ধান কাটতে তমিজের আরো কয়েকটি দিন সবুর করতে হবে। এর মধ্যে লাগলো হুমায়ুনের চল্লিশার ধুম। শরাফত মণ্ডলের বর্গাদারদের সবাই কয়েকটা দিন পেটে ভাতে খেটে দিলো। আপখোরাকি মজুরি দেওয়ার ইচ্ছা আজিজ ও কাদের দুজনেরই ছিলো, বাড়ির মাসুম ছেলেটার রুহের মাগফেরাতের জন্যে খরচ করতে তাদের কোনো দ্বিধা নাই, এখানে পয়সা ঢালা মানে আখেরাতের সঞ্চয়। কিন্তু মণ্ডলের বড়ো বর্গাদার হামিদ সাকিদার অভিমান মতো করে : যার জমি চাষ করে তাদের রেজেক, তার বাড়ির শোক উদযাপনে গতর খাটিয়ে তারা পয়সা নেয় কোন আক্কেলে? তাদের আল্লারসুল নাই? তাদের আখেরাত নাই? গরিব হলেও কেয়ামতের দিন তাদের জবাবদিহি করতে হবে না? তার কাকুতি মিনতিতেই শরাফত তাদের মজুরি না দিয়ে দুই বেলা গরম ভাত খাওয়াবার ব্যবস্থা করে। আবদুল আজিজ খাওয়াবার ঝামেলার মধ্যে যেতে চায় না বলেই পয়সা দিয়ে কাজ করার পক্ষে। পয়সা নাও, কাম করো। একেকজনের হাতির খোরাক জোটাবার চেয়ে পৌষ মাসের খেতমজুরির রেটে পয়সা দিলে রবং অনেকটা সাশ্রয় হয়। কিন্তু তার বর্গাদারদের দুনিয়াদারির সঙ্গে আখেরাতের দেখভালের জিম্মাদারি শরাফতের এখতিয়ারেই পড়ে। সুতরাং নতুন ধান ভানা, বর্গাদারদের কারো কারো বাড়ির গাছ কাটা, করতোয়ার ওপারে দশটিকার হাট থেকে ৭টা বড়ো বড়ো দামড়া কিনে তাদের হটিয়ে নিয়ে আসা, কয়েক মণ আটা, আলু মশলাপাতির জোগাড়যন্তর করা, বাড়ির খুলিতে মস্ত মস্ত চুলা কাটা, কয়েক মাইল পুবে শিমুতলার মিয়াবাড়ি গিয়ে ভারে করে বড়ো বড়ো ডেকচি বয়ে আনা এবং চল্লিশার দিন রান্নাবান্না ও পরিবেশনের কাজ করার অনুমতি দিয়ে শরাফত তার আধিয়ারদের সওয়াব হাসিলের সুযোগ করে দেয়।
এতো বড় আয়োজন,-শরিক না হয়ে কি তমিজ পারে? তমিজের বাপ এই নিয়ে গাঁইগুঁই করে : কারো জমিতে মাঙুন কামলা খাটতে তমিজের এতো আপত্তি, শমশেরের। ধান কাটার সময় মাঙুন কামলা খাটলো বলে বাপটাকে তমিজ তো কম হেনস্থা করে। নি। আর মণ্ডলের বাড়িতে তুমি মাগনা খেটে মরো, তাতে তোমার খুব পোষায়? ২ বাপটাকে নিয়ে তমিজের পদে পদে বিপদ! বুড়ার বেটার গো আর কমলো না। নিজের বেটা মরার আগে আবদুল আজিজ কতোবার খবর দিলো, তমিজও কতোবার বললো, আজিজের বৌ কি স্বপ্ন দেখেছে তাই নিয়ে কী বলবে,—তা বুড়া গেলো না তো গেলোই না। শেষপর্যন্ত কুলসুম না গেলে আবদুল আজিজ যে কী কাণ্ডটা করতো ভাবতেও তমিজের গা শিউরে ওঠে। আর সে-ই কি আর কাদেরের কাছে মুখ দেখাতে পারতো?
বাপের কথা শুনলে কী আর তমিজের চলে? আবুদল কাদের তো অনেকটা ভরসা করে তার ওপরেই। তার টাউনের মেহমানদের খেদমত করতে গফুর কলু একাই যথেষ্ট, কিন্তু চল্লিশার প্রস্তুতির কাজে কয়েকটা দিন তাকে ছেড়ে দিলে কাদেরের চলবে কী করে? কাদেরের দোকানে বসে তেল বেচার কাজটা গফুর একাই করে। ঘানিতে সর্ষে। তেল বার করার চাইতে দোকানে বসে কেরোসিন তেল বেচা অনেক সোজা। এখানে ইজ্জতও আছে,-কন্ট্রোল রেটে আধ পোয়া তেল পেতে কতো মানুষ তাকে কী তোয়াজটাই না করে। আগে এইসব মানুষ কলুর বেটা বলে তাকে কতো হেলা করেছে। গফুরের কাজ আরো আছে। মুসলিম লীগের ছেলেরা দোকানে আসে দলের কাজ করতে। কাদের না থাকলে তাদের বসতে দেওয়া, তাদের কাজের সুবিধা অসুবিধার দিকে খেয়াল রাখা এবং কাদের সম্বন্ধে কে কী বললো সেদিকে একটু নজর রাখাও বটে,—এসব করে কে?
ভদ্রলোক মেহমান যা অনুমান করা গিয়েছিলো তার চেয়ে কমই এসেছে। আবদুল আজিজের অফিসের লোকজন অতো দূর থেকে আসতে পারে না। টাউনের সিভিল সাপ্লাই অফিসে সে তার তিনজন বন্ধুকে দাওয়াত করেছিলো, এসেছে একজন। আবদুল কাদেরের মেহমান মেলা, তবে দাওয়াত করা হয়েছিলো আরো অনেককে। আজিজ বা কদেরের যত খুশি মেহমানকে আপ্যায়ন করতে শরাফত মণ্ডলের কিছুমাত্র আপত্তি নাই। কিন্তু কাঁচা রাস্তায় টমটমের ঝাকুনি খেতে খেতে টাউনের বাবুরা যে এই পর্যন্ত কতো আসবে সেটা তার ভালো করেই জানা আছে!
লাঠিডাঙা কাছারির মুসলমান পাইক বরকন্দাজদের সবাইকে বলা হয়েছিলো। কাদের খামাখা তড়পালো, নায়েববাবুর ভয়ে ওরা এক সঙ্গে এতোগুলো মানুষ কাছারি ছেড়ে আসবে কি-না সন্দেহ। শরাফত অবশ্য ঠিকই জানে কয়েক বছর আগে হলেও পাইক বরকন্দাজের এক দিনের কামাই নিয়ে নায়েববাবু হাম্বিতম্বি করতো, কিন্তু বুড়ো হতে হতে লোকটা ধর্মকর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। কারো ধর্মের আচার অনুষ্ঠানে বাধা দেওয়ার মানুষই সে নয়। নায়েববাবুর এখনকার কথাই হলো; আমার ধর্ম আমি মানি। তোমার ধর্ম ভুল হক আর যাই হোক, সেটাই ঠিকমতো পালন করো। মানুষের সবই অনিত্য, এই ভবসংসারে সবই নশ্বর, কিন্তু ধর্ম আর জাত হলো জীবনের সার; ওটা গেলে মানুষের আর রইলো কী?
কামারপাড়ায় নেমন্তন্ন করলে সেটা বরং নায়েববাবুর সইতে না। মোসলমানের মড়ার শ্রাদ্ধের ভাত গিলে জাত খোয়ানোর অধিকার ভগবান কিংবা নায়েববাবু কেউই তাদের দিতে পারে না। তবে কাদেরের বিয়ের সময় মণ্ডল তার কামারপড়ার আধিয়ারদের ঠেসে খাওয়াবে; শিমুলতলার মিয়ারা তো বাড়িতে বিয়েসাদি হলে একটা দিন খওয়ায় শুধু হিন্দুদের। মণ্ডলও তাই করবে।
তা হুমায়ুনের চল্লিশায় মানুষও হয়েছিলো বাপু! গিরিরডাঙা, নিজগিরিরডাঙা, গোলাবাড়ি, ছাইহাটা থেকে ওদিকে রানিরপাড়া পারানিরপাড়া মহিষাবান,-কোনো গ্রামের মানুষ বাদ পড়ে নি। চাষা বলো, মাঝি বললা, কলু বলো আর জোলা বলো সবাই এসেছে ঝাঁক বেঁধে, ছেলেপুলে নাতিপুতি নিয়ে–এতো এতো সব মানুষে গোটা গাও গমগম করে; কালাহার বিলের সব মাছ ভিড় করে গিরিরডাঙার তটের দিকে। ফজরের নামাজের পরপরই মসজিদে দোয়া পড়া হলো। বলতে গেলে এই উপলক্ষেই মণ্ডলবাড়ির লাগোয়া জুম্মাঘরটার বেড়া নতুন করা হলো, জুম্মাঘরকে মসজিদ বলা শুরু হয়েছে এর আগে আগে। আহলে হাদিস জামাতের মসজিদ, এখানে মিলাদ পড়ানো চলে না। কাদের টাউনের টাইটেল পাস মৌলবিকে দিয়ে দোয়া পড়াতে চাইলেও মণ্ডল রাজি হয় নি, বাপদাদার আমলের রেওয়াজ মোতাবেক গায়ের জুম্মাঘরের ইমাম সাহেব দোয়া পড়ুক। পরে নাহয় খাওয়া দাওয়া দেওয়ার পর নাজাতের দোয়া পড়বে টাউনের আলেম সাহেবরা।
খানকা ঘরের উঁচু বারান্দায় সতরঞ্চির ওপর দুই দিকে বালিশ দিয়ে সাজানো। জায়নামাজে বসে নাজাতের দোয়া পড়ে টাউনের জামে মসজিদের ইমাম আলহাজ মওলানা হাফেজ আবু নসর বরকতুল্লাহ প্রতাপপুরী সাহেব। দুই পাশে বালিশের শিওরে কাঁসার গ্লাসে চালের ভেতর গোঁজা আগরবাতির ধোঁয়ায় ভর করে মওলানা সাহেবের সুরেলা মিষ্টি গলার এহলান ছড়িয়ে পড়ে বাড়ির সামনে বিশাল জমায়েতে এবং দেখতে দেখতে তা মিশে যায় বড়ো বড়ো ডেকচির গোরুর গোশতের সুরুয়ার গরম ধোঁয়ায় এবং রূপান্তরিত হয় খিদে-বাড়ানো সৌরভে।
এতো এতো লোক দেখে হামিদ সাকিদার ও গফুর কলু ঘাবড়ে যায় এবং সারিতে সারিতে ভাত দেওয়ার ব্যাপারে একটু তাড়াহুড়াই করে। দোয়া পড়ার শুরুতেই কলাপাতার ভাত ও নুন দেওয়া হয়ে গিয়েছিলো, বালতিতে বালতিতে আটা দিয়ে পাক-করা গোরুর গোশত নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পরিবেশনের জন্যে, তখন আরম্ভ হলো মোনাজাত। সারি সারি মানুষ অপেক্ষা করছে গোশতের জন্যে। গোশতের বালতি নিয়ে ছুটছে হুরমতুল্লা, কালুর বাপ, হামিদ সাকিদার, গফুর কলু, তমিজ,-মোনাজাতের দিকে এদের খেয়াল নাই। খানকা ঘরের বারান্দার ধারে দাঁড়িয়ে আবদুল আজিজ হঠাৎ জোরে নির্দেশ দেয়, মোনোজাত হচ্ছে, মোনাজাত; সবাই হাত তোলেন। পরপরই মওলানার স্বর হঠাৎ করে চড়ে গেলো।
মওলানার মোনাজাত হচ্ছিলো উর্দুতে, উর্দুতে সমবেত জনতার অজ্ঞতা এই ভাষার প্রতি তাদের ভক্তিকে উস্কে দেয় এবং এর রহস্যময়তা আরবি আয়াতের সঙ্গে সবরকম ফারাক মোচন করে। ওদিকে পঙক্তিতে বসা লোকজনের অনেকেই অধৈর্য হয়ে নুন দিয়েই ভাত মেখে খেতে শুরু করেছে। এমন কি কারো কারো ক্যা গো তরকারি দিবা না? ভাত কি শুধাই খাওয়া লাগিব? তোমরা কিসের সাকিদারি করো? পাতেত গোশত কুটি? প্রভৃতি অভিযোগ ঠোকাঠুকি লাগে মোনাজাতের কথার সঙ্গে। এতে বিরক্ত হয়ে কাদের আজিজের পাশে দাড়িয়ে হুকুম ছাড়ে, খামোশ! এই শব্দটির অর্থ পরিবেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকদেরও জানা না থাকায় ঘাবড়ে গিয়ে গোশতের বালতি মাটিতে রেখে তারা মোনাজাতের জন্যে হাত তোলে এবং তাদের দেখাদেখি হাত তোলে খেতে বসা মানুষের অনেকে। নুন দিয়ে ভাত যারা মেখে ফেলেছিলো তাদের নাকে লাগে ভাতের গন্ধ এবং ঘ্রাণে অর্ধ ভোজনং-এর তৃপ্তির বদলে তাদের পেটে তারা পায় খিদের নতুন মোচড়। মোনাজাতে নিষ্ঠার সঙ্গে শরিক হয়েছিলো সতরঞ্চি পাতা খানকা ঘর ও ওই ঘরের বারান্দায় বসা মেহমানরা। মাসুম বালক মোহাম্মদ হুমায়ুনের বেহেশত * নসিবের জন্যে আল্লাপাকের দরবারে, মওলানা সাহেবের আকুল আবেদনে তাদের চোখ ভিজে যায়, আমিন আমিন বললে তাদের গলা থেকে গড়িয়ে পড়ে নোনতা আওয়াজ। এই মাসুম আওলাদের অছিলায় তার বাপমা, দাদাদাদী এবং সমস্ত পূর্বপুরুষের গোনাখাতা মাফ করার জন্য মিনতি জানানো হচ্ছিলো। আগরবাতির ধোয়া এই ঘরে ছিলো স্বচ্ছ উৎসের মতো, গোশতের গন্ধে বিলুপ্ত হবার জন্যে ছোটার আগে ওই ধোয়া এই ছছাটো মজলিশে হুমায়ুনের তো বটেই, তার বাপদাদা এমন কি অপরিচিত পূর্বপুরুষের জন্যে লোকদের সংহত করে তোলে। হুমায়ুনের বড় ভাই বাবর বসেছিলো দাদুর কোল ঘেঁষে। পড়াশোনায় ভালো বলে এই নাতিটির জন্যে শরাফত মণ্ডলের টান একটু বেশি। দোয়ার প্রথম থেকে তার চোখ দিয়ে অবিরাম পানি ঝরছিলো, মোনাজাতের সময় ভাষার দুর্বোধ্যতা ছাপিয়ে মওলানা সাহেবের আকুল মিনতি তাকে ধাক্কা দেয় বেশ জোরেসোরে এবং সে কাঁদতে থাকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। আর শরাফত মণ্ডলের চোখ ছলছল করে, চোখের পানি আটকে থাকে চোখের গভীর গর্তে এবং নোনা পানির পর্দা ফুড়ে সে তাকিয়ে থাকে মিয়াবাড়ির ছোটোমিয়ার সৌম্য চেহারার দিকে। ছোটোমিয়ার ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি ও পায়ের ওপর যেনতেনভাবে ছড়িয়ে রাখা একই রঙের কাশ্মীরি শাল থেকে আসা আতরের গন্ধ শরাফতের শোককে গৌরব দেয় এবং ছোটোমিয়ার প্রায়-বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে সে তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় বুদ হয়ে যায়।
শিমুলতলার বুড়ো বুড়ো চার ভাইয়ের পানজর্দা খাওয়া ও গড়গড়া টানা চার জোড়া ঠোঁটের বাঁকা হাসির কুচিতে তার নিজের চোখজোড়া খচখচ করতে পারে-এই ঝুঁকি নিয়েও শরাফত দুইবার গিয়েছিলো তাদের দাওয়াত করতে। বড়ো বড়ো ডেকচি কাদের জোগাড় করতে পারতো তো টাউন থেকেই। কিন্তু মণ্ডল ছেলের কথায় কান না। দিয়ে ওইসব চাইতে গেলো শিমুলতলার মিয়াদের বাড়িতে। এতে বড়ো বড়ো হাঁড়িপাতিল ও দামি বাসনপত্র সংগ্রহে মিয়াদের পুরনো সমৃদ্ধির ধারণাটির নবায়ন করা হয়। তা এতে কাজ হয়েছে; ছোটোমিয়া এসেছে তার মেজোভাইয়ের এক নাতিকে নিয়ে।
আবদুল কাদেরের মেহমানরা টাউনের যতো দাপটের বান্দা হোক না কেন, শরাফত মণ্ডলকে তারা ওপরে ওঠাবে কতোটা? তারা দল বেঁধে এসেছে, জমিয়ে গপ্পোজব করছে, তারা পাকিস্তান, মুসলিম লীগ, কংগ্রেস, গান্ধিজি, জিন্না সাহেব, ইলেকশন, জহরলাল, কৃষক প্রজা পার্টি, হক সাহেব, সোহরোয়ার্দি, আবুল হাশিম, নাজিমুদ্দিন, আলিগড়, ইসলামিয়া কলেজ নিয়ে মেলা বাক্য ছাড়বে। মানুষ হাঁ করে ওইসব শোনে এবং বেশিরভাগ কথা না বুঝে কিংবা বোঝে না বলেই অভিভূত হয়। তারপর স্লামালেকুম বলে টমটমে চেপে তারা টাউনের দিকে রওয়ানা হলে লোকজন অনেকক্ষণ বিলীয়মান টমটমের দিকে তাকিয়ে থাকে। টমটম চোখের আড়াল হতেই তাদের কথা লোকে ভুলে যাবে, তাদের কথাবার্তার যেটুকু বুঝেছে তাও ভুলে যাবে। কিন্তু শিমুলতলার মিয়াদের সঙ্গে এক কাতারে না হলেও একই দিনে, একই জেয়াফতে, একই বাড়িতে ভাত খাবার কথা তারা জীবনে ভুলবে না।
শিমুলতলার মিয়ারা আজকের খানদান নয়, সেই কবে থেকে দীঘাপতিয়ার রাজাদের মস্ত তরফের খাজনা আদায় করে আসছে এরা। জেলার গোটা পুর এলাকার দীঘাপতিয়ার প্রজাপাটের ওপর চোটপাট করা, তাদের মারধোর করা, তেমন সুন্দরী মেয়ে চোখে পড়লে তাদের ভোগ করা,—সবই তো করে আসছে এরা। ইদানীং দুই পাতা লেখাপড়া করে ছোটো ঘরের কেউ কেউ বেয়াদব হয়ে উঠছে, এই ছোটোলোকের বাচ্চারা কাউকেই আমল দিতে চায় না। শগ্রফত তবু জানে, মরা হাতির দাম লাখ টাকা। শিমুলতলা পড়ে গেলেও এদের নাম থেকে এখনো আভা বেরোয়। এদের অবস্থা। পড়ো পড়ো হয়েছে বলেই শরাফত এদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক করার সখ করতে সাহস পায়। বড়োমিয়ার এক নাতনিকে কাদেরের বৌ করে আনার কথা সে একবার ভেবেছিলো, জগদীশ সাহাকে দিয়ে মিয়াবাড়িতে ইশারাও দিলো। জগদীশ বললো, সত্যিমিথ্যা জগদীশই জানে, প্রস্তাব শুনেই বৃড়োমিয়া জ্বলে ওঠে, চাষার, সাহস তো কম নয়, তার ঘরের মেয়ে নিতে চায় নিজের ছেলের বৌ করে!
বড়োমিয়া ওরকম রাগ না করলেও তো পারে। শরাফত নিজের হাতে লাঙল ধরে না, তার বাপই লাঙল ধরা ছেড়েছে জোয়ান বয়সেই। এ কথা ঠিক, জমিজমা কি জোতসম্পত্তির দিক থেকে মিয়াদের তুলনায় তারা কিছুই নয়। কিন্তু মণ্ডলের ধানপান, বাঁশঝাড়ের আয়, গোলাবাড়ি হাটের দোকানে কেরোসিন তেল বেচার টাকা—এসব ধরলে তার রোজগার তালুকদারদের কাছাকাছিই যাবে। জগদীশ সাহা অনেক রাত করে শিমুলতলায় তালুকদারদের বাড়ি যাওয়া আসা করে; এসবের মানে কি মণ্ডল বোঝে না? মিয়াদের নাক কারো কারো বেশ চাপাই, কিন্তু অবস্থা পড়তে শুরু করার পর থেকে তাদের নাক-উঁচু ভাবটা বাড়ছে।
এদের মধ্যে ছোটোমিয়াই বরং মানুষটা ভালো। টাউনে তার যাতায়াত বেশি। মাসে দুমাসে একবার কলকাতা যায়, দুই বছর পরপর দার্জিলিং ঘুরে আসে। আবার খদ্দরও ধরেছিলো কিছুদিন। দেশবন্ধু মারা যাবার সময় ছোটোমিয়া দার্জিলিঙে। দেশবন্ধুর শবদেহ নিয়ে কংগ্রেস ভলান্টিয়ারদের সূঙ্গে ছোটোমিয়া একই ট্রেনে কলকাতা গিয়েছিলো। ওই ট্রেনে মুসলমান ভলান্টিয়ার ছিলো আর কয়জন? এসব অবশ্য অনেক আগেকার কথা। রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছে তা বছর দশেক তো হবেই। এই লোকটা এখনো সবার সঙ্গে মিশতে পারে। ছোটোমিয়ার আর একটা ব্যাপার মণ্ডলের বড়ো পছন্দ, অবস্থাপন্ন ঘর হলেই তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে ছোটোমিয়ার আপত্তি নাই, অতো খানদানের ধার সে ধারে না। তবে তার ব্যারাম অন্যখানে। গ্র্যাজুয়েট না হলে তাদের বাড়ির জামাই হতে পারবে না। আরে এ কি গভর্নমেন্ট অফিসে অফিসার পোস্টে চাকরি দিচ্ছো যে বি এ পাস না হলে এ্যাপ্লাই করতে পারবে না?
গ্র্যাজুয়েট না হলেই বা আবদুল কাদের কম কিসে? ছোটোমিয়ার সঙ্গে কাদেরের আলাপ শুনতে শুনতে শরাফত মণ্ডল মুগ্ধ। বড়ো ছেলেটা তার সরকারি চাকরি করে, কিন্তু ভারিক্কি গোছের কি নামী দামি লোক দেখলে সরে সরে থাকে। গুজুরগাজুর ফুসুরাসুর সব ওই সিভিল সাপ্লাইয়ের কেরানির সঙ্গেই। অথচ আবদুল কাদের কেমন দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে।
আপনে ইসমাইল সাহেবকে বলেন, টিকেটের একটু চেষ্টা তদবির করুক। আমাদের এদিকে তার ফিল্ড খুব ভালো। আর বাঙালির পুবে যমুনার পশ্চিমে আপনাদের কথা কেউ ফেলতে পারবে না।
কাদেরের কথায় ছোটোমিয়া মোটেই ফুলে ওঠে না, এসব কথা তারা জন্ম থেকেই শুনে আসছে। তবে ইসমাইলের প্রশংসা করায় লোকটা খুশি। ইসমাইল হোসেন তার আপন ভাস্তিজামাই, বড়োমিয়ার মেজোমেয়ের স্বামী। তবে ইলেকশনে সে নমিনেশন পাবে কি না তাতে ছোটোমিয়ার একটু সন্দেহ আছে, দামাদমিয়া টিকেট পাবে কী করে? এই এলাকায় তো তোমাদের পুরনো লোক অনেক। কাদের এতে দমে না, বরং আরো উৎসাহিত হয়ে বলে, তা আছে। তারা তেমন কামের মানুষ নয়। কলকাতার নেতাদের সঙ্গে ইসমাইল ভায়ের খাতির কতো বেশি। ছাত্রনেতা ছিলেন তো। পাকিস্তান ইসু সারা বাঙলায় যারা প্রচার করে।
পাকিস্তানের ব্যাপারে ছোটোমিয়ার উত্তেজনা কম, আমাদের বাবাজি পাকিস্তান ছাড়া কিছু বোঝে না। তুমিও তাই। তোমরা ছেলেমানুষ, মাথা গরম করা তোমাদের বয়সের ধর্ম।
ছোটোমিয়া ইসমাইল হোসেন ও তাকে বয়সের ও মাথা গরম করার ব্যাপারে এক কাতারে ফেলায় কাদের এই লোকটার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়, এই কৃতজ্ঞতাবোধ তাকে একটু লাই দেয়। ফলে উত্তেজিত হয়ে সে বলে, পাকিস্তান ছাড়া মোসলমানের টেকার পথ নাই। মোসলমান কী ছিলো আর আজ কোথায় নেমেছে–।
মুসলমানদের বর্তমান হাল ব্যাখ্যা করার ভার তার হাত থেকে স্বেচ্ছায় তুলে নেয় টাউনের মাঝবয়েসি নেতা ডাক্তার আমিরুদ্দিন আখন্দ। দেখেন না, শিক্ষদীক্ষা, স্কুল কলেজ, কোর্ট কাচারি, অফিস আদালত, বিজনেস সব হিন্দুদের হাতে। আর জমিদার তো নাইন্টি পার্সেন্ট হিন্দু। লোকটা মনে হয় আজ সকালেই রিহার্সেল দিয়ে এসেছে, কিংবা নিজের চেম্বারে বসে রোজ রোজ বলতে বলতে তার মুখস্থ, মোসলমান হলো হিন্দু জমিদারের প্রজা, হিন্দু উকিলের মক্কেল, হিন্দু মহাজনের খাতক, হিন্দু মাস্টারের স্টুডেন্ট, হিন্দু ডাক্তারের পেশেন্ট।
ছোটোমিয়া তার কথার স্রোত একটুখানি আটকায়, কেন আপনার কাছে মোসলমান পেশেন্ট যায় না? ডাক্তার আসিরুদ্দিন জবাব দেয়, হিন্দু পেশেন্ট তো আমার কাছে যায়ই না, আবার মোসলমান সব ভালো ভালো শিক্ষিত মানুষের ধারণা, মোসলমান কখনো ভালো ডাক্তার হতে পারে না।
তাহলে খালি হিন্দুদের দোষ দেন কেন? মোসলমান ডাক্তার যদি ভালো হয় তো হিন্দু পেশেন্ট কি তার কাছে না গিয়ে পারবে? টাউনের চোখের ডাক্তার দুজনেই তো মোসলমান, হিন্দুরা তাদের দিয়ে চোখ দেখায় না? কলকাতায় সবচেয়ে বড়ো দাঁতের ডাক্তার তো মোসলমান, তার পেশেন্টদের মধ্যে হিন্দুর হার কতো বেশি তা হিসাব করে দেখেছেন?
এসব একসেপশন। টোটাল পজিশনটা কী? প্রশ্ন করে আবার জবাব দেওয়ার কাজটিও সম্পন্ন করে ডাক্তার সাহেবই, বিজনেস ওদের হাতে, চাকরি বাকরিতে বড়ো বড়ো পোস্টও দখল করে আছে তো ওরাই। ভালো পজিশনে থাকলে জাতভাইদের টেনে তোলা যায়। আমাদের সেই অপরচুনিটি কোথায়?
গভর্নমেন্ট তো মুসলিম লীগের। লীগ তো বেঙ্গল রুল করছে অনেক দিন। এক ফেমিন ছাড়া এদের বড়ো কীর্তি আর কী বলেন তো?
এই তো ঠিক পয়েন্টে আসলেন। ছোটোমিয়াকে জুতমতো ধরা গেছে এমন ভাব . করে ডাক্তার, ফেমিনের সময় বেঙ্গল গভর্নমেন্ট চাল চাইলো বিহার গভর্নমেন্টের কাছে, হিন্দু ডমিনেটেড কংগ্রেস গভর্নমেন্ট না করে দিলো। এখানকার হিন্দু লিডাররা পুরো সায় দিলো বিহারকে। ওয়ারের নাম করে বৃটিশ চাল সব গায়েব করে দিলো। বদনাম হলো। মুসলিম লীগের। পাকিস্তান হলে হেলপ করবে গোটা ইনডিয়ার মোসলমানরা। মোসলমান বিজনেস কমিউনিটি হেলপ করার স্কোপ পাবে।
মোসলমান জমিদার যারা আছে তারা এখুন কী হেলপ করছে? হিন্দু জমিদার ছাড়া দেশে স্কুল কলেজ হতো? এই ডিস্ট্রিক্টে এক জেলা স্কুল ছাড়া আর সবই হিন্দু জমিদারদের দান। টাউনে তো বড়ো বড়ো জমিদার দুজনেই মোসলমান, কোনো স্কুল কলেজের জন্যে একটা ইট দিয়েছে কেউ? ডাক্তার সাহেব, এসব কাজ করতে আলাদা মেন্টালিটি লাগে, বুঝলেন?
মেন্টালিটি তৈরি হবে পাকিস্তান হলে। নিজের দেশে পাওয়ার থাকবে নিজেদের হাতে, মুসলমান জমিদারদের তখন সোস্যাল রেসপনসিবিলিটি গ্রো করবে।
কিন্তু ডাক্তারের এই কথায় কাদেরের সায় নাই, সে বরং প্রতিবাদ করে, পাকিস্তানে জমিদারি সিস্টেম উচ্ছেদ করা হবে। বিনা খেসারতে জমিদারি উচ্ছেদ করা হবে। পাকিস্তানে নিয়ম হবে জমি তার লাঙল যার। পাকিস্তানের আমিরে গরিবে ফারাক থাকবে না।
এই কথাগুলো অনেক গুছিয়ে বলতে পারে ইসমাইল হোসেন। কলকাতা থেকে বস্তা বস্তা কাগজ আসছে, পপাস্টারে লিফলেটে এইসব কথা লেখা থাকে। পাকিস্তান নামে বইও এসেছে। কাদের সেসব পড়ে, কিন্তু ঠিকমতো বলতে পারে না। তার অগোছালো উত্তেজনায় কেউ সায় দেয় না। আসিরুদ্দিন ডাক্তার বরং একটু বিরক্ত হয়। জমিদারি ব্যবস্থার অভাবে সম্পত্তির মালিকানায় অরাজকতা দেখা দেবে ভেবে শরাফত মণ্ডল ছেলের মন্তব্যে সায় দিতে পারে না। বরং নিশ্চিন্তে হাসে ছোটোমিয়াই, বলে, তোমরা জমিদারদের সম্পত্তি কেড়ে নেবে, বড়োলোকদের মারবে। কম্যুনিস্টদের সঙ্গে তাহলে তোমাদের ফারাক কী? এদিকে দীন ইসলামের কথা বলো, ওদিকে নাস্তিকদের কথা ধার করে বলো। আমরা এখন কোনটা ধরি, বলো?
ইসলাম তো সব মানুষকে সমান অধিকার দিয়েছে। ইসলামে কোনো কাস্ট সিস্টেম নাই। আমাদের নবী এই কথা বলে গেছেন কতো আগে। কম্যুনিস্টরাই এসব ধার করেছে ইসলামের কাছ থেকে। কাদেরের গলা আত্মবিশ্বাসে ঝাঝালো হয়ে উঠেছে। এই ঝাঁঝ ইসমাইলের কাছ থেকে ধার-করা টের পেয়ে ছোটোমিয়া সন্তুষ্ট দামাদমিয়া এই এলাকায় সাগরেদ বেশ ভালো জুটিয়েছে। নমিনেশন পেলে ভোটটা ভালোভাবেই পাড়ি দেব। যাক, করতোয়ার পুব দিকটা তাহলে তাদের আত্মীয় কুটুম্বের দাপটে থাকে। ছোটোমিয়ার সন্তোষের আরেকটি কারণ হলো এই যে, ইসমাইলের সঙ্গে রাজিয়ার বিয়ের সম্পর্কটা পাকা হয় তার হাতেই। বড়ো ভাইয়ের তো ইচ্ছাই ছিলো না, মেজাভাইও তেমন গা করে নি। জমিজমা তেমন নাই; শুধু শহরের চাকুরে পরিবারের ছেলে হয়ে শিমুলতার মিয়াদের বাড়ির জামাই হওয়া অতো সোজা নয়। এই কঠিন কাজটি সম্পন্ন হলো কেবল ছোটোমিয়ার গোঁ ছিলো বলেই। আজ সেই জামাইয়ের সাফল্যের আভাস পেয়ে সে তো একটু খুশি হবেই। কাদেরকে তার ওই জামাইয়ের কথাগুলোর জবাব দিতেও তার ভালো লাগে, ইসলামে কি কারো সম্পত্তি দখল করার হুকুম আছে? আমাদের হজরত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাহিসালাম কি হজরত ওসমান রাজিআল্লাহু আনহুর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছিলেন? বরং তার সঙ্গে তিনি তার দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। ধনী গরিব বড়ো কথা নয় বাবা। পরহেজগার মানুষ আমির হলেও ভালো, গরিব হলেও ভালো।
এতোসব খুঁটিনাটি ব্যাপার কাদেরের জানা নাই, জবাবই বা সে দেবে কোত্থেকে? ইসমাইল ভাই আজ খামাখা কলকাতা গেলো। কর্পোরেশনের মেয়র ইলেকশনের এখনো এক মাস, অথচ সেই অছিলা করে লোকটা ছুটলো। সুযোগ পেলেই খালি কলকাতা ছছাটে। ইসমাইল হোসেন আজ থাকলে এখানে চমৎকার মিটিং করা যেতো একটা। এক সাথে এতো মানুষ পাওয়া কি সোজা কথা?
তোমাদের লীগের বড়ো বড়ো হোমরাচোমরা তো সবই জমিদার আর বড়োলোক। তাদের উচ্ছেদ করলে তোমাদের পার্টি টিকবে কী করে? তার দীর্ঘ বক্তব্যের উপসংহার সেরে তার যুক্তি প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে ভেবে ছোটোমিয়া তৃপ্তি পায় এবং বিজয়ীর উদারতায় আবদুল কাদেরকে রেহাই দিতে সে প্রসঙ্গ পাল্টায়। আবদুল আজিজের বড়ো ছেলে বাবরকে কোলে কাছে টেনে নিয়ে তার নাম, কোন স্কুলে কোন ক্লাসে পড়ে, পরীক্ষায় কেমন করে, ধান গাছে বড়ো বড়ো তক্তা হয় বাক্যটির ইংরেজি অনুবাদ কী প্রভৃতি জিগ্যেস করে এবং নিজের রসিকতায় হো হো করে হাসে। বাবর কিছুক্ষণ উসখুস করে ছোটোমিয়ার কৌতূহল ও আদর সহ্য করে ঘর থেকে বাইরে চলে যায়। ছেলে হাতছাড়া হলে ছোটোমিয়া ধরে তার বাপকে। আবদুল আজিজের বস সাব-রেজিস্ট্রার সাহেবের জীবন বৃত্তান্ত তার প্রায় সবটাই জানা। মুর্শিদাবাদের কোন এক। খান বাহাদুরের অকর্মণ্য ছেলে, আনওয়ার্দি সন অফ ওয়ার্দি ফাদার হিসাবে লোকটা চাকরি পেয়েছে কবে, সব কথা ছোটোমিয়া ফাঁস করে দেয়। আবার এটাও জানায়, সাব-রেজিস্ট্রারের সঙ্গে তাদের তিন পুরুষের আত্মীয়তা। ছোটোমিয়ার এক চাচী এসেছে ওই পরিবার থেকে এবং ওই চাচীর বাবা আবার ছোটোমিয়ার খালার দেওরের খালুশ্বশুর। তাদের এই ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধের কথা জেনে আজিজ বড়োই পুলকিত। জয়পুরে। অফিসে যোগ দিয়েই স্যারকে এটা জানাতে হবে। বেশ আনন্দিত চিত্তে এই খানকা। ঘরের মেহমানদের খাওয়ার বন্দোবস্ত কতোটা হলো তার খবরদারি করতে সে রওয়ানা হলো বাড়ির ভেতর। এইসব খাস মেহমানদের রান্নাবান্না হচ্ছে বাড়ির ভেতরে রান্নাঘরে, রাঁধছে তার বৌ আর শাশুড়ি। এদের জন্যে দুটো খাসি জবাই করা হয়েছে, এদের কেউ হয়তো গোরু নাও খেতে পারে। আর শুধু গোরুর গোশত দিয়ে কি সবাইকে ভাত খাওয়ানো যায়? দৈয়ের জন্যে লোক পাঠানো হয়েছিলো হাতিবান্ধায়, গোপাল ঘোষ নিজে দৈ নিয়ে আসবে। এখন পর্যন্ত তার দেখা নাই। বেলা হয়ে যাচ্ছে। তবে খানকা। ঘরের মেহমানদের আসার পরপরই ভারী নাশতা দেওয়া হয়েছে, তাদের খিদে লাগতে একটু সময় দেওয়ার দরকার।
এদিকে কিছুক্ষণের মধ্যেই জেয়াফতের মজলিশ থেকে জোরে জোরে ধমক দেওয়ার আওয়াজ পাওয়া গেলো। কী নিয়ে কে কাকে ধমক দিচ্ছে না এই খানকাঘর থেকে বোঝা গেলেও একজনের গর্জনে আঁচ করা যায় যে, ওখানে কেউ সাংঘাতিক অপরাধ করে। ফেলেছে। মজলিশের হৈ চৈতে এখানেও অস্বস্তিকর নীরবতা নামে। মুসলিম লীগের এক উত্তেজিত কর্মী এই সুযোগ পাকিস্তানের অপরিহার্যতা নিয়ে নতুন করে কথা বলতে শুরু করে। জমিয়ে আলাপ করার প্রস্তুতি নেয় আবদুল কাদের। কিন্তু শরাফত মণ্ডলের ইশারায় তাকে উঠে যেতে হয় বাইরে যেখানে কে যেন কাকে কষে ধমকাচ্ছে।
টিনের আটচালা ও নতুন চারচালার মাঝখানে চওড়া গলির ভেতর থেকে গোরুর–গোশতের তরকারির বালতি হাতে তমিজকে ছুটে আসতে দেখে কাদের চোখে ও ভুরুতে প্রশ্ন ফুটিয়ে তুললে তমিজ বলে, হুরমত পরামাণিক ক্যাচাল করিচ্ছে।
ঝামেলা হুরমতুল্লা শুরু করলেও এতে তীব্রতা দেওয়ার কৃতিত্ব গফুর কলুর। বাইরের উঠানে কয়েকশো মানুষ বসার পর মানুষ উপচে পড়লে ওই গলিতে মুখোমুখি দুটি সারিতে পঞ্চাশ ষাটজন মানুষ বসাবার হুকুম দিয়ে গিয়েছিলো কাদের নিজেই। এখান সেখানে যারা বসেছে তাদের মধ্যে আছে হুরতমুল্লা আর তমিজের বাপ।। পরিবেশনের দায়িত্বে থাকলেও প্রথম দল বিদায় হবার পর হুরমতুল্লা খিদেয় অস্থির হয়ে আর অপেক্ষা করতে পারে না, গলির একটি সারিতে পাতা পেতে বসে পড়ে একটু চাপাচাপি করেই। কিন্তু পাশেই তমিজের বাপ। কেন বাপু, গোয়ালঘরের পেছনেই তো তোমাদের মাঝির জাতের মানুষের পাত পড়েছে, ওখানে সাকিদারি করার কাজও করছে মাঝিপাড়ার লোক। ওখানে বসলে তোমার পাতে ভাতের ভাগ কি কম পড়বে? না-কি গোশতের বালতি তোমাকে বাদ দিয়ে চলে যাবে সামনের দিকে? এক সারিতে বসলেও হয় কথা ছিলো, তা তো নয়, তমিজের বাপ বসেছে তার গা ঘেঁষে। শালা মাঝির এঁটো পাতের সুরুয়ার ছিটা কি ভাতের একটা দানা হুরমতুল্লার পাতে পড়লে সে সহ্য করে কী করে? হুরমতুল্লা তাই চাচায়, মাঝি, তোমার জাতের মানুষ তো ওটি এক ঠেনে বসিছে। তুমি এটি পাত পাতো কোন আক্কেলে গো?
তমিজের বাপ এসব কথায় কান না দিয়ে তার কলাপাতার টুকরাটা হাত দিয়ে। মোছে, কলাপাতায় ময়লা দাগ পড়ে, বারবার মুছলে সবুজ রঙ চাপা পড়লেও সেদিকে তার খেয়াল নাই, তার দুই চোখেই সে তাকিয়ে থাকে ধোয়া-ওঠা ভাতের চাঙাড়ির দিকে, ওটা এ পর্যন্ত পৌঁছুতে আর কতো দেরি?
হুরমতুল্লার সব অভিযোগ শুনে গফুর কলু এগিয়ে আসে। তার মূল দায়িত্ব ভদ্রলোক মেহমানদের খেদমত করা। তারা তো এখানে খানকাঘরে বসে গপ্পো করেছ; এই সুযোগে সে কলুদের খাওয়ার দেখাশোনা করছিলো। কলুরা বসেছে শিমুলতলার বকের ঝকের নিচে। তাদের জন্যে গোশতের বালতিতে সুরুয়ার সঙ্গে গোশতের পরিমাণ নিশ্চিত করতে সে নিজেই যাচ্ছিলো ভেতর উঠানের দিকে। এদিক দিয়ে হাঁটার সময় জাত তুলে কথা বলতে শুনে প্রথমেই সে ধমক দেয়, মোসলমানের আবার জাত কী গো? খবরদার, জাতের কথা কলে এই বাড়িত খাওয়া চলবি না।
ধমকে হুরমতুল্লা ভয় পায়। কলু জাতের মানুষ হলেও গফুরের দাপট সম্বন্ধে হুরমতুল্লা ওয়াকিবহাল, তাই সে তাড়াতাড়ি অন্য নালিশ করে, জাতের কথা লয় বাপু, খালি জাতের কথা লয়। খ্যাপশা বুড়া খাবার বস্যা খালি পাদে, গোন্দে প্যাট হামার খালি ঘাঁটিচ্ছে। বুড়াক তুমি সর্যা বসবার কও।
গোশতের খুশবুতে অন্য যে কোনো গন্ধই তো চাপা পড়বে। তবু তমিজের বাপের এই কাজটিকে গফুর কলু অনুমোদন করতে পারে না। থুথু ফেলে সে নাকে হাত দেয়। তার দেখাদেখি এবং তার সম্মানে আরো কয়েকজন নিজনিজ পাতের সামনে গোশতের সুরুয়া মেশানো আঠালো থুথু ফেলে। ততোক্ষণে হুরমতুল্লা ও তমিজের পাতে ভাত পড়েছে এবং গোশতের সুরুয়াও দেওয়া হয়েছে দুই হাতা করে। দুজনেই ভাতের গর্ত করে গোশতের টুকরাগুলি আলাদা করে একটু আড়াল করে রেখে সুরুয়ামাখা আঙুল চোষে। গোশত পাতে পড়ার আগেই অবশ্য নুনমাখা ভাতের কয়েকটি লোকমা তাদের মুখে উঠে পড়েছে।
গফুর কলু কপাল কুঁচকে তমিজের বাপের মুখে সরাসরি তাকায় এবং হঠাৎ বলে, ক্যা গো তুমি না গোয়ালঘরের পাছামুড়াত বস্যা খায়া আসলা। আবার এটি খাবার বসিছো? ওঠো, এখনি ওঠো। দুইবার কর্যা কাকো খাওয়া দেওয়া হবি না। একবার যতো খুশি খাও, প্যাট ড়ুমড়ুম্যা করা খায়া ওঠো। কিন্তু দুইবার দেওয়া হবি না, পোটলাও বান্দার দিমু না। এই জেয়াফতে খাওয়ার বিধিমালা জানিয়ে সে বিধি প্রয়োগের উদ্যোগ নেয়, ওঠো! ল্যালপা বুড়া। ওঠো কলাম।
তখন মোটা একটা হাড় থেকে মজ্জা বের করার কাজে তমিজের বাপ খুব ব্যস্ত, গফুর কলুর নির্দেশ মানা তার পক্ষে অসম্ভব। বরং গফুরের হুমকিতে তার খিদে বাড়ে দশ গুণ এবং মজ্জা চোষা স্থগিত রেখে ভাত মুখে দিতে থাকে, তখন তার একেকটা গ্রাস তেআঁটিয়া তালের সমান। তার আশেপাশের এবং সামনের সারির কেউই তার দুইবার খাওয়া একেবারেই অনুমোদন করে না, জেয়াফতে এসে একবারের বেশি খাওয়া যে খুবই বদ খাসলতের প্রকাশ এ ব্যাপারে তারা একমত। তবে তাদের ধিক্কার জ্ঞাপনও পানসে। গফুর কলুকে খুশি করা তাদের উদ্দেশ্য, কিন্তু এই নিয়ে বেশি কথা বলা মানে এখন সময়ের অপচয় বিবেচনা করে পরম নিষ্ঠার সঙ্গে একটির পর একটি লোকমা মুখে তোলে। তমিজের বাপের দৃষ্টান্ত তাদের কাউকে কাউকে দ্বিতীয়বার চুপচাপ পাত পাতার ফন্দি আঁটতে উদ্বুদ্ধ করেও থাকতে পারে।
হুরমতুল্লা ও গফুর কলু দুইজনের দুই ধরনের আপত্তি সত্ত্বেও তমিজের বাপ ফের ভাত নেওয়ার জন্যে পাত থেকে মুখ তুলে এদিকে ওদিকে তাকায়। ওই সময় তমিজ ওই গলি দিয়ে যাচ্ছিলো গোশতের বালতি হাতে। মাঝিপাড়ার মানুষদের পরিবেশন করতে করতে গফুরের মতো সেও যাচ্ছিলো ভেতরের উঠানে তার বালতিটা ভরে নিতে। রান্নাবান্না বাইরে হলেও নিরাপত্তার স্বার্থে গোশতের বড়ো বড়ো ডেকচিগুলো রাখা হয়েছিলো বাড়ির ভেতরের উঠানে একটা নতুন চালার নিচে। তা তমিজ তো কিছুক্ষণ আগে নিজেই বাপকে পাত ভরে ড়ুমা ড়ুমা গোশত ঢেলে দিয়েছে। গোয়ালঘরের পেছনে এক পেট খেয়ে বাপকে ফের এখানে এসে বসতে দেখে তমিজের হাসিই পায় : বুড়ার বেটার খাবার হাউসটা একটু বেশি। তা খাক, বুড়া মানুষ, এরকম খাবার ফের কবে জোটে আল্লাই জানে। মণ্ডল এতো এতো খাওয়াচ্ছে, দুইবার কেন, তিনবার চারবার। খেয়েও বাপের দিলটা যদি মণ্ডলের প্রতি একটু নরম হয় তো ভালো। বাপটাকে বেশি করে গোশত দেওয়া যায় কী করে এই ভাবতে ভাবতে সে শুনতে পায় গফুর কলুর কড়া নির্দেশ, ওঠো। তুমি ওঠো কলাম। সঙ্গে সঙ্গে বাপের প্রতি প্রশ্রয় তার চাপা পড়ে তীব্র। ক্ষোভের তলায়।কয়টা দিন মণ্ডলবাড়ির এই জেয়াফতের জন্যে বেগার খাটলাম দেখ্যা বুড়া কী কথাটাই না হামাক শুনালো। আর তুমি এটি আসো ল্যালপা ফকিরের লাকান। তোমার দশগজি জিভখান লিয়া একবার গোলঘরের ওটি খায়া উঠা তুমি ফির আরেক জায়গাত অ্যাস্যা পাত পাতো। খাওয়ার এতো লালচ তোমার?—উচ্চারণ করে বলতে না পারলেও মনে মনে সে এই কথাগুলি ঠিক এমনি করেই আওড়ায়। গফুর কলু যেমন হারামি, মাঝির ঘরের তালাক-খাওয়া মাগীকে বিয়ে করে আর কাদেরের পাছার পেছনে। পেছনে ঘুরে ঘুরে শালা কি-না-জানি-হনু-রে ভাব নিয়ে থাকে, শালা বুড়া মানুষটাকে পাত থেকে না উঠিয়ে ছাড়বে না।-এতোগুলো মানুষের সামনে বাপের ভোগান্তি দেখা এড়াতে তমিজ হনহন করে হাঁটে গোয়ালঘরের দিকে, এমন কি গোশতের বালতি ভরে না নিয়েই। মাঝিদের পেট পুরে খাওয়াতে পারলে তাদের জানগুলো আরাম পায়। আবার তাদের মতো মাঝির ঘরের মানুষ হয়েও মণ্ডলবাড়িতে তমিজের দাপট দেখে ওই জানগুলোই হিংসায় চিনচিন করে। এতোগুলো জানের আরাম ও হিংসা তৈরির গৌরব ও সুখ থেকে সে বঞ্চিত হচ্ছে বাপের লালচের জন্যে।
চারচালা টিনের ঘরের জানলার কপাট একটু ফাঁক করে দুইজন মানুষের দুই ধরনের আপত্তি অগ্রাহ্য-করা এক বুড়োর প্রবল তেজে খাওয়া দেখছিলো আবদুল আজিজের শাশুড়ি। নাতি মরার পর দিন সে এসেছিলো টাটকা শোক নিয়ে। এবার দিন তিনেক হলো এসেছে মেয়ের শোক ও নাতির চল্লিশায় যোগ দিতে। মণ্ডলের দুই নম্বর বিবির অনুরোধে খাস মেহমানদের রান্নার দেখাশোনাও করছে সে-ই। এদের বাড়ি টাউনের সঙ্গেই। তাদের হাটবাজার, টুকটাক ব্যবসাপাতি, রোজগার কামাই সব টাউনেই। ছয় মাসে নয় মাসে ফাস্ট শো টকি দেখে তাদের বাড়িতে মেয়েরা বাড়ি ফেরে শাড়ি-জড়ানো রিকশা করে।
টাউনের প্রভাবে এবং একটু টানাটানির জন্যেও বটে, তাদের খাওয়া-পরা, ঘোরাফেরা মোটামুটি ছিমছাম। উত্তেজনা যেটুকু আছে তাও. প্রায় বাঁধা ধরা। টাউন তাদের একেবাইে ছোটো; কিন্তু চাষবাস নাই বলে রোজগার সম্বন্ধে মোটামুটি আগে থেকেই সব জানা। জীবনযাপনও তাই ধরাবাঁধাই বলা চলে। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে নাতির চল্লিশায় হৈ চৈ, ভিড়ভাট্টা এবং অনির্ধারিত ও অকল্পনীয় উত্তেজনা দেখে এবং খানদানি মেহমানদের রান্নার তদারকি করার সুযোগ পেয়ে হিংসায়, খুশিতে, গর্বে আজিজের শাশুড়ি ছটফট করে এবং যেদিকে চোখ যায় তাই দেখে নেয় নয়ন ভরে। রান্না সেরে মুখে একটা পান পুরতে এবং মেয়েকে কাছে পেলে ভালো রান্না সম্বন্ধে এই বাড়ির মানুষের সীমাহীন অজ্ঞতা নিয়ে তাকে যথাযথ ধারণা দিতে সে এসেছিলো মেয়ের ঘরে। জানলার ঠিক বাইরে কাঁচাপাকা দাড়িওয়ালা একটা বুড়াকে এরকম হেনস্থা হতে দেখে সে হেসে ফেলে। ব্যাপারটা দেখে সে বেশ তারিয়ে তারিয়ে এবং যতোই দেখে, ততোই হাসে।
ভেতর উঠানে সারি সারি কলাপাতার সামনে বসা মেয়েদের এবং তাদের কোলেপিঠেবুকে আসা রোগা, বেঢপ মোটা, পেটফোলা, মাথায় ঘা, চোখে পিঁচুটি ও নাকে-সিকনি বাচ্চাদের খাওয়ার তদারকি করতে করতে হামিদার হঠাৎ হঠাৎ করে মনে পড়ে তার ছেলের কথা। এতোগুলো মানুষ আজ মেতে উঠেছে ভাতের উৎসবে, গোশতের উৎসবে। তার সোনার টুকরা, বুকের মাণিকের অছিলাতেই এই বাড়িতে আজ এতোগুলো মানুষের মুখে ভাতের গেরাস ওঠে। অথচ, হায় রে, ছেলেটা তার কিছুই দেখতে পারলো না।-চোখের পানি মুছতে মুছতে হামিদা তার নিজের ঘরে এসে বিছানায় বসে হুহু করে কাঁদে। কিন্তু কান্নার সময় কৈ তার? তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে তাকে ফের যেতে হয় উঠানে। সে নিজের হাতে যতো মানুষকে যতো তৃপ্তি দিয়ে খাওয়াতে পারবে, মাসুম ছেলেটার রুহে ততো শান্তি, ততো তৃপ্তি। এখনি ফের উঠানে। যাবে বলে হামিদা উঠতে যাচ্ছিলো, জানলার পাশ থেকে ডাক দিলো তার মা, ও হামিদা, দেখ, মানুষটা ক্যাংকা করা ভাত খাচ্ছে, দেখ। আর একবার বলে খায়া আসিছে। দেখ, একোটা লোমা কতো বড়ো? গাঁয়ের মানুষ এতোও ভাত খাবার পারে গো!
গ্রামের মানুষের বেশি বেশি ভাত খেতে দেখার প্রবৃত্তি হামিদার একেবারেই নাই। বিয়ের পর থেকেই এটা দেখে দেখে সে একেবারে অতিষ্ঠ। নেহায়েৎ মায়ের উৎসাহে হামিদা এসে দাঁড়ালো একটু-ফাঁক-করা জানলার পাশে।
ঐ সময়টায় গফুর কলু ও হুরমতুল্লার দুইরকম অভিযোগ ও ধিক্কার শুনতে শুনতে তমিজের বাপ আরো চারটে ভাতের আশায় পাত থেকে চোখ তুলে তাকিয়েছিলো ওপরের দিকে। এই ঘরের জানলার ফাঁক দিয়ে তার মুখটা এবার স্পষ্ট দেখা গেলো। তমিজের বাপকে দেখেই হামিদা একটা জোর ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে পেছন দিকে। বিছানাটা ছিলো বলে বসে পড়লো ওটার পরেই। তা জানলা দিয়ে তমিজের বাপকে চোখে পড়ে এই বিছানা থেকেও। পাতে দ্বিতীয় দফা ভাত তখনো পায় নি বলে তমিজের বাপের মুখটা তখনো ওপরের দিকে ফিট-করা। সুতরাং হামিদা তাকে নয়ন ভরে দেখতেই থাকে। দেখতে দেখতেই সে কাঁপে এবং তার পাশে বসে মা তাকে জড়িয়ে ধরে ব্যাকুল হয়ে বলে, কী মা? কী হলো রে মা?
ফ্যাকাশে চেহারার মুখ দিয়ে হামিদা ফিসফিস করে, এই মানুষই মা! এই মানুষটাই গো হুমায়ুন যাওয়ার আগের দিন রাতে, না-কি তার আগের রাতে, তোমাক কলাম না মা, কই নাই? এই মানুষটাই আসিছিলো গো। হামিদার মায়ের সব মনে আছে। হামিদার সেই কালরাত্রির অভিজ্ঞতার কথা হামিদার মা শুনেছে হুমায়ুনের মৃত্যুর পরদিনই এখানে এসে। এই বাড়ির সব মানুষ এই ঘটনা জানে। গ্রামের লোকও অনেকে শুনেছে আর হামিদা তার মাকে বলেছে অন্তত একশো বার।