হযরত ঈসা (আ)-এর জন্ম ও ওহীর সূচনা
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, হযরত ঈসা (আ) বায়তুল মুকাদ্দাসের সন্নিকটে বায়তে লাহমে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু ওহাব ইব্ন মুনাববিহু (র)-এর ধারণা, হযরত ঈসা (আ)-এর জন্ম হয় মিসরে এবং মারিয়াম ও ইউসুফ ইব্ন ইয়াকুব আল-নাজার একই গাধার পিঠে আরোহণ করে ভ্ৰমণ করেন এবং গাধার পিঠের গদি ব্যতীত তাদের মধ্যে অন্য কোন আড়াল ছিল না। কিন্তু এ বর্ণনা সঠিক নয়। কেননা, ইতিপূর্বে উল্লেখিত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, ঈসা (আঃ)-এর জন্মস্থান হচ্ছে বায়তে লোহাম। সুতরাং এ হাদীসের, মুকাবিলায় অন্য যে কোন বর্ণনা অগ্রহণযোগ্য।
ওহাব ইব্ন মুনাববিহ উল্লেখ করেছেন যে, হযরত ঈসা (আঃ) যখন ভূমিষ্ঠ হন তখন পূর্ব ও পশ্চিমের সমস্ত মূর্তি ভেঙ্গে পড়ে যায়। ফলে শয়তানরা অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়ে। এর কোন কারণ তারা খুঁজে পাচ্ছিল না। অবশেষে বড় ইবলীস তাদেরকে জানাল যে, ঈসা (আ)-এর জন্ম হয়েছে। শয়তানরা শিশু ঈসাকে তার মায়ের কোলে আর চারদিকে ফেরেশতাগণ দাড়িয়ে তাকে ঘিরে রেখেছেন দেখতে পেল। তারা আকাশে উদিত একটি বিরাট নক্ষত্রও দেখতে পেল। পারস্য সম্রাট এই নক্ষত্র দেখে শংকিত হয়ে পড়েন এবং জ্যোতিষীদের নিকট এর উদিত হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করেন। জ্যোতিষীরা জানাল, পৃথিবীতে এক মহান ব্যক্তির জন্ম হয়েছে। এজন্য এই নক্ষত্র উদিত হয়েছে। তখন পারস্য সম্রাট উপটৌকন হিসেবে স্বর্ণ, চান্দি ও কিছু লুব্বান দিয়ে নবজাতকের সন্ধানে কতিপয় দূত প্রেরণ করেন। দূতগণ সিরিয়ায় এসে পৌছে। সিরিয়ার বাদশাহ তাদের আগমনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। তারা উক্ত নক্ষত্র ও জ্যোতিষীদের মন্তব্যের কথা তাকে জানায়। বাদশাহ দূতদের নিকট নক্ষত্রটির উদয়কাল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। উত্তর শুনে তিনি বুঝলেন, ঐ শিশুটি বায়তুল মুকাদ্দাসে জন্ম গ্রহণকারী মারিয়াম পুত্র ঈসা। ইতিমধ্যেই ব্যাপক প্রচার হয়ে গিয়েছিল যে, নবজাত শিশুটি দোলনায় থেকেই মানুষের সাথে কথা বলেছেন। এরপর বাদশাহ দূতদেরকে তাদের সাথে আনীত উপটৌকনসহ শিশু ঈসার নিকট পাঠিয়ে দেন এবং এদেরকে চিনিয়ে দেয়ার জন্যে সাথে একজন লোকও দেন। বাদশাহর উদ্দেশ্য ছিল, দূতগণ যখন উপঢৌকন প্রদান করে চলে আসবে, তখন এ লোক ঈসাকে হত্যা করে ফেলবে। পারস্যের দূতগণ মারয়ামের নিকট গিয়ে উপঢৌকনগুলো প্ৰদান করে চলে আসার সময় বলে আসলো যে, সিরিয়ার বাদশাহ আপনার নবজাত শিশুকে হত্যা করার জন্যে চর পাঠিয়েছে। এ সংবাদ শুনে মারিয়াম শিশুপুত্র ঈসাকে নিয়ে মিসরে চলে আসেন এবং একটানা বার বছর সেখানে অবস্থান করেন। এ সময়ের মধ্যে ঈসা (আ)-এর বিভিন্ন রকম কারামত ও মুজিযা প্ৰকাশ হতে থাকে। ওহাব ইব্ন মুনাববিহ কতিপয় মুজিযার কথা উল্লেখ করেছেন। যথা ৪
(এক) বিবি মারিয়াম মিসরের যে সর্দারের বাড়িতে অবস্থান করেন, একদা ঐ বাড়ি থেকে একটি বস্তু হারিয়ে যায়। ভিক্ষুক, দরিদ্র ও অসহায় লোকজন সে বাড়িতে বসবাস করত। কে বা কারা বস্তুটি চুরি করেছে, তা অনুসন্ধান করেও তার কোন সন্ধান পাওয়া গেল না। বিষয়টি মারিয়ামকে ভীষণ চিন্তায় ফেলে দিল। বাড়ির মালিক ও অন্যান্য লোকজনও বিব্রত অবস্থায় পড়ে গেল। অবশেষে শিশু ঈসা সেখানে অবস্থানকারী এক অন্ধ ও এক পঙ্গু ব্যক্তির নিকট গেলেন। অন্ধকে বললেন, তুমি এ পঙ্গুকে ধরে উঠাও এবং তাকে সাথে নিয়ে চুরি করা বস্তা নিয়ে এস। অন্ধ বলল, আমি তো তাকে উঠাতে সক্ষম নই। ঈসা বললেন, কেন, তোমরা উভয়ে যেভাবে ঘরের জানালা দিয়ে-বস্তুটি নিয়ে এসেছিলে, সেভাবেই গিয়ে নিয়ে এস। এ কথা শোনার পর। তারা এর সত্যতা স্বীকার করল এবং চুরি করা বস্তুটি নিয়ে আসলো। এ ঘটনার পর ঈসার মর্যাদা মানুষের নিকট অত্যধিক বেড়ে যায়। যদিও তিনি তখন শিশু মাত্র।
(দুই) উক্ত সর্দারের পুত্র আপনি সন্তানদের পবিত্রতা অর্জনের উৎসবের দিনে এক ভোজ সভার আয়োজন করে। লোকজন সমবেত হল। খাওয়া-দাওয়া শেষ হল। সে যুগের নিয়মানুযায়ী এখন মদ পরিবেশনের পালা। কিন্তু মদ ঢালতে গিয়ে দেখা গেল কোন কলসীতেই মদ নেই। সর্দার পুত্র ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেল। হযরত ঈসা (আ) এ অবস্থা দেখে প্রতিটি কলসীর মুখে হাত ঘুরিয়ে আসলেন। ফলে সেগুলো সাথে সাথে উৎকৃষ্ট মদে পূর্ণ হয়ে গেল। লোকজন। এ ঘটনা দেখে বিস্মিত হলো। ফলে, তাদের নিকট আরও মর্যাদা বৃদ্ধি পেল। মানুষ বিভিন্ন রকম উপটোকন এনে ঈসা ও তার মার কাছে পেশ করলো। কিন্তু তারা এর কিছুই গ্রহণ করলেন না। তারপর তারা বায়তুল মুকাদ্দাসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে পড়লেন।
ইসহাক ইব্ন বিশর. আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। হযরত ঈসা ইব্ন মারয়ামই প্রথম মানুষ, যিনি শিশুকালে কথা বলেছেন। আল্লাহ তাঁর রসনা খুলে দেন এবং তিনি আল্লাহর প্রশংসায় এমন অনেক কথা বলেন, যা ইতিপূর্বে কোন কান কখনও শোনেনি। এ প্রশংসায় তিনি চাঁদ, সুরুজ, পর্বত, নদী, ঝর্ণা কোন কিছুকেই উল্লেখ করতে বাদ দেননি।
তিনি বলেন : হে আল্লাহ! সু-উচ্চ মর্যাদায় থেকেও আপনি বান্দার নিকটবর্তী। বান্দার নিকটবতী থেকেও আপনি সু-মহান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। সমস্ত সৃষ্টিকুলের উপরে আপনার শক্তি ও ক্ষমতা। আপনি এমন ক্ষমতাবান সত্তা, যিনি আপনি বাণী দ্বারা মহাশূন্যে সাতটি স্তরে আকাশকে সৃষ্টি ও বিন্যস্ত করেছেন। এগুলো প্রথম দিকে ধোঁয়ার আকারে ছিল। পরে আপনার নির্দেশ মতে ওগুলো আপনার অনুগত হয়। এসব আকাশে ফিরিশতাকুল আপনার মহিমা বর্ণনায় তাসবীহ পাঠে রত। এগুলোতে আপনি রাতের অন্ধকারে আলোর ব্যবস্থা করেছেন এবং সূর্যের আলো দ্বারা দিনকে আলোকিত করেছেন। আকাশে বাজ ধ্বনিকে আপনার স্তুতি পাঠে নিয়োজিত রেখেছেন। আপনার সন্ত্রমের সম্মানে সেগুলোর অন্ধকার বিদূরিত হয়ে আলোয় উদভাসিত হয়ে উঠে। আসমান রাজিতে আপনার স্থাপিত নক্ষত্রপুঞ্জরূপী প্ৰদীপমালার সাহায্যে দিশাহারা পথিকগণ পথের দিশা পায়। অতএব হে আল্লাহ, আসমান রাজিকে বিন্যস্ত করে এবং যমীনকে বিস্তৃত করে আপনি মহা কল্যাণ সাধন করেছেন। যমীনকে আপনি পানির উপরে বিছিয়েছেন। তারপর পানির বিশাল ঢেউয়ের উপরে উচু করে রেখেছেন এবং ঢেউগুলোকে নমনীয় হওয়ার আদেশ দিয়েছেন। আপনার আদেশ পালনাৰ্থে ঢেউগুলো অবনত মস্তকে নমনীয় হয়। এরপর আপনি প্রথমে সমুদ্র ও সমুদ্র থেকে নদী সৃষ্টি করেছেন। তারপর ছােট ছােট নালা ও ঝর্ণা সৃষ্টি করেছেন। এরপর আপনি এ থেকে সৃষ্টি করেছেন খাল, বিল, গাছপালা ও ফলফলাদি। তারপর যমীনের উপরে স্থাপন করেছেন পাহাড়, পাহাড়গুলো পানির উপরে পেরেকের ন্যায় যমীনকে স্থির করে রেখেছে। এসব কাজে পর্বতমালা ও পাথরসমূহ আপনার পূর্ণ আনুগত্য করে। অতএব, হে আল্লাহ! আপনি অত্যন্ত বরকতময়। এমন কে আছে, যে আপনার মত করে আপনার প্রশংসা করতে পারে? কে আছে এমন, যে আপনার মত করে আপনার গুণাবলী বর্ণনা করতে সক্ষম? আপনি মেঘপুঞ্জকে ছড়িয়ে দেন। বাধা-বন্ধনকে মুক্ত করেন, সঠিক ফয়সালা করেন, এবং আপনিই শ্ৰেষ্ঠ ফয়সালাকারী। আপনি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই। আপনি মহা পবিত্র। আপনি আমাদেকে যাবতীয় পাপ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করার হুকুম করেছেন। আপনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। আপনি মহা পবিত্র। আকাশমণ্ডলীকে আপনি মানুষের ধরা হীেয়া থেকে দূরে রেখে দিয়েছেন। আপনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই। আপনি মহা পবিত্র। জ্ঞানী লোকই কেবল আপনাকে উপলব্ধি করতে পারে। আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি আমাদের নিজেদের উদ্ভাবিত উপাস্য নন। আপনি এমন পালনকর্তা নন, যার আলোচনা শেষ হতে পারে। আপনার কোন অংশীদার নেই যে, আপনাকে ডাকার সাথে তাদেরকেও আমরা ডাকবো। আমাদের সৃষ্টি কাজে আপনাকে কেউ সাহায্য করেনি যে, আপনার ব্যাপারে আমাদের কোন সন্দেহ হতে পারে। আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি — আপনি একক, মুখাপেক্ষীহীন, আপনি কাউকে জন্ম দেননি, আপনাকেও কেউ জন্ম দেয়নি, কোন দিক দিয়েই আপনার সমকক্ষ কেউ নেই।
ইসহাক ইব্ন বিশার। … ইব্ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন। ঈসা ইব্ন মারিয়াম (আ) শিশু অবস্থায় একবার কথা বলেন। এরপর তার কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়। অন্যান্য শিশুরা যখন স্বাভাবিক বয়সে কথা বলে থাকে, তিনিও সে বয়সে পুনরায় কথা বলতে শুরু করেন। আল্লাহ তখন তাকে যুক্তিপূৰ্ণ কথা ও বাগিতা শিক্ষা দেন। ইয়াহুদীরা ঈসা (আ) ও তাঁর মা সম্পর্কে জঘন্য উক্তি করে। তাঁকে তারা জারজ সন্তান বলত। আল্লাহর বাণীঃ
এবং তারা লানতগ্রস্ত হয়েছিল তাদের কুফরীর জন্যে ও মারিয়ামের বিরুদ্ধে গুরুতর অপবাদের জন্যে। (৪ নিসাঃ ১৫৬)। ঈসা (আ)-এর বয়স যখন সাত বছর, তখন তারা তাকে লেখাপড়া শিখাবার জন্যে বিদ্যালয়ে পাঠান। কিন্তু ঘটনা এমন হল যে, শিক্ষক তাকে যে বিষয়টিই শিখাতে চাইতেন, তিনি আগেই সে বিষয় সম্পর্কে বলে দিতেন। এমতাবস্থায় এক শিক্ষক তাকে আবু জাদ শিখালেন। ঈসা জিজেস করলেন, আবু-জাদ কি? শিক্ষক বললেন, আবু জাদ কি তা আমি বলতে পারি না। ঈসা বললেন, যে বিষয়ে আপনি জানেন না, সে বিষয়ে আমাকে কেমন করে শিখাবেন? শিক্ষক বললেন, তা হলে তুমিই আমাকে শিখাও। ঈসা। বললেন, তবে আপনি ঐ আসন থেকে নেমে আসুন! শিক্ষক নেমে আসলেন। তারপর ঈসা। (আ) সে আসনে গিয়ে বসলেন এবং বললেন, আমার নিকট জিজ্ঞেস করুন! শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন, আবু জাদ কি? উত্তরে ঈসা বললেন, —।। দ্বারা এ1Jry (আল্লাহর নিয়ামতরাশি) {
এ উত্তর শুনে শিক্ষক বিস্মিত হয়ে গেলেন। হযরত ঈসা-ই সর্ব প্রথম আবু জাদ (এL -1) শব্দের ব্যাখ্যা প্ৰদান করেন।
অতঃপর ইসহাক ইব্ন বিশর এক দীর্ঘ হাদীস উল্লেখ করে বলেছেন যে, হযরত উছমান রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর প্রতিটি শব্দের উত্তর দিয়েছিলেন। কিন্তু এ হাদীস মাওয়ু-জােল। অনুরূপ ইব্ন আব্দীও।……. আবু সাঈদ থেকে এক মারফু হাদীসের মাধ্যমে ঈসার মকতবে প্রবেশ, শিক্ষক কর্তৃক আবু জাদ এর অক্ষর সমূহের অর্থ শিক্ষা দান ইত্যাদির উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এ হাদীসও গ্রহণযোগ্য নয়। ইব্ন আদী বলেছেন, এ হাদীস মিথ্যা। ইসমাঈল ব্যতীত আর কেউ এ হাদীস বর্ণনা করেন নি। ইব্ন লুহায়আ আব্দুল্লাহ ইব্ন হুবায়রা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আব্দুল্লাহ ইব্ন উমর (রা) বলেছেনঃ ঈসা ইব্ন মারয়াম (আ) কিশোর বয়সে অন্যান্য বালকদের সাথে মাঠে খেলাধুলা করতেন। মাঝে মধ্যে তিনি তাদের কাউকে ডেকে বলতেন, তুমি কি চাও যে, তোমার মা কি কি খাদ্য তোমাকে না দিয়ে গোপন করে রেখেছে, আমি তা বলে দেই? সে বলত, বলে দিন। ঈসা। বলতেন, অমুক অমুক জিনিস গোপন করে রেখেছে। বালকটি তৎক্ষণাৎ দৌড়ে গিয়ে মাকে বলত, আপনি যে সব খাদ্য আমাকে না দিয়ে গোপন করে রেখে দিয়েছেন, তা আমাকে খেতে দিন। মা বলতেন, কি জিনিস আমি গোপন করে রেখেছি? বালক বলত, অমুক অমুক জিনিস। মা বলতেন, এ কথা তোমাকে কে বলেছে? ছেলে বলত, ঈসা ইব্ন মারিয়াম বলেছে। এ কথা জনাজানি হয়ে যাওয়ার পর লোকজন পরামর্শ করল, আমরা যদি ছেলেদেরকে ঈসার সাথে এ ভাবে মেলামেশার সুযোগ দিই তাহলে ঈসা তাদেরকে নষ্ট করে ছাড়বে। সুতরাং সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরদিন তারা সকল ছেলেদেরকে একটা ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখল। ঈসা। বালকদেরকে সন্ধান করে ফিরলেন; কিন্তু কাউকেও খুঁজে পেলেন না। অবশেষে একটি ঘর থেকে তাদের কান্নাজড়িত চিৎকার শুনতে পেয়ে লোকজনের নিকট জিজ্ঞেস করলেন, ঐ ঘরটির ভিতর শব্দ কিসের? তারা ঈসাকে জানাল, ঘরের ওগুলো হচ্ছে বানর ও শূকর। তখন ঈসা বললেন, হে আল্লাহ! ঐ রকমই করে দিন। ফলে বালকগুলো বানর ও শূকরে পরিণত হয়ে গেল। (ইব্ন আসাকির) W
ইসহাক ইব্ন বিশর .ইব্ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন। হযরত ঈসা আল্লাহর ইঙ্গিত (ইলহাম) অনুযায়ী বাল্যকালে বিস্ময়কর কাজকর্ম দেখাতেন। ইয়াহুদীদের মধ্যে এ কথা ছড়িয়ে পড়ে। ঈসা (আঃ) বয়োবৃদ্ধি লাভ করেন। বনী ইসরাঈলরা তাঁর প্রতি শত্রুতা পোষণ করতে থাকে। তার মা এ জন্যে শংকিত হয়ে পড়েন। তখন আল্লাহ তাকে ওহীর মাধ্যমে ছেলেসহ মিসরে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। কুরআন পাকে আল্লাহ বলেন :
وجعلنا ابن مريم وأمة اية واوينهما الې ربوة ذات قراريو معين. —এবং আমি মারিয়াম তনয় ও তার মাকে করেছিলাম এক নিদর্শন, তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছিলাম এক নিরাপদ ও প্রস্রবণ বিশিষ্ট উচ্চ ভূমিতে। (২৩ মুমিনুনঃ ৫০)
আয়াতে উল্লেখিত নিরাপদ ও প্রস্রবণ বিশিষ্ট উচ্চ ভূমি দ্বারা কোন স্থানকে বুঝানো হয়েছে, তা নির্ণয়ে প্রথম যুগের উলামা ও মুফাসসিরগণের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কেননা এ ধরনের বৈশিষ্ট্যময় স্থান খুবই বিরল। যেহেতু সমতল থেকে উচ্চ ভূমি, যার উপরিভাগ হবে প্রশস্ত ও সমতল এবং যেখানে রয়েছে পানির প্রস্রবণ। ……….. বলা হয় এমন ঝর্ণাকে, যার পানি যমীনের উপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ে। উচ্চ ভূমিতে এ ধরনের প্রস্রবণ সাধারণত হয় না। এজন্যে এর অর্থ নির্ণয়ে বিভিন্ন মতামতের সৃষ্টি হয়েছে যথাঃ
(১) সেই স্থান, যেখানে মাসীহ জন্মগ্রহণ করেছিলেন অর্থাৎ বায়তুল মুকাদ্দাসের নিকটবতী। একটি খেজুর বাগান। আল্লাহর বাণী :
ফেরেশতা তার নিম্নপার্শ্ব হতে আহবান করে তাকে বলল, তুমি দুঃখ কর না তোমার পাদদেশে তোমার প্রতিপালক এক নহর সৃষ্টি করেছেন। (১৯ মারয়াম : ২৪)। অধিকাংশ প্রাচীন আলিমদের মতে এটি একটি ছােট নহর। ইব্ন আব্বাস (রা) থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত —নহর দ্বারা এখানে দাশিমকের একাধিক নহরকে বুঝানো হয়েছে। সম্ভবত তিনি দামিশকের নহর সমূহের সাথে ঐ স্থানের সাদৃশ্যের কথা ব্যক্ত করেছেন।
(২) কারও কারও মতে উচ্চ ভূমি দ্বারা মিসরকে বুঝানো হয়েছে। যেমন আহলে কিতাবদের একটি অংশ এবং তাদের অনুসারীগণ ধারণা পোষণ করেন।
(৩) কেউ বলেছেন উচ্চ ভূমি অর্থ এখানে রসুল্লাকে বুঝানো হয়েছে। ইসহাক ইব্ন বিশর…….. ওহাব ইব্ন মুনাববিহ থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত ঈসার বয়স যখন তের বছর, তখন আল্লাহ তাকে মিসর ত্যাগ করে ঈলিয়া যাওয়ার নির্দেশ দেন। তখন ঈসার মায়ের মামাত ভাই ইউসুফ এসে ঈসা ও মারিয়ামকে একটি গাধার পিঠে উঠিয়ে ঈলিয়া নিয়ে যান এবং সেখানেই অবস্থান করতে থাকেন। আল্লাহ এখানেই তার উপর ইনজীল অবতীর্ণ করেন, তাওরাত শিক্ষা দেন, মৃতকে জীবিত করা, রোগীকে আরোগ্য করা, বাড়িতে প্রস্ততকৃত খাদ্য সম্পর্কে না দেখেই জানিয়ে দেওয়ার জ্ঞান দান করেন। ঈলিয়ার লোকদের মধ্যে তাঁর আগমন বার্তা পৌঁছে যায়। তার দ্বারা বিস্ময়কর ঘটনাবলী প্ৰকাশিত হতে দেখে তারা ঘাঁড়িয়ে যায় এবং আশ্চর্যবোধ করতে থাকে। ঈসা (আ) তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহবান জানান। এভাবে তার নবুওতী প্রচার কার্য জনগণের মধ্যে বিকাশ লাভ করে।
আবু যুরআ দামেশকী (র) বর্ণনা করেন যে, তাওরাত কিতাব হযরত মূসা (আ)-এর উপর ৬ রমযানে অবতীর্ণ হয়। এর চার শ বিরাশি বছর পর হযরত দাউদ (আ)-এর উপর যাবুর নাযিল হয় ১২ রমযানে। এর এক হাজার পঞ্চাশ বছর পর ১৮ রমযানে হযরত ঈসা (আ)-এর উপর ইনজীল অবতীর্ণ হয় এবং ২৪ রমযানে হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর উপর কুরআন মজিদ
রমযান মাস, এতে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে (২। বাকারা : ১৮৫)- এ আয়াতের অধীনে আমরা তাফসীর গ্রন্থে। এতদ সম্পৰ্কীয় হাদীসগুলো উল্লেখ করেছি। সেখানে এ কথাও বলা হয়েছে যে, ঈসা (আ)-এর উপরে ইনজীল ১৮ রমযানে অবতীর্ণ হয়।
ইব্ন জারীর (র) তার ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন যে, ত্ৰিশ বছর বয়সকালে হযরত ঈসা। (আ)-এর প্রতি ইনজীল অবতীর্ণ হয় এবং তেত্রিশ বছর বয়সের সময় তাকে আসমান উঠিয়ে নেয়া হয়। ইসহাক ইব্ন বিশর. আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। আল্লাহ তাআলা হযরত ঈসা ইব্ন মারয়ামের নিকট নিম্নলিখিত ওহী প্রেরণ করেন : –
হে ঈসা! আমার নির্দেশ পালনে কঠোরভাবে চেষ্টা কর, হীনবল হয়ে না। আমার বাণী শ্রবণ কর ও আনুগত্য কর। হে ঈসা! তুমি এক পবিত্র সতী কুমারী ও তাপসী নারীর সন্তান। পিতা বিহীন তোমার জন্ম। বিশ্ববাসীর নিদর্শন স্বরূপ আমি তোমাকে সৃষ্টি করেছি। সুতরাং আমারই দাসত্ব কর, আমার উপরই ভরসা রাখা। সর্বশক্তি দিয়ে আমার কিতাবের অনুসরণ কর। সুরিয়ানী ভাষা-ভাষীদের নিকট কিতাবের বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করে শোনাও। তোমার সম্মুখে যারা আছে তাদের কাছে আমার বাণীগুলো পৌঁছিয়ে দাও। আমিই মহাসত্য, চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী ও অক্ষয়। লোকজনের কাছে প্রচার করবে যে, আরবের উন্মী নবীকে সত্য বলে জানবে। তিনি হচ্ছে উষ্ট্রারোহী, পাগড়ীধারী, বর্মধারী, জুতা পরিধানকারী এবং লাঠি ব্যবহারে অভ্যস্ত। তিনি বলেন আয়তলোচন, প্রশান্ত কপাল উজ্জ্বল চেহারা কোঁকড়ান চুল*, ঘন দাঁড়ি, জোড়া ভুরু, উচু নাক বিশিষ্ট। তার সামনের দাঁতগুলোতে সীমান্য ফাঁক থাকবে; খুতনীর উপরের ও ঠোঁট সংলগ্ন ছােট দাঁড়ি হবে দৃশ্যমান। তাঁর ঘাড় হবে রৌপ্য পাত্রের মত উজ্জ্বল। তার হাঁসুলীর হাঁড় দুটি হবে যেন প্রবহমান স্বর্ণ। তাঁর বুক থেকে নাভি পর্যন্ত কাল পশমের রেখা থাকবে। এই রেখা ব্যতীত পেটে বা বুকের অন্য কোথাও চুল থাকবে না। তার হাতের তালু ও পায়ের তলা হবে মাংসল। কোন দিকে তাকালে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকবেন। হাঁটার সময় মনে হবে সম্মুখে ঝুকে যেন নিম্ন দিকে নেমে আসছেন। ঘামক্তি অবস্থায় দেখলে মনে হবে যেন চেহারার উপরে মুক্তার দানা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে এবং মিশকের ঘাণ চারিদিকে ছড়াচ্ছে। তাঁর পূর্বেও কাউকে এমন দেখা যায়নি এবং পরেও কেউ এমন আসবে না। তার দৈহিক গঠন ও অবয়ব হবে অত্যন্ত সুশ্ৰী। তিনি অধিক বিবাহকারী, তাঁর সন্তান সংখ্যা হবে কম এবং তাঁর বংশধারা চলবে এক বরকতময় মহিলা থেকে। জান্নাতে তার জন্যে থাকবে নির্ধারিত প্রকোষ্ঠী। প্রকোষ্ঠটি একটি প্ৰকাণ্ড ফাঁপা মুক্তোয় নির্মিত। সেখানে থাকবে না কোন ক্লান্তি, থাকবে না কোন চিৎকার ধ্বনি। হে ঈসা! তুমি শেষ যামানার যিম্মাদার হবে, যেমন যাকারিয়া ছিল তোমার মায়ের যিম্মাদার, জান্নাতে তার জন্যে থাকবে সাক্ষ্য দানকারী দটি পাখীর ছানা। আমার নিকট তার যে মর্যাদা, তা অন্য কোন মানুষের নেই। তার কিতাবের নাম হবে কুরআন, ধর্মের নাম হবে ইসলাম। আমার এক নাম সালাম। ধন্য সেই, যে তার সময়কাল পাবে, তার কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করবে ও তার কথা শ্রবণ করবে।
*াটীকা : শামাইলে তিরমিয়ীর ১ম অধ্যায়ের দ্বিতীয় হাদীসের বর্ণনা মতে তার চুল না ছিল অত্যধিক কুঞ্চিত, না ছিল একেবারে সোজা।
তুবা বৃক্ষের বর্ণনা
নবী ঈসা (আ) একদা আল্লাহর নিকট নিবেদন করলেন, হে আমার প্রতিপালক! তুবা কী? আল্লাহ জানালেন, তুবা একটি বৃক্ষের নাম। আমি নিজ হাতে তা রোপণ করেছি। এটা প্ৰত্যেকটা জান্নাতের জন্যই। এর শিকড় রিযওয়ানে এবং তার পানির উৎস তাসনীম। এর শিশির কপূরের মত, এর স্বাদ আদার এবং ঘাণ মিশকের মত। যে ব্যক্তি এর থেকে একবার পান করবে। সে কখনও পিপাসাবোধ করবে না। ঈসা (আ) বললেন, আমাকে একবার সে পানি পান করার সুযোগ দিন। আল্লাহ বললেন, সেই নবী পান করার পূর্বে অন্য নবীদের জন্যে এটা পান করা নিষিদ্ধ এবং সেই নবীর উম্মতরা পান করার পূর্বে অন্য নবীদের উম্মতদের জন্যে এর স্বাদ গ্ৰহণ নিষিদ্ধ। আল্লাহ বললেন, হে ঈসা! আমি তোমাকে আমার নিকট উঠিয়ে আনব। ঈসা। বললেন, প্ৰভো! কেন আমাকে উঠিয়ে নিবেন? আল্লাহ বললেন, আমি প্ৰথমে তোমাকে উঠিয়ে আনিব। তারপর শেষ যামানায় আবার পৃথিবীতে পাঠাব। এতে তুমি সেই নবীর উম্মতের বিস্ময়কর অবস্থা প্রত্যক্ষ করতে পারবে এবং অভিশপ্ত দাজ্জালকে হত্যা করার ব্যাপারে তাদেরকে সাহায্য করতে পারবে। কোন এক নামাযের সময় তোমাকে পৃথিবীতে নামাব। কিন্তু তুমি তাদের নামাযে ইমামতি করবে না। কেননা তারা হচ্ছে রহমতপ্রাপ্ত উন্মত। তাদের যিনি নবী, তারপর আর কোন নবী নেই।
হিশাম, ইব্ন আম্মার. যায়দ থেকে বৰ্ণিত। ঈসা বলেছিলেন, প্ৰভো! আমাকে এই রহমত প্রাপ্ত উম্মত সম্পর্কে কিছু জানান। আল্লাহ বললেন, তারা আহমদ নবীর উম্মত। তারা হবে নবীতুল্য আলিম ও প্রজ্ঞাবান। আমার অল্প অনুগ্রহে তারা সস্তুষ্ট থাকবে। শুধু লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহুর বদৌলতেই তাদেরকে আমি জান্নাতে প্ৰবেশ করাবো। তারাই হবে জান্নাতের অধিকাংশ অধিবাসী। কেননা, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহুর যিকির দ্বারা তাদের জিহবা যে পরিমাণ সিক্ত হয়েছে, সে পরিমাণ সিক্ত অন্য কোন জাতির হয়নি এবং সিজদা করাতে তাদের গর্দান যতবার ভূ-লুষ্ঠিত হয়েছে, ততবার অন্য কোন জাতির গর্দন ভুলুষ্ঠিত হয়নি। (ইব্ন আসাকির)
ইব্ন আসাকির আব্দুল্লাহ ইব্ন আওসাজা থেকে বর্ণনা করেন। আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে ঈসা। ইব্ন মারিয়ামকে বলেন, তোমার চিন্তা-ভাবনায় আমাকেও নিত্য সাখী করে রাখা এবং তোমার আখিরাতের জন্যে আমাকে সম্বলারুপে রােখ। নফল ইবাদতের, দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জন কর, তাহলে আমি তোমাকে প্রিয় জানবো। আমাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে তোমার বন্ধু বানিয়ো না। এরূপ করলে তুমি লাঞ্ছিত হবে। বিপদে ধৈর্যধারণ কর এবং তাকদীরের প্রতি সন্তুষ্ট থাক। তোমার মধ্যে আমার সন্তুষ্টিকে জাগ্রত রােখ। কেননা তোমার সন্তুষ্টি আমার আনুগত্যে নিহিত, অবাধ্যতায় নয়। আমার নৈকট্য লাভের চেষ্টা কর, আমাকে সর্বদা স্মরণ রাখ। তোমার অন্তরে যেন আমার ভালবাসা বিরাজ করে। অবসর সময়ে সদা সচেতন থাক। সূক্ষ্ম প্রজ্ঞাকে সুদৃঢ় কর। আমার প্রতি আগ্রহ ও ভীতি পোষণ কর। আমার ভীতি দ্বারা অন্তরকে সমাহিত কর। আমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে রাতের সদ্ব্যবহার করবে। এবং দিনের বেলা থাকবে তৃষ্ণাৰ্থ, যাতে করে আমার নিকট পূর্ণ পরিতৃপ্তির দিলা লাভ করতে পোর। কল্যাণকর কাজে তোমার চেষ্টা-সাধনা নিয়োজিত রােখ। যেখানেই থাক, কল্যাণকর কাজের সহায়ক থাক। মানুষের
নিকট আমার উপদেশ পৌছিয়ে দাও। আমার ন্যায়পরায়ণতার সাথে আমার বান্দাদের মধ্যে ফয়সালা কর। তোমার নিকট আমি এমন উপদেশ নাযিল করেছি, যা মনের সন্দেহ-সংশয় ও বিস্মৃতি রোগের নিরাময় স্বরূপ। তা চোখের আবরণ দূর করে ও দৃষ্টিকে প্রখর করে। তুমি কোথাও মৃত্যুবৎ স্থবির হয়ে থেকে না, যতক্ষণ তোমার শ্বাস-প্ৰশ্বাস চলে। হে ঈসা ইব্ন মারিয়াম!! আমার প্রতি যে লোকই ঈমান আনে, সে আমাকে ভয় করে। আর যে আমাকে ভয় করে, সে আমার থেকে পুরষ্কারেরও আশা রাখে। অতএব, তুমি সাক্ষী থেকে, ঐ ব্যক্তি আমার শাস্তি থেকে নিরাপদ থাকবে- যাবৎ না। সে আমার নীতি পরিবর্তন করে। হে কুমারী তাপসী
দান কালে কোন লোক এবং দুনিয়াকে প্রত্যাখ্যান করে, দুনিয়ার স্বাদ বর্জন করে এবং আপন প্রভুর নিকট পুরস্কারের আকাজক্ষায় থাকে। লোকের সাথে কোমল ব্যবহার করবে। সালামের প্রসার ঘটাবে। মানুষ যখন নিদ্রায় বিভোর থাকে তখন তুমি কিয়ামতের ভয়াবহ অবস্থা ও বিভীষিকাময় কঠিন ভূ-কম্পনের ভয়ে জাগ্রত থাকবে।
সেদিন আপন পরিবার ও ধন-সম্পদ কোনই কাজে আসবে না। নিবেধিরা যখন হাসিঠাট্টারত থাকে, তখন তুমি চক্ষুদ্বয়কে চিন্তার বিষাদের সুর্মা মেখে রাখা এবং এ ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ কর এবং একে তোমার পুণ্যপ্ৰাপ্তির হেতু করা। ধৈর্য অবলম্বককারীদের জন্যে আমি যে পুরস্কারের ওয়াদা করেছি, তা যদি তুমি পেয়ে যাও, তবে তোমার জীবন ধন্য। দুনিয়ার মোহ ছিন্ন করে ক্রমান্বয়ে আল্লাহর দিকে অগ্রসর হতে থাক। যে নিয়ামত তোমার আয়ত্বে এসেছে তা থেকে সামান্য স্বাদ গ্ৰহণ করা। যে নিয়ামত তোমার আয়ত্বে আসেনি তার লোভ করো না। দুনিয়ায় অল্পতেই সন্তুষ্ট থাক। জীবন ধারণের জন্যে একটি শুকনা খেজুরই তোমার জন্যে যথেষ্ট মনে করবে। দুনিয়া কোন পরিণতির দিকে ধাবিত হচ্ছে তা তুমি প্রত্যক্ষ করছি। পরকালের হিসাবের কথা স্মরণ রেখে আমল করতে থাক। কেননা সেখানে তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে। আমি আমার মনোনীত নেককার লোকদের জন্যে সেখানে যেসব পুরস্কারের ব্যবস্থা রেখেছি, তা যদি তুমি দেখতে, তাহলে তোমার অন্তর বিগলিত হয়ে যেত এবং সহ্য করতে না পেরে তুমি মারাই যেতে।
আবু দাউদ তাঁর কিতাবে তাকদীর অধ্যায়ে লিখেছেন, মুহাম্মদ ইব্ন ইয়াহিয়া. তাউস থেকে বর্ণিত। একদা ঈসা ইব্ন মারিয়ামের সাথে ইবলীসের সাক্ষাত হয়। ঈসা ইবলীসকে বললেন, তুমি তো জান, তোমার তাকদীরে যা লেখা হয়েছে তার ব্যতিক্রম কিছুতেই হবে না। ইবলীস বলল, তা হলে আপনি এই পাহাড়ের চূড়ায় উঠুন এবং সেখান থেকে লাফ দিয়ে নীচে পড়ে দেখুন জীবিত থাকেন। কিনা। ঈসা (আ) বললেন, তুমি জান না, আল্লাহ বলেছেন, বান্দা আমাকে পরীক্ষা করতে পারে না, আমি যা চাই তাই করে থাকি? যুহরী বলেছেন, মানুষ কোন বিষয়ে আল্লাহকে পরীক্ষা করতে পারে না, বরং আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করে থাকেন। আবু দাউদ বলেন, আহমদ তাউসের বরাতে বলেন। একবার শয়তান হযরত ঈসার নিকটে এসে বলল, আপনি তো নিজেকে সত্যবাদী বলে মনে করেন, তা হলে আপনি উর্ধে উঠে নীচে লাফিয়ে পড়ুন দেখি। ঈসা বললেন, তোমার অমঙ্গল হোক, আল্লাহ কি এ কথা বলেন নি যে, হে আদম সন্তান! তোমরা আমার নিকট মৃত্যু কামনা করবে না? কেননা আমি যা চাই তা-ই করে থাকি। আবু তাওয়া আর রবী… খালিদ ইব্ন ইয়ায়ীদ থেকে বৰ্ণিত। শয়তান দশ বছর কিংবা দা বছর যাবত ঈসা (আ)-এর সাথে ইবাদত বন্দেগী করতে থাকে। একদিন তারা এক পাহাড়ের উপরে অবস্থান করছিলেন। তখন শয়তান ঈসা (আ)-কে বলল, আমি যদি এখান থেকে লাফ দিয়ে নীচে পড়ি, তাহলে আমার তাকদীরে যা লেখা আছে তার কি কোন ব্যক্তিক্রম ঘটবে? ঈসা (আ) বললেন, আমি আল্লাহকে পরীক্ষা করার ক্ষমতা রাখি না, বরং আল্লাহর যখন ইচ্ছা আমাকে পরীক্ষা করে থাকেন। ঈসা (আ) এতক্ষণে চিনতে পারলেন যে, এ শয়তান ছাড়া আর কিছু নয়। সুতরাং তিনি তাকে তাড়িয়ে দিলেন। আবু বকর ইব্ন আবিদ দুনিয়া…… আবু উছমান (র) থেকে বর্ণিত। একদা হযরত ঈসা (আ) এক পাহাড়ের উপরে সালাত আদায় করছিলেন। এমন সময় তার নিকট ইবলীস এসে বলল, আপনি কি এই দাবী করে থাকেন যে, প্রতিটি বিষয়ই তার পূর্ব নির্ধারিত তাকদীর অনুযায়ী সংঘটিত হয়? ঈসা (আ) বললেন, হ্যাঁ। ইবলীস বলল, তাহলে আপনি এ পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে নীচে পড়ুন এবং বলুন যে, এটাই আমার তাকদীরে ছিল। ঈসা (আ) বললেন, ওহে অভিশপ্ত শয়তান! আল্লাহ তাঁর বান্দাকে পরীক্ষা করতে পারেন, কিন্তু বান্দারা কখনও আল্লাহকে পরীক্ষা করতে পারে না। x
আবু বকর ইব্ন আবিদ দুনিয়া……. সুফিয়ান ইব্ন উয়ায়না (র) থেকে বর্ণনা করেন যে, একদা হযরত ঈসার সাথে ইবলীসের সাক্ষাত হয়। ইবলীস বলল, হে ঈসা ইব্ন মারয়াম! আপনি দোলনায় শিশু অবস্থায় মানুষের সাথে কথা বলেছেন, এটা আপনার প্রভুত্বের বড় নিদর্শন। আপনার পূর্বে আর কোন মানব সন্তান ঐ অবস্থায় কথা বলেনি। ঈসা (আ) বললেন, না। -প্ৰভুত্ব তো ঐ আল্লাহর জন্যে নির্ধারিত, যিনি আমাকে শিশু অবস্থায় কথা বলার শক্তি দিয়েছেন, এরপরে এক সময় আমাকে মৃত্যু দিবেন এবং পুনরায় জীবিত করবেন। ইবলীস বলল, আপনি মৃতকে জীবিত করে থাকেন, এটা আপনার প্রভু হওয়ার বড় প্রমাণ। ঈসা (আ) বললেন, তা হয় কিভাবে, প্ৰভু তো একমাত্র তিনি, যিনি জীবিত করার প্রকৃত মালিক। এবং আমি যাকে জীবিত করি, তিনি তাকে মৃত্যু দেন এবং পুনরায় তাকে জীবিত করেন। ইবলীস বলল, আল্লাহর কসম, আপনি আকাশেরও প্ৰভু এবং দুনিয়ারও প্ৰভু। এ কথা বলার সাথে সাথে ফিরিশতা জিবরাল (আঃ) তাকে আপন ডানা দ্বারা এক ঝাপটা মেরে সূর্যের কিনারায় পৌঁছিয়ে দেন। তারপরে আর এক ঝাপটা মেরে সপ্তম সমুদ্রের তলদেশে পৌঁছিয়ে দেন। এমনকি ইবলীস সমুদ্রের নীচে কাদার সংগে লেগে যায়। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে ঈসা ইব্ন মারিয়ামকে বলে, আমি আপনার থেকে যে শিক্ষা পেলাম, এমন শিক্ষা কেউ কারও থেকে পায় না। এ জাতীয় ঘটনা আরও বিশদভাবে ভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।
হাফিজ আবু বকর আল খাতীব. আবু সালমা সুয়ায়দ থেকে বর্ণিত। হযরত ঈসা (আ) একদা বায়তুল মুকাদাসে সালাত আদায় করে বাড়ি ফিরছিলেন। একটি গিরিপথ দিয়ে যাওয়ার সময় ইবলীস তাঁর সম্মুখে এসে পথরোধ করে দাঁড়ায়। ঈসা (আ) ঘুরে গেলে সে আবার সম্মুখে এসে দাঁড়ায় এবং বলতে থাকে- আপনার জন্যে অন্য কারও দাসত্ব করা শোভা পায় না। এ কথাটি সে বারবার ঈসা (আ)-কে বলতে থাকে। ঈসা (আঃ) তার হাত থেকে ছুটে আসার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু পারছিলেন না। ইবলীস বারবার এ কথাই বলছিল যে, হে ঈসা! কারও দাস হওয়া আপনাকে মানায় না। শেষ পর্যন্ত তিনি আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন। তখন হযরত জিবরীল ও মিকাঈল ফিরিশতাদ্বয় সেখানে হাজির হলেন। ইবলীস তাদেরকে দেখা মাত্র থেমে গেল। কিছুক্ষণ পর ঐ গিরিপথেই ইবলীস ঈসা (আ)-এর সম্মুখে উপস্থিত হল। তখন ফিরিশতাদ্বয় ঈসা (আ)-এর সাহায্যে অগ্রসর হলেন। হযরত জিবরীল। তার ডানা দ্বারা ঝাপটা মেরে ইবলীসকে বাতনে ওয়াদীতে নিক্ষেপ করে দেন। ইবলীস সেখান থেকে উঠে পুনরায় ঈসা (আঃ)-এর নিকট আসল। সে ধারণা করল, সে ফেরেশতাদ্বয়কে যা হুকুম করা হয়েছিল তা পালন করে তারা চলে গিয়েছেন, আর আসবেন না। সুতরাং সে ঈসা (আঃ)-কে পুনরায় বলল, আমি আপনাকে ইতিপূর্বেই বলেছি, দাস হওয়া আপনার জন্যে শোভনীয় নয়। আপনার ক্ৰোধ কোন দাসের ক্ৰোধ নয়। আপনার সাথে সাক্ষাতকালে প্ৰকাশিত ক্ৰোধ থেকে আমি এ কথা বুঝেছি। আমি আপনাকে এমন এক বিষয়ের প্রতি আহবান জানাচ্ছি যা আপনার জন্যে লাভজনক। আমি শয়তানদেরকে হুকুম দিব, তারা আপনাকে প্ৰভু মানবে। মানুষ যখন দেখবে জিনরা আপনাকে প্ৰভু মানছে তখন তারাও আপনাকে প্ৰভূ বলে মানবে এবং আপনার ইবাদত করবে। আমি এ কথা বলছি না যে, আপনিই একমাত্র মাবুদ আর কোন মাবুদ নেই। আমার কথা হচ্ছে, আল্লাহ থাকবেন আসমানের মাবুদ আর আপনি হবেন দুনিয়ার মাবুদ।
ইবলীসের মুখে এ কথা শুনার পর ঈসা (আঃ) আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন এবং উচু আওয়াজ করেন। তখন হযরত ইসরাফীল (আঃ) উপর থেকে নীচে নেমে আসেন। জিবরীল ও মীকাঈল ফিরিশাদ্বয় তার দিকে লক্ষ্য করেন। ইবলীস থেমে যায়। অতঃপর ইসরাফীল তার ডানা দ্বারা ইবলীসকে আঘাত করেন এবং আয়নুশ শামসে নিক্ষেপ করেন। কিছুক্ষণ পর দ্বিতীয়বার আঘাত করেন। এরপর ইবলীস সেখান থেকে অবতরণ করে ঈসা (আ)-কে একই স্থানে দেখতে পায় এবং তাকে উদ্দেশ্য করে বলে, হে ঈসা! আজি আমি আপনার জন্যেই দারুণ কষ্ট ভোগ করেছি। তারপর তাকে আয়নুশ শামসে নিক্ষেপ করা হয। সেখানে আয়নুল হামিয়াতে সাত রাজাকে দেখতে পায়, তারা তাকে তাতে ডুবিয়ে দেয়। যখনই সে চিৎকার করেছে তখনই তারা তাকে সেই কৰ্দমে ডুবিয়ে দেয়। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর ইবলীস কখনও ঈসা (আঃ)-এর নিকট আসেনি। ইসমাঈল আত্তার. আবু হুযায়ফা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, অতঃপর ইবলীসের নিকট তার দলবল শয়তানরা জমায়েত হয় এবং বলে, হে আমাদের সর্দার! আজি যে আপনাকে খুবই ক্লান্ত শ্ৰান্ত মনে হচ্ছে! ইবলীস হযরত ঈসার প্রতি ইংগিত করে বললঃ তিনি হচ্ছেন আল্লাহর নিষ্পাপ বান্দা। তার উপর প্রভাব বিস্তার করার সাধ্য আমার নেই। তবে তাকে কেন্দ্র করে আমি বিপুল সংখ্যক লোককে বিপদগামী করব। বিভিন্ন প্রকার কামনা-বাসনা তাদের মধ্যে জাগিয়ে তুলার। তাদেরকে নানা দলে-উপদলে বিভক্ত করব। তারা তাকে ও তাঁর মাকে আল্লাহর আসনে বসাবে। কুরআন মজীদে আল্লাহ হযরত ঈসাকে ইবললীসের ধোঁকা থেকে হেফাজত করাকে তাঁর অনুগ্রহ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন :
হে মারিয়াম তনয় ঈসা! তোমার প্রতি ও তোমার জননীর প্রতি আমার অনুগ্রহ স্মরণ করা। পবিত্র আত্মা অর্থাৎ জিবরীল ফিরিশতা দ্বারা আমি তোমাকে শক্তিশালী করেছিলাম। হিকমত, তাওরাত ও ইনজীল শিক্ষা দিয়েছিলাম; তুমি কর্দম দ্বারা আমার অনুমতিক্রমে পাখি সদৃশ আকৃতি গঠন করতে এবং তাতে ফুৎকার দিতে, ফলে আমার অনুমতিক্রমে তা পাখি হয়ে যেত; জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্তকে তুমি আমার অনুমতিক্রমে নিরাময় করতে এবং আমার অনুমতি ক্ৰমে তুমি মৃতকে জীবিত করতে; আমি তোমা হতে বনী-ইসরাঈলকে নিবৃত্ত রেখেছিলাম; তুমি যখন তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন এনেছিলে তখন তাদের মধ্যে যারা কুফরী করেছিল তারা বলেছিল, এ তো স্পষ্ট যাদু। (৫ মায়িদাঃ ১১০)।
আমি গরীব ও মিসকীন লোকদেরকে তোমার একান্ত ভক্ত ও সাখী বানিয়েছি— যাদের উপরে তুমি সন্তুষ্ট; এমন সব শিষ্য ও সাহায্যকারী তোমাকে দিয়েছি, যারা তোমাকে জান্নাতের পথ প্রদর্শনকারী রূপে পেয়ে সন্তুষ্ট। জেনে রেখাে, উক্ত গুণ দটি বান্দার জন্যে প্রধান গুণ। যারা এ গুণ দুটি নিয়ে আমার কাছে আসবে, তারা আমার নিকট সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ও মনোনীত বান্দা হিসেবে গণ্য হবে। বনী ইসরাঈলরা তোমাকে বলবে, আমরা রোজা রেখেছি কিন্তু তা কবুল হয়নি, নামায পড়েছি কিন্তু তা গৃহীত হয়নি, দান-সাদকা করেছি। কিন্তু তা মঞ্জর হয়নি, উটের কান্নার ন্যায় করুণ সুরে কেঁদেছি কিন্তু আমাদের কান্নার প্রতি দয়া প্রদর্শন করা হয়নি। এ সব অভিযোগের জবাব তাদের কাছে জিজ্ঞেস কর, এমনটা কেন হল? কোন জিনিসটি আমাকে এসব কবুল করা থেকে বাধা দিয়েছে? আসমান ও যমীনের সমস্ত ধন ভাণ্ডার কি আমার হাতে নেই? আমি আমার ধন ভাণ্ডার থেকে যেরূপ ইচ্ছা খরচ করে থাকি। কৃপণতা আমাকে স্পর্শ করে না। আমি কি প্রার্থনা শ্রবণের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম এবং দান করার ব্যাপারে সবচেয়ে উদার সত্তা নই? না। আমার দান- অনুগ্রহ সংকুচিত হয়ে গিয়েছে? দুনিয়ার কেউ কারও প্রতি অনুগ্রহশীল হলে সে তো আমারই দয়ার কারণে তা করে থাকে।
হে ঈসা ইব্ন মারিয়াম! ঐ সম্প্রদায়ের লোকদের অন্তরে আমি যে সব সদগুণ প্ৰদান করেছিলাম তারা যদি সেগুলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগােত তা হলে আখিরাতের জীবনের উপরে দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দিত না এবং বুঝতে পারত যে, কোথা থেকে তাদেরকে দান করা হয়েছে, আর তারা এটাও বিশ্বাস করত যে, মনের কামনা বাসনাই তাদের বড় দুশমন। তাদের রোজা আমি কিভাবে কবুল করি। যখন হারাম খাবার গ্রহণের মাধ্যমে তারা শক্তি সঞ্চয় করেছে? তাদের নামায আমি কিভাবে কবুল করি, যখন তাদের অন্তর ঐ সব লোকদের প্রতি আকৃষ্ট যারা আমার বিরোধিতা করে এবং আমার নিষিদ্ধ বস্তুকে হালাল জানে? কি করে তাদের দান-সাদকা আমি মঞ্জর করি, যখন তারা মানুষের উপর জুলুম করে অবৈধ পন্থায় তাদের ধন-সম্পদ ছিনিয়ে নেয়। হে ঈসা! আমি ঐ সব লোকদেরকে যথাযথ প্রতিদান দিব। হে ঈসা! তাদের কান্নায় আমি দয়া দেখাব কিভাবে, যখন তাদের হাত নবীদের রক্তে রঞ্জিত? এ কারণে তাদের প্রতি আমার ক্ৰোধ অতি মাত্রায় বেশী। হে ঈসা। যে দিন আমি আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছি- সে দিন-ই আমি এ বিষয়টি চূড়ান্ত করে রেখেছি যে, যে ব্যক্তি আমার দাসত্ব কবুল করবে এবং তোমার ও তোমার মা সম্পর্কে আমার বাণীকে সঠিক বলে মেনে নিবে, তাকে আমি তোমার ঘরের প্রতিবেশী বানাব, সফরের সাখী করব এবং অলৌকিক ঘটনা প্ৰকাশে তোমার শরীক করব। যে দিন আমি আসমান যমীন সৃষ্টি করেছি, সে দিন এ বিষয়ে চূড়ান্ত ফয়সালা করে রেখেছি যে, যে সব লোক তোমাকে ও তোমার মাকে আল্লাহর সাথে শরীফ করে প্রভু বানাবে, তাদেরকে আমি জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে স্থান দিব। যে দিন আমি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছি, সে দিন এই সিন্ধান্ত চূড়ান্ত করে রেখেছি যে, আমি আমার প্রিয় বান্দা মুহাম্মদের হাতে এ বিষয়টি নিষ্পত্তি করব। তার উপরেই নবুওত ও রিসালাতের পরিসমাপ্তি টানব। তার জন্ম হবে মক্কায়, হিজরতস্থল (মদীনা) তায়্যিবা। শ্যাম দেশ তার করতলগত হবে। সে কর্কশ ভাষী ও কঠোর হৃদয় হবে না, বাজারে চিৎকার করে ফিরবে না, অশ্লীল অশ্রাব্য কথাবার্তা বলবে না। প্রতিটি বিষয়ে উত্তম পন্থা অবলম্বনের জন্যে আমি তাকে তাওফীক দিব। সৎ চরিত্রের যাবতীয় গুণাবলী তাকে প্রদান করব। তার অন্তর থাকবে তাকওয়ায় পরিপূর্ণ। জ্ঞান হবে প্রজ্ঞায় তার আদর্শ, নাম হবে তার আহমদ।
আমি তার সাহায্যে মানুষকে বিভ্রান্তি থেকে সঠিক পথ দেখাব, অজ্ঞতা থেকে ফিরিয়ে জ্ঞানের দিকে আনব, নিঃস্ব অবস্থা থেকে স্বচ্ছলতার দিকে আনব, বিপর্যন্ত অবস্থা থেকে উদ্ধার করে উন্নতির সোপানে উঠাব। তার দ্বারা সঠিক পথ প্রদর্শন করবো। তার সাহায্যে বধির ব্যক্তিকে শ্রবণ শক্তি দান করব, আচ্ছাদিত হৃদয় সমূহকে উন্মুক্ত করে দিব, বিভিন্ন কামনা-বাসনাকে সংযত করব। তার উম্মতকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উম্মতের মর্যাদা দান করব। মানব জাতির কল্যাণ সাধনের জন্যে তাদের অত্যুদয় ঘটবে। তারা মানুষকে ভাল কাজে আহবান জানাবে ও গৰ্হিত কাজ থেকে নিষেধ করবে। আমার নামে তারা নিষ্ঠাবান থাকবে। রাসূলের আনীত আদর্শকে তারা মনে-প্ৰাণে বিশ্বাস করবে। তারা তাদের মসজিদে, সভা সমিতিতে বাড়ি ঘরে ও চলতে ফিরতে সর্বাবস্থায় আমার তাসবীহ পাঠ করবে, পবিত্রতা ঘোষণা করবে ও লাইলাহা ইল্লালাহ কলেমা পড়বে। তারা দাঁড়ানো অবস্থায়, বসা অবস্থায় রুকু সিজদার মাধ্যমে আমার জন্যে সালাত আদায় করবে। আমার পথে তারা সারিবদ্ধ হয়ে দুশমনের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। আল্লাহর পথে রক্ত দান হচ্ছে তাদের নিকট পুণ্যকর্ম। সুসংবাদের আশায় তাদের অন্তর ভরপুর, তাদের পুন্য কাজসমূহ প্রদর্শনীমুক্ত। রাতের বেলায় তারা আল্লাহর ধ্যানে মশগুল। তাপস আর দিনের বেলায় যুদ্ধের ময়দানে সাক্ষাত সিংহ-এ সবই আমার অনুগ্রহ। যাকে ইচ্ছা! তাকে দিই। আমি মহা অনুগ্রহশীল।
উপরে যা কিছু আলোচনা হল, এর সপক্ষে প্রমাণাদি আমরা সূরা মায়িদা ও সূরা সাফ এর প্রসঙ্গে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করব ইনশা আল্লাহ। আবু হযায়ফা ইসহাক ইব্ন বিশর বিভিন্ন সূত্রে কাব আল-আহবার, ওহাব ইব্ন মুনাব্বিাহ, ইব্ন আব্বাস (রা) ও সালমান ফারসী (রা) থেকে বর্ণনা করেন। বর্ণনায় তাদের একজনের বক্তব্য অন্যজনের বক্তব্যের সাথে মিশে গেছে। তারা বলেন যে, হযরত ঈসা ইব্ন মারিয়াম যখন বনী ইসরাঈলের নিকট প্রেরিত হলেন এবং তাদের সম্মুখে সুস্পষ্ট নিদর্শনাদি তুলে ধরলেন তখন বনী ইসরাঈলের মুনাফিক ও কাফির শ্রেণীর লোকেরা তার সাথে উপহাস করতো। তারা জিজ্ঞেস করত, বলুন তো, অমুক গতকাল কী খাবার খেয়েছে এবং বাড়িতে সে কী রেখে এসেছে? হযরত ঈসা (আঃ) তাদেরকে সঠিক জবাব দিয়ে দিতেন। এতে মুমিনদের ঈমান এবং কাফির ও মুনাফিকদের সন্দেহ ও অবিশ্বাস আরও বেড়ে যেত, এতদসত্ত্বে ও হযরত ঈসার মাথা গোজায় মত কোন ঘর বাড়ী ছিল না। খোলা আকাশের নীচে মাটির উপর তিনি সালাত ও তাসবীহ আদায় করতেন। তার কোন স্থায়ী আবাসস্থল বা ঠিকানা ছিল না। সর্বপ্রথম তিনি যে মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করেন। সে ঘটনাটি ছিল এরূপ :
একদা তিনি কোন এক কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ঐ কবরের নিকটে এক মহিলা বসে। কাদছিল। ঈসা মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কী হয়েছে? মহিলাটি বলল, আমার একটি মাত্র কন্যা ছিল। সে ছাড়া আমার আর কোন সন্তান নেই। আমার সে কন্যাটি মারা গিয়েছে। আমি আল্লাহর সাথে প্ৰতিজ্ঞা করেছি যে, হয় তিনি আমার কন্যাকে জীবিত করে দিবেন, না হয়। আমিও তার মত মারা যাব, এ জায়গা ত্যাগ করব না। আপনি এর দিকে একটু লক্ষ্য করুন। ঈসা (আঃ) বললেন, আমি যদি লক্ষ্য করি তবে কি তুমি এখান থেকে ফিরে যাবে? মহিলাটি বলল, হ্যাঁ তা-ই করব। তারপর হযরত ঈসা (আঃ) দু রাকাআত সালাত আদায় করে কবরের পাশে এসে বসলেন এবং বললেনঃ ওহে অমুক, তুমি আল্লাহর হুকুমে উঠে দাঁড়াও, এবং বের হয়ে এস। তখন কবরটি সামান্য কেঁপে উঠল। ঈসা (আ) দ্বিতীয়বার আহবান করলেন। এবার কবরটি ফেটে গেল। তৃতীয়বার আহবান করলে কবরবাসিনী বেরিয়ে আসল এবং মাথার চুল থেকে ধুলাবালি ঝেড়ে ফেলতে লাগল। ঈসা (আঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, বের হতে তোমার দেরী হল কেন? মেয়েটি বলল, প্রথম আওয়াজ শোনার পর আল্লাহ আমার নিকট একজন ফিরিশতা পাঠান। তিনি আমার দেহের অংগ-প্রত্যংগগুলি জোড়া লাগান; দ্বিতীয় আওয়াজের পর রূহ আমার দেহের ভিতর প্রবেশ করে। তৃতীয় আওয়াজ যখন হল তখন আমার ধারণা হল, এটা কিয়ামতের আওয়াজ। আমি ভীত-শংকিত হয়ে পড়লাম। কিয়ামতের ভয়ে আমার মাথার চুল ও চোখের ভ্ৰষ্ঠ সব সাদা হয়ে গিয়েছে। তারপর মেয়েটি তার মায়ের কাছে গিয়ে বলল, মা! আপনি আমাকে মৃত্যুর তিক্ত স্বাদ দুইবার গ্রহণ করালেন কেন? মা! ধৈৰ্য ধরুন, পুণ্যের আশা করুন। দুনিয়ার উপরে থাকার কোন আগ্রহ আমার নেই। হে রূহুল্লাহ! হে তুল্লাহ! আপনি আল্লাহর নিকট দোয়া করুন, যেন আমাকে তিনি আখিরাতের জীবন ফিরিয়ে দেন এবং মৃত্যুর কষ্ট কমিয়ে দেন। ঈসা (আঃ) আল্লাহর নিকট দোয়া করলেন। ফলে মেয়েটির দ্বিতীয়বার মৃত্যু হল এবং তাকে কবরস্থ করা হল। এ সংবাদ ইয়াহুদীদের নিকট পৌছলে তারা ঈসা (আ)-এর প্রতি পূর্বের চাইতে অধিক বিদ্বেষ পরায়ণ হয়ে উঠে।
ইতিপূর্বে হযরত নূহ (আ)-এর ঘটনা বর্ণনা করার পরে উল্লেখ করা হয়েছে যে, হযরত নূহের পুত্র সাম-কে জীবিত করে দেয়ার জন্যে বনী ইসরাঈলরা হযরত ঈসার নিকট দাবী জানায়। তিনি সালাত আদায় করে আল্লাহর নিকট দোয়া করেন। ফলে আল্লাহ তাকে জীবিত করে দেন। সাম জীবিত হয়ে বনী ইসরাঈলদেরকে নূহ (আ)-এর নীেকা সম্বন্ধে অবহিত করেন, ঈসা (আ) পুনরায় দোয়া করলে তিনি আবার মাটির সাথে মিশে যান।
সুদন্দী … ইব্ন আব্বাস (রা)-এর বরাতে একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটি হল, বনী ইসরাঈলের কোন এক বাদশাহর মৃত্যু হয়। কবরস্থ করার জন্যে তাকে খাটের উপর রাখা হয়। এ সময় হযরত ঈসা (আ) সেখানে উপস্থিত হন। তিনি আল্লাহর নিকট দোয়া করেন। ফলে বাদশাহ জীবিত হয়ে যায়। মানুষ অবাক দৃষ্টিতে এ আশ্চর্য ও অভূতপূর্ব ঘটনা প্রত্যক্ষ করে। আল্লাহর বাণী :
অনুগ্রহ স্মরণ করা ৪ পবিত্র আত্মা দ্বারা আমি তোমাকে শাক্তিশালী করেছিলাম এবং তুমি দোলনায় থাকা অবস্থায় ও পরিণত বয়সে মানুষের সাথে কথা বলতে; তোমাকে কিতাব হিকমত, তাওরাত ও ইনজীল শিক্ষা দিয়েছিলাম; তুমি কাদা দ্বারা আমার অনুমতিক্রমে পাখী সদৃশ আকৃতি গঠন করতে এবং তাতে ফুৎকার দিতে, ফলে আমার অনুমতিক্রমে তা পাখী হয়ে যেত; জন্মান্ধ ও কুণ্ঠ ব্যাধিগ্রস্তকে তুমি আমার অনুমতিক্রমে নিরাময় করতে এবং আমার অনুমতিক্রমে তুমি মৃতকে জীবিত করতে; আমি তোমা হতে বনী ইসরাঈলকে নিবৃত্ত রেখেছিলাম; তুমি যখন তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন এনেছিলে তখন তাদের মধ্যে যারা কুফৱী করেছিল তারা বলেছিল, এতো স্পষ্ট যাদু। আরও স্মরণ করা, আমি যখন হাওয়ারীদেরকে এই আদেশ দিয়েছিলাম যে, তোমরা আমার প্রতি ও আমার রাসূলের প্রতি ঈমান আনি, তারা
বলেছিল, আমরা ঈমান আনলাম এবং তুমি সাক্ষী থাক যে, আমরা তো মুসলিম। (৫ মায়িদা :
এখানে আল্লাহ তাআলা হযরত ঈসার প্রতি প্রদত্ত অনুগ্রহসমূহ ও পিতা ব্যতীত মায়ের থেকে সৃষ্টির কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁকে তিনি মানব জাতির জন্যে নিদর্শন বানিয়েছেন। বলা বাহুল্য, এটা আল্লাহর অসীম ক্ষমতারই সুস্পষ্ট প্রমাণ। এ সবের পরেও তাঁকে রাসূল বানিয়ে নিজ অনুগ্রহ পূর্ণ করেন। তোমার মায়ের প্রতি আমার অনুগ্রহ অর্থাৎ প্রথমত, এই বিশাল নিয়ামতের অধিকারী মহান নবীর মা হওয়ার জন্যে তাঁর প্রতি যে কুৎসা রটনা করেছিল তা থেকে মুক্ত করার জন্যে প্রমাণ উপস্থাপন। পবিত্র আত্মা দ্বারা আমি তোমাকে শক্তিশালী করেছিলাম। পবিত্র আত্মা অর্থ জিবরাঈল ফিরিশতা। জিবরাঈলের দ্বারা শক্তিশালী করেছিলেন। এভাবে যে, তিনি তার রূহকে তার মায়ের জামার হাতার মধ্যে ফুৎকার দিয়ে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিলেন; রিসালাতের দায়িত্ব পালনকালে তিনি ঈসা (আ)-এর সাথে সাথে থাকতেন এবং নবীর বিরোধীদেরকে তিনি প্ৰতিহত করতেন। দোলনায় থাকা অবস্থায় ও পরিণত বয়সে কথা বলার অর্থ-তুমি শিশুকালে দোলনায় থাকা অবস্থায় মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান করেছ। এবং পরিণত বয়সেও তাদেরকে আহবান করবে। কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেওয়ার অর্থ লিপি জ্ঞান ও গভীর অনুধাবন শক্তি দান করা। প্রাচীন যুগের আলিম এরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। কাদা দ্বারা পাখীর আকৃতি গঠন অর্থাৎ আল্লাহর অনুমতিক্রমে তুমি কাদা দ্বারা পাখীর আকৃতি অবয়ব গঠন করতে। আমার অনুমতিক্রমেপখী হয়ে যেত। অনুমতিক্রমে অর্থ আদেশক্রমে, আল্লাহর অনুমতি কথাটি আনার উদ্দেশ্য হল, মানুষ যাতে এই সন্দেহ না করে যে, ঈসা নিজের ক্ষমতা বলেই এরূপ করেছেন। জন্যান্ধ বলতে এখানে কোন কোন আলিম বলেছেন : যার কোন চিকিৎসা নেই। কুণ্ঠ রোগীও এমন কুণ্ঠরোগ, যার কোন চিকিৎসা নেই। মৃতকে জীবিত করা অর্থাৎ কবর থেকে জীবিত অবস্থায় উঠানো। আমার অনুমতিক্ৰমে শব্দটির পুনরুক্তি। এ কথা দ্বারা ঐ ঘটনার দিকে ইংগিত করা হয়েছে, যখন বনী ইসরাঈলরা তাঁকে শূলে চড়াবার জন্যে
উদ্যত হয়েছিল। তখন আল্লাহ তাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন এবং আপনি সান্নিধ্যে তুলে নিয়েছিলেন। আমি যখন হাওয়ারীদেরকে ওহী মারফত আদেশ দিয়েছিলাম। এখানে ওহীর দুপ্রকার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
এক: ওহী অর্থ ইলহাম বা প্রেরণা জাগিয়ে দেওয়া। এ অর্থে কুরআনের আয়াত যেমন
নির্দেশ দিয়েছেন (১৬ নাহল ৪ ৬৮); و او حینا الی اچ قوسی ان ار ضعیه فاذا خفت عليه فألقيه فى اليم. মূসার মায়ের অন্তরে আমি ইংগিতে নিদের্শ করলাম, শিশুটিকে স্তন্য দান করতে থাক। যখন তুমি তার সম্পর্কে কোন আশংকা করবে। তখন একে দরিয়ায় নিক্ষেপ করে দিও। (২৮ কাসাস : ৭)
দুই; রাসূলের মাধ্যমে প্রেরিত ওহী এবং তাদেরকে সত্য গ্রহণের তাওফীক দেওয়া। এ জন্যেই তারা প্রতি উত্তরে বলেছিল ৬, . I., LA, L. ……..I, […। আমরা ঈমান আনলাম এবং তুমি সাক্ষী থাক যে, আমরা মুসলিম। হযরত ঈসা (আ)-এর প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত অনুগ্রহ সমূহের মধ্যে অন্যতম বড় অনুগ্রহ এই যে, তিনি তাকে এমন একদল সাহায্যকারী ও সেবক। দিয়েছিলেন, যারা তাকে সর্বোতভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন এবং মানুষকে এক অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহবান জানাতেন। যেমন আল্লাহ তাআলা হযরত মুহাম্মাদ (সা) সম্পর্কে বলেছেন :
তিনি তোমাকে আপনি সাহায্য ও মুমিনদের দ্বারা শক্তিশালী করেছেন; এবং তিনি ওদের পরস্পরের হৃদয়ের মধ্যে গ্ৰীতি স্থাপন করেছেন। পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ ব্যয় করলেও তুমি তাদের হৃদয়ে গ্ৰীতি স্থাপন করতে পারতে না; কিন্তু আল্লাহ তাদের মধ্যে প্রীতি স্থাপন করেছেন। নিশ্চয়ই তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (৮ আনফাল : ৬২,৯৬২)
আল্লাহ বলেন :
এবং তিনি তাকে শিক্ষা দিবেন। কিতাব, হিকমত, তাওরাত ও ইনজীল এবং তাকে বনী ইসরাঈলের জন্যে রাসূল করবেন। সে বলবে, আমি তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমাদের নিকট নিদর্শন নিয়ে এসেছি। আমি তোমাদের জন্যে কাদা দিয়ে একটি পাখীর আকৃতি গঠন করব; তাতে আমি ফুৎকার দিব; ফলে আল্লাহর হুকুমে তা পাখী হয়ে যাবে। আমি জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্তকে নিরাময় করব এবং আল্লাহর হুকুমে মৃতকে জীবন্ত করব। তোমরা তোমাদের ঘরে যা আহার কর ও মাওজুদ কর তাতোমাদেরকে বলে দেব। তোমরা যদি মুমিন হও তবে এতে তোমাদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। আর আমি এসেছি আমার সম্মুখে তাওরাতের যা রয়েছে তার সমর্থকরূপে ও তোমাদের জন্যে যা নিষিদ্ধ ছিল তার কতকগুলোকে বৈধ। করতে। এবং আমি তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট নিদর্শন নিয়ে এসেছি। সুতরাং আল্লাহকে ভয় কর ও আমাকে অনুসরণ কর। আল্লাহ আমার প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক, সুতরাং তোমরা তার ইবাদত করবে। এটাই সরল পথ। যখন ঈসা। তাদের অবিশ্বাস উপলব্ধি করল তখন সে বলল, আল্লাহর পথে কারা আমার সাহায্যকারী? হাওয়ারীরা বলল, আমরাই আল্লাহর পথে সাহায্যকারী। আমরা আল্লাহতে ঈমান এনেছি। আমরা আত্মসমৰ্পণকারী, তুমি এর সাক্ষী থাক। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি যা অবতীর্ণ করেছ তাতে আমরা ঈমান এনেছি, এবং আমরা এই রাসূলের অনুসরণ করেছি। সুতরাং আমাদেরকে সাক্ষ্য দানকারীদের তালিকাভুক্ত কর। এবং তারা চক্রান্ত করেছিল, আল্লাহও
কৌশল করেছিলেন; আল্লাহ কৌশলীদের শ্রেষ্ঠ। (৩ আলে ইমরান : ৪৮-৫৮)
প্ৰত্যেক নবীর মুজিযা ছিল তাঁর নিজ যুগের মানুষের চাহিদার উপযোগী। যেমন হযরত মূসা (আ)-এর যুগের লোকেরা ছিল তীক্ষুধী। যাদুকর। আল্লাহ তাঁকে এমন মুজিযা দান করলেন যা যাদুকরদের চোখ ঝলসিয়ে দিয়েছিল এবং যাদুকররা তাঁর নিকট আত্মসমৰ্পণ করেছিল। যাদুকররা যাদু সংক্রান্ত তথ্যাদি সম্পর্কে অবগত ছিল। যাদুর দৌড় যে কী পর্যন্ত, সে সম্পর্কেও তারা অবহিত ছিল। সুতরাং যখন তারা মূসা (আ)-এর মুজিযা প্রত্যক্ষ করল তখন তারা বুঝতে পারলো যে, এতো মানবীয় ক্ষমতার বহির্ভূত ব্যাপার। আল্লাহর সাহায্য ও প্রদত্ত ক্ষমতা ব্যতীত কোন মানুষের ক্ষেত্রে এ ধরনের কিছু প্ৰকাশ হতে পারে না। কোন নবীর সত্যতা প্রমাণের জন্যে আল্লাহ এরূপ মানবীয় ক্ষমতার বহির্ভুত কিছু প্রকাশ করে থাকেন। সুতরাং কালবিলম্ব না করে তারা মূসা (আঃ)-এর নিকট আত্মসমর্পণ করলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করলেন। অনুরূপভাবে হযরত ঈসা ইব্ন মারয়াম (আ)-কে যে যুগে প্রেরণ করা হয় সে যুগটি গ ছিল উন্নত চিকিৎসার জন্যে প্রসিদ্ধ। আল্লাহ তাকে এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এমন মুজিযা দান করলেন যা ছিল তাদের ক্ষমতা ও আয়ত্তের বাইরে। একজন চিকিৎসক যখন অন্ধ, খঞ্জ,কুণ্ঠ ও পঙ্গুকে ভাল করতে অক্ষম, সেখানে একজন জন্মািন্ধকে ভাল করার প্রশ্নই উঠে না। আর একজন মৃত ব্যক্তিকে কবর থেকে জীবিত উঠাবার শক্তি মানুষের জন্যে তো কল্পনাই করা যায় না। প্রত্যেকেই বুঝে যে, এসব এমন মুজিযা, যার মাধ্যমে এগুলো প্রকাশ পায় তার দাবির পক্ষে এটা হয়ে থাকে সুস্পষ্ট প্রমাণ এবং যে সত্তা তাকে প্রেরণ করেন তার কুদরত ও মহাশক্তির প্ৰমাণ।
একই পদ্ধতিতে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-কে যে যুগে প্রেরণ করা হয় সে যুগটি ছিল বালাগােত-ফসাহাত তথা অলংকারশাস্ত্রে সমৃদ্ধ উন্নত ভাষা শিল্পের যুগ। আল্লাহ তার উপর কুরআন মাজীদ অবতীর্ণ করেন। যে কোন ত্রুটি থেকে তা মুক্ত। কুরআনের বাক্য ও শব্দগুলো এমনই মুজিযা যে, মানব ও জিন জাতিকে সম্মিলিতভাবে এই কুরআনের অনুরূপ একটি কুরআন, কিংবা অনুরূপ ১০টি সূরা অথবা মাত্র ক্ষুদ্র একটি সূরা রচনা করার চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এরপর দৃঢ়তার সাথে বলা হয়েছে যে, তারা কোন দিন এ চ্যালেঞ্জের মুকাবিলা করতে পারবে না-বর্তমানেও না, ভবিষ্যতেও না, এখনই যখন পারেনি, ভবিষ্যতে কখনও পারবে না। এরকম ভাষা তারা তৈরি করতে এ জন্যে পারবে না, যেহেতু এটা আল্লাহর বাণী। আর আল্লাহর সাথে কোন কিছুরই তুলনা হতে পারে না। –না তার সত্তার সাথে না তাঁর গুণাবলীর সাথে, না। তার কার্যাবলীর সাথে। w
হযরত ঈসা (আঃ) যখন বনী ইসরাঈলের নিকট অকাট্য দলীল-প্রমাণ স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন তখন তাদের অধিকাংশ লোকই কুফারী, ভ্ৰষ্টতা, বিদ্বেষ ও অবাধ্যতার উপর অটল থেকে যায়। তবে তাদের একটি ক্ষুদ্র দল তার পক্ষ অবলম্বন করে এবং বিরোধিতাকারীদের প্রতিবাদ জানান। তারা নবীর সাহায্যকারী হন ও তার শিষ্যত্ব বরণ করেন। তাঁরা নবীর আনুগত্য করেন, সাহায্য-সহযোগিতা করেন ও উপদেশ মেনে চলেন। এই ক্ষুদ্র দলটির আত্মপ্রকাশ তখন ঘটে যখন বনী ইসরাঈল তাকে হত্যার জন্যে পরিকল্পনা গ্ৰহণ করে এবং সে যুগের জনৈক বাদশাহর সাথে ষড়যন্ত্র পাকাপোক্ত করে তাঁকে হত্যা ও শূলে চড়ানোর চক্রান্ত সম্পন্ন করে। কিন্তু আল্লাহ
۹ مالا
তাকে তাদের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করেন। তাদের মধ্য থেকে নবীকে তার সান্নিধ্যে উঠিয়ে নেন। এবং তাঁর একটি শিষ্যকে তার চেহারার অনুরূপ চেহারায় রূপান্তরিত করে দেন। কিন্তু বনী ইসরাঈলরা তাকে ঈসা। মনে করে হত্যা করে ও শূলে চড়ায়। এব্যাপারে তারা ভুল সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করে ও সত্যকে উপেক্ষা করে। খ্ৰীষ্টান সম্প্রদায়ের অধিকাংশ লোক এদের দাবিকে সমর্থন করে। কিন্তু উভয় দলই এ ব্যাপারে ভুলের মধ্যে রয়েছে।
আল্লাহর বাণী তারা এক চক্রান্ত করেছিল, আর আল্লাহ এক কৌশল অবলম্বন করলেন। আল্লাহই উত্তম কৌশল অবলম্বনকারী। আল্লাহ আরও বলেন?স্মরণ করা, মারিয়াম তনয় ঈসা বলেছিল, হে বনী ইসরাঈল! আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর রাসূল এবং আমার পূর্ব হতে তোমাদের নিকট যে তাওরাত রয়েছে। আমি তার সমর্থক এবং আমার পরে আহমদ নামে যে রাসূল আসবেন আমি তার সুসংবাদদাতা। পরে সে যখন স্পষ্ট নিদর্শনসহ তাদের নিকট আসল তারা বলতে লাগল, এতো এক স্পষ্ট যাদু। যে ব্যক্তি আল্লাহর দিকে আহুত হয়েও আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা রচনা করে তার অপেক্ষা অধিক জালিম আর কে? আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না। তারা আল্লাহর নূর ফুৎকারে নিভাতে চায় কিন্তু আল্লাহ তার নূর পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত করবেন যদিও কাফিররা তা অপছন্দ করে। (সূরা সাফ : ৬-৮)
এরপরে আল্লাহ বলেন? হে মুমিনগণ! আল্লাহর দীনের সাহায্যকারী হও, যেমন মারিয়াম তনয় ঈসা বলেছিল তার শিষ্যগণকে, আল্লাহর পথে কে আমার সাহায্যকারী হবে? শিষ্যগণ বলেছিল, আমরাই তো আল্লাহর পথে সাহায্যকারী। অতঃপর বনী ইসরাঈলদের একদল ঈমান আনল এবং একদল কুফরী করল। পরে আমি মুমিনদেরকে শক্তিশালী করলাম তাদের শক্ৰদের মুকাবিলায়; ফলে তারা বিজয়ী হল। (৬ সূরা সাফ : ১৪)। অতএব, ঈসা (আঃ) হলেন বনী ইসরাঈলের শেষ নবী। তিনি তাদের তার পরে আগমনকারী সর্বশেষ নবীর সুসংবাদ দান করেন, তার নাম উল্লেখ করেন এবং তাঁর লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্যসমূহ বৰ্ণনা করেন, যাতে করে সেই নবী যখন আগমন করবেন তখন তারা তাকে চিনতে পারে ও তাঁর আনুগত্য করতে পারে। তারা যাতে কোন রকম অজুহাত তুলতে না পারে, সে জন্যে তিনি দলীল-প্রমাণ চুড়ান্তভাবে পেশ করেন এবং তাদের প্রতি এটা ছিল আল্লাহর অনুকম্পা স্বরূপ। যেমনটি আল্লাহ বলেন : যারা অনুসরণ করে বার্তাবাহক উন্ময়ী নবীর যার উল্লেখ তাওরাত ও ইনজীল যা তাদের নিকট আছে তাতে লিপিবদ্ধ পায়। যে তাদেরকে সৎকাজের নির্দেশ দেয় ও অসৎকাজে বাধা দেয়, যে তাদের জন্যে পবিত্র বস্তু বৈধ করে ও অপবিত্র বস্তু অবৈধ করে এবং যে মুক্ত করে তাদেরকে তাদের গুরুভার থেকে ও শৃংখল থেকে যা তাদের উপর ছিল। সুতরাং যারা তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তাকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং যে নূর তার সাথে অবতীর্ণ হয়েছে
তার অনুসরণ করে, তারাই সফলকাম। (৭ আরাফ : ১৫৭)
মুহাম্মদ ইব্ন ইসহাক … রাসূল (সা)-এর কতিপয় সাহাবীদের বরাতে বর্ণনা করেন যে, একদা তাঁরা বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদেরকে আপনার নিজের সম্পর্কে অবহিত করুন। উত্তরে তিনি বলেন, আমি ইবরাহীম (আ)-এর দোয়ার ফলে, ঈসা (আ)-এর সুসংবাদ। যখন আমি মায়ের পেটে ছিলাম তখন আমার মা স্বপ্ন দেখেছিলেন যে, তার থেকে একটি নূর বের হয়ে শাম দেশের বুসরা নগরী প্রাসাদ।রাজিকে আলোকে উদ্ভাসিত করে দিয়েছে। ইরাবায ইব্ন সারিয়া ও আবু উমামাও রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। তাদের বর্ণনায় এসেছে যে, আমি ইবরাহীম (আ)-এর দোয়া এবং ঈসা (আঃ)-এর সুসংবাদ। ইবরাহীম (আঃ) যখন কাবা ঘর নির্মাণ করেন তখন আল্লাহর নিকট দোয়া করেছিলেন যে, হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের মধ্য হতে তাদের নিকট এক রাসূল প্রেরণ করা। (২ বাকারা? ১২৯)।
অতঃপর বনী ইসরাঈলের মধ্যে নবুওতের ধারাবাহিকতা যখন ঈসা (আ) পর্যন্ত এসে শেষ হল তখন তিনি তাদেরকে জানিয়ে দেন যে, তাদের মধ্যে নবী প্রেরণের ধারা শেষ হয়ে গিয়েছে। এরপর আরবদের মধ্যে এক উক্ষ্মী নবী আসবেন। তিনি হবেন খাতিমুল আম্বিয়া বা শেষ নবী। তাঁর নাম হবে আহমদ, তিনি হচ্ছেন মুহাম্মাদ ইব্ন আবদুল্লাহ ইব্ন আবদুল মুত্তালিব ইব্ন হাশিম। ইসমাঈল ইব্ন ইবরাহীমের বংশধর।
আল্লাহ বলেন, পরে সে যখন স্পষ্ট নিদর্শনসহ তাদের নিকট আসল, তারা বলতে লাগল, এতো এক স্পষ্ট যাদু (৬ সাফ : ৬)। সে যখন আসল –এখানে সে সর্বনাম দ্বারা ঈসা। (আ)-কেও বুঝান হতে পারে, এবং আবার মুহাম্মদ (সা)-কেও বুঝান হতে পারে। তারপার আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে, মুসলমানদেরকে সাহায্য করতে এবং নবীকে সম্মান করতে ও ইকামতে দীন এবং দাওয়াত সম্প্রসারণ কাজে সহযোগিতা করতে নির্দেশ দান করেন।
আল্লাহ বলেন, হে মুমিনগণ! আল্লাহর দীনের সাহায্যকারী হও, যেমন মারিয়াম-তনয় বলেছিল তার শিষ্যগণকে, আল্লাহর পথে কে আমার সাহায্যকারী হবে। অর্থাৎ আল্লাহর দিকে মানুষকে আহবান জানাবার কাজে কে আমাকে সাহায্য করবে? শিষ্যগণ বলেছিল, আমরাই তো আল্লাহর পথে সাহায্যকারী। নাসিরা নামক একটি গ্রামে ঈসা নবীর সাথে শিষ্যদের এই কথাবার্তা হয়েছিল; এ জন্যেই পরবর্তীতে তারা নাসারা নামে আখ্যায়িত হয়।
আল্লাহার বাণী : অতঃপর বনী ইসরাঈলদের একদল ঈমান আনল এবং একদল কুফারী করল। অর্থাৎ ঈসা (আঃ) যখন বনী ইসরাঈলসহ অন্যদেরকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেন। তখন কিছু লোক দাওয়াত কবুল করল এবং কিছু লোক প্রত্যাখ্যান করল। সীরাতবেত্তা ইতিহাসবিদ ও তাফসীরবিদগণ লিখেছেন যে, এন্টিয়কের সমস্ত অধিবাসী ঈসা (আ)-এর প্রতি ঈমান আনয়ন করে। ঈসা (আ) এন্টিয়াকে তিনজন দুত প্রেরণ করেন। তাদের এক জনের নাম শামউন আস-সাফা। তারা তার আহবানে সাড়া দেয় এবং ঈমান গ্রহণ করে। সূরা ইয়াসীনে যে তিনজন দূতের উল্লেখ আছে, এরা সেই তিনজন নন, আলাদা তিনজন। আসহাবুল কারিয়ার ঘটনায় আমরা এ বিষয়ে আলোচনা ইতিপূর্বে করেছি। বনী ইসরাঈলের অধিকাংশ ইয়াহুদী ঈসা। (আ)-এর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে। পরবর্তীতে আল্লাহ ঈমান গ্রহণকারীদেরকে সাহায্য ও শক্তি দান করেন। ফলে তারা ঈমান প্রত্যাখ্যানকারীদেরকে পযুদস্ত করে এবং তাদের উপর বিজয় লাভ করে। এ প্রসংগে আল্লাহ বলেন, স্মরণ কর, যখন আল্লাহ বললেন, হে ঈসা! আমি তোমার মেয়াদ পূর্ণ করছি এবং আমার নিকট তোমাকে তুলে নিচ্ছি এবং যারা সত্য প্রত্যাখ্যান করেছে তাদের মধ্য হতে তোমাকে মুক্ত করছি। আর তোমার অনুসারীগণকে কিয়ামত পর্যন্ত কাফিরদের উপরে প্রাধান্য দিচ্ছি। (৩ আলে ইমরান : ৫৫) এ আয়াতের আলোকে যে সব দল ও সম্প্রদায় হযরত ঈসা (আ)-এর দীন ও দাওয়াতের অধিক নিকটবতী, তারা তুলনামূলক নিম্নবতীদের উপর বিজয় ও প্রাধান্য লাভ করবে। সুতরাং ঈসা (আ)-এর ব্যাপারে মুসলমানদের বিশ্বাসই যথার্থ যাতে কোন সন্দেহ নেই। আর তা হচ্ছে তিনি আল্লাহর বান্দা ও রাসুল। সুতরাং নাসারাদের (খ্ৰীষ্টানদের) উপর তারা বিজয়ী থাকবেন। কেননা, নাসারাগণ তার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছে তার ব্যাপারে সীমালজান করেছে, এবং আল্লাহ তাকে যে মর্যাদা দিয়েছেন তারা তার চাইতে উর্ধে স্থান দিয়েছে।
যেহেতু মোটামুটিভাবে অভিশপ্ত ইয়াহুদীদের তুলনায় ঈসা (আ)-এর আদর্শের কাছাকাছি অবস্থানে আছে, সে জন্যে তারা ইয়াহুদীদের উপরে বিজয়ী হয়ে ইসলামের পূর্বেও ছিল এবং ইসলামের আবির্ভাবের পরেও রয়েছে। –
আসমানী খােঞ্চার বিবরণ
আল্লাহর বাণী :
স্মরণ কর, হাওয়ারীগণ বলেছিল, হে মারিয়াম-তনয় ঈসা! তোমার প্রতিপালক কি? আমাদের জন্যে আসমান হতে খাদ্য পরিপূর্ণ খািঞ্চ (মায়িদা) প্রেরণ করতে সক্ষম? সে বলেছিল, আল্লাহকে ভয় কর, যদি তোমরা মুমিন হও। তারা বলেছিল, আমরা চাই যে, তা থেকে কিছু খাব এবং আমাদের অন্তর প্রশান্তি লাভ করবে। আর আমরা জানতে চাই যে, তুমি আমাদেরকে সত্য বলেছ এবং আমরা এর সাক্ষী থাকতে চাই। মারিয়াম-তনয় ঈসা বলল, হে আল্লাহ, আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্যে আসমান হতে খাদ্যপূর্ণ খাঞ্চা প্রেরণ করা; এটা আমাদের পূর্ববতী ও পরবর্তী সকলের জন্যে হবে আনন্দােৎসব স্বরূপ ও তোমার নিকট হতে নিদর্শন। এবং আমাদেরকে জীবিকা দান কর; তুমিই তো শ্রেষ্ঠ জীবিকাদাতা। আল্লাহ বললেন, আমিই তোমাদের নিকট এটা প্রেরণ করব; কিন্তু এরপর তোমাদের মধ্যে কেউ কুফরী করলে তাকে এমন শাস্তি দিব, যে শান্তি বিশ্বজগতের অপর কাউকেও দিব না। (মায়িদা : ১১২-১১৫)
তাফসীর গ্রন্থে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আমরা খাঞ্চা অবতারণ প্রসংগে সেই সব হাদীস উল্লেখ করেছি। যা হযরত ইব্ন আব্বাস, সালমান ফারসী, আম্মার ইব্ন ইয়াসির প্রমুখ থেকে বর্ণিত হয়েছে। ঘটনার সারসংক্ষেপ এই; হযরত ঈসা (আ) হাওয়ারীগণকে ত্রিশ দিন সওম পালনের নির্দেশ দেন। তারা ত্রিশ দিন সওম পালন শেষে ঈসা (আ)-এর নিকট আসমান থেকে খাদ্যপূর্ণ খািঞ্চা অবতীর্ণ করার আবদার জানায়। উদ্দেশ্য ছিল— তারা আল্লাহর প্রেরিত এই খাদ্য আহার করবে। তাদের সওম ও দোয়া আল্লাহ। কবুল করেছেন এ ব্যাপারে অন্তরে প্রশান্তি লাভ করবে, সওমের মেয়াদ শেষে সওম ভংগের দিনে ঈদ উৎসব পালন করবে, তাদের পূর্ব পুরুষ ও উত্তর পুরুষ এবং তা ধনী ও দরিদ্র সকলের জন্যে আনন্দের বিষয় হিসেবে গণ্য হবে। ঈসা (আ) এ ব্যাপারে তাদেরকে অনেক উপদেশ দিলেন। তাঁর আশংকা হল, এরা আল্লাহর এ নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে এবং এর শর্তাদি পূরণ করতে সক্ষম হবে না। কিন্তু তারা তাদের আবদার পূরণ না হওয়া পর্যন্ত উপদেশ শুনতে প্রস্তুত হল না। অবশেষে তাদের পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়ে তিনি আল্লাহর নিকট দোয়া করতে প্ৰস্তুত হন। তিনি সালাতে দণ্ডায়মান হলেন। পশম ও চুলের তৈরি কম্বল পরিধান করলেন এবং অবনত মস্তকে কান্নায় বুক ভাসিয়ে দিলেন। তিনি আল্লাহর নিকট কাকুতি-মিনতি করে দোয়া করলেন যেন তাদের প্রার্থতি জিনিস তিনি দিয়ে দেন। আর আল্লাহ আসমান থেকে খাদ্য ভর্তি খাঞ্চা অবতীর্ণ করেন।
মানুষ তাকিয়ে দেখছিল যে, দুটি মেঘের মাঝখান থেকে খাঞ্চাটি ধীরে ধীরে নীচের দিকে নেমে আসছে। খািঞ্চাটি যতই পৃথিবীর নিকটবতী হচ্ছিল ততই ঈসা (আ) বেশী বেশী করে আল্লাহর নিকট দোয়া করছিলেন, হে আল্লাহ! একে তুমি রহমত, বরকত ও শান্তি হিসেবে দান কর। শাস্তি হিসেবে দিও না। খাঞ্চাটি ক্রমান্বয়ে নেমে এসে একেবারে নিকটবতী হয়ে গেল এবং ঈসা (আ)-এর সম্মুখে মাটির উপর থামল। খািঞ্চাটি ছিল রুমাল দিয়ে ঢাকা। ঈসা। (আ) ১৩, ১১11, a111 . বলে রুমালখানা উঠালেন। দেখলেন, তাতে সাতটি মাছ ও সাতটি রুটি আছে। কেউ বলেছেন, এর সাথে সির্ক ছিল। আবার কেউ কেউ বলেছেন, ঐগুলোর সাথে ডালিম এবং ফল ফলাদিও ছিল। উক্ত খাদ্য দ্রব্যগুলো ছিল অত্যন্ত সুগন্ধি। আল্লাহ বলেছিলেন, হও আর তাতেই তা হয়ে গিয়েছিল। তারপর ঈসা (আঃ) তাদেরকে খাওয়ার জন্যে আহবান করেন। তারা বলল, আপনি প্রথমে খাওয়া আরম্ভ করুন তারপরে আমরা খাব। ঈসা (আ) বললেন, এ খাঞ্চার জন্যে তোমরাই প্রথমে আবেদন করেছিলে; কিন্তু প্ৰথমে খেতে তারা কিছুতেই রাজি হল না। হযরত ঈসা (আ) তখন ফকীর, মিসকীন, অভাবগ্ৰস্ত, রোগাক্রান্ত ও পঙ্গুদেরকে খাওয়ার আদেশ দেন। এ জাতীয় লোকদের সংখ্যা ছিল তেরশ। সকলেই তা থেকে খেলো। ফলে দুঃখ-দুৰ্দশা ও রোগ-শোক যার যে সমস্যা ছিল, এই খাদ্যের বরকতে তা থেকে সে নিরাময় লাভ করল। যারা খেতে অস্বীকার করেছিল। তা দেখে তারা খুবই লজ্জিত হল ও অনুশোচনা করতে লাগল। কথিত আছে, এই খাঞ্চা প্রতিদিন একবার করে আসত। লোক এ থেকে তৃপ্তি সহকারে আহার করত। খাদ্য একটুও হ্রাস পেতো না। প্রথম দল যেভাবে আহার করত, শেষের দলও ঐ একইভাবে আহার করত। কথিত আছে, প্রতিদিন সাত হাজার লোক ঐ খাদ্য আহার করত। –
কিছু দিন অতিবাহিত হলে একদিন পর পর খাঞ্চ অবতরণ করত। যেমন সালিহ (আ)-এর উটনীর দুধ একদিন পর পর লোকেরা পান করত। অতঃপর আল্লাহ হযরত ঈসা (আ)-কে আদেশ দেন যে, এখন থেকে খাঞ্চার খাবার শুধুমাত্র দরিদ্র ও দুর্দশাগ্ৰস্ত লোকেরাই আহার করবে। ধনী লোকেরা তা থেকে আহার করতে পারবে না। এই নির্দেশ অনেককেই পীড়া দেয়। মুনাফিকরা এ নিয়ে বিরূপ সমালোচনা করতে শুরু করল। ফলে আসমানী খাঞ্চী সম্পূণরূপে বন্ধ হয়ে গেল এবং সমালোচনাকারীরা শূকরে পরিণত হল।
ইব্ন আবি হাতিম ও ইব্ন জারীর উভয়ে… আম্মার ইব্ন ইয়াসির (রা) থেকে বর্ণনা
করেন। নবী করীম (সা) বলেছেন : রুটি ও গোশতসহ খাঞ্চা আসমান থেকে অবতীর্ণ হয়েছিল এবং বনী ইসরাঈলকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা এর অপব্যবহার করবে না, সঞ্চয় করে রাখবে না ও আগামী দিনের জন্যে ঘরে তুলে নিবে না। কিন্তু তারা এতে খিয়ানত করে সঞ্চয় করে রাখে ও আগামী দিনের জন্যে ঘরে তুলে নেয়। ফলে তাদেরকে বানর ও শূকরে পরিণত করা হয়। ইব্ন জারীর আম্মার (রা) থেকে বিভিন্ন সূত্রে মওকুফব্রুপে এ হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং এটাই সঠিক। হাদীসটি যে সূত্রে মারফুরূপে বৰ্ণিত হয়েছে তা মুনকাতা বা বিভিন্ন সূত্রের হাদীস। হাদীসটির মারফু হওয়া নিশ্চিত হলে এ ব্যাপারে এটি হবে চূড়ান্ত ফয়সালা; কেননা, খাদ্যপূর্ণ খাঞ্চা আদৌ অবতীর্ণ হয়েছিল কি না সে সম্পর্কে আলিমদের মধ্যে মতভেদ আছে। তবে অধিকাংশের মতে তা অবতীর্ণ হয়েছিল। উপরোক্ত হাদীস ও কুরআনের প্রকাশভংগী থেকে তাই বুঝা যায়।
বিশেষ করে এই আয়াত : ২, 1. [4*v%,। (আমি অবশ্যই তা তোমাদের উপর অবতীর্ণ করব।) ইব্ন জারীর দৃঢ়তার সাথে এই মতের পক্ষে প্রমাণাদি উল্লেখ করেছেন। তিনি বিশুদ্ধ সনদে মুজাহিদ ও হাসান বসরীর মতামত উল্লেখ করেছেন। তারা বলেছেন, মায়িদা আন্দীে অবতীর্ণ হয়নি। তারা বলেন, এই আয়াত এরপর তোমাদের মধ্যে কেউ কুফরী করলে তাকে এমন শাস্তি দিব, যে শাস্তি বিশ্বজগতের অপর কাউকেও দিব না। (মায়িদা ৪১১৫) যখন নাযিল হয় তখন বনী-ইসরাঈলরা মায়িদা অবতীর্ণের আবদার প্রত্যাহার করে নেয়। এ কারণেই বলা হয়ে থাকে যে, নাসারগণ মায়িদার ঘটনা সম্পর্কে অবহিত নয় এবং তাদের কিতাবেও এ ঘটনার বাস্তবে কোন উল্লেখ নেই। অথচ এমন একটি ঘটনা বাস্তবে সংঘটিত হলে তার উল্লেখ না থেকে পারে না। তাফসীর গ্রন্থে এ বিষয়ে আমরা বিশদভাবে আলোচনা করেছি। আগ্রহী ব্যক্তি সেখান থেকে দেখে নিতে পারেন।
পরিচ্ছেদ
আবু বকর ইব্ন আবিদ দুনিয়া……বকর ইব্ন আবদিল্লাহ মুযানী থেকে বর্ণনা করেনঃ একদা হাওয়ারীগণ হযরত ঈসা (আ)-কে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। জনৈক ব্যক্তি তাদেরকে বলল, তিনি সমুদ্রের দিকে গিয়েছেন। তারা সন্ধান করতে করতে সমুদ্রের দিকে গেল। সমুদ্রের তীরে গিয়ে দেখেন, তিনি পানির উপর দিয়ে হাঁটছেন। সমুদ্রের তরঙ্গ একবার তাকে উপরে উঠাচ্ছে এবার নীচে নামাচ্ছে। একটি চাদরের অর্ধেক গায়ের উপর দিয়ে রেখেছেন আর বাকী অর্ধেক
মধ্যকার শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিটি বললেন, হে আল্লাহর নবী! আমি কি আপনার নিকট আসব? তিনি বললেন, হ্যাঁ, এস, যখন তিনি এক পা পানিতে রেখে অন্য পা তুলেছেন, আমনি চিৎকার করে উঠেন উহঃ হে আল্লাহর নবী! আমি তো ডুবে গেলাম। ঈসা (আঃ) বললেন, ওহে দুর্বল ঈমানদার! তোমার হাত আমার দিকে বাড়াও। কোন আদম সন্তানের যদি একটা যাব পরিমাণও ঈমান থাকে তাহলে সে পানির উপর দিয়ে হাটতে পারে।
আবু সাঈদ ইবনুল আরাবী… বকর থেকে অনুরূপ ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ইব্ন আবিদ। দুনিয়া… ফুযায়ল ইব্ন ইয়ায থেকে বর্ণনা করেন : জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে ঈসা! আপনি কিসের সাহায্যে পানির উপর দিয়ে হাঁটেন? তিনি বললেন, ঈমান ও ইয়াকীনের বলে। উপস্থিত লোকেরা বলল, আপনি যেমন ইয়াকীন রাখেন, আমরাও তেমনি ইয়াকীন রাখি। ঈসা। বললেন, তাই যদি হয় তা হলে তোমরাও পানির উপর দিয়ে হেঁটে চল। তখন তারা নবী ঈসার সাথে পানির উপর দিয়ে হাঁটা শুরু করল। কিন্তু ঢেউ আসা মাত্রই তারা সকলেই ডুবে গেল। নবী বললেন, তোমাদের কী হল হে? তারা বলল, আমরা ঢেউ দেখে ভীত হয়ে গিয়েছিলাম। নবী বললেন, কত ভাল হত যদি ঢেউ এর মালিককে তোমরা ভয় করতে। অতঃপর তিনি তাদেরকে বের করে আনলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি মাটিতে হাত মেরে এক মুষ্টি মাটি নিলেন। পরে হাত খুললে দেখা গেল এক হাতে স্বর্ণ এবং অন্য হাতে মাটির ঢেলা কিংবা কঙ্কর। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, এ দুহাতের কোনটির বস্তু তোমাদের কাছে প্রিয়তর? তারা বলল, স্বর্ণ। নবী বললেন, আমার নিকট স্বর্ণ ও মাটি উভয়ই সমান। ইতিপূর্বে ইয়াহয়া ইব্ন যাকারিয়া (আঃ)-এর ঘটনায় আমরা উল্লেখ করেছি যে, হযরত ঈসা (আঃ) পশমী বস্ত্ৰ পরিধান করতেন, গাছের পাতা আহার করতেন। তাঁর বসবাসের কোন ঘরবাড়ী ছিল না। পরিবার ছিল না, অর্থ সম্পদ ছিল না এবং আগামী দিনের জন্যে কিছু সঞ্চয় করেও তিনি রাখতেন না। কেউ কেউ বলেছেন, তিনি তাঁর মায়ের সূতা কাটার চরকার আয় থেকে আহার
করতেন।
ইব্ন আসাকির শাবী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ঈসা (আ)-এর সম্মুখে কিয়ামতের আলোচনা করা হলে তিনি চিৎকার করে উঠতেন এবং বলতেন, ইব্ন মারিয়ামের নিকট কিয়ামতের আলাচনা করা হবে। আর তিনি চুপচাপ থাকবেন তা হয় না। আবদুল মালিক ইব্ন সাঈদ ইব্ন বাহর থেকে বর্ণিত : হযরত ঈসা (আঃ) যখন উপদেশ বাণী শুনাতেন তখন তিনি সন্তান হারা মায়ের ন্যায় কান্নাকাটি করতেন। আবদুর রাযযাক জাফর ইব্ন বালকাম থেকে বর্ণনা করেন যে, ঈসা (আঃ) সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে। এরূপ দোয়া করতেন, হে আল্লাহ! আমার যা অপছন্দ তা থেকে আত্মরক্ষা করতে আমি সক্ষম নই; যে কল্যাণ আমি পেতে চাই তা আমার অধিকারে নেই, সব বিষয় রয়েছে অন্যের হাতে, আমি আমার কাজের মধ্যে বন্দী: সুতরাং আমার চেয়ে অসহায় আর কেউ নেই। হে আল্লাহ! আমার শক্রকে হাসিয়ো না এবং আমার কারণে আমার বন্ধুকে কষ্ট দিও না। আমার দীনের মধ্যে সংকট সৃষ্টি করিও না এবং : আমার প্রতি সদয় হবে না। এমন লোককে আমার উপর চাপিয়ে দিও না।
ফুযায়ল ইব্ন ইয়োয, ইউনুস ইব্ন উবায়দ সূত্রে বর্ণনা করেন, হযরত ঈসা (আঃ) বলতেন, যতক্ষণ আমরা দুনিয়ার ভোগ-বিলাস থেকে বিমুখ হতে না পারবো, ততক্ষণ প্রকৃত ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে পারব না। ফুযায়ল আরও বলেছেন, ঈসা (আ) বলতেন, আমি সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করেছি। তাতে আমি দেখেছি যে, যাকে সৃষ্টি করা হয়েছে তার তুলনায় যাকে সৃষ্টি করা হয়নি সে-ই আমার কাছে বেশী ঈর্ষণীয়। ইসহাক ইব্ন বিশর. হাসান (র) সূত্রে বর্ণনা করেন, কিয়ামতের দিন হযরত ঈসা (আ) হবেন সংসার-বিমুখদের নেতা! তিনি আরও বলেছেন : কিয়ামতের দিন পাপ থেকে পলায়নকারী লোকদের হাশর হবে ঈসা। (আ)-এর সাথে।
রাবী আরও বলেন : একদিন হযরত ঈসা (আ) একটি পাথরের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়েন। তিনি গভীর নিদ্ৰায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। এমন সময় ঐ স্থান দিয়ে ইবলিস যাচ্ছিল। সে বলল, ওহে ঈসা! তুমি কি বলে থাক না যে, দুনিয়ার কোন বস্তুর প্রতি তোমার আগ্রহ নেই? কিন্তু এই পাথরটি তো দুনিয়ার বস্তু। তখন হযরত ঈসা (আ) পাথরটি ধরে তার দিকে ছুড়ে মারলেন এবং বললেন, দুনিয়ার সাথে এটিও তুই নিয়ে যা। মুতামির ইব্ন সুলায়মান বলেন, একদা হযরত ঈসা (আঃ) তাঁর শিষ্যদের সাথে নিয়ে বের হন। তাঁর পরিধানে ছিল পশমের জুব্বা, চাদর ও অন্তর্বাস। তাঁর পায়ে কোন জুতা ছিল না। তিনি ছিলেন ক্ৰন্দনরত। তার মাথার চুল ছিল এলোমেলো! ক্ষুধার তীব্রতায় চেহারা ছিল ফ্যাকাশে। পিপাসায় ঠোঁট দুটি শুষ্ক। এ অবস্থায় তিনি বনী ইসরাঈলের লোকদেরকে সালাম দিয়ে বললেন : আল্লাহর মেহেরবানীতে আমি দুনিয়াকে তারা সঠিক অবস্থানে রেখেছি। এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই এবং এর জন্যে আমার গৌরবেরও কিছু নেই। তোমরা কি জান, আমার ঘর কোথায়? তারা বলল, হে রুহুল্লাহ! কোথায় আপনার ঘর? তিনি বললেন, আমার ঘর হল মসজিদ, পানি দিয়েই আমার অঙ্গসজ্জা। ক্ষুধাই আমার ব্যঞ্জন। রাতের চাঁদ আমার বাতি, শীতকালে আমার সালাত পূবাঁচল, শাক-সজিই আমার জীবিকা, মোটা পশমই আমার পোষাক। আল্লাহর ভয়ই আমার পরিচিতি, পঙ্গু ও নিঃস্বরা আমার সঙ্গী-সাথী। আমি যখন সকালে উঠি তখন আমার হাত শূন্য, যখন সন্ধ্যা হয় তখনও আমার হাতে কিছু থাকে না। এতে আমি সন্তুষ্ট ও তৃপ্ত এবং নিরুদ্বিগ্ন। সুতরাং আমার চাইতে ধনী ও সচ্ছল। আর কে আছে? বৰ্ণনাটি ইব্ন আসাকিরের।
আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে তিনি বর্ণনা করেছেন : রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, আল্লাহ হযরত ঈসার নিকট এই মর্মে ওহী পাঠান যে, তোমাকে শত্রুরা যাতে চিনতে ও কষ্ট দিতে না পারে সে জন্যে তুমি সর্বদা স্থান পরিবর্তন করতে থাকবে। আমার সন্ত্রম ও প্রতিপত্তির কসম, আমি তোমাকে এক হাজার হুরের সাথে বিবাহ দিব এবং চারশ বছর যাবত ওলীমা খাওয়াব। এ হাদীসটি গরীব পর্যায়ের। এটা একটি ইসরাঈলী বৰ্ণনা। আবদুল্লাহ ইব্ন মুবারক, খালফ ইব্ন হাওশব থেকে বর্ণনা করেন, হযরত ঈসা (আ) হাওয়ারীদেরকে বলেছিলেন, রাজা-বাদশাহরা যেমন দীন ও হিকমত তোমাদের জন্যে ছেড়ে দিয়েছে, তোমরাও তেমন তাদের জন্যে দুনিয়া ছেড়ে দাও। কাতাদা বর্ণনা করেন, ঈসা (আ) বলেছিলেন : তোমরা আমার নিকট প্রশ্ন কর।
উমর (রা) থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা (আ) হাওয়ারীদেরকে বলেছিলেন : যবের রুটি আহার কর, খালিস পানি পান কর এবং দুনিয়া থেকে শান্তি ও নিরাপদের সাথে বের হয়ে যাও। আমি তোমাদেরকে নিগৃঢ় তত্ত্বকথা জানাচ্ছি যে, দুনিয়ায় যা সুস্বাদু, আখিরাতে তা বিস্বাদ আর দুনিয়ায় যা বিস্বাদ আখিরাতে তা-ই সুস্বাদু। আল্লাহর প্রকৃত বান্দারা দুনিয়ায় ভোগ বিলাসের জীবন যাপন করতে পারে না। তোমাদেরকে আমি সঠিক বলছি যে, তোমাদের মাঝে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি হচ্ছে সেই লোক, যে জ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং চায় যে, সকলেই যেন তার মত হয়।
আবু হুরায়রা (রা) থেকেও অনুরূপ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আবু মুসআব মালিকা থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা (আ) বনী ইসরাঈলদেরকে বলতেন : খালিস পানি পান কর, তাজা সক্তি খাও এবং যবের রুটি আহার কর। গমের রুটি খেয়ো না যেন। কেননা তোমরা এর শোকর আদায় করতে পারবে না। ইব্ন ওহাব … ইয়াহয়া ইব্ন সাঈদ থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা (আ) বলতেন : তোমরা দুনিয়া অতিক্রম করে যাও। একে আবাদ করো না। তিনি বলতেন : দুনিয়ার মহব্বত সকল গুনাহের মূল এবং কুদৃষ্টি অন্তরের মধ্যে কাম-ভােব উৎপন্ন করে। উহায়ব ইব্ন ওয়ারদও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। তবে তার বর্ণনায় এইটুকু বেশী আছে যে, কামনা-বাসনা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষকে দীর্ঘস্থায়ী দুঃখে ফেলে। ঈসা (আ) বলতেন, হে দুর্বল আদম-সন্তান! যেখানেই থাক। আল্লাহকে ভয় কর, দুনিয়ায় মেহমান হিসেবে জীবন যাপন কর। মসজিদকে নিজের ঘর বানাও। চক্ষুদ্বয়কে কাঁদতে শিখাও, দেহকে ধৈর্যধারণ করতে ও অন্তরকে চিন্তা করতে অভ্যস্ত কর। আগামী দিনের খাদ্যের জন্যে দুশ্চিন্তা করো না এটা পাপ। তিনি বলতেন, সমুদ্রের তরঙ্গের উপরে ঘর বানান যেমন সম্ভব নয় তেমনি দুনিয়ায় স্থায়ীভাবে থাকাও সম্ভব নয়। কবি সাবিকুল বরাবরী এ প্রসংগে সুন্দর কথা বলেছেন যথাঃ
অর্থাৎ তলোয়ারের পথেই তোমাদের ঘর শোভা পায়। যে ঘরের ভিত্তি মাটির উপরে, তা কি পানির উপরে বানানো সম্ভব?
সুফিয়ান ছাওরী বলেন, ঈসা (আঃ) বলেছেন : মুমিনের অন্তরে দুনিয়ার মহব্বত ও আখিরাতের মহব্ববত একত্রে থাকতে পারে না- যেভাবে একত্রে থাকতে পারে না একই পাত্রে আগুন ও পানি। ইবরাহীম হারবী… আবু আবদুল্লাহ সূফী সূত্রে বলেন, ঈসা (আ) বলেছেন : দুনিয়া অন্বেষণকারী লোক সমুদ্রের পানি পানকারীর সাথে তুলনীয়। সমুদ্রের পানি যত বেশী পান করবে তত বেশী পিপাসা বৃদ্ধি পাবে এবং তা তাকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেবে। ঈসা (আ) বলেছেন : শয়তান দুনিয়া অন্বেষণ ও কামনাকে আকর্ষণীয় করে এবং প্রবৃত্তির লালসার সময় শক্তি যোগায়।
আমাশ খায়ছমা থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা (আ) সংগী-সাথীদের সামনে আহার্য রেখে নিজে আহার থেকে বিরত থাকতেন এবং বলতেন, মেহমানদের সাথে তোমরাও এইরূপ আচরণ করবে। জনৈক মহিলা ঈসা (আঃ)-কে বলেছিল, ধন্য সেই লোক, যে আপনাকে ধারণ করেছিল এবং ধন্য সেই স্থান যে আপনাকে দুধ পান করিয়েছিল। উত্তরে ঈসা (আঃ) বলেছিলেন, ধন্য সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহর কিতাব পাঠ করে ও তার বিধান মেনে চলে। ঈসা (আঃ) আরও বলেছেন, সেই ব্যক্তিই সৌভাগ্যের অধিকারী যে নিজের গুনাহ স্মরণ করে কান্নাকাটি করে, জিহবাকে সংযত রাখে এবং যার ঘরই তার জন্য যথেষ্ট হয়। তিনি বলেছেন, ঐ চক্ষুর জন্যে সুসংবাদ, যে গুনাহ থেকে চিন্তামুক্ত অবস্থায় ঘুমিয়ে যায় এবং জেগে উঠে গুনাহ বিহীন কাজে মনোনিবেশ করে। মালিক ইব্ন দীনার থেকে বর্ণিত। ঈসা (আ) আপন শিষ্যবর্গের সাথে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথে একটি মৃত দেহ দেখতে পেলেন। শিষ্যরা বলল, মৃত দেহ থেকে তীব্র দুৰ্গন্ধ বের হচ্ছে। ঈসা (আ) বললেন, তার দাঁতগুলো কত সাদা। এ কথা বলে তিনি শিষ্যদেরকে গীবত করা থেকে বিরত থাকার উপদেশ দিচ্ছিলেন। আবু বকর ইব্ন আবিদ দুনিয়া… যাকারিয়া ইব্ন আব্দী সূত্রে বর্ণনা করেন। একদা ঈসা (আ) ইব্ন মারিয়াম বললেন, হে হাওয়ারীগণ! দীন নিরাপদ থাকলে দুনিয়ার নিম্নমান নিয়েই সন্তুষ্ট থাক; যেমন দুনিয়াদার ব্যক্তিরা দুনিয়ার জীবন নিরাপদ থাকলে দীনের নিম্নমান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে। এ প্রসংগে কবি বলেন :
আমি লক্ষ্য করেছি, এক শ্রেণীর লোক আছে যাদের মধ্যে দীন কম থাকলেও তাতেই তারা সন্তুষ্ট। কিন্তু দুনিয়ার সংকীর্ণতায় তারা রাজী নয়। সুতরাং রাজা বাদশাহদের দুনিয়া থেকে বিমুখ হয়ে দীন নিয়েই তুমি সন্তুষ্ট থাক, যেমন রাজা বাদশাহরা দীন থেকে বিমুখ হয়ে দুনিয়া পেয়ে সন্তুষ্ট থাকে।
আবু মাসআব মালিক থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা ইব্ন মারিয়াম বলেছেন : আল্লাহর যিকির ব্যতীত কথাবার্তা বেশী বল না; অন্যথায় তোমাদের অন্তর কঠিন হয়ে যাবে। আর কঠিন অন্তর আল্লাহ থেকে দূরে থাকে, কিন্তু তোমরা সে বিষয়ে অবগত নও। মানুষের গুনাহের প্রতি এমনভাবে দৃষ্টি দিও না, যেন তুমিই প্ৰভু বরং নিজেকে দাসের ভূমিকায় রেখে সে দিকে লক্ষ্য কর। কেননা, মানুষ দুই শ্রেণীর হয়ে থাকে। কেউ বিপদ থেকে মুক্ত, কেউ বিপদগ্ৰস্ত। বিপদগ্রস্তের প্রতি সদয় হও এবং বিপদমুক্তের জন্যে আল্লাহর প্রশংসা কর। ছাওরী…… ইবরাহীম তায়মী সূত্রে বর্ণনা করেন, ঈসা (আঃ) তার সাথীদেরকে বলেছেন, আমি তোমাদেরকে যথাৰ্থ বলছি, যে ব্যক্তি ফিরদাউস আশা করেন তার উচিত যবের রুটি আহার করা এবং আবর্জনা স্তুপের মধ্যে কুকুরদের সাথে বেশী বেশী ঘুমান। মালিক ইব্ন দীনার বলেন, ঈসা। (আ) বলেছেন, ছাইযুক্ত যাব আহার করা এবং আবর্জনার উপরে কুকুরের সাথে ঘুমানোর অভ্যাস ফিরদাউস প্রত্যাশীদের মধ্যে খুব কমই দেখা যাচ্ছে।
আবদুল্লাহ ইব্ন মুবারক…… সালিম ইব্ন আবিল জাদ সূত্রে বর্ণনা করেন। হযরত ঈসা। (আঃ) বলেছেন : তোমরা কাজ করা আল্লাহর জন্যে, পেটের জন্যে নয়। পাখীদের প্রতি লক্ষ্য কর, তারা সকালে বের হয়। সন্ধ্যায় ফিরে তারা চাষাবাদও করে না, ফসলও ফলায় না; আল্লাহ-ই তাদেরকে খাওয়ান। যদি বল যে, পাখীদের চেয়ে আমাদের পেট বড়। তা হলে গরু ও গাধার দিকে তাকাও ৷ সকালে যায়, সন্ধ্যায় ফিরে আসে। এরাও না ক্ষেত করে, না ফসল ফলায়; আল্লাহ-ই এদেরকে রিযিক দান করেন। সাফওয়ান ইব্ন আমার…ইয়াখীদ ইব্ন মায়সারা থেকে বর্ণনা করেন, একদা হাওয়ারীগণ ঈসা (আ)-কে বললেন, হে মাসীহুল্লাহ! দেখুন, আল্লাহর মসজিদ কতই না। সুন্দর। মাসীহ বললেন, ঠিক ঠিক, তবে আমি তোমাদেরকে যথার্থ জানাচ্ছি, আল্লাহ এ মসজিদের পাথরগুলোকে স্থায়ীভাবে দণ্ডায়মান রাখবেন না। বরং তার সাথে সংশ্লিষ্টদের গুনাহের কারণে ধ্বংস করে দিবেন। তোমাদের স্বর্ণ-রৌপ্য ও পছন্দনীয় ধন-সম্পদ দিয়ে আল্লাহর কোন কোজ নেই। এই দুনিয়ায় আল্লাহর নিকট প্রিয় বস্তু হচ্ছে সৎ অন্তর। এর সাহায্যেই আল্লাহ দুনিয়াকে আবাদ রেখেছেন এবং এর জন্য তিনি দুনিয়া ধ্বংস করে দিবেন, যখন তা পরিবর্তিত হয়ে যাবে।
ইব্ন আসাকির তার ইতিহাস গ্রন্থে মুজাহিদের সূত্রে ইব্ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, নবী আকরম (সা) বলেছেন : একদা হযরত ঈসা (আ) একটি ধ্বংসপ্ৰাপ্ত শহরের উপর দিয়ে যাচ্ছিলেন। শহরের বিধ্বস্ত প্রাসাদ।রাজি দেখে তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। কিছু সময় পর তিনি আল্লাহর নিকট আবেদন করেন, হে আল্লাহ! এই শহরকে আমার কতিপয় প্রশ্নের উত্তর দেয়ার অনুমতি দিন। আল্লাহ তাআলা বিধ্বস্ত শহরটিকে ঈসার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার নির্দেশ প্ৰদান করেন। তখন শহরটি ঈসা (আ)-কে ডেকে বলল, হে প্রিয় নবী ঈসা। (আ)! আপনি আমার নিকট কী জানতে চান? ঈসা (আ) বললেন, তোমার বৃক্ষরাজি কোথায় গেল? তোমার নদী-নালার কী হলো? তোমার প্রাসাদ-রাজির কী অবস্থা? তোমার বাসিন্দারা কোথায় গেল? উত্তরে শহর বলল, হে প্ৰিয় নবী! আল্লাহর ওয়াদা কার্যকরী হয়েছে। তাই আমার বৃক্ষরাজি শুকিয়ে গিয়েছে, নদী-নালা পানিশূন্য হয়ে গিয়েছে, প্রাসাদ।রাজি ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়েছে এবং আমার বাসিন্দারা সবাই মারা গিয়েছে। ঈসা (আঃ) বললেন, তবে তাদের ধন-সম্পদ কোথায়? শহরটি উত্তর দিল, তারা হালাল ও হারাম পন্থায় নির্বিচারে সম্পদ সঞ্চয় করেছিল, সে সবই আমার অভ্যন্তরে রক্ষিত আছে। আসমান ও যমীনের সব কিছুর সত্ত্বাধিকারী তো আল্লাহই।
অতঃপর ঈসা (আঃ) বললেন : তিন ব্যক্তির ব্যাপারে আমার অবাক লাগে। তারা হল (১) যে ব্যক্তি দুনিয়ার সন্ধানে মত্ত। অথচ মৃত্যু তার পশ্চাতে লেগে আছে (২) যে ব্যক্তি প্রাসাদ নির্মাণ করছে; অথচ কবর তার ঠিকানা; (৩) যে ব্যক্তি অট্টহাসিতে মজে থাকে, অথচ তার সম্মুখে আগুন। আদম-সন্তানের অবস্থা এই যে, অধিক পেয়েও সে তৃপ্ত হয় না; আর কম। পেলেও তুষ্ট থাকে না। হে আদম সন্তান! তুমি তোমার ধন-সম্পদ এমন লোকদের জন্যে সঞ্চয় করে রেখে যোচ্ছ, যারা তোমার প্রশংসা করবে না। তুমি এমন প্রভুর পানে এগিয়ে চলছ, যিনি তোমার কোন ওযর শুনবেন না। তুমি তো তোমার পেট ও প্রবৃত্তির গােলাম হয়ে রয়েছে। কিন্তু তোমার পেট সেই দিন পূর্ণ হবে, যে দিন তুমি কবরে প্রবেশ করবে। হে আদম-সন্তান! অচিরেই তুমি কবরে প্রবশ করবে। হে আদম সন্তান! অচিরেই তুমি দেখতে পাবে, তোমার সঞ্চিত ধন-রত্ন অন্যের পাল্লাকে ভারী করছে। এ হাদীসটি সনদের বিচারে খুবই গরীব পর্যায়ের। কিন্তু উত্তম উপদেশপূর্ণ হওয়ায় উল্লেখিত হলো।
সুফিয়ান ছাওরী ইবরাহীম তায়মী সূত্রে বর্ণনা করেন, ঈসা (আঃ) বলেন : হে হাওয়ারীগণ! তোমরা তোমাদের মূল্যরান সম্পদ আসমানে রােখ। কেননা, মানুষের অন্তর সেই দিকেই আকৃষ্ট থাকে, যেখানে তার মূল্যবান সম্পদ সঞ্চিত থাকে। ছাওর ইব্ন ইয়ায়ীদ আবদুল আষীয ইব্ন যুবয়ান থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা ইব্ন মারিয়াম থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা ইব্ন মারিয়াম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি ইলম শিখে অন্যকে শিখায় এবং সে মতে আমল করে, উর্ধজগতে তাকে বিরাট সম্মানে ভূষিত করা হয়। আবু কুরায়ব বলেন, বর্ণিত আছে, হযরত ঈসা (আঃ) বলেছেন : যেই ইলম তোমাকে কাজের ময্যদানে নিয়ে যায় না, কেবল মজলিস মাহফিলে নিয়ে যায়, তাতে কোন কল্যাণ নেই। ইব্ন আসাকির এক গরীব সনদে ইব্ন আব্বাস থেকে মারফু হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, ঈসা (আ) বনী ইসরাঈলদের মাঝে গিয়ে এক ভাষণে বলেন : হে হাওয়ারীগণ! অযোগ্য লোকদের নিকট হিকমতের কথা বলিও না। এরূপ করলে হিকমত ও প্রজ্ঞাকে হেয় করা হবে। কিন্তু যোগ্য লোকদের নিকট তা বলতে কৃপণতা কর না। তা হলে তাদের উপর অবিচার করা হবে। যে কোন বিষয়ের তিনটি অবস্থা হতে পারে (১) যার উত্তম হওয়া স্পষ্ট; এগুলোর অনুসরণ করা। (২) যার মন্দ হওয়া স্পষ্ট; এর থেকে দূরে থাক; (৩) যার ভাল বা মন্দ হওয়া সন্দেহযুক্ত; তার ফয়সালা আল্লাহর উপর ছেড়ে দাও। আবদুর রাযযাক ….ইকরিমা থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা (আঃ) বলেছেন শূকরের কাছে মুক্তা ছড়ায়ো না। কেননা মুক্তা দিয়ে সে কিছুই করতে পারে না, আর জ্ঞানপূর্ণ কথা ঐ ব্যক্তিকে বলো না, যে তা শুনতে চায় না। কেননা জ্ঞানপূর্ণ কথা মুক্তার চাইতেও মূল্যবান আর যে তা চায় না, সে শূকরের চাইতেও অধম। ওহাব প্রমুখ রাবী ইকরিম থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
ইকরিম আরও বর্ণনা করেন, ঈসা (আ) হাওয়ারীদেরকে বলেছেনঃ তোমরা হচ্ছে পৃথিবীতে লবণ তুল্য। যদি নষ্ট হয়ে যাও তবে তোমাদের জন্য কোন ঔষধ নেই। তোমাদের মধ্যে মূর্খতার দুটি অভ্যাস আছে (১) বিনা কারণে হাসা এবং (২) রাত্রি জাগরণ না করে সকালে উঠা। ইকরিম থেকে বর্ণিত, ঈসা (আ)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়, কোন ব্যক্তির ফিৎনা সবচাইতে মারাত্মক? তিনি বললেনঃ আলিমের পদস্থলন। কেননা আলিমের পদস্থলনে আরও বহু লোক বিপথগামী হয়ে যায়। রাবী আরও বলেন, হযরত ঈসা (আঃ) বলেছেনঃ হে জ্ঞান পাপীরা! দুনিয়াকে তোমরা মাথার উপরে রেখেছ, আর আখিরাতকে রেখেছ পায়ের নীচে। তোমাদের কথাবার্তা যেন সৰ্বরোগের নিরাময় হয়। কিন্তু তোমাদের কার্যকলাপ হচ্ছে মহাব্যাধি। তোমাদের উপমা হচ্ছে সেই মাকাল গাছ যা দেখলে মানুষ আকৃষ্ট হয়। কিন্তু তার ফল খেলে মারা যায়। ওহাব থেকে বর্ণিত, ঈসা (আঃ) বলেছেনঃ হে নিকৃষ্ট জ্ঞান পাপীরা! তোমরা জান্নাতের দরজায় বসে আছ, কিন্তু তাতে প্ৰবেশ করছে না। আর নিঃস্বদেরকে তাতে প্ৰবেশ করার জন্যে আহবানও করছ না। আল্লাহর নিকট সর্বাধিক নিকৃষ্ট মানুষ সেই জ্ঞানী ব্যক্তি, যে তার জ্ঞানের বিনিময়ে দুনিয়া অর্জন করে। মাকতুল বর্ণনা করেন, একবার ঈসার সাথে ইয়াইয়া (আ)-এর সাক্ষাত হয়। ঈসা (আ) হাসিমুখে তার সাথে মুসাফাহা করেন। ইয়াহয়া (আ) বললেন, কি খালাত ভাই! হাসছেন যে, মনে হচ্ছে আপনি নিরাপদ হয়ে গেছেন? ঈসা (আ) বললেন, তোমাকে বিষন্ন দেখাচ্ছে কেন, নৈরাশ্যে ভুগছি না কি? তখন আল্লাহ উভয়ের নিকট ওহী প্রেরণ করে জানালেন, তোমাদের দুজনের মধ্যে সে-ই আমার নিকট প্রিয়তর, যে তার সঙ্গীর সাথে অধিকতর হাসিমুখে মিলিত হয়।
ওহাব ইব্ন মুনাববিহ বৰ্ণনা করেছেন, একদা হযরত ঈসা ও তার সংগীরা একটি কবরের পাশে থামলেন। ঐ কবরবাসী সংকটপূৰ্ণ অবস্থায় ছিল। তখন সংগীরা কবরের সংকীর্ণতা নিয়ে আলাপ করতে লাগলেন। তাদের কথা শুনে ঈসা (আ) বললেনঃ তোমরা মায়ের পেটে এর চেয়ে সংকীর্ণ স্থানে ছিলে। তারপরে আল্লাহ যখন চাইলেন প্রশস্ত জায়গায় নিয়ে আসলেন। আবু উমর বলেন, ঈসা (আঃ) যখন মৃত্যুর কথা আলোচনা করতেন, তখন তার চামড়া ভেদ করে রক্ত ঝরে পড়ত। হযরত ঈসা (আ)-এর থেকে এ জাতীয় অনেক উক্তি বর্ণিত আছে। হাফিজ ইব্ন আসাকির তাঁর গ্রন্থে বহু উক্তি উদ্ধৃত করেছেন। আমরা এখানে সংক্ষিপ্তভাবে কিছু উল্লেখ করলাম।