হোরাসের চোখ
সেইদিন রাতেই বাড়ি ফিরে আমি আর পিজি গুগল ঘাঁটতে বসেছিলাম। ভবেশদা কোনো হিন্টও দেননি, তাই কোথা থেকে খোঁজাটা ঠিক শুরু করব সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। তবে রাত এগারোটা নাগাদ পিজি হঠাৎ ‘মিল গয়া, মিল গয়া’ বলে ঘরের মধ্যে লাফাতে আরম্ভ করল। আমি জিজ্ঞাসা করতে বলল, ‘এখন বলব না, কালকেই দেখতে পাবি।’ বুঝলাম, এবারে বেটা ভবেশদার কাছে গিয়ে বেশ ঘ্যাম দেখাবে।
পরের দিন সন্ধেবেলায় হাজির হলাম ভবেশদার দোকানে। পিজি একটা বেশ জ্ঞানী সুলভ মুখ নিয়ে ভবেশদাকে বলল,
‘ইজিপ্ট নিয়ে আপনার নলেজ কিন্তু ইমেন্স। আমি সেটা বুঝতে পারছি আস্তে আস্তে।’
‘হুঁ, তুমি বুঝতে পেরেছ আমি এতে অনার্ড ফিল করছি। কয়েক মাস আগে তো মিশর মানে লিজ টেলর বুঝতে।’
‘ভালো কথা আপনাকে বলতে নেই, তাই না? ওইটা ছাড়াও আরও অনেক কিছুই জানতাম আমি, নেহাত কম কথা বলি তাই বুঝতে পারেন না আপনি।’
এবারে আমি আর ভবেশদা দু-জনেই হেসে ফেললাম। সেটাতে আরও বিরক্ত হয়ে পিজি বলল,
‘যাই হোক, কালকে আপনি ডাক্তারির সঙ্গে ইজিপশিয়ান মাইথোলজির যে মিলটার কথা বললেন, ওইটাও আমি আগে থেকে জানতাম, গুগল থেকে শুধু সেটাকে একবার কনফার্ম করে নিলাম। বলি?’
‘হুমম, শুনি কী জানো তুমি?’
‘‘‘আর এক্স’’-এর কথা বলছেন তো আপনি? মানে যেটা আমরা প্রেসক্রিপশন লেখার সময়ে লিখি।’
‘আমি এখনই কিছু বলব না, তুমি শেষ করো আগে, নাহলে আবার বলবে সেটাও জানতে, আমি বলতে দিইনি তোমাকে।’
‘সে তো অনেক সময়েই দেন না, সত্যিটা মানতে এত কষ্ট কেন হয় আপনার বুঝি না। যাই হোক, এই ‘‘আর এক্স’’-এর ‘‘আর’’টা আসলে এসেছে ল্যাটিন শব্দ রেসিপি থেকে, যার মানে, টু টেক। অর্থাৎ ডাক্তার এখানে রুগিকে কিছু নিতে অ্যাডভাইস দিচ্ছেন। সেটা ওষুধই, আগেকার দিনে ডাক্তাররাই তো ফার্মাসিস্টও ছিলেন। ওঁরাই ওষুধও বানাতেন। তাই সেই ওষুধই রুগিকে নিতে বলার জন্য আর এক্স লেখার শুরু। সেটাই এখনও চলে আসছে।’
‘আর এর সঙ্গে মিশরের মিল কোথায়?’
‘দেবতা হোরাসের চোখ! সেটার ছবি দেখলেই বোঝা যাবে যে তার সঙ্গে এই আর এক্স চিহ্নের অদ্ভুত মিল!’
এবারে আমি বললাম,
‘আই অফ হোরাস কেমন দেখতে? আমি তো আগে দেখিনি।’
ভবেশদা একটা কাগজের টুকরোতে ঝটপট এঁকে ফেললেন একটা চোখ, তার নীচের দিকে দুটো দাগ নেমে গেছে। একটা সোজাসুজি, আরেকটা বাঁকা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে অনেকটা আর-এর মতোই।
‘হোরাসের কথা একবার বলেছিলাম তোমাদের, মনে আছে?’
‘হ্যাঁ, সেই মমির গল্প বলার সময় বলেছিলেন তো। মৃত ওসাইরিসের শরীরে প্রাণ আসার পরে ওসাইরিস আর ওঁর স্ত্রী আইসিসের এক সন্তান জন্মায়। সে-ই হল হোরাস।’
‘ঠিক! কিন্তু হোরাসের চোখের থেকেই ডাক্তারির ওই চিহ্ন কেন তৈরি হল জানো?’
এবারে পিজি পড়ল ফ্যাসাদে। ওর মুখ দেখেই বুঝলাম ভবেশদার এই প্রশ্নের উত্তর ওর কাছে নেই। কিন্তু হার মানবার ছেলে তো ও নয়, বলল,
‘হ্যাঁ, এটাও জানতাম এককালে, কিন্তু এখন ভুলে গেছি। আপনি আরেকবার বলে দিন তো, তাহলে ফের মনে পড়ে যাবে।’
‘হুমম, এবারে আমি শুরু করি তবে, দেখো তোমার মনে পড়ে কী করে। এত কম বয়সে কী করে এত ভোলো, সেটা বুঝি না।’
‘প্রথম কথা ওই চিহ্নতে ‘‘আর’’ অক্ষরটা থাকলেও তার লেজে যে আড়াআড়ি কাটা দাগটা আছে সেটা এক্স নয়। হোরাসের চোখ উপড়ে নেওয়া হয়েছিল। সেই আঘাতের দাগই ওটা।’
‘হোরাসের চোখ উপড়ে নেওয়া হয়েছিল! কে নিয়েছিল!?’
‘দেবতা সেথ।’
‘সেথ? মানে ওসাইরিসের ভাই, যে ওকে খুন করেছিল?’
‘হ্যাঁ ভাই, এই সেই সেথ, কেন চোখ উপড়ে নিলেন সেই গল্পটাই বলি শোনো।’
‘ওসাইরিসকে খুন করে দেবতাদের সিংহাসনে বসেন সেথ। অন্যদিকে আইসিসের জাদুতে ওসাইরিসের মৃত শরীরে প্রাণ এলেও তিনি আর বাকি দেবতাদের দলে জায়গা পেলেন না। তাঁরকে চলে যেতে হল মিশরের পশ্চিমে, যেখানে মৃতদের কবর দেওয়া হত। ওসাইরিস হলেন মৃতদের দেবতা। সেথ কিন্তু রাজা হয়েও শান্তি পাননি, খবর পেয়েছিলেন যে আইসিসের এক সন্তান হয়েছে ওসাইরিসের ঔরসে। তাকে মারার জন্য উঠে-পড়ে লেগেওছিলেন।
‘বুদ্ধিমতী আইসিস হোরাসের জন্ম দেওয়ার পরেই সদ্যোজাত শিশুকে তুলে দেন দেবী হাথোরের হাতে। নীল নদের অববাহিকাতে প্যাপিরাস গাছে ভরা জলাভূমিতে বেড়ে উঠতে থাকলেন হোরাস। হোরাস যখন প্রাপ্তবয়স্ক হলেন তখন আইসিস ওঁকে নিয়ে এলেন দেবতাদের দরবারে, যাতে হোরাস সিংহাসনে ওঁর যোগ্য অধিকার দাবি করতে পারেন। কিন্তু সেথ সিংহাসন ছাড়তে রাজি হলেন না। তখন দেবতারা ঠিক করল সেথ আর হোরাস দু-জনকেই একবার করে সুযোগ দেওয়া হোক এইটা বলার যে কেন সে-ই সিংহাসনের ন্যায্য দাবিদার।
‘প্রথমে সেথ বলতে উঠলেন, বললেন, আমি দেবী নুতের সন্তান, তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী। প্রতিদিন আমিই রা-এর নৌকোতে থাকি, প্রতি রাতে আমিই তাকে সাহায্য করি আপেপ নামের সাপকে হত্যা করার জন্য। আর কেউ তো এই কাজ করতে পারবে না। তাই আমিই এই সিংহাসনে বসার যোগ্য।
‘এরপরে হোরাসের সুযোগ এল, কিন্তু তিনি শুধু বললেন, ওসাইরিসের সন্তান আমি, এই সিংহাসন রাজা ওসাইরিসের ছিল, তাই এখন তাঁরর অনুপস্থিতিতে এর ওপরে আমারই অধিকার। সেথ আমাকে ঠকাচ্ছেন।
‘দেবতাদের মধ্যে এবারে মতপার্থক্য দেখা দিল, কিছু জন যদিও ভাবলেন যে হোরাসকেই সিংহাসনে বসতে দেওয়া হোক, বেশির ভাগেরই মত ছিল সেথের দিকে। কারণ সেথ অনেক বেশি অভিজ্ঞ এবং সাহসী। দেবতাদের পাল্লা সেথের দিকে ভারী বেশি দেখে হোরাস সেথকে যুদ্ধে আহ্বান করে বসলেন। দু-জনেই দুটো জলহস্তীর আকার ধারণ করে ঝাঁপ দিলেন নীল নদের জলে। আইসিস এই সময় ছলনার আশ্রয় নিলেন। সেথকে আঘাত করার জন্য তির ছুড়লেন জলের মধ্যে। কিন্তু সেই তির গিয়ে লাগল হোরাসের পায়ে। আহত হোরাসকে জল থেকে উঠে আসতেই হল। সে লুকিয়ে পড়ল জঙ্গলের মধ্যে। সেথও ধাওয়া করলেন ওকে।
হোরাস ও সেথ ফারাওকে আশীর্বাদ করছে
‘সন্ধের দিকে সেথ খুঁজে পেলেন প্রায় অচৈতন্য হোরাসকে। একটা গাছের নীচে শুয়ে আছে। সেথ ঝাঁপিয়ে পড়লেন হোরাসের ওপরে। দুর্বল হোরাস সেই আক্রমণ ঠেকাতে পারল না। সেই সময়তেই সেথ হোরাসের দুটো চোখই উপড়ে নিলেন। এরপরে জঙ্গলের বাইরে বেরিয়ে এসে বলেন হোরাসকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অতএব তিনিই রাজা।’
‘হোরাস তাহলে মারা গেলেন!’
‘আরে, এখানেই তো টুইস্টটা। মৃতপ্রায় হোরাসকে খুঁজে পান ওর পালিকা মা হাথোর। হাথোর এক বন্য হরিণকে ধরে তার দুধ দুয়ে নেন। তারপরে সেই দুধ একটু একটু করে ঢালেন হোরাসের দুই চোখের গহ্বরে। হাথোরের জাদুতে হোরাস ফের তাঁরর দৃষ্টি ফিরে পান। তারপরে আরও অনেক যুদ্ধ, বাগ্্বিতণ্ডা পেরিয়ে সেথকে হারিয়ে হোরাস রাজার সিংহাসনে বসেন। হোরাসের চোখের চিকিৎসা করেছিলেন হাথোর। তাই ইজিপশিয়ানদের বিশ্বাস ছিল এই চোখের জাদু ক্ষমতা আছে। মিশরীয় চিকিৎসকেরাও ওষুধের সঙ্গে সঙ্গে হোরাসের চোখের আকারে বানানো তাবিজ পরতে বলতেন। এইভাবেই হোরাসের চোখ মিশে গেছে ডাক্তারির ধ্যানধারণার সঙ্গে।’
পিজি এবারে আবার মুখ খুলল,
‘ইয়েস! আমি জানতাম এই গল্পটার কথা! আমার ন-দাদু বলেছিল ! মনে পড়ে গেল সব।’
আমি আর তারপরে থাকতে পারিনি, ওর মাথায় একটা গাঁট্টা মারতেই হল। গুল দেওয়ারও তো একটা লিমিট আছে নাকি!