সরকারবাড়ির জলমহালে মাছ মারবার জন্য এক দিন সকালে একদল কৈবর্ত এসে হাজির। সর্বমোট সাতটি নৌকার বিরাট একটা বহর। স্থানীয় কৈবর্ত ধারণাও করতে পারে নি, বাইরের জেলেদের মাছ-মারার ব্যবস্থা দেওয়া হয়েছে। খবর পেয়ে স্থানীয় কৈবর্তদের প্রধান নরহরি দাস ছুটে এল। নিজাম সরকার গম্ভীর হয়ে বললেন, তোমরার কাছে মাছ ধরার বড় জালই নাই। তোমরা মহালের মাছ ধরবা কী দিয়া?
এইডা কী কথা কইলেন সরকার সাব! মাছ ধরাই আমরার কাম, আর জাল থাকত না? আসল কথাডা কী চৌধুরী সাব?
আসল কথা নকল কথা কিছু নাই, নরহরি। নিজ গোরামের লোক দিয়া আমি কাম করাইতাম না।
আমরা দোষটা কী করলাম? সারা বচ্ছ জলমহালের দেখশোন করলাম। এখন পুলাপান লইয়া কই যাই?
নরহরি দাস হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।
বিদেশী কৈবর্ত-দলটি রাতারাতি জলমহালের পার্শ্বে ঘরবাড়ি তুলে ফেলল। গাবের কষে জাল ভিজিয়ে প্রকাও সব জাল রোদে শুকাতে লাগল। ওদের মেয়েরা উদোম গায়ে শিশুদের দুধ খাওয়াতে-খাওয়াতে এমন ভাবে হাঁটাচলা করতে লাগল, যেন এই জায়গায় তারা দীর্ঘদিন ধরে আছে। রাতারাতি নতুন বসতি তৈরী হল। হাঁস-মুরগি চরছে। গরু দোয়ান হচ্ছে। সন্ধ্যার পর খোলা জায়গায় আগুন জ্বালিয়ে গান-বাজনার আয়োজনও হল। ঢোল বাজতে লাগল মধ্যরাত পর্যন্ত।
নরহরি দাস তাদের সঙ্গে আলাপ করে সুবিধা করতে পারল না। সরকারবাড়ির সঙ্গে নরহরির কী কথা হয়েছিল, তা তারা জানতে চায় না। তাদের চার মাসের করে আনা হয়েছে। মাছের ত্রিশ ভাগ নিয়ে মাছ ধরে দেবে, এইটিই একমাত্র কথা। নরহরির যদি কিছু বলবার থাকে, তাহলে তা সরকারবাড়ির সঙ্গেই হওয়া দরকার, তাদের সঙ্গে নয়।
মঙ্গলবার সকালবেলা কৈবর্তদের কুমারী মেয়েরা এলোচুলে জলমহালে নেমে পূজা দিল। পূজার ফলস্বরূপ অসম্ভব মাছ ধরা পড়বে, মাছ মারার কোনো রকম বিষ্ণু উপস্থিত হবে না। প্রথম যে-মাছটি ধরা পড়ল সেটি একটি দৈত্যাকৃতি কাতল। ডালায় সিঁদুর, ফুল এবং কাতলটি সাজিয়ে পাঠান হল সরকারবাড়ি। ঘনঘন উলু পড়তে লাগল নতুন কৈবর্তপাড়ায়।
মাছ মারা হয়েছে পুরোদমে। মাছখোলার পাশে একটি চালাঘর তোলা হয়েছে। আমিন ডাক্তার সেখানে খাতা-পেন্সিল নিয়ে সারা দিন বসে থাকে। কৈবৰ্তরা চিৎকার করে হিসাব মেলায়,
এক কুড়ি–এক
দুই কুড়ি-দুই।
তিন কুড়ি-নি
রাখ তিন। রাখ তিন। রাখ তিন।
চার কুড়ি–চার।
পাঁচ কুড়ি–পাঁচ
ছয় কুড়ি–ছয়।
রাখ ছয়। রাখ ছয়। রাখ ছয়।
আমিন ডাক্তারের ব্যস্ততার সীমা নেই। কত মাছ ধরা পড়ল, কত গেল, আর কত মাছ পাঠান হল খোলায়–সহজ হিসাব নয়। নাওয়াখাওয়ার সময় পর্যন্ত নেই।
খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা চৌধুরীবাড়ির মতো নয়। খাবার দেওয়া হয় বাংলাঘরে। একটি কামলা এসে ভাত দিয়ে যায়। মোটা চালের ভাত আর খেসারির ডাল। মেয়েরা কেউ পর্দার ফাঁক দিয়ে লক্ষ করে না। এই ব্যবস্থা আমিন ডাক্তারের ভালো লাগে। মেয়েরা কেউ পর্দার ফাঁক দিয়ে লক্ষ রাখছে জানলে তৃপ্তি করে খাওয়া যায় না। এখানে সে-ঝামেলা নেই। নিশ্চিন্ত মনে খাওয়া, তবু প্রতি বারেই খেতে বসার সময় চৌধুরীবাড়ির কথা মনে পড়ে।
শেষ দিন যখন খেতে গেল তখন খুব ভালো খাওয়াদাওয়ার আয়োজন। মাঝখানে চৌধুরী সাহেব এসে খোঁজ নিয়ে গেলেন।
শেষ কয়টা দিন তোমার কষ্ট হইল ডাক্তার, সময়টা আমার খারাপ পড়ছে, কী আর করবা কওঁ।
না-না চৌধুরী সাব, কী কন আপনি?
কোনো দিন চিন্তাও করছি না, আমার বাড়ির অতিথ চাইর পদের নিচে খানা খাইব।
চৌধুরী সাহেব কিছুক্ষণ থেকেই চলে গেলেন। খাওয়াদাওয়ার শেষে বৌটি। যথারীতি মিষ্টি গলায় বলল, পেট ভরছে ডাক্তার চাচা?
আমিন ডাক্তারের চোখে পানি এসে গেল। সে ধরাগলায় বলল, খুব খাইছি, মা।
বসেন, পান আনতে গেছে।
আমিন ডাক্তার থেমে থেমে বলল, অনেক ভদ্রলোক দেখছি মা এই জীবনে, কিন্তু চৌধুরীর মতো ভদ্রলোক দেখলাম না।
বৌটি অনেকক্ষণ কোন কথা বলল না। আমিন ডাক্তার যখন চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে, শান্ত গলায় বলল, ডাক্তার চাচা, আমার বিয়ার সময় এরা কিন্তু কয় নাই–ছেলেটা পাগল। ছয় বৎসর বিয়া হইছে, কিন্তু আমারে বাপের বাড়িত যাইতে দেয় না। আমার বাপ-চাচা গরিব মানুষ, তারা কী করব কন?
আমিন ডাক্তার স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। বৌটি মনে হল কাঁদছে। আমিন ডাক্তার থেমে থেমে বলল, মা আমি খাস মনে দোওয়া করছি, ছেলেটা বালা হইয়া যাইব। মাথার দোষ থাকত না। তুমি দেখবা, নিজেই দেখবা।
ঘর থেকে বেরুবার পরপরই পাগল ছেলেটা চেঁচাতে লাগল, এই শালা আমিন চোরা, তরে আইজ খুন কইরা ফাঁসি যাইয়াম। শালা তর এক দিন কি আমার এক দিন।
আমিন ডাক্তার জলমহালে ফিরে এসে দেখে তার ঘরে আজরফ বসে আছে।
কী রে আজরফ–কোনো খবর আছে?
জ্বিনা চাচা। বাজান আবার গেছে গিয়া।
কস কী? কই গেছে?
জানি না।
আজরফ চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়াতেই আমিন ডাক্তার দেখল, আজরফের চোখ ভেজা।
বিষয় কি আজরফ, কী হইছে?
জমি কিনার লাগিন যে টেকাপয়সা আছিল, বাজান সব লইয়া গেছে। পাতিলের মইধ্যে আছিল।
কান্দিস না, আজরফ। বেড়া মাইনষের কান্দন ঠিক না, উখ মোছ।
আজরফ শার্টের হাতায় চোখ মুছল।