অনুরাগ—সখী সম্বোধনে
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। তুড়ি ।।
কানড় কুসুম জিনি, কালিয়া বরণ খানি,
তিলেক নয়নে যদি লাগে।
ছাড়িয়া সকল কাজ, জাতি কুল শীল লাজ,
মরিবে কালিয়া অনুরাগে।।
সই! আমার বচন যদি রাখ।
ফিরিয়া নয়ন কোণে, না চাহিও তার পানে,
কালিয়া বরণ যার দেখ।।
পিরীতি আরতি মনে, যে করে কালিয়া সনে,
কখন তাহার নহে ভাল।
কালিয়া ভূষণ কালা, মনেতে গাঁথিয়া মালা,
জপিয়া জপিয়া প্রাণ গেল।।
নিশি দিশি অনুক্ষণ, প্রাণ করে উচাটন,
বিরহ অনলে জ্বলে তনু।
ছাড়িলে ছাড়ন নয়, পরিণামে কিবা হয়,
কি মোহিনী জানে কালা কানু।।
দারুণ মুরলী স্বর, না মানে আপন পর,
মরমে ভেদিয়া যার থাকে।
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কয়, তনু মন তার নয়,
যোগিনী হইবে সেই পাকে।।
————–
কালিয়া ভূষণ কালা – পাঠান্তর–“কালিয়া রভস কালা”। প, ক, ত।
জপিয়া জপিয়া প্রাণ গেল – পাঠান্তর–“জাগিয়া জপিয়া প্রাণ গেল।” ঐ।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। শ্রীরাগ ।।
সজনি লো সই!
ক্ষণেক বৈসহ শ্যামের বাঁশীর কথা কই।।
শ্যামের বাঁশিটি, দুপুরে ডাকাতি,
সরবস হরি হৈল।
হিয়া দগদগি, পরাণ পোড়নি,
কেন বা এমতি কৈল।।
খাইতে শুইতে, আন নাহি চিতে,
বধির করিল বাঁশী।
সব পরিহরি, করিল বাউরী,
মানয়ে যেমন দাসী।।
কুলের করম, ধৈরজ ধরম,
সরম মরম ফাঁসী।
চণ্ডীদাসে ভণে, এই সে কারণে,
কানুর সরবস বাঁশী।
————–
সরবস হরি হৈল – সর্ব্বস্ব হরণ করিয়া লইল।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সুহই ।।
বিষম বাঁশীর কথা কহন না যায়।
ডাক দিয়া কুলবতী বাহির করয়।।
কেশে ধরি লৈয়া যায় শ্যামের নিকটে।
পিয়াসে হরিণ যেন পড়য়ে শঙ্কটে।।
হারে সই শুনি যবে বাঁশীর নিশান।
গৃহকাজ ভুলি প্রাণ করে আনচান।।
সতী ভুলে নিজপতি মুনি ভুলে মৌন।
শুনি পুলকিত হয় তরুলতাগণ।।
কি হবে অবলা জাতি সহজে সরলা।
কহে চণ্ডীদাস সব নাটের গুরু কালা।।
————–
করয় – কবে।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। ধানশী ।।
কুলের বৈরী, হইল মুরলী,
করিল সকল নাশে।
মদন কিরাতি, মধুর যুবতী,
ধরিতে আইল দেশে।।
সই জীবন মন নেয় বাঁশী।
পিরীতি আটা, ননদী কাঁটা,
পড়সি হইল ফাঁসি।।
বৃন্দাবন মাঝে, বেড়ায় সাজে,
ধরিতে যুবতী জনা।
যমুনার কূলে, গাছের তলে,
বসিয়া করিল থানা।।
এক পাশ হৈয়া, থাকি লুকাইয়া,
দেখি যে বসিল পাখী।
ধীরে ধীরে যাই, তাহা পানে চাই,
আনলা চালায় দেখি।।
গাছের ডালে, বসিয়া ভালে,
তাক করে এক দিঠে।
জড়াল আটা, লাগায় কাঁটা,
লাগিল পাখীর পীঠে।।
পড়িয়া ভূমেতে, ধর-ফড়াইতে,
কিরাতে ধরিল পাখে।
পাখে পাখা দিয়া, বাঁধিল টানিয়া,
ঝুলিতে ভরিয়া রাখে।।
চণ্ডীদাস কয়, মহাজন হয়,
কিনিয়া লয় সে পাখী।
ছাড়িয়া দেয়, পাখায় ধোয়ায়,
তবে সে এড়ান দেখি।।
————–
মদন কিরাতি – মদন ব্যাধ।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। তুড়ি ।।
মুরলীর স্বরে, রহিবে কি ঘরে,
গোকুল যুবতীগণে?
আকুল হইয়া, বাহির হইবে,
না চাবে কুলের পানে।।
কি রঙ্গ লীলা, মিলায় শিলা,
শুনিলে সে ধ্বনি কাণে।
যমুনা পবন, স্থগিত গমন,
ভুবন মোহিত গানে।।
আনন্দ উদয়, শুধু সুধাময়,
ভেদিয়া অন্তর টানে।
মরমে জ্বালা, জীয়ে কি অবলা,
হানয়ে মদন বাণে।।
কুলবতী কুল, করে নিরমূল,
নিষেধ নাহিক মানে।
চণ্ডীদাস ভণে, রাখিও মরমে,
কি মোহিনী কালা জানে।।
————–
শুনিলে সে ধ্বনি কাণে – পাঠান্তর–“শুনিতে সুন্দর কাণে”। প, ক, ত।
স্থগিত গমন – পাঠান্তর–“থাকিত গগন”। প, ক, ত। “চৌদিকে গগন”। প্রা, কা, সং।
হানয়ে – হানে।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। ধানশী ।।
কালা গরলের জ্বালা, আর তাহে অবলা,
তাহে মুঞি কুলের বৌহারী।
অন্তরে মরম ব্যথা, কাহারে কহিব কথা,
গুপতে গুমরি মরি মরি।।
সখিহে বংশী দংশিল মোর কাণে।
ডাকিয়া চেতন হরে, পরাণ না রহে ধড়ে,
তন্ত্র মন্ত্র কিছুই না মানে।।
মুরলী সরল হয়, বাঁকার মুখেতে রয়ে,
শিখিয়াছে বাঁকার স্বভাব।
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কয়, সঙ্গ দোষে কিনা হয়,
রাহু মুখে শশী মসি লাভ।।
————–
বৌহার – বধু।
কাহারে কহিব কথা – পাঠান্তর–“না শুনে ধরম কথা।”- প্রা, কা, সং।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। ধানশী ।।
মন মোর আর নাহি লাগে গৃহ-কাজে।
নিশি দিশি কাঁদি, কিন্তু হাসি লোক লাজে।।
কালার লাগিয়া হাম হব বনবাসী।
কালা নিল জাতি কুল, প্রাণ নিল বাঁশী।।
হাঁরে সখি কি দারুণ বাঁশী।
যাচিয়া যৌবন দিয়া হনু শ্যামের দাসী।
তরল বাঁশের বাঁশী নামে বেড়া জাল।
সবার সুলভ বাঁশী রাধার হৈল কাল।।
অন্তরে অসার বাঁশী বাহিরে সরল।
পিবয়ে অধর সুধা উগারে গরল।।
যে ঝাড়ের তরল বাঁশী তারি লাগি পাও।
ডালে মূলে উপাড়িয়া সাগরে ভাসাও।।(১)
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কহে বংশী কি করিবে।
সকলের মূল কালা তারে না পারিবে।।(২)
————–
অসার – পাঠান্তর–“কঠিন”। প্রা, কা, সং।
(১) পাঠান্তর–
“যে না দেশে বাঁশীর ঘর সেই দেশে যাব।
ডালে মূলে উপাড়িয়া সাগরে ভাসাব।।”–প্রা, কা, সং
(২) পাঠান্তর–
“দ্বিজ চণ্ডীদাসে কহে বংশী যে কি করে।
আপন করম দোষ, দোষ দিবে কারে।।”–প্রা, কা, সং
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সিন্ধুড়া ।।
তোমরা মোরে, ডাকিয়া সুধাও না,
প্রাণ আন চান বাসি।
কেবা নাহি করে প্রেম,
আমি হইলাম দোষী।।
গোকুল নগরে, কেবা কি না করে,
তাহে কি নিষেধ বাধা।
সতী কুলবতী সে সব যুবতী,
কানু কলঙ্কিনী রাধা।।
বাহির হইতে, লোক চরচায়,
বিষ মিশাইল ঘরে।
পিরীতি করিয়া, জগতের বৈরী,
আপনা বলিব কারে।।
তোমরা পরাণের, ব্যথিত আছিলা,
জীবন মরণে সঙ্গ।
অনেক দোষের, দোষিণী হইলে,
কে ছাড়ে আপন সঙ্গ।।
নন্দের নন্দন, গোকুল কানাই,
সবাই আপনা বলে।
সোপনু ইছিয়া, নিছিয়া লইনু,
অনাদি জনম কালে।।
রাধা বলি আর, ডাকি না সুধাও,
এখনি এখানে মৈলে।
চণ্ডীদাস কহে, সকলি পাইবা,
বঁধুয়া আপন হৈলে।।
————–
ইছিয়া – ইচ্ছা করিয়া।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সিন্ধুড়া ।।
দেখিলে কলঙ্কীর মুখ কলঙ্ক হইবে।
এ জনার মুখ আর দেখিতে না হবে।।
ফিরি ঘরে যাও নিজ ধরম লইয়া।
দেশে দেশে ভরমিব যোগিনী হইয়া।।
কাল মাণিকের মালা গাঁথি নিব গলে।
কানু গুণ যশ কাণে পরিব কুণ্ডলে।।
কানু-অনুরাগ রাঙ্গা বসন পরিব।
কানুর কলঙ্ক ছাই অঙ্গেতে লেপিব।।
চণ্ডীদাস কহে কেন হইলা উদাস।
মরণের সাথি যেই, সে কি ছাড়ে পাশ!
————–
ভরমিব – ভ্রমিব।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। তুড়ি ।।
আগুনি জ্বালিয়া, মরিব পুড়িয়া,
কত নিবারিব মন।
গরল ভখিয়া মো পুনি মরিব,
নতুবা লউক সমন।।
সই! জ্বালহ অনল চিতা!
সীমন্তিনী লইয়া, কেশ সাজাইয়া,
সিন্দুর দেহ সে সীঁথায়।। ধ্রু।
তনু তেয়াগিয়া, সিদ্ধ যে হইব,
সাধিব মনের যত।
মরিলে সে পতি, আসিবে সংহতি,
আমারে সেবিবে কত।।
তখন জানিবে, বিরহ বেদনা,
পরের লাগিয়া যত।
তাপিত হইলে, তাপ যে জানয়ে,
তাপ হয় যে কত।।
বিরহ বেদন, না জানে আপন,
দরদের দরদী নয়।
চণ্ডীদাস ভণে, পর দরদের,
দরদী হইলে হয়।
————–
আগুনি – আগুন। মো – আমি। সীমন্তিনী – সধবা স্ত্রী। দরদের – ব্যথার।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। ধানশী ।।
সই না কহ ও সব কথা।
কালার পিরীতি, যাহার লাগিল,
জনম হইতে ব্যথা।।
কালিন্দীর জল, নয়ানে না হেরি,
বয়ানে না বলি কালা।
তথাপি সে কালা, অন্তরে জাগয়ে,
কালা হৈল জপমালা।।
বঁধুর লাগিয়া, যোগিনী হইব,
কুণ্ডল পরিব কাণে।
সবার আগে, বিদায় হইয়া,
যাইব গহন বনে।।
গুরু পরিজন, বলে কুবচন,
না যাব লোকের পাড়া।
চণ্ডীদাস কহে, কানুর পিরীতি,
জাতি কুলশীল ছাড়া।
————–
কালিন্দীর – যমুনার।
বয়ানে – বদনে।
অন্তরে জাগয়ে – পাঠান্তর–“অন্তর না ছাড়ে।” প্রা, কা, সং।
বিদায় হইয়া – পাঠান্তর–“কহিয়া বলিয়া।” প্রা, কা, সং।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সুহই ।।
কাস জল ঢালিতে সই কালা পড়ে মনে।
নিরবধি দেখি কালা শয়ন স্বপনে।।
কাল কেশ এলাইয়া বেশ নাহি করি।
কাল অঞ্জন আমি নয়ানে না পরি।।
আলো সই মুঞি শুনিলাম নিদান।
বিনোদ বঁধুয়া বিনে না রহে পরাণ।।
মনের দুখের কথা মনে সে রহিল।
ফুটিল সে শ্যাম শেল বাহির নহিল।।
চণ্ডীদাস কহে রূপ শেলের সমান।
নাহি বাহিরায় শেল দগধে পরাণ।।
————–
বাহিরায় – বাহির হয়।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। বড়ারী ।।
কাল কুসুম করে, পরশ না করি ডরে,
এবড় মনের মনো ব্যথা।
যেখানে সেখানে যাই সকল লোকের ঠাঁই,
কাণাকাণি শুনি এই কথা।।(১)
সই! লোকে বলে কালা পরিবাদ।
কালার ভরমে হাম, জলদে না হেরি গো,
ত্যজিয়াছি কাজরের সাধ।।(২)
যমুনা সিনানে যাই, আঁখি মেলি নাহি চাই,
তরুয়া কদম্ব তলা পানে।
যথা তথা বসে থাকি, বাঁশীটি শুনিয়ে যদি,
দুটি হাত দিয়া থাকি কাণে।।
চণ্ডীদাস ইথে কহে, সদাই অন্তর দহে,
পাসরিলে না যায় পাসরা।
দেখিতে দেখিতে হরে, তবু মন চুরি করে,
না চিনি যে কালা কিংবা গোরা।।
————–
(১) পাঠান্তর–“সদাই শুনিতে পাই, কাণে কাণে কহে তুয়া কথা।” প্রা, কা, সং।
(২) শ্রীকৃষ্ণের রূপ মেঘের মত সেই জন্য লজ্জায় আমি মেঘের দিকে তাকাই না। কাজরও আর পরি না, কেন না কাজর দেখিতে শ্রীকৃষ্ণকে মনে পড়ে।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। তুড়ি ।।
পাসরিতে চাহি তারে পাসরা না যায় গো।
না দেখি তাহার রূপ মনে কেন টানে গো।।
খাইতে বসি যদি খাইতে কেন নারি গো।
কেশ পানে চাহি যদি নয়ান কেন ঝুরে গো।।
বসন পরিয়া থাকি চাহি বসন পানে গো।
সমুখে তাহার রূপ সদা মনে ঝাপে গো।।
ঘর মোর সাধ নাই কোথা আমি যাব গো।
না জানি তাহার সঙ্গ কোথা গেলে পাব গো।।
চণ্ডীদাস কহে মন নিবারিয়া থাক গো।
সে জনা তোমার চিতে সদা জাগি আছে গো।*
————–
* লীলাসমুদ্র।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সুহই ।।
এই ভয় উঠে মনে, এই ভয় উঠে।
না জানি কানুর প্রেম তুলে জনি ছুটে।।
গড়ন ভাঙ্গিতে সই আছে কত খল।
ভাঙ্গিয়া গড়িতে পারে সে বড় বিরল।।
যথা তথা যাই আমি যতদূরে পাই।
চাঁদমুখের মধুর হাসে তুলেক জুড়াই।।
সে হেন বন্ধুরে মোর যে জন ভাঙ্গায়।
হাম নারী অবলার বধ লাগে তায়।।
চণ্ডীদাস কহে রাই ভাবিছ অনেক।
তোমার পিরীতি বিনে সে জীয়ে তিলেক।।
পাঠান্তর—গড়ন ভাঙ্গিতে সই আছে কত’জন। প্রা, কা, সং।
পাঠান্তর—“ভাঙ্গিয়া গড়িতে পারে সে বড় সুজন”। ঐ
বিভিন্ন পাঠ—“সে হেন বন্ধুরে মোর যে জন ভাঙ্গিবে।/অবলা রাধার বধ তাহারে লাগিবে।।”
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। শ্রীরাগ ।।
কানু পরিবাদ, মনে ছিল সাধ,
সফল করিল বিধি।
কুজন বচনে, ছাড়িতে নারিব,
সে হেন গুণের নিধি।।
বঁধুর পিরীতি, শেলের ঘা,
পহিলে সহিল বুকে।
দেখিতে দেখিতে, ব্যথাটী বাড়িল,
এ দুখ কহিব কাকে।।
অন্য ব্যথা নয়, বোধে শোধে যায়,
হিয়ার মাঝারে থুয়া।
কোন কুলবতী, কুল মজাইয়া,
কেমনে রৈয়াছে শুয়া?
সকল ফুলে, ভ্রমরা বুলে,
কি তার আপন পর।
চণ্ডীদাস কহে, কানুর পিরীতি,
কেবল দুঃখের ঘর।।
————–
পহিলে – (হিন্দী) প্রথমে। কেমনে রৈয়াছে শুয়া – কেমনে শুইয়া রহিয়াছে।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। ধানশী ।।
সখিরে! মনের বেদনা, কাহারে কহিব,
কেবা যাবে পরতীত।
কানুর পিরীতে, ঝুরি দিবা রাতে,
সদাই চমকে চিত।।
কুল তেয়াগিনু, ভরম ছাড়িনু,
লইনু কলঙ্কের ডালা।
যে জন যে বল, আমারে বল,
ছাড়িতে নারিব কালা।।(১)
সে ডালি মাথায় করি, দেশে দেশে ফিরি,
মাগিয়া খাইব যবে।
সতী চরাচর, কুলের বিচার,
তবে সে আমার যাবে।।
চণ্ডীদাস কয়, কলঙ্কে কি ভয়,
যে জন পিরীতি করে।
পিরীতি লাগিয়া, মরে সে ঝুরিয়া,
কি তার আপন পরে।।
————–
ভরম – পাঠান্তর–“ধরম”। প্রা, কা, সং।
(১) বিভিন্ন পাঠ–
সই ছাড়িতে নারিব কালা।
কুল তেয়াগিনু, ভরম ছাড়িনু,
লইনু কলঙ্কের ডালা। লী, স।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। ধানশী ।।
আগো সই কে জানে এমন রীত।
শ্যাম বঁধুর সনে, পিরীত করিয়া,
কেবা যাবে পরতীত।।
খাইতে পিরীতি, শুইতে পিরীতি,
পিরীতি স্বপনে দেখি।
পিরীতি লহরে, আকুল হইয়া,
পরাণ পিরীতি সাক্ষী।।
পিরীতি আঁখর, জপি নিরন্তর,
এক পণ তার মূল।
শ্যাম বন্ধুর সনে, পিরীতি করিয়া,
নিছিয়া দিলাম কুল।।
চণ্ডীদাস কয়, অসীম পিরীতি,
কহিতে কহিব কত।
আদর করিয়া, যতেক রাখিবে,
পিরীতি পাইবা তত।।
————–
নিছিয়া – জলাঞ্জলী।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। তুড়ি ।।
আমার মনের কথা শুন গো সজনি।
শ্যাম বঁধু পড়ে মনে দিবস রজনী।।
কিবা গুণে কিবা রূপে মোর মন বান্ধে।
মুখেতে না স্বরে বাণী দুটি আঁখি কান্দে।।
চিতের অনল কত চিতে নিবারিব।
না যায় কঠিন প্রাণ কারে কি বলিব।।
চণ্ডীদাস বলে প্রেমে না কুটিলতা রীত।(১)
কুল ধর্ম্ম লোক লজ্জা নাহি মানে চিত।
————–
(১) পাঠ দুর্বোধ্য ছিল। কাছাকাছি পাঠ নেয়া হয়েছে।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। ধানশী ।।
জাতি জীবন ধন কালা।
তোমরা আমারে, যে বল সে বল,
কালিয়া গলার মালা।।
সই! ছাড়িতে যদি বল তারে।
অন্তর সহিত, সে প্রেম জড়িত,
কে তারে ছাড়িতে পারে।।
যেদিন যেখানে, যে সব পিরীতি
লীলা করয়ে কানু।
সঙ্গের সঙ্গিনী, হৈয়া রহিনু,
শুনিতাম মধুর বেণু।।
এত রূপ নহে, হিয়া পরতীত,
যাইতাম কদম্বের তলা।
চণ্ডীদাস কহে, এত প্রাণে সহে,
বচন বিষের জ্বালা।
————–
বেণু – বাঁশী।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সিন্ধুড়া ।।
বলে বলুক মোরে মন্দ আছে যত জন।
ছাড়িতে নারিব মুই শ্যাম চিকণ ধন।।
সে রূপ লাবণ্য মোর হৃদয়ে লাগি আছে।
হিয়া হৈতে পাঁজর কাটী লইয়া যায় পাছে।।
সই অই ভয় মনে বড় বাসি।
অচেতন নাহি থাকি জাগি দিবানিশি।।
অলস আইসে, নিদ যদি আইসে ইথে,
শয়ন করিয়া থাকি ভুজ দিয়া মাথে।।
এমত পিয়ারে মোর ছাড়িতে লোকে বলে।
তোমরা বলিবে যদি খাইব গরলে।।
কালা রূপের নিছনি নিছিয়া দিনু কুলে।
এত দিন বিহি মোহে হৈল অনুকূলে।।
পূরুক মনের সাধ, ধরম যাউক দূরে।
কানু কানু করি প্রাণ নিরবধি ঝুরে।।
চণ্ডীদাস কহে রাই ভাল ভাবিয়াছ।
মনের মরম কথা কারে জানি পুছ।।
————–
নিছনি – বালাই; ছবি। নিছিয়া – জলাঞ্জলী। বিহি মোহে – বিধি মোরে।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। দাস পাড়িয়া ।।
দূর দূর কলঙ্কিনী বলে সব লোকে গো।
না জানি কাহার ধন নিলাম আমি গো।।
কার সনে না কহি কথা থাকি ভয় করি গো।
তবুত দারুণ লোকে কহে সেই কথা গো।।
তার সনে মোর দেখা নাই, রটে মিছা কথা গো।
দেখা হইলে কইত যদি তার বোলে সইত গো।।
মিছা কথা কহিয়া পরের মন ভারি করে গো।
পর কুচ্ছা অধর্ম্ম বিনা কেমন করে রহে গো।।
চণ্ডীদাস কয় লোকে মিছা কয় কয় গো।
হয় কি না হয় মনে আপনি বুঝে দেখ গো।।*
————–
পর কুচ্ছা – পর কুৎসা।
* লীলা সমুদ্র।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। তুড়ি ।।
সুজন কুজন, যে জন না জানে,
তাহারে বলিব কি?
অন্তর বেদনা, যে জন জানয়ে,
পরাণ কাটিয়া দি।।
সই কহিতে যে বাসি ডর।
যাহার লাগিয়া, সব তেয়াগিনু,
সে কেন বাসয়ে পর।।
কানুর পিরীতি, বলিতে বলিতে,
পাঁজর ফাটিয়া উঠে।
শঙ্খ বণিকের, করাট যেমতি,
আসিতে যাইতে কাটে।।
সোণার গাগরি, যেন বিষভরি,
দুধেতে পুরিয়া মুখ।
বিচার করিয়া, যে জন না খায়,
পরিণামে পায় দুঃখ।।
চণ্ডীদাসে কয়, শুনহ সুন্দরি,
এ কথা বুঝিবে পাছে।
শ্যাম বন্ধু সনে, করিয়া পিরীতি,
কেবা কোথা ভাল আছে?*
————–
* পদসমুদ্র।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। তুড়ি ।।
পিয়ার পিরীতি লাগি যোগিনী হৈনু।
তবুত দারুণ চিতে সোয়াস্তি না পানু।।
কি হইল কলঙ্ক রঙ্গ শুনি যথা তথা।
কেন বা পিরীতি কৈনু খাইয়া আপন মাথা।।
না বল, না বল সই সে কানুর গুণ।
হাতের কালি গায়ে দিলাম মাখিলাম চূণ।।
আর না করিব পাপ পিরীতির লেহা।
পোড়া করি সমান করিনু নিজ দেহা।।
বিধিরে কি দিব দোষ করম আপনা।
সুজনে করিনু প্রেম হইল কুজনা।।
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কহে না কর ভাবনা।
সুজনে সুজন মিলে, কুজনে কুজনা।।*
————–
* পদসমুদ্র।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। তুড়ি ।।
এক জ্বালা গুরু জন আর জ্বালা কানু।
জ্বালাতে জ্বলিল দে সারা হৈল তনু।।
কোথায় যাইব সই কি হবে উপায়?
গরল সমান লাগে বচন হিয়ায়।।
কাহারে কহিব কেবা যাবে পরতীত।
মরণ অধিক হৈল কানুর পিরীত।।
জারিলেক তনু মন কি করে ঔষধে।
জগত ভরিল কালা কানু পরিবাদে।।
লোক মাঝে ঠাঁই নাই অপযশ দেশে।
বাশুলী আদেশে কহে দ্বিজ চণ্ডীদাসে।।
————–
এক জ্বালা গুরু জন – বিভিন্ন পাঠ–“এক জ্বালা ঘরে হৈল”। প, ক, ত।
দে – দেহ। পাঠান্তর–“প্রাণ”। প্রা, কা, সং।
কোথায় যাইব সই – পাঠান্তর–কোথা যাব কি করিব”। ঐ।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সিন্ধুড়া ।।
এ দেশে বসতি নৈল যাব কোন্ দেশে।
যার লাগি প্রাণ কাঁদে তারে পাব কিসে?
বল না উপায় সই বল না উপায়।
জনম অবধি দুকঝ রহল হিয়ায়।।
তিতা কৈল দেহ মোর ননদী বচনে।
কত না সহিব জ্বালা ও পাপ পরাণে।।
বিষ খায়া দেহ যাবে রব রবে দেশে।
বাশুলী আদেশে কহে দ্বিজ চণ্ডীদাসে।।
————–
নৈল – পাঠান্তর–“নাহি”। প্রা, কা, সং।
ননদী বচনে – পাঠান্তর–“ননদীর রোলে”। প, ক ত।
পাপ পরাণে – পাঠান্তর–“শাশুড়ীর বোলে”। ঐ।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সিন্ধুড়া ।।
সই! একি সহে পরাণে।
কি বোল বলিয়া, গেল ননদিনী,
শুনিলা আপন কাণে।।
পরের কথায়, এত কথা কহে,
ইহাতে করিব কি?
কানু পরিবাদে, ভুবন ভরিল,
বৃথায় জীবনে জী।।
কানুরে পাইত, এ সব কহিত,
তবে বা সে বোলে ভাল?
মিছা পরিবাদে, বাদিনী হইয়া,
জর জর প্রাণ হৈল।।
কে আছে বুঝায়া, শ্যামেরে কহিয়া,
এ দুখে করিবে পার?
চণ্ডীদাস কহ, ধৈর্য্য ধরি রহ,
কে কিবা করিবে কার?
————–
বৃথায় জীবনে জী – বৃথা বাঁচিয়া আছি।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। শ্রীরাগ ।।
পর পুরুষে, যৌবন সঁপিলে,
আশা না পূরয়ে তায়।
আপন পতি, বিছুরিলে কতি,
দ্বিগুণ সুখ সে পায়?
সই! বিধি করিল এমত রীতি!
কুলবতী হইয়া, পতি তেয়াগিয়া,
পর পতি সনে প্রীতি।।
পড়সী সকল এবে সে জানিল,
দুকুল ভাসিল জলে।
পিরীতি করিতে, আসিবে চটাই,
দুই কুল ফাক্ হলে।।
দুদিকে ভাসিতে, উঠু ডুবু করিতে,
কিনারা হইল দেখি।
মহাজন ঘরে, চোরে চুরি করে,
পড়সী দেয় সে সাখী।।
তলাস করিয়া, বেড়ায় ফিরিয়া,
ধনের না পায় লেশ।
মনে যে বুঝিয়া, দেখিনু ভাবিয়া,
তাহারি কপাল দোষ।।
এমন তাকতি, কানুর পিরীতি,
হরি’নিল মোর মন।
আপন পর যে, দূষিল সব,
তেজিল গৃহ গুরু জন।।
রাখ চিহ্ন পায়, চণ্ডীদাস হিয়ায়,
দোসর বোধিক জনা।
সকলি পাইবে, কুশলে রহিবে,
আসিবে নন্দনন্দনা।।*
————–
* পদসমুদ্র
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সিন্ধুড়া ।।
গোকুল নগরে, আমার বন্ধুরে,
সবাই ভাল বাসে।
হাম অভাগিনী, আপন বলিলে,
দারুণ লোকেতে হাসে।।
সই! কি জানি কি হইল মোরে।
আপন বলিয়া, দুকুল চাহিয়া,
না দেখি দোসর পরে।।
কুলের কামিনী, হম অভাগিনী,
নহিল দোসর জনা।
রসিক নাগর, গুরু জনা বৈরী
এ বড় মুখরপণা।।
বিধির বিধান, এমন করল,
বুঝিনু করম দোষে।
আগে পাছে বুঝি, না কৈলে সমঝি,
কহে চণ্ডীসাসে।।*
————–
* পদসমুদ্র
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। গান্ধার ।।
পিরীতি লাগিয়া হম্ সব তেয়াগিনু।
তবুত শ্যামের সঙ্গে গোঙা’তে নারিনু।।
বিধিরে কি দিব দোষ আপন করম।
না খেনে করিনু প্রেম না জানি মরম।।
ঘরে পরে বাহিরে কুলটা বলি খ্যাতি।
কানু সঙ্গে প্রেম করি না পোহা’ল রাতি।।
চল চল আর দেখি ওঝা বাড়ী যাও।
কালকুট বিষ আনি হাতে তুলি দাও।।
পিরীতি মরতে করিতে যে বা করে আশ।
পিরীতি লাগিয়ে মরে দ্বিজ চণ্ডীদাস।।*
————–
* পদসমুদ্র
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। পঠ মঞ্জরী ।।
নিশ্বাস ছাড়িতে না দেয় ঘরের গৃহিণী।
বাহিরে বাতাসে ফাঁদ পাতে ননদিনী।।
বিনি ছলে ছলয়ে, সদাই ধরে চুলি।
হেন মনে করে জলে প্রবেশিয়া মরি।।
সতী সাধে দাঁড়াই যদি সখীগণ সঙ্গে।
পুলকে পূরয়ে তনু শ্যাম পরসঙ্গে।।
পুলক ঢাকিতে নানা করি পরকার।
নয়নের ধারা মোর বহে অনিবার।।
পোড়া লোক না জানে পিরীতি বোলে কারে।
তুমি যদি বল, সমাধান দেই ঘরে।।
চণ্ডীদাস বলে শুন আমার যুকতি।
অধিক জ্বালা যার তার অধিক পিরীতি।।
————–
পরকার – প্রকার।
পোড়া – পাঠান্তর–“পাড়ার” প, ক, ত এবং লী স।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সিন্ধুড়া ।।
তাহারে বুঝাই সই! পেলে তার লাগি।
ননদী-বচনে যেন বুকে উঠে আগি।।
কাহারে না কহি কথা রহি দুখে ভাসি।
ননদী দ্বিগুণ বাদী এ পোড়া পড়সি।।
কাহারে কহিব দুখ যাব আমি কোথা।
কার সনে কব আর কালা কানুর কথা?
যত দূরে যায় মন তত দূরে যাব।
পিরীতি পরাণভোগী কোথা গেলে পাব।।
তাহারে কহিব দুখ বিনয় করিয়া।
চণ্ডীদাস কহে তবে জুড়াইবে হিয়া।।
————–
আগি – আগুন।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। শ্রীরাগ ।।
কানু সে জীবন, জাতি প্রাণধন,
এ দুটি নয়ান-তারা।
হিয়ার মাঝারে, পরাণ পুতলি,
নিমিখে নিমিখ হারা।।
তোরা কুলবতী, ভজ নিজ পতি,
যার মনে যেবা লয়।
ভাবিয়া দেখিলাম, শ্যাম বঁধু বিনে,
আর কেহ মোর নয়।।
কি আর বুঝাও, ধরম করম,
মন স্বতন্তরী নয়।
কুলবতী হইয়া, পিরীতি আরতি,
আর কার জানি হয়।।
যে মোর করম, কপালে আছিলা,
বিধি মিলাওল তায়।
তোরা কুলবতী, ভজ নিজ পতি,
থাক ঘরে কুল লয়।।
গুরু দূরজন, বলে কুবচন,
সে মোর চন্দন চুয়া।
শ্যাম অনুরাগে, এ তনু বেচিনু,
তিল তুলসী দিয়া।।
পড়ছি দুর্জ্জন, বলে কুবচন,
না যাব সে লোক পাড়া।
চণ্ডীদাসে কয়, কানুর পিরীতি,
জাতি কুল শীল ছাড়া।।
————–
স্বতন্তরী – স্বতন্ত্র।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। শ্রীরাগ ।।
কে আছে বুঝিয়া, শুঝিয়া বলিবে,
আমার পিয়ার পাশে?
গোপত পিরীতি, না করে বেকতি,
শুনিয়া লোকেতে হাসে।।
গোপত বলিয়া, কেন বা বলিলে,
এমন করিল কেনে।
এমত ব্যাভার, না বুঝি তাহার,
পিরীতি যাহার সনে।।
সই! এমতি কেন বা হৈল।
পরের নারী, মনে যে হরি,
নিচয় ছাড়িয়া গেল।।
মোরা অভাগিনী, দিবস রজনী,
সোঙরি সোঙরি মরি।
কুলের কলঙ্ক, করিনু সালঙ্ক,
তবু যে না পানু হরি।।
পুরুষ পরশ, হইল দুরস,
বিছুরিলে আপন রীতি,
জনম অবধি, না পাই সোয়াতি,
কাঁদিয়া মরি যে নিতি।।
চণ্ডীদাস কয়, সুজন যে হয়,
এমতি না করে সে।
তাহার পিরীতি, পাষাণে লেখতি,
মুছিলেও নাহি ঘুচে।।
————–
পাশে – নিকটে। গোপত – গুপ্ত, গোপনীয়। সালঙ্ক – অলঙ্কার। সোয়াতি – সোয়াস্তি। লেখতি – লিখিত।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। ধানশী ।।
সই! কেমনে ধরিব হিয়া?
আমার বঁধুয়া, আন বাড়ি যায়,
আমার আঙিনা দিয়া!
সে বঁধু কালিয়া, না চায় ফিরিয়া,
এমতি করিল কে?
আমার অন্তর, যেমন করিছে,
তেমতি হউক সে।।
যাহার লাগিয়া, সব তেয়াগিনু,
লোকে অপযশ কয়।
সেই গুণ নিধি, ছাড়িয়া পিরীতি,
আর জানি কার হয়?
আপনা আপনি, মন বুঝাইতে,
পরতীত নাহি হয়।
পরের পরাণ, হরণ করিলে,
কাহার পরাণে সয়?
যুবতী হইয়া, শ্যাম ভাঙাইয়া,
এমতি করিল কে?
আমার পরাণ, যে মতি করিছে,
সে মতি হউক সে।।
কহে চণ্ডীদাস, করহ বিশ্বাস,
যে শুনি উত্তম মুখে।
কেবা কোথা ভাল, আছয়ে সুন্দরী,
দিয়া পরমনে দুখে।।
————–
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। গান্ধার ।।
দেখিব যে দিনে, আপন নয়নে,
কহিতে তা সনে কথা।
বেশ দূর করিব, কেশ ঘুচাইব,
ভাঙ্গিব আপন মাথা।।
সই! কেমনে ধরিব হিয়া।
এত সাধের বন্ধুয়া আমার,
দেখিলে না চায় ফিরিয়া।।
সে হেন কালিয়া, যা বিনেক হিয়া,
এমতি করিলে কে।
হৃদি সীদতি, আমার যে মতি,
তেমতি পুড়ুক সে।।
কহে চণ্ডীদাস, কেন কর ত্রাশ,
সে ধন তোমারি বটে।
তার মুখে ছাই, দিয়া সে কানাই,
আসিবে তোমা নিকটে।
————–
হৃদি সীদতি – হৃদয় শিহরিতেছে।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। ধানশী ।।
সই! তাহারে বলিব কি?
যেমতি করিয়া, শপথি করিল,
বৃথায় জীবন জী।।
ধরম গুণে, ভয় না মানে,
এমন ডাকাতি সেহ।
বুঝিলাম মনে, ডাকাতিয়া সনে,
ঘুচিল ভাল যে দেহ।।
বিনি যে পখরি, রূপ যে দরখি,
ভুলিনু পরের বোলে।
পিরীতি করিয়া, কলঙ্ক হইল,
ডুবিনু অগাধ জলে।।
গুরুর গঞ্জন, সহি সদাতন,
না জানিনু সেই রসে।
অমিঞা হইয়া, গরল হইল
এমতি বুঝিলাম শেষে।।
আগে যদি জানিতুঁ, সতর্কে থাকিতুঁ,
এমত না করিতুঁ মনে।
সে হেন পিরীতি, হবে বিপরীতি,
এমন মনে কে জানে।।
চণ্ডীদাস কহ, ধৈর্য্য ধরি রহ,
কাহারে না কহ কথা।
কথা যে কহিবে, যথা সে যাইবে,
মনেতে পাইবে ব্যথা।।
————–
সদাতন – সর্ব্বদা। জানিতুঁ – জানিতাম। থাকিতুঁ – থাকিতাম। করিতুঁ – করিতাম।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। ধানশী ।।
পিরীতি পসার, লইয়া ব্যভার,
দেখি যে জগৎ ময়।
যতেক নাগরী, কুলের কুমারী,
কলঙ্কী আমারে কয়।।
সই! জানি কি হইবে মোর?
সে শ্যাম নাগর, গুণের সাগর,
কেমনে বাসিব পর?
সে গুণ সোঙরিতে, যাহা করে চিতে,
তাহা বা কহিব কত।
গুরু জনা কুলে, ডুবাইয়া মুলে,
তাহাতে হইত রত।।
থাকিলে যে দেশে, আমার হাসে,
কহিতে না পারি কথা।
অযোগ্য লোকে, তত দেয় শোকে,
সে আর দ্বিগুণ ব্যথা।।
কহে চণ্ডীদাস, বাশুলীর পাশ,
এমন যদি হয় মনোরীত।
যার সনে হয়, পিরীতি করয়,
কহিলে সে হয় পরতীত।।
————–
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। শ্রীরাগ ।।
সই! মরম কহিএ তোকে।
পিরীতি বলিয়া, এ তিন আখর,
কভু না আনিব মুখে।।
পিরীতি মূরতি, কভু না হেরিব,
এ দুটি নয়ান কোণে।
পিরীতি বলিয়া, নাম শুনইতে,
মুদিয়া রহিব কাণে।।
পিরীতি নগরে বসত তেজিয়া,
থাকিব গহন বনে।
পিরীতি বলিয়া, এ তিন আখর,
যেন না পড়য়ে মনে।।
পিরীতি পাবক, পরশ করিয়া
পুড়িছি এ নিশি দিবা।
পিরীতি বিচ্ছেদ, সহনে না যায়,
কহে চণ্ডীদাস কিবা।।
————–
পাবক – আগুন।
শুন শুন সই! কহি তোরে।
পিরীতি করিয়া কি হৈল মোরে।।
পিরীতি পাবক কে জানে এত। সদাই পুড়িছে সহিব কত।।
পিরীতি দুরন্ত কে বলে ভাল। ভাবিতে পাঁজর হইল কাল।।
অবিরত বহে নয়ানে নীর। নিলাজ পরাণে না বান্ধে থির।।
দোষর ধাতা পিরীতি হইল। সেই বিধি মোরে এতেক কৈল।।
চণ্ডীদাস কহে সে ভাল বিধি। এই অনুরাগে সকল সিধি।।
————–
নিলাজ পরাণে না বান্ধে থির – নির্লজ্জ প্রাণ স্থির হয় না। সিধি – সিদ্ধি।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। শ্রীরাগ ।।
ও সই! আর না বলিহ মোরে।
পিরীতি বলিয়া, দারুণ আখর,
বলিতে নয়ন ঝুরে।।
পিরীতি আরতি, কভু না স্মরিব,
শয়ন স্বপন মনে।
পিরীতি নগরে, বসতি তেজিব,
রহিব গহন বনে।।
পিরীতি অবশ, পরাণ লাগিয়া,
তেজিব নিকুঞ্জ বাস।
পিরীতি বেয়াধি, ছাড়িলে না ছাড়ে
ভালে জানে চণ্ডীদাস।।
————–
ভালে – ভাল।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। পঠমঞ্জরী ।।
কি বুকে দারুণ ব্যথা!
সে দেশে যাইব, যে দেশে না শুনি,
পাপ পিরীতির কথা।।
সই! কে বলে পিরীতি ভাল?
হাসিতে হাসিতে, পিরীতি করিয়া,
কাঁদিতে জনম গেল।।
কুলবতী হৈয়া, কুলে দাঁড়াইয়া,
যে ধনী পিরীতি করে।
তূষের অনল, যেন সাজাইয়া,
এমতি পুড়িয়া মরে।।
হাম অভাগিনী, এ দুখে দুখিনী,
প্রেমে ছল ছল আঁখি।
চণ্ডীদাস কহে, যেমতি হইল,
পরাণে সংশয় দেখি।।
————–
ধনী – পাঠান্তর–“জন”–প্রা, কা, সং।
প্রেমে ছল ছল আঁখি – পাঠান্তর–“সদাই ঝরয়ে আঁখি”–পদকল্পলতিকা।
চণ্ডীদাস কহে, যেমতি হইল, পরাণে সংশয় দেখি – পাঠান্তর–“চণ্ডীদাস কহে, যে দুখ উঠিল, জীবন-সংশয় দেখি”–পদকল্পলতিকা।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সিন্ধুড়া ।।
এ দেশে না রব সই দূর দেশে যাব।
এ পাপ পিরীতির কথা শুনিতে না পাব।।
না দেখিব নয়নে পিরীতি করে যে।
এমতি বিষম চিতা জ্বালি দিবে সে।।
পিরীতি আখর তিন না দেখি নয়ানে।
যে কহে তাহারে আর না হেরি বয়ানে।।
পিরীতি বিষম দায়ে ঠেকিয়াছি আমি।
চণ্ডীদাসে কহে রামি ইহার গুরু তুমি।।
————–
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। শ্রীরাগ ।।
সুখের লাগিয়া, এ ঘর বাঁধিনু,
আগুণে পুড়িয়া গেল।
অমিয়া সাগরে, সিনান করিতে,
সকলি গরল ভেল।।
সখি! কি মোর কপালে লেখি!
শীতল বলিয়া, চাঁদ সেবিনু,
ভানুর কিরণ দেখি।।
উচল বলিয়া, অচলে চড়িনু,
পড়িনু অগাধ জলে।
লছমী চাহিতে, দারিদ্র বেঢ়ল,
মাণিক হারানু ছেলে।।
নগর বসালেম, সাগর বাঁধিলাম,
মাণিক পাবার আশে।
সাগর শুকাল, মাণিক লুকাল,
অভাগীর করম দোষে।।
পিয়াস লাগিয়া, জলদ সেবিনু,
বজর পড়িয়া গেল।
কহে চণ্ডীদাস, শ্যামের পিরীত,
মরমে বহল শেল।।
————–
কপালে – পাঠান্তর–“করমে”–প্রা, কা, সং।
উচল বলিয়া, অচলে চড়িনু – পাঠান্তর–“উচল হইতে, নিচলে চাপিয়া”–প্রা, কা, সং।
চাহিতে – পাঠান্তর–“সেবিতে”–প্রা, কা, সং।
এই পদটি জ্ঞানের বলিয়া উল্লেখিত আছে–প, ক, ত; লী, স।
জ্ঞানদাসের ভণিতা এইরূপ–
“পিয়াস লাগিয়া, জলদ সেবিনু,
পাইনু বজর তাপে।
জ্ঞানদাস কহে, পিরীতি করিয়া,
পাছে কর অনুতাপে।।”
–প, ক, ত; লী, স।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। শ্রীরাগ ।।
যাবত জনমে, কি হৈল মরমে,
পিরীতি হইল কাল।
অন্তরে বাহিরে, পশিয়া রহিল,
কেমতে হইলে ভাল?
সই! বল না উপায় মোরে।
গঞ্জনা সহিতে, নারি আর চিতে,
মরম কহিনু তোরে।।
ননদী বচনে, জ্বলিছে পরাণে,
আপদ মস্তক চুল।
কলঙ্কের ডালি, মাথায় করিয়া,
পাথারে ভাসাব কুল।।
ভাসিয়া যায়, ঘুচবে দায়,
এ বোল এ ছার লোকে।
চণ্ডীদাস কহে, এমতি হইলে,
মরিবে তাহার শোকে।।
————–
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সুহই ।।
পাপ পরাণে কত সহিবেক জ্বালা!
শিশুকালে মরি গেলে হইত যে ভালা।।
এ জ্বালা জঞ্জাল সই তবে সে পরিহরি।
ছেদন করিয়া দেও পিরীতের ডরি।।
তেমতি নহিলে, যার এমতি ব্যভার।
কলঙ্ক-কলসী লৈয়া ভাসিব পাথার।।
চণ্ডীদাস কহে ইহা বাশুলী কৃপায়।
পিরীতি লাগিয়া কেন ভাসিবে দরিয়ায়।।
————–
পরিহরি – ভুলিতে পারি। ডরি – দড়ী। দরিয়ায় – সমুদ্রে।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। শ্রীরাগ ।।
শুন গো মরম সই!
যখন আমার, জনম হইল,
নয়ন মুদিয়া রই।।
দিতে ক্ষীর সর, জননী আমার,
নয়ন মুদিত দেখি।
জননী আমার করে হাহাকার,
কহিল সকলে ডাকি।।
শুনি সেই কথা, জননী যশোদা,
বঁধুরে লইয়া কোরে।
আমারে দেখিতে, আইল তুরিতে,
সুতিকা মন্দির ঘরে।।
দেখিয়া জননী, কহিছেন বাণী,
এই কি ছিল কপালে।
করিয়া সাধনা, পেলেন অন্ধকন্যা,
বিধি এত দুখ দিলে।।
উঠ উঠ বলি, করে ধরি তুলি,
বসান যতন করে।
হেনই সময়ে, মায়ে তেয়াগিয়ে,
বন্ধু পরশিল মোরে।।
গায়ে দিতে হাত, মোর প্রাণনাথ,
অন্তরে বাঢ়ল সুখ।
হাসিয়া কান্দিয়া, আঁখি প্রকাশিয়া,
দেখিনু বঁধুর মুখ।।
ঘুচিল অন্ধ, বাঢ়িল আনন্দ,
জননী যশোদার মনে।
আমার কল্যানে, আনন্দিত মনে,
করিল বিবিধ দানে।।
সুজন যে জন, জানে সেই জন,
কুজন নাহিক জানে।
অনুরাগে মন, সদাই মগন,
দ্বিজ চণ্ডীদাসে ভণে।।
————–
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। তুড়ি ।।
শুন কমলিনি, চল কুল রাখি,
আর না করিও নাম।
সে যে, কালিয়া মূরতি, কালিয়া প্রকৃতি,
কালা খল নাম শ্যাম।।
জনক জননী, তেজিয়া আপনি,
অন্যের হইয়া মজে।
রাম অবতারে, জানকি সীতারে,
বিনি অপরাধে ত্যজে।।
উহার চরিত, আছয়ে বিদিত,
বালী বধিবার কালে।
বলীকে ছলিয়া, পাতালে লইল,
কি দোষ উহার পেলে?
উহার চরিত, আছয়ে বিদিত,
হৃদয় পাষাণ ময়।
উহার শরণে, যে মত রাবণে,
যোই সে শরণ লয়।।
চণ্ডীদাস ভণে, মরুক সে জনে,
যেবা পর চরচায় থাকে।
পিরীতি লাগিয়া, মরে সে ঝুরিয়া,
কুলেতে কি করে তাকে?
————–
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। শ্রীরাগ ।।
আপনা আপনি, দিবস রজনী
ভাবিয়ে কতেক দুখ।
যদি পাখা পাই, পাখী হয়ে যাই,
না দেখাই পাপ মুখ।।
সই বিধি দিল মোরে শোকে।
পিরিতি করিয়া, আশা না পুরল,
কলঙ্ক ঘোষিল লোকে।।
হাম অভাগিনী, তাতে একাকিনী,
নহিল দোসর জনা।
অভাগিয়া লোকে, যত বোলে মোকে,
তাহা যে না যায় শুনা।।
বিধি যদি শুনিত, মরণ হইত,
ঘুচিত সকল দুখ।
চণ্ডীদাসে কয়, এমতি হইলে,
পিরীতির কিবা সুখ।।
————–
ঘোষিল – ঘোষণা করিল।
হাম অভাগিনী, তাতে একাকিনী – পাঠান্তর–“এতেক কামিনী, আমি অভাগিনী”–প্রা, কা, সং।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। শ্রীরাগ ।।
পরের রমনী, ঘুচিবে কখনি,
এমনি করিবে ধাতা।
গোকুল নগরে, প্রতি ঘরে ঘরে,
না শুনি পিরীতি কথা।।
সই যে বোল সে বোল মোরে।
শপতি করিয়া, বলি দাঁড়াইয়া,
না রব এ পাপ ঘরে।।
গুরুর গঞ্জন, মেঘের গর্জ্জন,
কত না সহিব প্রাণে।
ঘর তেয়াগিয়া, যাইব চলিয়া,
রহিব গহন বলে।।
বনে যে থাকিব, শুনিতে না পাব,
এ পাপ জনের কথা।
গঞ্জন ঘুচিবে, হিয়া জুড়াইবে,
ঘুচিবে মনের ব্যথা।।
চণ্ডীদাস কয়, স্বতন্তরী হয়,
তবে সে এমন বটে।
সে সব কহিলে, করিতে পারিলে,
তবে সে এ পাপ ছুটে।।
————–
কখনি – কখন। ধাতা – বিধাতা। শপতি – শপথ।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সুহই ।।
না জানে পিরীতি যারা নাহি পায় তাপ।
পরসে পিরীতি আঁধার ঘরে সাপ।।
সই পিরীতি বড়ই বিষম।
না পাই মরমি জনা কহিতে মরম।।
গৃহে গুরু গঞ্জর কুবচন জ্বালা।
কত না সহিবে সুখ পরাধিনী বালা?
পিরীতি বেয়াধি যদি অন্তরে শ্যামাইল।
ঔষধ খাইতে তবে পরাণ জারি গেল।।
চণ্ডীদাস কহে প্রেম বড়ই বিষম।
জীয়ন্তে এমন করে, লউক শমন।।
————–
পরসে – (সে–হিন্দী–)পরে সঙ্গে অথবা পর হইতে। প্রা, কা, সং।
শামাইল – প্রবেশ করিল।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। ধানশী ।।
দৈব যুকতি, বিশেষ গতি,
যাহারে লাগয়ে তায়।
আন আন জনে, করিয়া যতনে,
প্রেমেতে গড়ায়ে দেয়।।
সই! এমনি কানুর রসে।
জনম অবধি, রহিবে পিরীতি,
বিচ্ছেদ না হবে শেষে।।
যেই মনে ছিল, তাহা না হইল,
সোঙরিতে প্রাণ কাঁদে।
লেহ দাবানলে, বন যেন জ্বলে,
হরিণী পড়িল ফাঁদে।।
পলাইতে চায়, পথ নাহি পায়,
দেখে যে আনলময়।
বনের মাঝারে, ছটফট করে,
কত বা পরাণে সয়।।
বাহিরে আসিয়া, বাণ যে খাইয়া,
পশিতে তাহাতে পুন।
গরল আনলে, শরীর বিবল,
শামাইতে নারে যেন।।
করীবর আদি, না পায় সমাধি,
ফিরিয়া চীৎকার করে।
একে কুল নারী, ফুকারিতে নারি,
ননদী আছয়ে ঘরে।।
এমতি আকার, পিরীতি তাহার,
বহিয়া দহিছে মনে।
ননদী বচনে, দগধে পরাণে,
পাঁজর বিধিল ঘুণে।।
নয়নে নয়নে, নজর পীঁজরে,
রাখয়ে আপন কাছে।
জলে যাই যবে, সঙ্গে চলে তবে,
শ্যামেরে দেখি যে পাছে।।
চণ্ডীদাস কয়, বাশুলীর সায়,
মনেতে থাকয়ে যদি।
যে জন যা বিনে, না জীয়ে পরাণে,
তার কি করে ননদী।।
————–
বহিয়া দহিছে মনে – পাঠান্তর–“রহিতে সহিছে মনে”–প্রা, কা, সং।
পীঁজরে – খাঁচায়। যা বিনে – যাহা বিহনে।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। ধানশী ।।
জনম অবধি, পিরীতি বেয়াধি,
অন্তরে রহিল মোর।
থেকে থেকে উঠে, পরাণ ফাটে,
জ্বালার নাহিক ওর।।
সই! এ বড় বিষম কথা।
কানুর কলঙ্ক, জগতে হইল,
জুড়াইব আর কোথা?
বেয়াধি অবধি, সমাধি করিয়ে,
পাই এবে যার লাগি।
এমতি ঔষধ হয়, অল্প মূল্য লয়,
হিয়ার ঘুচায় আগি।।
জনম অবধি, কণ্টক ননদী,
জ্বালাতে জ্বালাল মন।
তাহার অধিক, দ্বিগুণ জ্বালায়,
খলের পিরীতি শুন।।
খলের সংহতি, ছাড়িনু পিরীতি,
ছাড়িনু সকল সুখ।
চণ্ডীদাস কয়, যদি দেখা হয়,
এবে কেন বাস দুখ?
————–
ওর – সীমা। সংহতি – সঙ্গে।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সিন্ধুড়া ।।
সখি! কেমনে জীব গো আর!
বুকে খেয়েছি, শ্যামের শেল,
পীঠে হৈল পার।।
মনু মনু মৈলাম, গো সখি,
কালিয়া বাঁশীর গানে।
সুজন দেখিয়া, পিরীতি করিনু,
এমতি হবে কে জানে?
সকল গোকুল, হইল আকুল,
শুনিয়া বাঁশীর কথা।
খলের সহিতে, পিরীতি করিয়া,
কি হৈল অন্তরে ব্যথা।।
স্থিত হৈতে নারি, প্রাণের সখি গো,
বুকে খেয়েছি ঘা।
আঁখির জলে, পথ নাহি দেখি,
মুখে না নিঃসরে রা।।
পিরীতি রতন, করিব যতন,
পিরীতি গলার হার।
শ্যাম বঁধুয়ার নিদারুণ বাঁশী,
পরাণ বধে আমার।।
কে জানে কেমন, পিরীতি এমন,
পিরীতে কৈল সব নাশ।
গঞ্জে গুরু জনে, আনন্দিত মনে,
কহে দ্বিজ চণ্ডীদাস।
————–
রা – বাক্য।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সিন্ধুড়া ।।
যতন করিয়া, বেসালি ধুইয়া,
সাঁজে সাজাইনু দুধ।
দধি সে নহিল, জল সে হইল,
পাইনু বড়ই দুঃখ।।
সই দধি কেন ছিঁড়ি গেল?
কানুর পিরীতি, কুলের করাতি,
পরাণ টানিয়া নিল।।
পিরীতি ঘুচিল, আরতি না পূরিল,
না ঘুচিল কলঙ্ক জ্বালা।
তবু অভাগিনী, না ঘুচায় কাহিনী,
পরিবাদ হৈল কালা।।
বুঝিলাম যতনে, প্রবোধিনু পরাণে,
ছাড়িনু তাহার আশ।
চিতে আর কত, ভাবি অবিরত,
দৈবে করিল নৈরাশ।।
আর কেহ বলে, ঝাঁপ দিব জলে,
তেজিব এ পাপ দেহ।
চণ্ডীদাস কহে, ছাড়িলে ছাড়ন নহে,
শুধু সুধাময় লেহ।
————–
বেসালি – দুগ্ধ আবর্ত্তনের নিমিত্ত মৃত্তিকার পাত্র বিশেষ।
সাঁজে – সন্ধ্যার সময়।
সাজাইনু – পাতিলাম।
সই দধি কেন ছিঁড়ি গেল – সই দধি কেন নষ্ট হইল?
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। ধানশী ।।
না বল না বল সখি না বল এমনে।
পরাণ বান্ধিয়া আছি সে বন্ধুর সনে।।
ত্যজিলে কুল শীল এ লোক লাজ।
কি গুরু গৌরব গৃহের কাজ।।
ত্যজিয়া সব লেহা পিরীতি কৈনু।
যে হইবে বিরতি ভাবে ত্যজিয়া মৈনু।।
যে চিতে দাড়াঞাছি সই সে হয়।
ক্ষেপিল বাণ যে রাখিল নয়।।
ঠেকিল প্রেম ফাঁদে সকলি নাশ।
ভালে সে চণ্ডীদাস না করে আশ।।*
————–
লেহা – সাধ।
* গীতকল্পতরু এবং পদকল্পতরু গ্রন্থে এই পদটি জ্ঞানদাসের ভণিতা যুক্ত দেখিতে পাওয়া যায়।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। ধানশী ।।
ইক্ষু রোপিনু, গাছ যে হইল,
নিঙ্গাড়িতে রসময়।
কানুর পিরীতি, বাহিরে সরল,
অন্তরে গরল হয়।।
সই কে বলে ইক্ষুরস গুড়!
খাইনু আপন মুড।।
চাকিতে চাকিতে, লাগিল জিহ্বাতে,
পহিলে লাহিল মীঠ।
মোদক আনিয়া, ভিয়াঁন করিয়া,
এবে সে লাগিল সীঠ।।
মশল্লা আনিনু, আগুনে চঢ়ানু,
বিছুরিনু আপন ভাব।
কানুর পিরীতি, বুঝিনু এমতি,
কলঙ্ক হইল লাভ।।
আপন করমে, বুঝিনু মরমে,
বস্তুর নাহিক দোষ।
চণ্ডীদাস কহে, পিরীতি করিয়া,
কেবা পাইল কোথা যশ?
————–
মুড় – মাথা। মীঠ – মিষ্ট। সীঠ – সার বিহীন দ্রব্য। মশল্লা – মসলা।
অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। মল্লার ।।
দিবস রজনী, গুণ গণি গণি,
কি হৈল অন্তরে ব্যথা।
খলের বচনে, পাতিয়া শ্রবণে,
খাইনু আপন মাথা।।
কে বলে পিরীতি ভাল গো সখি
কে বলে পিরীতি ভাল?
সে ছার পিরীতি, ভাবিতে ভাবিতে,
সোণার বরণ কাল।।
সোণার গাগরী, বিষ জল ভরি,
কেবা আনি দিল আগে।
করিনু আহার, না করি বিচার,
এ বধ কাহারে লাগে।।
নীর লোভে মৃগী, পিয়াসে ধাইতে,
ব্যাধ শর দিল বুকে।
জলের সফরী, আহার করিতে,
বঁড়শী লাগিল মুখে।।
নবঘন হেরি, পিয়াসে চাতকী,
চঞ্চু পসারল আশে।
বারিক কারণ, বহল পবন,
কুলিশ মিলল শেষে।।
লাখ হেম পায়া, যতনে বাঁধিতে,
পড়ল অগাধ জলে।
হেন অনুচিত, করে পাপ বিধি,
দ্বিজ চণ্ডীদাস ভণে।।
————–
গাগরী – কলস; পশ্চিম অঞ্চলে এখনও লোকে গাগরী কহিয়া থাকে।
নবঘন – মেঘ।
চঞ্চু পসারল – ঠোঁট বাড়াইল।
বারিক কারণ – জলের নিমিত্ত।
কুলিশ – বজ্র।