১৫. অনুমেয় তত্ত্বাবলি
রিপাবলিকের মধ্যভাগ অর্থাৎ পঞ্চম খণ্ডের শেষাংশ থেকে সপ্তম খণ্ডের শেষ পর্যন্ত প্রধানত শুদ্ধ দার্শনিক প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা, রাজনীতি নিয়ে নয়। এই প্রশ্নগুলো উত্থাপন করা হয়েছে সহসা একটি বিবৃতি উপস্থিত করেঃ
যতদিন না দার্শনিকরা রাজা হবেন কিংবা এই পৃথিবীর রাজা এবং রাজপুত্রদের দার্শনিকের মনোভাব এবং ক্ষমতা না হবে এবং যতদিন না রাজনৈতিক মহত্ত্ব ও প্রজ্ঞা একসঙ্গে মিশবে ও সাধারণ লোক যারা একটিকে বর্জন করে অন্য একটিকে অনুসরণ করেন, তাঁদের বাধ্যতামূলকভাবে একঘরে করা হবে, ততদিন পর্যন্ত নগরগুলো এই সমস্ত দোষ থেকে মুক্ত হবে না-না। আমার বিশ্বাস মনুষ্য জাতিও এই দোষ থেকে মুক্ত হবে না এবং একমাত্র এরকম হলেই আমাদের রাষ্ট্রের বাস্তবায়ন সম্ভব এবং জন্মগ্রহণ সম্ভব।
একথা যদি সত্য হয় তাহলে আমাদের ঠিক করতে হবে দার্শনিক কী দিয়ে গঠিত হন এবং দর্শন বলতে আমরা কী বুঝি। পরবর্তী আলোচনা রিপাবলিকের সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত অংশ নিয়ে এবং বোধহয় এর প্রভাব ছিল সর্বাপেক্ষা অধিক। কোনো কোনো অংশে এর রয়েছে অনন্যসাধারণ সাহিত্য সৌন্দর্য- বক্তব্যের সঙ্গে পাঠকের মতভেদ থাকতে পারে (যেমন আমার আছে) কিন্তু পাঠ করে বিচলিত না হয়ে উপায় নেই।
প্লাতনের দর্শনের ভিত্তি বাস্তবতা (reality) এবং আভাস (appearance)-এর পার্থক্য। এটা প্রথম উপস্থাপন করেছিলেন পার্মেনিদেস। এখন আমরা যে আলোচনা নিয়ে বিচার করছি তার প্রায় সর্বত্রই পার্মেনিদেসীয় বাক্যাংশ এবং যুক্তি বার বার ফিরে এসেছে। কিন্তু বাস্তবতা সম্পর্কে একটা ধর্মীয় ভাব রয়েছে, সেগুলো পার্মেনিদেসীয় নয় বরং পুথাগোরীয় এবং গণিত ও সংগীতশাস্ত্র বিষয়ে এমন অনেক কিছু আছে যেগুলোর প্রত্যক্ষ উৎস পুথাগোরাসের শিষ্যসম্প্রদায়। পার্মেনিদেসের যুক্তি এবং পুথাগোরাসের ও অফীয়দের অপার্থিবতার সমন্বয় এমন একটি মতবাদ সৃষ্টি করেছিল, যে মতবাদ বুদ্ধি এবং ধর্মীয় ভাবাবেগ দুটিকেই তৃপ্ত করতে পেরেছিল। এর ফল হয়েছিল অত্যন্ত শক্তিশালী এক সংশ্লেষণ (synthesis) যা নানারকম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে হেগেল পর্যন্ত (হেগেলও এর অন্তর্ভুক্ত) মহান দার্শনিকদের অধিকাংশকে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু শুধুমাত্র দার্শনিকরাই প্লাতনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন তা নয়। পিউরিটানরা কেন ক্যাথলিক চার্চের সংগীত, চিত্রণ এবং জাঁকজমকপূর্ণ ক্রিয়াকলাপের বিরোধী ছিলেন? এর উত্তর আপনি পাবেন রিপাবলিকের দশম খণ্ডে। বিদ্যালয়ের ছাত্রদের কেন পাটীগণিত পড়তে বাধ্য করা হয়? এর যুক্তিগুলো দেওয়া হয়েছে সপ্তম খণ্ডে।
পরবর্তী অনুচ্ছেদগুলোতে প্লাতনের ধারণাতত্ত্বের সংক্ষিপ্তসার দেওয়া হয়েছে।
আমাদের প্রশ্ন হলো ও দার্শনিক কাকে বলে? প্রথম উত্তর শব্দপ্রকরণ (etymology) অনুসারে : দার্শনিক একজন প্রজ্ঞাপ্রেমিক। কিন্তু এটা জ্ঞানপ্রেমিকের মতো জিনিস নয়- যে অর্থে একজন কৌতূহলী মানুষ জ্ঞানকে ভালোবাসেন বলে বলা হয় এটা ঠিক সে অর্থে নয়। অমার্জিত কৌতূহলে দার্শনিক তৈরি হয় না। সুতরাং সংজ্ঞা সংশোধন করা হলো : দার্শনিক সত্যের দৃষ্টিকে ভালোবাসেন। কিন্তু এই দৃষ্টি কাকে বলে?
এমন একজনের কথা ভাবা যাক যিনি জিনিস ভালোবাসেন, যিনি নতুন বিয়োগান্ত নাটক দেখা, নতুন চিত্রকলা দেখা এবং নতুন সংগীত শোনা কর্তব্য বলে মনে করেন। এরকম মানুষ দার্শনিক নন, কারণ, তিনি শুধুমাত্র সুন্দর জিনিস ভালোবাসের অথচ দার্শনিক ভালোবাসেন সৌন্দর্য। যে মানুষ সুন্দর জিনিস ভালোবাসেন তিনি স্বপ্ন দেখছেন কিন্তু যে মানুষ পরম সৌন্দর্য (absolute beauty) জানেন তিনি সম্পূর্ণ জেগে আছেন। প্রথমোক্তের রয়েছে শুধুমাত্র মত, শেষোক্তের রয়েছে জ্ঞান।
জ্ঞান এবং মত-এর ভিতরে পার্থক্য কী? যে মানুষের জ্ঞান রয়েছে তার রয়েছে কোনো কিছু সম্পৰ্কীয় জ্ঞান অর্থাৎ এমন কোনো কিছু যার অস্তিত্ব রয়েছে। তার কারণ যার অস্তিত্ব নেই সেটা কিছুই নয় (এ কথা পার্মেনিদেসকে স্মরণ করিয়ে দেয়)। সুতরাং জ্ঞান নির্ভুল, কারণ, যৌক্তিক বিচারে এক্ষেত্রে ভুল হওয়া অসম্ভব। কিন্তু মত-এর ভুল হতে পারে। এটা কি করে হয়? যা নেই সে সম্পর্কে মত থাকতে পারে না, কারণ, সেটা অসম্ভব। আর যা আছে সে সম্পর্কেও মত থাকতে পারে না, কারণ, তাহলে তো সেটা জ্ঞান-এ পরিণত হতো। সুতরাং মত অবশ্যই হবে যা আছে এবং যা নেই- উভয় সম্পর্কে।
কিন্তু এটা কী করে সম্ভব? উত্তরটা হলো বিশেষ বিশেষ জিনিসের সবসময়ই বিপরীত ধর্ম থাকে : যা সুন্দর সেটা কোনো কোনো বিষয়ে কুৎসিত; যেটা ন্যায্য সেটা কোনো কোনো দিক দিয়ে অন্যায্য, ইত্যাদি ইত্যাদি। প্লাতনের যুক্তি-ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রতিটি বিশেষ বস্তুরই বিপরীত ধর্ম রয়েছে, সুতরাং সেগুলো অস্তিত্ব এবং অনস্তিত্বের মাঝামাঝি এবং সেগুলো মতের কারণ হওয়ার উপযুক্ত কিন্তু জ্ঞানের উপযুক্ত নয়। কিন্তু যারা পরম, চিরন্তন এবং অপরিবর্তনীয়কে জানেন, বলা যেতে পারে তাদের জ্ঞান আছে, শুধুমাত্র মত নয়।
সুতরাং আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই- মত হলো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিশ্ব সম্পর্কে আর জ্ঞান হলো অতীন্দ্রিয় চিরন্তন বিষয় সম্পর্কে। উদাহরণ-মত হলো কোনো একটি বিশেষ সুন্দর বস্তু সম্পর্কে কিন্তু জ্ঞান সৌন্দর্য নিয়ে।
একমাত্র যুক্তি দেখানো হয়েছে যে, একটি জিনিস সুন্দর এবং অসুন্দর-দুই-ই হতে পারে কিংবা ন্যায্য ও অন্যায্য দুই-ই হতে পারে- এই বিবৃতি স্ববিরোধী। তবুও বিশেষ বস্তুগুলোতে এই পরস্পর বিরোধী ধর্মের সমন্বয় রয়েছে বলেই মনে হয়। সুতরাং বিশেষ বস্তুগুলো বাস্তব নয়। হেরাক্লিস বলেছেন, আমরা একই নদীতে নামি এবং নামি না, আমরা আছি এবং নেই। কিন্তু এটাই পার্মেনিদেসের সঙ্গে সংযুক্ত করে আমরা প্লাতনের ফলে উপনীত হই।
কিন্তু প্লাতনের মতবাদে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এমন বস্তু রয়েছে যার চিহ্ন তাঁর পূর্বগামীদের মধ্যে পাওয়া যায় না এবং সেটা হলো ধারণা কিংবা আকার সম্পৰ্কীয় তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অংশত যৌক্তিক অংশত অধিবিদ্যক। যৌক্তিক অংশ সাধারণ শব্দের অর্থের সঙ্গে জড়িত। এরকম অনেক একক বস্তু আছে যাদের বলতে পারি এটি একটি বিড়াল। এটা সত্য ভাষণ। আমরা বিড়াল শব্দ বলতে কী বুঝি? স্পষ্টতই প্রতিটি বিশেষ বিড়াল থেকে পৃথক একটি বস্তু। মনে হয়, একটি জন্তুকে বিড়াল বলা হয়, তার কারণ, সমস্ত বিড়ালের সাধারণ ধর্মের সে অংশীদার। বিড়ালের মতো সাধারণ শব্দ ছাড়া ভাষা অচল এবং স্পষ্টতই এই ধরনের শব্দ অর্থহীন নয়। কিন্তু বিড়াল শব্দের যদি কোনো অর্থ থেকে থাকে তাহলে সেটা এই বিড়াল কিংবা ঐ বিড়াল নয়, সেটা হলো এক ধরনের নির্বিশেষ (universal) বিড়ালত্ব। এর জন্মক্ষণ একটি বিশেষ বিড়ালের জন্মক্ষণ নয় এবং এর মৃত্যুক্ষণও একটি বিশেষ বিড়ালের মৃত্যুক্ষণ নয়। আসলে স্থান-কালে এর কোনো অবস্থান নেই, এটা শাশ্বত (eternal) এটা হলো মতবাদটির যৌক্তিক অংশ। শেষ পর্যন্ত, বৈধ হোক কিংবা না হোক এর সপক্ষে যুক্তিগুলো শক্তিশালী এবং মতবাদের অধিবিদ্যক অংশের উপর নির্ভরশীল নয়।
এই মতবাদের অধিবিদ্যক অংশ অনুসারে বিড়াল শব্দের অর্থ একটি আদর্শ বিড়াল, বিড়ালটি ঈশ্বরসৃষ্ট এবং অনন্য। বিশেষ বিশেষ বিড়ালে বিড়ালটির কিয়দংশ থাকে কিন্তু কমবেশি অসম্পূর্ণভাবে। নিখুঁত না হওয়ার দরুনই বিড়ালের অস্তিত্বের সম্ভাবনা। বিড়ালটি বাস্তব, বিশেষ বিশেষ বিড়াল আভাস মাত্র।
রিপাবলিকের শেষ অংশে চিত্রকরদের নিন্দার ভূমিকা হিসেবে ধারণা (আভাস-idea) কিংবা আকার সম্পর্কে মতবাদ খুব স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে।
এখানে প্লাতন ব্যাখ্যা করেছেন যে, যখনই একাধিক ব্যক্তির সাধারণ নাম থাকে তখনই তাদের একটি সাধারণ ধারণা (idea) কিংবা আকারও থাকে। উদাহরণ যদিও অনেক শয্যা রয়েছে তবুও শয্যার একটিমাত্র ধারণা কিংবা আকার রয়েছে। ঠিক যেমন দর্পণে শয্যার প্রতিবিম্ব ধারণা মাত্র, বাস্তব নয়, তেমনই নানা বিশেষ বিশেষ শয্যাও অবাস্তব, সেগুলো শুধুমাত্র ধারণা শয্যার নকল- যেটি একমাত্র বাস্তব শয্যা এবং ঈশ্বরসৃষ্ট। ঈশ্বরসৃষ্ট একটি শয্যা সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে পারে কিন্তু সূত্রধরের নির্মিত বিবিধ শয্যা সম্পর্কে থাকতে পারে শুধু মত। এই হিসেবে দার্শনিকের আকর্ষণ শুধুমাত্র একটি বাস্তব শয্যার দিকে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের বহু শয্যার দিকে নয়। সাধারণ জাগতিক ব্যাপারে সে একটু নিস্পৃহ হতে পারে, যার মানসে সর্বকাল এবং সর্ব অস্তিত্বের দর্শক হওয়ার মতো চমৎকারিত্ব রয়েছে সে মনুষ্যজীবন সম্পর্কে কী করে উচ্চ ধারণা পোষণ করবে? যে তরুণের দার্শনিক হওয়ার ক্ষমতা রয়েছে সে তার অন্যান্য সাথীদের তুলনায় হবে ন্যায়পরায়ণ ভদ্র স্বভাবের, শিখতে আগ্রহী, ভালো স্মৃতিশক্তির অধিকারী এবং স্বাভাবিকভাবে তার মন হবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এইরকম তরুণকে দার্শনিক এবং অভিভাবক হওয়ার জন্য শিক্ষা দেওয়া হবে।
এখানে আদেইমান্তস (Adeimantus) প্রতিবাদ করে ওঠেন। তিনি বলেন, যখন সাতেসের সঙ্গে তর্ক করার চেষ্টা করেন তখন তাঁর মনে হয় তিনি প্রতি পদক্ষেপেই পথভ্রষ্ট হচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর পূর্বের সব ধারণাই উল্টে যায়। কিন্তু সক্রাতেস যা-ই বলুন না কেন, ব্যাপারটা এই রকমই। সবাই দেখতে পান যাঁরা দর্শন নিয়ে আবিষ্ট থাকেন তাঁরা পরিণত হন এক অদ্ভুত দানবে, এমনকি পাকা বদমায়েসেও। তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ যারা তাদেরও দর্শনশাস্ত্র অপদার্থ করে দেয়।
সক্রাতেস মেনে নেন পৃথিবীর বর্তমান অবস্থায় এ বক্তব্য সত্য কিন্তু তাঁর মতে এর জন্য দায়ী দার্শনিকরা নন, দায়ী বাকিরা। জ্ঞানীদের সমাজে দার্শনিকদের বোকা মনে হবে না, শুধুমাত্র বোকাদের ভিতরে জ্ঞানীদের নির্বোধ বলে মনে হবে।
এই উভয়সঙ্কটে কী করা উচিত? আমাদের গণরাষ্ট্র (Republic) দুভাবে শুরু হতে পারে- দার্শনিকদের শাসক হওয়া কিংবা শাসকদের দার্শনিক হওয়া। শুরুতে প্রথম উপায়টি অসম্ভব বলেই মনে হবে, কারণ, যে নগর আগে থেকেই দার্শনিক নয় সেখানে দার্শনিকরা জনপ্রিয় নন। কিন্তু জন্মসূত্রে রাজপুত্র একজন দার্শনিক হতে পারেন এবং একজনই যথেষ্ট; এমন একজন মানুষ থাকুন একটি নগর যার ইচ্ছা পালন করে এবং তিনি হয়তো সেই লোক যিনি একটি আদর্শ রাজনৈতিক অবস্থার অস্তিত্ব সম্ভব করতে পারেন যার সম্বন্ধে বিশ্ব এত অবিশ্বাসী। প্লাতনের আশা ছিল সুরাকুজে-র স্বেচ্ছাচারী শাসক কনিষ্ঠ দিওনিসিয়স এই রকম একজন রাজপুত্র হবেন কিন্তু এই যুবকের পরিণতি তাঁকে হতাশ করেছিল।
রিপাবলিকের ষষ্ঠ এবং সপ্তম খণ্ডে প্লাতন দুই প্রশ্ন নিয়ে ব্যস্ত : প্রথম, দর্শন কী? দ্বিতীয়, উপযুক্ত মানসিকতাসম্পন্ন একজন তরুণ কিংবা তরুণীকে কীভাবে দার্শনিক হওয়ার মতো শিক্ষা দেওয়া যায়?
প্লাতনের কাছে দর্শনশাস্ত্র একধরনের দৃষ্টি, সত্যের দৃষ্টি (vision of truth) এটা শুদ্ধ বৌদ্ধিক নয়, শুধুমাত্র প্রজ্ঞা নয়, এটা হলো প্রজ্ঞাপ্রীতি (love of wisdom) স্পিনোজা-র বৌদ্ধিক ঈশ্বর প্রীতি অনেকটাই এরকম চিন্তা এবং ভাবাবেগের ঘনিষ্ঠ মিলন। কোনো সৃজনশীল কর্ম করেছেন এরকম প্রত্যেকেরই কমবেশি অভিজ্ঞতা হয়েছে-বহু পরিশ্রমের পর মনের এমন একটা অবস্থা আসে যখন সত্য কিংবা সৌন্দর্য উপস্থিত হয় কিংবা উপস্থিত হয়েছে বলে মনে হয়-উপস্থিত হয় সহসা ও সগৌরবে। হতে পারে বিষয়টা অতি ক্ষুদ্র কিংবা সমগ্র মহাবিশ্ব সম্পর্কীয়। সে মুহূর্তে এই অভিজ্ঞতা খুবই বিশ্বাসযোগ্য, পরে হয়তো সন্দেহ দেখা দিতে পারে কিন্তু সেই সময়ে থাকে সম্পূর্ণ নিশ্চিত। আমি মনে করি শিল্পে, বিজ্ঞানে, সাহিত্যে এবং দর্শনশাস্ত্রে সৃজনশীল কর্ম এইরকমই একটি মুহূর্তের ফল। আমার কাছে যেমন আসে, অপরের কাছেও তেমনি আসে কিনা জানি না। আমার বেলায় আমি দেখেছি কোনো বিষয়ে যখন একটা বই লিখতে যাই তখন প্রথমে সেই বিষয়ের প্রতিটি খুঁটিনাটিতে আমাকে আবশ্যিকভাবে ডুবে যেতে হবে যতক্ষণ না তার বিভিন্ন অংশের প্রতিটি ব্যাপার সড়গড় হচ্ছে। তারপর কোনো একদিন, কপাল যদি ভালো হয়, তাহলে আমি অনুভব করব সমগ্রকে তার সমস্ত অংশের আন্তসম্পৃক্ততা সহযোগে। তারপর বাকি থাকে শুধুমাত্র আমি যা দেখেছি সেটা লিখে ফেলা। এর নিকটতম তুলনা হলো কুয়াশার ভিতরে একটি পাহাড়ের সব জায়গায় হাঁটা, যতক্ষণ না প্রতিটি পথ, প্রতিটি শিখর এবং প্রতিটি উপত্যকা পৃথকভাবে পরিচিত হয়ে যায়। তারপর দূর থেকে উজ্জ্বল সূর্যালোকে পাহাড়টিকে সম্পূর্ণভাবে দর্শন করা।
আমার বিশ্বাস, ভালো সৃজনশীল কাজে এ অভিজ্ঞতা প্রয়োজন কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়, আসলে এর সঙ্গে যে ব্যক্তিনিষ্ঠ নিশ্চিত উপস্থাপিত হয় সেটা মারাত্মক বিপথগামীতা সৃষ্টি করতে পারে। উইলিয়াম জেমস (William James) একটি লোকের লাফিং গ্যাস থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়েছেন। যখনই তিনি এ গ্যাসের প্রভাবে থাকতেন তখনই মহাবিশ্বের গুপ্তরহস্য জানতে পারতেন কিন্তু সম্পূর্ণ জ্ঞান ফিরে এলে সেটা ভুলে যেতেন। শেষ পর্যন্ত, একবার তিনি খুবই চেষ্টা করে এই সত্যদৃষ্টি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই লিখে ফেললেন। সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার পরে তিনি ছুটলেন কী লিখেছেন সেটা দেখবার জন্য। লেখা ছিল? সর্বত্র পেট্রলের গন্ধ বর্তমান। যাকে সহসালব্ধ অন্তদৃষ্টি মনে হয়, সেটা ভুলপথে নিয়ে যেতে পারে। সুতরাং ঐশ্বরিক উন্মাদনা চলে যাওয়ার পর সেটা শান্তভাবে বিচার করা আবশ্যক।
প্লাতন যখন রিপাবলিক বইটি লিখেছেন তখন তিনি নিজের সত্যদৃষ্টিতে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতেন, এই দৃষ্টি পাঠকদের বোঝানোর জন্য শেষ পর্যন্ত একটা উপদেশাত্মক রূপককাহিনীর সাহায্য প্রয়োজন- গুহার রূপককাহিনী। কিন্তু পাঠককে ধারণার জগতের প্রয়োজনীয়তা বোঝানোর জন্য বহু প্রাথমিক আলোচনার সাহায্যে প্রস্তুত করা হয়।
প্রথমত, বৌদ্ধিক জগৎ এবং অনুভূতির জগৎকে পৃথক করা হয়, তারপর বুদ্ধি এবং ইন্দ্রিয়ানুভূতি-প্রতিটিকে দুটি ভাগ করা হয়। দুই ধরনের ইন্দ্রিয়ানুভূতি আমাদের প্রয়োজন নেই; দুই ধরনের বুদ্ধির নাম দেওয়া হয়েছে, যুক্তি (reason) এবং বোধগম্যতা (understanding)। এদের ভিতরে যুক্তি হলো উচ্চতর, এর কাজকর্ম শুদ্ধ ধারণা শক্তি নিয়ে এবং এর পদ্ধতি হলো দ্বান্দ্বিক (dialectic)। বোধগম্যতা সেই ধরনের বুদ্ধি যা গণিতে ব্যবহার করা হয়, এটা যুক্তির চেয়ে নিম্নস্তরের। তার কারণ, এক্ষেত্রে এমন প্রকল্প ব্যবহার করা হয় যেটা পরীক্ষা করা যায় না। যেমন- জ্যামিতির ক্ষেত্রে আমরা বলে থাকি ও ধরে নেওয়া যাক ABC একটি সরলরেখাবদ্ধ ক্রিকোণ। কিন্তু সত্যিই ABC সরলরেখাবদ্ধ ক্রিকোণ কিনা এ প্রশ্ন উত্থাপন করা নিয়মবিরুদ্ধ, অবশ্য এটা যদি আমাদের আঁকা একটি চিত্র হয় তাহলে নিশ্চিত হতে পারি যে, যেহেতু পরম ঋজুরেখা আঁকা সম্ভব নয় তাই ওটি সরলরেখাবদ্ধ ক্রিকোণ নয়। সেইজন্য গণিতশাস্ত্র কখনোই আমাদের বলতে পারে না কি বর্তমান, শুধু বলতে পারে কি হতো যদি…..। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিশ্বে কোনো ঋজুরেখা নেই, সুতরাং গণিতশাস্ত্রের যদি প্রকল্পিত সত্যের চেয়ে আরও কিছু বেশি থাকতে হয় তাহলে আমাদের অতীন্দ্রিয় জগতে অতীন্দ্রিয়গ্রাহ্য ঋজুরেখার অস্তিত্বের সাক্ষ্য খুঁজে পেতে হবে। বোধগম্যতা দিয়ে এ কর্ম করা যায় না, তবে প্লাতনের মতে যুক্তি দিয়ে করা যায়। এ থেকে বুঝা যায় যে, স্বর্গে একটি সরলরেখাবদ্ধ ত্রিকোণ আছে, সেটা নিয়ে জ্যামিতিক প্রস্তাবের সত্যতা নিশ্চিতভাবে ঘোষণা করা যায়, প্রকল্পিতভাবে নয়।
ঠিক এখানে একটা অসুবিধা দেখা দেয়, এ অসুবিধা প্লাতনের দৃষ্টি এড়ায়নি এবং এড়ায়নি আধুনিক ভাববাদী দার্শনিকদের দৃষ্টিও। আমরা দেখেছি ঈশ্বর একটিমাত্র শয্যা নির্মাণ করেছিলেন এবং স্বাভাবিকভাবেই অনুমান করা যায় তিনি মাত্র একটি ঋজুরেখা নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু যদি একটি স্বর্গীয় ত্রিভুজ থেকে থাকে তাহলে তিনি অন্ততপক্ষে তিনটি সরলরেখা নির্মাণ করেছেন। জ্যামিতিক বস্তুগুলো ধারণাসিদ্ধ হলেও বহু উদাহরণে অবশ্যই তার অস্তিত্ব থাকবে, আমাদের দুটি পরস্পরছেদী বৃত্তের সম্ভাব্যতার প্রয়োজন-ইত্যাদি, ইত্যাদি। এ থেকে আভাস পাওয়া যায় যে, প্লাতনের মতের উপর নির্ভর করে চরম সত্যে পৌঁছানোর ক্ষমতা জ্যামিতির নেই বরঞ্চ আভাসপাঠের অংশ বলে জ্যামিতি নিন্দনীয়। আমরা কিন্তু এ ব্যাপারটাকে অগ্রাহ্য করব; এই প্রশ্নে প্লাতনের উত্তরও অস্পষ্ট।
সুস্পষ্ট বৌদ্ধিক দৃষ্টি এবং অস্পষ্ট ইন্দ্রিয়ানুভূতির পার্থক্য প্রাতন বোঝাতে চেষ্টা করেছেন দৃষ্টি-অনুভূতির একটা উপমা দিয়ে। তিনি বলছেন, অন্যান্য ইন্দ্রিয়ানুভূতির সঙ্গে দৃষ্টির একটা পার্থক্য রয়েছে, কারণ, দেখবার জন্য শুধুমাত্র চোখ এবং বস্তুরই প্রয়োজন নয়, প্রয়োজন আলোকেরও। সূর্যালোকে বস্তুগুলোতে আমরা স্পষ্টভাবে দেখিঃ সন্ধ্যায় দেখি অস্পষ্টভাবে এবং গাঢ় অন্ধকার হলে কিছুই দেখতে পাই না। সূর্যালোকিত উদ্ভাসিত বস্তু হলো ধারণার জগৎ কিন্তু চলমান বস্তুর জগৎ হলো অস্পষ্ট সন্ধ্যালোকের জগৎ। চোখকে তুলনা করা হয়েছে আত্মার সঙ্গে এবং আলোকের উৎস সূর্যকে কল্পনা করা হয়েছে সত্য কিংবা মাঙ্গল্যের সঙ্গে।
আত্মা যেন এক চোখ : সত্য এবং অস্তিত্ব যাতে উদ্ভাসিত তার উপর নিবদ্ধ হলে আত্মা উপলব্ধি করে এবং বোঝে আর সে তখন বুদ্ধিতে উজ্জ্বল। কিন্তু যখন অস্তিত্ব ও অস্তিত্বহীনতার গোধূলির মুখোমুখি হয় তখন তার থাকে শুধুমাত্র মত ও পিটপিট করতে থাকে। প্রথমে একরকম মত হয়, পরে হয় আর একরকম এবং মনে হয় বুঝি তার কোনো বুদ্ধি নেই….। জ্ঞাত বস্তুকে যা সত্য দান করে এবং জ্ঞাতাকে যে জ্ঞান অর্জনের ক্ষমতা দান করে- আমি তোমাদের বলব তাকেই শ্রেয়-র ধারণা আখ্যা দিতে এবং একেই তোমরা বলবে বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য।
গুহা কিংবা গহবরের বিখ্যাত উপমার এটাই পথিকৃৎ, এই উপমা অনুসারে যারা দর্শনশাস্ত্রে অজ্ঞ তাদের তুলনা করা যেতে পারে, গুহাবন্দী মানুষের সঙ্গে। তারা শুধুমাত্র একটি দিকেই দৃষ্টিপাত করতে পারে, কারণ, তারা বদ্ধ, তাদের পশ্চাতে রয়েছে এক অগ্নি এবং সম্মুখে একটি প্রাকার। প্রাকার এবং তাদের মাঝখানে কিছু নেই, তারা যা দেখে তা শুধুমাত্র আপন ছায়া এবং নিজেদের পশ্চাদ্বতী বস্তুসমূহের ছায়া, আগুনের আলোয় ছায়াগুলো প্রাকারের উপর পড়ছে। এই ছায়াগুলোকে বাস্তব বলে মনে করা তাদের পক্ষে অবশ্যম্ভাবী এবং ছায়ার কারণ বস্তুগুলো সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। শেষ পর্যন্ত কোনো একজন ঐ গুহা থেকে পালিয়ে সূর্যালোকে পৌঁছাতে সক্ষম হয় এই প্রথম সে বাস্তব বস্তুগুলোকে দেখে এবং জানতে পারে এতদিন পর্যন্ত ছায়াগুলো তাকে প্রতারণা করেছে। যদি সে অভিভাবক হওয়ার উপযুক্ত দার্শনিক হয় তাহলে তার আবার গুহায় নামা উচিত। তাদের সত্যটা বোঝানো উচিত এবং উচিত উত্তরণের পথনির্দেশ করা। কিন্তু তাদের স্বমতে আনা কঠিন হবে, কারণ, সূর্যালোক থেকে আসার দরুন গুহাবাসী অন্যদের তুলনায় ছায়াগুলিকে সে অনেক অস্পষ্টভাবে দেখবে এবং পলায়নের পূর্বাবস্থার তুলনায় তাকে মনে হবে নির্বোধতর।
এইবার, আমি বলেছিলাম, একটা ছবি দিয়ে দেখানো যাক আমাদের স্বভাব কতটা। আলোকিত অথবা অনালোকিত? দেখ! পাতালের গুহাবাসী মানুষ, সে গুহার একটা মুখই আলোকের দিকে উন্মুক্ত, সেই আলোকে সমস্ত গুহাতেই পৌঁছায়। এই গুহাতে তারা আশৈশব রয়েছে, তাদের গ্রীবা আর পদযুগল শৃঙ্খলাবদ্ধ, তাই তারা অনড়, শুধুমাত্র সম্মুখ দর্শনে সক্ষম, কারণ, শৃঙ্খল তাদের মাথা ঘোরাতে বাধা দিচ্ছে। তাদের পশ্চাতে এবং ঊর্ধ্বে একটি জ্বলন্ত অগ্নি কিছু দূরত্বে অবস্থিত এবং অগ্নি ও বন্দীদের মাঝে রয়েছে একটা উন্নত পথ এবং তাকালে দেখতে পাবে রাস্তা বরাবর রয়েছে একটা নিচু প্রাকার। প্রাকারটা অনেকটা পুতুল নাচিয়েদের দৃশ্যপটের মতো, সেটাই তো তাদের সামনে অবস্থিত-তার উপরেই তারা পুতুল নাচ দেখায়।
বুঝলাম।
আমি বললাম, আর দেখতে পাচ্ছ প্রাকার বরাবর সব মানুষেরা চলেছে, তারা বহন করছে নানারকম ভাণ্ড এবং মূর্তি ও কাঠ, পাথর ও নানা ধরনের জিনিস দিয়ে তৈরি নানা জন্তুর প্রতিমূর্তি, প্রাকারের উপর যেগুলো দেখা যাচ্ছে? তাদের কেউ কথা বলছে, কেউ নির্বাক।
আপনি আমাকে এক বিচিত্র চিত্র দেখালেন ও তারা সব বিচিত্র বন্দী।
আমি উত্তর দিয়েছিলাম, আমাদেরই মতো। তারা শুধুমাত্র নিজেদেরই ছায়া দেখে কিংবা দেখে পরস্পরের ছায়া। গুহার ভিতরকার উল্টোদিকের দেওয়ালে পিছনের আগুনের আলোয় ছায়াগুলো পড়ে।
উত্তমের স্থানটা প্লাতনের দর্শনে একটু অদ্ভুত। তাঁর মতে, বিজ্ঞান এবং সত্য উত্তমের মতো কিন্তু উত্তমের স্থান উচ্চতর। উত্তম সার (essence) নয়, মর্যাদা এবং ক্ষমতার সার-এর চাইতে অনেক অধিক। পরম উত্তমের অনুভূতি বিষয়ে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি বৌদ্ধিক জগতের অবসানের পথিকৃৎ। এই উত্তমের সাহায্যেই দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি গণিতজ্ঞের প্রকল্পগুলোকে ত্যাগ করতে পারে। অন্তর্নিহিত অনুমান-বাস্তব সম্পূর্ণভাবে এবং বিশুদ্ধভাবে উত্তম, এটা আভাসের বিপরীত। সুতরাং উত্তমকে অনুভব করা হলো বাস্তবকে অনুভব করা। প্লাতনের সমগ্র দর্শনে পুথাগরসবাদের মতো একইরকম বুদ্ধি এবং অতীন্দ্রিয়বাদের সংযুক্তি রয়েছে কিন্তু এই অন্তিম পরিণতিতে দেখা যায়। অতীন্দ্রিয়বাদ স্পষ্টতই প্রাধান্য লাভ করেছে।
প্লাতনের ধারণা সম্পর্কিত মতবাদে একাধিক সুস্পষ্ট ভুল রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই মতবাদ দর্শনশাস্ত্রের অগ্রগতির একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক, কারণ সার্বিকের (univdrsal) সমস্যাকে সর্বপ্রথম এই তত্ত্বই গুরুত্ব দিয়েছে। এই সমস্যা নানা রূপে আধুনিককাল পর্যন্ত বর্তমানে রয়েছে। আরম্ভগুলো অসংস্কৃত (crude) হয়ে থাকে কিন্তু এই কারণে তার মৌলিকত্ব অগ্রাহ্য করা উচিত নয়। প্রয়োজনীয় সমস্ত সংশোধনের পরেও প্লাতনের বক্তব্যের কিছু বস্তু অবশিষ্ট থাকে। প্লাতনের প্রতি যারা সর্বাপেক্ষা শত্রুভাবাপন্ন তাদের দৃষ্টিতেও তাঁর মতবাদের স্বল্পতম যা অবশিষ্ট থাকে তা হলো? শুধুমাত্র ব্যক্তিবাচক নাম দিয়ে গঠিত একটি ভাষার দ্বারা আমরা নিজেদের ভাব প্রকাশ করতে পারি না, আমাদের সাধারণ শব্দ দরকার, যেমন মানুষ, কুকুর, বিড়াল, অথবা এগুলো যদি না হয় তাহলে সম্পর্কসূচক শব্দ প্রয়োজন যেমন-সদৃশ, পূর্বে-এবং এরকম। এই শব্দগুলো অর্থহীন শব্দ মাত্র নয় এবং পৃথিবীতে যদি শুধুমাত্র ব্যক্তিবাচক নাম দ্বারা নির্দিষ্ট বিশেষ বস্তুগুলোই থাকে তাহলে কী করে এদের অর্থ হতে পারে তা বোঝা মুশকিল। এই যুক্তি খণ্ডনের একাধিক উপায় থাকতে পারে কিন্তু প্রাথমিক দৃষ্টিতে এই বক্তব্য সার্বিক-এর সপক্ষে একটি যুক্তি বলে মানতেই হবে। আমি সাময়িকভাবে এই যুক্তিকে কিছুটা সঠিক বলে মেনে নেব। কিন্তু এতখানি মেনে নেওয়ার পরেও প্লাতনের অবশিষ্ট বক্তব্য গ্রহণীয় হয় না।
প্রথমত, প্লাতনের দার্শনিক বাক্যবিন্যাস সম্পর্কে কোনো বোধ নেই। আমি বলতে পারি সক্রাতেস মনুষ্যোচিত, প্লাতন মনুষ্যোচিত এবং এইরকম। এই বক্তব্যগুলোতে অনুমান করে নেওয়া যেতে পারে মনুষ্যোচিত শব্দটি নির্ভুলভাবে একই অর্থ বহন করছে। কিন্তু এর অর্থ যাই হোক না কেন, সবসময়ই এটা এই অর্থ বহন করে যে, সক্রাতেস, প্লাতন এবং অবশিষ্ট যাঁদের দিয়ে মনুষ্যজাতি গঠিত তাঁদের সর্বক্ষেত্রে এটা সমার্থক নয়। মনুষ্যোচিত শব্দটি একটি বিশেষণ, মনুষ্যোচিত হলো মনুষ্যোচিত একথার কোনো অর্থ হয় না। মনুষ্যোচিত হলো মনুষ্যোচিত এই ধরনের কথায় যে ভুল, পাতন সে ধরনের ভুলই করেছিলেন। তার ধারণা সৌন্দর্য সুন্দর। তাঁর চিন্তা অনুসারে সামান্য মানুষ ঈশ্বরসৃষ্টি এক আদর্শ মানুষের নাম, বাস্তব মানুষেরা তার প্রতিচ্ছবি কিন্তু সে প্রতিচ্ছবি নির্ভুল নয় এবং খানিকটা অবাস্তবও বটে। সামান্য এবং বিশেষের পার্থক্য যে কত বিরাট সেটা তিনি বুঝতে একেবারেই সমর্থ হননি। তাঁর ধারণাগুলো আসলে শুধু অন্য বিশেষ, সেগুলো নীতি এবং সৌন্দর্যের দিক দিয়ে সাধারণের চাইতে উন্নততর। পরবর্তীকালে তিনি নিজেই এই অসুবিধাগুলো বুঝতে পারেন, পার্মেনিদেস-এও এরকম দেখা যায়। এটি ইতিহাসে দার্শনিকদের আত্ম সমালোচনার একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।
কথিত আছে, পার্মেনিদেস আন্তিফন (প্লাতনের সৎ ভাই)-এর দ্বারা বিবৃত, একমাত্র তিনিই এই আলোচনাকে মনে রেখেছিলেন কিন্তু তখন ঘোড়া ব্যতীত অন্য কিছুতে তাঁর আকর্ষণ ছিল না। তাঁরা আন্তিফনকে একটি ঘোড়ার লাগাম বহনরত দেখেন এবং বহু কষ্টে তাঁকে পার্মেনিদেস, জেনো এবং সক্রাসেত- এঁদের বিখ্যাত আলোচনা বিবৃত করতে রাজি করান। আমরা শুনেছি, আলোচনা যখন হয় তখন পামেনিদেস বৃদ্ধ (প্রায়। পঁয়ষট্টি বছর), জেনো মাঝবয়সী (প্রায় চল্লিশ বছর) এবং সাতেস তরুণ যুবক। সক্রাতেস তাঁর ধারণাতত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন। তিনি নিশ্চিত যে, সমরূপত্ব, ন্যায়, সৌন্দর্য এবং উত্তমত্বের ধারণা রয়েছে, মানুষ সম্পর্কে ধারণা রয়েছে কিনা সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত নন। কেশ, কর্দম এবং মালিন্যের যে আদর্শ থাকতে পারে এ ধারণাকে তিনি ঘৃণার সঙ্গে বাতিল করে দিয়েছেন। অবশ্য তিনি যোগ করেছেন যে, মাঝে মাঝে মনে হয় পৃথিবীতে ধারণা ছাড়া কোনো কিছুই নেই। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি অপসরণ করেছিলেন, কারণ তার ভয় ছিল অপসরণ না করলে তিনি অতলস্পর্শী মূর্খতার গহবরে গিয়ে পড়বেন।
পার্মেনিদেস বলছেন, হ্যাঁ সক্রাতেস, কারণ তুমি এখনও তরুণ, আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে তাহলে এমন একটা সময় আসবে যখন দর্শনশাস্ত্র তোমাকে আরও গভীরভাবে অধিকার করবে। তখন তুমি ক্ষুদ্রতম জিনিসকেও ঘৃণা করবে না।
সক্রাতেস স্বীকার করে নিলেন তাঁর মত অনুসারে এমন কতকগুলো ধারণা আছে অন্য সব বস্তু যার কিছু অংশ গ্রহণ করে এবং তা থেকেই তাদের নাম হয়। উদাহরণ, সমরূপ সমরূপ হয়, কারণ, তারা সমরূপত্বের অংশীদার এবং মহান বস্তু মহান হয়, কারণ, তারা মহত্ত্বের অংশীদার এবং ন্যায্য ও সুন্দর বস্তু ন্যায্য এবং সুন্দর হয়, কারণ, তারা ন্যায্যতা ও সৌন্দর্যের অংশীদার।
পার্মেনিদেস অসুবিধাগুলোর কথা উল্লেখ করতে শুরু করেন। (ক) ব্যক্তি কি সম্পূর্ণ ধারণাটিরই অংশী? অথবা অংশী শুধুমাত্র একটি অংশের? দুটি মতেই আপত্তি রয়েছে। যদি প্রথমটি সত্য হয় তাহলে একই বস্তুর বহু স্থানে যুগপৎ অস্তিত্ব থাকে। যদি শেষেরটি হয় তাহলে ধারণাকে ভাগ করা সম্ভব এবং যে বস্তুতে ক্ষুদ্রের একটি অংশ রয়েছে সেই বস্তুটি পরম ক্ষুদ্রের চাইতেও ক্ষুদ্রতর-এটা অসম্ভব। (খ) যখন একজন ব্যক্তি একটি ধারণার অংশগ্রহণ করে তখন সেই ব্যক্তি এবং ধারণা- দুটিই সমরূপ, সুতরাং অন্য একটি ধারণা থাকা প্রয়োজন। সে ধারণার ভিতরে থাকবে প্রথম ধারণা এবং অন্যান্য বিশেষ। তাছাড়া, আরও একটি ধারণা থাকতে হবে, তার ভিতরেও থাকবে দুটি ধারণা এবং অন্যান্য বিশেষগুলো এবং এইরকম চলবে সীমাহীনভাবে। সুতরাং প্রতিটি ধারণাই একক না হয়ে অনন্ত ধারণশ্রেণিতে পরিণত হবে। (এটা আরিস্ততেলেসের তৃতীয় মানুষ সম্পর্কীয় যুক্তির সঙ্গে অভিন্ন)। (গ) সক্রাতেস বলতে চাইছিলেন যে, ধারণাগুলো হয়তো শুধুমাত্র চিন্তাধারা কিন্তু পার্মেনিদেস বললেন চিন্তা নিশ্চয় কিছু সম্পর্কীয় চিন্তা। (ঘ) ধারণাগুলো কখনোই তার অংশগ্রহণকারী বিশেষগুলোর সদৃশ হতে পারে না, এর কারণ দেওয়া আছে উপরের খ অংশে। (ঙ) যদি ধারণা কিছু থাকে তাহলে সেটা আমাদের কাছে অজানিত হতেই হবে, কারণ, আমাদের জ্ঞান পরম নয়। (চ) ঈশ্বরের জ্ঞান যদি পরম হয় তাহলে তিনি আমাদের জানবেন না, সুতরাং তিনি আমাদের শাসনও করতে পারেন না।
তবুও ধারণা সম্পর্কীয় তত্ত্ব সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয়নি। সাতেস বলছেন, ধারণা থাকলে স্থিত হবার মতো মনের কিছু থাকবে না, সুতরাং যুক্তি ধ্বংস হয়ে যাবে। পার্মেনিদেস তাঁকে বলছেন যে, তাঁর অসুবিধার কারণ পূর্বশিক্ষার অভাব কিন্তু কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্ত হয়নি।
আমার মনে হয় না অনুভবযোগ্য বিশেষগুলোর বাস্তবতা সম্পর্কে প্লাতনের যৌক্তিক আপত্তি পরীক্ষায় টিকবে। উদাহরণ, তিনি বলছেন, যা কিছু সুন্দর তা কোনো না কোনো দিক থেকে অসুন্দর, যেটা দ্বিগুণ, সেটা অর্ধেকও বটে এবং এইরকম। কিন্তু যখন আমরা কোনো শিল্পকর্ম সম্পর্কে বলি কোনো কোনো দিক থেকে সেটা সুন্দর আবার কোনো কোনো দিক থেকে কুশ্রী, বিশ্লেষণ করলে সবসময়ই (অন্তর তাত্ত্বিকভাবে) আমরা বলতে সক্ষম এই অংশ কিংবা এই দিকগুলো সুন্দর এবং ঐ অংশ কিংবা ঐ দিকগুলো কুশ্রী। তাছাড়া দ্বিগুণ এবং অর্ধেক সম্পর্কে বলা যায় ঐগুলো আপেক্ষিক শব্দ। ২ হল ১-এর দ্বিগুণ এবং ৪-এর অর্ধেক-এই তথ্যের ভিতর কোনো দ্বন্দ্ব নেই। আপেক্ষিক শব্দগুলো না বোঝার জন্য প্লাতন অবিরাম অসুবিধায় পড়ছেন। তিনি ভাবছেন যে, A যদি B-র চাইতে বড় হয় এবং C-র চাইতে ছোট হয় তাহলে A যুগপৎ ক্ষুদ্র এবং বৃহৎ, এটা তাঁর কাছে প্রতিভাত হয়েছে দ্বন্দ্ব রূপে। এই অসুবিধাগুলো দর্শনশাস্ত্রের শৈশবের ব্যাধিগুলোর অন্যতম।
বাস্তবতা এবং আভাসের ভিতরে পার্থক্যের যে ফলাফলের কথা পার্মেনিদেস, প্লাতন এবং হেগেল বলেছেন সেটা হতে পারে না। আভাস যদি আভাসিত হয় তাহলে তাকে কিছু নয় বলা যায় না, সুতরাং সেটা বাস্তবতার অংশ- এটা পার্মেনিদেসীয় ধরনের নির্ভুল যুক্তি। যদি আভাস বাস্তবে আভাসিত না হয় তাহলে তা নিয়ে আমাদের মাথা। ঘামিয়ে কী দরকার? কিন্তু হয়তো কেউ কেউ বলবেন : আভাস বাস্তবে আভাসিত হয় না কিন্তু আভাসিত হচ্ছে বলে আভাস পাওয়া যায়। এতেও কোনো লাভ হবে না, কারণ, আমরা আবার প্রশ্ন করব? এটা কি সত্যিই আভাসিত হচ্ছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে? না, শুধুমাত্র আপাতদৃষ্টিতে আভাসিত হচ্ছে বলে আভাস পাওয়া। যাচ্ছে? আগে হোক পরে হোক, আভাস যদি আভাসিত হচ্ছে বলে আভাস পাওয়া যায় তাহলেও আমাদের এমন কিছুতে পৌঁছাতে হবে যেটা বাস্তবে আভাসিত হয়, সুতরাং সেটা বাস্তবের একটা অংশ। যদিও ঈশ্বরসৃষ্ট একটিমাত্র বাস্তব শয্যা রয়েছে তবুও বহু শয্যার আভাস পাওয়া যায়- এই তথ্য অস্বীকার করার কথা প্লাতন স্বপ্নে ভাবেননি। কিন্তু মনে হয় বহু আভাস রয়েছে এবং এই বহুত্ব বাস্তবের একটি অংশ- এই তথ্যের নিহিতার্থের মুখোমুখি প্লাতন কখনো হননি। বিশ্বকে একাধিক অংশে ভাগ করা এবং তার একটিকে অন্যটির চাইতে বেশি বাস্তব বলার প্রচেষ্টা বিফল হতে বাধ্য।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্লাতনের আর একটি অদ্ভুত মতবাদ- জ্ঞান এবং মত ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে সংযুক্ত। আমাদের বলা উচিত? আমার যদি মনে হয় তুষারপাত হবে তাহলে সেটা মত। পরে যদি আমরা দেখি তুষারপাত হচ্ছে তাহলে সেটা জ্ঞান। দুটি ঘটনাতেই বিষয়বস্তু অভিন্ন। প্লাতন কিন্তু ভাবেন যে, কোনো সময় যা মতবাদের বিষয়বস্তু তা কোনোভাবেই জ্ঞানের বিষয় হতে পারে না। জ্ঞান নিশ্চিত এবং অভ্রান্ত, মত শুধুমাত্র ভ্রান্তই নয় কিন্তু যেহেতু মত যেটা আভাসমাত্র তাকেই বাস্তব বলে গ্রহণ করে সেহেতু এটা ভুল হতে বাধ্য। এসবই পার্মেনিদেসের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি।
প্লাতনের অধিবিদ্যা আপাতদৃষ্টিতে পাৰ্মেনিদেসের অধিবিদ্যার সঙ্গে এক বিষয়ে পৃথক। পার্মেনিদেসের রয়েছে শুরু সেই এক কিন্তু প্লাতনের রয়েছে বহু ধারণা শুধুমাত্র সৌন্দর্য, সত্য এবং শ্রেয় নয়, আমরা দেখেছি ঈশ্বরসমস্ত স্বর্গীয় শয্যাও রয়েছে, রয়েছে স্বর্গীয় মানুষ, স্বর্গীয় কুকুর, স্বর্গীয় বিড়াল এবং এই ধরনের সমগ্র জীবজগৎ, যেমন ছিল নোয়ার (Noah) নৌকায়। মনে হয়, রিপাবলিক পুস্তকে এইসব যথেষ্টভাবে সুচিন্তিত হয়নি। কোনো প্লাতনীয় ধারণা কিংবা আকার চিন্তা নয়, যদিও এটা একটা চিন্তার বিষয়বস্তু হতে পারে। ঈশ্বর কীভাবে এটা সৃষ্টি করেছিলেন তা বোঝা শক্ত কারণ এর অস্তিত্ব কালাতীত এবং চিন্তা না করলে একটি শয্যা সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত তিনি নিতে পারতেন না। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তাঁর বিষয়বস্তু ছিল সেই পুতনীয় শয্যা- এর সম্বন্ধে আমাদের বলা হয়েছে ঈশ্বরই একে অস্তিমান করেছেন। যা কালাতীত তা অবশ্যই অসৃষ্ট। এখানে আমরা এমন একটি অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছি যা বহু দার্শনিক ধর্মতাত্ত্বিককে অসুবিধায় ফেলেছে। শুধুমাত্র আনুষঙ্গিক জগৎ অর্থাৎ স্থান-কাল অবস্থিত জগৎই সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে কিন্তু এটাই আবার দৈনন্দিন জগৎ- একে নিন্দা করা হয়েছে মায়া এবং মন্দ বলে। সুতরাং মনে হয় সৃষ্টিকর্তা শুধুমাত্র মায়া এবং সৃষ্টি করেছেন। কিছু কিছু প্রজ্ঞাবাদী এমনই সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিলেন যে, তারা এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু প্লাতনের ক্ষেত্রে অসুবিধাটা এখনও মাটির গভীরে এবং মনে হয় রিপাবলিকে তিনি এ সম্বন্ধে কখনোই অবহিত ছিলেন না।
.
প্লাতনের মতানুসারে যে দার্শনিক অভিভাবক হবেন তাঁকে গুহাতে ফিরে যেতে হবে এবং সত্যের সূর্য যারা দেখেনি তাদের সঙ্গে বাস করতে হবে। মনে হতে পারে। ঈশ্বর যদি তার সৃষ্টিকে সংশোধন করতে চান তাহলে তাঁকে নিজেকেও একইরকম করতে হবে। প্লাতনের মতাবলম্বী খ্রিষ্টানরা এভাবে অবতার ব্যাখ্যা করতে পারেন। কিন্তু ঈশ্বর কেন ধারণার জগৎ নিয়ে অতৃপ্ত তা ব্যাখ্যা করা সম্পূর্ণ অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। দার্শনিক গুহার অস্তিত্ব দেখতে পান এবং ঔদার্যের জন্য সেখানে ফিরে যেতে চান কিন্তু স্রষ্টা যদি সবই সৃষ্টি করে থাকেন তাহলে মনে হতে পারে গুহাটি সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতে পারতেন।
হয়তো এই সঙ্কটের উৎপত্তি শুধুমাত্র স্রষ্টা সম্পর্কীয় খ্রিষ্টিয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এবং প্লাতনের ঘাড়ে এ দায়িত্ব চাপানো চলে না। তাঁর বক্তব্য-ঈশ্বর সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেননি, সৃষ্টি করেছেন শুধুমাত্র উত্তম। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে অনুভূত জগতের বহুবিধ বস্তুর উৎস ঈশ্বরের কিছু এবং ধারণাগুলো বোধহয় ঈশ্বর সমস্ত ততটা নয় যতটা তার সার পদার্থের অংশ। বহুবিধ ধারণার আপাতদৃষ্ট চরম হবে না। শেষ পর্যন্ত শুধু মাত্র ঈশ্বর কিংবা শ্রেয় রয়েছেন, ধারণাগুলো তাঁরই বিশেষণ। অন্ততপক্ষে এটা প্লাতনের মতবাদের একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা।
যে যুবক অভিভাবক হবেন তাঁর শিক্ষার একটি আকর্ষণীয় রূপরেখা প্লাতন দিতে শুরু করেন। আমরা দেখেছি, যে যুবককে নির্বাচিত করা হয়েছে তাকে এই সম্মান। দেওয়ার কারণ তার বৌদ্ধিক এবং নৈতিক গুণগুলোর সমন্বয়। তাকে অবশ্যই ন্যায়পরায়ণ এবং দ্র হতে হবে, শিক্ষায় আগ্রহ থাকতে হবে এবং থাকতে হবে উত্তম। স্মৃতিশক্তি ও সামঞ্জস্যপূর্ণ মন। যে যুবককে এই গুণগুলোর জন্য নির্বাচন করা হবে তাকে কুড়ি থেকে ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত পুথাগরসনির্দিষ্ট চারটি বিষয় শিখতে হবে? গণিতশাস্ত্র, জ্যামিতি (তল এবং ঘন), জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং সুরবিজ্ঞান। এই শিক্ষাগুলো তাকে নিতে হবে কোনো ব্যবহারিক উদ্দেশ্যে নয়, উদ্দেশ্য হবে তার মনকে শাশ্বত বস্তুসমূহ দর্শনের জন্য তৈরি করা। উদাহরণ, জ্যোতির্বিজ্ঞানে তার আকাশচারী বস্তুপিণ্ড নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাতে হবে না বরং তাকে মাথা ঘামাতে হবে আদর্শ আকাশচারী বস্তুর গতির গণিত নিয়ে। আধুনিক মানুষের কানে ব্যাপারটা অযৌক্তিক মনে হবে কিন্তু অদ্ভুত শোনালেও পরীক্ষামূলক জ্যোতির্বিজ্ঞানে এটা খুব ফলদায়ী দৃষ্টিভঙ্গি বলে প্রমাণিত হয়েছিল। এটা কীভাবে হয়েছিল তা কৌতূহলোদ্দীপক এবং বিচারযোগ্য।
গভীরভাবে বিশ্লেষণের পূর্বে গ্রহগুলোর আপাতদৃষ্ট গতি অনিয়মিত ও জটিল মনে হয় এবং মনে একজন পুথাগোরীয় স্রষ্টার নির্বাচনের অনুপযুক্ত। প্রত্যেক গ্রিকের কাছেই সুস্পষ্ট ছিল- আকাশের উচিত গাণিতিক সৌন্দর্যের উদাহরণস্বরূপ হওয়া, গ্রহগুলো বৃত্তাকারে ঘূর্ণায়মান হলেই তা সম্ভব। প্লাতনের কাছে এটা হতে বিশেষভাবে স্পষ্ট, কারণ তিনি জোর দিতেন উত্তমের উপর। সুতরাং সমস্যা উপস্থিত হলো? এমন, কোনো প্রকল্প কি আছে যা গ্রহগতির আপাতদৃষ্ট বিশৃঙ্খলাকে শৃঙ্খলা, সৌন্দর্য এবং সারল্যে পরিণত করবে? তা যদি থাকে উত্তম সম্পর্কে আমাদের ধারণা এই প্রকল্পকে সমর্থনের একটি যুক্তি হয়ে দাঁড়াবে। সামসবাসী আরিস্তারখস (Aristarchus) এরকম একটি প্রকল্প খুঁজে বার করেছিলেন : পৃথিবী এবং অন্যান্য সমস্ত গ্রহ বৃত্তাকার পথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি অংশত আরিস্ততেলেসের কর্তৃত্বের দরুন দুহাজার বছর পর্যন্ত বাতিল করা হয়েছিল। আরিস্ততেলেস পুথাগোরীয়দের উপর প্রায় একইরকম একটি প্রকল্পের দায় আরোপ করেছিলেন (De Coelo, ২৯৩a)। কোপারনিকাস এই মতকে পুনর্জীবিত করেন এবং এর সাফল্য জ্যোতির্বিজ্ঞানে প্লাতনের নন্দনতত্ত্বের উপর গুরুত্ব দেওয়াকে যুক্তিযুক্ত মনে করতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, কেপলার (Kepler) আবিষ্কার করেন যে, গ্রহগুলো বৃত্তাকারে ভ্রাম্যমাণ নয়, ভ্রাম্যমাণ উপবৃত্তাকারে, সূর্য তার কেন্দ্রে অবস্থিত নয়, অবস্থিত একটি ফোকাস-এ। তারপর নিউটন আবিষ্কার করলেন গ্রহগতি নির্ভুল উপবৃত্তাকারের নয়। সুতরাং প্লতন যে জ্যামিতিক সারল্য খুঁজেছিলেন এবং সামস-এর আরিস্তারখস আপাতদৃষ্টিতে যা খুঁজে পেয়েছিলেন তা শেষে অলীক প্রমাণিত হলো।
বিজ্ঞানের এই ইতিহাসের খণ্ডটি একটি সাধারণ নীতির দৃষ্টান্ত ও যে কোনো প্রকল্প, যতই অবিশ্বাস্য হোক না কেন, বিজ্ঞানে প্রয়োজনীয় হতে পারে, যদি অবশ্য সে প্রকল্প তার আবিষ্কারককে নতুনভাবে একাধিক বস্তু সম্পর্কে ধারণা করার ক্ষমতা দেয়। কিন্তু প্রকল্পটি সৌভাগ্যগুণে তার উদ্দেশ্য সাধন করার পরে পরবর্তী প্রগতির পথে একটা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটি বিশেষ স্তরে বিশ্বকে বৈজ্ঞানিকভাবে বোঝার জন্য শ্ৰেয়তে বিশ্বাসকে একটি চাবিকাঠি মনে করা কার্যকর হয়েছিল কিন্তু পরবর্তী প্রতিটি স্তরে এটি ছিল ক্ষতিকর। প্লাতনের নৈতিক এবং নান্দনিক পক্ষপাতিত্ব এবং আরিস্ততেলেসের এ বিষয়ে অধিকতর পক্ষপাতিত্ব গ্রিক বিজ্ঞানকে হত্যা করতে অনেক সাহায্য করেছে।
উল্লেখযোগ্য যে, কয়েকটি ব্যতিক্রমকে বাদ দিলে আধুনিক প্লাতনবাদীরা গণিতশাস্ত্র সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ অথচ প্লাতন গণিতের উপর ও জ্যামিতির উপর বিরাট গুরুত্ব দিয়েছিলেন এবং তাঁর দর্শনের উপরও গণিত ও জ্যামিতির প্রভাব ছিল বিরাট। বিশেষজ্ঞ হওয়ার দোষের এটা একটা উদাহরণ : যিনি তরুণ বয়সে গ্রিক শেখার জন্য এত সময় ব্যয় করেছেন তাঁর প্লাতন সম্পর্কে লেখা কখনোই উচিত নয়, কারণ, প্লাতন যেসব বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ ভেবেছিলেন সেগুলোর জন্য তাঁর আর সময় থাকেনি।