১৫১৩ সাল – ১

প্ৰথম পরিচ্ছেদ।

সে অনেক দিনের কথা।

একদিন সন্ধ্যার সময় চেয়ারে বসিয়া আছি, তখন আমার গৃহের টেলি-ফটোগ্রাফের (Tele-photograph-এর) ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল। চাহিয়া দেখি উহার পর্দ্দার উপর আমার এক অতি প্রিয় বন্ধু শ্রীগুরুপ্ৰসাদ ঘোষালের মূর্ত্তির আবির্ভাব হইয়াছে।

 কুতূহল হইয়া যন্ত্রের নিকট গেলাম। বন্ধু জিজ্ঞাসা করিলেন:—

 “রজনী আছ?”

 “হাঁ। ব্যাপার কি?”

 “একবার আমার এখানে আসিলে ভাল হয়। বিশেষ প্রয়োজন আছে।”

 “যাইতেছি”, বলিয়া receiver তুলিয়া রাখিলাম।

 কিয়ৎক্ষণ পূর্ব্বে এক পশলা বৃষ্টি হইয়াছিল। এজন্য আমার রেডিওকারে (radio-carএ) না গিয়া, এ’রো (aero carএ) কারে গেলাম। দেখি অনেকে উপস্থিত। অনেকেই আমার পরিচিত। সম্ভাষণাদির পর বন্ধু অনেকের সহিত আমার পরিচয় করাইয়া দিলেন। নানা কথাবার্ত্তার পর বন্ধু আমাদের সকলকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন:—

 “আপনাদের কষ্ট দিয়া আনিয়াছি। তজ্জন্য আমার অপরাধ মার্জ্জনা করিবেন। আমি আপনাদের নিকট একটা গুরুতর প্রস্তাব উপস্থাপিত করিব। আশা করি আপনারা স্থিরচিত্তে শুনিয়া আপনাদের মতামত সুবিধা মত দিবেন। আমাদিগের বৃদ্ধ, অতি বৃদ্ধ, পিতামহদিগের একটা অখ্যাতি ছিল যে তাঁহারা বাক্‌সর্ব্বস্ব মাত্র ছিলেন। তাঁহাদের সন্তানেরা সেই অখ্যাতি মিথ্যা প্রমাণ করিয়াছেন। দেখুন, আজ বাঙ্গালী এক উৎসাহশীল জাতি বলিয়া পৃথিবীতে খ্যাতিলাভ করিয়াছে। সে আজ প্ৰায় ২০০শত বৎসরের কথা । ইহার মধ্যে কি কাণ্ড হইয়াছে, হরিনাথ বাবুর ডাইরেক্টরী খুলিয়া দেখিলেই বুঝিতে পরিবেন। দেখুন, এক বাঙ্গালীদিগের দ্বারায় প্রায় ৪০০ কাপড়ের কাল স্থাপিত হইয়াছে। ইহা ব্যতীত রঙ্, দিয়াশলাই, সাবান, প্রভৃতির বিবিধ কল কারখানা স্থাপিত হইয়াছে। দেশের অর্থ দেশে থাকিতেছে। ফলে, পূর্ব্বাপেক্ষায় গড়পড়তায় প্ৰায় ২০ গুণ ধন বৃদ্ধি হইয়াছে। আপনারা জানেন যে আমি অনুকরণপ্রিয় নই। আমি একটা সম্পূর্ণ নূতন অর্থাগমের পন্থা বাহির করিয়াছি। কিন্তু এ কাজ একেলা হইবে না। আমি যৌথ কারবারে কাজ করিতে ইচ্ছা করি। ইহাতে লাভ এত বেশী, যে আপনারা বোধ হয় আমার প্রস্তাবটা গাঁজাখুরী বলিয়া উড়াইয়া দিবেন। যদি একটু চিন্তা করেন তবে দেখিবেন যে কথাটা ফেলার নয়। যদি আপনারা ঘণ্টা খানেক সময় দিতে পারেন, তবে আমি উহা বিশেষরূপে বুঝাইয়া দিব। না হয়, আর একদিন সকলে মিলিয়া উহা আলোচনা করিব। আপনাদের মত কি?”

 আমরা বলিয়া উঠিলাম:—“বেশ, বলুন না? এক ঘণ্টা কেন, দুই তিন ঘণ্টা পর্য্যন্ত দিতে পারিব। আমাদের এখন বিশেষ প্রয়োজন কিছুই নাই।”

 বন্ধু বলিলেন:—

 “আমি বড়ই বাধিত হইলাম! যে প্ৰস্তাব অদ্য উপস্থিত করিতে ইচ্ছা করিয়াছি, উহা বহু চিন্তা ও গবেষণার ফল। বহুদিন পূর্ব্বে একজন বাঙ্গালী কবি গাহিয়াছিলেন, “একটা নূতন কিছু কর।” আমি যে প্রস্তাব করিতেছি তাহা সম্পূর্ণ নূতন ও অভিনব। কথাটা এই। আপনারা সকলেই বোধ হয় জানেন যে সমুদ্রের জল হইতে সুবর্ণ পাওয়া যাইতে পারে। ভূমিতে যে সুবৰ্ণ আছে তাহা উত্তোলন করিতে অনেক ঝঞ্ঝাট পাইতে হয়। কিন্তু আমার প্রস্তাব নির্ঝঞ্ঝাট বলিলেই হয়—”

 একজন জিজ্ঞাসা করিলেন:—“কিরূপ?”

 “দেখুন, খনির উৎপাদিকাশক্তির সীমা আছে। সুবৰ্ণ বা অন্য ধাতু তুলিতে খরচ অনেক পড়ে, যেমন ম্যানেজার, কুলী, মজুর, প্রভৃতির মাহিয়ানা, যন্ত্রাদির ক্ষয়, ইত্যাদি। তাহার উপর কঠোর আইনের গণ্ডীর ভিতর কাজ করিতে হয়। অজ্ঞাতসারে কোন আইনভঙ্গ করিলে এবং তাহা ধরা পড়িলে, খনি-পরিদর্শক-মহাশয়ের কৃপায় আদালতে যাওয়া আসা করিতে হয়। তাহার উপর সরকার বাহাদুর, জমির মালিক প্রভৃতিকে অনেক সেলামী দিতে হয়। সকল খরচ খরচা বাদে যাহা থাকে, তাহা হইতে রেস্তে কিছু রাখিয়া বাকী টাকায় শতকরা ১০ হইতে ২০ টাকা মাত্র লাভ পোষায়। এমনও প্রায় ঘটিয়া থাকে যে একটা খনি হইতে প্ৰথম প্ৰথম বেশ আয় হইতেছে, কিন্তু হঠাৎ দেখা যায় যে lodeটা শেষ হইয়া গিয়াছে। তখন অংশীদারদিগকে হাহাকার করিতে হয়। ফাঁকতালে কোম্পানী-স্থাপয়িতারা কিছু মারিয়া ল’ন। এই সকল কারণে আমি ভূমিস্থ সুবর্ণ-খনির ব্যবসায়ের পক্ষপাতী নই।”

 আমি জিজ্ঞাসা করিলাম:—“আপনার প্রস্তাবের সুবিধা কি?”

 উত্তরে বন্ধু বলিলেন:—

 “এখন তাহা দেখাইব। আমি বলিয়াছি যে সমুদ্রে বৃহৎ যন্ত্রাদির প্রয়োজন নাই। Inspector of Mines এর উৎপাত নাই, কেননা খনি যেখানে নাই, সেখানে পরিদর্শক কি করিতে যাইবে—”

 “কিরূপ?”

 “আপনারা বোধ হয় জানেন যে স্বাধীন রাজার রাজ্যের সীমা হইতে তিন মাইল পরে neutral zone আরম্ভ হয়। আমরা ১০ মাইলের পর কার্য্য আরম্ভ করিব। সেখানে আমরা Monarch of all I survey হইয়া থাকিব।”

 “একেবারে Selkirk হইবেন?” আমি বলিয়া উঠিলাম।

 একটা হাস্যের রোল উঠিল।

 বন্ধুবর বলিতে লাগিলেন:—

 “আরও দেখুন। সমুদ্রে mine-gas এ মরিবার ভয় নাই। চোর, ডাকাত, ধর্ম্মঘট ইত্যাদি হইতে রেহাই পাইব। সংক্ষেপে সকল কথা বলিলাম। এখন আপনাদের মতামত শুনিতে পাইলে সুখী হইব।”

 আমি প্রশ্ন করিলাম:—

 “আপনার প্রস্তাব অভিনব। চিন্তা না করিয়া এ বিষয়ে মতামত দেওয়া যায় না। তবে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। আর কেহ কি পূর্ব্বে সমুদ্রের জল হইতে সুবৰ্ণ উৎপাদন করিতে চেষ্টা করে নাই?”

 “করিবে না কেন? ১৯০৪ খৃষ্টাব্দে ইংলণ্ডের কোন একজন বিখ্যাত বৈজ্ঞানিকের তত্ত্বাবধানে সুবৰ্ণ উৎপাদন করিবার জন্য এক কোম্পানী স্থাপিত হয়। তাহার কিছুদিন পূর্ব্বে Gulf of Mexico হইতে সুবর্ণ উৎপাদন করিতেছে বলিয়া একজন পাদরী বিজ্ঞাপন দেয়। সেই বিজ্ঞাপনের চটকে ভুলিয়া অনেকে তাহার কারবারের অংশ কেনে। পরে একদিন সে গা’ ঢাকা দেয়। তখন তাহার জুয়াচুরী বাহির হইয়া পড়ে। সন্ধানে জানা যায় ষে খানিকটা সোনা সংগ্ৰহ করিয়া তাহা চূৰ্ণ করিয়া সমুদ্র হইতে উৎপাদন করিতে পারিয়াছে বলিয়া সে প্ৰকাশ করিয়াছে। এই কয়েক বৎসর অনেকে চেষ্টা করিয়াছেন, কিন্তু কিরূপ কৃতকার্য্য হইয়াছেন তাহা জানার উপায় নাই। কেননা তাঁহারা যে কোম্পানী করিয়াছেন তাহা public নহে, private, তাঁহাদের balance sheets বাহিরে প্রকাশ হয় নাই।”

 যোগেন্দ্ৰ বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন:—

 “বুঝিলাম। এখন আপনি যে প্রস্তাব করিতেছেন তাহা গবেষণার ফল, না অন্য কিছু।”

 বন্ধুবর ব্যথিতভাবে উত্তর দিলেন:—

 “আপনি এমন বলিবেন, তাহা আশা করি নাই। আপনারা সকলেই জানেন যে আমার জীবন বিজ্ঞান-চর্চ্চায় অতিবাহিত হইয়াছে। অামি যে তারহীন বার্ত্তাপ্রেরণের (wireless telegraphy র) উন্নতি করিয়াছি, তাহা ইউরোপে সকলেই স্বীকার করিয়াছেন। আমার Rotophone, Adometer, প্রভৃতি যন্ত্রের কথা আপনারা সকলেই জানেন। এজন্য উহাদের বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া নিষ্প্রয়োজন। নিজের গুণ নিজমুখে গাহিলাম। এজন্য যে দোষ করিয়াছি তাহা মাফ করিবেন। আমি কোন কার্য্য দৃঢ়নিশ্চয় না হইয়া বলি না, বা করি না। আপনার যদি দেখিতে ইচ্ছা করেন, এখনই আপনাদের সম্মুখে সমুদ্রের জল হইতে সুবৰ্ণ উৎপাদন করিয়া দেখাইতে পারি।”

 অমনি আমি বলিয়া উঠিলাম:—“তাহা হইলে অনেকের চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভাঙ্গিয়া যায়।”

 বন্ধুবর আমাদিগকে তাঁহার বিজ্ঞানাগারে লইয়া গেলেন। তাহার পার্শ্বে একটী বৃহৎ ঘর। সেই ঘরে একটা বৃহৎ মারবেলের চৌবাচ্চা রহিয়াছে। তাহার সহিত একটী porcelain পাত্রের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নলের দ্বারা যোগ আছে।

 বন্ধুবর বলিলেন:—

 “দেখুন, এই চৌবাচ্চার জল বঙ্গোপসাগর হইতে আজ সাত দিন হইল আনীত হইয়াছে। এই চৌবাচ্চার সহিত কয়েকটী নল সংযুক্ত দেখিতেছেন। এই পথে জল pump করিয়া আমার বিজ্ঞানাগারে লইয়া যাই। এখন কি উপায়ে সুবর্ণ উৎপাদন করি সকলে দেখুন।”

 এই বলিয়া তিনি দেওয়ালের গাত্রস্থিত একটী রবারের বোতামের উপর দুইটা আঘাত করিলেন। তৎক্ষণাৎ একটা শব্দ হইয়া বিজ্ঞানাগারের dynamo চলিতে আরম্ভ করিল। শীঘ্রই জল পম্প হইয়া পূর্ব্বোক্ত porcelain পাত্রের ভিতর দিয়া আর একটা মারবেলের চৌবাচ্চায় পড়িতে লাগিল। দুই এক মিনিট পরে সেই জল টগ্ বগ্ করিয়া ফুটিতে লাগিল। কিয়ৎক্ষণ পরে সেই জল বাষ্পাকারে উড়িয়া গেল। অবশিষ্ট গুঁড়ার মত কি পড়িয়া থাকিল। তাহাই সযত্নে চামচে উঠাইয়া লইয়া বন্ধুবর একটা test tube এ রাখিয়া দিলেন; পরে তাহার সহিত কি একটা গুঁড়া মিশাইয়া একটা spirit lampএর উপর কিয়ৎক্ষণ জ্বাল দিলেন। তাহার পর tube এর উপরের খানিকটা গুঁড়া ফেলিয়া দিয়া tubeটা আমায় দিয়া বলিলেন:—

 “এই যে হরিদ্রাবর্ণের দ্রব্যটী পড়িয়া আছে, উহাই সুবর্ণ। বিশ্বাস না হয় কোন জহুরীর নিকট যাচাই করিয়া আনুন।”

 সকলেই আমার দিকে ঝুঁকিয়া পড়িলেন। একে একে সকলে ঐ দ্রব্যটী দেখিলেন এবং উহা যে সোণা তাহা কাহারও বুঝিতে বাকী রহিল না। আমরা তাঁহাকে ধন্যবাদ দিলাম।

 বন্ধুবর আমাদিগকে নমস্কার করিয়া বলিলেন:—

 “আজি প্ৰায় দশ বৎসর হইতে আমি পরীক্ষা করিয়া আসিতেছি। এ পরীক্ষার কথা কাহাকেও জানাই নাই, কেন না যদি কৃতকার্য্য না হই, তাহা হইলে আমায় হাস্যাস্পদ হইতে হইবে। অনেক চিন্তা ও অর্থ ব্যয় করিয়া আমি সফলতা লাভ করিয়াছি। তাহার প্রমাণ দিলাম। এখন আপনাদের কার্য্য করুন।”

 “Processটা কি জানিতে পারি?” আমি জিজ্ঞাসা করিলাম।

 “মাফ করিবেন। উহা এখন অপ্ৰকাশ থাকিবে।”

 নগেন্দ্র বাবু প্রশ্ন করিলেন:—“এখন আপনার প্রস্তাব কি?”

 “আমার প্রস্তাব এই যে একটা যৌথ কারবার করিয়া সুবৰ্ণ প্ৰস্তুত করিব। আমার এমন সামর্থ্য নাই যে একাই এই কার্য্যে প্ৰবৃত্ত হই। একটা private কোম্পানী করিতে ইচ্ছা করি, কেননা যতটা মূলধনের আবশ্যক, তাহা আপনারা কয়েক জনেই ইচ্ছা করিলে দিতে পারেন। সুতরাং লাভটা আপনাআপনির মধ্যেই পাকিবে।”

 আমি বলিলাম:—

 “আপনার প্রস্তাব সুন্দর। অামি সাধ্যমত সাহায্য করিতে ত্রুটী করিব না। আপনি ইতিমধ্যে একটা আয়-ব্যয়ের হিসাব প্ৰস্তুত করুন। আর একদিন আমরা সকলে মিলিয়া সিদ্ধান্ত স্থির করিব।”

 বন্ধুবর হাসিয়া বলিলেন:—

 “হিসাব প্ৰস্তুত আছে। এই লউন ৷” এই বলিয়া একটা দেরাজ হইতে কয়েকখানা ছাপান কাগজ লইয়া আমার হস্তে দিলেন ও বলিলেন:—“প্ৰথম পৃষ্ঠায় কোম্পানীর উদ্দেশ্য বর্ণিত আছে। ইহার নাম Sea Gold Syndicate Ltd. রাখিয়াছি। মূলধন ২৫ লক্ষ যথেষ্ট। তৃতীয় পৃষ্ঠায় ব্যয়ের হিসাব দেখুন। একটা তড়িৎ চালিত জাহাজ চাই। টারবাইনের (turbineএর) আমি পক্ষপাতী নহি। বোম্বায়ের হাসানজী কোম্পানী বলিয়াছেন যে আমার আবশ্যক অনুযায়ী একটী জাহাজ প্ৰস্তুত করিতে প্ৰায় ১৫ লক্ষ টাকা খরচ পড়িবে। ইহাই বৃহৎ খরচ। যন্ত্রাদি খাতে ৫ লক্ষ যথেষ্ট। বাকী ৫ লক্ষ চলতি খরচ বাবত হস্তে মজুত থাকিবে। বৎসরে নয় মাস কার্য্য চলিবে। আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, এই তিন মাস কার্য্য বন্ধ থাকিবে। বুঝিতে পারিতেছেন কেন? আমরা মাসে ২৬ দিনে ৯ ঘণ্টা করিয়া কার্য্য করিবে। দৈনিক যতটা সুবৰ্ণ পাওয়া যাইবে তাহা দ্বারায় বৎসরের খরচ খরচা বাদে শতকরা ৫০ হইতে ২০০ টাকা লাভ থাকিবে নিশ্চিত। ৫ বৎসরের মধ্যে মূলধন উঠিয়া যাইবে আশা করা যায়। এ ব্যবসায়ে লোকসান হইবে না নিশ্চিত। রাতারাতি বড় মানুষ হওয়ার এই এক উত্তম সুযোগ। আপনারা চিন্তা করিয়া দেখুন। সুবিধামত যত শীঘ্ৰ পারেন, আপনাদের মনোগত ভাব জানাইয়া বাধিত করিবেন।”

 চারুবাবু বলিলেন:—

 “দেখুন, আপনার উপর আমাদের কোনই অবিশ্বাস নাই। আপনার প্রস্তাবের সহিত আমাদের সকলের সহানুভূতি আছে। এখন প্ৰত্যেক অংশের মূল্য কত করিয়া ধরিয়াছেন?”

 “তাহা আপনাদের উপর নির্ভর করিতেছে। আমি প্ৰস্তাব করি আপনারা প্রত্যেকে কত টাকা ফেলিতে প্রস্তুত আছেন তাহাও এক এক খণ্ড কাগজে লিখিয়া আমায় দিন। তাহা হইলে আমি প্রত্যেক অংশের মূল্য নির্দ্ধারণ করিতে সক্ষম হইব। আমি এক লক্ষ টাকা দিতে প্ৰস্তুত আছি।”

 সকলে শ্লিপ দিলে পর বন্ধুবর টাকার সমষ্টি করিয়া আনন্দ সহকারে বলিলেন:—

 “আমি ২৫ লক্ষ চাহিয়া ছিলাম। আপনারা ৩০ লক্ষ দিয়াছেন। তবে আর ভাবনা কি? কোম্পানী private রাখিলেই চলিবে। আমার ইচ্ছা এই মাসের মধ্যেই কোম্পানী রেজেষ্ট্রী করিয়া জাহাজের অর্ডার লই। শীতকাল সম্মুখে উপস্থিত। আমাদের কার্য্যারম্ভের জন্য ইহাই প্রশস্তকাল। আপনারা আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানিবেন। এখন মধুরেণ সমাপয়েৎ। অনুমতি হইলেই হয়।”

 “না, আজ থাক,” আমরা বলিয়া উঠিলাম।

বন্ধুবর বলিলেন—“তই কি হয়,” এবং সঙ্গে সঙ্গে দেওয়ালে স্থিত একটী রবারের বোতাম টিপিলেন। আমনি মধুর বাদ্য বাজিয়া উঠিল ও কয়েকটী বালক ছোট ছোট aluminium পাত্রে সভ্য সমাজে প্রচলিত বিবিধ খাদ্যের tabloids ও এক এক গ্লাস জল দিয়া গেল। ভোজনাদির পর বন্ধুর নিকট বিদায় লইয়া আমরা স্ব স্ব গৃহে প্ৰত্যাবর্ত্তন করিলাম।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

 একটা প্ৰবাদ আছে যে কোন কার্য্য “তৃতীয় কর্ণ” হইলে তাহা আর গুপ্ত থাকে না। আমাদের সকলের ইচ্ছা ছিল যে বন্ধুবরের প্রস্তাবটী সাধারণের নিকট গুপ্ত থাকে৷ প্ৰাতে pneumatic postএ যখন ডাক আসিল, তখন অন্য দিনের অপেক্ষা পত্রাদির সংখ্যা অধিক দেখিয়া কিঞ্চিৎ আশ্চর্য্য হইলাম। প্রথম পত্ৰখানি দেখি আমার জ্যেষ্ঠ সহোদর এলাহাবাদ হইতে লিখিয়াছেন। তাহার এক অংশ উদ্ধৃত করিতেছি:—“…………… পরে একটা কথা শুনিয়া আশ্চর্য্য বোধ করিলাম। শুনিলাম তুমি কোন একটা জুয়াচোরের পাল্লায় পড়িয়াছ এবং সম্ভবতঃ সর্ব্বস্বাস্ত হইবে। দেখ, এখন দিন কাল বড়ই ভয়ানক পড়িয়াছে। তোমার কয়েকটী নাবালক শিশুসন্তান আছে। তুমি তাহদের কি ভাসাইয়া দিতে মনস্থ করিয়াছ? ব্যাপারখানা কি খোলসা করিয়া লিখিবে। সংবাদটা আমি এখানকার “বার্ত্তাবহের” বিশেষ সংস্করণে পাইয়াছি।—” এক এক করিয়া সকল পত্ৰ পাঠ করিলাম। প্ৰায় সকলগুলি বন্ধু ও আত্মীয়দিগের নিকট হইতে আসিয়াছে। সকলেই ব্যাপারটা জানিতে ইচ্ছুক এবং সকলেই সাবধানের সহিত কার্য্য করিতে উপদেশ দিয়াছেন। তাহার পর সংবাদপত্রগুলির মোড়ক খুলিলাম। “প্ৰভাতী” খুলিয়াই দেখি বড় বড় অক্ষরে আমাদের কল্যকার সভার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া আছে। তাহার উপর এক কলম সম্পাদকীয় মন্তব্যও আছে। তাহার মর্ম্মার্থ এই যে বন্ধুবরে প্রস্তাবটী একটা দ্বিতীয় South Sea Bubble এবং গবর্ণমেণ্টের উচিৎ যদি ঐ কোম্পানী স্থাপিত হয়, তবে তাহার স্থাপন-কর্ত্তাদিগকে অভিযুক্ত করা। একে একে সকল সংবাদপত্র পাঠ করিলাম। দেখিলাম অল্প বিস্তর সকল পত্রিকাতেই আমাদের সভার বিবরণ প্রকাশিত হইয়াছে। কেহ বা সামান্য দুই একটা মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন, কেহ বা করেন নাই। একমাত্র “রঞ্জন” অত্যন্ত আনন্দ প্ৰকাশ করিয়াছেন এবং প্ৰস্তাবকর্ত্তা একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানবিদ্ বলিয়া কোনরূপ জুয়াচুরীর সম্ভব নাই, একথা স্পষ্ট করিয়া লিখিয়াছেন।

 কিয়ৎক্ষণ সকল কথা চিন্তা করিলাম। যদি বন্ধুবর বিখ্যাত বিজ্ঞানবিদ্ না হইতেন এবং তাঁহার উপর অচলা ভক্তি ও বিশ্বাস না থাকিত, তাহা হইলে কখনও আমি তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হইতাম না। তাহার উপর তিনি হাতে কলমে দেখাইয়া দিয়াছেন যে সমুদ্রের জল হইতে সুবৰ্ণ উৎপাদন করা যায়। সুতরাং যে যাহাই বলুক আমি যখন কথা দিয়াছি, তখন শত বাধা ঘটিলেও বন্ধুবরের সাহায্য করিবই করিব।

 বড় দাদা মহাশয়ের পত্রের উত্তর লিখিতে যাইতেছি, এমন সময় বাহিরে একখানা গাড়ী থামিল। জানালা দিয়া চাহিয়া দেখি মাতাঠাকুরাণী কাশী হইতে উপস্থিত। কুশলাদি জিজ্ঞাসার পর তিনি বলিলেন:—

 “হাঁরে লেখা পড়া শিখে কি মানুষ মূর্খ হয়? তুই তাই হয়েছিস্ দেখ্‌ছি। ব্যাপার কি?”

 আমার বুঝিতে বাকী রহিল না। জিজ্ঞাসা করিলাম:—

 “তোমায় খবর কে দিল?”

 “কেন, হর্‌শে।”

 আমার মনে একটা খট্‌কা উপস্থিত হইল।

 “সে কি করে তোমায় জানাইল?”

 “কেন সে কাল ৭টার গাড়ীতে কাশী পৌঁছায়। আমি সবে শুতে যাচ্ছি, এমন সময় সে উপস্থিত হয়ে তোর কীর্ত্তি কাহিনী বল্লে। আমার মন খারাপ হ’ল, তাই রাত্রের গাড়ীতে চলে এলেম। এখন ব্যাপারখানা খু’লে বল ত?”

 আমি ধীরে ধীরে সকল কথা বুঝাইয়া বলিলাম। শুনিয়া তিনি বলিলেন:—

 “তা হ’লে হর্‌শের কথা মিথ্যা নয়। তুই কি ছেলেপিলেদের ভাসিয়ে দিবি, আর আমায় শেষকালে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করাবি?”

 আমি তাঁহাকে কোন মতে বুঝাইতে পারিলাম না। অবশেষে তিনি বিরক্ত হইয়া বলিলেন:—

 “যা ভাল বুঝ কর। কিন্তু দেখো, আমাদের পথের ভিখারী ক’রো না। তুমি ছেলেমানুষ নও। তোমায় অধিক আর কি বুঝাব, একখানা গাড়ী ডেকে দেও, আমি এখনই কাশী যাব।”

 থাকিবার জন্য অনেক অনুরোধ করিলাম। তিনি শুনিলেন না। অগত্যা তাঁহাকে ষ্টেশনে পৌঁছিয়া দিলাম।

 মন কিন্তু বড়ই খারাপ হইল। বাড়ী না ফিরিয়া বন্ধুবরের গৃহে গেলাম। আমায় দেখিয়া তিনি বলিলেন:—

 “তুমি আসিয়াছ ভালই হইয়াছে। তাহা না হইলে আমি নিজেই তোমার ওখানে যাইবার জন্য প্ৰস্তুত হইতেছিলাম। ব্যাপার কিছু গুরুতর দাঁড়াইয়াছে। কথাটা প্ৰকাশ হইল কিরূপে তাহা বুঝিতেছি না।”

 আমি জিজ্ঞাসা করিলাম:—

 “তোমার চাকর হরিশ কোথায়?”

 “কাল তাহার দেশ হইতে এক টেলিগ্ৰাম আসে যে তাহার ভগিনীর কলেরা হইয়াছে। তজ্জন্য সে সন্ধ্যার গাড়ীতে বাড়ী গিয়াছে।”

 “ক’ দিনের ছুটী দিয়াছ?”

 “এক সপ্তাহের।”

 “আমার মনে একটা বিষম সংশয় উপস্থিত হইয়াছে। তোমার তারহীন বার্ত্তা-প্রেরণের যন্ত্রটা ঠিক আছে কি?”

 “হাঁ, কেন?”

 “প্রয়োজন আছে, পরে বলিব।”

 কাশীতে আমার এক আত্মীয় ছিলেন। তাঁহাকে ইথারো-গ্রামে জিজ্ঞাসা করিলাম যে হরিশ তাহার বাড়ীতে আছে কিনা এবং তাহার ভগিনী কেমন আছে। ঘণ্টা খানেক পরে উত্তর পাইলাম যে হরিশ কলিকাতায় যাইবে বলিয়া প্ৰাতেই চলিয়া গিয়াছে এবং তাহার ভগিনীর কোনরূপ অসুখ হয় নাই।

 বন্ধুবরকে জিজ্ঞাসা করিলাম:—

 “হরিশের জিনিষপত্র কোথায়?”

 আমায় তাহার ঘরে লইয়া গেলেন। দেখিলাম যে একটা টিনের বাক্স, দুই একটা বালিস ও কাঁথা ব্যতীত আর কিছুই নাই।

 একটু ভাবিয়া বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করিলাম:—

 “আমায় এ বাক্স খুলিতে অনুমতি দিবে কি?”

 “কেন?” তিনি বিস্মিতভাবে প্রশ্ন করিলেন।

 “বিশেষ কারণ না থাকিলে এরূপ অনুরোধ করিতাম না। কথাটা কিছু গুরুতর দাঁড়াইয়াছে। এক কথায়, এখনও সময় থাকিতে সাবধান না হইলে আমাদের বিপদে পড়িতে হইবে। তুমি আপত্তি করিও না।”

 একটা বাজে চাবি দিয়া বাক্স খুলিয়া ফেলিলাম। দেখিলাম উহার ভিতর বিশেষ কিছুই নাই, মাত্র দুইটা জামা, চারিখানা কাপড়, তিনখানা চাদর ও একখানা বই। কৌতূহলবশতঃ বহিখানা লইয়া দেখি, উহা সেক্‌সপিয়ারের মারচেন্ট্ অফ্ ভেনিসের বঙ্গানুবাদ। উহার পাতা উল্‌টাইতে উল্‌টাইতে একখানা ১০০৲ টাকার চেক্‌ দেখিলাম। উহা হিন্দু ব্যাঙ্কের উপর হরিশের নামে কাটা হইয়াছে। তারিখ কল্যকার। চেকখানা বন্ধুবরকে দেখাইয়া বলিলাম:—

 “কিছু বুঝিতে পারিতেছ কি?”

 “না, ব্যাপার কি?”

 “যাহা সন্দেহ করিয়াছিলাম নিশ্চয় তাহাই ঘটিয়াছে। এ চেকের সাক্ষরটা পড় দেখি।”

 “রামদাস ঘোষ।”

 “ইহাকে চেন?”

 একটু চিন্তা করিয়া বন্ধুবর বলিলেন:—

 “আমার এনামে পরিচিত কেহ নাই।”

 “প্ৰভাতী’র সম্পাদকের নাম কি?”

 “রামদাস ঘোষ।”

 “তাঁহাকে চেন?”

 “বিলক্ষণ।”

 চেকের সাদা পৃষ্ঠা উল্টাইয়া বলিলাম, “দেখ কি লেখা আছে।”

 “হাঁ, তাইত। এ যে “প্ৰভাতী” সম্পাদকের চেক্। হরিশ এমন কি কাজ করিয়াছে যাহার জন্য তিনি ধাঁ করিয়া ১০০৲ টাকার চেক্‌ দিয়াছেন।”

 “কারণ আছে। টাকায় সব হয়। টাকায় আপন পর হয়, পর আপন হয়। টাকা থাকিলে তুমি আমি যাহা ইচ্ছা তাহাই করিতে পারি। এমন কি দেবতাদিগকেও বশ করা যাইতে পারে। এখনও কি ঘটনাটা উপলব্ধি করিতে পারিলে না?”

 “বাস্তবিক না। এ একটা মস্ত সমস্যা বোধ হইতেছে। তুমি কিছু বুঝিয়াছ কি?”

 গম্ভীর স্বরে উত্তর দিলাম:—

 “সমস্তই বুঝিয়াছি। এখনই বুঝাইয়া বলিব। কথাটা এই। তোমার প্রস্তাব অতি সুন্দর। যদি তাহা বিশেষ লাভ জনক না বোধ হইত, আমি কখনই অংশ লইতে স্বীকৃত হইতাম না। তুমি সমুদ্রের জল হইতে সুবর্ণ উৎপাদনের চেষ্টা অনেক দিন হইতেই করিতেছ। একথা বাহিরে প্রকাশ না থাকিলেও, তোমার বাড়ীর অনেকেই জানে, নিশ্চিত। কি বল?”

 “হাঁ। হরিশ মাঝে মাঝে আমায় সাহায্য করিত।”

 “তবেই ঠিক হইল। হরিশ জানিত যে তুমি একটা বিশেষ লাভ জনক ব্যাপারে প্ৰবৃত্ত আছ। “প্ৰভাতী” সম্পাদক তোমার একজন শত্ৰু, তাহা তাহার সম্পাদকীয় মন্তব্যেই প্ৰকাশ। কারণ কি, তোমরাই জান। তবে আমি লক্ষ্য করিয়া আসিতেছি যে, তোমার আবিষ্কারগুলি অকিঞ্চিৎকর এই কথা প্রায়ই সে উহার কাগজে লিখিয়া থাকে। যাহা হউক, সে তোমার অনিষ্ট করিবার চেষ্টা খুঁজিতেছিল। তাহা সে অনেকদিন পরে সাধিত করিবার সুযোগ পাইল। সে হরিশাকে অর্থলোভে বশীভূত করিয়া আমাদের সভার সকল বিবরণ সংগ্ৰহ করে এবং আমার বিশ্বাস যে সে তাহারই আজ্ঞাক্ৰমে আমার মাতাঠাকুরানীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তোমার কার্য্য একটা বিষম জুয়াচুরী ইত্যাদি বলিয়া ভাঙ্‌চি দেওয়ার জন্য চেষ্টা করে। তাঁহার কথায় আমার এই বিশ্বাস হইয়াছে। আরও একটা বিশ্বাসের কারণ এই, যে তাহার ভগিনীর কোন অসুখ না হইয়া থাকিলেও সে মিথ্যা কথা বলিয়া কল্যই চলিয়া গিয়াছে। আমার বোধ হয় সে কলিকাতায় ফিরিয়া আসিয়াছে এবং এখন “প্ৰভাতী” সম্পাদকের নিকটই আছে।”

 “বাঃ! বাঃ! এ একটা মস্ত উপন্যাস খাড়া করিয়াছ দেখিতেছি। যাহা হউক, “প্ৰভাতী” সম্পাদক যে এত নীচ তাহা আমার বিশ্বাস ছিল না। ওঃ।”

 “একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি? উহার এত ক্রোধের কারণ কি?”

 “কারণ এমন বিশেষ কিছুই নাই। তবে একটা কথা মনে পড়িতেছে। অনেকদিন পূর্ব্বে একদিন বৈকালে সে আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসে এবং কথা-প্রসঙ্গে বলে, যে সে শীঘ্রই এক অভিনব পত্রিকা বাহির করিবে। বিশেষ করিয়া জিজ্ঞাসা করায় সে বলিল যে সে একখানি দৈনিক “রুমাল বার্ত্তাবহ” প্ৰকাশ করিতে ইচ্ছুক হইয়াছে—”

 বন্ধুবরকে বাধা দিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম:—

 “রুমাল বার্ত্তাবহ কি?”

 ঈষৎ হাস্য করিয়া তিনি উত্তর দিলেন:—

 “রুমাল, যাহাকে ইংরাজীতে handkerchief, বলে, তাহারই উপর দৈনিক সংবাদ ছাপাইয়া প্ৰকাশ করা। ইহার সুবিধা এই যে কাগজ যেমন পড়া হইয়া গেলে মোড়কাদি করা ব্যতীত অন্য কোন কার্য্যে আসে না, এই রুমাল জলে ধুইয়া ফেলিলে বিবিধ কার্য্যে লাগাইতে পারা যায়। তাহার এরূপ প্ৰস্তাব ছিল যে যাঁহারা ইচ্ছা করিবেন তাঁহারা রুমালাগুলি জমাইয়া মাসে মাসে পত্রিকার কার্য্যালয়ে পাঠাইয়া দিলে অর্দ্ধেক দাম ফেরত পাইবেন। ইহাতে উভয় পক্ষেরই সুবিধা—”

 “এত এক সম্পূর্ণ নূতন ব্যাপার দেখিতেছি।”

 “বড় নূতন নহে। আজ প্ৰায় ২০০ বৎসর পূর্ব্বে স্পেনে এইরূপ এক সংবাদ পত্র বাহির হয়। কিন্তু উহা শীঘ্রই উঠিয়া যায়। ইংরাজীতে যাহাকে nine days’ wonder বলে উহা তাহাই ছিল মাত্র। তাহার পর আরও কেহ কেহ চেষ্টা করেন, কিন্তু সকলেই অকৃতকার্য্য হইয়াছিলেন। আমি সম্পাদক-প্রবরের প্রস্তাবটা বাজে বিবেচনা করিয়া অৰ্থ-সাহায্য করিতে অস্বীকৃত হই। তাহাতেই তাহার ক্রোধের উদয় হয়। সেই দিন হইতেই সে আমার অনিষ্টের চেষ্টা করিয়া আসিতেছে। ওঃ। কি নীচ স্বভাব। এমনতর সচরাচর দেখা ষায় না, বিশেষতঃ শিক্ষিত লোকের মধ্যে।”

 “তাহা হইলে আর সন্দেহের কিছুই থাকিল না। যাহা হউক ইহার একটা বিহিত করা উচিত নয় কি?”

 বন্ধুবর শ্লেষের হাস্য হাসিয়া বলিলেন:—

 “বিহিত? বিহিত ভগবানই করিবেন। ও আপনার আগুনে আপনি পুড়িয়া মরিবে। আমার অনিষ্ট-সাধনের চেষ্টা করিয়া অকৃতকার্য্য হইয়া যেমন কষ্ট পাইতেছে, তাহাই তাহার বিশেষ শাস্তি; নালিশের পক্ষ আমি নই। কিন্তু, যাহা হউক, হরিশের একটা শিক্ষা হওয়া আবশ্যক—।”

 “সেই তোমায় শিক্ষা দিবে। মৃত্যুর জন্য প্ৰস্তুত হও।” এই কথা হঠাৎ কে বিকট্‌স্বরে আমাদের পশ্চাতে বলিয়া উঠিল। চমকিয়া উঠিয়া ফিরিয়া দেখি হরিশ!

 তাহার উভয় হস্তে ঘোড়া তোলা পিস্তল। একটা আমার দিকে আর একটা বন্ধুবরের দিকে ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছে।

 বন্ধুবর স্তম্ভিত হইয়া তাহার দিকে চাহিয়া রহিলেন। একটু পরে বলিলেন:—

 “কি নেমক্‌হারাম! দেখ্। বলি, তোর নূতন মনিব আমাদের মারিয়া ফেলিতে কত টাকা দিবে বলিয়াছে?”

 “তাহা তোমার শুনিয়া কি হইবে? এক মিনিট্ সময় দিলাম। প্ৰস্তুত হও।”

 “একটা কথা শোন্। স্থির হ’। সে তোকে জোর পাঁচ শ’ বা হাজার দিবে। তাও নগ্‌দা নয়। আমাদের মারিয়া ফেলিলে পর। ফলে, টাকা নাও দিতে পারে। উল্টা তুই ধরা পড়িবি ও প্ৰাণটা খোয়াইবি। তাই বলি, একটু স্থির হইয়া বিবেচনা কর। যাহা হইয়াছে তাহার উপায় নাই। তোকে আমি নগদ ২০০০৲ দিব। তুই তাহা লইয়া দেশে চলিয়া যা। সেখানে গিয়া একটা কারবার করিয়া খাস্। ও মুখ আর এখানে দেখাস্ নি। কি বলিস্?”

 দেখিলাম প্রস্তাবটা হরিশের অন্তঃস্থল বিদ্ধ করিয়াছে। একটু চিন্তা করিয়া সে বলিল,

 “বিশ্বাস কি?”

 “যাহাতে হয় তাহাই করিব।” বন্ধু উত্তর দিলেন। “তুই এক কাজ কর্। পিস্তল দুইটা তোর ডাইনে যে গ্লোব দুইটা আছে তাহাদের পাশে রাখিয়া দে। পরে উহাদের উপরিভাগ জোরে চাপিয়া ধর্। তাহা হইলেই উহারা ফাঁক হইয়া পড়িবে। উহাদের প্রত্যেকটার ভিতর ১০০৲ টাকা করিয়া ১০ খানা নোট আছে। তাই নে। ভয় নাই, আমরা পলাইয়া যাইব না বা তোকে ঐরূপে নিরস্ত করিয়া আক্রমণ করিব না।”

 তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার আমার বন্ধুর দিকে চাহিয়া সে পিস্তল দুইটা তাহার কোটের পকেটে রাখিল। পরে জোরে গ্লোব দুইটার উপর চাপিয়া ধরিল। তৎক্ষণাৎ বন্ধুবর নিকটস্থ একটা কল দুই চারি বার ঘুরাইয়া দিলেন। হরিশ চীৎকার করিয়া উঠিল ও তাহার হাত সরাইয়া লইতে চেষ্টা করিল, কিন্তু পারিল না।

 বন্ধুবর হাস্য করিয়া বলিলেন:—

 “কেমন হল’ত, টাকা লও।” তাহার পর পিস্তল দুইটা তাহার পকেট হইতে বাহির করিয়া লইয়া একটী ড্রয়ারের ভিতর রাখিয়া দিলেন।

 আমি বিস্মিত হইয়া একবার বন্ধুবরের মুখের দিকে আর একবার হরিশের দিকে তাকাইতে লাগিলাম।

 “ব্যাপারটা আর কিছুই নয়,” বন্ধুবর বুঝাইয়া বলিলেন। “এয়ার পম্পের দ্বারা গ্লোব দুইটার ভিতর ভেকুয়ম্ (বায়ুশূন্য) করা হইয়াছে। বায়ুর চাপের জন্য ও হাত উঠাইয়া লইতে পারিতেছে না; ঐ দেখ উহার হাত ইহারই ভিতর ফুলিতে আরম্ভ হইয়াছে। যেমন কর্ম্ম তেমনি ফল।”

 আমি বলিলাম:—

 “ইহাকে পুলিশে দেওয়া যাউক। তাহা হইলে আইন অনুসারে উহার লাইসেন্স্ রদ হইয়া যাইবে। উহাকে আর চাকুরী করিয়া থাইতে হইবে না।”

 বন্ধু বলিলেন:—

 “ব্যস্ত হইও না। এ এখন আমাদের সম্পূর্ণ বশে আসিয়াছে। উহার দ্বারায় আমাদের সাহায্য হইবে। একটা ইংরাজী বচন আছে, “To set a thief to catch a thief।” হরিশের দ্বারা আমার শত্রুদিগকে দমন করিতে পারিব।”

 “এ ভাল কথা।”

 জালে পড়িয়া, হরিশ অনেক কাকুতি মিনতি করিতে লাগিল। বন্ধুবর একটু চিন্তার পর বলিলেন:—

 “দেখ, হরিশ, যাহা হবার হয়ে গেছে। এখন তুই যদি আমার প্ৰস্তাবে সম্মত হ’স তোর সকল দিকেই মঙ্গল, নতুবা তোর দশ বৎসরের জন্য শ্রীঘরবাস অনিবার্য্য। আমার প্রস্তাবে স্বীকৃত হ’লে, তুই প্ৰতিশ্রত ২০০০৲ টাকা নিশ্চয়ই পাইবি।”

 “আপনি যাহা বলিবেন আমি শপথ করিয়া বলিতেছি তাহাই করিব। আমায় এ যন্ত্রণা হইতে অব্যাহতি দিন। বড় কষ্ট হইতেছে।”

 হরিশ এই কথাগুলি কাতরস্বরে বলিল। বন্ধুবর তখন একটা কল টিপিলেন। অমনি গ্লোব দুইটা বায়ুপূর্ণ হইয়া গেল। হরিশ তখন তাহার হাত উঠাইয়া লইতে সক্ষম হইল। পরে আমাদের পায়ে পড়িয়া বারংবার ক্ষমা প্রার্থনা করিতে লাগিল।

 আমাদের কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য তাহাকে যে সকল প্রশ্ন করিলাম তাহার উত্তরে সে বলিল যে অর্থের লোভে সে আমাদের সভার বিবরণ “প্ৰভাতী” সম্পাদককে দিয়াছিল। তাহারই ইচ্ছানুসারে সে আমার মাতাঠাকুরাণীকে ভাঙ্‌চি দিয়াছে ইহাও স্বীকার করিল।

 বন্ধুবর তাহাকে বিশেষ ভর্ৎসনা করিয়া একখানা কাগজ সহি করাইয়া লইলেন। তাহাতে যাহা লেখা ছিল তাহার মর্ম্ম এই ষে সে অর্থের লোভে আমাদের প্রাণ নাশের চেষ্টা করিয়াছিল, এজন্য সে অনুতপ্ত; ভবিষ্যতে সে কখনও অনিষ্ঠের চেষ্টা করিবে না। করিলে, আমরা ইচ্ছামত শাস্তি দিতে পারিব।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

 এক মাসের মধ্যে “সী গোল্ড্ সিন্‌ডিকেট্ লিমিটেড্” (Sea Gold Syndicate Ltd.) আইন অনুসারে রেজেষ্টারী হইয়া গেল। আমরা একবাক্যে বন্ধুবরকে বোর্ড অব্ ডাইরেক্‌টার্সের সভাপতি মনোনীত করিলাম। কাহারও কাহারও মতে ২৫ লক্ষ টাকা মূলধন কম বোধ হওয়ায় ৩০ লক্ষই মূলধন নির্দ্দিষ্ট হইল। অবশ্য মূলধন আবশ্যক মত কমাইবার ও বাড়াইবার ক্ষমতা আমাদের থাকিল। নিম্নলিখিত পাঁচজন ব্যক্তি ডাইরেক্‌টার্স মনোনীত হইলেন:—

শ্রীরজনীনাথ রায় (রে ব্ৰাদার্স লিমিটেডের অধ্যক্ষ)।

„ চারুকৃষ্ণ ঘোষ (ঘোষ এণ্ড সন্স্ লিমিটেডের অংশীদার)।

„ সুধাময় বল (দালাল)।

„ রমানাথ মিত্র (বেঙ্গল জীবন বীমা কোম্পানী লিমিটেডের ডাইরেক্‌টার)।

„ বিপ্রদাস ভাদুড়ী (জমীদার)।

 কলিকাতা চৌরঙ্গী অঞ্চলে আমাদের রেজেষ্টারী-কৃত আফিস্ স্থাপিত হইল। ব্যাঙ্কার্স সলিসিটার্স প্রভৃতিও যে স্থির করা হইয়াছিল, তাহা বলা বাহুল্য। প্ৰথম “কল” শতকরা ২৫ টাকা নির্দ্ধারিত ছিল। কোম্পানী রেজেষ্টারী হইবার এক সপ্তাহের মধ্যে অংশীদারগণ স্বস্ব দেয় জমা দিলেন। কালবিলম্ব না করিয়া বন্ধুবর বোম্বাইএর হাসানজী কোম্পানীকে তাঁহার বর্ণনানুযায়ী জাহাজ নির্ম্মাণ করাইবার অর্ডার দিলেন। উহার নক্সাদি বন্ধুবর নিজেই প্ৰস্তুত করিয়াছিলেন। কেহ কেহ উহা দেখিতে চাহিলে, তিনি বলিলেন যে উহার মধ্যে কতকগুলি এমন অংশ আছে, যাহা প্ৰকাশ হইলে ক্ষতি হইতে পারে। এজন্য তিনি উহা এখন দেখাইতে অস্বীকার করিলেন। কাজে কাজেই আমরা নক্সা দেখিবার জন্য পীড়াপীড়ি করিলাম না।

 হাসানজী কোম্পানী ছয়মাসের মধ্যে জাহাজ প্ৰস্তুত করিয়া দেওয়ার চুক্তি-পত্ৰ সহি করিলেন। উহার কয়েকটী সর্ত্তের মধ্যে একটী এই ছিল যে ছয়মাসের পর প্রত্যেক “বিলম্ব”-দিনের জন্য ১০০০৲ টাকা তাহারা খেসারত দিতে বাধ্য থাকিবে। কিন্তু যদি চারি মাসের মধ্যে তৈয়ার করিয়া দিতে পারে, তবে ৫০০০০৲ হইতে ৭৫০০০৲ টাকা বোনাস্ পাইবে। আর যদি, তাহাদের দোষে, কোন রকমে নক্সার বিবরণ প্ৰকাশ হইয়া পড়ে, তাহা হইলে উহারা পাঁচ লক্ষ টাকা খেসারত দিতে বাধ্য থাকিবে।

 সপ্তাহে একদিন, আমরা, অর্থাৎ ডাইরেক্টররা, আফিসে অ্যাসিয়া “চলতি কার্য্য” সম্পন্ন করিতে লাগিলাম। এইরূপে প্ৰায় দুই মাস গত হইল। তাহার পর হাসানজী কোম্পানী একটী রিপোর্ট পাঠাইল, তাহাতে আমাদের আশা হইল যে চারি মাসের মধ্যে জাহাজ প্ৰস্তুত করিতে পারিবে। তখন আমরা কাপ্তেন, নাবিক প্রভৃতি নিয়োগের চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইলাম। আমাদের উৎসাহ কিরূপ বর্দ্ধিত হইয়াছিল, তাহা বৰ্ণনা করা যায় না।

 একদিন বৈকালে আমি আফিস হইতে বাটী আসিবার উদ্যোগ করিতেছি, এমন সময় বন্ধুবর অতি ব্যস্তভাবে আমার ঘরে প্রবেশ করিালেন। ব্যাপার শীঘ্রই জানিতে পারিলাম। জাহাজের নক্সার ডুপ্লিকেট, যাহা বন্ধুবরের নিকট ছিল, তাহা চুরি গিয়াছে! কি সর্ব্বনাশ! চুরি কি প্রকারে হইল, বন্ধুবর বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছেন না। মন কেমন এক রকম হইয়া গেল। তাঁহার বাসায় গেলাম। তিনি পাঠাগারে লইয়া গিয়া, একখানি চেয়ারে অামায় বসিতে বলিয়া বলিলেন:—

 “কি করিয়া চুরি হইল, বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। এই সেফ্‌টায় আমার যত প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র, টাকা কড়ি আদি খাকে। আজ প্রায় সপ্তাহ খানেক হইল ইহা খুলি নাই। কেন না, খুলিবার আবশ্যক হয় নাই। অদ্য আমার রাঘবপুরের জমীদারীর কাগজপত্র দেখার আবশ্যক হওয়ায় ইহা খুলি। তখন দেখিলাম নক্সাখানি নাই। তন্ন তন্ন করিয়া দেখিয়াছি। তুমি যদি দেখিতে ইচ্ছা কর দেখিতে পার।”

 সেফ্‌টা ভাল করিয়া দেখিলাম। বাস্তবিকই নক্সাখানি নাই। কেমন একটা অবসন্নভাব বোধ হইতে লাগিল। বন্ধুবরকে জিজ্ঞাসা করিলাম:—

 “সেফ্‌টার চাবী কোথায় থাকে?”

 “সর্ব্বদাই আমার নিকট থাকে।”

 “সর্ব্বদা যে জামা ব্যবহার কর, তাহার পকেটে তো?”

 “হাঁ।”

 “রাত্রে কি জামা গায়ে দিয়ে শোও?”

 “না। কখনও না। তখন জামা আলনায় ঝুলাইয়া রাখি।”

 “চাবি দেখি।”

 উহা মাইক্রস্‌কোপ দিয়া বিশেষ পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম, উহার যে মোমের ছাপ লওয়া হইয়াছে, এরূপ বোধ হইল না । কেন না, যখন আজ সাতদিনের মধ্যে ঐ চাবী ব্যবহার হয় নাই, তখন ছাপ লওয়া হইয়া থাকিলে উহার কোন না কোন চিহ্ণ থাকিত। বিশ্বাস হইল চাের কোন সামান্য ব্যক্তিমাত্র। বন্ধুবরকে জিজ্ঞাসা করিলাম:—

 “আচ্ছা, নক্সা চুরি গেলে বিশেষ ক্ষতি আছে কি?”

 “আছেও বটে, নাইও বটে। যদি কেহ প্ৰতিদ্বন্দিতা করিতে ইচ্ছা করে, তাহা হইলে ঐ নক্সা অনুযায়ী একখানা জাহাজ প্ৰস্তুত করিয়া লইতে পারিবে। নক্সার বা আমার আবিষ্কৃত যন্ত্রাদির পেটেন্ট লই নাই। অতএব যদি কেহ তাহা নকল করে, আমি তাহাকে আইনের আমলে আনিতে পারিব না। কিন্তু সে আমার সুবৰ্ণ প্ৰস্তুতের উপায় জ্ঞাত না থাকায়, ব্যর্থ-মনোরথ হইবে।”

 “ঐ উপায়টা কি লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছ?”

 “নিশ্চয়ই।”

 আমি হাসিয়া বলিলাম:—

 “ভাল বোধ হইতেছে না। দেখ তো সেটা চুরি গিয়াছে কি না?”

 “হাঁ, সে কে লইবে? বস, এখনই তোমায় দেখাই।”

 বন্ধুবর আর একটা সেফ্ খুলিয়া উহার অভ্যন্তরস্থ কাগজ পত্রাদি  তন্ন তন্ন করিয়া দেখিলেন। হঠাৎ তাঁহার মুখ বিবৰ্ণ হইয়া গেল।

 “সর্ব্বনাশ, তাহাও যে চুরি গিয়াছে দেখিতেছি।”

 আমি আসন হইতে লাফাইয়া উঠিয়া চীৎকার করিয়া বলিলাম:—

 “বল কি? ও চোর তবে তো সোজা নয়?”

 একটু পরে একটু প্রকৃতিস্থ হইয়া বন্ধুবর বলিলেন:—

 “যখন চুরি হইয়াছে, তখন উপায় নাই। সুখের বিষয় সুবর্ণ প্ৰস্তুতের উপায়ের বিবরণ এই ডায়ারীতে লেখা আছে। ইহা চুরি ষায় নাই। এই দেখা! ইহার উপর কিছুই লেখা নাই দেখিয়া চোর বোধ হয় এটা ছোঁয় নাই। কিন্তু এই ডায়ারী চুরি করিলেও কাহারও সুবিধা হইবে না, কেন না ইহা এমনভাবে লেখা যে, আমাভিন্ন দ্বিতীয় ব্যক্তির উহার বোধের অগম্য। যাহা হউক, এ বিষয় অনতিবিলম্বে ডায়রেক্টরদিগকে জানান উচিত। কি বল?”

 “না, এখন নয়। কেন না মানুষের মন কখন কি হয়, বলা যায় না। চাই কি তোমায় তাঁহারা সন্দেহ করিতে পারে। আর দুই চারি দিন অপেক্ষা কর। ইতিমধ্যে ভাল রকম সন্ধান করা যাউক। আমার কার্য্যের ক্ষতি হইলেও, আমি বিশেষভাবে অনুসন্ধান করিতে ক্ৰটী করিব না। চোর ধরা পড়িবে নিশ্চিত।”

 আর দুই একটা কথাবার্ত্তার পর, আমি বাড়ী ফিরিয়া আসিলাম।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

 পরদিন প্রাতে সংবাদপত্র পাঠ করিতেছি, এমন সময় বন্ধুবর অতি ব্যস্তভাবে আমার ঘরে প্রবেশ করিলেন। তাঁহার বদন অতি প্ৰফুল্ল।

 তিনি আহ্লাদসহকারে বলিলেন, “চাবী পাওয়া গিয়াছে।” তখন বোধ হইল যেন আমার দেহ হইতে একটা বোঝা নামিয়া গেল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম:—

 “কি? সকল কাগজপত্র অাছে তো?”

 “হাঁ”।

 “কি রকমে দেখিতে পাইলে?”

 “একটা দলিলের প্রয়োজন হওয়ায় সেফ্‌টা খুলি। দেখি উপরেই এই দুইখানা রহিয়াছে।”

 এই বলিয়া তিনি জাহাজের নক্সা ও সুবৰ্ণ প্রস্তুতের বিবরণ আমায় দেখাইলেন।

 “ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে ইহা পাওয়া গিয়াছে। এখন আর চুরির কথা প্ৰকাশ করিবার আবশ্যক নাই। যাহা হউক, আমার বিশ্বাস ষে কোন চোর ইহার নকল রাখিয়াছে। সে যে অতি চতুর তাহা বুঝা যাইতেছে।”

 আর দুই একটা কথাবার্ত্তার পর বন্ধুবর চলিয়া গেলেন। সেইদিন আমাদের সাপ্তাহিক সভার এক অধিবেশন হয়। যথাসময়ে উপস্থিত হইলে পর, বন্ধুবর আমায় বলিলেন:—

 “এই, আর এক বিপদ উপস্থিত। এই টেলিগ্রাম পাঠ কর।”

 দেখি হাসানজী কোম্পানী লিখিয়াছে যে তাহারা কোন বিশ্বস্ত ব্যক্তির নিকট শুনিয়াছে যে আমাদের উদ্দেশ্য ভাল নয়। আবশ্যক হয় কোন আদালতে তাহাদের অভিযোগ প্ৰমাণ করিতে প্ৰস্তুত আছে। এই জন্য সমস্ত টাকা অগ্রিম না পাইলে, তাহারা ডেলিভারি দিবে না এবং আপাততঃ সকল কার্য্য স্থগিত রহিয়াছে।

 আমি বলিলাম:—“এ কলঙ্ক কে দিল তাহা এক্ষণই জানা উচিত। এক্ষণেই টেলিগ্ৰাফ্ করিতেছি।”

 অর্দ্ধঘন্টা মধ্যে উত্তর আসিল যে তাহারা আমাদের আপনার লোকের নিকট সকল কথা শুনিয়াছে। তাহারা তাঁহার নাম বলিতে প্ৰস্তুত ও বাধ্য নহে।

 সুধাময় বাবু বলিলেন:—

 “এদের মেজাজটা কিছু উগ্ৰ দেখিতেছি। আমার ইচ্ছা হইতেছে যে ইহাদের অর্ডার এখনই রদ করিয়া দিই।”

 “তাহার উপায় নাই,” বন্ধুবর বলিলেন। “আইনে বাধ্য আছি যে।”

 বিপ্ৰদাস বাবু এতক্ষণ একখণ্ড কাগজ পাঠে ব্যস্ত ছিলেন। সহসা তিনি বলিয়া উঠিলেন:—

 “বাঃ, দেখ দেখ। এই এক নূতন খবর।”

 কাগজখানা লইয়া আমি পাঠ করিলাম। সেখানা “প্রভাতী”র সান্ধ্য সংস্করণ। উহার সম্পাদকীয় স্তম্ভে নিম্নলিখিত কথাগুলি লেখা ছিল:—

 “আমাদের গ্রাহক অনুগ্রাহক মহাশয়গণ শুনিয়া সুখী হইবেন যে অতি শীঘ্ৰ কয়েকজন বিশিষ্ট ভদ্রসন্তান মিলিত হইয়া একটী কোম্পানী গঠন করিয়া সমুদ্রের জল হইতে সুবর্ণ প্ৰস্তুত করিবেন। মূলধন ৫০ লক্ষ টাকা নির্দ্ধারিত হইয়াছে। ইতিমধ্যে ২৫ লক্ষ টাকার অংশ বিক্রয় হইয়াছে। বাকী অংশগুলি সাধারণকে ক্রয় করিবার সুবিধা দেওয়া হইবে। এই ব্যবসায়ে লাভ যে অত্যধিক তাহা বলা বাহুল্য। কোম্পানী স্থাপয়িতারা গবৰ্ণমেণ্টের নিকট “একচেটিয়া অধিকার” লইয়াছেন। তাঁহারা neutral zone এ কার্য্য করিবেন, কেননা তাহা হইলে জলদস্যু বা ভিন্ন গভর্ণমেণ্ট তাঁহাদিগকে আক্রমণ করিতে সাহস করিবে না।”

 পাঠান্তে আমি বলিলাম:—

 “আমার বিশ্বাস যে এই কোম্পানী স্থাপয়িতাদিগের মধ্যে “প্ৰভাতী” সম্পাদক একজন। এই ব্যক্তি অতি হিংসক। সে আমাদের ভাল দেখিতে পারে না; তাহার অনেক প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। যাহা হউক, দেখা যাউক সে কি করে।”

 “লোকটা আমাদের উপর কটাক্ষ করিতে ছাড়ে নাই।” বিপ্রদাস বাবু বলিলেন। “বলে কিনা একচেটিয়া অধিকার প্রাপ্ত হইয়াছে। পাগল আর কি?”

 সুধাময়বাবু বলিলেন:—

 “আপনি কথাটা উড়াইয়া দিতেছেন বটে, কিন্তু ইহা একটী চিন্তার বিষয়। যদি তাহারা গভৰ্ণমেন্টের নিকট হইতে একচেটিয়া অধিকার লয়, তাহা হইলে আমাদের কারবার চলিবে না নিশ্চিত। আর একটা কথা। যদি কোন ভিন্ন গভর্ণমেন্ট বা জলদস্যু আমাদের আক্রমণ করে, তাহা হইলে আমাদের সকল চেষ্টাই পণ্ড হইয়া যাইবে।”

 বন্ধুবর উত্তর দিলেন:—

 “আপনি যাহা বলিয়াছেন তাহা আংশিক সত্য বটে। কিন্তু দেখুন, আমি তাহার বন্দোবন্ত না করিয়া আগে হইতে সাবধান না হইয়া কার্য্যে প্রবৃত্ত হই নাই। একটু বিস্তারিত করিয়া বলি। প্রথম একচেটিয়ার কথা। একচেটিয়া কোথায় হইতে পারে? না, যেখানে রাজার রাজ্য আছে। neutral zone তো ইংরাজীতে যাহাকে No man’s land বলে তাহাই। সেখানে কোন রাজার রাজ্য নাই। অতএব তথায় কার্য্য করিলে একচেটিয়া-ওয়ালারা আমাদের কোনরূপ ক্ষতি করিতে পরিবে না। আপনি বলিতে পারেন, “কেন, neutral zone এ কার্য্য নাইবা করা হইল? রাজ্যের সীমানার মধ্যে করুন না কেন?” আমি তাহা করিতে প্ৰস্তুত নাহি। কেননা তাহা হইলে গভর্ণমেন্টের তদারক ও অন্যান্য হাঙ্গামায় পড়িতে হইবে। ফলে, অনেক অর্থ বৃথা ব্যয় হইয়া যাইবে। সুতরাং লাভের অংশ কমিয়া যাইবে। তাহার পর, জলদস্যু ও ভিন্ন গভর্ণমেণ্টের আক্রমণের কথা। তাহারও বন্দোবস্ত করিয়াছি—একটা টরপেডোর ওয়াস্তা। আপনারা আমার উপর যখন সকল বিশ্বাস স্থাপন করিয়াছেন, তখন এ বিশ্বাসও রাখিতে পারেন।”

 বিপ্ৰদাসবাবু বলিলেন:—“বিশ্বাস না থাকিলে কি আর এ কার্য্যে প্ৰবৃত্ত হইতাম। যাহা হউক, এ বিষয়ে আর অধিক বাক্যব্যয়ের প্রয়োজন নাই।”

 বল মহাশয় চিন্তাযুক্তভাবে বলিলেন:—

 “দেখুন, সত্য বলিতে কি, আমার মনে কেমন একটা খট্‌কা উপস্থিত হইয়াছে। আমি প্ৰস্তাব করি যে আমাদের কোম্পানীকে পাব্‌লিক্‌ করা হউক৷”

 আমি জিজ্ঞাসা করিলাম:—

 “কি করিয়া করা যাইবে?”

 “কেন, আমাদের মূলধন বাড়াইবার বা কমাইবার অধিকার আছে। আমরা মনে করিলেই, ধরুন আর পাঁচলক্ষ টাকার অংশ সৃষ্টি করিয়া সাধারণকে উহা বিক্রয় করিতে পারি। তবে নিয়ম পত্রের যা একটু পরিবর্ত্তন করিতে হয়, এইমাত্র। এ আর বেশী কথা তো নয়।”

 অামি জিজ্ঞাসা করিলাম:—

 “কেন, প্রাইভেট্ কোম্পানীতে কাহারও আপত্তি আছে কি?”

 “হওয়া বিচিত্র কি? মানুষের মন, নিয়ত পরিবর্ত্তনশীল।”

 একটু বিরক্তভাবে আমি বললাম:—

 “এমন যদি কেহ থাকেন, তিনি আমাদের সংস্রব ত্যাগ করিতে পারেন। আমি তাঁহার অংশ parএ ক্ৰয় করিতে প্ৰস্তুত আছি।”

 বিপ্রদাস বাবু বলিলেন:—

 “চটিবেন না। অংশীদারদিগের নিকট এক পত্র প্রেরণ করিয়া সকলের এ বিষয়ে মতামত জানা যাউক। তাহার পর যাহা হয় স্থির করা যাইবে।”

 বল মহাশয় বলিলেন:—

 “আমি প্ৰস্তাব করি যে যখন কার্য্য চালানর ভার আমাদের উপর ন্যস্ত আছে, তখন এক্ষণেই ভোট লইয়া দেখা যাউক আমার প্রস্তাবের স্বপক্ষে বা বিপক্ষে কয়জন আছেন।”

 ভোট লইয়া দেখা গেল যে চারিজন তাঁহার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে মত দিয়াছেন। অতএব উহা গ্ৰাহ্য হইল না। কিন্তু বল মহাশয় সন্তুষ্ট হইলেন না। তিনি বলিলেন:—

 “আমি সকল অংশীদারগণের নিকট আমার প্রস্তাব উপস্থিত করিতে চাহি। তাঁহারা যদি আমার বিপক্ষে মত দেন, তবে আমি উহা গ্রাহ্য করিব নতুবা নহে।”

 “তাহাই করুন,” বন্ধুবর একটু বিরক্তভাবে বলিয়া উঠিলেন।

 বিপ্রদাস বাবু বলিলেন:—

 “কথায় কথায় অন্য কখা আসিয়া পড়িয়াছে। এখন হাসানজী কোম্পানীকে কি লিখিবেন স্থির করিলেন?”

 “ধন্যবাদ, এ কথাটা একেবারে চাপা পড়িয়া গিয়াছিল,” বন্ধুবর বলিলেন। “দেখুন, আমাদের কার্য্য অনেকটা অগ্রসর হইয়াছে। এখন যদি আমরা চুক্তির সর্ত্ত অনুসারে কার্য্য করিতে চাহি, উহারা বক্ৰ হইয়া দাঁড়াইবে। শেষে আদালতে যাইতে হইবে। ফলে অনর্থক ব্যয়, মনঃপীড়া ও কার্য্যারম্ভে অযথা বিলম্ব ইত্যাদি ঘটিবে। অতএব আমি প্ৰস্তাব করি যে উহাদের প্রাপ্য টাকার বার অানা মত অগ্রিম দেওয়া হউক।”

 আমি উহা সমর্থন করিলাম। প্ৰস্তাবের বিরুদ্ধে মাত্র একটী মত থাকায় উহা গৃহীত হইল। আপত্তিকার আমাদের বল মহাশয়।

 যথারীতি ধন্যবাদাদির পর সভাভঙ্গ হইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *