১৫১৩ সাল – ১০

দশম পরিচ্ছদ।

 যথানিয়মে কার্য্য আরম্ভ করিবার দিনধার্য্য ও অন্যান্য আনুসঙ্গিক বিষয় নির্দ্দেশ করিবার উদ্দেশ্যে তাহার পরদিন আমরা সভা আহবান করিলাম।

 যথাসময়ে কার্য্য আৱম্ভ হইল। সর্ব্বসম্মতিক্ৰমে বন্ধুবরকে সভাপতি পদে বরণ করা হইল। সভার প্রথম কার্য্য—হাসানজী কোম্পানীর বিল শোধ করা। তাঁহাদের প্রধান অংশীদার উপস্থিত ছিলেন; বিলখানি বিশলক্ষ টাকার। চুক্তি কিন্তু ছিল পনের লক্ষের। একজন অংশীদার এই পার্থক্যেরকারণ জিজ্ঞাসা করিলেন।

 বন্ধুবর ঈষৎ হাস্য করিয়া বলিলেন:—

 “এই যে অতিরিক্ত টাকা দেখিতেছেন উহা একখানি সবমেরিন্ বোট্ ক্রয় বাবত পড়িয়াছে—”

 “সেকি? সবমেরিন্ বোট্ কি হইবে?”

 “যখন কোম্পানী স্থাপন করি, তখন ঐ বোট কিনিবার কোন আবশ্যকতা দেখি নাই। কিন্তু আমাদের কোন পরম হিতৈষী বন্ধুর হস্ত হইতে আত্মরক্ষার জন্য ইহা ক্রয় করিতে বাধ্য হইয়াছি। তাঁহার নাম উল্লেখ করিবার কোন আবশ্যকতা নাই, কেন না তাঁহাকে আপনারা সকলেই জানেন। অতএব আমি আশা করি এই অতিরিক্ত ব্যয়টা আপনারা পাস করিয়া দিবেন।”

 সকলেই একবাক্যে বলিয়া উঠিলেন, “নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।”

 “আমি আর একটা অতিরিক্ত খরচার হিসাব দেখাইয়া দিতে ইচ্ছা করি। আপনারা তাহা লক্ষ্য করিয়াছেন কিনা জানি না। একটা তারহীন-বার্ত্তা-প্রেরণ-যন্ত্রের বাবত হাসানজী কোম্পানী ২০০০০ টাকা মাত্র চাহিয়াছেন। ইহা পূর্ব্বে ধরা ছিল না। কিন্তু ইহার আবশ্যকতা যে কত, তাহা বোধ হয় আপনাদিগকে বুঝাইয়া বলিতে হইবে না। আমি প্ৰস্তাব করি, আপনারা এই বিল একবাক্যে মঞ্জুর করুন।”


 ৪  সকলে তাহাই করিলেন। হাসানজী কোম্পানীকে তাহাদিগের প্ৰাপ্য টাকার বাবৎ এক চেক লিখিয়া দিয়া আমরা কার্য্যারম্ভের দিনধার্য্যের জন্য প্ৰবৃত্ত হইলাম।

 অনেক বাদানুবাদের পর স্থির হইল যে, যে কয়মাস কার্য্য হইবে সেই সময় মাত্র বন্ধুবর ও আমি সর্ব্বদাই জাহাজে থাকিব। আমরা কলিকাতার আফিসে সপ্তাহে সপ্তাহে রিপোর্ট পাঠাইব। আফিসের কার্য্যে অপর তিন জন ডাইরেক্‌টার্ নিযুক্ত থাকিবেন।

 তাহার পর জাহাজের কর্ম্মচারী নিয়োগের কথা উঠিল। কাপ্তেন, নাবিক, প্ৰভৃতির নির্ব্বাচনবিষয়ে কোনও গোলযোগ হইল না। কিন্তু যখন ভাণ্ডারী (steward) নির্ব্বাচনের কথা উঠিল, তখন বেশ একটু গোলযোগ হইল।

 আমি প্ৰস্তাব করিলাম যে, অামার ভৃত্য সুন্দরলালকে ঐকার্য্যে নিযুক্ত করা হউক।

 বন্ধুবর আপত্তি করিলেন।

 আমি বলিলাম:—

 “যে কয় দিবস ও অামার বাটীতে কার্য্য করিয়াছে তাহাতে আমার বিশ্বাস হয়—সে ভাণ্ডারী পদের উপযুক্ত।”

 “তাহার উপযুক্ততার দুই একটী উদাহরণ দাও,” বন্ধুবর একটু শ্লেষের সহিত বলিলেন।

 “একটা দিব! একদিন আমি খুচরা টাকায় ও নোটে প্রায় ১০০০ মুদ্রা ভুলক্রমে এক টেবিলের উপর ফেলিয়া যাই। ও অনায়াসেই উহা লইতে পারিত, কিন্তু তাহা না করিয়া আমি আসিবামাত্র উহা আমায় দেয়। আমি তাহাকে পুরস্কার দিতে গেলে সে তাহা লইল না। আর একদিন আমার ঘড়ি ও চেন ঐ রূপে ফেলিয়া যাই। তাহাও সে আমায় দেয়। তখন মনে করিয়াছিলাম যে, বিপদের ভয়ে সে টাকা ও ঘড়ি আমায় দিয়াছিল। তাহার সাধুতা পরীক্ষা করিবার ইচ্ছায় একদিন গোটা পনের টাকা আমার বিছানার উপর রাখিয়া যাই। যথাসময়ে সে ঐ টাকা আমার হস্তে পৌঁছিয়া দেয়। সেই দিন হইতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস হইয়াছে যে ও অতি বিশ্বাসী। ভাণ্ডারের কার্য্যের জন্য বিশ্বাসী লোকের প্রয়োজন। আমার ধারণা সুন্দরলাল ঐ কার্য্যের জন্য একজন উপযুক্ত ব্যক্তি।”

 বন্ধুবর মস্তক নাড়িয়া বলিলেনঃ—

 “আমি তোমার কথা অবিশ্বাস করিতেছি না। তবে তাহাকে তোমার ওখানে যে দিন প্ৰথম দেখি সেই দিন হইতে অামার মনে কেমন একটা সন্দেহ উপস্থিত হইয়াছে যে উহার দ্বারা আমাদের বিশেষ অনিষ্ট ঘটিবে। তুমি কি উহার ভদ্রয়ানা চেহারা লক্ষ্য করিয়াছ? আমার এক ঘটনা শুন। এক দিন আমি সহসা তোমার গৃহে প্রবেশ করিয়া দেখি যে ও একখানা ইংরাজী সংবাদ পত্র নিবিষ্টচিত্তে পাঠ করিতেছে। আমায় দেখিয়া ত্র্যস্ত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল ও কাগজখানা পাট করিয়া যথাস্থানে রাখিয়া দিল। কিন্তু আমি জিজ্ঞাসা করায় বলিল যে সে ইংরাজী জানে না, কাগজের অক্ষরগুলি দেখিতেছিল মাত্ৰ। ইহা হইতে কি মনে হয়? অতএব আমার ইচ্ছা অপর কাহাকে ভাণ্ডারী নিযুক্ত করা হউক।”

 আমি বলিলামঃ—

 “ঐ পদ-প্রার্থীর সংখ্যা বেশী নহে, সর্ব্বসমেত দশজন মাত্র। ইহাদের মধ্যে ভোটাধিক্যে যে মনোনীত হইবে তাহাকে নিযুক্ত করা হউক, ইহাই আমার প্রস্তাব।”

 সকলে ভোট দিলে পর দেখা গেল যে সুন্দরলাল সর্ব্বাপেক্ষা অধিক ভোট পাইয়াছে। কাজেকাজেই তাহাকে ভাণ্ডারী নিযুক্ত করা হইল।

 ক্ৰমে ক্ৰমে অন্যান্য কার্য্যগুলি সমাধা করিয়া এক সপ্তাহের পরে অামাদের কার্য্যের দিনধার্য্য করিয়া সভা ভঙ্গ করা হইল।

একাদশ পরিচ্ছদ।

 দেখিতে দেখিতে সেই দিন আসিল। আজ আমাদের উৎসাহ দেখে কে? সকাল সকাল আহারাদি সমাপন করিয়া আমরা “সোনার ভারতে” আরোহণ করিলাম। কয়েকজন অংশীদার বন্দরে উপস্থিত ছিলেন। তাঁহারা আমাদিকে বিদায় দিলেন। নির্দ্দিষ্ট সময়ে জাহাজ ধীরে ধীরে চলিতে আরম্ভ করিল। সবমেরিন্ বোট পশ্চাতে আগমন করিতে লাগিল। আমরা তীরস্থ বন্ধুগণকে লক্ষ্য করিয়া অনবরত রুমাল উড়াইতে লাগিলাম। যতক্ষণ তাঁহাদিগকে দেখিতে পাওয়া যাইতেছিল, ততক্ষণ তাঁহাদের দিকে চাহিয়া রহিলাম। ক্রমে তীর অদৃশ্য হইল। সমুদ্র তখন নিস্তব্ধ। ক্বচিৎ একটা ঢেউ দেখা যাইতেছিল। আকাশ নির্ম্মল। পবনদেবও সুপ্ৰসন্ন।

 টং করিশা একটা বাজিল। আমরা ডেকে বসিয়াছিলাম, তৎক্ষণাৎ নীচে গেলাম। বন্ধুবর একটা বোতাম টিপিলেন। দুই এক মিনিটের মধ্যে সুবৰ্ণ প্ৰস্তুত করিবার যন্ত্রগুলি চলিতে আরম্ভ করিল। পাঁচ মিনিষ্ট পরে দেখিলাম যে সুবৰ্ণ প্ৰস্তুত হইতে আরম্ভ হইয়াছে। কিয়ৎক্ষণ পরে বন্ধুবর যন্ত্রগুলি বন্ধ করিয়া দিলেন।

 আমি আশ্চর্য্য হইয়া বলিলামঃ—

 “যখন চলিতেছে চলুক্‌না কেন?”

 তিনি বলিলেনঃ—

 “না। Neutral zone এর বাহির দিয়া যাইতেছি বটে, কিন্তু আইন অনুযায়ী আমরা এখনও সরকারী সীমানার মধ্যে আছি। তাহার প্রমাণ দিতেছি।”

 এই বলিয়া তিনি বোম্বাই হাইকোর্টের ল রিপোর্টের একখণ্ড আনিয়া তাহাতে দুইটা কেস্ দেখাইলেন। বুঝিলাম আমার প্রস্তাৰ মত কার্য্য করিতে গেলে আইন লঙ্ঘন করা হইবে। অর্থাৎ আমরা ভারত-মহাসাগরের গর্ভে স্থিত ও কোনও শক্তি-কর্ত্তৃক অনধিকৃত যে জনশূন্য দ্বীপের নিকট আমাদের কার্য্যস্থল অতি সংগোপনে—এমন কি অংশীদারগণের অজ্ঞাতসারে—স্থির করিয়াছিলাম, তথায় উপস্থিত হইবার পর রীতিমত কার্য্য করিতে সক্ষম হইব।

 আমি জিজ্ঞাসা করিলামঃ—

 “তবে তুমি একথা পূর্ব্বে বল নাই কেন? অদ্য হইতেই ত’ কার্য্যারম্ভের কথা?”

 “হাঁ। আমার ভুল হইয়াছে বটে। অদ্য প্রাতে হঠাৎ এই কথা মনে উদয় হয়। তখন ল রিপোর্টখানি দেখি। যাহা হউক, দুই এক দিনের বিলম্বে কিছুই আসিয়া যাইবে না। অংশীদার মহাশয়দিগকে বুঝাইয়া বলিলে তাঁহারা বিরক্ত হইবেন না নিশ্চয়ই। আর দুইদিন পরে আমরা কার্য্যস্থলে পৌঁছিব। তখন—”

 এই সময়ে সুন্দরলাল আসিয়া বলিল যে তারহীন যন্ত্রের ঘন্টা অনবরত বাজিতেছে। বন্ধুবর তৎক্ষণাৎ উঠিয়া গেলেন। একটু পরে বিরক্তভাবে আসিয়া বলিলেনঃ—

 “একটা কাণ্ড দেখিবে এস।”

 উক্ত যন্ত্রের নিকট লইয়া গিয়া তিনি আমায় বলিলেনঃ—

 “দেখ, receiver এর অবস্থা।”

 দেখি উহা ভাঙ্গা! কাজেই সংবাদ পাওয়া গেলনা।

 আমি আশ্চর্য্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলামঃ—

 “একি?”

 বন্ধুবর গম্ভীরভাবে বলিবেন:—

 “তুমি আমার কথা হাসিয়া উড়াইয়া দিওনা। ইহা কে অদ্যই ইচ্ছা করিয়া ভাঙ্গিয়াছে।”

 “কি করিয়া বুঝিলে?”

 “অদ্য জাহাজে উঠিবার পর আমি একটা সংবাদ কলিকাতার বাটীতে পাঠাইয়াছি। তখন উহা বেশ ছিল। এই কয়েক ঘন্টার মধ্যেই কে উহা ভাঙ্গিয়াছে।”

 “আঁ, বলকি? এরূপ কে করিল?”

 “কোনও ব্যক্তির উপর আমার সন্দেহ হইয়াছে। কিন্তু প্রমাণ না পাইলে আমি কিছুই বলিব না বা করিব না”!

 “এখন উপায় কি?”

 “উপায় না করিয়া কি আমি আসিয়াছি?” এই বলিয়া তিনি ভাণ্ডার ঘরে গিয়া একটা receiver আনিয়া ফিট্ করিয়া দিলেন। এই সকল কার্য্যে প্রায় অর্দ্ধঘণ্টা সময় অতিবাহিত হইয়া গেল। তখনও কিন্তু ঘণ্টা বাজিতেছে। বন্ধুবর receiver লইলেন!

 আমাদের কোন অংশীদার বোম্বাই হইতে জানিতে চাহিয়াছেন যে আমরা কেমন আছি এবং কার্য্যারম্ভ হইয়াছে কিনা। প্রশ্নের উত্তর দিয়া বন্ধুবর আমায় পাঠাগারে লইয়া গেলেন। আসন গ্ৰহণান্তর তিনি বলিলেন:—

 “দেখ রজনী, মনে করিয়াছিলাম এখানে নির্ব্বিঘ্নে কার্য্য করিতে পারিব। কিন্তু এখানেও আমাদের শত্রুর চর চুকিয়াছে। আমার যাহার উপর সন্দেহ হয়, তাহার নাম তোমায় এখন বলিব না। কিন্তু এইমাত্র বলি যে আমাদের সাবধানে থাকিতে হইবে। নতুবা বোধ হয় সকল শ্রম পণ্ড হইয়া যাইবে।”

 “যদি সন্দেহ হইয়া থাকে, তবে বল কোন বন্দরে সেই চরকে নামাইয়া দিই।”

 “তুমি বালকের মত কথা বলিতেছে। বিশেষ প্রমাণ না পাইলে চরকে ধরিব কি করিয়া? হইতে পারে আমার সন্দেহের কোন ভিত্তি নাই।”

 “তা বটে। এখন কি করিবে?”

 “একটা বিশেষ অনুসন্ধান করিব। তাহার ফল যে কিছুই হইবেনা, তাহা নিশ্চিত। দেখা যাউক কি হয়।”

 আমরা দুইজনে ডেকে গেলাম। সেখানে সকল কর্ম্মচারীদিগকে ডাকিয়া receiver ভাঙ্গার কথা বলিলাম। সকলেই শুনিয়া আশ্চর্য্য হইল; এবং ঘটনার যে কিছুই জানেনা তাহাও একবাক্যে বলিল!

 আমরা বিশেষ তদন্ত করিলাম, কিন্তু অনিষ্টকারীর সন্ধান হইল না। মন বড়ই খারাপ হইল। আরম্ভ ভালবোধ হইল না।

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ।

 পরদিন প্ৰত্যূষে বন্ধুবর আমাকে শয্যা হইতে উঠাইলেন। কেমন একটা আলস্য বোধ হইতেছিল বলিয়া উঠি উঠি করিয়াও উঠিতে পারিতেছিলাম না।

 তিনি হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেনঃ—

 “বলি আজ এক জায়গায় বেড়াইতে যাইবে?”

 শয্যা হইতে লাফাইয়া উঠিয়া আশ্চর্য্যভাবে প্রশ্ন করিলামঃ—

 “কোথায়?”

 তিনি উচ্চহাস্য করিয়া বলিলেনঃ—

 “কেন জলের তলায়। নূতন স্থান। কত কি দেখিবে।”

 “হাঁ। নিশ্চয়ই যাইব। কখন্ শুভযাত্রা করিতে হইবে?”

 “আহারাদির পর।”

 সবমেরিন্ বোট্ প্রস্তুত ছিল। যথা নির্দ্দিষ্ট সময়ে বন্ধুবর ও আমি তাহাতে আরোহণ করিলাম। উহার কাপ্তেন একটা কল টিপিলে ঘবং ঘবং করিয়া একটা বিকট শব্দ হইতে লাগিল। অর্দ্ধঘণ্টা পরে বন্ধুবর একটা যন্ত্র পরীক্ষা করিয়া আমায় জিজ্ঞাসা করিলেন:—

 “আমরা কোথায় আছি বলত?”

 “কোথায় থাকিব? যেখানে ছিলাম সেইখানেই। কখন্ সবমেরিন্ নামিবে?”

 ঈষৎ হাস্য করিয়া তিনি বলিলেনঃ—

 “উহা দুইশত ফিট্ নামিয়াছে।”

 “বল কি? আমিত কিছুই বুঝিতে পারি নাই।”

 “দেখিবে এস,” বলিয়া তিনি আমাকে একটা ক্ষুদ্র গৃহে লইয়া গেলেন। পরে তাহার এক পার্শ্বের একখানি লৌহ আবরণ সরাইয়া ফেলিলেন। একট বৃহৎ কাচ সম্মুখে দেখিলাম। তাহার অপর পার্শ্বে লবণাম্বুরাশি! তথায় শত শত অদ্ভুত জীব বিচরণ করিতেছে। জীবনে এ এক সম্পূর্ণ নূতন দৃশ্য। আমি সবিস্ময়ে তাহাদের ক্রীড়া দেখিতে লাগিলাম। সহসা দেখি এক ভয়ঙ্কর জীব আমাদের দিকে আসিতেছে। ভয়ে আমি পশ্চাতে হটিয়া গেলাম।

 বন্ধুবর আমায় ধরিয়া বলিলেন:—

 “ভয় নাই। এই কাচখণ্ড ভাঙ্গিতে ১০০০০ ঘোড়ার বলের প্রয়োজন।”

 আমি লজ্জিত হইয়া পড়িলাম। একটু পরে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম:—

 “ওটা কি?”

 “উহাকে ইংরাজীতে John Dory বলে। ইহা Kingfish শ্ৰেণীভুক্ত মৎস্যবিশেষ। কথিত আছে ইহার গাত্রে সেন্টপিটারের অঙ্গুলির দাগ আছে।”

 এমন সময় দেখি কতকগুলি লম্বা ছুঁচালমুখ মৎস্য ধীরে ধীরে আমাদের দিকে আসিতেছে। মুখ লম্বায় তিন, চারি ফিট্ কিন্তু দেহটা দশ বার ফিট্ বোধ হইল। বন্ধুবর চিৎকার করিয়া উঠিলেন:—

 “সাবধান, সাবধান। সোর্ডফিসের ঝাঁক আসিয়াছে।” এই বলিয়া তিনি বেগে মোটাররুমে গেলেন।

 আমি বড়ই চিন্তিত হইয়া পড়িলাম এবং তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গেলাম। কিয়ৎক্ষণ পরে তিনি দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলেন:—

 “আঃ, বাঁচা গেল।”

 আমি চিন্তিতভাবে প্রশ্ন করিলামঃ—

 “ব্যাপার কি?”

 “একটা ফাঁড়া গেল। যে মৎস্যগুলি দেখিয়াছিলে উহাদের নাম সোর্ডফিস্। ইহারা অতি ভয়ঙ্কর মৎস্য। ঐ লম্বা মুখ দ্বারা উহারা অনেক জাহাজের তলদেশ বিদীর্ণ করিয়াছে। লণ্ডনের British Museum ও অন্যান্যস্থানে উহাদের কর্ত্তৃক ভগ্ন অনেক জাহাজের hull দেখিতে পাইবে। উহাদের ঐ সোর্ডের ক্ষমতা এত যে উহা তাম্রাবরণ এমন কি নয় ইঞ্চি মোটা কাষ্ঠখণ্ড, বিদীর্ণ করিতে পারে। অনেকে সমুদ্রে স্নান করিতে গিয়া ঐ মৎস্যের হস্তে প্ৰাণ দিয়াছে। এইরূপ প্ৰবাদ যে, উহারা তিমি মৎস্যের চিরশত্রু। জাহাজাদিকে তিমি মৎস্য মনে করিয়া উহারা তাহাদিগকে নষ্ট করিয়া ফেলে।”

 “তাইত। তাহা হইলে বাস্তবিকই মস্ত ফাঁড়া গিয়াছে। এখন কি করিলে?”

 “আমি বোট্‌খানি আরো নামাইয়া দিয়াছি এবং তড়িতের সাহায্যে উহাদিগকে মারিয়া ফেলিয়াছি। দেখিবে?”

 তিনি আমাকে পূর্ব্বোক্ত কাচখণ্ডের নিকট লইয়া গেলেন। দেখি বাস্তবিকই সোর্ডফিসগুলি মরিয়াছে এবং তাহাদের সহিত আরো শত শত মৃত মৎস্য ভাসিয়া বেড়াইতেছে।

 বন্ধুবর বলিলেন:—

 “উপায় নাই। তড়িতের বেগ ত একজনের উপর প্রয়োগ হইতে পারে না। সোর্ডফিসের নিকটস্থ সকল মৎস্যের উপর উহা সমভাবে লাগিয়াছে। আর এক নূতন কাণ্ড দেখ! মৎস্যের লড়াই হইতেছে।”

 দেখি একটা মৎস্যকে আট দশটা মৎস্য আক্রমণ করিয়াছে। উহার অধোভাগে বেয়নেটের মত একটা দাঁড়া আছে। বুঝিলাম উহাকে স্বেচ্ছায় খাড়া করিয়াছে। যেমনই একটা মৎস্য তাহাকে আক্রমণ করিতেছে, সে উল্টাইয়া পড়িয়া ঐ দাঁড়ার দ্বারা তাহাকে বিদীর্ণ করিয়া দিতেছে।

 আমি জিজ্ঞাসা করিলামঃ—

 “ইহার নাম কি?”

 বন্ধুবর উত্তর দিলেনঃ—

 “ইহার সাধারণ নাম Stickle-back। উত্তর আয়ারলণ্ডে ইহাকে sprittle bag বা sprickly-bag বলে। দেখ, দেখ, দৃশ্য বড়ই সুন্দর হইল।”

 চাহিয়া দেখি একটা লম্বা কুম্ভীরের মত মৎস্য সহসা উহাকে আক্রমণ করিল। ইহার দাঁতগুলি ক্ষুদ্র ও বাঁকা কিন্তু উহার মাথা হইতে করাতের মত লম্বা একটা দাঁড়া আছে। সে তাহা দিয়া ঐ Stickle-back কে আক্রমণ করিল। উহা পূর্ব্ব প্রথামত উলটাইয়া গিয়া উহার দাঁড়া দিয়া কুম্ভীরের পেট যেমন বিদীর্ণ করিতে যাইবে, উহাও সেই সময় উহার করাতখানি তাহার গলার দিকে চালাইয়া দিল। ফলে Stickleback দ্বিখণ্ডিত হইয়া গেল। “করাত মৎস্য” উহাকে ভক্ষণ করিয়া চলিয়া গেল।

 এমন সময় সহসা “গেলাম, গেলাম” রব শ্রুত হইল।

 ব্যাপার দেখিবার জন্য আমরা ছুটিয়া গেলাম। দেখি একজন লস্‌কর্ পাটাতনের উপর ছট্‌ফট্ করিতেছে। অনুসন্ধানে জানা গোল যে কৌতূহল বশতঃ সে ডেকের এক হাচেট্ খোলে। সেই সময় চৌবাচ্চায় একটি মৎস্য প্রবেশ করে। হাচেট্ বন্ধ করিয়া সে সেই মৎস্য যেমন ধরে অমনি চিৎকার করিয়া পড়িয়া যায়।

 মৎস্যটি দেখিবামাত্র বন্ধুবর বলিয়া উঠিলেন:—

 “যাহা ভাবিয়াছিলাম, তাহাই ঘটিয়াছে। একটা electric silurus উহাকে আক্রমণ করিয়াছিল।”

 “কি রকম?”

 “এই মৎস্য আরব্যোপসাগরে সচরাচর দেখা যায় না। কেমন করিয়া একটা আসিয়া পড়িয়াছে। ইহা প্ৰায় নাইল্ নদীতে বাস করে। ইহার এক প্ৰধান গুণ এই যে, ইহা তড়িত আঘাত দিতে পারে। আঘাতের পর শরীরের ভিতর কেমন এক যন্ত্রণা উপস্থিত হয়। এমনও দেখা যায় যে কখনও দুই তিন চারিমাস পরেও ঐরূপ যন্ত্রণা অনুভূত হইতেছে। আরবীয়েরা ইহার যে নাম দিয়াছে তাহার মানে “Thunder”।”

 “এখন এ ব্যক্তির যন্ত্রণা-নিবায়ণের উপায় কি?”

 “বিশেষ কিছুই নাই; আপনি সারিবে।”

 এই বলিয়া বন্ধুবর অপর এক লস্‌কর্‌কে শুশ্ৰূষা সম্বন্ধে উপদেশ দিয়া পূর্ব্বোক্ত কাচের দরজার নিকট আসিলেন।

 সেখানে বসিয়া বন্ধুবর কত অদ্ভুত অদ্ভুত জীব আমাকে চিনাইয়া দিতে লাগিলেন। Pipe fish, Pilot fish, Tunny, Red Band, প্রভৃতি কত প্রকারের যে নূতন মৎস্য দেখিলাম তাহা বৰ্ণনা করা যায় না। সেদিনকার অপূর্ব্ব আনন্দ ইহজীবনে ভুলিব না।

 বন্ধুবর একটা Limpsucker দেখিয়া উহার বর্ণনা করিতেছেন, এমন সময় দেখি গোলাকার একটা কি ভাসিয়া যাইতেছে। উহার গাত্রোপরিস্থিত আঁইসগুলি সোজাভাবে অবস্থিত। উহা কি জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিলেন:—

 “উহার নাম Diodon বা Globe fish। উহা বায়ুভক্ষণ করিয়া বেলুনের মত আকার ধারণ করিতে পারে। ফলে, উহাকে কেহ আক্রমণ করিলে ঐ সোজা দাঁড়ার জন্য উহার কোনই অনিষ্ট হয় না।”

 “উহা কি সাঁতার দিতে পারে?”

 “অনেকের বিশ্বসে উহা পারে না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কুভিয়ার নামে যে এক বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন তাঁহারও ঐ মত ছিল। কিন্তু ডারউইন্ দেখাইয়া ছিলেন যে উহা কেবল সাঁতার দিতে পারে তাহা নহে, সোজা, উল্টা, যে ভাবে ইচ্ছা চলিতে পারে।”

 বন্ধুবরের বক্তব্য শেষ হইতে না হইতেই দেখি একটা শুভ্ৰবর্ণের হাঙ্গর উহার দিকে ধাবিত হইয়াছে। হঠাৎ উহা থমকিয়া দাঁড়াইল। পরে ঐ Globe উহাকে আক্রমণ করিল এবং উহাকে মুখে করিয়া অদৃশ্য হইল।

 বন্ধুবর বলিলেন:—

 “ঐ যে জীবটা দেখিলে উহা নাবিকদিগের এক বিশেষ ভয়ের কারণ। উহাকে ধরিবামাত্র তাহারা উহার ল্যাজ কাটিয়া দেয়। তাহাদের বিশ্বাস যে ঐ ল্যাজেই উহার সকল শক্তি নিহিত আছে। উহার সম্বন্ধে যদি বিস্তারিত বিবরণ জানিতে ইচ্ছা কর, তবে Captain Hall প্রণীত Fragments of Voyages and Travels, Second Series, প্রথমভাগ, ২৬৭ পৃষ্ঠা পাঠ করিও। এই কয়েক ঘন্টার মধ্যে কতশত নূতন জীব দেখিলাম। তাহাতে মনে কি ভাব উদয় হইয়াছে বল—অ্যাঁ, বিপদ জ্ঞাপক ঘণ্টা বাজে কেন?” এই বলিয়া তিনি ত্র্যস্তভাবে কাপ্তেনের নিকট গেলেন। একটু পরে আসিয়া বলিলেন:—

 “আমরা একটা সমুদ্রগর্ভস্থিত জাহাজের নিকটবর্ত্তী হইয়াছি, তাই ঐ ঘন্টা বাজিয়া উঠিয়াছিল। আমাদের বোটের গতি ফিরান হইয়াছে। এখন আর ভয়ের কারণ নাই।”

 আমি আগ্রহ সহকারে জিজ্ঞাসা করিলাম:—

 “নিমজ্জিত জাহাজ? উহা দেখাত’ ভাগ্যে ঘটে না। উহা দেখিবার কি সুবিধা হইবে না?”

 বন্ধুবর হাস্য করিয়া বলিলেন:—

 “খুব সুবিধা আছে। দেখিবে কি?”

 “হাঁ।”

 “তবে এস।”

 আমরা দুইজনে কাপ্তেন মহাশয়ের নিকট উপস্থিত হইলাম। আমার অভিপ্রায় জানিতে পারিয়া, তিনি ধীরে ধীরে বোট্‌খানিকে ভগ্ন জাহাজের নিকট লইয়া গেলেন। তাহার পর ডাইভিং পোষাক পরিয়া আমরা পাঁচ ছয় জন উহার ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম যে, উহা Eastern Star Line এর একখানা জাহাজ। তখন মনে পড়িল যে, প্রায় দশ বৎসর পূর্ব্বে উহা ধন লইয়া ইংলণ্ডাভিমুখে যাইতেছিল; কিন্তু অপর এক জাহাজের সহিত ধাক্কা লাগিয়া ডুবিয়া যায়। তাহাতে খুব অল্প প্ৰাণী নষ্ট হইয়াছিল।

 জাহাজখানি আমরা ভাল করিয়া দেখিলাম। প্রত্যেক কামরাস্থিত দ্রব্যাদি একেবারেই নষ্ট হইয়া গিয়াছে। দরওয়াজা জানালাদি এতই জীর্ণ হইয়াছে যে, হাত দিলেই খসিয়া পড়িতেছে। প্ৰত্যেক কামরা দেখিয়া অবশেষে ধনাগারে গেলাম। দেখি উহায় দারওয়াজা বেশ দৃঢ়ভাবে প্রস্তুত। বুঝিলাম, স্বাভাবিক অবস্থায় উহা খোলা একরূপ অসম্ভব; কিন্তু আমাদের দুই চারিটা পদাঘাতে উহা ভাঙ্গিয়া গেল। সম্মুখে এক অপূর্ব্ব দৃশ্য দেখিলাম। স্তরে স্তরে রৌপ্য ও সুবর্ণ bars সজ্জিত রহিয়াছে। অনুমান করিয়া দেখিলাম, উহার মূল্য কুড়ি হইতে ত্ৰিশ লক্ষ হইবে। উহা দেখিয়া কাপ্তেন মহাশয়ের কিঞ্চিৎ লোভ হইল। তিনি প্রস্তাব করিলেন যে, ঐ ধন আমরা তুলিয়া লইয়া আপনাদিগের মধ্যে ভাগ করিয়া লই।

 বন্ধুবর বলিলেন:—

 “আমি এ প্রস্তাবে সম্মত নহি। জানিয়া শুনিয়া ইহা লইলে যদি কোন প্রকারে কথাটা প্ৰকাশ পায়, তাহা হইলে আমাদিগকে ফৌজদারীতে পড়িতে হইবে। তবে এক কাজ করিতে পারি। ইহা তুলিয়া লইয়া গিয়া যাহাদের ধন তাহাদের পৌঁছাইয়া দিলে তাহারা Salvage বাবৎ শতকরা কুড়ি টাকা পর্য্যন্ত দিতে অস্বীকার করিবে না। আপনি তাহার শতকরা পাঁচ টাকা মত অংশ লইবেন। আর পাঁচ টাকা মত অংশ আমরা লইব।”

 ভগ্নস্বরে কাপ্তেন মহাশয় বলিলেন:—

 “আপনার কথা স্বীকার করি; কিন্তু এত ধন উত্তোলন করিতে সময় লাগিবে। আর আমাদিগের কার্য্যের বিলম্ব ঘটিবে। আপনি যাহা ভাল বুঝেন করুন।”

 “আমিও ঐ কথা বলিতে যাইতেছিলাম। কেননা, আমরা যে কার্য্যে প্ৰবৃত্ত হইয়াছি, তাহার ব্যাঘাত কোন মতেই করিতে পারি না। কাজেই এখন এই ধন উত্তোলন প্রস্তাব স্থগিত থাকুক। সময়ান্তে যাহা ভাল হয় করিব।”

 একটী নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কাপ্তেন মহাশয় বলিলেন:—

 “তাহাই হইবে। আমি ইহার যথার্থ bearing লইয়া রাখিব।”

 আর বিলম্ব না করিয়া আমরা স্বস্থানে প্রত্যাবর্ত্তন করিলাম।

 কাপ্তেন মহাশয় এক ঈঙ্গিত করিয়া সবমেরিন্ চালাইতে হুকুম দিলেন। কিন্তু অর্দ্ধঘণ্টা কাটিয়া গেল, তথাপি উহা চলিল না।

 তিনি একটু চিন্তিত হইয়া পড়িলেন ও সত্বর এই কথা আমাদিগকে জানাইলেন। বন্ধুবর সকল যন্ত্রাদি পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন। কোথাও কোন ত্রুটী দেখা গেল না। ব্যাপার কিছু গুরুতর বোধ হইল।

 আমি উদ্বিগ্নচিত্তে বলিয়া উঠিলাম:—

 “এখানেও নিশ্চয়ই শত্রুর চর চুকিয়াছে। সে কোনরূপ অনিষ্টের চেষ্টা করিতেছে। বোধ হয় আমাদিগকে এই সমুদ্রগর্ভে প্রোথিত করিয়া রাখা তাহার মনোগত ইচ্ছা।”

 বন্ধুবর বলিলেন—

 “তাহা হইতে পারে।” পরে কাপ্তেন মহাশয়কে সম্বোধন করিয়া বলিলেন:—“চলুন, একবার আশ্ পাশ্ ভাল করিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখা যাউক।”

 অতি সত্বরই উভয়ে ডাইভিং পোষাক পরিধান করিলেন। আমিও তাঁহাদের অনুগমন করিলাম। তড়িতালোকে বহুদূর উদ্ভাসিত হইতেছিল। আমরা চারি পার্শ্ব ভাল করিয়া দেখিলাম।

 সহসা বন্ধুবর এক বিকট হাস্য করিয়া বলিলেন:—

 “যাহা ভাবিয়ছিলাম তাহাই ঘটিয়াছে। কাপ্তেন মহাশয়, একবার বোটের তলভাগ দেখুন।”

 কাপ্তেন মহাশয় চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন:—

 “বাঃ! এ যে কতকগুলি মৎস্য দেখিতেছি। উহারাই কি আমাদিগের গতিরোধ করিয়াছে। উহারাই কি আমাদিগের শত্রুর চর?”

 বন্ধুবর হাস্য করিয়া বলিলেন:—

 “চর হউক না হউক, উহারাই আমাদিগের গতিরোধ করিতেছে। উহাদিগের নাম Remora। উহাদিগের মস্তকের উপর এক Sucking disc দেখিতেছেন ত? উহার এত শক্তি যে উহা জাহাজের গতিরোধ করিতে সক্ষম। দেখিতেছি সংখ্যায় প্রায় ত্রিশটা। হউক।”

 আমি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলাম:—

 “আঃ, বাঁচা গেল। আমার মনে নানা সন্দেহ উপস্থিত হইয়াছিল। এখন উপায় কি?”

 “স্বস্থানে গিয়া বলিব। চল।”

 কালবিলম্ব না করিয়া আমরা আমাদিগের কামরায় প্ৰবেশ করিলাম। ডাইভারের পোষাক ত্যাগ করিয়াই, বন্ধুবর একটা বোতাম সজোরে টিপিলেন। দুই তিন মিনিট পরে জাহাজ চলিতে আরম্ভ হইল।

 আমার প্রশ্নোত্তরে তিনি বলিলেন:—

 “Remora দিগকে একেবারে নষ্ট করিয়া ফেলিয়াছি। দেখিবে এস।”

 এই বলিয়া তিনি পূর্ব্বকথিত কাচের আর্শীর নিকট লইয়া গেলেন। দেখিলাম বাস্তবিকই Remora গুলি মরিয়া ভাসিতে ভাসিতে চলিয়া যাইতেছে।

 আমরা আর বিলম্ব না করিয়া উপরে উঠিতে লাগিলাম। একেবারে উপরে উঠবার পর দেখিলাম যে চারিদিকে ঘোর অন্ধকার। ঘড়ি খুলিয়া দেখি প্রায় ১০ টা বাজিয়াছে। “সোনার ভারত” অদূরে নোঙ্গর করিয়াছিল। সকলে তাহাতে আরোহণ করিয়া স্ব স্ব শয্যা গ্ৰহণ করিলাম। বড়ই পরিশ্রান্ত ছিলাম। নিদ্রাদেবীও সত্বর আমাদিগকে তাঁহার ক্রোড়ে আশ্রয় দিলেন।

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ।

 পরদিবস প্ৰত্যূষেই “সোনার ভারত” আমাদিগের গন্তব্য স্থলাভিমুখে যাত্ৰা করিল। ঠিক তিন দিবস পরে আমাদিগের “স্বস্থানে” উপস্থিত হইলাম। তীর হইতে কিছু দুরে জাহাজ নঙ্গর্ করা হইল। আমরা জালিবােটে করিয়া ডাঙ্গায় উঠলাম। তথা হইডে এক পোয়া পথ দূরে এক মনোরম স্থান নির্ণয় করিয়া সেখানে কয়েকটী অস্থায়ী আবাস প্ৰস্তুত করিলাম। এই কার্য্যে প্ৰায় পনর দিবস কাটিয়া গেল। দিবাভাগে সেখানে আমরা থাকিতাম, রাত্ৰিতে জাহাজে আসিয়া শয়ন করিতাম।

 আফিসাদি প্ৰস্তুত হইয়া যাইবার দুই এক দিবস পরে আমরা কার্য্য আরম্ভ করিয়া দিলাম। আমরা বেলা ৯টা হইতে ৫টা পর্য্যন্ত, অর্থাৎ ৮ঘণ্টা করিয়া, অনবরত কার্য্য করিতে লাগিলাম। বন্ধুবর ও আমি সকল কার্য্য তত্ত্বাবধারণ করিতাম। প্রত্যহ যতটা সুবৰ্ণ উৎপন্ন হইত, তাহা কার্য্যাবসানের পর ওজন করিয়া Strong roomএ রাখিয়া দিতাম। সপ্তাহান্তে, প্ৰত্যেক শনিবারে, আমাদিগের কার্য্যের একটা হিসাব কলিকাতার আফিসে তারযোগে পাঠাইতে লাগিলাম। এই ভাবে এক মাস কার্য্য করিয়া দেখিলাম যে, যে পরিমাণ সুবৰ্ণ পাওয়া গিয়াছিল, তাহা বন্ধুবরের estimateএর অপেক্ষা অনেক অধিক। বলা বাহুল্য, এই সংবাদ শ্রবণ করিয়া সকলেরই উৎসাহ বৃদ্ধি পাইল এবং যাহার মনে কার্য্যসাফল্য বিষয়ে কণামাত্ৰ সন্দেহ ছিল, তাহা দূর হইয়া গেল।

 ছয় মাস কার্য্য করিবার পর বন্ধুবর কলিকাতার Director গণের নিকট এই মর্ম্মে তার করিলেন যে, তাঁহারা যদি একখানি জাহাজ ভাড়া করিয়া পাঠান, তাহা হইলে তিনি যতটা সুবৰ্ণ পাইয়াছেন তাহা তাঁহদিগের নিকট পাঠাইয়া দিবেন। কার্য্যকালের অবসান পর্য্যন্ত তিনি অপেক্ষা করিতে ইচ্ছা করেন না। তাঁহারা কালবিলম্ব না করিয়া আপনারাই এক জাহাজ ভাড়া করিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহাদিগের সহিত কয়েকজন অংশীদার ও আসিলেন। তাঁহারা আমাদিগের কার্য্যপ্ৰণালী ও ফল দেখিয়া বড়ই তুষ্ট হইয়া বন্ধুবরকে শত শত ধন্যবাদ দিলেন। পরে একদিন প্রাপ্ত সুবৰ্ণ লইয়া কলিকাতাভিমুখে যাত্রা করিলেন। আমরাও অনেকটা নিশ্চিন্ত হইলাম।

চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ।

 বন্ধুবরকে প্রত্যহ সুবৰ্ণ প্ৰস্তুত করিতে দেখি। যে যে যন্ত্রের সাহায্যে উহা উৎপন্ন হয় তাহাও দেখি; কিন্তু শেষে কি এক দ্রব্যের সাহায্যে তিনি উহা প্ৰস্তুত করেন তাহা বুঝিতে অনেক চেষ্টা করিয়াও পারি না। কয়েকবার তাঁহাকে প্রশ্নও করিয়াছিলাম; কিন্তু তিনি ‘হতগজ’ ভাবে উত্তর দিয়াছিলেন। একদিন বিশেষ করিয়া চাপিয়া ধরিলাম। তখন তিনি বলিলেন:—

 “তুমি প্রায়ই আমাকে এই প্রশ্ন করিয়া থাক। তুমি শিক্ষিত লোক। এ কথা তুমি বুঝ, যদি কেহ কোন কথা প্ৰকাশ করিতে ইচ্ছা না করে, তাহাকে তজ্জন্য পীড়াপীড়ি করা উচিত নয়। তুমি মনে করিও না অামি বিরক্ত হইয়া এ কথা বলিতেছি। তুমি মনে করিতে পার যে, যে দ্রব্যটীর সাহায্যে সুবর্ণ উৎপাদন হয়, তাহা রাসায়নিক বিশ্লেষণ দ্বারা বাহির করিতে পারিবে। নাম করিয়া বলিব না, কেহ কেহ তাহার চেষ্টাও করিয়াছিল। কিন্তু কেহই কৃতকার্য্য হয় নাই, হইবেও না। তুমি জান আমার আবিষ্কার দীর্ঘ গবেষণার ফল। ইহাই অত্যন্ত আধুনিক সুবৰ্ণ উৎপাদনের উপায়। একটু বদলাইয়া লইয়া উহার দ্বারা তুমি অনায়াসেই স্বল্প ব্যয়ে ভূমি হইতে সুবর্ণ উত্তোলন করিতে পরিবে। বহুপূর্ব্বে যখন রীতিমত ভাবে সুবৰ্ণ উত্তোলন কার্য্য আরম্ভ হয় নাই, তখন কি করিয়া উহা সংগ্ৰহ করা হুইত জান?”

 “না।”

 “তখন লোকে ore চূৰ্ণ করিত। পরে তাহার উপর পারা ঢালিয়া দিত। ঐ পারা সুবর্ণের সহিত এক্‌সা হইয়া যাইত, baser metals পড়িয়া থাকিত। ফলে তখন এ কার্য্য কঠিন ছিল না, খরচও কম পড়িত। কিন্তু ক্ৰমে ক্ৰমে উপরিস্থ স্তর শেষ হইয়া গেলে, নীচে কার্য্য করিতে মূল্যবান্ যন্ত্রাদির প্রয়োজন হইতে লাগিল। সেখানে সুবর্ণ refractory অবস্থায় থাকায় উহা পৃথক্ করা সহজ ছিল না। তখন stamping ও grinding যন্ত্রাদির প্রয়োজন হইল। ক্ৰমে দেখা গোল যে, মিশ্ৰণ-প্ৰণালীর দ্বারা খানিকটা সুবৰ্ণ পাওয়া যাইতে লাগিল, অবশিষ্ট নিকটস্থ নদীগর্ভে বা গুহায় চলিয়া যাইতে লাগিল। তখন এই ক্ষতি দূর করিবার জন্য নানা জটিল উপায় অবলম্বন করা হইল; কিন্তু ক্ষতি বন্ধ হইল না। ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দে dilute cyanide of potassium এর ব্যবহার প্রস্তাবিত হয়। ইহাতে ঘোরতর আপত্তি হয়, কেন না এই দ্রব্যটী এক দিকে যেমন মূল্যবান্, তেমনি বিষাক্ত। কিন্তু এই দ্রব্যের ব্যবহায় ক্ৰমে পৃথিবীর সর্ব্বত্র চলিত হইয়া গেল। তাহার প্রমাণ দেই। ১৮৯০ খৃষ্টাব্দে পৃথিবীতে যত সুবৰ্ণ খনি ছিল, তাহাতে ৫০ টন্ এর অধিক cyanide of potassium ব্যবহৃত হয় নাই; কিন্তু ১৯০৬ খৃষ্টাব্দে ২০০০০ টনের অধিক ব্যবহার হইয়াছিল। ঐ দ্রব্যের অর্দ্ধ সেরের মূল্য প্রথম প্রথম ১৷৷৹ টাকা ছিল, কিন্তু পরে ৷৷৹ আনা পর্যন্ত নামিয়াছিল। এই cyanide process দ্বারা এখনও সুবর্ণ উৎপাদন হয়। অবশ্য এখন ইহার অনেক উন্নতি হইয়াছে স্বীকার করি। এখন তুমি সহজেই অনুমান করিতে পরিবে যে, এই process এর সহিত আমার process এর আকাশ পাতাল প্রভেদ আছে। আমার process cyanide process নয় তাহার প্যমাণ দেই।” এই বলিয়া তিনি একখানি Text Book of Chemistry খুলিয়া cyanide of potassium জিনিষটা কি তাহা বুঝাইয়া দিলেন।

 অামি বলিলাম:

 “তুমি তোমার processটা পেটেণ্ট্ কর না কেন?”

 “করিয়া লাভ কি? কোন দেশে কুড়ি, কোথায় পনর, কোথায় বা পঁচিশ বৎসর মাত্ৰ একচেটিয়া অধিকার পাইব। পরে উহা সাধারণ সম্পত্তি হইয়া যাইবে। অবশ্য সেলামী বাবত কিছু পাওয়া যাইবে; কিন্তু কয়েক বৎসরের জন্য মাত্র। অথচ আমি যদি উহা প্ৰকাশ না করি, তাহা হইলে জীবিত কাল পর্য্যন্ত ত উহার দ্বারা বহু ধন লাভ করিতে পারিব। আমার মৃত্যুর পর আমার সন্তানসন্ততিগণও উহার দ্বারায় বেশ পয়সা উপার্জ্জন করিতে পারিবে। তাহাদিগকে কখনও দৈন্য দশায় পড়িতে হইবে না। তুমি বলিতে পার, যদি উহা কোন গতিকে প্রকাশ হইয়া পড়ে তবে কি হইবে? আমি বলি প্ৰকাশ কি করিয়া হইবে? কারণ গুপ্ততত্ত্ব আমার মাথার ভিতর আছে। উহার সবিশেষ বিবরণ লিখিয়া এমত এক স্থানে রাখিয়া দিয়াছি যে, দ্বিতীয় ব্যক্তি তাহা জানে না। কেবল দুইটী উপায় মাত্র দ্বারা আমার নিকট হইতে উহা জানিবার চেষ্টা হইতে পারে। এক Hypnotise করিয়া; কিন্তু তাহার সম্ভব নাই, কেন না আমি Hypnotism বিশেষরূপে শিক্ষা করিয়াছি, এবং কি প্রকারে আপনাকে সাবধানে রাখিতে হয় তাহাও সম্যক্ জ্ঞাত আছি। অন্য উপায়, ভয় প্রদর্শন করিয়া জানিয়া লওয়া। তাহাও অসম্ভব। কেন না আমি পরিচিত স্থল ব্যতীত অন্য কোথাও এক্‌লা যাই না। অপর, বাটীতে আক্রমণ করা সম্ভবপর নহে। কেন না Satineb যন্ত্রের দ্বারা শত্রু আপনি ধরা পড়িয়া যাইবে। অতএব আমি পেটেণ্ট লইবার আবশ্যকতা দেখি না।”

 সে দিন হইতে আমি বন্ধুবরকে তাঁহার সুবৰ্ণ প্ৰস্তুত করিবার প্ৰণালী বলিতে আর অনুরোধ করি নাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *