চোদ্দ
একেনবাবু কদিন হল সাতসকালে বেরোচ্ছেন বাড়ি থেকে, আর ফিরছেন সেই রাত করে। কারণ জানতে গিয়ে ‘গভরমেণ্টের চাকরি নচ্ছার স্যার’, এটুকু ছাড়া আর কিছুই আদায় করতে পারি নি। সুতরাং ওঁর দিক থেকে তদন্তের কাজ কতটুকু এগোচ্ছে বোঝার কোনও উপায় নেই। এটুকু শুধু জানি য়ে, উনি এরমধ্যে ব্রিজ শাহকে একবার ধরার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ব্রিজ শাহ ওঁর সঙ্গে কথা বলতে পারেন নি ব্যস্ত ছিলেন বলে। পরে অবশ্য ব্রিজ শাহ পাল্টা ফোন করেছিলেন একেনবাবুকে। একেনবাবু তাতে খুব ইমপ্রেসড। ‘কথার দাম আছে বটে মিস্টার শাহর’, প্রমথকে বলেছিলেন উনি। কিন্তু ইনফরমেশন নাকি বিশেষ কিছু পান নি।
আর-একটা ইণ্টারেস্টিং খবর হল, কিরিট প্যাটেল ওঁর বন্ধু মহলে কার্ট বলে পরিচিত। নাউ ইট মেকস সাম সেন্স। পিঙ্ক এলিফ্যাণ্টের জো যে কার্টের কথা উল্লেখ করেছিল, খুব সম্ভবত তিনিই হলেন কিরিট প্যাটেল। কিরিট প্যাটেল সহদেব ভারওয়ানিকে মুনস্টোনটা বিক্রি করেছিলেন, পরে আবার সেটা কেনার চেষ্টা করছিলেন। এদিকে ‘বস’ও ওটা কিনিতে চাইছিলেন, আর সহদেব চেষ্টা করছিল কার থেকে বেশী পাওয়া যায়। শেষে সম্ভবত কিরিট প্যাটেলকেই মুনস্টোনটা বিক্রি করে। ফলে ‘বস’ খেপে যায়! কিন্তু সে ক্ষেত্রে জো যে কথাটা শুনেছে ‘ ইট ওয়াজ মাই আইডিয়া’ – সেটার অর্থ কি? তাছাড়া টাইম স্কেলেও ঘটনাগুলো ঠিক ফিট করে না। স্যাম নাটালের ডিলারের ফোন পেয়েছিল মাত্র কয়েকদিন আগে। অবশ্য স্যাম যে সত্যি কথা বলছে, তার কোনও মানে নেই। ইনফ্যাক্ট গত পরশু প্রমথ একটা দুর্দান্ত খবর এনেছে, যেটা শুনে একেনবাবু একেবারে সারপ্রাইজড। প্রমথর ডিপার্টমেণ্টে পোস্ট ডক করে তানজানিয়ার একটি ছেলে, ভিক্টর ডিসুজা। সে মিস্টার প্যাটেলের অনেক পুরনো খবর জানে। মিস্টার প্যাটেল নাকি দশ বছর আগে তানজানিয়াতে থাকতেন। সেখানে ডেরিক ওয়াকার বলে একজন মুনস্টোন মার্চেণ্টের অ্যাসিস্টেণ্ট ছিলেন। কাজের সূত্রে ডেরিক ওয়াকার আর মিস্টার প্যাটেল একবার সাউথ আফ্রিকাতে যান। ফেরার পথে কালাহারি মরুভূমির পাশে ছোট একটা শহরে ডেরিকের মৃত্যু ঘটে বেশ রহস্যজনক ভাবে। বোৎসোয়ানার পুলিশ সন্দেহ করেছিল যে, মিস্টার প্যাটেলের এ-ব্যাপারে কোনও হাত আছে। ওঁকে গ্রেফতারও করা হয়েছিল। কিন্তু পরে প্রমাণাভাবে উনি ছাড়া পান। ডেরিকের স্ত্রী ছিলেন আফ্রিকান। তিনি স্বামীর মৃত্যুর পর প্রায় পাগলের মত হয়ে যান। খবর পেয়ে তাঁর বাবা এসে মেয়ে ও নাতিকে নিজের বাড়ি নিয়ে যান।
গল্পটা শুনে প্রমথ ভিক্টরকে জিজ্ঞেস করেছিল, ডেরিক ওয়াকারের স্ত্রী জাম্বিয়ার মেয়ে কিনা। ভিক্টর শুনে অবাক! বলেছিল, “রাইট। কিন্তু তুমি কী করে জানলে?”
“জাস্ট এ লাকি গেস,” প্রমথ উত্তর দিয়েছিল।
মোটকথা থিংস আর লুকিং ভেরি সিরিয়াস। তার ওপর আমাদের শখের গোয়েন্দাগিরির খবরটাও মনে হচ্ছে রাষ্ট্র হয়ে গেছে। আমার ধারণা সেটা প্রমথর দৌলতে। পেটে যদি একটা কথাও রাখতে পারে! গতকাল প্রমথ একটা চিঠি পেয়েছে, যেখানে লেখা: প্রাইভেট ইনভেস্টিগেশন কুড বি হ্যাজার্ডাস টু ইওর হেলথ!
চিঠিটা সম্ভবত জোক, কিন্তু সিরিয়াসও তো হতে পারে।
শনিবার সকালে একটু স্কুলে যেতে হয়েছিল। সেখানেই বসে-বসে এইসব ভাবছিলাম। ভাবতে ভাবতে কী হল জানি না, আমি হঠাৎ সম্পূর্ণ অন্য লাইনে চিন্তা শুরু করলাম! সেটা লেখার আগে একটা কথা বলে নি। স্যাম ওয়াকারের সঙ্গে দেখা না হওয়া পর্যন্ত আমার মনে কিন্তু মুনস্টোনের অস্তিত্ব সম্পর্কে একটা খটকা ছিল। একেনবাবুর কৃতিত্বটাকে আমি খাটো করছি না। কিরিট প্যাটেলকে লেখা চিঠিতে ‘মুনস্টোন’ কথাটা খুঁজে পাওয়া নিঃসন্দেহে একটা ব্রিলিয়াণ্ট অবজার্ভেশন। কিন্তু চিঠির সেকেণ্ড লাইন ‘Sounds music to my ear’ কথাটার কী অর্থ? একেনবাবু যে সিস্টেম ব্যবহার করে প্রথম লাইন ‘Mary owns one nice stone’ থেকে ‘মুনস্টোন’ শব্দটা আবিস্কার করেছেন, সেই সিস্টেম, অর্থাৎ প্রত্যেক শব্দের প্রথম অক্ষর তুলে সাজালে দ্বিতীয় লাইন থেকে পাওয়া যায় SMTME! কথাটার কোন অর্থই হয় না! আমি অবশ্য নিজেও দ্বিতীয় লাইনটা নিয়ে অনেক ভেবেছি, এবং বিভিন্ন সম্ভাবনা নিয়ে বিচার-বিবেচনা করেছি। যেমন চিন্তা করেছি Sounds কথাটায় ছ’টা অক্ষর। ইংরেজি অ্যালফাবেটের ষষ্ঠ অক্ষর হল, F । music -এ হচ্ছে পাঁচটা অক্ষর। অ্যালফাবেটের পঞ্চম অক্ষর হল, E । একই ভাবে to হবে, B। অর্থাৎ Sounds music to কথাটা দিয়ে বোধহয় বোঝানো হচ্ছে, FEB বা ফেব্রুয়ারি মাস! my আর ear-এ অক্ষরের সংখ্যা হচ্ছে, ২ আর ৩। পাশাপাশি সাজালে ২৩। পুরো লাইনটা তাহলে দাঁড়াচ্ছে ২৩শে ফেব্রুয়ারি! তার মানে কি – মুনস্টোনটা তেইশে ফেব্রুয়ারির মধ্যে চাই, অন্যথায় মৃত্যু?
এই ইণ্টারপ্রেটেশনে অবভিয়াসলি ভুল আছে, কারণ মিস্টার প্যাটেল তেইশে ফেব্রুয়ারির বেশ কয়েকদিন আগেই মারা গেছেন। সুতরাং দ্বিতীয় লাইনটা কখনোই ঠিক নয়। আর ফ্র্যাঙ্কলি, এ ধরণের হেঁয়ালি করে চিঠি দেবার অর্থটাই বা কি? হয়তো চিঠিটা একটা প্র্যাক্টিক্যাল জোক। ‘মুনস্টোন’ কথাটা আবিষ্কার হয়ে যাওয়াটা একেবারেই ফ্লুক। স্যাম ওয়াকার পিকচারে আসায় মুনস্টোনের অস্তিত্বটা অবশ্য এখন প্রমাণিত হয়েছে। এবং এটাও ঠিক, চিঠির প্রত্যেক লাইনই যে অর্থবহ হতে হবে – তার কোনও মানে নেই। একেনবাবু কুড ভেরি ওয়েল বি রাইট অন দ্য টার্গেট। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, হু ইজ দ্য মার্ডারার? এসব যেমন ভেবেছি, আবার এও ভেবেছি, সত্যিসত্যিই কি কেউ কিরিট প্যাটেলকে খুন করেছে? একেনবাবু অবশ্য বলছেন, মিস্টার প্যাটেলের মৃত্যুটা সুইসাইড নয়, মার্ডার। কিন্তু নিউ ইয়র্ক পুলিশ কেন সেটা মনে করছে না? এটা কি সম্ভব যে, একেনবাবুর লজিকের মধ্যে কোন একটা ফাঁক আছে?
আমি এ ক’দিন ধরে যা-যা ঘটেছে সবটাই আবার তলিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু খুব ক্রিটিকালি স্টাডি করেও একেনবাবুর অ্যানালিসিসে কোনও খুঁত খুঁজে পেলাম না। আর তখনই আমি একটা নতুন অ্যাঙ্গেল থেকে অ্যানালিসিস শুরু করলাম। এটা কী সম্ভব যে, চিঠিতে মুনস্টোনের উল্লেখ থাকলেও, কিরিট প্যাটেলের মৃত্যুর আসল কারণটা মুনস্টোন নয়! ভাল মুনস্টোনের দাম পাঁচ-দশ হাজার ডলার হতেই পারে, কিন্তু সেটা এমন কিছু অমূল্য বস্তু নয়, যার জন্য কাউকে খুন করার প্রয়োজন হবে। আর খুন করেই বা কি লাভ হল? উনি নিশ্চয় ওটা পকেটে নিয়ে ঘুরছিলেন না! হয়ত এই মুনস্টোনের অন্য কোনও ইমপ্লিকেশন আছে । হত্যাকারী ‘মুনস্টোন’ শব্দটা বুদ্ধি খাটিয়ে ব্যবহার করেছে, কোনও একজন বিশেষ লোক বা ঘটনাকে মনে করিয়ে দেবার জন্য! সেই লোকটি বা সেই ঘটনার সঙ্গে নিশ্চয় তেইশে ফেব্রুয়ারিরও কোনও একটা যোগ আছে, যেটা চিঠির দ্বিতীয় লাইনের সাংকেতিক অর্থ! কিন্তু কী সেটা হতে পারে? এই নতুন ব্যাখ্যাটা যদি নির্ভুল হয়, তাহলে চিঠির তৃতীয় লাইনে ‘I must have it’ বলতে ‘মুনস্টোন’ বোঝানো হয় নি, তার থেকে অনেক বেশি মূল্যবান কোনও জিনিস বোঝানো হয়েছে। সম্ভবত ২৩ তারিখের সঙ্গেও সেই জিনিসটার একটা যোগাযোগ আছে । এখন ভিক্টর ডিসুজার কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে মুনস্টোন কথাটার উল্লেখ মাত্রই কিরিট প্যাটেলের ডেরিক ওয়াকারের কথা মনে পড়বে। আরও হয়তো মনে পড়বে যে, ডেরিকের কাছ থেকে একটা মহামূল্য জিনিস ২৩শে ফেব্রুয়ারি উনি পেয়েছিলেন। কী পেয়েছিলেন, অবশ্যই আমার জানা নেই। তবু অনুমান করছি, সৎ উপায়ে সেটা পান নি। এখন ডেরিক ওয়াকারের মৃত্যু যদি সত্যি সত্যিই তেইশে ফেব্রুয়ারি হয়ে থাকে, তাহলে ব্যাপারটা আর অনুমানের পর্যায় থাকে না। কিরিট প্যাটেল খুব সম্ভবতঃ ডেরিক-কে হত্যা করে সেই মহামূল্য বস্তুটি আত্মস্যাৎ করেছিলেন! সেক্ষেত্রে একমাত্র প্রশ্ন, স্যাম ওয়াকার কি বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিল?
আমার দরজার পাল্লার পেছনে একটা বড় আফ্রিকার ম্যাপ। ওজো নামে আমার এক পুরনো নাইজেরিয়ান ছাত্র গত বছর ওটা আমাকে উপহার দিয়েছিল। এতদিন ধরে ম্যাপটা আছে, কিন্তু কোনদিন ম্যাপটা ভালো করে দেখি নি।আজ উঠে গিয়ে মন দিয়ে ওখান থেকে খুঁজে বার করলাম কালাহারি মরুভূমিটা ঠিক কোথায়। কালাহারি অবশ্য অনেকটা জায়গা জুড়ে। তার কোনখানে ডেরিকের মৃত্যু হয়েছে তা আমার জানা নেই। কিন্তু আমাকে জানতেই হবে যে, তেইশে ফেব্রুয়ারিতে ওঁর মৃত্যু হয়েছিল কিনা! হঠাৎ মনে হল তানজানিয়ার কোনও নিউজপেপারে নিশ্চয় ডেরিক ওয়াকারের মৃত্যুর খবর ছাপা হয়েছিল! ভিক্টর ডিসুজা যদি খবরটা জোগাড় করতে পারে, তাহলে তো চুকেই গেল। এক্স্যাক্ট ডেট না পেলেও, ওর কাছে যদি মোটামুটি জানতে পারি ডেরিক ওয়াকার কত বছর আগে মারা গেছে, তাহলে তানজানিয়ার নিউজপেপারগুলো ঘেঁটে দেখা যেতে পারে ডেরিকের মৃত্যুর কোন খবর ফেব্রুয়ারির শেষাশেষি কোথাও বেরিয়েছে কিনা। পত্রিকা পাবার খুব একটা অসুবিধা এখানে নেই। নিউ ইয়র্ক সিটি লাইব্রেরিতে পৃথিবীর নামী-দামী প্রায় সব পত্রিকারই পুরনো ইস্যু মাইক্রো-ফিল্ম-এ পাওয়া যায়।
এটা অবশ্য খুব ঘুরপথে এগানো। কিন্তু স্যাম ওয়াকারকে সোজাসুজি বাবার মৃত্যুর তারিখ জিজ্ঞেস করাটা হবে মুর্খামি। স্যাম যদি সত্যি সত্যিই কিরিট প্যাটেলকে খুন করে থাকে, তা হলে কোন রকম সন্দেহ জাগলে আমাকেও সে খুন করতে পারে! ভাবলাম প্রমথকে ফোন করে আমার কনক্লুশনটা বলি। কিন্তু ওকে পেলাম না।