১৫১৩ সাল – ১৫

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ।

 আমি প্রায়ই দেখি যে বন্ধুবর তারহীন বার্ত্তা প্রেরণ করিবার যন্ত্র দিনের মধ্যে পাঁচ সাত বার পরীক্ষা করিয়া দেখেন। একদিন কৌতূহল বশতঃ কারণ জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিলেন:—

 “দেখ, এই জনমানবহীন স্থানে এই যন্ত্রটার যত প্রয়োজন আর কোন বস্তুর তত নহে। ধর, যদি এখানে আমরা একজন ব্যতীত সকলে মরিয়া যাই, তবে জীবিত ব্যক্তি তার করিয়া কলিকাতার খবর দিলে তাহাকে বাঁচাইতে পারা যাইবে। আমাদিগের কোন বিপদ ঘটিলে আমরা নিকটবর্ত্তী জনপদ হইতে সাহায্য পাইতে পারিব। আমার ঘন ঘন পরীক্ষা করিবার অার এক কারণ এই যে, যেদিন উক্ত যন্ত্র নষ্ট করিবার প্রথম চেষ্টা হইয়াছিল, সে দিন হইতে আমার মনে ধারণা হইয়াছে যে শত্রুর কোন চর আমাদিগের সহিত আসিয়াছে। তজ্জন্য সাবধানে থাকা নিতান্ত প্রয়োজন।”

 “যদি এমন কেহ থাকে, তবে এই ছয় মাসের অধিককাল আমরা কার্য্য করিতেছি, সে অন্য কোন প্রকারে অনিষ্টের চেষ্টা করে নাই কেন?”

 “করিয়াছে, কিন্তু সুবিধা করিতে পারে নাই। তোমার মনে উদ্বেগ হইবে বলিয়া এত দিন কোন কথা প্ৰকাশ করি নাই। যাহা হউক, “সাবধানে বিনাশ নাই” এই প্রবাদ অতি সত্য। আর এক কথা। আমাদের এই season এর কার্য্য শেষ হইতে আর অধিক বিলম্ব নাই। অতএব এখন কিছু বিশেষ সাবধানতার প্রয়োজন।”

 একটু ব্যঙ্গভাবে আমি বলিলাম:—

 “তোমার এখনও জুজুর ভয় যায় নাই দেখিতেছি। এই জনশূন্য স্থানে কোন্ শত্রুর চর আসিতে সাহস করিবে? ধরিলাম সে আসিয়াছে। আচ্ছা, সে খাইবে কি?”

 আমার বক্তব্য শেষ হয় নাই, এমন সময় তারহীন বার্ত্তা প্রেরণ করিবার যন্ত্রের ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল। বন্ধুবর যে সংবাদ পাইলেন, তাহা অতীব বিস্ময়কর! উহা এই:—

 “সাবধান। শত্রুর চর আপনার ঘরে প্রবেশ করিয়াছে। আপনাদিগের গতি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সে লক্ষ্য করিতেছে। ঘোরতর বিপদ শীঘ্রই উপস্থিত হইবে।”

 এই সংবাদে বন্ধুবরের ও আমার মুখ বিবৰ্ণ হইয়া গেল। একটু প্রকৃতিস্থ হইয়া বন্ধুবর জিজ্ঞাসা করিলেন:—

 “তুমি কে?”

 উত্তর আসিল:—“আমি হরিশ!”

 “তুমি এখন কোথায়?”

 “চারু বাবুর বাটীতে।”

 চারু বাবু আমাদিগের কোম্পানীর একজন ডাইরেক্টার্।

 “এতদিন কোথায় ছিলে?”

 “গুম হইয়া—সে অনেক কথা। সাক্ষাতে সব বলিব। বিশেষ সাবধানে থাকিবেন।”

 “আচ্ছা।”

 Receiver তুলিয়া রাখিয়া বন্ধুবর আমায় বলিলেন:—

 “শুনিলে ত? আমার কথা উড়াইয়া দিতে চাহিয়াছিলে না?”

 “এখত করিবে কি? যাহাকে সন্দেহ কর, গ্রেপ্তার করিলে হয় না?”

 “চেষ্টা করিয়া দেখিতে পার,” এই কথা কে আমাদের পশ্চাতে বলিয়া উঠিল। ফিরিয়া দেখি সুন্দরলাল দণ্ডায়মান!

 আমি বিরক্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম:—

 “তুই এখানে কেন?”

 “তোমাদিগকে মারিয়া ফেলিতে আসিয়াছি!”

 বন্ধুবর শ্লেষ করিয়া বলিলেন:—

 “তুই যে আমাদের শত্রুর চর তাহা অনেক দিন হইতে জানি। তোকে আমি কখনই সঙ্গে লইতোম না; কিন্তু আমার এই বন্ধুর জেদে তোকে লইয়াছিলাম। আমি তোকে প্রথম দিনেই চিনিতে পারি। তবে তুই যেরূপ ভাবে কার্য্য করিতেছিলি, তাহাতে আমি একটু ভ্ৰমে পড়িয়াছিলাম। তুই আমাদের তারহীন বার্ত্তা প্রেরণ করিবার যন্ত্রটা খারাপ করিয়া দিয়াছিলি, নহে কি?”

 “হাঁ। কি করিবে কর না। তোমাদের ত আর ঘরে ফিরিয়া যাইতে হইবে না, এখানেই চিতায় শয়ন করাইব। অমাদিগের ভয় কি?”

 “‘দিগের’ কারা রে?”

 “দেখিবে? দেখ।” এই বলিয়া সে একটি শিষ্ দিল।

 দেখিতে দেখিতে পাঁচ ছয় জন লস্কর্ ছটিয়া আসিল। তাহাদের প্ৰত্যেকের হস্তে এক এক লাঠি।

 তাহাদিগকে দেখিয়া বন্ধুবর সুন্দরলালকে জিজ্ঞাসা করিলেন:—

 “তুই কি চাস্?”

 সে বলিল:—

 “তোমরা প্ৰাণে বাঁচিতে চাও কিনা বল। যদি চাও, তবে এক সর্ত্তে রাজী হইতে হইবে। আর যদি আমাদের সহিত শত্রুতা কর, তাহা হইলে অন্য ব্যবস্থা করিব।”

 “তুই দেখ্‌চি লাট্ হইয়াছিস; তোর বক্তব্য বল।”

 “লাট্ ত বটেই। তা না হইলে আমি এমন ভাবে তোমাদের সম্মুখে দাঁড়াইতে সক্ষম হইতাম না। যদি বাঁচিতে চাও, তবে আমাদের এই সর্ত্তে লেখাপড়া করিয়া দাও যে, তোমরা স্বেচ্ছায় “সোনার ভারত” ও তাহাতে যে কিছু দ্রব্যাদি অাছে সকলই আমাদিগকে দান করিলে; আমরা তাহার যথা ইচ্ছা ব্যবহার করিতে পারিব। যদি তোমরা পরে সর্ত্ত বাতিল করিতে ইচ্ছা কর, তাহা গ্ৰাহ্য হইবে না।”

 “যদি ইহাতে রাজী হই তুই করিবি কি?”

 “তুমি কি মনে কর তোমাদিগকে সাদরে ঘরে পৌঁছাইয়া দিব। যদি এরূপ মনে করিয়া থাক, ভুল বুঝিয়াছ। আমরা জাহাজে চড়িয়া চলিয়া যাইব। তোমরা দুই জনে এই দ্বীপে পরম সুখে বাস করিতে থাকিবে। তোমাদের জন্য এক বৎসরের মত খাবার দিয়া যাইব। তারপর তোমাদের ভাগ্য।”

 “ওঃ, কি দয়ার শরীর তোর! এমন তর সচরাচর দেখা যায় না। আচ্ছা যদি সর্ত্তে রাজী না হই, তবে কি করিবি?”

 “তোমাদের প্রাণবধ করিয়া মৃতদেহ সৎকার করিয়া স্বস্থানে চলিয়া যাইব। যাহাতে তোমাদের অস্তিত্ব পর্য্যন্ত লোপ পায় তাহা না করিয়া যাইব না।”

 “বটে? তবে আমাদের ছেলেপিলের অনেক কষ্টের লাঘব করিয়া দিবি দেখিতেছি। বল, তুই এরকম করিতেছিস্ কেন? কে তোর এমন মতি দিল? তুই ভবিষ্যৎ ভাবিতেছিস্ না।”

 “ভবিষ্যৎ, সে আবার কি? যাহার বরাতে যাহা আছে তাহাই হইবে। আমার আবার ভয় কি? তোমরা যদি না থাক, তবে আমাদের বিপদে ফেলিবে কে?”

 “তোর মাথার ঠিক নাই দেখিতেছি। একটু ঠাণ্ডা হ’। ব্যাপারটা বুঝাইয়া বল।”

 “মাথা ঠিকই আছে। ব্যাপারটা শুনিতে চাহিতেছ? এখন বলিতে আর আপত্তি কিছুই নাই। কেন না, তোমাদের শেষ সময় উপস্থিত। সকল কথা শুনিয়া একটু আশ্বস্ত হইয়া মরিতে পরিবে। তুমি জান, তুমি “প্ৰভাতী” সম্পাদকের কতই না অনিষ্ট করিয়াছ। তিনি যাহা চেষ্টা করিয়াছেন, তাহাতে একটা না একটা বখেড়া দিয়াছ। মানুষের শরীর কতদিন আর সহ্য করিতে পারে। কাজেই তিনি তোমায় রীতিমত শিক্ষা দিতে দৃঢ়প্ৰতিজ্ঞ হইয়াছেন। আমায় তুমি উঁহার ছাপাখানায় কাজ করিতে দেখিয়াছিলে, তাহা ঠিক। আমি কিন্তু মনে করি নাই তুমি আমাকে চিনিতে পারিবে। যাহা হউক, আমি কোন রকমে তাঁহার মতলব জানিতে পারিয়া তাঁহার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে প্ৰস্তুত—একথা তাঁহাকে জানাই। তিনি আমায় নানা প্রকারে পরীক্ষা করিয়া আমার প্ৰতিজ্ঞার দৃঢ়তা দেখিয়া একদিন বলিলেন যে, যদি আমি তোমাদের জাহাজ ডুবাইয়া দিতে ও তোমাদিগের প্রাণনাশ করিতে পারি, তিনি আমায় পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরস্কার দিবেন। আমার বিশ্বাসের জন্য তিনি দশ হাজার টাকা অগ্ৰিম দিয়াছেন। আমি কোন রকমে তোমার বন্ধুর অধীনে এক চাকুরী জোগাড় করিয়া তাঁহাকে অনেক খোসামোদ করিয়া “সোনার ভারতে” একটি কর্ম্ম যোগাড় করি। উহাতে আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিবার বড়ই সুবিধা হইল। তুমি জান, তোমার তারহীন বার্ত্তা প্রেরণ করিবার যন্ত্র আমিই প্রথমে নষ্ট করিয়া দেই। তখন জানিতাম না যে, উহার duplicate অংশ ছিল। যাহা হউক, তাহার পর আরও কয়েকবার তোমার অনিষ্টের চেষ্টা করিয়াছি; কিন্তু তোমার সাবধানতার জন্য সুবিধা করিতে পারি নাই। অবশেষে অনেক চেষ্টায় পর স্থির করিলাম যে, তোমাদের লস্করগণকে অর্থলোতে বশীভূত করিয়া বিদ্রোহী করিতে না পারিলে আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে না। যে দিন আমি সমুদ্রতলস্থিত জাহাজের ধনরাশি দেখি, সেই দিনই এই মতলব্ স্থির করি। কিন্তু সেই সময়েই আমার আগেকার মতের পরিবর্ত্তন হয়। সেই সুবর্ণ ও রৌপ্যের মূল্য ত্ৰিশ লক্ষ টাকার কম হইবে না। “সোনার ভারতে” যে সুবৰ্ণ আছে, তাহার মূল্যও দশলক্ষের কম মহে। দেখিলাম যে, এই ত্ৰিশ লক্ষের কিছু না হ’ক, বিশ লক্ষ আমি অনায়াসেই নিজস্ব করিয়া লইতে পারিব। বাকী বিশ লক্ষ লস্কর্‌দিগকে ঘুষ দিলে, তাহারা আমার সহিত নিশ্চয়ই যোগ দিবে। আমি প্রথমে কাপ্তেনের মনোগত ভাব বুঝিয়া দেখিলাম। তিনি একেবারেই নারাজ। তখন আমি লস্কর্‌দিগকে জাপাইতে লাগিলাম। প্রথমে তাহার রাজী হয় না; কিন্তু যখন তাহাদিগকে রাতারাতি বড় মানুষ হইবার সুবিধা বিস্তারিত ভাবে বুঝাইয়া দিয়া তাহাদের এই ধারণা করাইলাম যে, তাহাদিগের কোন বিপদের আশঙ্কা নাই, তখন তাহারা অনেকেই আমার সহিত যোগ দিতে স্বীকৃত হইল। পরে আমি অন্যান্য মতলব স্থির করিয়া বিদ্রোহ করিবার সুবিধা খুঁজিতে লাগিলাম। আমি এখন আর “প্ৰভাতী” সম্পাদকের ভৃত্য নহি। আমাকেই তোমাদের শত্রু জানিবে।”

 বন্ধুবর বলিলেন:—

 “এখন সকল কথাই বুঝিলাম! কাপ্তেন মহাশয় কোথায়?”

 “তাঁহার হাত পা বাঁধিয়া তাঁহাকে এক কাবিনে বন্দী করিয়া রাখিয়া আসিয়াছি। চার জন্য লস্কর্ তাঁহাকে পাহারা দিতেছে। যাক্, এখন তোমরা অামার সর্ত্তে রাজী আছ কিনা বল?”

 বন্ধুবর দৃঢ় ভাবে উত্তর দিলেন:—

১৫১৩ সাল 89.jpg
 “যষ্টি উত্তোলন করিয়া আমাদিগকে আক্রমণ করিতে আসিল।” (পৃঃ ৭৫)

 “না।”

 “তবে মজা দেখ।”

 এই বলিয়া সুন্দরলাল একটা ইসারা করিল। তৎক্ষণাৎ যষ্টি উত্তোলন করিয়া তাহার সঙ্গীগণ আমাদিগকে আক্রমণ করিতে আসিল। আমরা প্ৰাণপণে তীরাভিমুখে দৌড়াইতে লাগিলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই জালিবোট ধরিতে পারিলাম এবং উহা এমন বেগে চালাইয়া দিলাম যে, আক্রমণকারিগণ তীরে উপস্থিত হইবার পূর্ব্বে আমরা প্ৰায় ২০০ হাত দূরে চলিয়া যাইতে সক্ষম হইলাম। নিরুপায় হইয়া তাহারা অকথ্য ভাষায় গালি দিতে লাগিল। আমরা তাহা গ্ৰাহ্য করিলাম না।

 একটু প্ৰকৃতিস্থ হইয়া বন্ধুবরকে জিজ্ঞাসা করিলাম:—

 “বলি, যাইতেছ কোথায়?”

 “কেন, জাহাজাভিমুখে?”

 “কিন্তু সেখানেও যে বিপদ্?”

 “থাকুক। আমার বিশ্বাস আমাদের হঠাৎ আবির্ভাব অপর বিদ্রোহীদিগের মনে ভীতি-উৎপাদন করিতে সক্ষম হইবে। তাহার পর তাহাদিগকে মিষ্ট বাক্য দ্বারা বশীভূত করিব। আমার উপর নির্ভর কর।”

 “সোনার ভারতের” নিকট যখন আমাদিগের বোট পৌঁছিল, তখন দেখি ডেকের উপর দুই জন থালাসী দণ্ডায়মান আছে। তাহারা আমাদিগকে দেখিয়াই “গাঁঙ্গওয়ে” দিয়া নামিয়া আসিল এবং আমাদিগকে উপরে লইয়া গেল। তথায় অন্য কাহাকেও দেখিলাম না। বন্ধুবর তাহাদিগকে সকল কথা খুলিয়া বলিতে বলিলেন। তাহারা সংক্ষেপে বিদ্রোহের সকল বিবরণই দিল। তাহাদিগের নিকট ইহাও জানিলাম যে আন্দাজ অর্দ্ধেক খালাসী বিদ্রোহী হইয়াছে, অপর সকলে ভয়ে তাহাদিগের বশ্যতা স্বীকার করিয়াছে। এই কথা শুনিয়া আমাদের একটু সাহস হইল। প্ৰথমে আমরা আমাদের কেবিনে প্রবেশ করিলাম। সেখান হইতে পাঁচটী রিভলবার সংগ্ৰহ করিয়া কাপ্তেন মহাশয়কে যে কেবিনে বিদ্রোহীরা আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিল, তদাভিমুখে গমন করিলাম। উহার সম্মুখেই চারিজন পাহারা বসিয়া আছে দেখিলাম। আমাদিগকে দেখিয়া তাহারা চীৎকার করিয়া আক্রমণ করিতে অগ্রসর হইল। আমরা তাহাদিগের মস্তকের দিকে রিভলবার লক্ষ্য করিয়া ধরিলাম এবং বন্ধুবর দৃঢ়ভাবে তাহাদিগকে বলিলেন:—

 “খবরদার্। এক পা এগুলেই তোদের মাথা উড়িয়া যাইবে। যদি ভাল চাস্, তবে তোদের লাঠি এক পাশে ফেলিয়া দে। নইলে তোদের রক্ষা নাই।”

 বন্ধুবরের সেই দৃঢ়তা-ব্যঞ্জক স্বর বিদ্রোহীদিগকে নরম করিয়া দিল। তাহারা দুই একবার “হাঁ,—না” বলিয়া লাঠি দিল এবং অপরাধের জন্য বারংবার ক্ষমা প্রার্থনা করিতে লাগিল।

 বন্ধুবর নরম ভাবে বলিলেন:—

 “তোদের বিশেষ দোষ নাই জানি। তোরা মন্দলোকের প্ররোচণায় এইরূপ দুঃসাহসিক কার্য্য করিয়াছিস্। আয়, আমাদের সঙ্গে আয়। তোদের দোষ এবারকার মত মাপ করিলাম।”

 বারংবার কৃতজ্ঞতা জানাইয়া তাহারা অামাদিগের সহিত কপ্তেন মহাশয়ের কেবিনে প্ৰবেশ করিল। তাঁহাকে সত্বর মুক্ত করিয়া তাঁহার মুখে বিদ্রোহের সকল বিবরণ শুনিয়া লইলাম। আমাদিগের দল এখন ভারী হইল। তখন বন্ধুবরের নেতৃত্বে ধীরে ধীরে সকলে ডেকের নিম্নে অবতরণ করিলাম। সেখানে অপরাপর বিদ্রোহীরা জটলা করিতেছিল।

 হঠাৎ আমাদিগকে, বিশেষতঃ কাপ্তেন মহাশয়কে, দেখিয়া তাহারা বুঝিল যে আর নিস্তার নাই। কেহ কেহ “মার” “মার” করিয়া লাঠি তুলিয়া দাঁড়াইল। সকলকে সম্বোধন করিরা বন্ধুবর বলিলেন:—

 “হুঁসিয়ার! তোদের যে পালের গোদা, সে ধরা পড়িয়াছে। তোরা তার মিথ্যা লোভে পড়িয়া আমাদিগের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়াছিস্। তোরা আমাদিগের কিছুই অনিষ্ট করিতে পারিবি না। যদি এক্ষণেই দোষ স্বীকার করিয়া ক্ষমা চাস্, ত ভালই; নচেৎ তোদের আর রক্ষা নাই। ভাবিবার জন্য দুই মিনিট সময় দিলাম।”

 এই বলিয়া তিনি ঘড়ি খুলিয়া ধরিলেন।

 তাহাদের ভিতর একটা গোলযোগ উপস্থিত হইল। তিন জন ব্যতীত অপর সকলেই অবিলম্বে বশ্যতা স্বীকার করিল! আমাদিগের ভয় দূর হইল। বন্ধুবরের হুকুম মত সেই তিন জনকে রজ্জু দ্বারা বাঁধিয়া একটা কেবিনে বন্দী করিয়া রাখা হইল। পরে থালাসীগণকে একত্র করিয়া তাহারা সুন্দরলালের প্ররোচনায় যে ভয়ানক অন্যায় কার্য্য করিায়াছে, তাহা বন্ধুবর তাহাদিগকে বুঝাইয়া দিলেন। তাহারা ঈশ্বরের নামে শপথ করিয়া বলিল যে আর কখনও বিদ্রোহী হইবে না।

 তাহার পর আমরা বারোজন উপযুক্ত ভাবে সজ্জিত হইয়া তীরে গেলাম। নিকটেই সুন্দরলাল ও তাহার বন্ধুগণ বসিয়াছিল। আমাদিগকে দেখিয়া তাহারা “মার” “মার” শব্দে আক্ৰমণ করিল। কিয়ৎক্ষণ যুদ্ধ চলিল। কিন্তু শীঘ্রই তাহারা পরাভূত ও একে একে ধৃত হইল। তাহাদিগকে বাঁধিয়া জাহাজে চালান দেওয়া গেল। আমরা দুইজনে তখন অনেকটা নিশ্চিন্ত হইলাম এবং তীরে বসিয়া শ্ৰা্ন্তিদূর করিতে লাগিলাম।

ষোড়শ পরিচ্ছেদ।

 শ্ৰা্ন্তিদূর হইলে পর বন্ধুবর বলিলেন:—

 “দেখ, রজনি, একটা বেশ কাণ্ড হইয়া গেল। আমাদিগের অবশ্য বিশেষ কিছু ক্ষতি হয় নাই; কিন্তু মন বড়ই খারাপ হইয়াছে। বোধ হইতেছে, যেন কোন অপরিহার্য্য বিপদ্ সম্মুখীন। তুমি হাসিয়া উড়াইয়া দিতে পার; কিন্তু তুমি জান যে আনি এরূপ ভাবের কথা কখনও পূর্ব্বে বলি নাই। ইহা উপেক্ষণীয় নহে।”

 আমি সহাস্যে বলিলাম:—

 “একটা ভয়ানক বিপদ্ হইতে রক্ষা পাইয়াছ। ফলে, তোমার শিরাগুলির উপর তাহা কার্য্য করিয়া নানারূপ বিভীষিকা উৎপাদন করাইতেছে। অবশ্য মানবের সর্ব্বদাই বিপদ্ ঘটিতে পারে; কিন্তু এখন আশঙ্কার আর কোন কারণ নাই। তুমি অযথা উত্তেজিত হইও না।”

 “আমি জানি, তুমি আমার কথা বিশ্বাস করিবে না। কিন্তু শীঘ্রই দেখিতে পাইবে যে আমার আশঙ্কা অমূলক নহে। যাহা হউক, এখন ডিপোতে চল। তাহার অবস্থা দেখা আবশ্যক।”

 দেখিয়া সুখী হইলাম, উহার কোনরূপ ক্ষতি হয় নাই। সকল দ্রব্যই যথাস্থানে আছে। তৎপরে আমরা দ্বার বন্ধ করিবার উপক্রম করিতেছি, এখন সময় তারহীন বার্ত্তা প্রেরণ করিবার যন্ত্রের ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল। বন্ধুবর receiverএর নিকট গেলেন; কিন্তু যে সংবাদ পাইলাম, তাহাতে আমরা অত্যন্ত চিন্তিত হইয়া পড়িলাম। তাহা এই:—

 “এবার আর কোন রকমে নিস্তার নাই। সর্ব্বদাই সাবধানে থাকিবেন”। প্রেরক হরিশ!

 বন্ধুবর বলিলেন:—

 “খোলসা করিয়া বল।”

 “শত্রুর এক বোট—”

 আর সংবাদ আসিল না। আমরা প্রায় এক ঘণ্টা দণ্ডায়মান রছিলাম; কিন্তু ঘণ্টা আর বাজিল না। অগত্যা receiver তুলিয়া রাখিয়া চেয়ারে বসিয়া পড়িলাম।

 বন্ধুবর বলিলেন:—

 “দেখিলে? আমার কথা উড়াইয়া দিতে চাহিয়াছিলে না? যাহা হউক, এখন কি করা যায়? এ এক মহাসমস্যা উপস্থিত।”

 আমি বলিলাম:—

 “ব্যাপারটা বিস্তারিত শোনা গেল না। যাহা হউক, একটা বিপদ্ যে সম্মুখীন, তাহা বুঝা যাইতেছে। তাহাকে সর্ব্বতোভাবে এড়াইতে চেষ্টা করিতে হইবে।”

 “তাহাতো আমি বুঝি; কিন্তু সকল কথা না জানিতে পারিলে কি উপায় অবলম্বন করিব, স্থির করিতে পারিতেছি না। যাহা হউক, এক কার্য্য করা যা’ক্। আমাদিগের কার্য্য বন্ধ করিতে আর পনেরো দিবস মাত্র বাকি আছে। ইহার পূর্ব্বেই—কল্যই, উহা বন্ধ করা যা’ক্। আমাদিগের বিপদ্ সমুদ্রের উপরই ঘটিবে, ভূপৃষ্ঠে নহে। অতএব যত সুবৰ্ণ পাওয়া গিয়াছে, তাহা জাহাজ হইতে নামাইয়া ডিপোতে জমা রাখা যা’ক্। উহা দুইজন বিশ্বাসী ব্যক্তির চার্জ্জে রাখিয়া, চল কলিকাতায় ফিরিয়া যাই। সেখানে ব্যাপার বিস্তারিত জানিয়া যাহা ভাল হয় করা যাইবে। তোমার মত কি?”

 “আমিও তাহাই বলি। তবে আর বিলম্বের প্রয়োজন কি?”

 আমরা জাহাজে সত্বরই ফিরিয়া আসিলাম। পরে সকলকে ডাকাইয়া বলিলাম যে, নানা কারণে আমরা অদ্য হইতে কার্য্য বন্ধ করিতে মনস্থ করিয়াছি এবং আগামী কল্যই কলিকাতাভিমুখে যাত্রা করিব। সেইদিনই জাহাজে যতটা সুবৰ্ণ ছিল, তাহা ডিপোজাত করিয়া এবং উপযুক্ত ও বিশ্বাসী দুইজন ভৃত্যের চার্জ্জে উহা রাখিরা জাহাজে প্রত্যাবর্ত্তন করিলাম। পরদিন প্ৰত্যূষেই কলিকাতাভিমুখে যাত্রা করিলাম। সবমেরীন্ বোম্বায়ে পাঠাইয়া দিলাম।

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ।

 আমাদিগের যে একটা বিপদ্ ঘটিবার সম্ভাবনা আছে, তাহা কাপ্তেন মহাশয় ব্যতীত আর কাহাকেও বলি নাই। কেননা, ভয় পাইয়া খালাসী প্রভৃতি অশিক্ষিত ব্যক্তিগণ একটা কাণ্ড বাধাইতে পারে।

 আমরা সর্ব্বদাই সতর্ক রহিলাম। আমাদিগের জিনিষপত্রাদি গোছাইয়া রাখিয়া ডার্কের লাইফ্ বেলট্ সর্ব্বদাই সঙ্গে সঙ্গে লইয়া বেড়াইতে লাগিলাম।

 দুই দিন গেল, চারি দিন কাটিল। ক্রমে ক্রমে লঙ্কা প্ৰদক্ষিণ করিয়া আমাদিগের জাহাজ বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করিল। ক্রমে ক্রমে মাদ্রাজও ছাড়াইলাম। তখন বোধ হইতে লাগিল, সম্ভবতঃ হরিশ ভুল সংবাদ দিয়াছে। যাহা হউক, তখনও সম্পূর্ণ নিরাপদ মনে করিলাম না। পরদিন প্রাতে পুরী ছাড়াইলাম। সেইদিন দ্বিপ্রহরের সময় যখন আমরা ডেকে বসিয়া পুস্তক পাঠ করিতেছি, সেই সময় কাপ্তেন মহাশয় নিকটে আসিয়া চুপে চুপে বলিলেন:—

 “বোধ হয়, এতদিন পরে যে বিপদের আশঙ্কা করিতেছিলাম, তাহা ঘটিতে চলিল।”

 আমরা বিশেষ ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম:—কেন? কি রকমে জানিলেন?”

 “আসুন দেখাইব।” এই বলিয়া তিনি তাঁহার কেবিনে আমাদিগকে লইয়া গেলেন এবং বলিলেন:—“এই যন্ত্রের নিড্‌লগুলির কম্পন্ন আরম্ভ হইয়াছে। আমার বোধ হয়, কেহ আমাদিগের জাহাজ্ লক্ষ্য করিয়া টরপেডো ছাড়িয়াছে। উহা অতি নিকটবর্ত্তী হইয়াছে। বোধ হয়, এক পোয়—না—দেখুন নিড্‌লগুলির কম্পন্ন বড় ঘন ঘন  

১৫১৩ সাল 97.jpg
 “উহার তলদেশ বিদ্ধ হইয়া হু হু করিয়া জল উঠিতেছে।” (পৃঃ ৮১)

হইতেছে। আর নিস্তার নাই। এই সময় ভগবানকে স্মরণ করুন। আমার কোন দোষ নাই। আমি জ্ঞানতঃ কোন ত্রুটি করি নাই। বিদায়! বিদায়!! ওঃ! ওঃ!!” এইরূপ চীৎকার করিয়া উন্মাদের ন্যায় তিনি কেবিন হইতে বহির্গত হইলেন এবং নিমিষের মধ্যে সমুদ্রে ঝম্প প্ৰদান করিলেন।

 তাঁহার চীৎকার শুনিয়া কতকগুলি খালাসী দৌড়াইয়া আসিল। আমরা তাহাদিগকে তৎক্ষণাৎ লাইফ্‌বেল্ট পরিতে বলিয়া বিপদবার্ত্তাজ্ঞাপক ঘণ্টা বাজাইতে লাগিলাম। উহা শুনিবামাত্র, যে যেখানে ছিল ছুটিয়া আমাদিগের নিকট উপস্থিত হইল। আমরা তাহাদিগকেও ঐরূপ আদেশ দিয়া লাইফ্‌বেল্ট পরিয়া ডেকের উপর স্থিরচিত্তে দণ্ডায়মান হইয়া শেষ মুহূর্ত্তের জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলাম।

 সহসা কি এক বস্তু আমাদিগের জাহাজকে আঘাত করিল। তাহাতেই উহার একপ্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত কাঁপিয়া উঠিল। পর মুহূর্ত্তে একজন খালাসী চীৎকার করিয়া বলিল যে, উহার তলদেশ বিদ্ধ হইয়া হু হু করিয়া জল উঠিতেছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমাদের সাধের “সোনার ভারত” অতল জলে নিমজ্জিত হইল।

 আমি একবার চারিদিকে চাহিয়া দেখিলাম। আমার নিকটে আট দশ জন লোক ভাসিতেছে, তাহাদিগের মধ্যে বন্ধুবর একজন। বুঝিলাম আর সকলে “সোনার ভারতে”র সহিত ডুবিয়াছে। তখন এক দীর্ঘ নিশ্বাস আপনা আপনি বহির্গত হইল। অজ্ঞাতসারে কয়েক ফোঁটা অশ্রুজল গণ্ডস্থল বহিয়া পড়িল। “হায় ভগবান্, এই কি তোমার মনে ছিল?” এই কথা মনের আবেগে চীৎকার করিয়া বলিয়া তাঁহাকে প্ৰণাম করিলাম।

 তাঁহার কৃপায় আমাদিগকে অধিকক্ষণ জলে ভাসিতে হইল না। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে দেখি একখানি বৃহৎ পোত অামাদিগের দিকেই আসিতেছে। আমরা সমস্বরে একটা বিকট্ রব করিয়া উঠিলাম। তাহা পোতস্থ সকলেই শুনিতে পাইল এবং অনতিবিলম্বে এক জালিবোট পাঠাইয়া দিয়া আমাদিগকে উদ্ধার করিল।

 সেই পোতের কাপ্তেনের ও যাত্রীগণের প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলিলাম যে, আমরা জলভ্রমণে বাহির হইয়াছিলাম; কিন্তু সহসা আমাদিগের জাহাজে এক বৃহৎ ছিদ্র হওয়ায় উহা ডুবিয়া গিয়াছে। নানা কারণে সত্য গোপন করা উচিত বিবেচনা করিয়া, এইরূপ একটা সম্ভবপর কথার অবতারণা করিলাম। সকলেই উহা বিশ্বাস করিল এবং আমাদিগের প্রতি তাঁহাদিগের সহানুভূতি জানাইল।

 যতক্ষণ পোতে ছিলাম, আমাদিগের যত্নের পরিসীমা ছিল না। যথাসময়ে জাহাজ কলিকাতায় পৌঁছিলে পর আমরা কাপ্তেন মহাশয়কে আমাদিগের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাইয়া বিদায় গ্ৰহণ করিয়া স্ব স্ব গৃহে প্ৰত্যাবর্ত্তন করিলাম।

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ।

 গেল, এত সাধের “সোনার ভারত” গেল। কত অাশা ছিল। কতই না মতলব করিয়াছিলাম। সবই ডুবিল। হা ভগবান্! তোমার ইচ্ছাই ত’ পূর্ণ হয়! তাহাই হউক।

 কলিকাতায় পৌঁছিবার দুই চার দিন পরে আমরা এক সভা আহ্বান করিলাম। সকল অংশীদারগণ উপস্থিত হইলেন। আমরা বিস্তারিত করিয়া সকল কথা তাহাদিগকে জ্ঞাপন করিলাম। হরিশ আমাদিগের কি মহৎ উপকার করিয়াছে, তাহাও বিশেষরূপে বুঝাইয়া বলিলাম। হরিশও সেখানে উপস্থিত ছিল। সকলের অনুরোধে সে তাহার কথা এইরূপভাবে বলিল:—

 “আমি বুঝিতে পারিয়াছিলাম যে ‘প্রভাতী’ সম্পাদক মহাশয় আমায় সন্দেহ করিতে আরম্ভ করিয়াছেন। একদিন একটু অসাবধানতাবশতঃ ধরা পড়িলাম। আমায় গ্রেপ্তার করিয়া তিনি তাঁহার বাটীর এক অন্ধকার ঘরে কয়েদ করিয়া রাখিলেন। আমি অনেক টাকার লোভ দেখাইয়া কারাগারের প্রহরীকে বশীভূত করিয়া একরাত্রে পলায়ন করিলাম। পরে বিপিন বাবুর বাটীতে আশ্ৰয় লই। তাহার পর পারিতোষিকের লোভে ‘প্রভাতী’ সম্পাদক মহাশয়ের এক বিশ্বস্তু কর্ম্মচারীকে বশীভূত করিয়া তাঁহার কার্য্যকলাপের সংবাদ লইতে লাগিলাম। তাহার নিকট শুনিতে পাই যে, সুন্দরলাল নামক এক ব্যক্তিকে রজনীবাবুদিগের পশ্চাতে লাগান হইয়াছে। পরে জানিতে পারিলাম যে, এক জলদস্যুর সহিত বন্দোবস্ত করিয়া তাঁহাদিগের জাহাজ ডুবাইবার বন্দোবস্ত করা হইয়াছে। সুন্দরলাল সুবিধা করিতে না পারায় এই বন্দোবস্ত করা হয়। যাহা হউক, সুন্দরলাল রজনীবাবুদিগের দৈনিক কার্য্য বিবরণী পাঠাইত। যখন সম্পাদক মহাশয় শুনিলেন যে, বাস্তবিকই আশাতিরিক্ত সুবর্ণ পাওয়া যাইতেছে, তখন আর স্থির থাকিতে না পারিয়া জলদস্যুর সহিত বন্দোবস্ত করেন। যাহা হউক, তাঁহার অভিসন্ধি জানিতে পারিয়া আমি রজনীবাবুকে সাবধান করিয়া দেই। দুঃখের বিষয় এই যে, বিস্তারিত সকল কথা তাঁহাকে জানাইতে পারি নাই; কেননা যে তারহীন বার্ত্তা প্রেরণের যন্ত্রের সাহায্যে সংবাদ পাঠাইতেছিলাম তাহা মাধববাবুর। আমাকে উহা ব্যবহার করিতে দেখিয়া তিনি কারণ জিজ্ঞাসা করেন। আমি গুপ্তকথা প্ৰকাশ করিতে ইচ্ছুক ছিলাম না। কাজেই একটা যা’ তা’ উত্তর দেই। তিনি আমায় উহা ব্যবহার করিতে নিষেধ করিলেন। অগত্যা বিস্তারিত সংবাদ পাঠাইতে পারিলাম না। পরে একদিন সুবিধা পাইয়া উহা ব্যবহার করি। কোন উত্তর না পাওয়ায় বুঝিলাম যে রজনীবাবুরা কলিকাতায় আসিতেছেন। আমার আর বিশেষ কিছু বলিবার নাই।”

 হরিশের কথাগুলি সকলেই একাগ্ৰচিত্তে শুনিলেন। তাহার বক্তব্য শেষ হইলে পর সভাপতি মহাশয় উঠিয়া আমাদিগের সকলের আন্তরিক ধন্যবাদ তাহাকে জ্ঞাপন করিলেন। তৎপরে আমাদিগের লাভ ও ক্ষতির এক হিসাব ধরা হইল। যতটা সুবৰ্ণ কলিকাতায় পাঠান হইয়াছিল—তাহার ও যতটা আমাদিগের কার্য্যস্থলে জমা ছিল, তাহার মূল্য ধরা গেল। তাহা হইতে জাহাজ প্ৰস্তুতের ব্যয়, বেতন, ইত্যাদি বাবত সমুদায় খরচ-খরচা বাদ দিয়াও প্রত্যেক অংশীদারের প্রদত্ত মূলধন উঠাইয়া লইয়াও দেখা গেল যে, আমরা নিট্ তিন লক্ষ টাকা লাভ পাইয়াছি। একজন অংশীদার প্রস্তাব করিলেন যে, ঐ টাকা অংশীদারগণের শেয়ারের মূল্যানুযায়ী তাহাদিগের মধ্যে ভাগ করা হউক। বন্ধুবর ইহাতে আপত্তি করিয়া বলিলেন:—

 “তাহা হইতে পারে না। যে সকল নিরপরাধ কর্ম্মচারীরা আমাদিগের কার্য্যে জীবন বিসর্জ্জন করিয়াছে, তাহাদিগের অসহায় স্ত্রী-পুত্ৰদিগের অন্নসংস্থাপন করিয়া দিতে আমরা লোকতঃ ধর্ম্মতঃ বাধ্য। আর এক ব্যক্তি (হরিশকে দেখাইয়া) আমাদিগের কি মহৎ উপকার করিয়াছে, তাহা বাক্যের দ্বারা প্ৰকাশ করা অসম্ভব। তাহার নিকট আমরা চিরঋণী থাকিব। ঐ ঋণ পরিশোধ হইবার নহে। তবুও আমি প্ৰস্তাব করিতেছি যে, আমাদিগের কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ তাহাকে এক লক্ষ টাকা পুরস্কার দেওয়া হউক।”

 ইহাতে কাহারও আপত্তি হইল না। সকলেই ইহা একবাক্যে অনুমোদন করিলেন। তৎপরে তাঁহার অপর প্রস্তাবও গৃহীত হইল। পর প্রস্তাব আমাদিগের দুইজনের প্রতি vote of confidence পাস করা। তাহাও সাহ্লাদে সকলে পাশ করিলেন।

 শেষ প্রস্তাব এইরূপ ছিল, “যখন নিঃসন্দেহে ইহা প্ৰমাণিত হইয়াছে যে সমুদ্ৰ হইতে সুবর্ণ উৎপাদন করা যাইতে পারে এবং যখন খরচখরচা যাদে মূলধন উঠিয়া গিয়া বিশেষ লাভ পাওয়া সম্ভব তখন ঐ কার্য্যে পুনরায় প্ৰবৃত্ত হওয়া যাউক। গুরুপ্ৰসাদ বাবুকে এ কার্য্যের ভার লইতে অনুরোধ করা যাইতেছে।”

বন্ধুবর বলিলেন তাঁহার ঐ কার্য্যে পুনঃ প্ৰবৃত্ত হইতে কোন আপত্তি নাই এবং যত শীঘ্ৰ পারেন তিনি হাসানজী কোম্পানীকে একখানি নূতন জাহাজ নির্ম্মাণ করিবার অর্ডার দিবেন। কার্য্য মনসুনের পর আরম্ভ হইবে স্থির হইল।

তৎপরে ভবিষ্যতে যাহাতে “প্ৰভাতী” সম্পাদক বা তৎসদৃশ অন্য দুষ্টলোক আমাদিগের কোন অনিষ্ট করিতে না পারে, তাহার উপায় নির্দ্ধারণ করিবার জন্য এক কমিটি গঠন করিয়া যথারীতি ধন্যবাদাদির পর সভাভঙ্গ হইল।

সম্পূর্ণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *