১৪.
নো ড্রাফট দিস মানথ।
লাস্ট মানথ ড্রাফট, স্টিল মিসিং।
বিগ প্রবলেম। ভেরি ওরিড।
১৫
রেবেকা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে দু দিন আগে। বরফে পা পিছলে বাঁ হাতের রেডিও আলনা এবংকলার বোন দুটোই ভেঙেছে। সামান্য পা হড়কান থেকে এমন জটিলতা তৈরী হতে পারে তা তার কল্পনাতেও আসে নি। প্রথম দিনটা তার খুব খারাপ কাটল। একা-একা খানিককক্ষণ কাঁদল। দ্বিতীয় দিনে জ্বরে আচ্ছন্ন হয়ে রইল। অপরিচিত হাসপাতাল, অপরিচিত লোকজনদের মধ্যে এমন নিঃসঙ্গ লাগতে লাগল নিজেকে।
দ্বিতীয় দিনের সন্ধ্যাবেলা পাশা তাকে দেখতে এল। রেবেকা থমথমে গলায় বলল, আপনার জন্যেই আমার এই অবস্থা।
কেন, আমার জন্যে কেন?
আপনি আমাকে বরফে হাটার কায়দা শিখিয়ে দিয়েছেন, সেই কায়দায় হাঁটতে গিয়ে।
পাশা হেসে ফেলল।
রেবেকা গম্ভীর হয়ে বলল, আমার জন্যে কী এনেছেন বলুন? নাকি খালিহাতে রোগী দেখতে এসেছেন?
খালিহাতেই এসেছি।
মার্থা আমাকে একটা কার্ড দিয়ে গেছে। দেখুন কার্ডে কী লেখা।
পাশা হাসিমুখে কার্ডটা পড়ল। কার্ডে লেখা, ভাগ্যকে ধন্যবাদ দাও যে তুমি মানুষ। তুমি ঘোড়া হয়ে জন্মালে তোমাকে মেরে ফেলা হত। পা-ভাঙা ঘোড়াকে সব সময় মেরে ফেলা হয়।
পাশা চেয়ার টেনে পাশে বসতে-বসতে বলল, তোমার শরীর এখন কেমন?
ভালো–তবে জ্বর আছে।
বেশি জ্বর?
বেশি জ্বর কি কম জ্বর সেটা আপনি আমার কপালে হাত দিয়ে দেখতে পারেন না? নাকি সেটা করলে আপনার পাপ হবে?
পাশা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
রেবেকা মৃদু স্বরে বলল, আমি সব সময় লক্ষ করেছি, আপনি আমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে চান।
এরকম মনে করার কোন কারণ নেই, রেবেকা।
নিশ্চয়ই আছে। আমি প্রমাণ দিতে পারি।
প্রমাণও আছে তোমার কাছে?
নিশ্চয়ই আছে। সতেরই ডিসেম্বরের কথা মনে করে দেখুন। আপনার ওখানে গিয়েছি, কথা বলতে-বলতে রাত হয়ে গেল। বাইরে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে, আপনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আমাকে ডরমিটরিতে ফিরিয়ে দেবার জন্যে। আপনার গাড়ি নষ্ট। আপনি টলিফোন করে একটা ট্যাক্সি আনালেন। অথচ ইচ্ছা করলে আপনি বলতে পারতেন–রেবেকা থেকে যাও। কেন বলেন নি?
পাশা চুপ করে রইল।
আপনার কি ধারণা, আমি আপনার প্রেমে পড়ে গেছি? না, আপনি বলুন–আপনার কাছ থেকে আমি শুনতে চাই।
পাশা অবাক হয়ে লক্ষ করল রেবেকার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। কী অসম্ভব জটিলতা এই পৃথিবীতে। পাশা দীর্ঘ সময় নীরবে বসে রইল। রেবেকা বলল, কই, আপনি তো আমার জ্বর দেখলেন না।
পাশা তার কপালে হাত রাখল। বেশ জ্বর গায়ে।
রেবেকা বলল, মানুষ তার খুব প্রিয়জনদের মনের কথা বুঝতে পারে, আপনি কি তা বিশ্বাস করেন?
করি না। এক জনের মনের কথা অন্য জনের জানার কোনোই বৈজ্ঞানিক কারণ নেই।
কিন্তু আমি পারি। এখন আমি খুব ভালো করে জানি, আপনি এই শেষ বারের মতো আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। আপনি ফার্গো ছেড়ে চলে যাচ্ছেন? ঠিক না?
পাশা কিছু বলল না।
বলুন, আমি ঠিক বলছি না?
হ্যাঁ, ঠিকই বলছ।
কোথায় যাচ্ছেন?
জানি না কোথায়। আমার কোন শিকড় নেই, রেবেকা।
কী করবেন, কোথায় যাবেন–কিছুই জানেন না?
পাশা জবাব দিল না।
রেবেকা বলল, দেশের কেউ চাচ্ছে না আমি এখানে আরো কিছু দিন থাকি। কিন্তু আমি থাকব। আমি অনেক বড় হতে চাই, পাশা ভাই।
সবাই চায়।
কিন্তু সবাই পারে না, এই তো বলতে চান? আমি পারব।
হ্যাঁ, তা পারবে। তোমার ক্ষমতা আছে।
আচ্ছা, আমি যদি একটা দু রুমের বাড়ি ভাড়া করে আপনাকে কিছুদিন আমার সঙ্গে থাকতে বলি, আপনি থাকবেন?
এটা কেন বলছ? কেন থাকব?
যাতে আবার আপনি ঐসব খেলাটেলা লিখে কিছু টাকাপয়সা করতে পারেন, তারপর দেশে ফিরে আমার মতো ভালো একটা মেয়েকে বিয়ে করতে পারেন। তখন আপনার শিকড় হবে।
পাশা হাসল। রেবেকা থমথমে গলায় বলল, আপনি হাসছেন কেন?
পাশা বলল, আজ তোমার বেশ জ্বর। জ্বর কমুক, তারপর কথা বলব। আমি কাল আসব।
আমি জানি, আপনি আর আসবেন না। এবং এও জানি, কেউ আমাকে এখানে থাকতে দেবে না। যথাসময়ে আমাকে দেশে ফিরে যেতে হবে। আপনি কি চলে। যাচ্ছেন?
হ্যাঁ।
কাল সত্যি-সত্যি আসবেন?
হ্যাঁ, আসব।
আমার গা ছুঁয়ে বলুন।
পাশা তাকিয়ে রইল। জ্বরতপ্ত একটি কোমল মুখ। বালিশের চারদিকে ছড়িয়ে আছে ঘন কালো চুল। কেন জানি বারবার সেই চুলে হাত রাখতে ইচ্ছা করছে।
রেবেকা বলল, কি, কথা বলছেন না কেন?
আসব, আমি কাল আসব।
আমার গা ছুঁয়ে বলুন। আমার হাত ধরে বারবার বলুন।
পাশা তার হাত ধরে কথাগুলি আবার বলল। রেবেকা চোখ বন্ধ করে ফেলল। দীর্ঘ সময় সে তাকিয়ে থাকতে পারছে না। চোখ জ্বালা করছে। সে মৃদু স্বরে বলল, কেন আপনি আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলছেন?
মিথ্যা কথা বলছি?
হ্যাঁ, বলছেন। কেন বলছেন? আমি তো কখনো আপনার সঙ্গে মিথ্যা বলি না। পাশা কিছু বলল না। রেবেকা ফিসফিস করে বলল, আমি খুব ভালো করে জানি, আপনি আর কোন দিন আসবেন না।
আজ উঠি রেবেকা?
না। আপনি বসে থাকুন। বসে-বসে গল্প করুন।
কী গল্প?
আপনার ছেলেবেলার গল্প।
আমার ছেলেবেলার কোন গল্প নেই, রেবেকা। সবার কি আর গল্প থাকে?
তাহলে আপনার যৌবনের গল্প বলুন।
তুমি ঘুমুতে চেষ্টা কর তো, রেবেকা।
না, আমি ঘুমুতে চেষ্টা করব না। আমি জেগে থাকব। আর অনবরত কথা বলব। আর আপনার হাত ধরে থাকব। হাত ছাড়ব না। কিছুতেই না।
তৃতীয় দিনে রেবেকার জ্বর আরো বাড়ল। কেন বাড়ল, ডাক্তাররা ধরতে পারলেন না–ভাঙা হাড়ের কারণে কোনো কমপ্লিকেশন, নাকি ভাইরাসঘটিত কোনট সংক্রমণ?
রেবেকা সমস্ত দিন আচ্ছন্নের মতো পড়ে রইল। সন্ধ্যাবেলা তাকে দেখতে এল আরিয়ে রত্না চন্দ্রাণী। সে রেবেকার চিঠি নিয়ে এসেছে।
চিঠি লিখেছে তার বর। এইটি এমনই এক চিঠি যা লক্ষ বার পড়া যায়। এবং কখনো পুরনো হয় না।
প্রিয়তমাসু, তুমি পি-এইচ.ডি প্রোগ্রামে ভর্তি হয়েছ শুনে বেশ অহংকারই হল। সাধারণ একটি বি.এ. পাস ছেলের পিএইচডি স্ত্রী। কী সর্বনাশ।
রেবেকা, এটা একটা চমৎকার সুযোগ। আমার মত দরিদ্র মানুষ তো তোমাকে আমেরিকা পাঠিয়ে পড়াশোনা করাতে পারবে না। নিজের ক্ষমতা ও যোগ্যতায় তুমি তা অর্জন করেছ। কী করে তুমি ধারণা করলে তোমার এই যোগ্যতার আমি দাম দেব না?
এত দীর্ঘদিন একা একা থাকতে আমার খুব কষ্ট হবে। তোমারও হবে। দুঃখকষ্ট তো পৃথিবীতে আছেই–কি বল?
আরিয়ে রত্ন বলল, কী আছে চিঠিতে? এত কাঁদছ কেন? এই রেবেকা, কী ব্যাপার?
অনেক রাতে পাশা তার গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামল। কোথায় যাবে? এখনো কিছু ঠিক করা হয় নি। নির্দিষ্ট কোন গন্তব্য নেই। কিছু পুরনো বন্ধুবান্ধব আছে মন্টানাতে। তাদের কাছে যাওয়া যেতে পারে, আবার নাও যাওয়া যেতে পারে। এক জন শিকড়হীন মানুষের কাছে সবই সমান।
রাস্তা নির্জন। দু পাশে প্রেইরির সমভূমি, বরফে-বরফে সাদা হয়ে আছে। বিশাল একটি বাটির মত আকাশটা চারদিক ঢেকে রেখেছে। আকাশে নক্ষত্রের মেলা। কী অদ্ভুত তাদের আলো! নক্ষত্রের আলোয় কেমন অন্য রকম লাগে। বড়ো ইচ্ছা করে কারো কাছে যেতে।
Mota muti ekta novel.