১৫১৩ সাল – ৫

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

 বল মহাশয়ের কাণ্ড আমরা আপাততঃ প্রকাশ করিব না স্থির করিলাম। কিন্তু সপ্তাহ কাটিতে না কাটিতে এমন এক ঘটনা ঘটিল যাহাতে উহা প্ৰকাশ হইয়া পড়িল।

 একদিন প্রাতে আমরা পত্ৰ পাইলাম যে অংশীদারগণের এক বিশেষ অধিবেশন হইবে। তাহাকে আমাদিগকে, অর্থাৎ ডাইরেক্টারগণকে, কার্য্যের এক হিসাব উপস্থিত করিতে হইবে, এবং সেই সময় একজন অংশীদার একটী প্ৰস্তাব করিবেন।

 কাজটা বেআইনী হইলেও আমরা যথাসময় সভাস্থলে উপস্থিত হইলাম। দেখি, সকল অংশীদারগণই উপস্থিত। তাঁহাদিগের মধ্যে একজন এই বলিয়া কার্য্য আরম্ভ করিলেন:—

 “অদ্যদার সভা আহ্বানের একটী বিশেষ কারণ আছে। আমি অনেকদিন হইতে ডাইরেক্টারগণ কি করিতেছেন তাহা জানিবার জন্য উৎসুক আমি। শুনিতে পাই, হাসানজী কোম্পানী কি গোলযোগ উপস্থিত করিয়াছে। কাজেই, আমরা একটা হিসাব নিকাশ লইতে বাধ্য হইতেছি। ডাইরেক্টার মহাশয়েরা নিশ্চয়ই তাঁহাদের হিসাব up-to-date রাখিয়াছেন। তাঁহারা তাহাই উপস্থিত করুন।”

 আমি বলিলাম:—

 “এ কিরূপ কথা? আপনারা আমাদের উপর বিশ্বাসস্থাপন করিয়া সকল বিষয়ের ভারার্পণ করিয়াছেন। আমরা যথাসাধ্য সকল কার্য্য করিতেছি। আমরা হিসাব দেখাইতে বা এতদিন কি করিয়াছি, তাহার বিবরণ উপস্থিত করিতে সর্ব্বদাই প্ৰস্তুত। কিন্তু বেয়াইনী ভাবে কিছুই দিব না। রীতিমত নোটিস্ দিয়া সভা আহ্ববান করুন। আমরা আহ্লাদে সকল কথা জানাইব।”

 সেই অংশীদার মহাশয় বলিলেন:—

 “এই সভা যথানিয়মে আহুত হইয়াছে। এ বিষয়ে বোধহয় দুইজন ব্যতীত আর কাহারও অন্যমত নাই। আমি প্ৰস্তাব করি যে আমাদের একজন মাননীয় অংশীদার “প্ৰভাতী” সম্পাদক শ্ৰীযুক্ত রামদাস ঘোষ মহাশয় অদ্যকার সভার সভাপতি হউন৷”

 এই প্ৰস্তাব শুনিয়া অনেকে পরস্পরের মুখাবলোকন করিতে লাগিলেন। শীঘ্রই একজন অংশীদার, শ্ৰীপ্ৰিয়নাথ রায়, বলিয়া উঠিলেন:—

 “প্ৰভাতী”—সম্পাদক আমাদের অংশীদার নহেন। তিনি কিরূপে সভাপতি হইতে পারেন?”

 আমি থাকিতে পারিলাম না, বলিলাম:—

 “বাস্তবিকই তিনি এখন একজন অংশীদার। বলমহাশয় সকল কথা জানেন। তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করুন।”

 বলমহাশয় বিস্মিতভাবে বলিলেন:—

 “কই, কবে তিনি অংশীদার হইলেন? আমিত কিছুই জানি না?”

 “প্ৰভাতী”-সম্পাদক সভায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি ব্যঙ্গোক্তি করিয়া বলিলেন:—

 “দেখিতেছি, বলমহাশয়ের স্মরণশক্তি হ্রাস পাইয়াছে। এমন অবস্থায় তিনি এরূপ গুরুতর কার্য্যের সহিত জড়িত না থাকিয়া কিছুকাল আপনার চিকিৎসকাদি করান। অন্যথা তাঁহার পরিণাম শোচনীয় হইতে পারে।”

 বলমহাশয় বলিলেন:—

 “আপনার কথায় পরম আপ্যায়িত হইলাম । আমার স্মরণশক্তির কিঞ্চিৎ মাত্রও হ্রাস হয় নাই। আমি প্ৰস্তাব করি যে “প্ৰভাতী”—সম্পাদক মহাশয়ের যখন এখানে আসিবার কোন অধিকার নাই তখন তাঁহাকে সভা হইতে চলিয়া যাইতে অনুরোধ করা হউক৷”

 “কেন যাইব? কখনই নহে,” সম্পাদক মহাশয় টেবিল চাপড়াইয়া বলিয়া উঠিলেন।

 বলমহাশয় দৃঢ়ভাবে উত্তর দিলেন:—“আপনি অংশীদার নহেন বলিয়া।”

 সম্পাদকমহাশয় দণ্ডায়মান হইয়া বলিতে লাগিলেন:—

 “বটে? তবে মহাশয়গণ শুনুন। এই ভদ্রলোক তাঁহার অংশ আমার নিকট বিক্রয় করিয়াছেন। তাহার কোবালা এই দেখুন।” এই বলিয়া কতকগুলি কাগজ আমার হস্তে দিলেন।

 খুলিয়া দেখি উহা কতকগুলি সাদা কাগজ মাত্ৰ! একটিও অক্ষর কোথাও নাই!

 আমি উহা ফিরাইয়া দিয়া বলিলাম:—

 “একি দিলেন? ইহাতে কিছুতেইতো লেখা নাই।”

 “আঁ, বলেন কি?” বলিয়া সম্পাদক মহাশয় অতি ব্যস্ততার সহিত কাগজগুলি উল্‌টিয়া দেখিলেন। সহসা মস্তকে হাত দিয়া তিনি বসিয়া পড়িলেন ও কাতরভাবে বলিলেন:—“আঁ, এ কিরকম হইল? একি? আঁ?”

 বল মহাশয় ব্যঙ্গভাবে বলিলেন:—

 “লোকটার রকম দেখুন! বলি, এ রকম জুয়াচুরী কবে হইতে অভ্যাস হইয়াছে?”

 সম্পাদক মহাশয়ের মুখ লাল হইয়া উঠিল। তিনি বলমহাশয়কে প্ৰহার দিবার জন্য আস্তিন্ গুটাইলেন। আমরা পড়িয়া উভয়কেই সরাইয়া দিলাম এবং সম্পাদক মহাশয়কে আর কেলেঙ্কারি না বাড়াইয়া চলিয়া যাইবার জন্য অনুরোধ করিলাম।

 যাইবার পূর্ব্বে তিনি বলমহাশয়কে সম্বোধন করিয়া বলিলেন:—

 “দেখ্, বল্। তুই ভীমরুলের চাকে পা দিয়াছিস্। ফলে তোর বিপদ অবশ্যম্ভাবী। তুই মনে করিস্ না যে তোর জুয়াচুরী ধরা পড়িবার জো নাই। আমার মন্দ চেষ্টা করেছিস্। না হয় কিছু টাকা লোকসান্ যা’বে। কিন্তু তোর সেই পত্র যা হাসানজীদের লিখেছিলি—বিস্তারিত খুলে বল্‌বনা—তা’ আমার কাছে এখনও আছে। দশ বৎসর দ্বীপান্তর, জানিস্। আমি তোকে সহজে ছাড়্‌বো না।”

 তিনি চলিয়া গেলে পর বলমহাশয় আমাদিগকে বলিলেন:—

 “লোকটা অতি নীচপ্রকৃতির। আমি উহার ভয়কে থোড়াই কেয়ার করি।”

 এই গোলযোগে কার্য্য কিছুই হইল না। সর্ব্বসম্মতিক্রমে এক সপ্তাহের জন্য সভা স্থগিত থাকিল। একে একে সকলেই প্ৰায় চলিয়া গেলেন। রহিলাম মাত্র অমি, বন্ধুবর ও বলমহাশয়।

 বলমহাশয়কে আমি শীঘ্রই গভীরস্বরে প্রশ্ন করিলাম:—

 “আপনার এ কেলেঙ্কারি করিবার কি প্রয়োজন ছিল?”

 তিনি চিৎকার করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন:—

 “কি? কি বলেন? কেলেঙ্কারি?”

 ঘৃণার সহিত তাঁহার দিকে চাহিয়া আমি বলিলাম:—

 “খেলিলেন খেলা ভাল। সম্পাদককে তো জুয়াচোর প্রভৃতি মধুর বাক্যে আপ্যায়িত করিলেন। এখন জুয়াচোর কে ধর্ম্মতঃ বলুন ত?”

 “কি বলেন? আমি জুয়াচাের?”

 “হাঁ। আপনি বিষম জুয়াচোর, দাগা বাজ, প্রবঞ্চক, দস্যু—”

 “মুখ সামলাইয়া কথা কহিবেন। না হইলে বিশেষ অনিষ্ট ঘটিতে পারে।”

 আস্তিন্ গুটাইয়া হাত দেখাইয়া আমি বলিলাম:—

 “শরীরের উপর নহে। এই দেখুন বহরটা।”

 “আপনার নামে নালিশ করিয়া কিছুদিন শ্ৰীঘর দর্শন করাইব।”

 “আমায় যাইতে হইবে না। সম্পাদক আপনার সেখানে বাসের আয়োজন করিবেন।”

 “আপনি ভাল চাহেন তবে ক্ষমা প্ৰাৰ্থন করুন।”

 “কখনই না।”

 বন্ধুবর এতক্ষণ চুপ করিয়া সকল কথা শুনিতেছিলেন। তিনি এখন বাধা দিয়া বলিলেন:—

 “রজনী বাড়াবাড়ি করিও না। থাম।”

 “লোকটার প্রবঞ্চনার প্রমাণ এক্ষণেই দিতেছি।” এই বলিয়া আমি এক ভৃত্যকে একটা spirit lamp আনিতে বলিলাম। তাহার উপর সম্পাদকের তথা-কথিত কোবালার একপৃষ্ঠা দুইচারি মিনিট ধরিবার পর ইংরাজী ভাষায় লিখিত অনেকগুলি অক্ষর বাহির হইয়া পড়িল।

 আমি পড়িতে উদ্যত হইলে, বল বাধা দিতে চেষ্টা করিল। কিন্তু আমি চিৎকার করিয়া কিছু কিছু পাঠ করিলাম।

 বন্ধুবর বলিলেন:—

 “এ ত’ আমরা যে কোবালা পূর্ব্বে দেখিয়াছি তাহারই অনুলিপি। অক্ষরগুলি লোপ পাইয়াছিল কি করিয়া?”

 এ আর বুঝিতে পারিলেন না? বল, বড় চালাক লোক কিনা। তাই অদৃশ্যকালী দিয়া এই কোবালা লেখায়! লেখার অবস্থা দেখিয়া বোধ হইতেছে ও অদৃশ্যকালী প্রস্তুতের উপায় জানে।”

 বলকে সম্বোধন করিয়া বন্ধুবর বলিলেন:—

 “দেখুন আমরা আপনার সকল জুয়াচুরিই জানিতে পারিয়াছিা! ইচ্ছা ছিল আপনার গুপ্ত কথা চাপিয়া রাখিব। কিন্তু একটা প্ৰবাদ আছে, “ধর্ম্মের কল বাতাসে নড়ে”। আপনার কাণ্ড প্ৰকাশ হইয়া পড়িয়াছে। আপনার একথা অস্বীকার করিবার জো নাই। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস হইয়াছে যে আপনিই হাসানজীদের ভাঙ্‌চি দিয়া আমাদের অনিষ্ট করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। আপনি “প্ৰভাতী” সম্পাদকের সহিত মিলিয়া এক প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানী স্থাপন করিবার চেষ্টায় আছেন। তাহার হাতে-কলমের প্রমাণ আমাদের নিকট আছে। সে যাহা হউক আপনি যে জুয়চুরী করিয়াছেন তাহার জন্য আপনার শাস্তি হওয়া উচিত। আপনি ভদ্র সন্তান, আপনাকে জেলে পাঠান উচিত মনে করি না। আমরা আপনাকে একটা ultimatum দিতেছি। আপনি “প্ৰভাতী”-সম্পাদককে আপনার যে অংশ বিক্রয় করিয়াছেন, সেই কার্য্য আমাদের articles of association এর বিরুদ্ধে। আমি প্রস্তাব করি আপনি আমাদের কোম্পানীর ডাইরেক্টারের পদ ত্যাগ করুন এবং অদ্যই আপনার অংশ আমাদিগকে ন্যায্য মূল্যে বিক্রয় করুন; এবং একটা অঙ্গীকার পত্ৰ লিখিয়া দিউন যে ভবিষ্যতে আমাদের মত কোম্পানী কেহ যদি স্থাপন করেন, আপনি তাহার সহিত কোনরূপ সংস্রব রাখিবেন না। যদি তাহার সহিত যোগ দেন, তবে এক লক্ষ টাকা খেসারতস্বরূপ দিতে বাধ্য থাকিবেন।”

 স্থিরচিত্তে বল সকল কথা শুনিল এবং একটু পরে উত্তর দিল:—

 “চিন্তা করিবার জন্য আমায় দুই একদিন অবকাশ দিতে হইবে।”

 বন্ধুবর বলিলেন:—

 “কখনই দিব না। অর্দ্ধঘণ্টা সময় দিতেছি। হয় এদিক না হয় ওদিক, এখানেই স্থির করিয়া ফেলিতে হইবে।”

 একটী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া বল জিজ্ঞাসা করিল:—

 “আমি যদি আপনার সর্ত্তে রাজী হই, তাহা হইলে এই কোবালা ফেরত দিবেন ত?”

 “হাঁ নিশ্চয়ই।”

 “আমি স্বীকার করিলাম।”

 বন্ধুবর তৎক্ষণাৎ আমাদিগের উকীলকে টেলিফোঁ করিলেন। অর্দ্ধ ঘণ্টার মধ্যে তিনি উপস্থিত হইলেন। সেইদিনই বিক্রয় কোবালা আমার নামে লেখা হইল। বল উহা সহি করিয়া দিয়া চলিয়া গেলেন। পরদিন যথারীতি উহা রেজেষ্ট্রী হইয়া গেলে পর তাহার প্রাপ্য চুকাইয়া দিয়া তাহার জাল কোবালা খানি ফেরৎ দেওয়া গেল।

সপ্তম পরিচ্ছেদ।

 নানা কারণে আমরা বলমহাশয়ের কাণ্ড অংশীদারগণকে জানাইলাম না। কেবলমাত্র এই প্ৰকাশ করিলাম যে তাঁহার অংশ আমি কিনিয়া লইয়াছি। জিজ্ঞাসিত হইলে বল মহাশয় লোকলজ্জার ভয়ে বলিতেন যে তিনি “প্রভাতী”—সম্পাদক কর্ত্তৃক লাঞ্ছিত হওয়ায় আমাদের সহিত সকল সম্পর্ক চ্যুত করিয়াছেন।

 সপ্তাহ খানেক যাইতে না যাইতে আমরা দুইজন, অর্থাৎ বন্ধুবর ও আমি, দুইখানি সমন্ পাইলাম। দেখি সম্পাদক বলমহাশয়ের নামে প্রতারণার অভিযোগ করিয়াছেন এবং আমাদিগকে তাঁহার সাক্ষী মানিয়াছেন। উভয় পক্ষই ভাল ভাল কৌঁসিলী নিযুক্ত করিলেন। কয়েকদিন ধরিয়া মামলা চলিল। কিন্তু বলমহাশয়ের দোষ প্ৰমাণ না হওয়ায় তিনি অব্যাহতি পাইলেন। আমরা হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিলাম।

 এদিকে হাসানজী কোম্পানীর চুক্তির কাল পূর্ণ হইয়া আসিল। আর দিন পনের বাকী আছে, এমন সময় আমরা টেলিগ্রাম পাইলাম যে জাহাজ তৈয়ার হইয়াছে। আমরা কাল বিলম্ব না করিয়া উহা দেখিতে বোম্বায়ে গেলাম। উহা লম্বায় ২০০ ফুট। Hull ভাগটা আবলুশ কাষ্ঠে প্ৰস্তুত ও তাম্র মণ্ডিত। কেবিনগুলি বেশ প্রশস্ত ও সুন্দরভাবে সজ্জিত। এঞ্জিনগুলি মধ্যস্থলে রক্ষিত হইয়াছিল। শুনিলাম জাহাজখানি প্ৰতি ঘণ্টায় ৭০ হইতে ৮০ মাইল পর্য্যন্ত যাইতে পারিবে। বন্ধুবর উহা ভাল করিয়া পরীক্ষা করিয়া অতীব সন্তুষ্ট হইলেন! তাহার পর একটা “চলন্ পরীক্ষার” দিন নির্দ্ধারিত হইল। সকল অংশীদারগণকে নিমন্ত্রণ করা গেল। অনেকে বোম্বায়ে আসিলেন। কেহ কেহ আসিতে অপারগ্ ইহা জানাইয়া আপনাদিগের কর্ত্তব্য সাঙ্গ করিলেন। আমাদের উৎসাহ তখন দেখে কে? একটা মানুষ যেন তিনজন হইলাম।

 যেদিন পরীক্ষা হইবে তাহার পূর্ব্বদিনে আমরা উপস্থিত সকল অংশীদার ও ডাইরেক্টরগণ মিলিয়া এক সভা করিলাম। ইহার প্রধান উদ্দেশ্য অংশীদারগণকে আমাদের কার্য্য কতদূর অগ্রসর হইয়াছে ও পরে কি হইবে তাহা বুঝাইয়া দেওয়া।

 সভার কার্য্য বেশ চলিতেছে, এমন সময় আমাদের গৃহের দ্বার খুলিয়া দুইজন কোর্টের কর্ম্মচারী প্ৰবেশ করিল ও বন্ধুবরের হস্তে কি দুইখানি কাগজ দিল। তিনি উহা পাঠ করিয়া যাহা বলিলেন তাহাতে আমরা অতি আশ্চর্য্য বোধ করিলাম। “প্ৰভাতী”—সম্পাদক আমাদের নামে কলিকাতা হাইকোর্টে সুবর্ণ প্ৰস্তুত করিতে কেন আমরা নিরস্ত হইব না—যেহেতু আমাদের নক্সাদি তাঁহার নক্সাদির অবিকল নকল মাত্র—তাহার কারণ দর্শাইবার জন্য এক রুল লইয়াছেন। তিনি ক্ষতিপূরণ স্বরূপ দশলক্ষ টাকাও চাহিয়াছেন।

 কর্ম্মচারীদ্বয় চলিরা গেলে পর বন্ধুবর উপস্থিত সকলকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন:—

 “বন্ধুগণ, আপনারা কেহ উদ্বিগ্ন হইবেন না। আমাদের অনিষ্ট করিবার জন্য সম্পাদক-প্রবর অার এক খেলা খেলিয়াছেন। ফলে তাঁহার হার নিশ্চিত। তবে আমাদের কার্য্যারম্ভের কিছু বিলম্ব হইবে এই যা। সম্পাদকের এই কার্য্যের ভিতর এক গুঢ় রহস্য নিহিত আছে। তাহা এখন প্রকাশ করিব না। আপনারা আমার উপর যেমন বিশ্বাস স্থাপন করিয়া আসিতেছেন, তাহাতে আমি বড়ই বাধিত আছি। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, আমাদের কেহ কোন অনিষ্ট করিতে পারিবে না।”

 আমার প্রস্তাবে বন্ধুবরের প্রতি একবাক্যে এক বিশ্বাসসূচক ভোট পাশ করা হইল। তৎপরে আমরা এই স্থির করিলাম যে “পরীক্ষা” আপাততঃ বন্ধ থাকুক। হাসানজী কোম্পানীর ইহাতে কোন আপত্তি না থাকায় যথারীতি ধন্যবাদাদির পর সভা ভঙ্গ হইল।

অষ্টম পরিচ্ছেদ।

 আমরা বুঝিয়াছিলাম যে সম্পাদকপ্রবর আমাদিগকে সহজে ছাড়িবেন না। আমরাও যে প্ৰস্তুত ছিলাম না তাহাও নহে। তবে শিক্ষিত লোক পদে পদে লাঞ্ছিত হইয়াও যে তাহার দুরভিসন্ধি পূর্ণ করিবার চেষ্টা ছাড়িতে পারে নাই ইহাতে বড়ই আশ্চর্য্য বোধ করিলাম। যাহা-হউক কলিকাতায় আসিয়া দেখি হরিশ আমাদের প্রতিদ্বন্দী কোম্পানীর একখণ্ড “অঙ্গীকারপত্ৰ” (articles of association) সংগ্ৰহ করিয়াছে। তাহার নিকট শুনিলাম যে সপ্তাহ খানেক হইল ঐ কোম্পানী গঠিত হইয়াছে। তাহারা এরূপ অসম্ভব প্ৰতিশ্রুতি করিয়াছে যে আমরা তাহা শুনিয়া হাস্যসম্বরণ করিতে পারিলাম না।

 যথাসময়ে রুল শুনানি আরম্ভ হইল। আমাদের কৌঁসিলী অতি বিশদভাবে বুঝাইয়া দিলেন যে প্ৰতিদ্বন্দী কোম্পানী আমাদেরই নক্সাদি চুরি করিয়াছে এবং তাহাদের উদ্দেশ্য আমাদিগের অনিষ্ট করা ভিন্ন আর কিছুই নহে। আমরা বিচারক মহাশয়কে আমাদিগের সুবর্ণ প্ৰস্তুতের উপায় দেখাইয়া দিলাম। তিনি প্ৰতিদ্বন্দী কোম্পানীকে তাহাদিগের উপায় দেখাইতে বলায় তাহারা পারিল না। সুতরাং বিচারক মহাশয় রুল ডিসচার্জ্জ করিয়া দিলেন।

 পদে পদে আমাদের অনিষ্ট চেষ্টা করিয়াও সম্পাদকপ্রবর বিশেষ কিছু করিতে সক্ষম হইলেন না। ইহাতে তাঁহার ক্ষোভের পরিসীমা রহিল না। তিনি কত কথাই যে আমাদের বিরুদ্ধে বলিয়া বেড়াইতে লাগিলেন তাহার ইয়ত্তা ছিল না।

 একদিন প্ৰাতে ঘরে বসিয়া সংবাদ পত্র পাঠ করিতেছি এমন সময় দরজা খুলিয়া একটী যুবক প্রবেশ করেন। তাহার পরিধানে মলিন বস্ত্র, গাত্রে একখানা ছিন্ন চাদর ও পদ নগ্ন। চেহারা দেখিয়া কিন্তু তাহাকে ভদ্রবংশজাত বলিয়া বোধ হইল। আমার প্রণাম করিয়া সে একখানি পত্র দিল।

 উহা পাঠ করিয়া দেখি যে সুধাময় বাবু তাহাকে কোন কর্ম্মে নিযুক্ত করিতে আমায় অনুরোধ করিয়াছেন। সে বিশ্বাসী ও কর্ম্মপটু ইহাও জানাইয়াছেন। আমি তাহার আপাদমস্তক ভাল করিয়া দেখিলাম।

 সহসা আমার মনে কেমন একটা সন্দেহ উপস্থিত হইল। তাহাকে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম:—

 “তোমার নাম কি?”

 “আজ্ঞে, সুন্দর লাল।”

 নাম চেহারার অনুরূপ বটে।

 “তুমি আর কোথাও কি পূর্ব্বে কর্ম্ম করিয়াছ?”

 “আজ্ঞে না।”

 “তবে তুমি কি করিয়া এখানে কার্য্য করিবে?”

 “আমি বড় গরীব। আপনাদের উপর ভরসা। আমাকে শিখাইয়া লইলেই সকল কর্ম্ম করিতে পারিব।”

 তোমার রেজেষ্টারী সার্টিফিকেট্‌ আছে?”

 “সে কি?”

 তাহাকে আইন বুঝাইয়া দিলাম। সে যেন একটু চিন্তিত হইয়া পড়িল ও পরে বলিল:—

 “তা এখানে কয়েকদিন কার্য্য করিলে আপনি দয়া করিয়া আমার নাম রেজেষ্টারী করাইয়া দিবেন। আপনি আমার মা বাপ। আমার এ সংসারে আর কেহ নাই। আমায় নিরাশ করিবেন না।”

 দেখিলাম যুবক চতুর ও বুদ্ধিমান বটে। যাহা হউক অপর এক তৃত্যকে ডাকিয়া উহাকে কাজকর্ম্ম শিখাইয়া দিতে বলিলাম। সেইদিন সন্ধ্যার সময় বন্ধুবর কোন কার্য্যোপলক্ষে আমার বাটী আসিলেন। দুই একটী কথাবার্ত্তার পর আমার হস্তে এক টেলিগ্রাম দিয়া বলিলেন:—

 “পড়”।

 দেখি তাহাতে একটীমাত্ৰ কথা লেখা:—

 “সাবধান।” প্রেরকের নাম নাই। স্থানটা দেখিলাম হাওড়া।

 বন্ধুবর জিজ্ঞাসা করিলেন:—

 “কিছু বুঝিলে কি?”

 “কিছু কিছু। আমাদের অনিষ্টের জন্য সম্পাদক-প্রবর কোন নূতন ফন্দি স্থির করিতেছেন বা করিয়াছেন। তাহাই কোন অজ্ঞাতনামা বন্ধু জানিতে পারিয়া টেলিগ্রাম দ্বারা আমাদিগকে সাবধান করিয়া দিয়াছেন।”

 “হাঁ। আমারও তাহাই বিশ্বাস। সন্দেহের একটু কারণও আছে। হরিশ প্রত্যহই, কোন নূতন সংবাদ থাক আর নাই থাক, আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আইসে। আজ চারিদিন হইল একেবারেই তাহার দেখা নাই। আমি গুপ্ত সন্ধান লইয়া জানিয়াছি যে সে সম্পাদক-প্রবরের বাটীতে নাই। কোন কার্য্যের জন্য তাহাকে বিদেশে যাইতে হইয়াছে।”

 “কথা ভাল বোধ হইতেছে না। কেন না, যদি কোন কার্য্যের জন্য তাহাকে পাঠান হইয়া থাকে, তাহা হইলে সে আমাদের সহিত সাক্ষাৎ না করিয়া যাহত না। মনের অগোচার পাপ নাই। আমার বিশ্বাস সম্পাদক উহার উপর সন্দেহ করিয়া কোথাও তাহাকে বন্দী করিয়া রাখিয়াছে।”

 “আমারও এখন এই সন্দেহ হইতেছে। অামাদের আর নিশ্চিন্ত থাকা উচিত নহে। হরিশ কোথায় আছে সন্ধান লইতে হইবেই হইবে। ইহার ভিতর একটা কিছু রহস্য জাছে।”

 “নিশ্চয়ই।”

 এমন সময় সুন্দরলাল নিঃশব্দে গৃহে প্রবেশ করিল এবং কয়েকখানা সংবাদপত্র টেবিলের উপর রাখিয়া দিল। তাহাকে দেখিয়াই বন্ধুবর জিজ্ঞাসা করিলেন:—

 “এ কে?”

 “আমার নূতন ভৃত্য।”

 “উহাকে কোথায় দেখিয়াছি বলিয়া বোধ হইতেছে?”

 সুন্দরলাল বলিয়া উঠিল:—

 “আজ্ঞে, সুধাময় বাবুর বাটীতে। আমিও আপনাকে সেখানে অনেকবার দেখিয়াছি।”

 বন্ধুবর মস্তক সঞ্চালন করিয়া বলিলেন:—

 “না, অন্য কোন স্থানে। মনে হয়—হাঁ—ঠিক—তুমি কি “প্ৰভাতী” প্রেসের একজন কম্পোজিটর ছিলে না? অামার মনে হইতেছে তোমায় সেখানে দেখিয়াছি।”

 “আজ্ঞা, যদি প্রেসের কর্ম্ম জানিব তবে এখানে ভৃত্যের কার্য্য করিব কেন? আপনি বোধ হয় আমার চেহারার মত অন্য কাহাকে দেখিয়াছেন।”

 “তাহা হইতে পারে,” বলিয়া বন্ধুবর আমার সহিত অন্য কথায় প্রবৃত্ত হইলেন। সুন্দলাল তৎক্ষণাৎ চলিয়া গেল।

নবম পরিচ্ছেদ।

 এই ঘটনার দুই চারিদিন পরে আমরা সকলে বোম্বায়ে যাত্ৰা করিলাম। বন্ধুবর আর একবার জাহাজ ভাল করিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন ও উপস্থিত সকল অংশীদারগণকে দেখাইয়া দিলেন যে তাঁহার নক্সার অনুযায়ী উহা প্ৰস্তুত হইয়াছে। কিন্তু উহার নামকরণ উপলক্ষে বেশ একটু ঝড় বহিয়া গেল। কাহারও মতে “Fortunatus” নাম রাখা উচিত বিবেচিত হইল। কেহ বলিলেন বন্ধুবরের নামানুসারে উহার 

 “উহার নাম “সোনার ভারত” রাখা হইল।”
 “উহার নাম “সোনার ভারত” রাখা হইল।”

নামকরণ করা হউক। অবশেষে তাঁহার মধ্যস্থতায় উহার নাম “সোনার ভারত” রাখা হইল।

 পরে জাহাজের কার্য্যকারিতা পরীক্ষার জন্য একটী দিন নির্দ্দিষ্ট হইল। সেদিন আকাশ অতি নির্ম্মল। মৃদমন্দ বায়ু বহিতেছিল। সমুদ্র নিস্তদ্ধ। ক্বচিৎ দুই একটী ঢেউ দেখা যাইতেছিল। নির্দ্দিষ্ট সময়ে সকলে ডকে উপস্থিত হইলাম। পরে জাহাজে আরোহণ করিলাম। ঢং ঢং করিয়া ১১টা বাজিল। বন্ধুবর একটা বন্দুকধ্বনি করিলেন। তৎক্ষণাৎ কাপ্তেন ইঞ্জিনিয়ারদিগকে জাহাজ চালাইতে হকুম দিলেন। অর্দ্ধঘণ্টার মধ্যে হংসের ন্যায় হেলিয়া দুলিয়া উহা চলিতে আরম্ভ করিল। ক্ৰমে আমরা neutral zone এর সীমানা পার হইয়া গেলাম। তখন সুবৰ্ণ প্রস্তুত করিবার যন্ত্রাদির কার্য্যকারিতা পরীক্ষার জন্য বন্ধুবর নিম্নে গেলেন। আমরা সাগ্রহে তাঁহার পশ্চাৎ গমন করিলাম।

 যন্ত্রগুলির বিবরণ দেই এমন ক্ষমতা অামার নাই। আমরা দেখিলাম এই যে, তিনি যে যন্ত্রগুলির সাহায্যে সুবর্ণ উৎপাদন করিয়া আমাদিগকে দেখাইয়াছিলেন তাহার অপেক্ষা অধিক সংখ্যক যন্ত্র প্রস্তুত করা হইয়াছে।

 আমরা সকলে একত্রিত হইলে পর, বন্ধুবর আমাদিগকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন:—

 “এতদিন পরে আমাদের আশা ফলবতী হইতে চলিল। সকলই প্রস্তুত। কেবল কার্য্যারম্ভ বাকী। আপনারা আমার কার্য্যাবলীর উপর লক্ষ রাখুন।”

 এই বলিয়া তিনি একটা বোতাম টিপিলেন। অমনি এক বিকট শব্দ হইয়া যন্ত্রগুলি চলিতে আরম্ভ করিল। একটা বৃহৎ মার্ব্বেল-নির্ম্মিত চৌবাচ্চায় সমুদ্রের জল পম্প হইয়া পড়িতে লাগিল। পরে সেই জল উক্ত চৌবাচ্চার সহিত নলের দ্বারা যুক্ত আর এক চৌবাচ্চায় পড়িয়া কোন অজ্ঞাত কারণে কর্দ্দমাকারে পরিণত হইতে লাগিল। পরে ঐ কর্দ্দম ঐ পাত্রের গাত্রস্থিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নল দিয়া বেগে বাহির হইয়া কতকগুলি U আকৃতিবিশিষ্ট কাচের পাত্রে গুঁড়া আকারে জমিতে লাগিল। উহার বর্ণ হরিদ্রা। মিনিট পনের পরে বন্ধুবর সহাস্যে বলিয়া উঠিলেন:—

 “এই U আকৃতিবিশিষ্ট নলগুলি দেখুন। উহাদের ভিতর সুবৰ্ণ জমিতে আরম্ভ হইয়াছে।”

 বালকদিগের মত ঠেলাঠেলি করিয়া কাচপত্র গুলির ভিতর হইতে গুঁড়া তুলিয়া আমরা পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম যে বাস্তবিকই উহা সুবর্ণ! আমাদের আর আহ্লাদের সীমা রহিল না। একে একে সকলে আনন্দভরে বন্ধুবরকে আলিঙ্গন করিলাম।

 পূর্ণ পাঁচঘণ্টাকাল যন্ত্রগুলি চালান হইল। তাহার পর উহাদিগকে বন্ধ করিয়া দেওয়া হইল। তখন পাত্রগুলিতে যে সুবৰ্ণ জমিয়াছিল তাহা ওজন করিয়া দেখা গেল যে প্রায় ১০০০ তোলা পাওয়া গিয়াছে। বাজার দরে উহার মূল্য ২০০০০৲ টাকা। পাঁচ ঘণ্টা মাত্ৰ কার্য্য করিয়া যদি এত আয় হয়, তবে আটঘণ্টা করিয়া কার্য্য করিলে আরো অধিক সুবৰ্ণ পাওয়া যাইবে এবং সেই অনুপাতে আয়ও বৃদ্ধি হইবে নিশ্চয়ই। সুতরাং খরচ খরচা বাদে যেরূপ লাভ হইবে বন্ধুবর আশা দিয়াছিলেন তাহা অপেক্ষা যে অধিক হইবে ইহা সকলেরই দৃঢ় বিশ্বাস হইল।

 সকলের ইচ্ছানুসারে অধিকদূর না গিয়া আমরা বোম্বায়ে ফিরিয়া আসিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *