১৪. সেলিম ভাইয়ের একটা দৃশ্য

সেলিম ভাইয়ের একটা দৃশ্য দিয়ে শুটিং শুরু হবে।

গাছের নীচে বসে তিনি ক্যামেরার লেন্স পরিষ্কার করবেন। গ্রামের একটা ছেলে কৌতূহলী হয়ে দৃশ্যটা দেখবে। ছেলেটির দিকে না তাকিয়েই তিনি বলবেন— ছবি তুলবি? ছেলেটা না সূচক মাথা নাড়বে। তখন দূর থেকে দিলুর গলা শোনা যাবে। দিলু চেঁচিয়ে বলবে–আমার একটা ছবি তুলে দিন। আমার ছবি। সেলিম ভাই দিলুর দিকে তাকিয়ে হাসবেন। দিলু এসে দাঁড়াবে। তার ছবি তোলা হবে। তখন দিলু বলবে–এখন এই পিচ্চিটার পাশে একটা ছবি তুলব। বলেই সে ছেলেটার সঙ্গে দাড়িয়ে ছবি তুলবে। তারপর তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে ছুটে যাবে পুকুর ঘাটের দিকে। পুকুরের বাঁধানো ঘাটে তখন জামিল বসে আছেন। তাঁর হাতে একটা বই। পেঙ্গুইন পেপার ব্যাক। দিলু এসে জামিলের পাশে বসবে এবং বলবে, জামিল ভাই আমি আপনার সঙ্গে একটা ছবি তুলব। সেলিম ভাই ছবি তুলে দেবেন। জামিল বলবেন–যা ভাগ। দিলু আহত চোখে তাকিয়ে থাকবে জামিলের দিকে। জামিল তার আহত অভিমানী দৃষ্টি বুঝতে পারবেন না কারণ তিনি বই থেকে একবারও চোখ তোলেন নি। জামিল তখন বলবেন— দিলু যা তো কাউকে বল, আমাকে যেন কড়া করে এক কাপ চা দেয়। চিনি হাফ চামচ। দিলু উঠে দাঁড়াবে। তারপর একটা কান্ড করবে— জামিলের হাত থেকে বইটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে মারবে পুকুরের দিকে। বই ছুঁড়ে ফেলেই দিলু ছুটে চলে যাচ্ছে। জামিল হতভম্ব। বইটা পুকুরের পানিতে ভাসছে। জামিল একবার তাকাচ্ছেন বইটার দিকে, একবার দিলুর দিকে। দিলুর ছুটে যাবার ব্যাপারটা সেলিমও দেখছেন। তিনি ক্যামেরা তুলে দিলুর ছুটে যাবার দৃশ্য নিয়ে নিলেন। শাটার টিপতেই ফ্রেমে বন্দি হল দিলু। সিকোয়েন্সের এইখানেই সমাপ্তি।

কাজ শুরু হচ্ছে না। তিথিকণার মেকাপ শেষ হয় নি। সে এসে পৌছায় নি। সর্পভুক সেলিম ভাই এসেছেন। তার গাল টাল ভেঙ্গে একাকার। শরীর মনে হয় পুরোপুরি সারে নি। কেমন উদভ্রান্ত দৃষ্টি। আমার দিকে যতবার চোখ পড়ছেচোখ ঝট করে ফিরিয়ে নিচ্ছেন। কারণ বোঝা যাচ্ছে না। ডিরেক্টর সাহেব জাম গাছের নীচে বসে আছেন। তার পায়ের কাছে টুল। টুলে পা তোলা। বসার ভঙ্গি বেশ আয়েশী। সিগারেট টানছেন। সিগারেট টানতে টানতে গল্প করছেন। শ্রেতা মওলানা সাহেব। মওলানা গভীর আগ্রহে কথা শুনছেন। নিশ্চয়ই ধর্ম সংক্রান্ত কোন কথা।

সেলিম ভাই যে জায়গায় তার কাজ হবে ঠিক সেই জায়গাতেই বসা। তার পাশেই পিচ্চি ছেলেটা বসে আছে। ছেলেটাকে এখান থেকে নেয়া হয়েছে। গারো ছেলে। নাক চ্যাপ্টা বলে অন্য রকম সুন্দর। গায়ের রং ধবধবে শাদা। গারোদের মধ্যে কালো কম। সেলিম ভাই ছেলেটির সঙ্গে কথা বলছেন। ছেলেটা কথা বলছে না, শুধু শুনে যাচ্ছে। তাদের কারো কথাই আমি শুনতে পাচ্ছি না। আমার কান খুব পরিষ্কার। অন্য সময় হলে তাদের কথা শুনতে পেতাম–আজ পাচ্ছি না। আজ আমার মন অন্য রকম হয়ে আছে। সেই অন্য রকমটা কী নিজেও বুঝতে পারছি না।

পাপিয়া ম্যাডাম তাঁর মেয়ের সঙ্গে কী একটা খেলা খেলছেন। কোন ইলেকট্রনিক গেম হবে। লুডু বোর্ডের মত বোর্ড। সাপ এবং মইয়ের ছবি আছে। তবে কৌটায় ছক্কা নিয়ে চলতে হয় না। চালার বদলে বোতাম টিপতে হয়। বোতাম টিপলেই শুরুতে মেরী হ্যান্ড আ লিটল ল্যাম্বের বাজনা বাজে তারপর এক থেকে ছয়ের ভেতর একটা সংখ্যা ভেসে ওঠে।

বোতাম টেপার ফাঁকে ফাঁকে পাপিয়া ম্যাডাম আমার সঙ্গে কথা বলছেন। খুব সাধারণ কথা। কথা বলতে হয় বলেই বলা। মেয়ে সঙ্গে আছে বলে তিনি অন্য সবার প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন এ রকম হতে পারে।

শুনলাম তোমার মার শরীর ভাল না?

জ্বি।

সমস্যাটা কী?

জ্বর।

ডাক্তার দেখিয়েছ?

জ্বি।

পাপিয়া ম্যাডামের মেয়েও চায় না–তার মা কারো সঙ্গে কথা বলুক। পাপিয়া ম্যাডাম আমার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেই মেয়ে তাঁর মায়ের হাত ধরে টানে।

আমি তাদের খেলাটা বুঝতে চেস্টা করলাম। তাতেও মেয়েটির আপত্তি। আমার দিকে তাকিয়ে সে কঠিন গলায় বলল, Dont look at the board. ছোট ছোট বাচ্চাদের মুখে চমৎকার ইংরেজি শুনলে ভাল লাগে। তাদের কথা শুনতে ইচ্ছে করে। এই মেয়েটা স্বল্পভাষী। তার মা দশটা কথা বললে সে দুটা কথা বলছে। ছোটবেলাতেই যে মেয়ে এত কম কথা বলে–বড় হলে তার অবস্থা কী হবে? খুব বেশি বকবক করবে? না পুরোপুরি চুপ হয়ে যাবে?

আমাকে কেউ তেমন লক্ষ্য করছে না। শুটিং এর সময় সবার সঙ্গে বসে থাকতে যতটা অস্বস্থিকর হবে বলে ভেবেছিলাম ততটা লাগছে না। সবাই কাজ নিয়ে ব্যস্ত। ক্যামেরাম্যান আজীজ আংকেল বার বার আকাশের দিকে তাকাচ্ছেন। আকাশে বড় বড় মেঘের খণ্ড। মেঘ ভেসে ভেসে যাচ্ছে। সূর্য ঢাকা পড়ছে। আজীজ আংকেল নিশ্চয়ই মনে মনে হিসেব করছেন— কতক্ষণ সান পাওয়া যাবে। দিনে শুটিং-এর সময় সব ক্যামেরাম্যান সূর্য উপাসক হয়ে যান।

আজ শুটিং খুব কষ্টকর হবে। একটু পর পর সান না পাওয়ার কারণে শট কাট হবে। আর্টিস্টদের উপর খুব চাপ পড়বে। অভিনয়ে ডিসকনটিনিউটি চলে আসবে।

ইউনিটের একটা ছেলে ফ্লাস্কে করে চা নিয়ে এসেছে। সবাইকে চা দিচ্ছে। লাল টকটকে ফ্লাস্কে চা। চারদিক সবুজ বলেই ফ্লাস্কের লাল রঙ খুব সুন্দর ফুটেছে। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে।

অন্য সময় হলে আমি চা খেতাম না। আজ নিজ থেকে চা চেয়ে নিলাম। কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকা। চা খাচ্ছি—তাকিয়ে আছি ডিরেক্টর সাহেবের দিকে। আমার তাকিয়ে থাকা তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। দেখতে পারছেন না বলেই আমি তাকিয়ে থাকতে পারছি।

আমি ভেবে পাচ্ছি না মানুষটা এত সহজ স্বাভাবিক আচরণ কি করে করছেন। সামান্য অন্যায় করলেও অপরাধ বোধ হয়। যার উপর অন্যায়টি করা হয়েছে তার সামনে সহজ হওয়া যায় না। উনার সহজ ভঙ্গিটা কি অভিনয়? অভিনয় হলে বলতেই হবে তিনি ভাল অভিনেতা।

ডিরেক্টর সাহেব উঠে আসছেন। আমাদের দিকেই আসছেন। আমার কাছে। নিশ্চয়ই না। হয়ত পাপিয়া ম্যাডামকে কিছু বলার জন্যে আসছেন। যেহেতু আমি পাশে আছি— আমাকেও হয়ত কিছু বলবেন— কেমন আছ রুমালী ধরনের কোন কথা। আমাকে খুব সহজ ভাবে জবাব দিতে হবে। ডিরেক্টর সাহেব পাপিয়া ম্যাডামের সামনে দাঁড়ালেন। হাসি মুখে বললেন, দুটার আগে তোমার কোন কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। তুমি ইচ্ছা করলে রেস্ট নিতে পার।

পাপিয়া ম্যাডাম বললেন, রেস্টইতো নিচ্ছি। ঘরের ভেতর রেস্ট নেবার চেয়ে বাইরে নেয়া কি ভাল না?

বোতাম টিপে কী খেলা খেলছ?

লুডু খেলা। ইলেকট্রনিক লুডু। কৌটার ভেতর ছক্কা নিয়ে চলতে হয় না। বোতাম টিপলেই ডিসপ্লেতে এক থেকে ছয়ের ভেতর একটা সংখ্যা ভেসে ওঠে।

কই গুটি চেলে দেখাওতো।

এখন দেখানো যাবে না। আমার মেয়ে রাগ করবে। আমরা দুজন যখন এক সঙ্গে থাকি তখন সে তৃতীয় কাউকে সহ্য করতে পারে না। এখনি সে কেমন করে তাকাচ্ছে।

ডিরেক্টর সাহেব শব্দ করে হেসে উঠলেন। হাসি থামিয়েই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন— রুমালী আমার সঙ্গে এসোতো।

আমি উঠে দাঁড়ালাম। তিনি কী বলবেন তা আমি জানি। কেন আমাকে বাদ দিতে হল তা ব্যাখ্যা করবেন। ব্যাখ্যাটা কী ভাবে করা হবে তা হচ্ছে কথা! নিশ্চয়ই খুব সুন্দর করে বলবেন।

একই কথা একেকজন একেক ভাবে বলে। শুধু মাত্র বলার ভঙ্গির কারণে কথার অর্থ পর্যন্ত বদলে যায়। ডিরেক্টর সাহেব আমাকে বলবেন— রুমালী! আমি খুব দুঃখিত যে তুমি বাদ পড়ে গেলে। ঘটনাটার উপর আমার হাত ছিল না। তোমার যত না খারাপ লাগছে, আমার তার চেয়েও বেশি খারাপ লাগছে। অভিনয় ভাল না হবার কারণে তুমি যদি বাদ পড়তে আমার মোটেও খারাপ লাগত না। অভিনয় তুমি যে শুধু ভাল কর তা না, খুবই ভাল কর। শোন রুমালী কিছু কিছু ঘটনা এই পৃথিবীতে ঘটে যার উপর আমাদের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এই ব্যাপারটা বুদ্ধিমতী মেয়ে হিসেবে অবশ্যই তুমি জান। আমার অবস্থা তুমি সেই দিক থেকে বিচার করবে। কেমন? বি এ গুড গার্ল। এইবার সুন্দর করে একটু হাসোতো।

ডিক্টের সাহেব এর বাইরে কিছু বলবেন না। এইটিই তিনি হয়ত আরো গুছিয়ে বলবেন— আমার কাছে মনে হবে আরে তাইতো। মানুষটার উপর তখন আমার আর রাগ থাকবে না। মানুষটার জন্যে করুণা ও মমতায় হৃদয় দ্রবীভূত হবে।

উনি কীভাবে কথাগুলি বলেন তা শোনার জন্যে আগ্রহ নিয়ে আমি অপেক্ষা করছি। উনি কিছু বলছেন না। উনি মানুষজন যে দিকে বসে আছে তার উল্টো দিকে যাচ্ছেন। মাঠের দিকে যাচ্ছেন। সবাই নিশ্চয়ই তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। সবাই ভাবছে–ব্যাপারটা কী?

রুমালী!

জ্বি।

তুমি আমাকে ছোট্ট একটা কাজ করে দাও তো।

কী কাজ বলুন— করে দিচ্ছি।

এই মাঠে কিছু ফড়িং ঘুরছে। তুমি আমাকে বড় সড় দেখে একটা ফড়িং ধরে দাও। ফড়িং ধরতে পার না?

কখনো ধরি নি। তবে নিশ্চয়ই ধরতে পারব।

ফড়িং দিয়ে কী করব বলতো?

দিলুর যখন শট নেয়া হবে তখন ফড়িংটা আপনি ব্যবহার করবেন। দিলুর হাতে থাকবে ফড়িংটা।

ঠিক ধরেছ। ক্যামেরা দিলুকে পেছন থেকে ধরবে। দেখা যাবে সে মাঠে ছোটাছুটি করছে। একটা হাতে তখন কিন্তু ফড়িংটা আছে। ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছে না। আমরা ক্যামেরায় যা দেখছি তা হচ্ছে একটা মেয়ে মাঠে ছোটাছুটি করছে। মেয়েটা যখন ক্যামেরার দিকে ফিরে তাকাল তখন দেখা গেল তার হাতে ফড়িংটা ধরা। ফড়িংটা ছটফট করছে মেয়েটা মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। ফড়িং এর দিকে। দৃশ্যটা সুন্দর হবে না?

খুব সুন্দর হবে।

তুমি একটা ফড়িং ধরে আমার কাছে নিয়ে এসো।

জ্বি আচ্ছা।

উনি চলে গেলেন উনার জায়গায়, আমি গেলাম ফড়িং ধরতে। ফড়িং ধরার জন্যে ইউনিটে অনেক লোক আছে। যে কোন প্রোডাকশন বয়কে ফড়িং ধরতে বললে সে মুহূর্তের মধ্যে পঞ্চাশটা ফড়িং ধরে নিয়ে আসবে। তা না করে তিনি আমাকে ফড়িং ধরতে বললেন। কাজটার পেছনে তার একটা উদ্দেশ্য আছে। উদ্দেশ্যটা কী? আমাকে এবং অন্য সবাইকে দেখানো যে সব স্বাভাবিক আছে? আমাকে সহজ করা? তার প্রয়োজন ছিল না, আমি সহজ স্বাভাবিক হয়েই আছি।

 

তিথিকণার মেকাপ শেষ হয়েছে। মেয়েটা খুব সুন্দর। মেকাপের পর তাকে দেখাচ্ছে ইন্দ্রাণীর মত। শট দেবার জন্যে সে তৈরি। ভীত এবং লজ্জিত ভঙ্গিতে সে হাসছে। আমার সিক্সথ সেন্স বলছে–অভিনয়টা সে ভাল পারবে। এ রকম কেন মনে হচ্ছে বুঝতে পারছি না। বরং উল্টোটা হবার কথা, কারণ ডিরেক্টর সাহেব তাকে কী বলছেন তা সে মন দিয়ে শুনছে না, বার বারই এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ডিরেক্টর সাহেবের কথার মাঝখানেই একবার সে তার মার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল। ডিরেক্টর সাহেব বললেন— তিথি আমি কী বলছি মন দিয়ে শোন! তুমি তোমার জীবনের একটা ট্রানজিশন পয়েন্টে আছ। এই তুমি কিশোরী— এই তুমি তরুণী এমন অবস্থা। বুঝতে পারছ কী বলছি?

হুঁ।

মেয়েটির মা বললেন–বলছ কেন? বল—জ্বি।

জ্বি।

ডিরেক্টর সাহেব বললেন, এই ফড়িংটা হাতে নাও। দু আঙ্গুলে পাখা দুটা ধর।

তিথি বলল, অসম্ভব আমি মরে গেলেও ফড়িং ধরব না, ঘেন্না লাগে।

ডিরেক্টর সাহেব বললেন, ঘেন্না লাগার কী আছে, ফড়িং কী সুন্দর একটা পতঙ্গ।

তিথিকণা বলল, সুন্দর পতঙ্গ হলে আপনি ধরে বসে থাকুন। আমি ধরব না।

তিথির মা বললেন, এইসব কী বেয়াদবের মত কথা। কার সঙ্গে কথা বলছ খেয়াল থাকে না? সরি বল।

তিথি বলল, সরি সরি সরি।

এইবার আংকেল যা বলছেন কর— ফড়িংটা ধর।

বললাম না মা, আমার ঘেন্না লাগে। তোমাকে যদি একটা পেট মোটা মাকড়শা ধরতে বলা হয় তুমি ধরবে? তুমিতো মাকড়শা দেখেই ফিট হয়ে পড়ে যাবে।

ফড়িংতো আর মাকড়শা না।

ফড়িং মাকড়শার চেয়েও খারাপ। যা যা করতে বলা হবে আমি করব, কিন্তু ফড়িং ধরব না। আর যদি ধরতে হয় হাতে গ্লাভস পরে নেব। আমার জন্যে গ্লাভস্ আনাতে হবে।

তিথি শেষ পর্যন্ত ফড়িং হাতে নিয়ে দৃশ্যটা করল। এত সুন্দর করল যে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। পাপিয়া ম্যাডাম বললেন–বাহ্ চমৎকারভো। মেয়েটাতো দারুণ।

জামিল ভাইয়ের সঙ্গে তার দৃশ্যটা আরো সুন্দর হল। বই ছিড়ে পানিতে ফেলে দেয়া। রাগ করে দৌড়ে ছুটে যাওয়া। ক্যামেরায় ছবি তোলার সময় চমকে তাকানো।

আমার কাছে সবচে ভাল লাগল–তার ক্যামেরায় ছবি তোলার অংশটা। সেলিম ভাই ছবি তুলছেন। তিথির হাতে ফড়িং। সেলিম ভাই (চিত্রনাট্যের সাব্বির) বললেন–রেডি ওয়ান-টু…. থ্রি বলার ঠিক আগে আগে তিথি ফাজলামি করে ঠোঁট দুটো গোল করে ফেলল। অপূর্ব দৃশ্য। তাদের বয়েসী মেয়েরা ছবি তোলার সময় এ রকম কাণ্ড কারখানা করে। আমি কি এরকম করতাম? না করতাম না। তিথি করছে কারণ একটা সিনেমা তৈরি হচ্ছে এ ব্যাপারটা তার মাথার মধ্যে নেই। সে ঘরে যা করে এখানেও তাই করছে। পুরো ব্যাপারটা সে নিয়েছে খেলার মত।

লাঞ্চ ব্রেকের সময় আমি ক্যাম্পে ফিরে গেলাম। তিথিও আমার সঙ্গে আসছে। সে গোসল না করে দুপুরের খাবার না-কি খেতে পারে না। ভালমত সাবান ডলে গোসল করবে। তারপর খাবে। খাবার পর আবার মেকাপ নিয়ে অভিনয়ের জন্যে তৈরি হবে। শুধু আজ গোসল না করে খেয়ে ফেলার ব্যাপারে তাকে অনেক বলেও রাজি করানো যায় নি। তিথির মা তার সঙ্গে আসতে চাচ্ছিলেন। তিথি বলেছে— মা তোমাকে আসতে হবে না। তুমি লাঞ্চ কর। আমি সোহরাব চাচার সঙ্গে যাচ্ছি, উনার সঙ্গে ফিরে আসব।

আমরা তিনজন ক্যাম্পের দিকে ফিরছি। সবার আগে সোহরাব চাচা তার একটু পেছনে আমরা দুজন। আমি বললাম তিথিকণা তোমার অভিনয় খুব ভাল হয়েছে। তিথি বলল, তুমি আমার নাম জান কীভাবে?

জিজ্ঞেস করে জেনেছি।

আমাকে দেখে তুমি দোতলার বারান্দা থেকে হাত নাড়াচ্ছিলে?

হ্যাঁ।

কেন?

এম্নি।

তোমার নাম আমি জানি না–তোমার নাম কী?

রুমালী।

বাহ্ কী অদ্ভুত! রুমাল থেকে রুমালী। চাদর থেকে চাদরি। হি হি হি।

তিথি হঠাৎ শুরু করা হাসি হঠাৎই থামিয়ে বলল, চাদরি বলায় রাগ কর নিতো?

না।

আমি যে চরিত্রটা করছি, সেই চরিত্রটা তোমার করার কথা ছিল—তাই না?

হুঁ।

তারপর তোমাকে বাদ দেয়া হয়েছে?

হুঁ।

কেন?

অভিনয় ভাল হচ্ছিল না।

অভিনয় ভাল হবে কি-না সেটা ওরা আগে দেখে নেবে না? ডেকে এনে অভিনয় করিয়ে তারপর বাদ দিয়ে লজ্জা দেবে কেন?

আমি চুপ করে রইলাম। তিথিকে আমার ভাল লাগতে শুরু করেছে। প্রথমেই যাদের ভাল লাগতে শুরু করে তাদেরকে কখনো খারাপ লাগে না। ভাল লাগার পরিমাণ দ্রুত বাড়তে থাকে। তিথি বলল, তোমাকে অভিনয় করার একটা কৌশল শিখিয়ে দেই— কৌশলটা শিখলে দেখবে ভাল অভিনয় করবে।

কৌশলটা কার কাছে শিখেছ?

নিজে নিজেই বার করেছি। কারো কাছ থেকে শিখি নি। আমি বেশির ভাগ জিনিসই নিজে নিজে বার করি। কারো কাছ থেকে শিখি না।

এটাতো ভাল। নিজেই নিজের শিক্ষক।

কৌশলটা হল–অভিনয়ের আগে নিজের মধ্যে একটা রাগ তৈরি করবে। কোন একটা ব্যাপারে হুট করে রেগে যাবে। তারপর রাগটা চাপা দিয়ে অভিনয় করবে। দেখবে অভিনয় ভাল হবে।

কারণটা কী?

রাগ ছাড়া অভিনয় করতে গেলে লজ্জা লাগবে। সবাই হা করে তাকিয়ে আছে, দেখছে। লজ্জা লাগবে না? অভিনয় কেমন হচ্ছে না হচ্ছে তা নিয়ে সব সময় ভয় থাকবে। মনের ভেতর রাগ থাকলে— এইসব কোন কিছুই মাথায় থাকবে না।

তোমার কথা সত্যি হলে যাদের রাগ বেশি তাদের খুব ভাল অভিনেতা হবার কথা।

তা জানি না। আমার যা মনে এসেছে আমি তোমাকে বললাম। আমিতো আর বেশি কিছু জানি না। আমি এ বছর এস.এস.সি. দেব। তাছাড়া আমি ছাত্রীও খুব খারাপ। স্কুলে সায়েন্স পাই নি আর্টস পেয়েছি।

সায়েন্স পড়তে ইচ্ছে করে?

সায়েন্স আর্টস কোনটাই আমার পড়তে ইচ্ছা করে না। আমার কী ইচ্ছা করে জান?

কী ইচ্ছা করে?

দিন রাত কম্পিউটার নিয়ে খেলতে ইচ্ছা করে।

ভিডিও গেম?

আরে না, ভিডিও গেম কেন খেলব? ভিডিও গেম খেলে বাচ্চারা। আমিতো বাচ্চা না— আমি কম্পিউটার ফটোশপ নিয়ে কাজ করি। ফটোশপ হল— একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম Adobe photoshop, এই প্রোগ্রাম দিয়ে অনেক কিছু করা যায়। উদাহরণ দিয়ে বুঝাই–মনে কর প্রথম তুমি রবীন্দ্রনাথের একটা ছবি কম্পিউটারে ঢুকালে। তারপর তোমার নিজের একটা ছবি ঢুকালে। তারপর দুটা ছবিকে একসঙ্গে জোড়া লাগালে। কিছু কারেকশন করলে। তারপর ছবিটা প্রিন্ট করলে, তখন দেখা যাবে রবীন্দ্রনাথের পাশে তুমি বসে আছ। একটুও মেকি মনে হবে না। মনে হবে সত্যি সত্যি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তোমার ছবি তোলা হয়েছিল। তুমি রবীন্দ্রনাথের নাতনী। কিংবা রবীন্দ্রনাথের নাতনীর কোন বান্ধবী।

তোমার কি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ছবি আছে?

অনেকগুলি আছে। আইনস্টাইনের সঙ্গে আছে। শেখ হাসিনার সঙ্গে আছে, বেগম জিয়ার সঙ্গে আছে, সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আছে। লতা মুঙ্গেশকরের সঙ্গে আছে।

বল কী?

আমি ছবিগুলি নিয়ে এসেছি তোমাকে দেখাব। অবশ্যি তুমি যদি দেখতে চাও।

আমি দেখতে চাই।

আচ্ছা দেখাব। শুটিং শেষ হোক তারপর! শুটিং শেষ হবার পর, গোসল করে ফ্রেশ হয়ে দেখাব।

তুমি কি ঘন ঘন গোসল কর?

হুঁ করি। আমি আগের জন্মে মাছ ছিলামতো, এই জন্যে বেশি বেশি গোসল করি। রুমালী শোন, তুমি আমার উপর রাগ করো না।

রাগ করব কেন?

এই যে আমি হঠাৎ এসে তোমার জায়গাটা নিয়ে নিয়েছি এই জন্যে।

কেউ কারো জায়গা নিতে পারে না। এই জায়গাটা গোড়া থেকেই তোমার ছিল। আমি ভুল করে মাঝখানে কিছুক্ষণের জন্যে চলে এসেছিলাম।

বাহ্ তুমি দেখি একেবারে আমার বাবার মত কথা বল। বাবা এত সুন্দর করে কথা বলে যে তার মিথ্যা কথাগুলিও সত্যি মনে হয়। ধর কোন একটা বিষয় নিয়ে তোমার মন খারাপ। তুমি বাবার কাছে গিয়ে যদি বিষয়টা বল— বাবা পানির মত বুঝিয়ে দেবেন যে মন খারাপ করার মত কিছু হয় নি তুমি মন ভাল করে ফিরে আসবে।

তোমার বাবা কি তোমার সঙ্গে এসেছেন?

হুঁ এসেছেন। বাবা আমাকে ছাড়া থাকতে পারে না। আমি যেখানে যাক বাবা যাবে। একবার আমরা স্কুল থেকে এক্সকারশানে কক্সবাজার গিয়েছিলাম। বাসে করে গিয়েছিলাম। কক্সবাজার পৌঁছে দেখি বাবা তার আগের দিন প্লেনে করে কক্সবাজারে চলে এসেছেন। হোটেল শৈবালে থাকেন। আমরা সব মেয়েরা সি বিচে হৈ চৈ করি উনি দূরে একা একা হাঁটেন। তোমার সঙ্গে অনেক গল্প করলাম। দেরি হয়ে গেছে। সবার কাছ থেকে বকা খাব। ভালই হয়েছে বকা খেলে রাগ উঠে যাবে। রাগ উঠে গেলে অভিনয় ভাল হবে।

 

আমি মার ঘরে ঢুকে একটু হকচকিয়ে গেলাম। ঘর অন্ধকার। দরজা জানালা বন্ধ। মা ঘুমুচ্ছেন না, জেগে আছেন। দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছেন। চোখ মুখ ফোলা। চুল এলোমেলো। বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। যাবার সময় হাসিখুশি দেখে গিয়েছিলাম— অল্প সময়ে আবার কী হয়ে গেল। আমি বললাম, জ্বর কি আরো বেড়েছে? মা জবাব দিলেন না। মনে হল আমি যা বলছি তা তাঁর কানে ঢুকছে না। আমি মার কপালে হাত রাখলাম— জ্বর আছে, এবং বেশ ভালই আছে। থার্মোমিটারে মাপলে একশ দুই টুই হয়ে যাবে।

জানালা বন্ধ করে ঘরটাকে গুদাম বানিয়ে রেখেছ কেন?

মা ক্লান্ত গলায় বললেন, বকুল তুই আমার সামনে বোস। তোর সঙ্গে কথা আছে।

আমি মার সামনে বসলাম। মার ভাবভঙ্গি কেমন কেমন যেন লাগছে। গলার স্বর পর্যন্ত পাল্টে গেছে।

তোর কাজ শেষ হয়েছে?

হুঁ।

শুটিং কেমন হল?

ভাল।

কোন অংশটা হল?

ছবি তোলার অংশ। সাব্বির সাহেব ক্যামেরায় ছবি তুলছেন— ঐ অংশ। সর্পভুক সেলিম ভাই এবং আমি।

আজকের মত কি কাজ শেষ?

কিছু বাকি আছে বিকেলে হবে।

মেকাপ তুলে ফেলেছিস কেন?

মেকাপ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল বলে তুলে ফেলেছি। বিকেলে শুটিং এর আগে আবার নেব। মা, জানালাগুলি খুলে দি?

না জানালা খুলবি না। আলো চোখে লাগে। বকুল–তুই এত সহজে মিথ্যা কথা বলছিস কীভাবে?

মিথ্যা কথা বলছি?

হ্যাঁ মিথ্যা কথা বলছিস। তোকে বাদ দেয়া হয়েছে। তোর জায়গায় আরেকটা মেয়ে অভিনয় করছে। মেয়েটার নাম তিথিকণা। তোকে বলেছে— আমাকে নিয়ে বিদেয় হতে। বলে নি?

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, হ্যাঁ বলেছে। তবে এত খারাপ ভাবে বলে নি ভদ্রভাবে বলেছে।

তার পরেও তুই মাটি কামড়ে পড়ে আছিস?

তোমার শরীর ভাল না, এই অবস্থায় যাব কীভাবে?

আমার কোন সমস্যা হবে না। আমি যেতে পারব।

যেতে পারলে চল যাই।

মা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, আমি ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি। তুই ইউনিটের কোন একটা ছেলেকে রিকশা ডাকতে বল। আমাদের বাসস্ট্যাণ্ডে নামিয়ে দেবে। বাসে করে আমরা চলে যাব।

কাউকে কিছু না বলে চলে যাব?

যারা আমার মেয়ের গায়ে থুথু দিয়েছে তাদের বলাবলির কী আছে?

ওরা ভুল করেছে বলে আমরা কেন ভুল করব মা? আমরা ভুল করব না। আজ রাতে শুটিং এর শেষে আমি সবার কাছ থেকে হাসি মুখে বিদেয় নেব, পরদিন সকালে চলে যাব।

না আমি এখনি যাব।

তুমি এখনি যেতে চাইলে যাও। আমি তোমাকে বাসে তুলে দিয়ে আসব। কিন্তু আমি চোরের মত পালিয়ে যাব না। আমি কোন চুরি করি নি যে আমাকে চোরের মত পালিয়ে যেতে হবে।

মা শব্দ করে কাঁদছেন। গোংগানীর মত শব্দ হচ্ছে। মার কান্না দেখে আমার কেন যেন মায়া লাগছে না। রাগ লাগছে। কান্নার শব্দ শুনে লোকজন জড় হবে। জানতে চাইবে কী ব্যাপার। কী বিশ্রী?

বকুল।

মা বল, আমি শুনছি।

তুই আমার সামনে থেকে যা। তোকে আমার সহ্য হচ্ছে না।

কোথায় যাব?

যেখানে ইচ্ছা যা তোর দেবতার সামনে হা করে বসে থাক। দেবতাকে পূজা কর গিয়ে। দেবতা তোর গায়ে যে থুথু দেবে— সেই থুথু চেটে চেটে খা…

এইসব কী বলছ?

আমি কী বলছি আমি জানি। তোকে আমি গর্ভে ধরেছি। আমি তোর গর্ভে জন্মই নি। আমি বোকা সেজে থাকি বলেই তুই আমাকে বোকা ভাবিস–শোন বুদ্ধিমতী যে রাতে তুই ঘটনা ঘটিয়েছিস আমি সেই রাতেই টের পেয়েছি। তুই মরার মত ঘুমুচ্ছিলি আমি সারারাত তোর পাশে জেগে বসেছিলাম। সারারাত নিজের মনে কী বলেছি শুনতে চাস?

না শুনতে চাই না।

সারারাত আমি আল্লাহকে বলেছি— আমি এত কী পাপ করেছি যে তুমি আমাকে এত শাস্তি দিচ্ছ? যে মেয়েকে বুকে নিয়ে জীবন কাটাব ভেবেছিলাম–এখন দেখি সেই মেয়ে বাজারের একটা নষ্ট মেয়ে।

তুমি কি দয়া করে চুপ করবে মা?

তোর দেবতা কি তোকে বিয়ে করবে? করবে না, পূজা নেবে কিন্তু বিয়ে করবে না। দেবতারা বোকা হন না। তারা দেবী বিয়ে করেন তারা বাজারের নষ্ট মেয়ে বিয়ে করেন না। বড়জোড় কিছুক্ষণ কচলাকচলি করেন। তার পর ঘেন্নায় থুথু দেন। তোর জীবন কাটবে দেবতার থুথু গায়ে মেখে।

মা হাতজোড় করছি চুপ কর!

চুপতো করবই। চুপ করা ছাড়া আমার গতি কী? আমি চুপ করব–আর কথা বলব না। শুধু তোর ভবিষ্যৎটা কী হবে বলে চুপ করি। আমি চোখের সামনে তোর ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি।

আমার ভবিষ্যটা তুমি রাতে বলো মা। রাতে খুব মন দিয়ে শুনব।

না রাতে না। এখনই শোন। আমি ঢাকায় যাব–তারপর তোকে নিয়ে আমি ক্লিনিকে ক্লিনিকে ঘুরব। তোর পেট খালাস করতে হবে….

মা ছিঃ।

খবরদার তুই ছিঃ বলবি না। খবরদার। ছিঃ বলতে হলে আমি বলব। তুই বলবি না। বেশ্যা মেয়ের মুখে ছিঃ মানায় না। যা আমার সামনে থেকে, যা। তোর মুখের দিকে তাকালেও পাপ হয়।

আমি ঘর থেকে বের হলাম। মা ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমি শুনতে পাচ্ছি, মা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছেন— বেশ্যা। আমার মেয়ে বেশ্যা।

জালালের মা কোত্থেকে উদয় হয়েছে। তার মুখ ভর্তি পান। সে পানের পিক ফেলে আরেকটু এগিয়ে এল। মা কী বলছেন ভাল মত শুনতে হবে। আমি হাঁটছি। কোথায় যাচ্ছি জানি না। একবার কি পেছনে ফিরে দেখব মার দরজার সামনে আরো লোক জড় হয়েছে কি না? না থাক।

 

দুটার মত বাজে। এখন কোথায় যাব? গ্রামের পথে একা একা হাঁটব? সোমেশ্বরী নদীর পানি দেখতে যাব? না-কি কোন গারো বাড়িতে উপস্থিত হয়ে বলব, আপনারা কেমন আছেন? আমি আপনাদের দেখতে এসেছি। আমার খুব পানির তৃষ্ণা, আপনারা আমাকে ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি দিন না।

পানির তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। খুব ঠান্ডা এক গ্লাস পানি যদি আমাকে কেউ দিত। ক্ষিধেও পেয়েছে। সকালে বড় মগ ভর্তি এক মগ চা খেয়েছি— এরপর আর কিছু খাওয়া হয় নি। ও না খেয়েছি, শুটিং চলার সময় আর একবার চা খেয়েছি। ক্ষিধেয় এখন নাড়ি কামড়াচ্ছে। ক্ষিধের দোষ নেই। ক্ষিধের কাছে মানুষ পরাজিত হবেই। ক্ষিধের কাছে পরাজয় মানে শরীরের কাছে পরাজয়। মানুষ বার বার শরীরের কাছে পরাজিত হয়েছে। মনের কী প্রবল ক্ষমতা, কিন্তু তার পরেও শরীরের কাছে সে কত অসহায়।

আচ্ছা জাহেদার কাছে গেলে কেমন হয়। জাহেদাকে জিজ্ঞেস করতে পারি— জাহেদা তোমার কাছে পাকা মন-ফল আছে। থাকলে কয়েকটা মন-ফল দাওতো খেয়ে দেখি। মন-ফল কি মনের জোর বাড়ায়? দ্বিধা সংকোচ কাটিয়ে দেয়?

আমি রোদে নেমে পড়লাম। ভয়ংকর কোন কাণ্ড করতে ইচ্ছে হচ্ছে। কেউ এখন আমার দিকে তাকাচ্ছে না। এমন কোন কাণ্ড কি করা যায় যেন সবাই চমকে তাকায় আমার দিকে। ডিরেক্টর সাহেব হতভম্ব গলায় বলেন–কী হল?

সিনেমার গল্পে দিলু এমন একটা কাণ্ড করেছিল। বেচারীর দিকে কেউ তাকাচ্ছিল না। শেষটায় এমন এক কাণ্ড সে করল যে সবাই বাধ্য হল তাকাতে। সে নিজে কিন্তু তা জানতে পারল না। দিলু তখন দিঘীর নীল জলে টকটকে লাল রঙের স্কার্ট পরে ভাসছিল। আমার লাল স্কার্ট নেই, কিন্তু লাল শাড়িতে আছে। দিঘীর নীল জলে লাল শাড়ি খুব মানাবে।

মেঘ কেটে রোদ উঠেছে। প্রচন্ড রোদ। আকাশ আঁ আঁ করছে। প্রচণ্ড রোদের সময় চারদিক কি একটু ঘোলাটে লাগে? আমার লাগছে। মনে হচ্ছে হালকা করে কুয়াশা হয়েছে।

রাস্তার দুপাশে পানিতে নাক ডুবিয়ে মহিষের দল শুয়ে আছে। পানির উপর শুধু নাক ভেসে আছে আর কিছু নেই। মহিষের নাক ভাসিয়ে ডুবে থাকার দৃশ্যটা কি ডিরেক্টর সাহেব নিয়ে রেখেছেন? না নিয়ে রাখলেও তিনি নেবেন। কোন সুন্দর দৃশ্যই তাঁর চোখ এড়াবে না। যা কিছু সুন্দর তিনি বন্দি করে ফেলবেন সেলুলয়েডে। সেলুলয়েডে যা বন্দি করা যায় না তার প্রতি তার আগ্রহ নেই। মানুষের মন বন্দি করা যায় না বলেই কি মানুষের মনের প্রতি তাঁর এত অনাগ্রহ?

 

জাহেদার উঠোনে বকটা গম্ভীর ভঙ্গিতে হাঁটছে। এর নাম ধলামিয়া। ধলা মিয়া বলে ডাক দিলে বৃদ্ধ মানুষের মত টুকটুক করে হেঁটে আমার কাছে আসার কথা। আমি ডাকলাম, ধলামিয়া ধলামিয়া। বকটা ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখল তারপর ছোট ছোট পা ফেলে আমার দিকে আসতে শুরু করল। কী অদ্ভুত দৃশ্য। ডিরেক্টর সাহেবকে এই ব্যাপারটা বলা দরকার, এবং দৃশ্যটাও তাঁকে দেখানো দরকার। আমার ধারণা দৃশ্যটা দেখা মাত্র তিনি তাঁর ছবিতে ঢুকিয়ে দেবেন। নতুন একটা সিকোয়েন্স তৈরি করবেন। যেমন দিলু নিজের মনে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ এক বাড়িতে ঢুকে শোনে, এই বাড়িতে একটা পোষা বক আছে। যার নাম ধলামিয়া। নাম ধরে ডাকলেই যে গুট গুট করে হেঁটে কাছে আসে! দিলু অল্পতেই মুগ্ধ হয়। এই ঘটনা দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হল। দৃশ্যটা জামিল ভাইকে সে দেখাবেই। জামিল তার কথা পাত্তাই দিলেন না। বক আবার মানুষের কথা শুনে কাছে আসে না-কি?

আচ্ছা আল্লাহতালা কী করেন? তিনিও কি নতুন নতুন দৃশ্য তৈরি করে মূল দৃশ্যমালায় ঢুকিয়ে দেন। নতুন দৃশ্যগুলি তাঁর আদি পরিকল্পনায় ছিল না, হঠাৎ মাথায় এসেছে।

ভইনডি কেমুন আছেন গো?

আমি চমকে পেছনে ফিরলাম। খলুই হতে জাহেদা ঠিক আমার পেছনে। তার খলুই ভর্তি গোবর। তার হাতও গোবরে মাখা মাখি। কাউকে গোবর নিয়ে মাখামাখি করতে দেখলে অন্য সময় আমার গা ঘিন ঘিন করে উঠত। এখন করছে না। এখন মনে হচ্ছে এটাই স্বাভাবিক। জাহেদার হাত গোবরে মাখামাখি না থাকলে মানাতো না।

জাহেদা আপনি কেমন আছেন?

জাহেদা হাসতে হাসতে বলল, আমি ভাল আছি গো ভইনডি। তয় আমার লোকটা নিরুদ্দেশ হইছে।

নিরুদ্দেশ হইছে মানে কী?

দুইদিন আগে হাটে যাইব বইলা বাইর হইছে আর ফিরে নাই।

সে কী।

জাহেদা হাসছে। শরীর দুলিয়ে হাসছে। স্বামীর নিরুদ্দেশ হওয়াটা যেন বড়ই আনন্দময় সংবাদ।

চিন্তার কিছু নাই। আবার ফিরা আসব। আর না আসলে নাই। পশু পাখিও শিকল দিয়া বান্দন যায় না। আর মানুষ বইল্যা কথা।

উনি কি প্রায়ই নিরুদ্দেশ হয়ে যান?

হুঁ। তার বাতাস রোগ আছে।

বাতাস রোগটা কী?

বাতাস রোগটা যার থাকে হে বাতাস পাইলেই উইড়া যায়। হে খুঁজে রঙ্গিলা বাতাস।

ও আচ্ছা। বাতাস রোগের কথা এই প্রথম শুনলাম।

ভইনড়ি আফনে কি কোন কামে আসছেন?

না। আমি আপনের সঙ্গে গল্প করতে এসেছি।

আসেন গফ করি। খাড়ান হাত ধুইয়া আসি।

জাহেদা আমাকে পাটি পেতে দিল। পাখা এনে দিল। ফুল তোলা ওয়ারের বালিশ এনে দিল। পান সুপারি এনে দিল। খালি পেটে পান খেতে কেমন লাগে দেখার জন্যে আমি পান খাচ্ছি। একটা আয়না থাকলে দেখতাম আমার ঠোঁট লাল হয়েছে কি না। ঠোঁট যদি টকটকে লাল হয় তাহলে বুঝতে হবে আমার স্বামী আমাকে পাগলের মত ভালবাসবে।

জাহেদা!

বলেন ভইনডি।

দেখুনতো আমার ঠোঁট লাল হয়েছে কি না।

হইছে ভইনডি। খুব লাল হইছে।

থ্যাংক য়্যু।

আপনের মনডা কি খারাপ?

হ্যাঁ আমার মন খুব খারাপ।

জাহেদা কুটকুট করে হাসছে। মুখে আঁচল চেপেও হাসি থামাতে পারছে না। আমার মন খারাপ শুনে তার হাসি পাচ্ছে কেন? মেয়েটা কি পাগল?

হাসছেন কেন?

আপনের মন ভাল হইয়া যাইব। খুব ভাল হইব।

কখন মন ভাল হবে?

এক দুই দিনের মইধ্যে।

আপনার কথাতো একটাও ঠিক হয় না। আপনি বলেছিলেন চণ্ডিগড়ে কোন শুটিং হবে না। একজন মানুষ মারা যাবে। কই কেউতো মারা যায় নি। শুটিংও ঠিকমতই হচ্ছে।

ভইনডি আমার কথা মাঝে মাঝে লাগে। মাঝে মাঝে লাগে না।

সবার বেলাতেই তো এমন হয়। সবার কথাই মাঝে মাঝে লাগে। মাঝে মাঝে লাগে না।

তাও ঠিক।

আকাশে কি মেঘ জমতে শুরু করেছে? আলো কেমন মরে আসছে। আমি মেঘ দেখার জন্যে আকাশের দিকে তাকালাম। মেঘ নেই, কিন্তু রোদ মরে যাচ্ছে, আশ্চর্য তো! জাহেদা বলল, আইজ রাইত ঝুম তুফান হইব।

তাই বুঝি?

হুঁ, ঝুম তুফান হইব। সোমেশ্বরী নদীত বান ডাকব। হাতি ভাসাইন্যা বান।

আপনার মন এইসব খবর আপনাকে দিচ্ছে, না-কি আকাশের অবস্থা দেখে বলছেন।

মন বলতাছে।

আপনের স্বামী কবে ফিরবে?

তাতো ভইনড়ি বলতে পারব না।

স্বামীর ব্যাপারে মন কিছু বলছে না?

জ্বে না।

বকটাকে ডাকা হয় নি। তারপরেও সে নিজের মনে হাঁটতে হাঁটতে আসছে। আমার দিকেই আসছে। বকটা বড় হয়েছে মানুষের সঙ্গে, কিন্তু সে মনে হয় একজন মানুষকে অন্য একজনের কাছ থেকে আলাদা করতে পারে না। আমরা যেমন একটা বককে অন্য একটা বক থেকে আলাদা করতে পারি না, তারাও আমাদের পারে না। সে আমাকে জাহেদা ভেবেই আমার কাছে আসছে।

জাহেদা পেছন থেকে ডাকল ধলামিয়া। ধলামিয়া। কটা দাড়িয়ে গেল। সে একবার দেখছে জাহেদাকে, একবার আমাকে। মনস্থির করতে পারছে না কার কাছে যাবে। কী করে দেখার জন্যে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম, এবং আমিও ডাকলাম ধলামিয়া। পাখিটা আমার কাছেও এল না, জাহেদার কাছেও গেল নাস্থির হয়ে রইল।

জাহেদা শান্ত গলায় বলল, ভইনডি ধলামিয়া আন্ধা। চউক্ষে দেখে না।

আমি হতভম্ব গলায় বললাম, সে কী।

ছোট বয়সে এরে যখন ধইরা আনে তখন চউক্ষে হাত লাইগ্যা চউখ নষ্ট হইছে। বকটা আন্ধাগো ভইনডি। হে মানুষ চিনে না।

আমার বুকে ধাক্কার মত লাগল। পাখি অন্ধ হতে পারে? এর কেউ নেই। কোন সঙ্গিনী এর পাশে বসে না। এ উড়ে আকাশে যেতে পারে না। সারাদিন নিজের অন্ধকার ভুবনে আপন মনে হাঁটে। আমার চোখে পানি এসে গেল। আমি অনেকক্ষণ ধরেই কাঁদতে চাচ্ছিলাম— কাঁদতে পারছিলাম না। অন্ধ পাখিটা আমাকে কাঁদিয়ে দিল। আমি ডাকলাম— ধলামিয়া আয় আয় আয়রে লক্ষ্মী আয়।

ধলামিয়া আসছে। ছোট ছোট পা ফেলে কী অদ্ভুত ভাবেই না আসছে। আমার চোখ ভর্তি পানি। চোখের পানিতে পাখিটা ঝাপসা দেখছি।

জাহেদা বলল, ভইনডি কাইন্দেন না। আফনের কান্দনে ধলামিয়ার লাভ-লোসকান কিছুই নাই। কাইন্দা কী হইব? ভইনডি আফনের মনে হয় শইলডা খারাপ। বালিশে মাথা দিয়া শুইয়া থাকেন।

আমি বালিশে মাথা রেখে শুয়ে আছি। ধলামিয়া আবারো উঠোনে চলে গেছে। ঝা ঝা দুপুর। বাড়ির পেছনের কাশবনে বাতাস লেগে অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। জাহেদা আমার মাথার কাছেই কাঁথা নিয়ে বসেছে। কোন নকশি কাঁথা তৈরি হচ্ছে না। কাব্যময় কোন দৃশ্য নয়, অতি সাধারণ দৃশ্য। ছেড়া কাঁথা রিপু করা হচ্ছে।

ভইনডি!

হুঁ।

ঘুমান আরাম কইরা ঘুমান।

জাহেদা কাঁথা সেলাই করতে করতে বিড় বিড় করে নিজের মনেই কথা বলছে। কথাগুলি আমার কানে আসছে গানের মত। ঘুম ঘুম পাচ্ছে। এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। গাঢ় শান্তিময় ঘুম।

 

ঘুম ভেঙ্গে দেখি রাত হয়ে গেছে। জাহেদা ঘরে বাতি জ্বালায় নি। চারদিকে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। কী অদ্ভুত কান্ড কতক্ষণ ধরে ঘুমুচ্ছি? ঘরের পেছনের বাঁশবনে বাতাস লেগে ভূতুড়ে শব্দ হচ্ছে। আমি ভয় পেয়ে ডাকলাম, জাহেদ জাহেদা।

জাহেদা ঘর থেকে বের হল। তার হাতে কুপী। সে কুপী জ্বালাতে জ্বালাতে বলল, লম্বা একটা ঘুম দিছেনগো ভইনডি। সইন্ধ্যাকালে দুইবার ডাকছি। সাড়া দেন নাই। মরা ঘুম ঘুমাইছেন গো ভইনডি। মরা ঘুম। আফনের খুঁজে মানুষ আসছে।

কে এসেছে?

মওলানা আসছে। বাইরের বাড়িত বইস্যা আছে। আমারে বলছে, ঘুম ভাঙ্গানির দরকার নাই। আরাম কইরা ঘুমাইতাছে ঘুমাউক। মানুষের নিদ্রাও ইবাদৎ। আফনেরার এই মওলানা লোক ভাল।

আমি বাইরে এসে দেখি মওলানা সাহেব বাংলা ঘরের উঠানে খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে আছেন। তাঁর গা দিয়ে ভুর ভুর করে আতরের গন্ধ আসছে। আজ মনে হয় প্রাণ ভরে গায়ে আতর মেখেছেন। তার হাতে লম্বা টর্চ। এরকম লম্বা টর্চ এর আগে আমি দেখি নি। মওলানা বললেন, ঘুম কেমন হয়েছেগো আম্মাজী?

ঘুম খুব ভাল হয়েছে।

পাঁচটা মিনিট আম্মা। এশার আযান হয়েছে। নামাজটা পড়ে রওনা দিব। অজু আছে দিরং হবে না।

গায়ে এত আতর দিয়েছেন কেন? গন্ধে মাথা ঘুরছে।

মনটা খুব খারাপ হয়েছে এই জন্যে আতর দিয়েছি। চোখে সুরমাও দিয়েছি। রাত্রি বিধায় দেখতে পাচ্ছেন না। মন খারাপ হলে সুগন্ধ মাখলে ভাল লাগে।

শুটিং বন্ধ হয়ে গেছে এই জন্যে মন খারাপ। তিথিকণা আম্মা হঠাৎ বলল, অভিনয় করব না। এই মেয়ে বড় শক্ত। না মানে না।

কী নিয়ে রাগ করেছে?

সঠিক বলতে পারব না। বয়স অল্প। অল্প বয়সের রাগের জন্য কারণ লাগে। বয়সটাই রাগের। আম্মাজী জাহেদারে নামাজের জন্যে পাটি টাটি কিছু দিতে বলেন। একটু কষ্ট দেই আম্মাজীরে। মনে কিছু নিয়েন না।

আমি নিজেই পাটি এনে দিলাম। মওলানা. পার্টিতে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, আম্মাজী আপনার একটা পত্র আছে আমার কাছে।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, আমার চিঠি? কে দিয়েছে?

স্যারের স্ত্রী। নীরা ম্যাডাম দিয়ে গেছেন। বলেছেন–সময় সুযোগ মত আপনার হাতে দিতে। সময় সুযোগ পাচ্ছিলাম না। দিতে পারি নাই।

আমি হাত বাড়িয়ে খাম বন্ধ চিঠি নিলাম। মওলানা বললেন, ম্যাডাম বলে গেছেন, চিঠি পড়া শেষ হলে আমি যেন আপনার কাছ থেকে নিয়ে নষ্ট করে ফেলি। আম্মাজী এক কাজ করেন। চিঠি এইখানেই পড়েন। এই ফাঁকে নামাজ আদায় করে ফেলি। আছরের নামাজ কাজা হয়েছিল। আর নামাজ কাজা করব না।

নীরা ম্যাডাম যাবার সময় আপনাকে এই চিঠি দিয়ে গেছেন?

জ্বি। আর হাতের এই টর্চ লাইটটাও দিয়ে গেছেন। বড় ভাল মেয়ে আমাকে অত্যন্ত পেয়ার করেন। আগে আমাকে আপনি করে বলতেন। এখন তুমি করে বলেন।

আমি মওলানা সাহেবের হাত থেকে চিঠি নিয়ে কুপির আলোয় পড়তে বসলাম। জাহেদা তার কাজকর্ম করে যাচ্ছে। আমার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না। বকটা আমার খুব কাছাকাছি। বকের একটা বিরাট ছায়া পড়েছে দেয়ালে।

 

রুমালী,

কিছু কিছু জিনিস আমি ভয়ঙ্কর অপছন্দ করি। চিঠি লেখা তার মধ্যে একটি। অনেককেই তার অপছন্দের কাজ বাধ্য হয়ে করতে হয়। জীবনের অনেক আয়রনির একটি হচ্ছে অপছন্দের কাজটি বেশি বেশি করা। যে চিঠি লিখতে অপছন্দ করে দেখা যায় তার জীবিকাই হয় চিঠি লেখা। পোস্টাপিসের সামনে সে টুল পেতে বসে থাকে। একটাকা দুটাকার বিনিময়ে চিঠি লিখে দেয়। আমি সে রকম না। অপছন্দের কাজ আমি করি না। চিঠি লেখা আমার জীবিকা নয়। আমার যা বলার তোমাকে সরাসরিও বলতে পারতাম। বলতে ইচ্ছে করল না। বলতে গ্লানিবোধ হল।

চিঠি লিখতেও গ্লানিবোধ করছি— তবে চিঠির সুবিধাটা হচ্ছে আমার গ্লানিবোধ তোমাকে দেখতে হচ্ছে না। কেউ চায় না তার লজ্জা অন্যের সামনে তুলে ধরতে। শরীরের লজ্জা আমরা কাপড় দিয়ে ঢাকি। মনের লজ্জা কী দিয়ে ঢাকব?

আমি ঢাকায় রওনা হবার আগে আগে মঈনকে বলে এসেছি— তুমি অবশ্যই রুমালীকে তোমার ছবি থেকে বাদ দেবে। এবং কেন বাদ দেয়া হল তা গুছিয়ে বলবে। সেই গুছিয়ে বলার মধ্যে যেন কোনরকম অস্পষ্টতা না থাকে। সে বলেছে, আচ্ছা।

আমি জানি সে কিছুই বলবে না। সত্য আগুনের মত। সবাই সেই আগুনের সামনে দাঁড়াতে পারে না। আমার মত শক্ত মেয়েই পারে না, আর ও নিতান্তই দুর্বল একজন মানুষ। কাজেই আমি বাধ্য হয়ে এই দীর্ঘ চিঠি লিখলাম। এবং মওলানা সাহেবকে দিলাম তিনি যেন যথাসময়ে চিঠিটা তোমার হাতে দেন। মওলানাকে আমার পছন্দ হয়েছে। মঈনের অনেক গুণের মধ্যে একটি গুণ হচ্ছে পাথরের গাদার ভেতর থেকে সে মানিক খুঁজে নিতে পারে। যাদেরকে সে খুঁজে নেয় তারা তাকে ভালবাসে অন্ধের মত। তারা তাকে ঘিরে রাখে কঠিন দেয়ালে। যেন দেয়াল ভেঙ্গে কেউ তার ক্ষতি করতে না পারে। পৃথিবীর কোন যুক্তির ক্ষমতা নেই সেই দেয়ালে ফাটল ধরাবে।

রুমালী, আমার চিঠি খুব সম্ভব খানিকটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে–আমি প্রসঙ্গ ছেড়ে বাইরে চলে এসেছি। ভয় নেই আবারো প্রসঙ্গে ফিরে যাব। চিঠির এলোমেলো ভাব ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখবে— কারণ চিঠিটা লিখতে গিয়ে প্রবল মানসিক চাপ অনুভব করছি।

মঈনের দুর্বলতার কথা তোমার কাছে কিছু কিছু বলেছি। তার চরিত্রের সবল অংশের কথা বলা হয় নি। আমি নিজেও কিন্তু জানি না। একজন দুর্বল মানুষ আশেপাশের সবাইকে মোহাবিষ্ট করে রাখতে পারে না। সে কিন্তু পারছে। কী করে পারছে আমার তা জানা নেই। এক সময় জানতে চেষ্টা করেছি— এখন চেষ্টা করি না। ধরে নিয়েছি এটি ব্যাখ্যাতীত কোন প্রাকৃতিক কারণে ঘটছে। এই মানুষটির প্রতি তোমার প্রবল আকর্ষণের কারণ তুমি নিজে কি ব্যাখ্যা করতে পারবে? পারবে না। মঈনের কাছে যে থাকে তার মনের Rational অংশ কাজ করে না। মনে করা যাক তুমি তার পাশে গিয়ে বসলে। সে তোমার দিকে তাকিয়ে বলল, তারপর রুমালী তোমার কী খবর? তাতেই তোমার পৃথিবী দুলে উঠবে! তোমার কাছে মনে হবে এই মানুষটির মুখ থেকে এই অপূর্ব বাক্যটি শোনার জন্যে তুমি জন্ম জন্ম ধরে অপেক্ষা করছিলে।

তোমার কি মনে আছে—

আমি তোমাকে বলেছিলাম তাকে প্রথম দিন দেখেই আমার মনে প্রবল ঘোর তৈরি হয়েছিল, মনে হয়েছিল, এই মানুষটিকে আমার দরকার। মঈন নামের মানুষটি অতি সহজেই অন্যের ভেতর স্বপ্ন তৈরি করে দিতে পারে। সে তার নিজের স্বপ্নে অন্যদের টেনেও নিতে পারে। স্বপ্নহীন মানুষদের জন্য এটা অনেক বড় ব্যাপার। তারা স্বপ্ন খুঁজে বেড়ায়। প্রথমবার তাকে দেখেই আমি বাবাকে হতভম্ব করে দিয়ে বলেছিলাম, এই মানুষটিকে আমি বিয়ে করতে চাই! ছেলে সম্পর্কে খোঁজ খবর করতে গিয়ে বাবা হতভম্ব সে মানুষ হয়েছে এতিমখানায় পূর্ব পরিচয় বলতে তার তেমন কিছু নেই। আমি তা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাই নি–রবীন্দ্রনাথের ঐ বিখ্যাত গান–ন্যায় অন্যায় জানিনে জানিনে। কিংবা, আমি সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়। ভাল কথা এই গান দুটি কি তুমি গাইতে পার?

এখন তোমাকে লাবণ্যের কথা বলি।

আমার যখন বিয়ে হয় আমার ছোটবোন লাবণ্য তখন দেশের বাইরে শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করছে— ছুটি পায় নি বলে আসতে পারে নি। চিঠিতে আমাকে সাহস এবং উৎসাহ দিয়েছে। চমৎকার সব চিঠি। লাবণ্য আমার মত নয়— সে সুন্দর চিঠি লিখতে পারে। তার চিঠি পড়লে মনে হয় সে সামনে বসে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে গল্প করছে। তার গানের গলাও অপূর্ব। এই দিক দিয়ে তোমার সঙ্গে তার কিছুটা মিল আছে। সেও তোমার মতই চাপা স্বভাবের। গরমের ছুটিতে সে দেশে এল। মঈনের সঙ্গে তার প্রথম দেখা। মঈন তাকে বলল, তারপর লাবণ্য তুমি কেমন আছ? এই বাক্যটিতেই লাবণ্য অভিভূত হল বলে আমার ধারণা। তার চিন্তা চেতনার জগৎটা ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল। চাপা স্বভাবের মেয়ে বলে কাউকে সে তা বুঝতে দিল না। নিজেকে প্রবল ভাবে আড়াল করে রাখল। মঈনের সঙ্গে সে একা কখনো কথা বলে নি। আমরা দুজন যখন গল্প করতাম তখনই সে উপস্থিত হয়ে হাসিমুখে বলত–আমি কি তোমাদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারি? তোমাদের খানিকক্ষণ বিরক্ত করতে পারি?

তার ছুটি শেষ হয়ে গেল, কিন্তু সে ফিরে যেতে চাইল না। সে বলল, শান্তিনিকেতন তার ভাল লাগছে না। তারপরেও সে গেল। দিন দশেক থেকে হুট করে ফিরে এল। তার দিকে তখন তাকানো যায় না। স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গেছে। মাথার চুল উঠে উঠে যাচ্ছে। আমি তাকে বলাম, তোর কী হয়েছে? সে বলল, বুঝতে পারছি না কী হয়েছে। ব্লাড ক্যানসার ফ্যানসার হয়েছে মনে হয়। চিকিৎসা করাতে এসেছি। শরীরের সব রক্ত ফেলে দিয়ে আমি নতুন রক্ত নেব। কোন পবিত্র মানুষের রক্ত। তোমার সন্ধানে কোন পবিত্র মানুষ আছে?

তোর সমস্যা কী?

আমার সমস্যা—রাতে ঘুম হয় না। এমন কোন ঘুমের অষুধ নেই, খাই নি।

কোন লাভ হয় নি।

দিনে ঘুম হয়?

দিনে হয় তবে খুব সামান্য। আপা তুমি কোন ভাল ডাক্তার দেখিয়ে আমাকে শান্তিমত ঘুম পাড়াবার ব্যবস্থা কর। এ রকম আর কিছু দিন চললে আমি মরে যাব।

তাকে ডাক্তার দেখান হল। ডাক্তাররা কোন রোগ ধরতে পারলেন না। তার শরীর আরো খারাপ করল। পুরোপুরি শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল। জীবনের শয্যাশায়ী অংশটা হয়ত তার ভাল কেটেছে কারণ এই সময় মঈন তাকে বই পড়ে পড়ে শুনাতো। নিজের লেখা চিত্রনাট্য শুনাত।

এখন তুমি যে ছবিটা করছ সেই ছবির চিত্রনাট্য তখনি করা। চিত্রনাট্যটা লাবণ্যের খুব পছন্দ ছিল। লাবণ্য বলতে আমি অভিনয়ের কিছু জানি না, কিন্তু আমি দিলুর ভুমিকায় অভিনয় করব। আপনি কিন্তু আর কাউকে দিলু হিসেবে নিতে পারবেন না। আমি করব দিলু আর আপা করবে নিশাত। আসুন আমরা রিহার্সেল করি। আপনি আমাকে শিখিয়ে দিন কী করে অভিনয় করতে হয়।

তার শরীর একটু সুস্থ হল। সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল শান্তিনিকেতনে ফিরে যাবার জন্যে। আমি এবং বাবা দুজনই চেষ্টা করলাম তাকে আটকে রাখতে। সে থাকবে না। তাকে না-কি যেতেই হবে। সে চলে গেল। সাত দিনের মাথায় আবার ফিরে এল।

সে মারা যায় ছাদ থেকে পড়ে। পুলিশের কাছে আমরা সে রকমই বলেছি। ঘুম হত না বলে সে ছাদে হাটত। ছাদের রেলিং-এ পা তুলে বসে থাকত। খুব সম্ভব সেখান থেকেই মাথা ঘুরে পড়ে যায়।

ব্যাপার তা ছিল না। সে খুব সুস্থ মাথায় ছাদ থেকে লাফ দেয়। যে তীব্র আবেগ সে মঈনের জন্যে জমা করে রেখেছিল— সেই আবেগ সে কখনো প্রকাশ করে নি। আমাকে কিছু বুঝতে দেয় নি। তার মৃত্যুর পর তার ডাইরি পড়ে আমি সব জানতে পারি। ডাইরির একটি অংশ আমি এত অসংখ্যবার পড়েছি যে মুখস্থ হয়ে আছে। আমি স্মৃতি থেকে আবারো লিখছি। দেখবে এখানেও তোমার সঙ্গে লাবণ্যের খানিকটা মিল আছে—

মঈন ভাইকে আমার দুলাভাই ডাকা উচিত কেন জানি ডাকতে পারি না। দুলাভাই মানেই কিছু ফাজলামি, কিছু রসিকতা। দুলাভাই মানেই আশে পাশে শালিকারা ঘুর ঘুর করছে। না এটা আমার ভাল লাগে না।

আজ সকাল থেকেই ভেবে রেখেছি মঈন ভাইকে ভড়কে দেব। কী ভাবে কাজটা করব ভেবে পাচ্ছি না। আপার সঙ্গে উনার বোধ হয় মন কষাকষি হয়েছে। উনি আলাদা ঘরে শুচ্ছেন। আমি তার মন ভাল করার প্ল্যান করছি। শুরুতে ভড়কে দিয়ে তারপর মন ভাল করে দেব। প্ল্যানটা হচ্ছে বিকট একটা মুখোশ পরে গভীর রাতে উনার জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াব। ভয় দেখিয়ে আক্কেল গুড়ুম করে দেব।

শেষ পর্যন্ত সেই প্ল্যান মত কাজ করা হয় নি। গভীর রাতে মুখোশ পরে জানালার পাশে না দাঁড়িয়ে আমি দরজায় টোকা দিলাম। উনি দরজা খুলে দিয়ে একটুও না চমকে বললেন–লাবণ্য এসো। তোমার সঙ্গে গল্প করি। সকাল থেকে মাথা ধরে আছে। গল্প করলে মাথা ধরাটা কমবে। আর শোন মুখ থেকে মুখোশটা খোল।

আমি মুখোশ খুললাম। উনি বললেন, আলো চোখে লাগছে। আলো নিভিয়ে দিলে তোমার অসুবিধা হবে?

আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, কোন অসুবিধা হবে না। আপনি বাতি নিভিয়ে দিন। মঈন ভাই বাতি নিভিয়ে দিলেন। আমার কাছে মনে হল এই পৃথিবীতে আমার চেয়ে সুখী মেয়ে কোন দিন জন্মায় নি, ভবিষ্যতেও জন্মাবে না।

লাবণ্য আমাকে যদি ব্যাপারটা বলতো–তার সমস্যা সমাধান করা আমার পক্ষে কোন ব্যাপারই ছিল না। আমার প্রধান ত্রুটি, লাবণ্যকে চোখের সামনে দেখেও তার সমস্যা সম্পর্কে কোন রকম আঁচ করতে পারি নি।

লাবণ্যের ছায়া আমি পুরোপুরি তোমার উপর দেখছি। আমার আত্মা কেঁপে উঠেছে।

রুমালী, ভালবাসা ব্যাপারটা কি তুমি জান? আমার ধারণা তুমি এই ব্যাপারটা নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ভেবেছ? তুমি কি কিছু বের করতে পেরেছ? পেরেছ বলে আমি মনে করি না। অনেক গুণীজন এই ব্যাপার নিয়ে ভেবেছেন। হিসেব নিকেষ করেছেন—— থিওরী বের করেছেন, হাইপোথিসিস দাঁড় করিয়েছেন। ফলাফল শূন্য। কেউ কেউ বলেছেন ভালবাসার বাস মনে। মন যেহেতু আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ভালবাসাও তাই। বৈজ্ঞানিকদের কোন যন্ত্রে ভালবাসাকে ধরা ছোঁয়া যাবে না।

একদল বললেন— মন আবার কী? মস্তিষ্কই মন। মানুষের যাবতীয় আবেগের একমাত্র নিয়ন্ত্রক মস্তিষ্ক। মস্তিষ্ক ধরা ছোঁয়ার বাইরে নয়— কাজেই ভালবাসাও ধরা ছোঁয়ার বাইরে নয়। ব্রেইনের টেম্পোরাল লোবে ভালবাসা বাস করে। টেম্পোরাল লোবে অসংখ্য নিওরোনের ভেতর দিয়ে ইলেকট্রিক ইম্পালসের বিশেষ ধরনের আদান প্রদানই ভালবাসা।

আরেকদল বললেন, কিছুই হয় নি। মানুষের আবেগ, ভয়, ভীতি সব কিছুর মূল নিয়ন্ত্রক পিটুইটারী গ্লান্ড। একটা মেয়ে যখন একটি ছেলের প্রেমে পড়ে তখন ছেলেটিকে দেখা মাত্র পিটুইটারী গ্লান্ড থেকে বিশেষ এক ধরনের এনজাইম বের হয়। সেই এনজাইমের কারণে ছেলেটি তখন যা করে তাই ভাল লাগে। তা দেখেই হৃদয়ে দোলা লাগে। ছেলেটি যদি ফেং শব্দ করে হাতের মধ্যে নাক ঝেড়ে সিকনিতে হাত ভর্তি করে ফেলে তখনও মনে হয়— আহারে কী সুন্দর করেই না নাক ঝাড়ছে। পৃথিবীতে তার মত সুন্দর করে কেউ নাক ঝাড়তে পারে না।

ভালবাসার সর্বশেষ থিওরীটি তোমাকে বলি। সর্বশেষ থিওরীতে বিজ্ঞানীরা বলছেন— প্রকৃতির প্রধান ইচ্ছা তাঁর সৃষ্ঠ জীবজগৎ যেন টিকে থাকে। জীব জগতের কোন বিশেষ ধারা যেন বিলুপ্ত না হয়। জীব জগতের একটা প্রধান ধারা হচ্ছে হোমোসেপিয়ানস মানব জাতি। মানবজাতিকে টিকে থাকতে হলে তাদের সন্তান হতে হবে, এবং উৎকৃষ্ট সন্তান হতে হবে। সন্তান হবার জন্যে মানব-মানবীকে খুব কাছাকাছি আসতে হবে। কাজেই তাদের ভেতর একের জন্যে অন্যের একটা প্রবল শারীরিক আকর্ষণ তৈরি করতে হবে। সেই শারীরিক আকর্ষণের একটা রূপ হচ্ছে ভালবাসা। সেই ভালবাসার তীব্রতারও হের ফের হয়। প্রকৃতি যখন দেখে দুটি বিশেষ মানব-মানবীর মিলনে উৎকৃষ্ট সন্তান তৈরির সম্ভাবনা তখন তাদের ভালবাসাকে অতি তীব্র করে দেয়। যেন তারা একে অন্যকে ছেড়ে যেতে না পারে। কোন বাধাই তাদের কাছে তখন বাধা বলে মনে হয় না। ছেলেরা রূপবতী মেয়েদের প্রেমে পড়ে কারণ প্রকৃতি চায় পরবর্তী প্রজন্ম যেন সুন্দর হয়। গুণী মানুষদের প্রেমে মেয়েরা যুগে যুগে পাগল হয়েছে। কারণ প্রকৃতির সেই পুরানো খেলা, প্রকৃতি চাচ্ছে পুরুষদের গুণ যেন পরবর্তী প্রজন্মে ডি এন এর মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। প্রকৃতি প্রাণপণে চাচ্ছে মানব সম্প্রদায়ের গুণগুলি যেন নষ্ট না হয়ে যায় যেন প্রবাহিত হতে হতে এক সময় পূর্ণ বিকশিত হয়। তৈরি হয় একটা অসাধারণ মানব সম্প্রদায়।

হাইপোথিসিস হিসেবে খুব আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে না-কি? যত আকর্ষণীয়ই মনে হোক আমার নিজের ধারণা হাইপোথিসিস ঠিক নয়। আমি মঈন নামের মানুষটির প্রতি প্রবল ভাবেই আকর্ষিত হয়ে প্রায় ঘোরের মধ্যেই তাকে বিয়ে করেছিলাম। বিয়ের পরপরই আমার নিজের জগৎ ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল। কারণ মঈন একজন অসম্পূর্ণ মানুষ। আমি কী বলার চেস্টা করছি তুমি বুঝতে পারছ? এন্টেনা নামের আমাদের একটি মেয়ে আছে। সে আমাদের ভালবাসার ফসল নয়। তাকে দত্তক নেয়া হয়েছে।

পশু কাঁদতে পারে না, হাসতেও পারে না। তারপরেও তীব্র যন্ত্রণায় পশু মাঝে মাঝে গোঁ গোঁ শব্দ করে। পশুর যন্ত্রণার এই প্রকাশ একবার যদি তুমি দেখ–তোমার মাথায় তা সারাজীবনের মত গেঁথে যাবে। আমি প্রায়ই পশুর কান্নার এই দৃশ্য দেখি। মঈন গভীর রাতে অবিকল পশুর মতই কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে সে আমাকে কী বলে জান? সে বলে–প্লীজ ডোন্ট গ্রো মি অন দ্যা স্ট্রীট। আমাকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেল না। আমি তোমাকে মুক্তি দেব। ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ব বা ঘুমের অষুধ খাব। আমাকে অল্প কিছু দিন সম্মান নিয়ে বাঁচতে দাও।

সে তার এই অসম্পূর্ণতা জন্মসূত্রে নিয়ে এসেছে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের কিছুই করার নেই।

আমি তাকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলি নি। আমি তাকে বাস করতে দিয়েছি। সম্ভবত একজন অসুস্থ মানুষের সঙ্গে থেকে থেকে আমি নিজেও মানসিক ভাবে পঙ্গু হয়ে পড়েছি। তার কষ্ট অবশ্যই অসহনীয়, আমার নিজের কষ্টও কিন্তু অসহনীয়। সে নিজে যেমন পশুর মত কাদে আমি নিজেও পশুর মত কাদি। মাঝে মাঝে গভীর রাতে সে ছাদে চলে যায়। রেলিং এর উপর উঠে বসে— আমি পেছনে পেছনে গিয়ে বলি, কী করছ? সে বলে, নীচে লাফিয়ে পড়ব। সাহস সঞ্চয় করছি। আমি বলি— প্লীজ ডু দ্যাট। তোমার জন্যে ভাল হবে। আমাকে মুক্তি দেবার জন্যে নয়। নিজেকে মুক্তি দেবার জন্যেই এই কাজটা তোমার করা দরকার।

রুমালী! একজন মানুষ কোন পর্যায়ে এ ধরনের কথা বলতে পারে?

তোমাদের চণ্ডিগড়ে জাহেদা নামের একটা মেয়ে ভবিষ্যৎ বাণী করে। সে বলেছে–চণ্ডিগড়ে শুটিং হবে না। একটা মানুষ মারা যাবে। শোনামাত্রই আমার মনে হয়েছে— আচ্ছা এই মানুষটা কি মঈন হতে পারে না? ভয়ংকর একটা খেলা কি শেষ হবে না?

প্রকৃতি অসুন্দর পছন্দ করে না। অপূর্ণতা পছন্দ করে না। তারপরেও সে অসুন্দর এবং অপূর্ণতা তৈরি করে তাদের নিয়ে বিচিত্র খেলা খেলে। কেন খেলে বলতো?

আমার যা লেখার আমি লিখলাম। তোমার সঙ্গে কি আবারো আমার দেখা হবে? দেখা না হওয়াই ভাল। আর যদি দেখা হয়েও যায়— আমি ভাব করব তোমাকে চিনতে পারি নি। তুমি তাতে রাগ করো না। আরেকটা ছোট্ট অনুরোধ। চিঠিটা তুমি নষ্ট করে ফেলো।

–নীরা

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *