হার্সিসাহেবের কাণ্ড
হার্সি (Hersey) পরিবারের নাম সাধারণত ইতিহাসের বইয়ে পাওয়া যাবে না। তাঁরা খাঁটি ইংরেজ ছিলেন না। তাঁরা এদেশের বাসিন্দা হয়ে গিয়েছিলেন, বিয়েও করতেন ভারতীয় মেয়েদের। হার্সির প্রথম নাম হায়দার। তাঁর মা জাঠ পরিবারের মেয়ে। লর্ড ওয়েলেসলির আগে পর্যন্ত তাঁরা ভারতীয় নবাব কিংবা রাজাদের কাছে চাকরি করেছেন। প্রত্যেকের কিছু কিছু সৈন্য থাকত। ভাল সৈনিক বলে ইউরেশিয়ানদের খ্যাতি ছিল। তাঁরা ভাল গোলন্দাজ হতেন। কেউ ছোটখাটো রাজ্যও গড়ে নিয়েছিলেন। লর্ড ওয়েলেসলির সময় থেকে এইসব অর্ধ-বিদেশীদের সুখের দিন শেষ হল। তিনি হুকুম দিলেন বিদেশীদের এভাবে চাকরি দেওয়া বন্ধ করতে হবে। অন্যান্যদের মতো হার্সি-পরিবারেরও কিছু অসুবিধা হল। তবে মেজর হার্সি অন্যদের থেকে একটু আলাদা ধরনের ছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত ভারতীয় রাজা কিংবা নবাবদের কাছে চাকরি করেছেন। তাঁর পরিবারের অনেকে ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধের পর থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাদলেও কাজ করেছেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে মেজর হার্সি অযোধ্যার নবাবের অধীনে চাকরি নিয়েছিলেন। একসময় তিনি দৌলতরাও সিন্ধিয়ার সৈন্যদলে ফরাসি অধিনায়ক পেরনের অধীনেও চাকরি করেছেন। পরে তিনি দল ছেড়ে জর্জ টমাসের কাছে চাকরি নিয়েছিলেন। জর্জ টমাস আয়ারল্যান্ডের লোক। তিনি পেরনের শত্রু ছিলেন। হার্সির ইচ্ছা হল, তিনি রাজপুতানায় কোথাও তাঁর নিজের একটি ছোট্ট রাজ্য গড়ে তুলবেন। কিন্তু ওয়েলেসলির সময় থেকে এ আর সম্ভব থাকল না। বেশির ভাগ সৈন্যদের ছাড়িয়ে দিতে হল এবং অল্প লোক নিয়ে তিনি কোম্পানির সৈন্যদলে যোগ দিলেন। কোম্পানির কাছ থেকে মাসিক আটশো টাকা পেতেন।
মারাঠাযুদ্ধ শেষ হবার পর হার্সি একজন মুসলমান মহিলাকে বিয়ে করে রোহিলখণ্ডে একটি গ্রামে গিয়ে বসতি করলেন। কিন্তু চুপচাপ বসে থাকা হার্সির স্বভাবে ছিল না। তিনি একদল পরিব্রাজকের সঙ্গে উত্তর-ভারতবর্ষে গঙ্গা-যমুনার উৎপত্তির জায়গা জরিপ করতে বেরিয়েছিলেন।
এর চার বছর পরে তিনি একটি খুব বড় কাজে হাত দিয়েছিলেন। উইলিয়াম মুরক্রফট নামে একজন পণ্ডিত পরিব্রাজকের সঙ্গে যোগ দিয়ে হার্সি মানস-সরোবরে গিয়েছিলেন। তাঁর দুটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মানস-সরোবর জরিপ করা, আর সে-দেশ থেকে ভেড়ার লোমের নমুনা সংগ্রহ করে দেশে নিয়ে আসা। ১৮১২ সালে গরমের সময় যোশীমঠ থেকে যাত্রা করলেন। তিব্বত তখন অন্য দেশের লোকের কাছে নিষিদ্ধ দেশ। বাইরের লোক ধরা পড়লে তাঁর প্রাণসংশয় হতে পারত। মুরক্রফট ও হার্সি দুজনেই ছদ্মবেশে সন্ন্যাসীর পোশাক পরে গিয়েছিলেন। এঁরা নিশ্চয়ই হিন্দি বলতে পারতেন। মুরক্রফটের শরীর ভাল যাচ্ছিল না বলে তিনদিনের বেশি মানস-সরোবরে থাকা সম্ভব হয়নি। মুরক্রফটের লেখা একটি রোজনামচা আছে, তাতে ক্যাপ্টেন হার্সির নাম বহুবার করা হয়েছে। কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটির এক সভায় এই রোজনামচা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। আরও বছর-দুয়েক পরে যখন নেপালের সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যুদ্ধ বাধল তখন হার্সি সে-যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। এর অল্প পরে রোহিলখণ্ডে এক বিদ্রোহের সময় আবার তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে লড়াই করেছিলেন।
১৮২৪ সালে ইংরেজরা যখন ভরতপুরে দুর্গ অবরোধ করেন হার্সিও তখন তাঁদের সঙ্গে সে-যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। রোহিলখণ্ডের বিদ্রোহের আগেই কাজের জন্য হার্সির পদোন্নতি হয়েছিল। তিনি ‘মেজর’ হলেন।
হার্সি যে অনেক বিষয়ে সাধারণ লোকের চেয়ে অন্য ধরনের ছিলেন সেকথা তাঁর কাজ থেকে স্পষ্ট হবে। তাঁকে নির্বোধ মনে করবারও কোনো কারণ নেই। কিন্তু ১৮৩২ সালে তিনি এমন একটি কাণ্ড করে বসলেন যে, সরকারি মহলে তাঁর নাম পুনর্বার শোনা যেতে লাগল।
কানপুরের কাছে বিচুরে ভূতপূর্ব পেশোয়া দ্বিতীয় বাজীরাও থাকতেন। মারাঠাযুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এক জায়গায় তাঁর বাসস্থান ঠিক করে দিয়েছিলেন। কোম্পানির কাছ থেকে তিনি বছরে আট লক্ষ টাকা বৃত্তি পেতেন। সেকালে অনেক টাকা। এই টাকায় তাঁর ভালভাবে দিন কেটে যেত। ইচ্ছামতো দানধ্যান করতেন। ইংরেজরাও বোধহয় চেয়েছিলেন, বাজীরাও বন্দিদশায় এ-সব করে সুখে থাকুন। যুদ্ধবিগ্রহে তাঁর নিজের কোনো উৎসাহ ছিল না। বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাবার জন্য যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন তা-ও নয়। তাঁর দেওয়ান রামচন্দ্র পন্ত পুনা থেকে মনিবের সঙ্গে বিঠুরে এসেছিলেন। পেশোয়ার সঙ্গে কয়েক হাজার লোকও মহারাষ্ট্র দেশ থেকে এসেছিলেন। এই নিয়ে বাজীরাওয়ের পৃথিবী। তাঁর স্বাস্থ্য বিশেষ ভাল থাকত না। যখন তাঁকে এত টাকা বৃত্তি দেওয়া হল তখন ইংরেজরাও কেউ কেউ ভেবেছিলেন শেষ পর্যন্ত কোম্পানির বেশি টাকা খরচ হবে না। বাজীরাওয়ের যা শরীর তিনি হয়তো দীর্ঘকাল বাঁচবেন না। কিন্তু তাঁদের আশার মুখে ছাই দিয়ে বাজীরাও ত্রিশ বছরের বেশি এই বৃত্তি ভোগ করেছিলেন। তবে ইংরেজদের কোনও রকম জ্বালাতন করার ইচ্ছা বা ক্ষমতা তাঁর ছিল না। তবু মাঝে মাঝে গুজব রটত বিঠুর থেকে গোলমাল হবার সম্ভাবনা আছে। এসব কথা ইংরেজরাও বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করতেন না।
এইরকম একটি ব্যাপার ১৮৩২ সালে ঘটেছিল। মেজর হায়দার হার্সি তার নায়ক। বাজীরাওয়ের দেওয়ান রামচন্দ্র পন্তের কাছে একজন হরকরা চিঠি নিয়ে এল। তার চাপরাসে হার্সির নাম লেখা। রামচন্দ্র পন্ত খুব সাবধানী লোক। তিনি চিঠি নিলেন বটে কিন্তু খুললেন না, সরাসরি বিঠুরের কমিশনার জেমস ম্যানসনের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। ম্যানসন চিঠি খুলে দেখলেন যে সর্বনেশে ব্যাপার ঘটতে চলেছে। তিনিও বোধহয় আগে হার্সির নাম শোনেননি। কারণ গভর্নর-জেনারেলকে তিনি লিখলেন, কে একজন মেজর হার্সি চিঠি লিখেছেন, চিঠিতে বলেছেন তিনি বেরিলির লোক। চিঠিতে কতকগুলি সাংঘাতিক কথা আছে। হার্সি যে চিঠি লিখেছিলেন তাতে তিনি মোটামুটি এই কথা বলেছিলেন—ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সনদ শেষ হয়ে যাবে। কোম্পানির অন্য কোনো অধিকার থাকবে না, কারণ ইংলন্ডের রাজা চতুর্থ উইলিয়াম নিজের হাতে তামাম হিন্দুস্তান নিয়ে নেবেন। কিছুদিন হল কোম্পানি সবাইয়ের মাইনে কমিয়ে দিচ্ছে। পেশোয়াকেও হয়তো এইরকম বিপদে পড়তে হবে। স্যার জন ম্যালকম তাঁর সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু ভবিষ্যতের ইংরেজরা কি পূর্ব-ব্যবস্থা মেনে চলবেন? (অর্থাৎ তাঁর বৃত্তি কি ঠিক পাবেন?) না-চলার সম্ভাবনাই বেশি। এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার একটি পথ আছে। সে হচ্ছে পেশোয়া যেন বিলাতে কোম্পানির ডিরেক্টরদের কাছে চিঠি লিখে জানান যে, তিনি তাঁর বার্ষিক বৃত্তির আট লাখ টাকা ছেড়ে দেবেন। তার বদলে দাক্ষিণাত্যে তাঁকে একটি জায়গির দিতে হবে। তাছাড়া ইংরেজরা পূনা লুটপাট করে অনেক ধনরত্ন বিলাতে পাঠিয়েছেন। যুদ্ধের সময় লুটপাট করে যে টাকা পাওয়া যায় সেটা বিজয়ীর প্রাপ্য। কিন্তু তার পরে যে টাকাপয়সা ধনরত্ন পুনা থেকে লুট করা হয়েছে তা বেআইনি হয়েছে। এই অর্থ ইংরেজের প্রাপ্য নয়। হার্সি প্রস্তাব করলেন যে, প্রথমে ডিরেক্টরদের এই সব কথা জানিয়ে চিঠি লেখা হোক। ডিরেক্টররা কর্ণপাত না করলে বোর্ড অব কন্ট্রোলকে ব্যাপারটি জানানো উচিত। ডিরেক্টরদের উপর তাঁদের ক্ষমতা আছে। তাতেও যদি কিছু না হয় তাহলে ইংলন্ডের রাজা চতুর্থ উইলিয়ামের কাছে আবেদন করা ছাড়া উপায় নেই। ইংলন্ডের রাজা নিশ্চয় এর একটা প্রতিবিধান তাড়াতাড়ি করবেন। ইংলন্ডের রাজাকে বলা হোক, যেসব ধনরত্ন পুনা থেকে কোম্পানির লোকরা নিয়ে গিয়েছে তার একটি বড় ভাগ তাঁকে দেওয়া হবে। দরকার হলে তার অর্ধেকও দেওয়া হতে পারে। এই লোভ দেখালেই তিনি রাজি না হয়ে পারবেন না।
হার্সি একথা বুঝতে পারেননি যে, ইংলন্ডের রাজাকে, একটু ঘুরিয়ে হলেও, এটা ঘুষের প্রস্তাব ছাড়া আর কিছু নয়। এর ফলাফল তাঁর পক্ষে ভাল হবে না। হার্সি আরও বলেছিলেন যে, তাঁর একজন বিচক্ষণ বন্ধু আছেন, তিনি এই চিঠি নিয়ে বিলাতে চলে যাবেন। রামচন্দ্র পন্ত এ প্রস্তাবে রাজি হলেই হার্সি বিঠূরে একজন ব্রাহ্মণ দূত পাঠাবেন। সে ইংরেজি ভাষা ভাল জানে। তার সঙ্গে কথাবার্তা বলে সব ঠিক করা যেতে পারে।
খুব আশ্চর্যের কথা, হার্সি কখনও ভাবেননি যে, তিনি আপত্তিকর কথা লিখেছেন। গভর্নর-জেনারেল সব কথা শুনে আশ্চর্য হলেন, জানতে চাইলেন সত্যিই কি হার্সি এ-রকম কোনো চিঠি লিখেছেন? হার্সি এর যে জবাব দিলেন তাতে কমিশনার খুশি হলেন না। হার্সি খোলাখুলি তাঁকে বলেছিলেন যে, বাজীরাওয়ের ধনসম্পত্তি যা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিয়েছেন সেসব অবৈধ হয়েছে। তিনি নিজেও তো একজন ভুক্তভোগী। লর্ড ওয়েলেসলির সময় কোম্পানি তাঁকে যেসব আশা দিয়েছিলেন তা পূর্ণ হয়নি। তিনি নিজে যে বৃত্তি পান তাও খুব কম। কমিশনার যেন এইসব কথা গভর্নর-জেনারেলকে জানান।
গভর্নর-জেনারেল এই সব কথা শুনে খুশি হলেন না। হার্সিকে খুব বকুনি দেওয়া হল। তিনি তো কোম্পানির নিমক খেয়েছেন, কোম্পানির কাছ থেকে পেনসন পান, তাঁর এসব কথা লেখা অন্যায় হয়েছে। আবার যদি এই ধরনের খবর গভর্নর-জেনারেলের কানে আসে তাহলে হার্সির পেনশন তত বন্ধ হবেই, আরও বেশি শাস্তি হতে পারে। হার্সি ধমক খেয়ে চুপ করে রইলেন।
হার্সি আর ভবিষ্যতে বিঠুরের কারুর সঙ্গে পত্ৰব্যবহার করেননি। তবে কখনও কখনও গুজব শোনা যত, অন্য কেউ কেউ বাজীরাওয়ের সঙ্গে মিলে অশান্তি করবার চেষ্টা করছে। সেসব বিশ্বাস করবার মতো কথা নয়। একবার সরকারের কাছে খবর গিয়েছিল শিবাজির বংশধর সাতারার রাজা প্রতাপসিং, যাঁকে ইংরেজরা পেশোয়ার হাত থেকে উদ্ধার করে সিংহাসনে বসিয়েছিলেন, তিনি বাজীরাও, ব্রহ্মদেশের রাজা ও নেপালিদের সঙ্গে মিলে খুব বড়রকম অশান্তি করবার চেষ্টা করছেন। কেউ বিশ্বাস করেনি একথা। ইংরেজরাও নয়। সাতারার প্রতাপসিংয়ের রাজত্বের দিন অবশ্য শেষ হয়ে আসছিল। কিন্তু সে অন্য গল্প।