১৫. অগাধ জলে ঝাঁপ

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
অগাধ জলে ঝাঁপ

চম্পা যখন ঝড়োয়া হইতে ফিরিল তখন অপরাহ্ন। কিস্তার ধারের বারান্দায় গৌরী মেঘাচ্ছন্ন মুখে বুকে হাত বাঁধিয়া পদচারণ করিতেছিল–সঙ্গে কেহ ছিল না। ময়ূরবাহনের শ্লেষ-বিদ্রূপ একটা কাজ করিয়াছিল; গৌরীর মনে তাহার নিজের অজ্ঞাতসারে যে আলস্যের ভাব আসিয়াছিল তাহাকে সে চাবুক মারিয়া একটু বেশী মাত্রায় চাঙ্গা করিয়া দিয়া গিয়াছিল। অপমান জর্জরিত বুকে গৌরী। ভাবিতেছিল— প্রাণ যায় যাক্, শঙ্কর সিংকে ঐ ধৃষ্ট কুকুরগুলার কবল হইতে উদ্ধার করিতে হইবে। আর কলা-কৌশল নয়, রক্তে সাঁতার দিয়া যদি এ কাজ সিদ্ধ হয়, তাও সে করিবে। ময়ূরবাহনের মত স্পর্ধিত শয়তানগুলাকে সে দেখাইয়া দিবে— বাঙালী কোন্ ধাতুতে নির্মিত।

বাঙালী নটুয়া! ঐ কথাটাতেই তাহার মাথায় রক্ত চড়িয়া গিয়াছিল। ময়ূরবাহন ও উদিত সিংয়ের রক্ত দিয়া এ অপমানের লাঞ্ছনা যতক্ষণ সে মুছিয়া দিতে না পারিবে ততক্ষণ যে তাহার প্রাণে শান্তি নাই, তাহাও সে বুঝিয়াছিল। এই প্রতিহিংসা পিপাসার কাছে নিজের প্রাণের মূল্যও তুচ্ছ হইয়া গিয়াছিল।

চম্পার পায়জনিয়ার আওয়াজ শুনিয়া গৌরী রক্তরাঙা চিন্তার আবর্ত হইতে উঠিয়া আসিল। চম্পা কোনো কথা না বলিয়া নিজের আঙরাখার ভিতর হইতে একখানা চিঠি বাহির করিয়া তাঁহার হাতে দিল। চিঠির উত্তর গৌরী প্রত্যাশা করে নাই, ভুকুঞ্চিত করিয়া সেটা খুলিবার উপক্রম করিতেছে এমন সময় বাহিরে নাগরার শব্দ শুনা গেল। গৌরী ক্ষিপ্রহস্তে চিঠিখানা পকেটে পুরিল।

ধনঞ্জয় প্রবেশ করিলেন; তাঁহার হাতে একখানা কাগজ। গৌরী জিজ্ঞাসা করিল কি সর্দার?

সর্দার বলিলেন–উদিতের নিমন্ত্রণ গ্রাহ্য করে চিঠি লেখা হল। এটাতে সহি দস্তখত করে দিন।

গৌরী চিঠিখানা পড়িয়া দস্তখত করিতে করিতে বলিল— কবে যাওয়া স্থির করলে?

এখনো স্থির করিনি। আপনি কবে বলেন?

কালই। আর দেরি নয় সদর, যত শীঘ্র সম্ভব তোমাদের কাজকর্ম চুকিয়ে দিয়ে আমি যেতে চাই, তা সে যেখানেই হোক–

ধনঞ্জয় চকিতে চম্পার দিকে ফিরিয়া বলিলেন–চম্পা, তুমি ক্লান্ত হয়েছ, কাপড়-চোপড় ছাড় গিয়ে।

চম্পা প্রস্থান করিল। ধনঞ্জয় বলিলেন— চম্পা জানে না। যাহোক, কি বলছিলেন?

বলছিলাম, যেখানে হোক এবার আমি যেতে চাই তা পরলোকে হলেও দুঃখ নেই। মনে একটা পূর্বাভাস পাচ্ছি যে আমার জীবনের সন্ধিক্ষণ উপস্থিত হয়েছে। যুদ্ধের ঘোড়ার মত আমার প্রাণ অস্থির হয়ে উঠেছে; তোমাদের আস্তাবল থেকে তাকে এবার ছেড়ে দাও সে একবার যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে দাঁড়াক। তারপর যা হবার হবে। যদি মৃত্যুই আসে তাতে আক্ষেপ করবার কিছু নেই; কারণ, জীবনটাকে আঙুরের মত তুলোর পেটারির মধ্যে ঢেকে রেখে বেঁচে থাকাকে আমি বেঁচে থাকা মনে করি না।

ধনঞ্জয় কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে গৌরীর মুখের দিকে তাকাইয়া রহিলেন; তারপর দ্রুত তাহার কাছে আসিয়া দুই হাতে দুই স্কন্ধ চাপিয়া ধরিয়া বলিলেন— রাজা, আজ আপনার মন ভাল নেই! মৃত্যুকে কোন্ মরদ পরোয়া করে? মৃত্যু আমাদের কাছে খেলার বস্তু, উপহাসের বস্তু-তার কথা বেশী চিন্তা করলে তাকে বড় করে তোলা হয়। সুতরাং মৃত্যুর কথা আমরা ভাবব না; আমরা ভাবব শুধু কাজের কথা, কর্তব্যের কথা। যে দুশমন আমাদের বাধা দিয়েছে, অপমান করেছে, তাদের বুকে পা দিয়ে কি করে আমরা তাদের মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেব— এই হবে আমাদের চিন্তা। শত্রুর কাছে লাঞ্ছিত হয়ে যারা নিজের মৃত্যু চিন্তা করে তারা তো কাপুরুষ; বীর যারা তারা শত্রুর মৃত্যু চিন্তা করে।

গৌরী একটু হাসিয়া বলিল— সেই চিন্তাই আমি করছি সর্দার এবং যতক্ষণ না চিন্তাকে কাজে পরিণত করতে পারব ততক্ষণ আমার রক্ত ঠাণ্ডা হবে না।

ধনঞ্জয় তাহাকে ছাড়িয়া দিয়া বলিলেন—ব্যস! এই কথাই তো আমরা আপনার মুখে শুনতে চাই। দেওয়ান কালীশঙ্করের বংশধর আপনি— ঝিন্দে এসে আপনি যদি কারুর সামনে মাথা হেঁট শুরন তাহলে তাঁর রক্তের অপমান হবে।

গৌরীর মুখে এতক্ষণে সত্যকার হাসি ফুটিল; সে বলিল— সর্দার! আজ নিয়ে তুমি তিনবার দেওয়ান কালীশঙ্করের নাম করলে। এবার কিন্তু তোমাকে বলতে হচ্ছে, ঝিন্দের সঙ্গে কালীশঙ্করের। সম্বন্ধ কি এবং কেনই বা তাঁর বংশধর ঝিন্দে এসে মাথা উঁচু করে চলবে।

মাথা উঁচু করে চলবে তার কারণ কিন্তু আজ নয়, সে গল্প আর একদিন বলব। এখন অনেক কাজ। গৌরীর হাত হইতে চিঠিখানা লইয়া বলিলেন–তাহলে কালই যাওয়া স্থির? সেই রকম বন্দোবস্ত করি?

হ্যাঁ। কিন্তু একটা কথা। উদিত খামকা আমায় শক্তিগড়ে নেমন্তন্ন করলে তার উদ্দেশ্য কিছু আন্দাজ করতে পেরেছ?

আপনি পেরেছেন?

বোধ হয় পেরেছি। আকস্মিক দুর্ঘটনা—কেমন?

হুঁ–আমারও তাই মনে হয়। কিন্তু তা হবে না। বলিয়া ধনঞ্জয় প্রস্থান করিলেন।

গৌরী দুইবার বারান্দায় পায়চারি করিল, তারপর পকেটে হাত দিয়া দেখিল চম্পার আনীত ঠিঠিখানা এখনো খোলা হয় নাই। সে একবার চারিদিকে তাকাইল— কেহ কোথাও নাই। একটু ইতস্তত করিল, কিন্তু এখানে চিঠি খুলিয়া পড়িতে ভরসা হইল না–হয়তো এখনি কেহ আসিয়া পড়িবে।

নিজের ঘরে গিয়া গৌরী জানালার ধারে দাঁড়াইল— ঠিক জানালার নীচে দিয়াই কিস্তার গাঢ় নীল জল বহিয়া যাইতেছে— কলকল ছলছল শব্দ করিতেছে। গৌরী কম্পিতবক্ষে চিঠি বাহির করিল, তারপর ধীরে ধীরে মোহর ভাঙ্গিয়া পড়িল।

কৃষ্ণা লিখিয়াছে :

স্বস্তি শ্রীদেবপাদ মহারাজ শঙ্কর সিংহের চরণাম্বুজে দাসী কৃষ্ণাবাঈর শতকোটি প্রণাম। আপনার লপির মর্ম আমাদের হৃদয়ঙ্গম হইল না। আপনি অনুরোধ করিয়াছেন, সখী যেন আপনাকে ভুলিয়া যান। প্রথমে মন কাড়িয়া লইয়া পরে ভুলিয়া যাইতে বলা— মহারাজের এ পরিহাস উপভোগ্য বটে। আগে আমার সখীর মন ফিরাইয়া দিন, তারপর ভুলিয়া যাইবার কথা ভাবা যাইবে। কিন্তু তাহাও কয় দিনের জন্য? আপনার কি আদেশ, বিবাহের পরও সখী আপনাকে ভুলিয়া থাকিবেন?

বুঝিতেছি, সখীর মনে ব্যথা দিয়া আপনি নিজেও কষ্ট পাইতেছেন। কিন্তু কষ্ট পাইবার প্রয়োজন কি? যাঁহার মানভঞ্জন করিলে দুইজনেরই মনের কষ্ট দূর হইবে তিনি তো কাছেই রহিয়াছেন–মাঝে শুধু ক্ষীণা কিস্তার ব্যবধান। অবশ্য একটা কথা গোপনে আপনাকে বলিতে পারি, মানভঞ্জনের পূর্বেই আপনার পত্র দর্শনে সখীর অর্ধেক অভিমান দৃর হইয়াছে। মুখে হাসি ফুটিয়াছে; শুধু তাই নয় গানও ফুটিয়াছে। শুনিতে পাইতেছি তিনি পাশের ঘরে চঞ্চল হইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন আর মৃদুস্বরে গান

করিতেছেন। গানটি কী শুনিবেন? মীরার দোঁহা—

মেরে জনম মরণ কী সাথী
তোহে ন বিসঁরি দিন রাতি

আপনার ভুলিয়া যাওয়ার অনুরোধের জবাব পাইলেন তো? আপনি কি আমার প্রিয়সখীকে গুণ করিয়াছেন? যাঁর অভিমান শত সাধ্যসাধনাতে ভাঙে না, আপনার এতটুকু চিঠির অনুতাপে সেই রাজরানী গলিয়া জল হইয়া গেলেন?

ভাল কথা, আপনি বৈদ্যুতিক আলোটা কাল রাত্রে ভুল করিয়া ফেলিয়া গিয়াছেন, সখী সেটিকে দখল করিয়াছেন এবং বলিয়াছেন, আজ রাত্রে বিশ্রামের পূর্বে নিজের শয়নকক্ষের জানালা হইতে তাহার আলো ফেলিয়া দেখিবেন, কিস্তার ব্যবধান পার হইয়া সে-আলো আপনার জানালা পর্যন্ত পৌঁছায় কিনা। আপনার শয়নকক্ষের জানালা যে সখীর শয়নকক্ষের জানালার ঠিক মুখোমুখি তাহা চম্পা বহিনের মুখে জানিয়া লইয়াছি। মধ্যে কেবল ক্ষীণা কিস্তার ব্যবধান।

অলমিতি।

.

রাত্রি দশটার মধ্যে ঝিন্দের রাজপুরী নিশুতি হইয়া গিয়াছিল। কাল প্রভাতেই শক্তিগড় যাত্রা করিতে হইবে, তাই ধনঞ্জয় সকাল সকাল বিশ্রামের জন্য প্রস্থান করিয়াছিলেন; কেবল রূদ্ররূপ নিয়ম মত শয়নকক্ষের দ্বারে পাহারায় ছিল।

দীপহীন কক্ষের জানালায় দাঁড়াইয়া গৌরী বাহিরের অন্ধকারের দিকে তাকাইয়া ছিল। কিস্তার জলে ঝড়োয়ার রাজপ্রাসাদের আলো পড়িয়া সোনালী জরির মত কাঁপিতেছিল। নদীর উপর। নৌকার যাতায়াত বন্ধ হইয়া গিয়াছে; কেবল কিস্তার খরস্রোত নাচিতে নাচিতে ছুটিয়াছে—সেই মহাপ্রপাতের মুখে যেখান হইতে সে ফেনহাস্যে উন্মুখর কল্লোলে নীচের উপত্যকার বুকে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছে; যেন এমনি করিয়া তটহীন শূন্যতায় নিজেকে নিঃশেষে ঢালিয়া দেওয়াই তাহার জীবনের চরম সার্থকতা!

গৌরী ভাবিতেছিল— আজ রাত্রিটা শুধু আমার! কাল কোথায় থাকিব, বাঁচিয়া থাকিব কিনা কে জানে? যদি মরিতেই হয়, মৃত্যুপথের পাথেয় সংগ্রহ করিয়া লইব না? কস্তুরীর মুখের দুইটি কথা—তার গলা এখনো ভাল করিয়া শুনি নাই—শেষবার শুনিয়া লইব না? ইহাতে কাহার কি ক্ষতি?

মেরে জনম মরণ কী সাথী—কথাগুলি গৌরীর স্নায়ুতন্ত্রীর উপর ঝঙ্কার দিয়া উঠিল। কস্তুরী তাহাকে ভালবাসিয়াছে— তোহে ন বিসরি দিন রাতি-—দিবারাত্রি তোমাকে ভুলিতে পারি না। কাল গৌরী তাহার নবোদ্ভিন্ন অনুরাগ-ফুলটিকে আঘ্রাণ না করিয়া অবহেলাভরে চলিয়া আসিয়াছিল, তবু সে অভিমান ভুলিয়া গাহিয়াছে—তোহে ন বিসরি দিন রাতি। কাবায় বন্ধ গোলাপ আতরের চাপা গন্ধের মত এই অনুভূতি তাহার দেহের সীমা ছাপাইয়া যেন অন্ধকার ঘরের বাতাসকে পর্যন্ত উন্মাদ করিয়া তুলিল।

কস্তুরী তাহাকে ভালবাসিয়াছে। তবে? এখন আর সাবধান হইয়া লাভ কি? যাহা হইবার তাহা তো হইয়া গিয়াছে— এখন কর্তব্যবুদ্ধির দোহাই দিয়া সাধু সংযমী সাজিয়া সে কাহাকে ঠকাইবে? একদিন তিক্ত বিষের পাত্র হতো তাহাকে কণ্ঠ ভরিয়া পান করিতে হইবে; তবে এখন অমৃতের পাত্র হাতের কাছে পাইয়া সে ঠেলিয়া সরাইয়া দিবে কেন?

ঝড়োয়ার প্রাসাদের দীপগুলি ক্রমে নিবিয়া গেল— কেবল একটি মৃদু বাতি দ্বিতলের একটি গবাক্ষ হইতে দেখা যাইতে লাগিল। গৌরী নির্নিমেষ চক্ষে সেইদিকে চাহিয়া রহিল।

চাহিয়া চাহিয়া এক সময় তাহার মনে হইল, যেন গবাক্ষের সম্মুখে কে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। এতদূর হইতে স্পষ্ট দেখা যায় না, তবু তাহার মনে হইল— এ কস্তুরী। কিছুক্ষণ রুদ্ধ নিশ্বাসে অপেক্ষা করিবার পর হঠাৎ বিদ্যুতের টর্চ জ্বলিল; কিস্তার জলের উপর এদিক ওদিক আলো ফেলিয়া তাহার জানালার উপর আসিয়া স্থির হইল। আলো অবশ্য অতি অস্পষ্ট, কেবল নীহারিকার মত একটা প্রভা গৌরীর মুখখানাকে যেন মণ্ডল পরিবেষ্টিত করিয়া দিল।

জানালার বাহির পর্যন্ত ঝুঁকিয়া গৌরী হাত নাড়িল। তৎক্ষণাৎ আলো নিবিয়া গেল। ক্ষণকাল পরে আবার জ্বলিল, আবার তখনি নিবিয়া গেল। আলোকধারিণী যেন গৌরীর সহিত কৌতুক করিতেছে।

ঘরের মধ্যস্থলে ফিরিয়া আসিয়া গৌরী ক্ষণকাল হেঁটমুখে স্থির হইয়া দাঁড়াইল; তারপর সন্তর্পণে দ্বারের কাছে গিয়া পর্দা ঈষৎ সরাইয়া উঁকি মারিল। রুদ্ররূপ দূরের একটা বদ্ধ দ্বারের দিকে তাকাইয়া। না জানি কিসের স্বপ্ন দেখিতেছে। গৌরী নিঃশব্দে দরজা ভিতর হইতে বন্ধ করিয়া দিল; তারপর আবার জানালার পাশে আসিয়া দাঁড়াইল।

এই সময় আবার দুই-তিনবার দূর গবাক্ষে আলো জ্বলিয়া নিবিয়া গেল। গৌরী আর দ্বিধা করিল। তাহার প্রিয়া তাহাকে ডাকিতেছে, এস এস বলিয়া বারবার আহ্বান করিতেছে। সে মনে মনে। উচ্চারণ করিল— কস্তুরী! কস্তুরী!

গায়ের জামাটা সে খুলিয়া ফেলিল। একটা পাগড়ির কাপড় জানালার পাশে শক্ত করিয়া বাঁধিয়া বাহিরের দিকে ঝুলাইয়া দিল। তারপর নগ্নদেহে সেই রঞ্জু বহিয়া ধীরে ধীরে অবতরণ করিয়া কিস্তার। জলে নিজেকে নামাইয়া দিল!

.

ঝড়োয়ার রাজপুরী নিস্তব্ধ—অন্ধকার। কেবল কস্তুরীর ঘরে একটি মৃদু দীপ জ্বলিতেছে। দীপের আলোকে ঘরটি সুস্পষ্ট হইয়া উঠে নাই—শুধু একটি স্নিগ্ধ ছায়াময় স্বচ্ছতার সৃষ্টি করিয়াছে।

পালঙ্কের ঠিক পাশেই মেঝেয় রেশমের গালিচার উপর কস্তুরী একটি হাত মাটিতে রাখিয়া হেঁটমুখে বসিয়া ছিল। গৌরী একটা শাল সিক্তদেহে জড়াইয়া পালঙ্কের উপর বাম বাহু রাখিয়া কস্তুরীর মুখের পানে তাকাইয়া ছিল। অদূরে পদাটাকা দ্বারের পাশে কৃষ্ণা চিত্রার্পিতার মত দাঁড়াইয়া পাহারা দিতেছিল।

অনেকক্ষণ নীরবে কাটিয়াছে। জল হইতে উঠিবার পর গৌরীকে লইয়া কৃষ্ণা যখন কস্তুরীর ঘরে উপস্থিত হইয়াছিল তখন গুটিকয়েক কথা হইয়াছিল; কৃষ্ণা এই দুঃসাহসিকতার জন্য তাহাকে সস্নেহ বিগলিতকণ্ঠে তিরস্কার করিয়াছিল। কস্তুরীর ঠোঁট দুইটি বারবার কাঁপিয়া উঠিয়াছিল, কিন্তু কোনো কথা বাহির হয় নাই। শুধু তাহার নিতল চোখ দুটির দৃষ্টিতে যে গভীর অনির্বচনীয় ভাবাবেশ ঘনাইয়া উঠিয়াছিল, তাহাই গৌরীকে পুরস্কৃত করিয়াছিল। তারপর কথার ধারা কেমন যেন ক্ষীণ হইয়া ক্রমে থামিয়া গিয়াছিল। কৃষ্ণা কিছুক্ষণ তাহাদের পাশে নীরবে দাঁড়াইয়া থাকিয়া অপ্রতিভভাবে সরিয়া গিয়া পাহারা দিবার অছিলায় দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়াছিল।

সুদীর্ঘ নিশ্বাস পতনের সঙ্গে কস্তুরী চোখ তুলিয়া চাহিল, দুইজনের চোখাচোখি হইল। দুইটি চোখ মাধুর্যের গাঢ়তায় গম্ভীর— অন্য দুইটি জিজ্ঞাসার ব্যগ্রতায় ব্যাকুল।

গৌরী অনুচ্চকণ্ঠে বলিয়া উঠিল— কস্তুরী!

কস্তুরী চোখ নামাইয়াছিল, আবার তুলিল।

গৌরী সাগ্রহকণ্ঠে বলিল— কালকের অপরাধ ক্ষমা করেছ?

একটুখানি হাসি— কিম্বা হাসির আভাস–কস্তুরীর ঠোঁটের কোণ দুইটিকে ঈষৎ প্রসারিত করিয়া দিল। কস্তুরী আবার চক্ষু অবনত করিল।

গৌরী আর একটু কাছে সরিয়া আসিয়া ব্যগ্রকণ্ঠে বলিতে লাগিল— রানি, আমার বুকের মধ্যে যে তুফান বইছে তা যদি দেখাতে পারতাম, তাহলে বুঝতে তুমি আমাকে কী করেছ। তোমাকে দেখে আমার আশা মেটে না, আবার বেশীক্ষণ দেখতেও ভয় করে–মনে হয় বুঝি অপরাধ করছি। আমার প্রাণের এই উজ্জ্বল অবস্থা তোমাকে বোঝাতে পারব না। ইচ্ছে হয় তোমাকে নিয়ে এমন কোথাও চলে যাই, যেখানে রাজ্য নেই, রাজা নেই, রানী নেই— শুধু তুমি আর আমি। শুধু আমাদের ভালবাসা। কস্তুরী, তোমার ইচ্ছে করে না?

কস্তুরীর মাথা আর একটু অবনত হইল, নিশ্বাস পতনের শব্দের মত লঘু অস্ফুটস্বরে সে বলিল— করে।

সহসা হাত বাড়াইয়া কস্তুরীর আঁচলের প্রান্ত চাপিয়া ধরিয়া গৌরী বলিল— কস্তুরী, চল আমরা তাই যাই। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাহার চটকা ভাঙ্গিয়া গেল! এ কি অসঙ্গত অর্থহীন প্রলাপ সে বকিতেছে? একটু চুপ করিয়া থাকিয়া আবার বলিল— আমি জানি তুমি আমায় ভালবাস কৃষ্ণার চিঠিতে আজ তা আমি জানতে পেরেছি। কিন্তু একটা কথা জানবার জন্য আমার সমস্ত অন্তরাত্মা ব্যাকুল হয়ে রয়েছে। কস্তুরী–

কস্তুরী প্রশ্নভরা দৃষ্টি তুলিল।

গৌরী আবার আরম্ভ করিতে গিয়া থামিয়া গেল। এতক্ষণ সে ভুলিয়া গিয়াছিল যে কৃষ্ণা দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া আছে; এখন তাহার দিকে চোখ পড়িতেই সে কস্তুরীর আঁচল ছাড়িয়া দিল। কিন্তু যে প্রশ্নটা তাহার কণ্ঠাগ্রে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে তাহার উত্তর জানিবার অধীরতাও তাহাকে অস্থির করিয়া তুলিল। সে কৃষ্ণার দিকে ফিরিয়া বলিল— কৃষ্ণা, তুমি একটিবার বাইরে যাবে? বেশী। নয়— দুমিনিটের জন্য।

কৃষ্ণা মুখ ফিরাইয়া একটু ভু তুলিল, গৌরীর দিকে একটা সুতীক্ষ দৃষ্টিপাত করিল, তারপর মৃদুকণ্ঠে বলিল–আচ্ছা। কিন্তু ঠিক দুমিনিট পরেই আমি আবার ফিরে আসব।

কৃষ্ণা পর্দার আড়ালে অন্তর্হিত হইয়া গেল।

গৌরী তখন কস্তুরীর মুখের খুব সন্নিকটে মুখ আনিয়া গাঢ়স্বরে বলিল—কস্তুরী, একটা কথার উত্তর দেবে কি?

গম্ভীর আয়ত চোখ দুইটি গৌরীর মুখের উপর স্থির হইল— একটু বিস্ময়, একটু কৌতূহল, অনেকখানি ভালবাসা সে দৃষ্টিতে মাখানো ছিল। গৌরী আর আত্মসম্বরণ করিতে পারিল না, কস্তুরীর যে-হাতখানা কোলের উপর পড়িয়াছিল, সেটা দুই হাতের মধ্যে তুলিয়া লইল; একটা সুদীর্ঘ নিশ্বাস টানিয়া বলিল— কস্তুরী, তোমার চোখের মধ্যে যা দেখতে পাচ্ছি, তাতে আমার মন আর শাসন মানছে না, মনে হচ্ছে। তবু তুমি একটা কথা বল। আমি যদি শঙ্কর সিং না হতাম, ঝিন্দের রাজা না হতাম, তবু কি তুমি আমায় ভালবাসতে?

কস্তুরীর হাতটি গৌরীর মুঠির মধ্যে একটু নড়িল, গ্রীবা একটু বাঁকিল। একবার মনে হইল বুঝি সে উত্তর দিবে, কিন্তু সে উত্তর দিল না, নিজের কঙ্কণের দিকে চাহিয়া রহিল।

গৌরী তখন আরো ব্যগ্রভাবে বলিতে লাগিল কস্তুরী, মনে কর আমি ঝিন্দের শঙ্কর সিং নই, মনে কর আমি একজন সামান্য বিদেশী–কোনো দূর দেশ থেকে এসে হঠাৎ ঘটনাচক্রে তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তবু কি তুমি আমায় ভালবাসবে?

কস্তুরী গৌরীর মুখের দিকে চাহিল; তাহার চোখ দুইটি একটু ঝাপসা দেখাইল। অধর যেন ঈষৎ কাঁপিতেছে। তারপর তাহার ধরাধরা অবরুদ্ধ কণ্ঠস্বর শুনা গেল— আমাকে কি পরীক্ষা করছেন?

না না–কস্তুরী। কিন্তু তুমি শুধু বল যে, তুমি আমাকেই ভালবাস, রাজ্যসম্পদ বাদ দিলেও তোমার ভালবাসা লাঘব হবে না।

ক্ষণকাল কস্তুরী নীরব রহিল, তারপর গৌরীর চোখে চোখ রাখিয়া ধীরে ধীরে বলিল–আপনি যদি একজন সামান্য সিপাহী হতেন, আপনার পরিচয় ঝিন্ঝডোয়ার কেউ না জান্ত, আপনি যদি অখ্যাত বিদেশী হতেন—তবু আপনি আমার–

তোমার?

আমার মালিক।

অকস্মাৎ কস্তুরীর চোখ ছাপাইয়া বুকের কাপড়ের উপর কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝরিয়া পড়িল।

কস্তুরী! গৌরীর কণ্ঠস্বর থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল; সে হাত দিয়া কস্তুরীর চিবুক তুলিয়া ধরিবার চেষ্টা করিতে করিতে বলিতে শুরু করিল–তবে শোনো–আমি—

ঠিক এই সময় দ্বারের পর্দা নড়িয়া উঠিল; কৃষ্ণা প্রবেশ করিল।

আর একটু হইলে দুর্নিবার আবেগের মুখে গৌরী সত্য কথা প্রকাশ করিয়া ফেলিত, কৃষ্ণার আবির্ভাবে সে থামিয়া গেল। কৃষ্ণা যেন তাহাকে কঠিন বাস্তব জগতে টানিয়া ফিরাইয়া আনিল। সে বাঁ হাতটা একবার চোখের উপর দিয়া চালাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।

কৃষ্ণা আসিয়া হাসিমুখে বলিল— হ্যাঁ, এবার বাঁধন ছিঁড়তে হবে। রাত দুপুরের ঘণ্টা অনেকক্ষণ বেজে গেছে।

গৌরীর গলার ভিতর যেন একটা কঠিন পিণ্ড আটকাইয়া গিয়াছিল, সে গলা ঝাড়িয়া পরিষ্কার করিয়া বলিল–কাল সকালেই আমি শক্তিগড় যাচ্ছি—হয়তো আর–

তাহার কথা শেষ না হইতেই কৃষ্ণা বলিয়া উঠিল—শক্তিগড়?

কস্তুরীর চোখের জল তখনো শুকায় নাই, কিন্তু তাহারই ভিতর হইতে নিমেষের জন্য কৌতুক-মাখানো দৃষ্টি কৃষ্ণার মুখের পানে তুলিল।

গৌরী বলিল— শিকারে যাচ্ছি–কবে ফিরব বলতে পারি না। হয়তো–

কৃষ্ণা মুখ টিপিয়া বলিল— হয়তো সেখানে কত আশ্চর্য ব্যাপার ঘটতে পারে, যা আপনি কখনো কল্পনাও করেননি–কে জানে?

গৌরী কৃষ্ণার মুখের প্রতি অর্থপূর্ণভাবে তাকাইয়া বলিল— তা পারে। আজ তাহলে চললাম।

কস্তুরী উঠিয়া দাঁড়াইল। সতৃষ্ণ চক্ষে তাহার দিকে চাহিয়া গৌরী বলিল— কস্তুরী, চললাম। হয়তো—

নৃত্যচঞ্চল চোখে কৃষ্ণা বলিল–হয়তো শক্তিগড় থেকে ফেরবার আগেই আবার দেখা হবে। অত কাতরভাবে বিদায় নেবার দরকার নেই।

গৌরী কেবল একটা নিশ্বাস ফেলিল।

কৃষ্ণা বলিল–চলুন, আপনাকে আমার ডিঙিতে করেই আপনার ঘাটে পৌঁছে দিই।

গৌরী মাথা নাড়িয়া বলিল— না, তোমাকে আর কষ্ট দেব না। যে ভাবে এসেছি সেই ভাবেই ফিরে যাব।

কস্তুরীর মুখে আশঙ্কার ছায়া পড়িল, সে অতি মৃদুস্বরে বলিল— কিন্তু যদি কোনো দুর্ঘটনা–

কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে না কস্তুরী– আমি এখন মরব না। যদি মরি তো শক্তিগড়ে গিয়ে—এখানে নয়। বলিয়া গৌরী মাথা নাড়িয়া হাসিল।

কৃষ্ণা বলিল— ও কি কথা! সখীকে মিছিমিছি ভয় পাইয়ে দিচ্ছেন কেন? চলুন—

চল কৃষ্ণা–

দ্বারের কাছে গৌরী ফিরিয়া দেখিল–কস্তুরী তাহার দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া আছে। একটা উচ্ছ্বসিত দীর্ঘনিশ্বাস চাপিয়া সে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। এই শেষ দেখা?

অন্ধকারে ঘাটের পাদমূলে আসিয়া গৌরী কৃষ্ণার হাত চাপিয়া ধরিল, ব্যাকুলস্বরে বলিল–কৃষ্ণা, হয়তো আমাদের আর দেখা হবে না, এই শেষ দেখা। যদি আমাদের জীবনে এমন কোনো বিপর্যয় ঘটে যায়, যা এখন তোমাদের কল্পনারও অতীত–তুমি কস্তুরীকে ছেড়ো না। সর্বদা তার কাছে থেকো; তুমি কাছে থাকলে হয়তো সে শান্তি পাবে! বলিয়া উত্তরের প্রতীক্ষা না করিয়া জলে ঝাঁপাইয়া পড়িল।

হায়! মানুষ যদি ভবিষ্যৎ দেখিতে পাইত!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *