা?

না।

পেঁপে খেতে পারো। কুদ্দুস নামে আমার এখানে একজন কর্মচারী আছে–সে রোজ নিউ মার্কেট থেকে পেঁপে কিনে এনে বলছে, নিজের গাছের পেঁপে স্যার। বাবার হাতে পোঁতা গাছ। কুদ্দুস খুব পিতৃভক্ত। তার সব গাছই থাকে বাবার হাতে পোঁতা।

মীরা তার ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছতে মুছতে বলল, রসিকতা করার চেষ্টা করছি বলে মনে হয়।

রসিকতা পছন্দ হচ্ছে না?

না। আজ তাহলে উঠি।

মীরা উঠে দাঁড়াল।

মনজুর দুঃখিত গলায় বলল, সত্যি সত্যি উঠছ? বস না একটু। আমার সঙ্গে এক কাপ চা খাও।

এক জায়গায় যাব। দেরি হয়ে যাবে, সন্ধ্যার পর রিকশায় যেতে ভয় ভয় লাগে।

আমার সঙ্গে গাড়ি আছে–যেখানে যেতে চাও নিয়ে যাবে।

ও আচ্ছা, তোমার তো এখন গাড়ি আছে। ভুলেই গিয়েছিলাম। তাহলে খানিকক্ষণ বসা যায়। বল, চা আনতে বল। ভালো কথা, ডোনার পাওয়া গেছে?

হ্যাঁ। নাম আমানুল্লাহ।

মীরা অতি দ্রুত চা শেষ করে ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়াল। মনজুর বলল, চল আমিও তোমার সঙ্গে যাই। তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যাব। তুমি যাবে কোথায়–মইন সাহেবের কাছে?

মীরা খানিকটা হকচকিয়ে গেল।

নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, হ্যাঁ। তুমি উনাকে চেন?

উনি একদিন আমার কাছে এসেছিলেন।

কী জন্যে?

এমনি বোধহয় এসেছিলেন। কথাবার্তা বলার জন্যে।

মীরা নরম গলায় বলল, তাঁর প্রতি এক সময় আমার ভয়ঙ্কর রকম টান ছিল তা কি উনি বলেছেন?

মনজুর হেসে বলল, সবই বলেছেন। কিছুই বাদ দেন নি। আমার কি মনে হয় জান? আমার মনে হয়। ভদ্রলোক তোমাকে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে চান। তোমাকে কী করে বলবেন বুঝতে পারছেন না।

তুমি তোমার উর্বর মাথা থেকে এটা বের করলে?

হ্যাঁ। আমার কিডনি ফেল করতে পারে, ব্রেইন ফেল করে নি।

করেছে। কারণ তুমি জান যে মইন ভাই তাঁর স্ত্রী এবং বাচ্চাদের নিয়ে খুব সুখে আছেন।

মনজুর সহজ গলায় বলল, আমি যতদূর জানি তাঁর স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে লুসিয়ানায় চলে যাবার পরই তিনি দেশে এসেছেন। ফিরে যাবেন না বলেই এসেছেন।

উনি নিজে তোমাকে বললেন?

হ্যাঁ। এবং আমার কি মনে হয় জান মীরা, আমার মনে হয় তোমার উচিত তাঁকে বিয়ে করা। এই ভদ্রলোকের প্রতি তোমার যে প্ৰচণ্ড মোহ ছিল তার সবটাই এখনো আছে। আছে বলেই আমার সঙ্গে থাকতে পারলে না। আমার মধ্যে তুমি মইন সাহেবের ছায়া দেখতে চেয়েছিলে। তা কি সম্ভব? আমি হচ্ছি আমি।

মীরা কিছু বলল না।

গাড়িতে উঠেও চুপ করে রইল। মনজুর বলল, মনে হচ্ছে তোমার মন খারাপ করিয়ে দিয়েছি। সরি।

মীরা বলল, সরি হবার কিছু নেই।

মনজুর বলল, তোমার মোহ প্রসঙ্গে যা বললাম তা কি ভুল?

না, ভুল না।

ভুল না হলে তুমি এত লজ্জিত বোধ করছ কেন?

লজ্জিত বোধ করছি না তো!

করছি। খুব মন খারাপ করেছ। প্লিজ মন খারাপ করবে না। আমার সঙ্গে তিনটি বছর তোমার খুব খারাপ কেটেছে। খারাপের পর ভালো আসে। সামনের দিনগুলো তোমার ভালো যাবে। আমি একশ ভাগ নিশ্চিত।

মনজুর মীরাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *