১৫০০ বছরের বাঙালি দার্শনিক : পাঁচ থেকে কুড়ি শতাব্দী
১.
১৩২৪ বঙ্গাব্দের বৈশাখী পূর্ণিমায় কলকাতার বিবেকানন্দ সোসাইটি আয়োজিত বুদ্ধ-স্মরণ উৎসবে পঠিত এক প্রবন্ধে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাস পাওয়া যায় না। কিন্তু বাংলা যে বহু পূর্বকাল, এমন-কি আর্যগণের পাঞ্জাবে আসিবার বহু পূর্বেও সভ্য জাতির বাস ছিল, তাহার নিদর্শন পাওয়া যায়।’ তিনি আরো বলেন, ‘ঋদ্বেদে’ বাংলা দেশের নাম পাওয়া যায়নি। কিন্তু ঋগ্বেদে’র ‘ঐতরেয় আরণ্যকে’ তিনটি জাতির নাম পাওয়া যায়। এখানে জাতি শব্দের অর্থ ইংরেজিতে যাকে caste বলে তাহা নহে— কিন্তু ethnic race। একটির নাম বঙ্গ, একটির নাম বগধ এভং অপরটির নাম চের। দ্রাবিড় জাতির সাধারণ নাম চের। …. কোনো কোনো anthropologist বলেন, বঙ্গ বা বং নামে এক দ্রাবিড় জাতি বাংলাদেশে বাস করিত।’ [ উদ্বোধন, আষাঢ় ১৩২৪]
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আরো বলেছেন, ‘বুদ্ধদেবের জন্মগ্রহণের পূর্বেও’ বাংলায় বিভিন্ন অনার্য জাতি বাস করিত এবং ইহারা কতক পরিমাণে সভ্য হইয়াছিল; কারণ জৈনদিগের প্রায় সকল তীর্থংকরই বাংলাদেশে বিশেষত রাঢ়ে বহুদিন বাস, তপস্যা ও সিদ্ধিলাভপূর্বক আপন আপন ধর্মের মূলভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন।’ এই বক্তব্য থেকে যে তথ্য আমরা পাচ্ছি তা হলো বঙ্গের এই গঙ্গেয় বদ্বীপে আড়াই হাজার বছরের বেশি সময় যাবৎ মানুষ বসবাস ও ধর্মচর্চা করছে। যে সমাজে মানুষ ধর্মশাস্ত্রের চর্চা করে সেখানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দর্শনেরও চর্চা হয় তবে সেই দর্শনচর্চা সুশৃঙ্খলভাবে ও যথাযথ পদ্ধতি অনুসারে হয়েছে কিনা তা বিচার্য। আজ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এ দাবি আমরা করতে পারি যে বাঙালি অন্তত দেড় হাজার বছর যাবৎ পদ্ধতিগতভাবে দর্শনের আলোচনায় নিয়োজিত রয়েছে।
যিশু খ্রিষ্টের জন্মের পাঁচ শ বছর পর থেকেই যে বাংলায় পণ্ডিতগণ দর্শনশাস্ত্রের (logic and metaphysics) আলোচনা করছেন তাতে এখন আর কোনো সন্দেহ নেই। ১৯২০-এর দশকের শুরুতে দামোদরপুরে যে পাঁচটি তাম্রশাসন পাওয়া যায় তাতে জানা গেছে খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যভাগেও বাংলায় দর্শনশাস্ত্র আলোচিত হয়েছে। প্রাচীনকালে অন্তত একখানি বেদ পাঠ না করলে কোনো পণ্ডিতের বিদ্যাশিক্ষা সমাপ্ত হতো না। দামোদরপুরের এক ব্রাহ্মণ ‘অগ্নিহোত্রোপযাগায়’ ভূমি প্রার্থনা করেছেন। অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞবেদের কর্মকান্ডের অন্তর্গত। মীমাংসা দর্শনেও তার সম্বন্ধে আলোচনা আছে। তাতে প্রতীয়মান হয়, পঞ্চম শতাব্দীতেও বঙ্গদেশে মীমাংসা দর্শনের আলোচনা ও চর্চা হতো। বঙ্গে আর্য সভ্যতা যে প্রাচীনকালেই অর্থাৎ দু’আড়াই হাজার বছর আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দামোদরলিপি থেকে তা অবগত হওয়া যায়।
পঞ্চম শতাব্দী থেকে যে পরবর্তী শত শত বছরব্যাপী এ দেশে দর্শনের চর্চা হয়েছে তার প্রমাণ ষষ্ঠ শতাব্দীতে চৈনিক পরিব্রাজক হুয়েন সাঙ-এর ভ্রমণবৃত্তান্ত থেকে জানা যায়। হুয়েন সাঙ নালন্দা মহাবিহারের অধ্যক্ষ আচার্য শীলভদ্রের নিকট পাঁচ বছর অবস্থান করে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। বেদ, বেদাঙ্গ, ত্রিপিটক ও অন্যান্য বৌদ্ধশাস্ত্ৰ সম্পর্কে শীলভদ্র তাঁকে পাঠ দেন। শীলভদ্রই আমাদের সমতটের প্রথম প্রধান দার্শনিক। শীলভদ্র বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হয়ে জীবন শুরু করার আগেই যুক্তিবিদ্যা, ভাষাতত্ত্ব, চিকিৎসাবিজ্ঞান, অথর্ব, সাংখ্য দর্শন ও অন্যান্য ধর্মশাস্ত্র গভীর মনোযোগ দিয়ে পাঠ করেন। হুয়েন সাঙ-এর লেখা থেকে যা জানা যায় তাতে বলা চলে ছয় শতকে বঙ্গে বিভিন্ন দর্শনের মধ্যে ন্যায় ও সাংখ্যই বেশি পঠিত হতো। বেদান্তের কথা অবশ্য হুয়েন সাঙ-এর বিবরণে নেই। সপ্তম শতাব্দীর মহান বৌদ্ধ দার্শনিক শান্তিদেবের ‘বোধিচর্যাবতার’ সহ কোনো কোনো গ্রন্থ বাংলায় অনূদিত হয়েছে।
অষ্টম শতাব্দীতে বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজাদের শাসন শুরু হয়। সুতরাং বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের ব্যাপক চর্চা হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। তবে ধারণা হয় বৌদ্ধ-শাসকরা হিন্দুদের ধর্ম রক্ষায় এবং তাঁদের দর্শনশাস্ত্র চর্চায় কোনো বাধা- বিপত্তিরও সৃষ্টি করেননি। গুপ্ত সম্রাটদের মতোই মহারাজ ধর্মপাল দার্শনিক ব্রাহ্মণদের ‘ভূমিদান করিয়া উৎসাহ দিতেন’। একটি উদাহরণ অন্তত আমাদের হাতে রয়েছে। তা হলো, মহারাজ বৈদ্যদেব বরেন্দ্রভূমির ভাব-গ্রামের অধিবাসী শ্রীধর নামক এক ব্রাহ্মণ- পণ্ডিতকে গ্রামদান করেছিলেন। সেকালের আর একজন বিশিষ্ট বেদান্ত পণ্ডিত দর্ভপাণি পাল রাজাদের সভাসদও ছিলেন এবং দর্শনচর্চাও করতেন। দর্ভপাণির পৌত্র কেদার মিশ্র চতুর্বেদে বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন। তাঁরই বংশধর দার্শনিক গুরব মিশ্র।
হিন্দু দর্শনের চর্চা তো বঙ্গে হতোই, কিন্তু বাংলার বৌদ্ধ দার্শনিকদের খ্যাতি ভারতের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রামের তিব্বত-বিশেষজ্ঞ পন্ডিত শরচ্চন্দ্র দাস (১৮৪৯-১৯১৭ ) তাঁর Indian Pandits in the Land of Snow-তে জানিয়েছেন, অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে বাংলার বহু পণ্ডিত বৌদ্ধধর্ম সংস্কার করার জন্যে তিব্বতে আমন্ত্রিত হন। এই সময়ই অষ্টম শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাঙালি বৌদ্ধ দার্শনিক আচার্য শান্ত রক্ষিত তিব্বত যান। শীলভদ্রের মতো তিনিও ছিলেন নালন্দা বিহারের অধ্যক্ষ। তিব্বতের জনগণ তাঁকে আচার্য ‘বোধিসত্ত্ব’ নামে সম্বোধন করেন। সেখানে তিনি বহু বছর অবস্থান করে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষকে বৌদ্ধ দর্শন ও নৈতিকতা শিক্ষা দিয়েছেন এবং সে সম্পর্কে গ্রন্থ রচনা করেছেন। শান্ত রক্ষিত নেপালেও বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। তাঁর দুটি গ্রন্থের নাম ‘মদ্যমকালঙ্কার- কারিকা’ ও ‘সত্যদ্বয়বিভঙ্গপঞ্জিকা’ বাংলা ভাষায় রচিত না হলেও, লেখক বাঙালি বলে আমরা গর্বিত।
শীলভদ্র, শান্তিদেব ও শান্ত রক্ষিতের পরে যে দার্শনিকের কথা উল্লেখ করব তাঁর নামটি এখন সকলেই জানেন। তিনি অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। দশম একাদশ শতাব্দীর এই দার্শনিকের নামে ঢাকায় একটি সড়ক আছে এবং সম্প্রতি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তিনি বিক্রমপুরের সন্তান, জন্ম আনুমানিক ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে। ১০৪০ অব্দে তিনি নেপাল হয়ে তিব্বত যান এবং সেখানে তিনি বুদ্ধের আবতার রূপে পূজিত হয়েছেন। হিন্দুদর্শন ও বৌদ্ধধর্মতত্ত্বে ছিল তাঁর অপার পাণ্ডিত্য। তিব্বতে যাবার আগে তিনি ছিলেন বিক্রমশিলা বিহারের অধ্যক্ষ। তিব্বতে তিনি বজ্রযান ও কালচক্রযান মতবাদ প্রচার করেন। বজ্রযানের মধ্যে দর্শন, রহস্যবাদ ও যৌনকলার সংমিশ্রন ঘটেছে, অন্যদিকে ভক্তদের বিশ্বাস কালচক্রযান হলো তাই যে-যান অবলম্বন করলে মৃত্যু থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। তাঁর যে সব গ্রন্থাবলির সন্ধান পাওয়া গেছে তার মধ্যে রয়েছে- ‘রত্নাকরস্তোদঘাট’, ‘বোধিপাঠপ্রদীপ পঞ্জিকা’, ‘ বোধিপাঠ প্রদীপ’ প্রভৃতি। তাছাড়া অতীশ দীপঙ্কর বহু সংস্কৃত গ্রন্থ তিব্বতের ‘ভোট’ ভাষায় অনুবাদ করেন। ১০৫৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি তিব্বতেই পরলোকগমন করেন। ধর্মনির্বিশেষে বাঙালি জাতি তাঁকে নিয়ে গর্বিত।
৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে পরবর্তী ছয় সাত’শ বছর বাংলাদেশে কাব্য ও জ্ঞানচর্চার প্রধান মাধ্যম ছিল সংস্কৃত, কয়েক প্রকারের প্রাকৃত এবং ‘ শৌরসেনী অপভ্রংশ’। শিল্প-সাহিত্য ও বিজ্ঞান-দর্শনের আলোচনায় বাঙালি পণ্ডিতগণ সংস্কৃত ভাষা ব্যবহার করতেন। সেকালের সৃষ্টিশীল ও মননশীল লেখকদের ‘চেষ্টা ছিল প্রাকৃতজনের কথ্যভাষাকে শুদ্ধ ও সংস্কৃত করিয়া ব্যাকরণসম্মত করিয়া নিজের বক্তব্যকে প্রকাশ করা। “এই শুদ্ধ, “সংস্কৃত’, ব্যাকরণসম্মত ভাষাই সংস্কৃত ভাষা। প্রাকৃতের চর্চা বাংলাদেশে বড় একটা হইত না।” [শাস্ত্রী] বৌদ্ধ পণ্ডিতরাও ‘শুদ্ধ সংস্কৃত না হয় প্রাকৃতাশ্রয়ী মিশ্র সংস্কৃত’ বা ‘ বৌদ্ধ সংস্কৃত’ ভাষায় লিখতেন।
পাল বংশ ও পাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ‘দুই এক শতাব্দী আগে’ থেকেই বাংলাদেশে জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শনের চর্চা ব্যাপকভাবে শুরু হয়। পাঁচ থেকে এগার শতাব্দী পর্যন্ত বাংলাদেশে বেদ, বেদান্ত, মীমাংসা, শ্রুতি, স্মৃতি প্রভৃতির চর্চা শুরু হয। জানা যায়, চার বেদের মধ্যে যজুর্বেদীয় বাজসনেয়ী শাখাই বেশি অধীত হতো। বড় বড় চতুষ্পাঠীগুলোয় পণ্ডিতরা বেদ, বেদান্ত, স্মৃতি, মীমাংসা প্রভৃতি আলোচনা করতেন। বাংলায় পাল রাজত্বে গৌড়পাদ বা গৌড়াচার্যের পর দর্শনশাস্ত্র সম্বন্ধে গ্রন্থ রচনা করে ‘সর্বভারতীয় খ্যাতি অর্জন’ করেছিলেন ন্যায়কন্দলী রচয়িতা শ্রীধর ভট্ট। তিনি আরো গ্রন্থ প্রণয়ন করেন তবে তা আজ আর টিকে নেই। তিনি ন্যায় বৈশেষিক দর্শনের একজন ভাষ্যকার ছিলেন। শ্রীধর ভট্টের সমসাময়িক ও সামান্য পরবর্তী বাঙালি দার্শনিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন উদয়ন ও গঙ্গেশ উপাধ্যায়। সেকালে বাংলায় বেদান্ত দর্শনের চেয়ে ন্যায় বৈশেষিক ও বৌদ্ধ দর্শনের চর্চাই বেশি হতো। এ সময়ের আর একজন ন্যায়-দর্শন বিশেষজ্ঞের নাম অভিনন্দ। তের শতকের দুজন বিশিষ্ট বৌদ্ধ দার্শনিক-পণ্ডিত হলেন মৈত্রেয় রক্ষিত ও জিনেন্দ্রবুদ্ধি। দুর্ভাগ্য আমাদের যে তাঁদের কারো জীবন সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না, শুধু তাঁদের কিছু কিছু রচনা এখনো টিকে আছে।
অতীশ দীপঙ্করের প্রায় সমসাময়িক ছিলেন বিক্রমশীল বিহারের আচার্য জ্ঞানশ্রী মিত্র। জন্মগতভাবে ছিলেন হীনযানী বৌদ্ধ, পরে তিনি মহাযানে দীক্ষা নেন। তাঁর বৌদ্ধ-ন্যায় সম্বন্ধীয় গ্রন্থ কার্যকরণ-ভাবসিদ্ধি। চৌদ্দ শতকের আচার্য মাধব রচিত সর্বদর্শনসংগ্রহে জ্ঞানশ্রী মিত্রের রচনার আলোচনা রয়েছে। এই সময়ের আর একজন বিখ্যাত বৌদ্ধ দার্শনিক হলেন অভয়াকর গুপ্ত। তন্ত্রশাস্ত্রে তাঁর কাজ অসামান্য। তিনি অন্তত ‘বিশখানা বজ্রযানী গ্রন্থের রচয়িতা’।
তের চৌদ্দ শতক পর্যন্ত বৌদ্ধ দার্শনিকগণ প্রায় সকলেই ছিলেন বাঙালি, মূল বাংলাদেশ ও বর্তমান বিহারের অংশবিশেষে ছিল তাঁদের বসবাস। মহাযান, বজ্রযান, মন্ত্রযান প্রভৃতি সম্পর্কে বিপুল রচনা তাঁরা সৃষ্টি করেন সংস্কৃত ভাষায়। তার কিছু কিছু তিব্বতী ভাষায় অনুদিত হয়েছিল।
২.
একেশ্বরবাদী ধর্মকে শুরুতে ভাগবত ধর্ম বলা হতো, পরে বৈষ্ণবধর্ম নামকরণ হয় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উপাস্য দেবতাদের বিষ্ণুর সঙ্গে সমীকরণের ফলে। বৈষ্ণবধর্মের উদ্ভব হয় পশ্চিম ভারতে, কিন্তু তা বিকশিত হয় বঙ্গে। একেশ্বরবাদ ঐতিহাসিক ও সামাজিক বিবর্তন পদ্ধতিরই এক ধরনের পরিণতি। এক ও অদ্বিতীয় সর্বশক্তিমান ঈশ্বর জগতের উপর প্রভূত্ব করেন, রাষ্ট্রের সর্ব ক্ষমতার অধিকারী রাজাও তাই করেন। এ জন্যে একেশ্বরবাদী বৈষ্ণবধর্ম ও শৈবধর্ম বাংলায় রাজানুকূল্য পেয়েছে, যেমন অন্যত্র পেয়েছে ইসলাম ও খ্রিষ্টধর্ম। অদ্বিতীয় স্রষ্টাকে নিঃশর্ত ভক্তি রাজাকে ভক্তিরই উচ্চতর রূপ বৈষ্ণবধর্ম বাংলাসহ পূর্ব ভারতে রাজতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হওয়ায় শাসকদের অসামান্য আনুকূল্য পেয়েছে।
দক্ষিণ ভারতে বৈষ্ণব ধর্মের প্রসার ঘটেছিল অতি প্রাচীনকালেই। গুপ্ত বংশীয় রাজারা ছিলেন বৈষ্ণবধর্মের পৃষ্ঠপোষক। রামানুজ, নিম্বার্ক, মঞ্চ, বল্লভ দক্ষিণের একেশ্বরবাদী ধর্মনেতা। বাংলায় চৈতন্যদেব। তাঁর জন্ম ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে নবদ্বীপে, মাত্র ৪৭ বছর বয়সে তাঁর অকালমৃত্যু ঘটে। তাঁর পিতামহের আদি নিবাস সিলেট। স্বল্পায়ু জীবনেই তিনি প্রেমোন্মাদনাময় রাধাকৃষ্ণের ভক্তিরসে গোটা দেশ প্লাবিত করেন। তাঁর প্রবর্তিত প্রেমধর্মে ব্রাহ্মণ-চণ্ডালের ভেদাভেদ ছিল না। অ-হিন্দুদের জন্যেও তাঁর দরোজা উন্মুক্ত ছিল। চৈতন্যদেব নিজে কোনো তত্ত্বমূলক গ্রন্থ প্রণয়ন না করলেও গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ ‘দশমূল- শ্লোক’-কে শ্রীচৈতন্যের নিজস্ব রচনা বলে মনে করেন। তাঁর সমসাময়িক ও তাঁর অনুসারী ও শিষ্যগণ বাংলাসহ বিভিন্ন ভাষায় তত্ত্বমূলক বহু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণব দার্শনিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অচ্যুতানন্দ, গোপাল ভট্ট, প্রবোধানন্দ, মুরারি গুপ্ত, শ্রীজীব গোস্বামী, বৃন্দাবন দাস, জয়ানন্দ, কৃষ্ণদাস কবিরাজ প্রমুখ।
দশমূল-শ্লোক থেকে প্রতীয়মান হয় চৈতন্যদেবের বৈষ্ণবধর্ম এক ধরনের ‘ভেদাভেদবাদ’ যা নিম্বার্কের দ্বৈতাদ্বৈতবাদের নিকটবর্তী। এই মতবাদ ‘অচিন্ত্যভেদাভেদ’ নামেও পরিচিত। শঙ্কারাচার্যের নির্গুণ ব্রহ্মই একমাত্র পরম সত্য- এই মতবাদের বিরোধী চৈতন্যদেব ও তাঁর অনুসারীরা। তাঁদের মতে, পরমসত্তা ব্রহ্ম হলেন এই বিশ্বজগতের প্রভু, সৃষ্ট জীবের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক প্রেমের। চৈতন্য প্রবর্তিত বৈষ্ণবধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সেখানে ঈশ্বর ও জীবকে কৃষ্ণ ও রাধা বলে ধারণা করা হয়। কৃষ্ণ পরমাত্মা যিনি অসীম ও পূর্ণ চৈতন্যস্বরূপ এবং জীবাত্মা রাধা তাঁর মানবিক অংশ। কৃষ্ণের প্রধান শক্তি প্রেম, রূপবতী ও গুণবতী রাধা তাঁর প্রেমের মূর্ত প্রতীক। পরমের সঙ্গে তাঁর অংশের ভেদ নেই বটে, কিন্তু জীবাত্মার পৃথক অস্তিত্বের দরুন একটা ভেদের ব্যাপারও অস্বীকার করা যায় না। সেজন্যেই গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতবাদকে ‘ভেদাভেদবাদ’ বলে।
অনেকের মতো রবীন্দ্রনাথেরও ধারণা, ‘চৈতন্যের আবির্ভাবে বাংলাদেশে বৈষ্ণবধর্ম যে হিল্লোল তুলেছিল সে একটা শাস্ত্রছাড়া ব্যাপার। তাতে মানুষের মুক্তি পাওয়া চিত্ত ভক্তিরসের আবেগে আত্মপ্রকাশ করতে ব্যাকুল হল। সেই অবস্থায় মানুষ কেবল স্থাবরভাবে ভোগ করে না, সফলভাবে সৃষ্টি করে। এইজন্য সেদিন কাব্যে ও সংগীতে বাঙালি আত্মপ্রকাশ করতে বসল’। [দেশ, মার্চ ৬, ১৯৯৯]
দর্শনচর্চার ক্ষেত্রে নবদ্বীপ ছিল মধ্যযুগে বাংলার অক্সফোর্ড, ফ্লোরেন্স বা বার্লিন 1 চৈতন্যদেব ও তাঁর সমসাময়িক রঘুনাথ শিরোমণি ও কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের অর্ধ শতাব্দী আগেও বাংলায় ষড়দর্শনের চর্চা হতো। বৃন্দাবনদাস ঠাকুর (১৫০৭-১৫৮৯) তাঁর ‘শ্রীচৈতন্য ভাগবত’-এর চৈতন্যপূর্ব নবদ্বীপের যে অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন তাতে জানা যায় সেখানে নব্য-ন্যায়ের চর্চা শুরুর আগেও অন্যান্য দর্শনশাস্ত্রের চর্চা বাঙালি পণ্ডিতগণ করতেন, তবে তা বাংলায় নয় সংস্কৃত ভাষায়।
পনের ষোল শতকের বাঙালি মনীষা দর্শনশাস্ত্রের আলোচনায় অসামান্য মৌলিকতা ও বিপুল সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দিয়েছে। পনের শতকের শেষ নাগাদ বাংলায় এক নবজাগরণের সৃষ্টি হয়। তখন নবদ্বীপে রঘুনাথ ভট্টাচার্য স্মৃতিশাস্ত্র; হুগলীতে রঘুনন্দন দাস গোস্বামী, নবদ্বীপে রঘুনাথ শিরোমণির নব্য-ন্যায়, চৈতন্যদেবের প্রেমধর্ম, কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের তন্ত্র-সংস্কার ব্যাপকভাবে চর্চা হয়েছিল। আগে নব্য-ন্যায়ের চর্চা শুধু মিথিলায় হতো, পনের শতক থেকে নবদ্বীপের নৈয়ায়িক ও দার্শনিক পণ্ডিতগণ দর্শন আলোচনায় এক নতুন যুগের সূচনা করেন।
নবদ্বীপে নব্য-ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাতা কে তা নিয়ে কিছু মতপার্থক্য রয়েছে। বাসুদেব সার্বভৌমকেই সে স্বীকৃতি দিতে হয়। তবে মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্নের (১২৪২-১৩১২) মতে, কুসুমাঞ্জলি-র অন্যতম ব্যাখ্যাকার রামচন্দ্র সিদ্ধান্তবাগীশই নবদ্বীপের আদি নৈয়ায়িক। বাসুদেবের স্থান তাঁর অব্যবহিত পরে। তারপর তাঁর ছাত্র রঘুনাথ শিরোমণি আরো বিস্তারিতভাবে ভারতীয় দর্শনের এই শাখাটি আলোচনা করেন।
বাসুদেব সার্বভৌম মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি দার্শনিক। তাঁর জন্ম ১৪৩৫-৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। তাঁর মতো নৈয়ায়িক, বৈদান্তিক ও ষড়দর্শনে পণ্ডিত মধ্যযুগে আর কেউ ছিলেন না। পণ্ডিত পরিবারেই তাঁর জন্ম, বাসুদেবের পিতামহ নরহরি বিশারদ একজন শাস্ত্রবিদ ছিলেন। বাসুদেব মিথিলার পক্ষধর মিশ্রের কাছে ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়ন শুরু করেন। সেখানে সর্বোচ্চ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ‘সার্বভৌম’ উপাধি পান। নৈয়ায়িক রঘুনাথ শিরোমণি ও অনুমানমনিব্যাখ্যা গ্রন্থের লেখক কণাদ তাঁর ছাত্র ছিলেন। জীবনের শেষ দিকে তিনি উড়িষ্যার রাজা পুরুষোত্তম দেবের পুত্র রাজা প্রতাপরুদ্র দেবের সভাসদ ছিলেন। চৈতন্যদেবের পিতা জগন্নাথ মিশ্র ছিলেন বাসুদেবের পিতৃতুল্য। চৈতন্যজীবনী থেকে জানা যায়, তিনি জগন্নাথ দেবের মূর্তি দেখে প্রেমবিহ্বল অবস্থায় অচেতন হয়ে পড়লে, হঠাৎ সেখানে সার্বভৌম উপস্থিত হয়ে তাঁকে নিজের গৃহে নিয়ে আসেন এবং সেবা করে সুস্থ করেন। পুরীতে তাঁদের মধ্যে ধর্মালোচনা হয়েছে বলে অনেক গ্রন্থে উল্লেখ আছে। একদিন বাসুদেব চৈতন্যদেবকে প্রশ্ন করেন, তাঁর মতো সুপণ্ডিত কেন সন্ন্যাস গ্রহণ করেছেন? তখন প্রত্যুত্তরে-
প্রভু বোলে শুন সার্বভৌম মহাশয়।
সন্ন্যাসী আমারে নাহি জানিহ নিশ্চয় ॥
কৃষ্ণের বিরহে মুঞি বিক্ষিপ্ত হইয়া।
বাহির হইলূঁ শিখাসূত্র মুড়াইয়া ॥
বাসুদেবের ছাত্রদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক ও নৈয়ায়িক ছিলেন রঘুনাথ শিরোমণি। তিনি ছিলেন খ্যাতনামা স্মৃতিশাস্ত্রবিদ মূলপাণি মহামহোপাধ্যায়ের দৌহিত্র। রঘুনাথের জন্ম পনের শতকের প্রথমার্ধে। তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে একজন চৈতন্যদেব। রঘুনাথের অবিস্মরণীয় গ্রন্থ অনুমানদীধিতি। তাঁর এই দর্শনগ্রন্থটি ওজনের দিক থেকে অনেকটা দেকার্তে, বেকনের গ্রন্থাবলির সঙ্গে তুলনীয়। রঘুনাথের অন্যান্য অমূল্য গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রত্যক্ষমণিদীধিতি, শব্দমণিদীধিতি, দ্রব্যকিরণাবলীপ্রকাশদীধিতি, গুণকিরণাবলীপ্রকাশ দীধিতি, আত্মতত্ত্ববিবেকদীধিতি, অখ্যাতবাদ, নঞবাদ, পদার্থখণ্ডন প্রভৃতি।
ষোল শতকের আর একজন শ্রেষ্ঠ দার্শনিক রঘুনাথ ভট্টাচার্য। তাঁর পিতা হরিহর ভট্টাচার্যও ছিলেন একজন বিশিষ্ট স্মৃতিশাস্ত্রবিদ। হিন্দুসমাজের সঙ্গে স্মৃতি শাস্ত্রের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। হিন্দুর ধর্ম, অধর্ম, কর্তব্য, অকর্তব্য অর্থাৎ জীবনাচরণ সম্পর্কিত সব বিষয় স্মৃতিশাস্ত্রের উপজীব্য। প্রাচীন হিন্দুসমাজের নেতা আর্য ঋষিগণ একবাক্যে শ্রুতি ও স্মৃতিকে ব্রাহ্মণের দুইটি চক্ষু বলিয়া মনে করিয়াছেন।’ বাঙালি হিন্দুসমাজের নানা অবক্ষয় প্রতিরোধ করতে রঘুনাথের রচনাবলি সেকালে অত্যন্ত সহায়ক হয়েছিল। তাঁর অমর কীর্তি অষ্টাবিংশতিতত্ত্বস্মৃতিগ্রন্থ। স্মৃতিশাস্ত্রে তাঁর অতুলনীয় পাণ্ডিত্যের জন্য লোকে তাঁকে ‘স্মার্ত ভট্টাচার্য’ বলে সম্বোধন করত।
ষোল, সতের ও আঠার শতকের বহু নৈয়ায়িকের নাম এবং তাঁদের দার্শনিক গ্রন্থাবলির পরিচয় ড. সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ (১৮৭০-১৯২০) তাঁর অবিস্মরণীয কাজ History of Indian Logic (১৯২২)-এ দিয়েছেন। ওই নামের তালিকার দিকে তাকালে বোঝা যায় তিন শতাব্দীব্যাপী বাঙালি কি ব্যাপকভাবে যুক্তিবিদ্যা ও দর্শনের চর্চা করেছেন। সতীশচন্দ্রের গ্রন্থটি বাঙালির দর্শনের এক মূল্যবান ইতিহাস। তবে দার্শনিকদের কালনির্ণয়ে তিনি অনেক ক্ষেত্রে অনুমানের উপর নির্ভর করেছেন বলে পরবর্তীকালের কোনো কোনো পণ্ডিত মনে করেন।
সতের শতকে মতুরানাথ তর্কবাগীশ ‘মাথুরী’ এবং জগদীশ তর্কালঙ্কার ‘জগদীশী’ নামক ভাষ্য রচনা করে বাঙালির দর্শনচর্চায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেন। জগদীশ ছিলেন চৈতন্যদেবের শ্বশুর সনাতন মিশ্রের অধঃস্তন পুরুষ, সেজন্যে সেকালে তাঁর মর্যাদা ছিল অনেক বেশি। সতের শতকের আর একজন নব্য-নৈয়ায়িক গদাধর ভট্টাচার্য তাঁর ‘গদাধরী টীকাভাষ্যের জন্যে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি বগুড়া জেলার অধিবাসী ছিলেন। গদাধরের একটি গ্রন্থের নাম ব্যুৎপত্তিবাদ এটির ১৬২৫ সালে হাতে-লেখা একটি কপি উদ্ধার করা গেছে।
দর্শনের ক্ষেত্রে মধ্যযুগে নবদ্বীপের স্থানই শীর্ষে, তবে সমগ্র বাংলায়ই দর্শনের চর্চা হতো। বিশেষ করে ১৪ থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত সময়ে ঢাকার বিক্রমপুর, ফরিদপুরের কোটালীপাড়া, এবং কৃষ্ণনগরের খানাকূল, বাকলা, চন্দ্রদ্বীপ, ভট্টপল্লী, বালি প্রভৃতি স্থানে ব্যাপকভাবে দার্শনিক জ্ঞানের আলোচনা হতো। উত্তরবঙ্গে ও চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, কুমিল্লায়ও দর্শনচর্চা হয়েছে।
নবদ্বীপের পরেই ছিল কোটালিপাড়ার স্থান। এখানকার রামচন্দ্র ন্যায়বাগীশ ছিলেন একজন অসাধারণ নব্য-ন্যায় দার্শনিক। জগদানন্দ তর্কবাগীশ প্রমুখ অন্তিম-মধ্যযুগের মানুষ। আঠার শতকে যাঁদের আবির্ভাব তাঁদের মধ্যে রয়েছে চন্দ্রনাথ তর্কালঙ্কার, কুলচন্দ্র শিরোমণি, আশুতোষ তর্করত্ন, নারায়ণ তর্করত্ন, শশধর তর্কচূড়ামণি প্রমুখ। বাংলা ভাষায় ষড় দর্শনের উপর যাঁরা প্রথম গ্রন্থ প্রণয়ন করেন তাঁদের একজন জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন (১৮০৬-১৮৭২), তাঁর একটি গ্রন্থের নাম সর্বদর্শনসংগ্রহ (১৮৬১)। পদার্থতত্ত্বসার-সহ তিনি আরো অনেক গ্রন্থের প্রণেতা।
অত্যন্ত গৌরবের সঙ্গে আমি আঠার শতকের দু’জন মহিলা দার্শনিকের নাম করব, তাঁরা হলেন বৈজয়ন্তী দেবী ও প্রিয়ম্বদা দেবী। বৈজয়ন্তী দেবীর স্বামীর একটি কাব্যগ্রন্থ রয়েছে, নাম আনন্দলতিকা। তাঁর পিতাও ছিলেন একজন দার্শনিক। প্রিয়ম্বদা দেবীর পিতা শিবরাম সার্বভৌম ছিলেন একজন বড় পণ্ডিত এবং স্বামী রঘুনাথ মিশ্রও দার্শনিক ছিলেন। প্রিয়ম্বদা মীমাংসাদর্শনে অসামান্য পাণ্ডিত্যের অধিকারিণী ছিলেন। বৈজয়ন্তী ও প্রিয়ম্বদা উভয়েই গোপালগঞ্জের অধিবাসী।
৩.
দুর্ভাগ্য বাঙালির যে মধ্যযুগের মুসলমান তত্ত্বজ্ঞানী বা দার্শনিকদের সম্পর্কে বস্তুত তেমন কিছুই লেখা হয়নি। সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁরা যদি-বা কিছুটা স্থান পেয়ে থাকেন, বাঙালির দর্শনচিন্তার ইতিহাসে তাঁরা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত বা অপাংক্তেয়। তাঁরা টোলের পণ্ডিতদের মতো শুধু গ্রন্থকীট ছিলেন না, শাস্ত্র নিয়ে শুধু ভাষাগত তর্ক করেননি, তাঁরা রবীন্দ্রনাথের মতো স্বাধীন তত্ত্বজ্ঞানী।
ষোল শতকের কবি আবদুল হাকিম জাগতিক ও অতীন্দ্রিয় জ্ঞানের আলোকে জীবনের অন্ধকার দূর করার উপর জোর দিয়ে বলেছেন- ‘এলেম প্রদীপে নাশ ঘর অন্ধকার।’ আবদুল হাকিম ছিলেন এমন একজন একেশ্বরবাদী যিনি শাস্ত্রনিরপেক্ষ, ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক। কবীর বা দাদুর চিন্তার সঙ্গে তাঁর কোনো দূরত্বই নেই। তিনি বলেন : সর্বগুণের আধার স্রষ্টা একজনই, তিনি হিন্দু-মুসলমান সকলের, তাঁকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন। তিনি তাঁর নূরনামা-য় বলেন,
আল্লা-খোদা-গোঁসাই সকল তার নাম।
সর্বগুণে নিরঞ্জন প্রভু গুণধাম।
মধ্যযুগের কবি সৈয়দ সুলতানও একজন সুফী ও তত্ত্বজ্ঞানী বা দার্শনিক ছিলেন। তাঁর জ্ঞান-চৌতিশা অসামান্য চিন্তামূলক ও নীতিতত্ত্বে পরিপূর্ণ গ্রন্থ। তিনি রচনা করেছেন সাধনতত্ত্বানুগ পদাবলী। তিনি ও তাঁর মতো অনেকেই ‘ভাল মানুষ্যের’ সাধনা করেছেন এবং তাদের ‘তরে’ই পয়ার রচনা করেছেন। তিনি ছিলেন একজন ইসলামি তত্ত্বজ্ঞানী, তবে তাঁর মাধ্যম কবিতা। সৈয়দ সুলতান তত্ত্বজ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে দুর্লভ মানবজীবনকে সার্থক করার উপর জোর দিয়েছেন :
আএ ভাই শাস্ত্র পড়ি করহ আমল
মানব দুর্লভ জন্ম না হইয়া বিফল।
মুসলমানসমাজের লৌকিক তত্ত্বকথা তাঁর রচনায় পাওয়া যায়। একেশ্বরবাদী সৈয়দ সুলতান চেয়েছেন সাধনার মাধ্যমে ‘ভবের জনম’ সার্থক করতে। তিনি বলেন,
শরিয়ত তরিকত কিবা হকিকত।
সাধিয়া এ সব অর্জিবারের মারকত।
সাফল্য করিতে নিজ ভবের জনম।
সবেরে জানিব মুখ্য আপ্ত জানি কম ॥
সৈয়দ সুলতান ছিলেন এক ধরনের সর্বেশ্বরবাদী। বিশ্বচরাচরে সর্বত্র তিনি নিরাকার আল্লার অস্তিত্ব দেখতে পেয়েছেন। তাঁর নিজের ভাষায় ‘ঘটে ঘটে ব্যাপিত আছ এ নৈরাকার’। হিন্দু অদ্বৈতবাদদের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য কোথায়?
আঠার শতকের চিন্তক-কবি আলি রজা বা রাজা ছিলেন মানবপ্রেমিক। তিনি ‘ধনের বদলে প্রেম’ প্রত্যাশা করেছেন। সে প্রেম ঈশ্বরেরও প্রেম, মানুষেরও প্রেম। তাঁর কাছে প্রেমের মূল্য সীমাহীন। তিনি বৈষ্ণবদের মতোই বলেন :
পিরীতি অমৃত ফল না পাকে না ঝরে।
পিরীতি কণ্ঠের মালা মরণে না ছাড়ে।
বৌদ্ধ শূণ্যবাদের মতোই অনেক মুসলমান তাত্ত্বিকের চিন্তা। মধ্যযুগের একজন মুসলমান তত্ত্বসাধক বলেন :
দেখিতে না পারি যারে তারে বলি শূণ্য।
তাহারে চিনিলে দেখি পুরষ হএ ধন্য!
মধ্যযুগের মুসলমান তত্ত্বজ্ঞানীরা যেমন জ্ঞানলব্ধ সত্যের সন্ধান করেছেন, তেমনি তাঁরা তাঁদের ধর্মীয় বিশ্বাসকেও বাতিল করেননি। তবে তাঁরা শাস্ত্রের উপর জোর কম দিয়েছেন, আধ্যাত্মিক চিন্তার উপর জোর দিয়েছেন বেশি।
৪.
বাউল দর্শন বাঙালির নিজস্ব সম্পদ। তা মানবতাবাদী দর্শন, সম্পূর্ণ শাস্ত্রনিরপেক্ষ, কিন্তু তাতে ঘুরে ফিরে আসে বেদ, উপনিষদ, কোরআন, হাদিস, তন্ত্র, যোগ, বৌদ্ধ শূণ্যবাদ, সহজিয়া, সুফীতত্ত্ব প্রভৃতি সব শাস্ত্র ও মতবাদের কথাই। কারণ বিভিন্ন ধর্ম ও সব সম্প্রদায় থেকেই বাউলদের আবির্ভাব ঘটে। সত্যের সন্ধান করেছেন তাঁরা সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মধ্যেই। তারপর পৌঁছেছেন নিজস্ব মতবাদে। বাউলদের ধর্ম যদি থাকে তা হলে তা মানবধর্ম যার মূল বাণী হলো প্রেম। বাউলরা প্রেমের পথেরই পথিক। মুসলিম সুফীদের সঙ্গে তাঁদের মিল আছে, হিন্দু বৈষ্ণবদের সঙ্গেও মিল আছে। যোগদর্শনের অনেক উপাদানও তাঁদের চিন্তায় উপস্থিত। তাঁরা কোনো বিশেষ ধর্ম-বর্ণে বিশ্বাসী নন। তাই হিন্দু বাউলের মুসলমান শিষ্য, মুসলমান বাউলের হিন্দু শিষ্য। বস্তুত তাঁরা সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবুক। বাউলদের চিন্তায় ত্যাগ ও বৈরাগ্যের কথা খুব স্পষ্টভাবে আছে। সংসার জীবনে তাঁরা উদাসীন, কিন্তু প্রেমের ব্যাপারে উদার ও ধর্মবর্ণনিরপেক্ষ।
উনিশ শতকের বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ বাউল লালন সাঁই-এর (১৭৭৪-১৮৯০) অজস্র গানে বাঙালির উদার মানবতাবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার প্রকাশ ঘটেছে। তিনি মুসলমানের ঘরে জন্মেছিলেন না হিন্দুর ঘরে জন্মেছিলেন সে আলোচনা আজ অবান্তর। তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ সাধক এবং কবীর দাদু প্রমুখেরীর দাদুর উত্তরসূরী। তাঁর কিছু কিছু গান আজ সংগীতশিল্পীদের কল্যাণে খুবই জনপ্রিয়। যেমন তাঁর বিখ্যাত গানটি : ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে’। ধর্মীয় আচার ও সংস্কারের কারণে মানুষের মধ্যে যে ব্যবধান তা তিনি অস্বীকার করেছেন। তাই এই গানটিতে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, খাত্না করলে যদি মুসলমান হয় তা হলে মেয়েলোকের কী উপায়, পৈতা দিলে যদি ব্রাহ্মণকে চেনা যায় তা হলে ব্রাহ্মণী চেনার ব্যবস্থা কী? লালন পরম সত্তার সন্ধান করেছেন, তবে কোনো শাস্ত্রীয় পথে নয়, আত্মজ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে। তিনি বলেন,
কারে আর সুধাই সে কথা,
কোন্ সাধনে পাব তারে, যে আমার জীবনদেবতা।
‘জীবনদেবতা’ পদটি কি রবীন্দ্রনাথ লালনের কাছ থেকে নিয়েছেন? হতে পারে ধর্মীয় শাস্ত্র, উপাসনালয় প্রভৃতি তাঁর কাছে অবান্তর মনে হয়েছে। মানুষই তাঁর কাছে মুখ্য। তাঁর ভাষায়,
মানুষ তত্ত্ব সত্য যার মনে।
অন্য রূপ সে কি মানে।
মাটির টিপি, কাঠের ছবি, ভূত ভাবনা, দেবাদেবী,
ভোলে না সে কোন্ ভোলে, মানুষ রতন চেনে।
সুফীদের আধ্যাত্মজ্ঞানের মতোই বাউলদের আত্মজ্ঞান। আধুনিক অস্তিত্ববাদীদের সঙ্গেও বাউলদের অনেক মিল রয়েছে। দেহের আধারে আত্মার অবস্থান। তাঁরা দেহ ও আত্মা দুটোকেই জানার উপর জোর দেন। লালন শাহের কঠিন প্রশ্ন—
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।
ধরতের পারলে মন-বেড়ী দিতাম তাহার পায়।
বাংলাদেশে বাউল সাধক ও লোককবিদের মধ্যে লালন ছাড়াও রয়েছেন অনেকে, যেমন শেখ মদন, পাগলা কানাই, পাঞ্জু সাঁই, সৈয়দ শাহনূর প্রমুখ। বাউল গান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘এ হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই; একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি।… এ গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠ মিলেছে। কোরানে- পুরাণে ঝগড়া বাধেনি।’ [আহমদ শরীফ, বাঙালি ও বাঙলা সাহিত্য, পৃ. ১১৫]
লোককবি-দার্শনিকদের মধ্যে লালন শাহের মতো হাসন রাজাকেও উপেক্ষা করার উপায় নেই। দার্শনিক অভিসন্দর্ভ রচনার মাধ্যমে নয় সংগীতের মাধ্যমে তাঁরা উভয়েই জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তাঁদের অনুভূতি ও চিন্তা প্রকাশ করেছেন। হাসন রাজা শুরু থেকেই এই জগতের আদি ও পরম সত্তাকে উপলব্ধি করার জন্য বিভিন্ন পথ বা মাধ্যম গ্রহণ করেন। মুসলমানের ঘরে জন্ম তাই প্রথমে ছিল তাঁর ইসলামি প্রত্যয়। তারপরে প্রেম। তারপরে বৈরাগ্য। এবং সবশেষে তাঁর নিজের সত্তার মধ্যে আদি সত্তার সন্ধান পেয়েছেন। তাই তিনি বলেন,
রূপ দেখিলাম রে নয়নে,
আপনার রূপ দেখিলাম রে।
আমার মাঝেতে বাহিরিয়া দেখা দিল আমারে।
আর একটি গানে তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ ভাষায় বলেন-
মম আঁখি হইতে পয়দা আসমান জমিন,
কর্ণেতে হইল পয়দা মুসলমানি দীন।
শরীলে করিল পয়দা শক্ত আর নরম,
আর পয়দা করিয়াছে ঠাণ্ডা ও গরম।
নাকেতে করিল পয়দা খুশ্বয় বদ্বয়,
আমি হইতে সর্বোৎপত্তি হাসন রাজায় কয়।
হাসন রাজার গান রবীন্দ্রনাথ প্রথমে ১৯২৫ সালে ভারতীয় দর্শন কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার সময় তাঁর সভাপতির বক্তৃতায় ইংরেজিতে অনুবাদ করে বলেছিলেন। পরে ১৯৩১-এ অক্সফোর্ডে হিবার্ট লেকচারে এবং শেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কর্তৃক তাঁর কন্যার নামে প্রতিষ্ঠিত স্মারক বক্তৃতায় উল্লেখ করেছিলেন। হাসন রাজাকে আমরা বলতে পারি এক ধরনের সর্বেশ্বরবাদী। তবে তাঁর সর্বেশ্বরবাদ তাঁর একেবারেই নিজস্ব, স্পিনোজার প্যানথেইজমের মতো নয়। পরিশেষে তিনি ব্যক্তি- কেন্দ্রিক সর্বেশ্বরবাদ পরিত্যাগ করে বলেছেন,
হাসন রাজায় কয়
আমি কিছু নয় রে আমি কিছু নয়,
যে দিকে তাকাই দেখি তুমি দয়াময়।
৫.
আগেই বলেছি উনিশ শতকের পূর্ববর্তী প্রায় দেড় হাজার বছর বাঙালি দার্শনিকদের দর্শন চর্চার মাধ্যম ছিল সংস্কৃত ভাষা। মধ্যযুগে মুসলিম শাসনের মধ্যে ফার্সি এবং আরবিতেও কিছু কাজ হয়েছে। উনিশ শতক থেকে বাঙালির দর্শন চর্চার প্রধান মাধ্যম হয় ইংরেজি ও বাংলা। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বাংলা গদ্য দ্রুত শক্তি অর্জন করার সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতের পরিবর্তে বাংলায় দর্শন আলোচনার দরোজা খুলে যায়। গত পৌনে দু’শ বছরে অসংখ্য বাঙালি লেখক বৌদ্ধ ও হিন্দু-দর্শনের কঠিন ও জটিল বিষয়গুলি বাংলায় বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থের টীকা ও ভাষ্য রচনা শুরু হয় বাংলা ভাষায়। বলাই বাহুল্য, এই সব রচনা মূলত হিন্দু ধর্মতত্ত্ব বা theology; এগুলিকে তত্ত্ববিদ্যা বা pure metaphysics বলা যাবে না। বাংলার মাটিই ভাববাদের শক্ত ঘাঁটি। যুক্তি নয় ভক্তিই এ সমাজে প্রাধান্য পায়। এক সাধক কবির ভাষায় : ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহু দূর’। সাধারণ মানুষ বিশ্বাসে পরিচালিত হলেও, সংস্কৃত পণ্ডিতগণ তর্কে ছিলেন ক্লান্তিহীন।
গত পৌনে দু’শ বছরে খ্যাতিমান লেখকদের বাইরে অসংখ্য অজ্ঞাত অপরিচিত ব্যক্তি, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাবুক সাধক সন্নাসীরা হাজার হাজার বই ও নিবন্ধ লিখেছেন; যার প্রায় সবই বেদ-বেদান্ত ও গীতা এবং বৈষ্ণবধর্ম সম্পর্কিত। তাছাড়া বহু হিন্দু সাধু-সন্ত ও সংসার বিবাগী ব্যক্তি জগৎ, জীবন ও স্রষ্টা সম্পর্কে তাঁদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও আধ্যাত্মিক উপলব্ধি প্রকাশ করেছেন তাঁদের কথায় ও লেখায়। সেগুলো pure metaphysics নয় বটে তবে এক ধরনের ফিলসফি। তাতে জীবনের রহস্য সম্পর্কে অনেক প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। এই সব হাজার হাজার ভক্তিমূলক গ্রন্থে শুধু যে ঈশ্বরপ্রেমের গভীর প্রকাশ ঘটেছে তাই নয়, এ গুলোতে সামগ্রিকভাবে বাঙালি হিন্দুর দর্শনচিন্তার পরিচয়ও পাওয়া যায়। কুড়ি শতকের আগের বাঙালি দর্শন মূলত ধর্মদর্শন, বিশেষ করে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মতত্ত্ব অথবা জৈন ধৰ্ম, ভাগবত বা বৈষ্ণব ধর্ম, শৈব ধর্ম, শাক্ত ধর্ম ও তন্ত্র। কুড়ি শতকে কিছু দার্শনিক আলোচনা হয়েছে ইসলামি দর্শন, সুফিবাদ, খ্রিস্টধর্ম প্রভৃতি সম্পর্কেও। সেই সঙ্গে তাঁরা আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শন আলোচনায়ও মনোযোগ দেন।
‘আধুনিক ভারতের জনক’ রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) বাংলা গদ্য ভাষায় দর্শনচর্চারও জনক। হুগলীর খানাকুলে জন্ম, রামমোহনকে দিল্লীর বাদশা মোহাম্মদ আকবর ১৮২৯ সালে ‘রাজা’ উপাধি দেন। ১৮৩১-এর এপ্রিলে তিনি বাদশার দূত হিসাবে ইংলন্ড যান এবং সেখানেই পরলোকগমন করেন। রামমোহন ছিলেন তাঁর কালের সবচেয়ে প্রগতিশীল মানুষ এবং বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তাঁর কাছে বাঙালি জাতির ঋণ কোনোদিন পরিশোধ হবে না। সংস্কারক হিসেবে তাঁর তুলনা শুধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। আরবি, ফার্সি, সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষায় তাঁর সমান অধিকার ছিল। ১৮০৩ সালে বেরোয় তাঁর ফারসিগ্রন্থ ‘তুহফাত-উল মুওয়াহিদ্দীন’– একটি ধর্মতত্ত্বমূলক গ্রন্থ। আরবি দর্শনশাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা, ধর্মতত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান প্রভৃতি তিনি গভীরভাবে পাঠ করেন। ১৮১৫ থেকে তাঁর বেদান্তসূত্র, বেদান্তসার, তলবকার উপনিষৎ, ঈশোপনিষৎ, কঠোপনিষৎ, মাণ্ডূক্যোপনিষৎ প্রভৃতি বইগুলি বেরুতে থাকে। মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের (১৭৬২-১৮১৯) বেদান্ত চন্দ্রিকা- র উত্তরে তিনি লেখেন ভট্টাচার্যের সহিত বিচার (১৮১৭)। তিনি প্রমাণ করেন ব্রহ্ম অনাদি, অরূপ, নির্গুণ চৈতন্যস্বরূপ। বাংলার নবজাগরণের অগ্রদূত একেশ্বরবাদী রামমোহন ছিলেন উদার, অসাম্প্রদায়িক ও আন্তর্জাতিকতাবাদী। দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৯৪৬) প্রমুখের সঙ্গে ১৮২৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্রাহ্মসমাজ’।
রামমোহনের পরে বাঙালি হিন্দু সমাজে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৪) ছিলেন সবচেয়ে প্রভাবশালী ভাবুক ও ব্যক্তিত্ব। তিনি ‘সরস প্রেমের ব্রাহ্মধর্ম প্রচার করিয়া বাঙালি সমাজে এক নতুন দার্শনিক চিন্তার বিস্তার ঘটানোর পথ উন্মুক্ত করে দেন। তাঁর প্রণীত ব্রাহ্মধর্মগ্রন্থতে তাঁর দর্শন ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সর্বশক্তিমান এক ও অদ্বিতীয় ‘ঈশ্বরের দিকে হৃদয়’ তাঁর সর্বদা পড়ে থাকতো, ঈশ্বরকে অনুভব করতেন কর্মে, চিন্তায়, শত বিপদে-আপদে, সুখে-দুঃখে। তাঁর আত্মজীবনী অসামান্য সাহিত্যকর্ম, তবে তাঁর দার্শনিক গ্রন্থের মধ্যে আত্মতত্ত্ববিদ্যা (১৮৫২), ব্রাহ্মধর্মের মত ও বিশ্বাস (১৮৬০), কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজের বক্তৃতা (১৮৬২), ব্রাহ্মধর্মের ব্যাখ্যান (১৮৬১) এবং জ্ঞান ও ধর্মের উন্নতি (১৮৯৩) প্রভৃতিতে তাঁর গভীর আধ্যাত্মবোধের সাক্ষর রয়েছে। ঋষিপ্রতিম দেবেন্দ্রনাথকে ‘মহর্ষি’ আখ্যায়িত করা হয়।
ব্রাহ্মনেতাদের মধ্যে মতপার্থক্য ও মনোমালিন্য সৃষ্টি হলে ১৮৬৬-তে কেশবচন্দ্র সেনের (১৮৩৮-১৮৮৪) নেতৃত্বে ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ’-এর সৃষ্টি হয়। দেবেন্দ্রনাথের সমাজের নাম হলো ‘আদি ব্রাহ্মসমাজ’। কেশবচন্দ্র ‘নানা মত নানা পথ’ নীতিতে বিশ্বাস করতেন। উপনিষদের ব্রহ্মবাদিতা, খ্রিষ্টানধর্মের জন-কল্যাণবোধ, ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব, চৈতন্যের প্রেমময় ভক্তি, বুদ্ধের বৈরাগ্য, মানবতাবাদ ও বিজ্ঞান চেতনা, শাক্তের মাতৃভাব, সুফীদের মরমিয়াবাদ প্রভৃতি সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছিলেন কেশবচন্দ্র। তাঁর দার্শনিক চেতনা ছিল সমন্বয়বাদী। তাঁর ধর্মদর্শন ও নববিধান বাঙালির দর্শনচিন্তার ক্ষেত্রে অমূল্য সম্পদ।
৬.
উনিশ শতকে বাংলায় প্রধান মৌলিক দার্শনিক ছিলেন দু’জন- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪) এবং দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬)। প্রাচীন ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে তাঁদের উভয়েরই জ্ঞান ছিল অপার। আধুনিক ইংরেজি শিক্ষিত বঙ্কিম ইউরোপীয় দার্শনিকদের লেখাও পাঠ করেছেন। উনিশ শতকে তিনিই বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টিশীল ও মননশীল লেখক। আধুনিক বাংলা উপন্যাসের তিনি যেমন জনক তেমনি আধুনিক ভারতের এক নতুন চিন্তারও উদ্গাতা। আধুনিক ভারতে বিবেকানন্দ ও বঙ্কিমের ধর্মবিশ্বাস ও দর্শন-চিন্তার প্রভাবই সমাজে সবচেয়ে বেশি ও সুদূরপ্রসারী। তাঁর উপন্যাস আনন্দমঠ স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের বেদে পরিণত হলো। বৈদান্তিক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর দার্শনিক বঙ্কিমচন্দ্র গ্রন্থে বঙ্কিমের ধর্মতত্ত্ব প্রথমভাগ সম্পর্কে মন্তব্য করেন ‘বঙ্কিমের সর্বোত্তম দার্শনিক অবদান’ বলে। এতে মানবজীবনের সবচেয়ে জরুরি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে। তবে হিন্দুধর্মের গৌরব প্রচার করতে গিয়ে তিনি ক্ষতিও করেছেন যার ফল বহুজাতির ও বহু ধর্মাবলম্বী উপমহাদেশের মানুষ ভোগ করবে বহুকাল। বেদান্ত দর্শনের অদ্বৈতবাদ বা শঙ্কারাচার্যের মায়াবাদ নয় বঙ্কিম আস্থা স্থাপন করেছেন রামানুজ-শ্রীধর স্বামীর দ্বৈতবাদে। তাঁর মতে, জগতের সব কিছু নিয়েই ধর্ম। ধর্মতত্ত্বের অনুশীলন অধ্যায়ে তিনি বলেন, ‘অন্য জাতির বিশ্বাস সে, কেবল ঈশ্বর ও পরকাল লইয়া ধর্ম। হিন্দুর কাছে ইহকাল, ঈশ্বর, মনুষ্য, সমস্ত জীব, সমস্ত জগৎ-সকল লইয়া ধর্ম। এমন সর্বব্যাপী সর্বসুখময়, পবিত্র ধর্ম কি আর আছে?’ ভারতে হিন্দুত্বের ভয়াবহ পুনর্জাগরণে তাঁর ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি।
সবচেয়ে গভীর ও নিমগ্ন বাঙালি দার্শনিক হলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬), দেবেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠপুত্র। তিনি ছিলেন একজন বহুমুখী প্রতিভা, অসামান্য পণ্ডিত ও মৌলিক চিন্তাবিদ। বহুদিন ‘ভারতী’ ও ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’-র সম্পাদক ছিলেন। তাঁর স্বপ্নপ্রয়াণ কাব্যগ্রন্থটিও একটি দার্শনিক চিন্তার আধার। তাঁর দার্শনিক গ্রন্থগুলির মধ্যে চার খন্ড তত্ত্ববিদ্যা বাংলা ভাষার অক্ষয় কীর্তি। প্রথম জ্ঞানকাণ্ড (১৮৬৬), দ্বিতীয় ভোগকাণ্ড (১৮৬৭), তৃতীয় কর্মকাণ্ড (১৮৬৮) এবং চতুর্থ সাধন প্রকরণ (১৮৯) সব বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের ছাত্রদের অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত। দ্বিজেন্দ্রনাথের অন্যান্য দার্শনিক গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : সাধনা—প্রাচ্য ও প্রতীচ্য (১৮৯২), আর্য্যধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের পারস্পারিক ঘাত- প্রতিঘাত ও সংঘাত (১৩০৬ ), বিদ্যা ও জ্ঞান (১৯০৬), অদ্বৈতমতের সমালোচনা (১৩০৩), অদ্বৈতমতের প্রথম ও দ্বিতীয় সমালোচনা (১৩০৪), ব্রহ্মজ্ঞান ও ব্রহ্মসাধন (১৩০৬) প্রভৃতি। বাংলা ভাষায় আধুনিক দর্শনচর্চার ক্ষেত্রে দ্বিজেন্দ্রনাথ অন্যতম প্ৰধান পথিকৃৎ। জড়বাদ খণ্ডন করে ভারতীয় দর্শন ও ইউরোপীয় কান্ট হেগেলের মতবাদের সংমিশ্রনে দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁর নিজস্ব এক মৌলিক আধ্যাত্মদর্শন গড়ে তুলেছেন। মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন ঋষিতুল্য এবং নিজেকে মনে করতেন ‘ব্রাহ্ম-সম্প্রদায় অন্তর্গত হিন্দু’। অল্প কথায় দ্বিজেন্দ্রনাথের দার্শনিক চিন্তার পরিচয় দেওয়া অসম্ভব।
অরবিন্দ ঘোষ (১৮৭২-১৯৫০) আশৈশব জাতীয়তাবাদী, মধ্যজীবনে বিপ্লবী রাজনীতির গুরু, শেষজীবনে যোগী ও দার্শনিক। যোগ ও আধ্যাত্মিক সাধনায় সিদ্ধি অর্জনের ফলে তিনি ‘ঋষি’ আখ্যা পান। বাংলা ইংরেজিতে তিনি বহু গ্রন্থের প্রণেতা। তাঁর The Life Divine, Essays on Gita, The Renaissance in India, ধর্ম ও জাতীয়তা প্রভৃতি দার্শনিক তাৎপর্যে অসামান্য। বিদ্যজীবনের সাধনা করেছেন তিনি। পশ্চিমের ভাববাদী দার্শনিকদের তিনি পাঠ করেছিলেন কিন্তু শান্তি পাননি। তিনি ছিলেন বৈদিক সাহিত্যে অসামান্য পণ্ডিত। তাঁর মতে, বিশ্বজগতের ক্রমবিবর্তনের প্রক্রিয়ায় মানুষের পক্ষে একদিন অতিমানবে রূপান্তরিত হওয়া সম্ভব।
প্রাতিষ্ঠানিক দার্শনিকদের মধ্যে কুড়ি শতকের প্রথম দিকে ব্রজেন্দ্রনাথ শীল (১৮৬৪- ১৯৩৮)-ই ছিলেন প্রধান। কঠোর নীতিবান আইনজীবী পিতার ঘরে কলকাতায় জন্ম, তাঁর শিক্ষা ও কর্মজীবনের শুরুও কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি পান ১৯১০ সালে। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল : Mechanical, physical and chamical theories of ancient Hindus। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠেন প্রাচীনভারতবিশেষজ্ঞ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত অবস্থায় তিনি যোগ দেন মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে ১৯২১ সালে। ১৯৩০-এ সেখান থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের ভাষায়, ড. শীল ছিলেন ‘একজন শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও রাজনৈতিক তাত্ত্বিক’। নানা বিষয়ে তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধের পরে ১৯১৫-তে প্রকাশিত হয় তাঁর অসামান্য গ্রন্থ The Positive Sciences of the Ancient Hindus। এর সাতটি অধ্যায়ে তিনি আলোচনা করেছেন প্রাচীন হিন্দুদের সমরবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, শব্দতত্ত্ব সম্পর্কে হিন্দুদের ধারণা, উদ্ভিদবিদ্যা সম্পর্কে হিন্দুদের চিন্তা, হিন্দুচিন্তায় জীবজন্তুর শ্রেণীবিভাগ, জীববিজ্ঞান ও শরীরবিদ্যা সম্পর্কে প্রাচীন হিন্দু মতবাদ প্রভৃতি। ড. শীলের সব সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য কিনা সে-প্রশ্ন করে বিনয়কুমার সরকার বলেছেন, ‘ব্রজেন শীলের এই বইটার মতন বই লিখবার ক্ষমতা সেকালের দুনিয়ার কোনো পণ্ডিতের ছিল না। ফরাসি, জার্মান, ইতালিয়ান, ইংরেজ আর মার্কিন এই পাঁচ জাতের পণ্ডিতদের ঘটে ও বিষয়ে কত বিদ্যা আছে, আমি ভাল করে ঘুটে দেখেছি। [বিনয় সরকারের বৈঠক, প্রথম ভাগ, কলকাতা, ১৯৪৪, পৃ. ২১] অতিশয়োক্তি হলেও খুব বেশি মিথ্যে নয়। ১৯২৪-এ প্রকাশিত হয় তাঁর Syllabus of Indian Philosophy; শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনে লেখা হলেও প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের এক পূর্ণাঙ্গ পরিচয় এতে পাওয়া যায়। বৈদিক ধর্ম ও তার দার্শনিক উপাদান, উপনিষদের বাণী, ধর্মীয় দর্শনের পদ্ধতি, চার্বাক, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মতত্ত্ব, ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংসা প্রভৃতি দার্শনিক মতের পরিচয় এতে দেয়া হয়েছে। বিনয় সরকার মন্তব্য করেছেন, ‘সূচীটা দেখলেই বোঝা যায় যে, একমাত্র ব্রজেন শীল ছাড়া আর কারো সাধ্য নেই যে, সে-বই লেখে। ভারতীয় দর্শন সাহিত্যে যাঁরা ঘাঁটাঘাঁটি করতে চায়, তাঁরা অনেকদিন পরেও এই সূচির ভেতর হরেক রকমের হাদিস পেতে বাধ্য। …. ব্রজেন শীলের কল্পনায় ছিল প্রকারান্তরে গোটা ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিহাস। একমাত্র দর্শনে যাঁরা মাথা খেলায়, তাঁদের পক্ষে ব্রজেন শীলের সূচির ভেতর থৈ পাওয়া কঠিন, – এমনকি অসম্ভব। দর্শন বললে তিনি একসঙ্গে দেখতেন অনেক জিনিস। দর্শন শব্দে তিনি গোটা জীবনকে বুঝতেন। তাঁর চিন্তায় দর্শন অন্যান্য অনেক কিছুর সঙ্গে যথা নৃতত্ত্ব, ধনবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সুকুমার শিল্প, ইতিহাস ইত্যাদি সুজড়িত ছিল।’ [প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৫-৬৬]
১৯৩৬-এ প্রকাশিত তাঁর The Quest Eternal-এ কবিতার আঙ্গিকে প্রাচীন, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের দার্শনিক আদর্শ বিবৃত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বন্ধু, ড. শীলের সঙ্গে বারট্রান্ড রাসেলের যোগাযোগ ছিল। তিনি যত বড় পণ্ডিত ছিলেন তাঁর দার্শনিক কাজ সে তুলনায় কম। ড. শীলের মৃত্যুর পরে অধ্যাপক হরিদাস ভট্টাচার্য মন্তব্য করেছিলেন, ‘তাঁহার সমালোচক বুদ্ধি তাঁহার দার্শনিক বুদ্ধিকে প্রসার লাভ করিতে দেয় নাই। যখনই একটা মতবাদকে আঁকড়াইয়া ধরিবার চেষ্টা করিয়াছেন, তখনই তাঁহার বিরুদ্ধে যুক্তি আসিয়া তাঁহার হস্তকে স্তম্ভিত করিয়া দিয়াছে।’ [‘আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে’, বাসন্তিকা, ষোড়শবর্ষ ১৩৪৫]।
ব্রজেন্দ্রনাথের প্রায়-সমসাময়িক প্রাতিষ্ঠানিক দার্শনিকদের মধ্যে কৃষ্ণচন্দ্ৰ ভট্টাচার্য (১৮৭৫-১৯৪৯) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কর্মজীবনে অমলনারে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ফিলজফির অধ্যক্ষ (১৯৩৩-৩৫) এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের প্রধান (১৯৩৫- ৩৭) ছিলেন। তাঁর রচনার পরিমাণ কম, মাত্র দুটি প্রধান গ্রন্থ ও কিছু প্রবন্ধ, কিন্তু তা অসামান্য গভীর ও মৌলিক। বেদান্তদর্শন ও ইমানুয়েল কান্টের দর্শনের সমন্বয়ে তিনি এক নতুন দর্শনের স্রষ্টা। তাঁর মতে জ্ঞানাত্মক চেতনার চারটি স্তর, ১. ব্যবহারিক চিন্তা : ব্যবহারিক জগতে প্রত্যক্ষীকৃত বস্তু বা প্রত্যক্ষীভূত হয়েছে বলে কল্পিত বস্তুসম্বন্ধীয় চিন্তা; ২. বিশুদ্ধ বস্তুগত চিন্তা : যে চিন্তা বস্তুসম্বন্ধীয় কিন্তু সেই বস্তু প্রত্যক্ষীভূত হবেই এমন কোনো কথা নেই; ৩. আধ্যাত্মিক চিন্তা : যার সঙ্গে বস্তুর সম্পর্ক নেই এবং যা সম্পূর্ণ আত্মগত; এবং ৪. অলৌকিক চিন্তা : যা বস্তুগতও নয় আত্মগতও নয়। তাঁর Subject as Freedom একটি অসামান্য দার্শনিক গ্রন্থ। তাঁর পুত্র দার্শনিক কালিদাস ভট্টাচার্যের ভাষায়, কৃষ্ণচন্দ্রের দর্শন ‘বহুতলগভীর অনুভব মহিমায় মহিমান্বিত ও সূক্ষাতিসূক্ষ্ণ বিশ্লেষণ সম্ভারে সমৃদ্ধ।’
কালিদাস ভট্টাচার্যের (১৯১১-১৯৮৪) কাজের পরিমাণ বরং বেশি। তিনি বিভিন্ন কলেজে দর্শনের অধ্যাপনা করেছেন, শেষ জীবনে বিশ্বভারতীর উপাচার্য ছিলেন। তাঁর ভারতীয় সংস্কৃতি ও অনেকান্ত বেদান্ত (১৯৮২) এবং মণ্ডুক্যউপনিষদের কথা (১৯৮২) অসামান্য কাজ। তবে ইংরেজিতে Object, Content and Relation (1951), Alternative Standpoints in Philosophy (1953), Philosophy, Logic and Language (1965), Presuppositions of Science and Philosophy and Other Essays (1974), Fundamentals of K.C. Bhattacharyya’s Philosophy (1975), Indian Concept of Man (1982) প্রভৃতি মূল্যবান কাজ। বাংলায় রয়েছে তাঁর বহু প্রবন্ধ।
ভারতীয় দর্শনের ইতিহাস রচয়িতা হিসেবে সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত (১৮৮৫-১৯৫২) অদ্বিতীয়। ১৯১০ থেকে তিনি বহুদিন চট্টগ্রাম, রাজশাহী, প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। ১৯২০-২২-এ ক্যাম্ব্রিজে লেকচারার ছিলেন। সেখান থেকে ডি. ফিল করেন। তাঁর ৫ খন্ড A History of Indian Philosophy, A Study of Patanjali, Yoga Philosophy in Relation to Other System of Indian Thoughts, Rabindranath the Poet and Philosopher, সৌন্দর্যতত্ত্ব প্রভৃতি বাঙালির অমূল্য সম্পদ। তবে তিনি তাঁর নিজের জীবনদর্শন সম্পর্কে অল্পই লিখেছেন।
বস্তুবাদী চিন্তার ক্ষেত্রে মানবেন্দ্রনাথ রায় (১৮৮৭-১৯৫৪) কুড়ি শতকের প্রথম দিকে বাঙালিসমাজে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। শুরুতে মার্ক্সবাদী বিপ্লবী ছিলেন, শেষজীবনে বিপ্লবী মানবতাবাদ বা নব মানবতাবাদের (new humanism) প্রবক্তা হন। তাঁর এই মানবতাবাদ ছিল উদার মানবিক নৈতিকতা ভিত্তিক। তাঁর দর্শনের লক্ষ্য শোষণ- নিপীড়নমুক্ত এক অগ্রসর সমাজব্যবস্থা।
আধুনিক বৌদ্ধ দার্শনিকদের মধ্যে বেণীমাধব বড়ুয়া (১৮৮৮-১৯৪৮)-ই সর্বশ্রেষ্ঠ। চট্টগ্রামের মহামুনি পাহাড়তলীতে জন্ম। শিক্ষাজীবন কাটে চট্টগ্রাম ও কলকাতায়। ১৯১৭- তে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.লিট পান। এশিয়াবাসীর মধ্যে তিনি প্রথম। ১৯১৮-তে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন এবং আমৃত্যু সেখানেই ছিলেন। বৌদ্ধদর্শনসহ প্রাচীন ভারতীয় দর্শন ও ধর্মতত্ত্বে তাঁর তুলনীয় পণ্ডিত তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে আর কেউ ছিলেন না। বাংলায় তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ, প্রবন্ধ ও অভিভাষণ রয়েছে, কিন্তু তাঁর অবিস্মরণীয় গ্রন্থাবলি সবই ইংরেজিতে। তাঁর A History of Pre-Buddhistic Indian Philosophy, a Prolegomenon to the History of Buddhist Philosophy, Philosophy of Progress, Inscripion of Ashoka (3 vols) প্রভৃতি অত্যন্ত মৌলিক কৰ্ম।
বহুকাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বাঙালির প্রাতিষ্ঠানিক দর্শনচর্চার কেন্দ্র। ১৯২১- এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এখানেও আধুনিক দর্শন চর্চার একটি নতুন কেন্দ্র তৈরি হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের প্রথম অধ্যক্ষ হরিদাস ভট্টাচার্য (১৮৯১-১৯৫৬) ছিলেন একজন খাঁটি দার্শনিক। দার্শনিক পঞ্চানন তর্করত্ন (১৮৬৬-১৯৪০) তাঁকে ‘দর্শন সাগর’ উপাধি দিয়েছিলেন। বিভিন্ন বাংলা ও ইংরেজি জার্নালে প্রকাশিত তাঁর তত্ত্ববিদ্যা ও নৈতিক দর্শন বিষয়ে ১০০-র মতো অমূল্য প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিকের শিক্ষক উমেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য, সতীশচন্দ্র রায়, মমতাজউদ্দিন আহমদ, বিনয়েন্দ্রনাথ রায়, গোবিন্দচন্দ্র দেব থেকে একালের আমিনুল ইসলাম পর্যন্ত সকলেই আধুনিক দর্শনের চর্চা করেছেন। তাঁরা সকলেই উদার মানবতাবাদী। ড. দেব নিজেকে বলতেন, সমন্বয়ী ভাববাদী। বর্তমান সংঘাতপূর্ণ পৃথিবীতে তাঁর এই মধ্যপন্থী সমন্বয়ী দর্শন অত্যন্ত উপযোগী। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফও (১৯০৮-১৯৯৯) গভীর ভাবুক ছিলেন এবং ড. দেবের মতোই তিনিও সমন্বয়ী ভাববাদী। মুসলিম দর্শনের ওপর সাইদুর রহমানের বইটি মূল্যবান।
উপনিবেশ উত্তরকালে দর্শনের ক্ষেত্রে অনেকেই কাজ করেছেন। নতুনদের মধ্যে আমি শুধু একজনের কথা উল্লেখ করবো। ১৯৯১-তে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে বিমলকৃষ্ণ মতিলালের অকালমৃত্যু বাঙালি দার্শনিক ও দর্শনের শিক্ষার্থীদের জন্য এক মর্মান্তিক দুঃসংবাদ। তিনি সংস্কৃত কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ভাষা, সাহিত্য ও দর্শন অধ্যয়ন করেন। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও অক্সফোর্ডে শিক্ষকতা। তাঁর অভিসন্দর্ভ Nabya – Naya Doctrine of Negation এক অসামান্য কাজ, প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫-তে। এর মূল উপজীব্য নব্য-ন্যায়ে ‘না/নেই’ শব্দের অর্থবিশ্লেষণ। এই গ্রন্থে তিনি ১৪ ও ১৫ শতকের ভারতীয় যুক্তিবিদ্যার শক্তি ও সূক্ষ্মতা বিশ্লেষণ করেন। অসামান্য অধিকার ছিল বিমলকৃষ্ণের ভারতীয় ও পাশ্চাত্য যুক্তিবিদ্যা, ভাষাবিজ্ঞান, প্রাচীন ও নব্য-ন্যায়, বেদান্ত, জৈন ও বৌদ্ধ দর্শনে শুধু নয় পাণিনির ব্যাকরণ, পুরাণ, ধর্মতত্ত্ব, রসশাস্ত্র ও অলঙ্কারশাস্ত্রেও।
বহু মূল্যবান গ্রন্থ ও প্রবন্ধের প্রণেতা বিমলকৃষ্ণ। ভারতীয় ও পাশ্চাত্য দর্শনে প্রত্যক্ষ প্রমাণ (perception), জৈন অনেকান্তবাদের সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ, জ্ঞানতত্ত্ব (Epistemology), যুক্তিবিদ্যা (Logic) ও ভাষাদর্শন (Language philosophy) বিষয়ক তাঁর গ্রন্থগুলি পশ্চিমে খুবই সমাদৃত। ১৯৯১-এর প্রথম দিকে নতুন দিল্লী থেকে বেরায় তাঁর Word and the World বা শব্দ ও জগৎ। বিমলকৃষ্ণের একমাত্র বাংলা গ্রন্থ নীতি, যুক্তি ও ধর্ম এর উপজীব্য হলো ‘রামায়ন ও মহাভারতে বিবেকবোধ ও সামাজিক ধর্মনীতির টানাপোড়েন’। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে পণ্ডিত অনেকেই আছেন, আগেও ছিলেন, কিন্তু ভারতীয় দর্শন আত্মস্থ করে নিজস্ব মৌলিক দার্শনিক চিন্তাজগৎ নির্মাণ করতে পেরেছিলেন আধুনিকদের মধ্যে একালে একমাত্র বিমলকৃষ্ণই।
উনিশ ও কুড়ি শতকে হিন্দুশাস্ত্র ও হিন্দুদর্শন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে প্রমথনাথ তর্কভূষণ, পঞ্চানন তর্করত্ন, হারাণচন্দ্র শাস্ত্রী, ফনিভূষণ তর্কবাগীশ, গোপীনাথ কবিরাজ, কমলকৃষ্ণ স্মৃতিতীর্থ, রাখালদাস ন্যায়রত্ন, হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ, মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন, কালীবর বেদান্তবাগীশ, কোকিলেশ্বর ভট্টাচার্য, চন্দ্রকান্ত তর্কালঙ্কার, যাদবেশ্বর তর্করত্ন, জগদ্দুর্লভ ন্যায়ালঙ্কার, শীতানাথ তত্ত্বভূষণ প্রমুখ অসামান্য কাজ করেছেন। তাঁদের অধিকাংশ গ্রন্থই বাংলা ভাষায় রচিত।
ব্রিটিশ যুগে স্বাধীনভাবে যাঁরা দর্শনচর্চায় মনোনিবেশ করেন তাঁদের মধ্যে কুমিল্লার দ্বিজদাস দত্ত (১৮৪৯-১৯৩৪), মহেশচন্দ্র ঘোষ (১৮৬৮-১৯৩০), রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় (১৮৪৫-১৮৮৬), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য (১৮৮৮-১৯৬৩), দীনেশচন্দ্ৰ ভট্টাচার্য (১৮৯০-১৯৫৭), সত্যব্রত সামশ্রমী, রাজেন্দ্রনাথ ঘোষ, কেদারনাথ ভারতীয়, শঙ্করনাথ পণ্ডিত, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৬৮-১৯৪২), ড. প্রসন্নকুমার রায় (১৮৪৯-১৯৩২), মোহাম্মদ এসহাক, আলাউদ্দিন আহমদ, খোন্দকার গোলাম আহমদ, আমিনউদ্দিন আহমদ, আহসানউল্লাহ, প্রবাসজীবন চৌধুরী, হুমায়ুন কবির প্রমুখের নাম উল্লেখ করা আবশ্যক।
৭.
কুড়ি শতকের ভারতবর্ষে হিন্দুসমাজের উপর ধর্মগুরু রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব (১৮৩৬- ১৮৮৬) এবং তাঁর প্রিয় ও যোগ্যতম শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দের (১৮৬৩-১৯০২) প্রভাবই সবচেয়ে বেশি। রামকৃষ্ণ তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত ছিলেন না, কিন্তু হিন্দুধর্মের উদার শিক্ষা তিনি তাঁর ভক্তদের মধ্যে প্রচার করেছেন। বলেছেন, “সত্য একটিই, ঋষিরাই বলেন বহু।’ তাঁর ভাষায়, ‘সব ধর্মই সত্য; যত মত তত পথ।’ তাঁর শিক্ষা জীবই শিব। জীবের কল্যাণ করার মাধ্যমেই ঈশ্বরলাভের পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
বিবেকানন্দ অদ্বৈতবাদী ছিলেন, তবে মূর্তিপূজাও অনুমোদন করেছেন। স্বামীজী বলতেন, ‘ব্রহ্মই একমাত্র সৎ পদার্থ, তিনিই অদ্বিতীয়, কিন্তু তিনিই আবার দেবদেবী হয়েছেন।’ [ভগিনী নিবেদিতা, স্বামীজীকে যেমন দেখেছি, ৪র্থ সং, পৃ. ১৫৭] তিনি শুধু আধ্যাত্মিক নেতা ছিলেন না, ছিলেন জাতীয়তাবাদী ও মানবতাবাদী। হিন্দুধর্মকে নতুন জীবন দিয়েছেন তিনি। তাঁর ভাববার কথা, বর্তমান ভারত, ইংরেজি গ্রন্থ কর্মযোগ, রাজযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ যুগপৎ বিপ্লবী ও অ-বিপ্লবী জাতীয়তাবাদীদের প্রেরণার উৎস। রামকৃষ্ণের আদর্শগুলি তিনি সেবাধর্ম ও কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে মূর্ত করে তোলেন। শুধু হিন্দুদের ধর্মজীবন নিয়ে তিনি ভাবিত ছিলেন না, পরাধীন ভারতের যাবতীয় সমস্যা- দারিদ্র, অশিক্ষা, কুসংস্কার, জাতিভেদপ্রথা- প্রভৃতি কারণে প্রাণহীন দেশবাসীকে তিনি আত্মসচেতন ও আত্মমর্যাদাশীল করে পুনর্জাগরণ আনতে অতুলনীয় ভূমিকা পালন করেন। তাঁর সহজ-সরল বাণী উৎপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের কাছে অতি সহজেই দ্রুত পৌঁছে যায়। বেদান্তের তিনি নিজে যে ব্যাখ্য দিয়েছেন, তা জীবন, জগৎ, পরমাত্মার পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়ে যতো নয় তার চেয়ে বেশি ছিল নিপীড়িতের জন্যে তাঁর ব্যাপক কর্মপ্রচেষ্টার তাত্ত্বিক সমর্থন
রবীন্দ্রনাথ যদি কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক প্রভৃতি না লিখে শুধু দর্শনের চর্চা করতেন তা হলে তিনি হতেন আধুনিক ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ মৌলিক দার্শনিক। তাঁর শাস্ত্রনিরপেক্ষ দার্শনিক চিন্তা নিয়ে সংখ্যাহীন প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও বহু পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ প্রণীত এবং গবেষণা হয়েছে। এ কালের বাঙালি পাঠকমাত্রই তাঁর মানবতাবাদী চিন্তা সম্পর্কে অবহিত। সুতরাং আমি আমার এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে তাঁকে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ পাব না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর দার্শনিক চিন্তা তাঁর কবিতায়, গানে, নাটকে ও প্রবন্ধে প্রকাশ করেছেন। ১৯২৫-এ কলকাতা দর্শন কংগ্রেসে তাঁর ভাষণটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘ভারতে কাব্য ও দর্শন কেমন হাত ধরাধরি করিয়া চলিয়াছে। জীবনে পূর্ণতা লাভের সহজ ও সম্ভব পথটি মানুষকে ধরাইয়া দিবার দায়িত্ব দর্শন গ্রহণ করিয়াছে বলিয়াই এটি ভারতে সম্ভব হইয়াছে। সে পূর্ণতার অর্থ কি? ইহার অর্থ সত্যের মধ্যে মুক্তি, যাহার জন্য এই প্রার্থনা জাগিয়াছে— অসতো মা সদ্গময়- কারণ যাহা সত্য, তাহাই আনন্দ।’ রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক জীবন নিয়ে সবচেয়ে মূল্যবান আলোচনা করেছেন আবু সয়ীদ আইয়ুব, যিনি নিজেও ছিলেন একজন অসামান্য দার্শনিক।
দেশের পরাধীনতার গ্লানি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)কে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে জড়িয়ে ফেলে। করেন তিনি অন্যায়, অবিচার ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। কিন্তু নজরুলের মধ্যে যে একজন মহৎ মরমী দার্শনিক ছিলেন তা তাঁর শেষের দিকের অভিভাষণ ও লেখাগুলি পাঠ করলে উপলব্ধি করা যায়। তাঁর মানবতাবাদী দর্শন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
বাঙালি ‘নেচারাল’ দার্শনিকদের কথা বলতে গেলে আরজ আলী মাতুব্বর (১৯০০- ১৯৮৫)-এর নাম উল্লেখ করতেই হবে। ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শ্রেণীকক্ষের ভেতরে যেমন নতুন দর্শনের সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি প্রাচ্যে নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব হয়েছে ব্যক্তির নির্জন কক্ষে অথবা হাট-বাজারে জনগণের কোলাহলের মধ্যে। মাতুব্বর ছিলেন ধর্মীয় গোড়ামিমুক্ত ও অন্ধত্বমুক্ত একজন আলোকিত মানুষ। তিনি সত্যের সন্ধান করেছেন আজীবন। অন্য দার্শনিকদের মতামত যতটুকু সম্ভব তিনি পাঠ করেছেন এবং পছন্দমতো সেখান থেকে গ্রহণ করেছেন। আমাদের ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের মানুষের উচিত তাঁর অনুমান, সৃষ্টিরহস্য, সত্যের সন্ধান প্রভৃতি গ্রন্থগুলি পাঠ করা। সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবঞ্চিত মানুষের পক্ষে মরমীবাদী হয়ে ওঠাই সহজ, কিন্তু মাতুব্বর তাঁর বিপরীত। তিনি ছিলেন যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানপন্থী। তিনি তাঁর সত্যের সন্ধান- এ সুস্পষ্ট বলেছেন, ‘বর্তমান যুগে বিজ্ঞানবিরোধী কোন শিক্ষাই গ্রহনীয় নয়।’ পাণ্ডিত্যের দিক থেকে তুলনীয় নন, খ্যাতি ও প্রভাবের দিক থেকেও নন, কিন্তু আধুনিকতা ও যুক্তিশীলতার দিক থেকে মাতুব্বর অরবিন্দের চেয়ে আধুনিক ও প্রগতিশীল।
৮.
দর্শনের প্রতি আত্মনিবেদিত বাঙালির আত্ম-উপলব্ধির মধ্য দিয়েই জগতের ও মানবজীবনের গভীরতম সত্য ও পরমসত্তার অনুসন্ধানের কাজটি হয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। বৌদ্ধ পণ্ডিতদের গ্রন্থে ও সহজ সাধকদের চর্যাপদে, হিন্দুধর্মশাস্ত্র ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণের মাধ্যমে, বৈষ্ণব সাহিত্য ও পদাবলিতে, মুসলমানদের ধর্মতত্ত্ববিশ্লেষণে ও পুঁথি সাহিত্যে, হিন্দুদের শ্যামাসংগীতে, ধর্ম ও শাস্ত্রনিরপেক্ষ বাউল গানে পরমসত্তার পরিচয় খোঁজার চেষ্টা হয়েছে। সম্প্রদায় ও সাধনভেদে ভাবুক ও সাধকদের নানা নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাঁরা বিশ্বলীলা উপলব্ধি ও পর্যবেক্ষণ করে যা খুঁজে পেয়েছেন তা অকপটে প্রকাশ করেছেন নানা মাধ্যমে। রক্ষণশীল হোক, প্রগতিশীল হোক বা প্রতিক্রিয়াশীল হোক, বাঙালির ব্রহ্মোপলব্ধি বস্তুত মানবজীবন উপলব্ধিরই নামান্তর। তাই প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাঙালির সাধনায় ও দার্শনিক চিন্তায় এবং সাহিত্যকর্মে ঈশ্বরের কথা, পরমাত্মার সন্ধান, দেব-দেবীর কথা যতই বলা হোক শেষ পর্যন্ত মনুষ্যত্বের জয়গানই ধ্বনিত হয়েছে।
ব্রিটিশ ঔনিবেশিকদের শাসন শুরু হলে বাঙালির দর্শন চর্চা এক নতুন মোড় নেয়। আধুনিক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোকে কেন্দ্র করে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনের যুগপৎ আলোচনা হতে থাকে। বাঙালি শুধু নব্য-ন্যায়, বৈষ্ণব ভাবধারা বা সুফিতত্ত্ব নয় কান্ট, হেগেল, মিল, মার্ক্স, সার্ত্রে, হাইডেগারদের নিয়েও আলোচনায় ব্রতী হয়। সামগ্রিকভাবে সমকালীন পৃথিবীর চিন্তাধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই বাঙালি মনীষা গড়ে তুলতে চায় নতুন নতুন জীবনদর্শন। ভাববাদী ও বস্তুবাদী, ধর্মপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষ সব ধরনের দর্শনই আলোচিত হতে থাকে।
গত প্রায় পৌনে এক শতাব্দী যাবৎ বাঙালি জাতি নানা রকম রাজনৈতিক ও সামাজিক দুর্বিপাক ও অস্থিরতার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। প্রায় দুই শতাব্দী উপমহাদেশের অন্যান্য জাতির মতোই বাঙালি ছিল ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শাসকদের পদানত। কিন্তু কূটাভাসের মতো মনে হয়, সেই সময়টিই ছিল বাঙালির জন্য খুবই সৃষ্টিশীল। বাঙালির মহান প্রতিভার জন্ম হয়েছে সেই কালেই।
অতি উর্বর ভূমির অধিকারী হলেও, বিচিত্র খাদ্যশস্য ও অন্যান্য ফসল উৎপন্ন হওয়া সত্ত্বেও, মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও, বিদেশী শাসন-শোষণের ফলে বাঙালির অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছিল। তার উপর গত কয়েক দশকে বাঙালির রাজনৈতিক ভূগোলের একাধিকবার পরিবর্তন ঘটেছে। বাঙালি এখন দুইটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের এবং একটি রাষ্ট্রের তিন চারটি প্রদেশের অধিবাসী। তবে অধিকাংশ বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাগরিক। সামগ্রিকভাবে বাঙালি আজ চরম অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার মধ্যে, চরম অবক্ষয় ও নীতিহীনতার মধ্যে জীবনের গভীর-জটিল বিষয়ে মনোনিবেশ করা কঠিন বৈ কি! সে জন্যেই আজ বাঙালির দর্শনচর্চা থেমে আছে, ১০০ বছর আগেও যা ছিল না। কিন্তু অতীতে বহু জাতির জীবনেই এমনটি ঘটেছে। জাতির উত্থান-পতন উন্নতি-অবনতি চিরকালই ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানী, জাপান, ইতালির যে অবস্থা হয়েছিল তাতে কয়েক শ বছরেও যে তারা সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াতে পারবে সে কথা অনেকে চিন্তাও করেননি। কিন্তু তারা আজ অত্যন্ত অগ্রসর ধনে ও জ্ঞানে, শিল্প-সাহিত্যে এবং শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যে।
যে বাঙালি জাতির দুই তিন হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে, যে বাঙালির দার্শনিক জ্ঞানচর্চার দেড় হাজার বছরের ঐতিহ্য রয়েছে, উনিশ শতকে ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্যেও যে বাঙালির একটি অংশ নতুন করে জেগে উঠেছিল, জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে গিয়েছিল বহু দূর, তখন সে ছিল যে-কোনো উন্নত জাতির সমকক্ষ, যে বাঙালি ১৯৭১-এ দুর্ধর্ষ পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে পরাভূত করেছে, তার ধ্বংস নেই। সপ্তম ও অষ্টম শতকে মাৎস্যন্যায় এবং তের শতকের রাষ্ট্র বিপর্যয়ের পরও যে বাঙালি নিঃশেষ হয়নি তার ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অন্ধকার হতে পারে না। প্রাচীন বাংলার ভাষা, সাহিত্য, দর্শন ও অন্যান্য জ্ঞানচর্চার মজবুত ভিত্তির কারণেই সাময়িক বিপর্যয় থেকে বারবার বাঙালির উত্তরণ ঘটবে। যে জাতির অহংকার করার মতো অতীত রয়েছে একদিন সে জাতি জ্ঞানবিভাসিত (Enlightened) হয়ে উঠবে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। ভবিষ্যতে সে জেগে উঠবেই- তবে সে ভবিষ্যৎ অদূর না সুদূর তা বলা সম্ভব নয়। প্রার্থনা করি সেই ভবিষ্যৎ যেন সুদূর না হয়ে অদূর হয়।*
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
অনন্তকুমার ভট্টাচার্য, বৈশেষিক দর্শন
উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ভারতীয় দর্শন
নলিনীনাথ দাসগুপ্ত, বাঙালার বৌদ্ধধর্ম
নীহাররঞ্জন রায়, বাঙালির ইতিহাস, আদিপর্ব
আহমদ শরীফ, বাঙালি ও বাঙলা সাহিত্য
কালিদাস ভট্টাচার্য, ভারতীয় সংস্কৃতি ও অনেকান্ত বেদান্ত, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়
অরবিন্দ পোদ্দার, মানবধর্ম ও বাংলা কাব্যে মধ্যযুগ
প্রমোদবন্ধু সেনগুপ্ত ও মতিলাল মুখোপাধ্যায়, ভারতীয় দর্শন, প্রথম খণ্ড
ক্ষিতিমোহন সেন, ভারতের সংস্কৃতি
নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস
নগেন্দ্রনাথ বসু, বিশ্বকোষ
মুহাম্মদ এনামুল হক, বঙ্গ সুফী প্রভাব
শ্রীনাথ চন্দ, ব্রাহ্মসমাজের চল্লিশ বৎসর
শঙ্করনাথ রায়, ভারতের সাধক
শশিভূষণ বিদ্যালঙ্কার [স], জীবনীকোষ
হরিমোহন মুখোপাধ্যায় [স], বঙ্গভাষার লেখক
গৌরাঙ্গগোপাল সেনগুপ্ত, স্বদেশীয় ভারতবিদ্যা-পথিক
দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, বাঙালির সারস্বত অবদান
হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য, বঙ্গীয় মহামহোপাধ্যায় জীবনী
সুকুমার সেন, মধ্যযুগের বাংলা ও বাঙালী
সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত [স] সংসদ বাঙালী চরিতাভিধান
মনো মুখোপাধ্যায়, উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে দার্শনিক চেতনা
সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, A History of Indian Philosophy
সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, A History of Sanskrit literature
বিপিনচন্দ্র পাল, Studies of Hinduism
সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ, History of Indian Logic
দেবী প্রসাদ চট্টোপধ্যায়, Lokayata: A Study in Ancient Indian Materialism
দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী, Short History of Indian Materialism
A Macdonell, History of Sanskrit Literature
J.N. Banerjea, Pauranic and Tantric Religion
—–
* ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রের মিলনায়তনে জুন ২০০৬ প্রদত্ত বক্তৃতা