১৪. হঠাৎ বৃষ্টি

মাঝরাত্রে হঠাৎ করে বৃষ্টি নামল। জহুর বিছানা টেনেটুনে এক পাশে নিয়ে এল। তাতেও শেষরক্ষা হল না। তোষকের অনেকখানি ভিজে চুপসে গেল। মশারি উড়তে লাগল নৌকার পালের মত। বাড়ির লোকজনদের না জাগিয়ে ভেতরে ঢোকার উপায় নেই। জহুরের কাউকে ডাকতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। যেরকম বাতাস হচ্ছে, এমনিতেই কারো-না-কারো ঘুম ভাঙবে।

ঘুম অবশ্যি ভাল না। জহুর পা গুটিয়ে বেঞ্চির উপর বসে বৃষ্টি দেখতে লাগল। তার সিগারেট রাবার ইচ্ছা করছিল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে আগুনের স্পর্শের জন্যে মন কাঁদে। সিগারেট নেই, শেষ সিগারেটটি ঘুমাবার আগে ধরিয়েছে। এরকম একটি ঝড়-বাদলের রাত একা-একা জেগে কাটান কষ্টকর। জহুরের শীত লাগছিল। গায়ে দেবার কিছু নেই। চারটি ভিজে ন্যাতান্যাতা।

মামা।

জহুর চমকে উঠে দেখল কোনো রকম শব্দ না করে অঞ্জু দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। বাতাসে তার লম্বা চুল উড়ছে। অজুর চুল যে এত লম্বা, সে আগে লক্ষ করে নি। জহুর বলল, ভালো বর্ষণ শুরু হয়েছে, দেখলি?

তুমি ডাকলে না কেন আমাদের?

তোরা নিজে থেকে উঠবি, তাই ভেবে ডাকি নি।

অঞ্জু ভারি স্বরে বলল, তুমি এমন ভাব কর, যেন তুমি বেড়াতে এসেছ আমাদের এখানে।

জহুর জবাব দিল না। অঞ্জু বলল, ছোটমার সঙ্গেও তুমি বেশি কথা বল না। শুধু হাঁ-হুঁ কর। ছোটমার ধারণা তুমি তাকে দেখতে পার না।

দেখতে পারব না কেন?

অঞ্জু বেঞ্চির এক পাশে বসল। জহুর বলল, বসলি কেন? ঘুমাতে যা।

তোমার সঙ্গে বসে বসে একটু বৃষ্টি দেখি।

ঘরের ভেতরে বাবলু জেগে উঠে চেঁচাতে শুরু করেছে। দবির মিয়া চাপা গলায় কী একটা বলল। বাবলুর চিৎকার আরো তীক্ষ্ণ ও তীব্র হল। প্ৰচণ্ড একটা চড় কল দবির মিয়া। মুহূর্তে সব চিৎকার-চেঁচামেচি থেমে গেল। শুনশান নীরবতা। জহুর বলল, ঘুমাতে যা।

আরেকটু বসি।

দুলাভাইয়ের সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট এনে দে।

অঞ্জু উঠে চলে গেল। সিগারেট নিয়ে চলে এল সঙ্গে সঙ্গে। তার পিছে পিছে এল বাবলু। জহুর অবাক হয়ে বলল, কি রে বাবলু? কী হয়েছে?

ঘুম আসে না, ভয় লাগে।

ভয়ের কী আছে?

বাবলু উত্তর না দিয়ে বয়স্ক লোকের মতত গম্ভীর হয়ে বসল বেঞ্চিতে। জহুর হাসিমুখে বলল, বাবলু, বৃষ্টিতে ভিজে যাবি।

বাবলু সে কথার উত্তর দিল না। সে খুবই স্বল্পভাষী।

অঞ্জু বলল, টুনী আপার বিয়েটা ভেঙে গেছে, তুমি শুনেছ নাকি মামা?

না তো! কী জন্যে ভাঙল?

তা জানি না। বাবা তো কাউকে কিছু বলে না।

বৃষ্টির বেগ খুবই বাড়ল। জহুর দেখল, বাবলু ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। অঞ্জু ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, মেয়ে হয়ে জলে খুব মুশকিল।

মুশকিল কেন?

অঞ্জু জবাব দিল না।

বাবলুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়।

অঞ্জু উঠে বাবলুকে কোলে নিয়ে বসল। হালকা গলায় বলল, টুনী আপা আজ সারা দুপুর কেঁদেছে।

কেন? আমি তো জানতাম ছেলে তার পছন্দ হয় নি।

তা হয় নি।

তবে কান্নাকাটি কি জন্যে?

অঞ্জু জবাব দিল না। প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল। বাতাসের বেগ বাড়তে লাগল। অঞ্জু অস্পষ্ট সুরে বলল, মামা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

কী কথা?

তুমি নাকি বলেছিলে, জেল থেকে ফিরে এসে চৌধুরী সাহেবকে খুন করবে?

মনে নেই, বলতে পারি।

সত্যি সত্যি করবে না নিশ্চয়ই

জহুর জবাব না দিয়ে সিগারেট ধরাল। ঘরের মধ্যে এবার বাহাদুরের চিৎকার এবং দবির মিয়ার গর্জন শোনা যেতে লাগল, হারামজাদাদের যন্ত্রণায় শান্তিতে ঘুমানব উপায় নাই। সব কটাকে কচুকাটা করা দরকার।

মামা।

উঁ।

তুমি নাকি বদি চাচার বাসায় গিয়েছিলে?

জহুর খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কার কাছ থেকে শুনলি?

বাবা বলছিল ছোটমাকে। আড়াল থেকে শুনে ফেললাম।

জহুর চুপ করে গেল।

গিয়েছিলে নাকি মামা?

হুঁ।

ওদের ছেলেটাকে দেখেছ? খুব সুন্দর না?

খুব কিন্তু পাজি। দেখলে বোঝা যায় না। বিন্দু একেবারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *