হাবীব সহজে বিচলিত হওয়ার মানুষ না। তার চরিত্রে ‘হংসভাব প্রবল। হাঁসের গায়ে পানি লাগে না। হাবীবের মনে রাগ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনা তেমন ছায়া ফেলে না। তবে আজ নিশ্চয়ই বড় কিছু ঘটেছে। সকাল থেকে তিনি চরম ঝিম ধরে বসে আছেন। বলে দিয়েছেন কোনো মক্কেলের সঙ্গে আজ আর বসবেন না। যত জরুরি কথাই থাকুক চলে যেতে হবে।
প্রণব বলল, শরীর কি খারাপ?
হাবীব জবাব দিলেন না। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। প্রণব বলল, শরীর খারাপ বোধ করলে চেম্বারে বসে না থেকে বিছানায় শুয়ে থাকেন। কাউকে বলুন গা-হাত-পা টিপে দিবে।
হাবীব কিছুই বললেন না। টেবিলের ওপর থেকে খবরের কাগজ হাতে নিলেন। খবরের কাগজটা বাসি। গতপরশুর কাগজ। একবার পড়া হয়েছে। বাসি খবরের কাগজ বিষ্ঠার কাছাকাছি। হাতে লাগলেও গা ঘিনঘিন করে। হাবীব পাতা উল্টালেন। প্রণব বলল, আপনার মক্কেল সবুর বসে আছে। টাকাপয়সা নিয়ে এসেছে।
তুমি রেখে দাও।
আমার হাতে দিবে না। আপনার হাতে দিতে চায়। দুটা মিনিট সময় দেন। টাকা দিয়ে চলে যাক। ভাটি অঞ্চলের মক্কেল তো, টাকা সহজে বের করে না।
হাবীব হাত থেকে খবরের কাগজ রাখতে রাখতে বললেন, একবার বলে দিয়েছি দেখা হবে না। এখন টাকা দিবে বলে দেখা করব, এটা কি ঠিক? তাহলে কথার ইজ্জত কি থাকে।
প্রণব বলল, ঠিক বলেছেন। বাস্তব চিন্তা। আমার মাথায় বাস্তব চিন্তা আসে না। সব অবাস্তব চিন্তা।
হাবীব খান উঠে দাঁড়ালেন। দিঘির ঘাটলায় কিছুক্ষণ বসবেন। মন শান্ত করবেন। পানির দিকে তাকিয়ে থাকলে মন শান্ত হয়। প্রাচীন সাধুসন্ন্যাসীরা এই জন্যেই কোমরপানিতে দাঁড়িয়ে মন্ত্র-তন্ত্র পড়তেন।
হাবীব খানের মন বিক্ষিপ্ত হবার মতো ঘটনা ঘটেছে। তিনি একটা বেনামি চিঠি পেয়েছেন। বেনামি চিঠিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা ঠিক না। তিনি নিজেও করছেন না। কিন্তু মন শান্ত করতেও পারছেন না। চিঠির বিষয়টা নিয়ে প্রণবের সঙ্গে আলাপ করবেন কি না তাও বুঝতে পারছেন না। জটিল সমস্যায় কাছের মানুষের সাহায্য নিতে হয়। হাবীব হঠাৎ লক্ষ করলেন, তার কাছের মানুষ কেউ নেই।
দিঘির ঘাটে ছাতিমগাছের ছায়া। ছাতিমের ফুল ফুটেছে। মাথা ধরে যাবার মতো উগ্র গন্ধ। বসতবাড়ির আশেপাশে ছাতিম গাছ রাখতে নেই। ছাতিম ফুলের গন্ধে নেশা হয়। সেই নেশার ঝেকে কুকর্ম করতে মন চায়।
হাবীব ছাতিম গাছের নিচের ছায়াতে বসলেন। বাইরে কড়া রোদ। ছায়াতে বসে থাকতে ভালো লাগছে। গাছটা কাটিয়ে ফেলতে হবে। তখন আর গাছের ছায়ায় বসা যাবে না। তার মনে হলো, প্রতিটি কাজের কিছু উপকার আছে আবার কিছু অপকারও আছে। দুইয়ে মিলে সমান সমান।
দিঘির জলে শাপলা ফুটেছে। দেখতে সুন্দর লাগছে। এই সুন্দরের সঙ্গে অসুন্দরও আছে। অসুন্দরটা কী? ফুলের অসুন্দর নিয়ে চিন্তা করতে করতে হাবীব নিজের অজান্তেই পাঞ্জাবির পকেট থেকে বেনামি চিঠি বের করলেন। তিনচারবার পড়া চিঠি তিনি আবারও পড়লেন।
জনাব,
আপনি আমাকে চিনবেন না। আমি আপনার একজন শুভাকাক্ষী। আপনার কন্যা নাদিয়ার বিষয়ে আমি আপনাকে একটি গোপন তথ্য দিতেছি। নাদিয়া তাহার এক শিক্ষককে কোর্টে বিবাহ করিয়াছে। শিক্ষক হিন্দু। তাহার নাম বিদ্যুত কান্তি। আপনার মতো একজন সম্মানিত মানুষের মুসলিম কন্যার সহিত এক হিন্দু খনাবিহীন লিঙ্গ দ্বারা প্রতি রাতে যৌনকর্ম করিবে, ইহা কি সহ্য করা যায়? এখন কী করিবেন আপনার বিবেচনা।
হাবীব চিঠিটা কুচিকুচি করে ছিঁড়লেন। নোংরা চিঠি সঙ্গে নিয়ে ঘোরা ঠিক। কখন কার হাতে পড়বে! তিনি চিঠির টুকরা দিঘির পানিতে ছুড়ে মারলেন। বাতাসের কারণে টুকরাগুলো পানিতে পড়ল না। তার গায়ে ফিরে এল। হাবীবের শরীরে জ্বলুনির মতো হলো।
চায়ের কাপ নিয়ে প্রণব আসছেন। তার পেছনে হুক্কা হাতে একজন। তাকে হাবীব আগে দেখেননি। মহিষের মতো বলশালী চেহারা। গাত্রবর্ণও মহিষের মতো কালো শরীরের তুলনায় মাথা ছোট। মাথার চুল কদমছাট করা। প্রণব চায়ের কাপ হাবীবের পাশে রাখতে রাখতে বললেন, এর নাম ভাদু। কোচ চালনায় ওস্তাদ। জেলখাটা লোক। আপনি বললে রেখে দিব। বাড়িতে পাহারার লোকের সংখ্যা কম। রাতে বাড়ি পাহারা দিবে, দিনে ফুটফরমাশ খাটবে। এখন সময় খারাপ। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবকে ফাঁসিতে ঝুলাবে, তখন সমস্যা আরও বাড়বে। ময়মনসিংহ ক্যান্টনমেন্টে আরও সৈন্য এসেছে। এখন বলুন, ভাদুকে রাখব?
এত অকারণ কথা কেন বলো? রাখতে চাইলে রাখবা।
প্রণব বললেন, এই ভাদু, বড় সাহেবকে কদমবুসি করে চলে যা।
ভাদু কদমবুসি করল। হাবীব বললেন, কাগজের টুকরাগুলি তুমি তুলে দিঘির পানিতে ফেলো, এটা তোমার প্রথম কাজ।
হাবীব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন। ভাদু কাগজের টুকরা একটা-একটা করে বা হাতে জমাচ্ছে। আগ্রহ করে দেখার মতো কোনো দৃশ্য না। তারপরেও মানুষ মাঝে মাঝে তুচ্ছ বিষয়ে আগ্রহ বোধ করে। এখন ভাদু কাগজের টুকরাগুলি দিয়ে বল বানাচ্ছে। এখন সে কাগজের বল দিঘির দিকে ছুড়ে মারল। কাগজের বল দিঘির প্রায় মাঝখানে ভেসে রইল। হাবীব বললেন, তোমার প্রথম কাজে আমি সন্তুষ্ট। তুচ্ছ কাজ থেকে বোঝা যায় বড় কাজ কেউ পারবে কি না। তুমি কি কখনো খুন করেছ?
জি-না। তবে বললে করতে পারব।
আচ্ছা এখন সামনে থেকে যাও।
ভাদু থপথপ শব্দ করে চলে যাচ্ছে। প্রণব আবারও দৃষ্টি ফেরালেন দিঘির দিকে। কাগজের বল পানিতে জেগে আছে। বাতাসে ভাসতে ভাসতে তীরের দিকে আসছে। হাবীব খান অস্বস্তি বোধ করছেন। এই কাগজের বল কখন ডুববে! তিনি ক্লান্ত গলায় বললেন, প্রণব! তুমি নাদিয়াকে আমার কাছে পাঠাও।
এক্ষণ পাঠাইতেছি।
হাবীব বললেন, থাক দরকার নাই। তুমি সামনে থেকে যাও। আমি কিছুক্ষণ একা থাকব।
নাদিয়া তার দাদির খাটে বসে দাদির জন্যে পান ঘেঁচে দিচ্ছে। খটখট শব্দ হচ্ছে। নাদিয়া বলল, পান ঘেঁচার যন্ত্র থাকলে ভালো হতো, তাই না দাদি? সুপারি-পানচুন যন্ত্রের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলাম। বোতাম টিপলাম। মিকচার বের হয়ে এল।
হাজেরা বিবি বললেন, তোর হাতে যেইটা আছে সেইটাও তো যন্ত্র।
নাদিয়া বলল, তা ঠিক। এই যন্ত্রটা চলছে শরীরের শক্তিতে। আমি যে যন্ত্রের কথা বলছি সেটা চলবে বিদ্যুতের শক্তিতে।
হাজেরা বিবি হঠাৎ গল নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বললেন, যন্ত্রের একটা গফ শুনবি?
নাদিয়া বলল, কী গল্প?
হাজেরা বিবি বললেন, কাছে আয় কানে কানে বলি। এইটা উঁচাগলার গফ না। কানাকানির গরু।
নিশ্চয়ই নোংরা কোনো গল্প। আমি শুনব না।
হাজেরা বিবি খলবলিয়ে হাসতে লাগলেন। তার চোখ এখন আনন্দে চকচক করছে। তিনি পানের জন্যে হাত বাড়ালেন। নাদিয়া পান-সুপারির গুঁড়া তার হাতে ঢালতে ঢালতে বলল, তোমাকে নিয়ে আমি একটা উপন্যাস লিখছি। পড়ে শোনাব?
না। তুই আমার গফ শুনবি না, আমিও তার গফ শুনব না।
প্রথম লাইনটা শুধু শোনো—’আজ বারোই চৈত্র। হাজেরা বিবির বিবাহ।’
তুই তারিখে ভুল করছস। চৈত্র মাসে বিবাহ হয় না।
দাদাজানের লেখা খাতা থেকে তারিখ নিয়েছি।
তোর দাদাজান আমার বিষয়ে যা লিখেছে সবই ভুল। আমার নামও ভুল। হাজেরা আমার নাম না।
তোমার নাম কী?
এখন বিস্মরণ হয়েছি। তোর দাদাজান নাম বদলায়েছে। সে বলল, ডাক দেওয়া মাত্র হাজির হব। তাই নাম দিলাম হাজিরন বিবি। সেই থাইকা হাজেরা বিবি। তারপর কী হইল শোন। আমি উনাকে বললাম, একদিন আমার দিন আসব। আমি আপনারে ডাক দিব। আপনি হাজির হইবেন। আপনার নাম বদলায়ে আমি নাম রাখব হাজির বাবা।
নাদিয়া বলল, তুমি বানিয়ে বানিয়ে কথা বলা শুরু করেছ। বিয়ের সময় তোমার বয়স দশ বছর। দাদাজানের ত্রিশ বছর। দশ বছরের বালিকা এমন বয়স্ক একজনকে এ ধরনের কথা বলতে পারে না।
হাজেরা বিবি বললেন, আমি পারি। এখন তুই বিদায় হ।
চলে যাব?
হুঁ।
নাদিয়া খাট থেকে নামল। হাজেরা বিবি তার পুত্রকে ডাকতে লাগলেন, হাবু। হবু। হাবুরে। তিনি ডেকেই যাচ্ছেন।
নাদিয়ার এখন কিছু করার নেই। লাইব্রেরি থেকে গল্পের বই আনা হয়েছে। ভোরবেলা গল্পের বই নিয়ে বসতে ইচ্ছা করছে না। গল্পের বই পড়তে হয় দুপুরে। খাওয়াদাওয়ার পর বিছানায় শরীর এলিয়ে গল্পের বই পড়তে পড়তে কিছুক্ষণের ভাতঘুম। একটা কাজ অবশ্য করা যায়। বই নিয়ে দিঘির ঘাটে চলে যাওয়া যায়। ছাতিম গাছে হেলান দিয়ে বই পড়া।
নাদিয়া বই হাতে দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়াল। এখান থেকে দিঘির ঘাট চোখে পড়ে। সে দেখতে পাচ্ছে তার বাবা দিঘির ঘাটে বসে আছেন। তামাক খাচ্ছেন। এই সময় তার দিঘির ঘাটে বসে থাকার কথা না। তিনি কি কোনো সমস্যায় আছেন? দিঘির ঘাটের দিকে তাকালেই নাদিয়ার মনে আসে বিদ্যুত স্যারের কথা। কী বুদ্ধি মানুষটার! মাস্টারি বাদ দিয়ে মানুষটা যদি সমাধান নাম দিয়ে অফিস খুলত তাহলে সবার উপকার হতো। সমস্যায় পড়তেই সমাধান অফিসে চলে যাওয়া। স্যারের কাছ থেকে সমাধান নিয়ে আসা।
নাদিয়া দোতলা থেকে নামল। দিঘির ঘাটের দিকে রওনা হলো। হাবীব মেয়েকে দেখে ভুরু কুঁচকে বললেন, প্রণবকে তো নিষেধ করেছিলাম তোকে খবর দিতে।
নাদিয়া বলল, কেউ আমাকে খবর দেয় নাই বাবা। আমি নিজ থেকে এসেছি। এখানে বসে আছ কেন?
হাবীব জবাব দিলেন না। হুক্কার কয়লা নিভে গেছে। তারপরেও তিনি অভ্যাসবশে টেনে যাচ্ছেন।
বাবা, কোনো সমস্যা?
সমস্যা হলে কী করবি? সমাধান করবি?
চেষ্টা করতে পারি।
নাদিয়া বাবার পাশে বসল। হাবীব অন্যমনস্কভাবে বললেন, একটা বেনামি চিঠি পেয়েছি।
নাদিয়া বলল, চিঠিতে কী লেখা? তোমাকে খুন করবে এই ধরনের কিছু?
না।
কী লেখা বলো।
হাবীব চুপ করে রইলেন। নাদিয়া বলল, আমাকে নিয়ে নোংরা কোনো কথা?
হুঁ।
এটাই তোমার সমস্যা?
হ্যাঁ।
বাবা শোনো, তোমাদের আদালত কি বেনামি চিঠি গ্রহণ করে?
না।
কাজেই বেনামি চিঠি গুরুত্বহীন। আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে আছে, নাম বকুল। মেয়েটার মাথায় মনে হয় কোনো গণ্ডগোল আছে। সে তার ক্লাসমেটদের ঠিকানা জোগাড় করে এবং তাদের বাবা-মা’র কাছে কুৎসিত সব কথা বেনামিতে লিখে পাঠায়। আমি নিশ্চিত আমাকে নিয়ে চিঠিটা সে-ই পাঠিয়েছে। আমি তার হাতের লেখা চিনি। চিঠিটা দাও পড়লেই বুঝব।
হাবীব দিঘির দিকে তাকালেন। কাগজের বল ডুবে গেছে। তিনি হুক্কার নল পাশে রাখতে রাখতে বললেন, চিঠি নষ্ট করে ফেলেছি।
নাদিয়া বলল, সামান্য একটা চিঠির কারণে মুখ ভোঁতা করে বসে থাকার কোনো অর্থ হয়? তুমি আমাকে চেনো। আমাকে দিয়ে ভয়ঙ্কর কোনো অন্যায় হবে না। আমি ভালো মেয়ে।
হাবীব বললেন, বড় বড় অন্যায় ভালো মানুষরা করে।
নাদিয়া বলল, তাহলে মনে হয় আমি ভালোমানুষ না। বড় অন্যায় দূরের কথা ছোট অন্যায়ও আমি করতে পারব না।
পাংখাপুলার রশিদ এসেছে। সামনে দাঁড়িয়ে হাত কচলাচ্ছে। হাবীব বিরক্ত গলায় বললেন, কী চাও?
রশিদ ভীত গলায় বলল, বড় মা আপনেরে ডাকে।
হাবীব বললেন, উনি সারা দিনে এক হাজারবার আমাকে ডাকেন। তাই বলে এক হাজারবার আমাকে খবর দিতে হবে? সামনে থেকে যাও।
রশিদ প্রায় দৌড়ে সরে গেল। হাবীব তাকালেন মেয়ের দিকে। কী সহজ সুন্দর মুখ মেয়েটার! তার মা’র চেহারাও সুন্দর, তবে সে সৌন্দর্যে কাঠিন্য আছে। নাদিয়ার মধ্যে তা নেই।
নাদিয়া বলল, কী দেখে বাবা?
হাবীব কিছু বললেন না। দৃষ্টি ঘাটের দিকে ফিরিয়ে নিলেন। হঠাৎ করেই তার মনে হলো, নাদিয়া তার বান্ধবী বকুল সম্পর্কে যা বলেছে তা মিথ্যা। নাদিয়া জানে তাকে নিয়ে এধরনের বেনামি চিঠি আসতে পারে। কাজেই সে বেনামি চিঠির কারণ নিয়ে গল্প বানিয়ে রেখেছে। নাদিয়াকে ঠিকমতো জেরা করলেই সব বের হয়ে যাবে। তার জেরার মুখে কঠিন আসামিও মাখনের মতো গলে যায়। আর এই মেয়ে তো শুরুতেই মাখন। তিনি হুক্কার নল মুখে নিয়ে কয়েকবার টানলেন।
নাদিয়া বলল, আগুন নিভে গেছে বাবা। কাউকে বলি কল্কে সাজিয়ে দিক।
না। তোকে কয়েকটা প্রশ্ন করব, জবাব দিবি। নাদিয়া হাসিমুখে বলল, জবাব দেওয়ার আগে কি আদালতের মতো প্রতিজ্ঞা করব—যাহা বলিব সত্য বলিব।
প্রতিজ্ঞা লাগবে না। তোদের ক্লাসের মেয়েটার নাম বকুল?
হ্যাঁ।
কীভাবে নিশ্চিত হলি বেনামি চিঠি সে-ই পাঠায়?
তার রুমমেট বলেছে। সে হাতেনাতে ধরেছে।
রুমমেটের নাম কী?
শেফালি।
শেফালির নামেও চিঠি পাঠিয়েছিল?
হ্যাঁ। শেফালিকে নিয়ে আর হলের দারোয়ানকে নিয়ে জঘন্য এক চিঠি।
বকুলের ভালো নাম কী?
বকুল বালা।
হিন্দু মেয়ে?
হ্যাঁ।
শেফালির ভালো নাম কী?
শেফালি হক।
তার সাবজেক্ট কী?
পলিটিক্যাল সায়েন্স।
রুম নাম্বার কত?
তিনশ এগারো।
হাবীব বড় করে নিঃশ্বাস ফেললেন। নাদিয়া বলল, জেরা শেষ?
হাবীব বললেন, জেরা আবার কী? ঘটনা জানতে ইচ্ছা করল বলে প্রশ্ন করলাম।
আমি সত্যি জবাব দিয়েছি না মিথ্যা দিয়েছি তা ধরতে পেরেছ?
মিথ্যা জবাব কেন দিবি?
দিতেও তো পারি। কেউ মিথ্যা বলছে কি না তা ধরার টেকনিক আছে। টেকনিকটা কি তোমাকে বলব?
বল।
টেকনিকটা আমরা শিখেছি বিদ্যুত স্যারের কাছে। স্যার বলেছেন যখন কেউ মিথ্যা বলে তখন তার ব্রেইনে বাড়তি চাপ পড়ে। এই কারণে ব্রেইনের অক্সিজেন লাগে বেশি। কাজেই মিথ্যাবাধী বড় করে শ্বাস নেয়। ব্রেইনের বাড়তি চাপের জন্যে চোখের মণির ওপর তার নিয়ন্ত্রণ কমে যায়। চোখের মণি হয় ডাইলেটেড। তোমাকে তো প্রায়ই আসামি জেরা করতে হয়। আসামির চোখের মণির দিকে তাকালেই তুমি কিন্তু ধরে ফেলতে পারবে সে সত্যি বলছে না মিথ্যা বলছে।
হাবীব দিঘির ঘাট ছেড়ে চেম্বারে যাচ্ছেন। আগামী পরশু হাসান রাজা চৌধুরীর মামলার আবার তারিখ পড়েছে। ফরিদকে জেরা করা হবে। কাগজপত্র উল্টেপাল্টে দেখা দরকার। মামলার নিষ্পত্তি হয়ে গেলেই নাদিয়ার বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবেন। মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি দরকার। তবে মামলা ঠিকমতো যাচ্ছে। সাজানো মামলা রেললাইনের ওপরের রেলগাড়ি। কখনো লাইন ছেড়ে যাবে না।
চেম্বারে ঢোকার মুখে প্রণবের সঙ্গে দেখা। হাবীব বললেন, হাসান রাজী চৌধুরীর মামলার কাগজপত্রগুলা বের করো।
এখন দেখবেন?
হুঁ।
আপনার শরীরটা খারাপ, আজ বাদ দেন।
তোমাকে যা করতে বললাম করো। আরেকটা খবর এনে দাও। রোকেয়া হলের তিনশ এগারো নম্বর রুমে যে মেয়ে দু’টা থাকে তাদের নাম। তারা কোন সাবজেক্টে পড়ে এই তথ্যও লাগবে।
ব্যবস্থা করব। তিনশ এগারোর মেয়ে দুটার নাম। সাবজেক্ট।
হাবীব মামলার নথির পাতা উল্টাচ্ছেন। মন বসাতে পারছেন না। হাজেরা বিবির গলার আওয়াজ আসছে। ভাঙা রেকর্ডের মতো তিনি ডেকেই যাচ্ছেন। হাবু, হাবু, ও হাবু।
নাদিয়া সিঁড়ি বেয়ে পানির কাছাকাছি চলে গেল। দিঘির জলে ছায়া দেখতে ইচ্ছা করছে। যদিও সে জানে এখন ছায়া পড়বে না। সূর্যের অবস্থান ঠিক নেই। নাদিয়া বুঝতে পারল না দূর থেকে একজন তাকে লক্ষ করছে। তার নাম ভাদু মিয়া। একজনের মনের কথা অন্যজন ধরতে পারে না। ধরতে পারলে নাদিয়া অবশ হয়ে যেত। ভাদু মিয়া প্রকাণ্ড একটা কাঠালগাছের আড়ালে লুকিয়ে আছে। নাদিয়ার ওপর থেকে সে চোখ ফেরাতে পারছে না। তার ইচ্ছা করছে এখনই মেয়েটার মুখ চেপে ধরে বাগানের ভেতরের কোনো আড়ালে চলে যেতে। কাজ সমাধার পর দেয়াল টপকে পালিয়ে যাওয়া। অনেক কষ্টে সে নিজেকে সামলাল। এখন না, আরও পরে। দিনের আলোয় ঘটনা ঘটালে তার ভালো লাগত। কিন্তু ঘটনা ঘটাতে হবে রাতে। ঘটনার পর কিছুক্ষণ মেয়েটার গলা টিপে ধরে রাখতে হবে, তারপর ফেলে দিতে হবে দিঘির পানিতে। এটা কোনো ব্যাপারই না।
ভাদু মিয়া দেখল মেয়েটা উঠে আসছে। সে চট করে গাছের আড়ালে সরে গেল। নাদিয়া বলল, কে? গাছের পেছনে কে?
ভাদু মিয়া বের হয়ে এল। তার দৃষ্টি মাটির দিকে। মেয়েটা যেন তার চোখ দেখতে না পায়। মেয়েরা চোখ দেখে অনেক কিছু বুঝে ফেলে। তাকে চোখ দেখতে দেওয়া যাবে না।
নাদিয়া বলল, আপনি কে?
আমি নতুন কাজ পাইছি। আমার নাম ভাদু মিয়া।
গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন কেন?
আপনারে দেইখা শরম পাইছি।
আমাকে দেখে শরম পাওয়ার কী আছে?
মেয়েছেলে দেখলে আমি শরম পাই।
নাদিয়া হেসে ফেলল। মহিষের মতো জোয়ান একজন, সে মেয়েছেলে দেখলে শরম পায়। কত বিচিত্র মানুষই না এই পৃথিবীতে আছে!
আমাকে দেখে শরম পাওয়ার কিছু নেই। আমি এ বাড়ির মেয়ে। আমার নাম নাদিয়া। আপনাকে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। আপনি আমার দিকে তাকাতে পারেন।
ভাদু মিয়া বলল, জে-না।
আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি শরম পেতে থাকুন।
ভাদু মনে মনে বলল, শরম কারে কয় তুমি বুঝবা। সবুর করোগো সোনার কইন্যা। সবুর।
হাজেরা বিবির সামনে বিরক্তমুখে হাবীব দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বললেন, সারাক্ষণ আমাকে ডাকো কেন মা?
হাজেরা বিবি বললেন, তোরে ছাড়া কারে ডাকুম? তোর কামলাগুলারে ডাকুম?
কিছু বলবেন?
হুঁ।
বলেন শুনি।
এখন ইয়াদ আসতেছে না। তুই আমার সামনে ব’। আমি ইয়াদের চেষ্টা নেই।
হাবীব বললেন, আপনি ইয়াদ করেন। যদি ইয়াদে আসে আমারে ডাকবেন। আমার কাজ আছে আমি যাই।
ইয়াদ হইছে। তুই ‘ব’ দেহি। তোরে বলতেছি। কথাটা গোপন। কাছে আয়।
আর কাছে আসতে পারব না। আপনার যা বলার বলেন।
কথাটা তেজিল্লী বিষয়ে।
কী কথা?
তোর মেয়ে শাদি করেছে।
আপনাকে নাদিয়া বলেছে?
আমারে কেউ কিছু বলে না। যা বুঝার আমি অনুমানে বুঝি।
অনুমান করলেন কীভাবে?
গন্ধ দিয়া অনুমান করেছি। কুমারী মেয়ের শরীরের গন্ধের এক ভাও, বিয়া হউরা মেয়ের আরেক ভাও। আবার গাভিন মেয়ের অন্য ভাও। কথায় আছে—
কুমারী কন্যার ঘ্রাণ হইল
পানের কচি পাতা
বিয়া হউর কন্যা হইল
পাকনা ফল আতা
গর্ভিনি নারীর শইলে টক ঘ্রাণ পাই
বিধবা নারীর শইলে কোনো গন্ধ নাই।
হাবীব বললেন, আমাকে বলেছেন ঠিক আছে। এই জাতীয় কথা আর কাউকে বলবেন না।
আচ্ছা বলব না। হাজেরা বিবি পান ছেঁচনি নিয়ে বসলেন। টক টকাস শব্দ হতে থাকল।
ভাদু মিয়াও শব্দ করছে। সে কুড়াল দিয়ে কাঠ ফেড়ে রান্নার খুড়ি বের করছে। কেউ তাকে কাঠ ফাড়তে বলেনি। বিশ্বাস অর্জনের জন্যে নিজ থেকে আগ্রহ নিয়ে এইসব কাজ করতে হয়। সবচেয়ে বেশি যা দরকার তা হলো নিজেকে বোকা হিসেবে দাঁড় করানো। বুদ্ধিমানকে কেউ বিশ্বাস করে না। বোকাকে বিশ্বাস করে। বোকা সাজা কঠিন কোনো কাজ না।
প্রণব গায়ে তেল মাখছিলেন। কাঠ ফাড়া শেষ করে ভাদু প্রণবের সামনে দাঁড়াল। প্রণব বললেন, কিছু বলবি?
ভাদু বলল, গায়ে তেল দিয়া দেই?
না। মুসলমানের হাতের ভলা নেওয়া নিষেধ। মন্ত্র নিয়েছি তো। মন্ত্র নেওয়ার পর নানান বিধিনিষেধ।
মন্ত্র কী?
ঈশ্বরের নাম। কানে একটা নাম গুরু দিয়ে দেন। সেই নাম জপ করতে হয়।
কী নাম?
কী নাম সেটা তো বলতে পারব না। নিষেধ আছে।
আমি কাউরে বলব না।
নাম জেনে তুই করবি কী? নাম জপ করবি?
ক্যামনে জপ করতে হয় শিখায়া দিলে করব। কাজ শিখায়া দিলে আমি পারি। না শিখাইলে পারি না।
কথাবার্তা শুনে তোকে তো বিরাট গাধা মনে হচ্ছে।
অদু বলল, জে-না আমি গাধা না। আমার বুদ্ধি আছে। আপনার শইলে তেল ডইলা দেই?
একবার তো বলেছি, না।
আরাম পাইবেন।
গাধা চুপ কর।
ভাদু মনে মনে হাসল। তার গাধা পরিচয়টা দ্রুত স্থায়ী করতে হবে। গাধা সাজতে হলে একই কথা কমপক্ষে তিনবার বলতে হবে। শরীরে তেল মাখার কথা দু’বার বলা হয়েছে। আরও একবার বলা দরকার। তৃতীয়বারের জন্যে ভাদু অপেক্ষা করছে। অপেক্ষাতেই আনন্দ।
পাংখাপুলার রশিদ এসে প্রণবের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, বড় সাব আপনেরে ডাকে।
প্রণব বিরক্ত হয়ে বললেন, কানাকানি করতেছ কেন? উনি আমারে ডাকেন এইটা গোপন কোনো কথা না। মেয়েছেলে কানে কথা বলতে পছন্দ করে। তুমি মেয়েছেলে না।
ভাদু আনন্দিত গলায় বলল, অত্যধিক সত্য কথা। সে মেয়েছেলে না।
প্রণব বলল, এই বেকুব, সব কথায় কথা বলবি না।
ভাদু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
হাবীব বারান্দার ইজিচেয়ারে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। পাশেই মোড়া পাতা। এতক্ষণ মোড়ায় লাইলী বসে ছিলেন। উনি উঠে যাওয়াতে মোড়া খালি। প্রণব মোড়ায় বসতে বসতে বলল, স্যার আমাকে ডেকেছেন?
হুঁ। সীতা মেয়েটার সন্ধান পাওয়া গেছে।
প্রণব বলল, সীতা কে?
হাবীব বিরক্ত হয়ে বললেন, সাত খণ্ড রামায়ণ নিজে লিখে এখন বলো সীতা কে? সীতা নারায়ণ চক্রবর্তীর মেয়ে যাকে উদ্ধারের জন্যে তুমি আমার পায়ে ধরলা।
প্রণব লজ্জিত গলায় বলল, ভুলে গেছি।
হাবীব হাই তুলতে তুলতে বললেন, এখন মেয়েটার কী ব্যবস্থা করবে করো।
প্রণব বলল, আমি কী ব্যবস্থা করব? মেয়ের বাবা-মা ব্যবস্থা করবে।
হাবীব বললেন, মেয়েটার বাবা-মা কোনো ব্যবস্থা নিবে না। মেয়ের কারণে তারা পতিত হয়েছে। মেয়ে নারায়ণগঞ্জের টানবাজারে ছিল। টানবাজার কী জানো?
না।
বেশ্যাপল্লী। যে মেয়ে বেশ্যাপল্লীতে ছিল, তোমাদের সমাজে তার জায়গা নাই। কথা কি ঠিক?
প্রণব বলল, মেয়েটা আছে কোথায়?
থানা হাজতে। ওসি সাহেব মেয়ের বাবার সঙ্গে কথা বলেছেন, তার মায়ের সঙ্গেও কথা বলেছেন। তারা মেয়েকে নিবে না। এখন তুমি বলো কী করা যায়?
প্রণব বলল, আমি কী বলব স্যার? আমি বাক্যহারা হয়েছি।
আমি ওসি সাহেবকে বলেছি মেয়েটাকে আমার এখানে দিয়ে যেতে। রাত এগারোটার দিকে আসবে। তুমি মেয়েটাকে চেম্বারে বসাবে। তুমি তার সঙ্গে কোনো কথা বলবে না। যা বলার আমি বলব। আমাকে খবর দিয়ে নিয়ে যাবে। আমি ওসি সাহেবের সঙ্গে এখন কোনো কথা বলব না। তাকে চলে যেতে বলবে।
চেম্বারে সব ক’টা দরজা-জানালা বন্ধু। একটা দরজা খোলা। সেখানে পর্দা দেওয়া। বাইরের বাতাসে পর্দা কাঁপছে। টেবিলে রাখা দুটা মোমবাতির শিখাও কাঁপছে। মোমবাতি ছাড়া ঘরে একটা হারিকেনও আছে। কারেন্ট নেই। মোমবাতি এবং হারিকেনের আলোয় অন্ধকার কমছে না।
সীতা চাদরে নিজেকে সম্পূর্ণ ঢেকে জড়সড়ো হয়ে বসে আছে। তার চোখে আতঙ্ক ছাড়া কিছু নেই। মাঝে মাঝে সে কাঁপছে। তার দৃষ্টি মোমবাতির দিকে। দমকা বাতাসে একটা মোমবাতি নিভে গেল। সীতা প্রবলভাবে কাপল এবং অস্ফুট শব্দ করল, আর তখনই হাবীব ঢুকলেন।
তোমার নাম সীতা?
সীতা জবাব দিল না। তার দৃষ্টি এখনো মোমবাতির শিখার দিকে।
তোমার বাবা মা তোমাকে নিতে রাজি না–এই খবর পেয়েছ?
সীতা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
হাবীব বললেন, তুমি আমার এখানে থাকবে। আমার কোনো অসুবিধা নাই। থাকবে?
সীতা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। হাবীব বললেন, আমার একটা বুদ্ধি শোনা, কলমা পড়ে মুসলমান হয়ে যাও। হিন্দুর গায়ে যতটা দোষ লাগে, মুসলমানের লাগে না। মুসলমান হবে?
সীতা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
হাবীব বললেন, তোমার বয়স অল্প। মাঝে মাঝে অল্প বয়সে বড় সিদ্ধান্ত নিতে হয়। শম্ভুগঞ্জের পীরসাহেব আগামী বুধবার আসবেন। তার কাছে তুমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবা। তোমার নতুন একটা নাম লাগবে। তোমার নাম দিলাম হোসনা। হোসনা শব্দের অর্থ সৌন্দর্য। তোমার চেহারা সুন্দর, এই জন্যেই হোসনা নাম।
বাতাসে দ্বিতীয় মোমবাতিটাও নিভে গেল। সীতা আবারও চমকে উঠে অস্ফুট শব্দ করল।
শম্ভুগঞ্জের পীরসাহেব এসেছেন। তিনি রোজা ছিলেন। সন্ধ্যাবেলা ইফতার করে মাগরেবের নামাজ পড়লেন। নামাজের শেষে ঘোষণা করলেন এশার নামাজের পর বেতরের নামাজ পড়বেন। তারপর হিন্দু কন্যাকে মুসলমান বানানোর প্রক্রিয়া শুরু করবেন। কন্যাকে বড়ইপাতা ভেজানো পানি দিয়ে গোসল দিতে হবে। নখ কাটতে হবে।
সীতাকে গোসল দেওয়া হলো। সে জলচৌকিতে পাথরের মূর্তির মতো বসে রইল। পীরসাহেব সীতার সঙ্গে কিছু কথা বলার চেষ্টাও করলেন। তিনি একতরফা বললেন, সীতা শুধু শুনে গেল।
কোরানপাঠ শিখবে। রোজ ফজরের নামাজের পর পাক কোরান পাঠ করবে। কোরানপাঠ শিখে নিবে।
হায়াজ নেফাসের পর অপবিত্র চুল সব ফেলতে হবে। একটা চুল থাকলেও শরীর শুদ্ধ হবে না।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে পীরসাহেব গলা নামিয়ে আরও কিছু কথা বললেন! সবই অত্যন্ত অশ্লীল কথা। কোনোভাবেই একটি মেয়েকে বলা যায় না। পীরসাহেব অবলীলায় বলে গেলেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি নোংরা কথাগুলি বলে আনন্দ পাচ্ছেন।
এশার নামাজের পর হাজেরা বিবি ভীষণ হৈচৈ শুরু করলেন। হাবু রে, হাবু রে, হাবু রে।
হাবীব মার কাছে গেলেন। শান্তগলায় বললেন, মা, তোমার সমস্যা কী?
হাজেরা বিবি বললেন, সমস্যা আমার না। সমস্যা তোর। শুনলাম নটিপাড়ার এক হিন্দু নটি মেয়ে তুই নিয়া আসছস। তারে এখন মুসলমান বাইনতাছস। নটির আবার হিন্দু-মুসলমান কী? নটি হইল নটি।
মা চুপ করো।
আমি চুপ করব না। তুই চুপ কইরা আমার কথা গুন। শম্ভুগঞ্জের বদ পীরটারে হাছুনের বারি দিয়া বিদায় কর।
কেন?
এই পীররে অনেক দিন ধইরা আমি লক্ষ করছি। হে মেয়েছেলের চোখের দিকে কোনো সময় তাকায় না। তাকায় বুকের দিকে।
মা! তোমার যন্ত্রণায় আমি অস্থির।
তুই আমার যন্ত্রণায় অস্থির না। আমি তোর যন্ত্রণায় অস্থির। তুই এক্ষণ বুনিচাটা পীর বিদায় করবি। কতবড় হারামজাদা! চউখ দিয়া বুনি চাটে।