সমাজের গতি ও প্রকৃতি
ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিন্যাস পাল-চন্দ্র-কম্বোজ যুগে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল, এবং বর্ণাশ্রম রক্ষণ ও পালনের দায়িত্ব এই যুগের বৌদ্ধরাষ্ট্রও স্বীকার করিত, এ সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও অবকাশ সত্যই নাই। কিন্তু বর্ণবিন্যাস এবং প্রত্যেক বর্ণের সীমা পরবর্তী কালে যতটা দৃঢ়, অনমনীয় এবং নানা বিধিনিষেধের সূত্রে শক্ত ও সুনির্দিষ্ট রূপে বাঁধা পড়িয়াছিল, এই যুগে তাহা হয় নাই। তাহার প্রধান কারণ, বাংলাদেশ তখনও পর্যন্ত তাহার নিজস্ব স্মৃতিশাসন গডিয়া তোলে নাই; বস্তুত, স্মৃতিশাস্ত্র রচনার সূত্রপাতই তখনও হয় নাই। দ্বিতীয়তঃ, এই যুগের সব ক’টি রাষ্ট্র এবং রাজবংশই বৌদ্ধধমাবলম্বী এবং বৌদ্ধ সংস্কারাশ্রয়ী; ইঁহারা ব্রাহ্মণ্যধর্মের পৃষ্ঠপোষক এবং ব্রাহ্মণ্য-সমাজ ব্যবস্থার ধারক ও পালক হইলেও —হিন্দুরাষ্ট্ৰীয় আদর্শে রাজার অন্যতম কর্তব্যই প্রচলিত সমাজ-ব্যবস্থার ধারণ ও পালন—উত্তর বা দক্ষিণ ভারতের ব্রাহ্মণ্য স্মৃতিশাসন ইঁহাদের নিকট একান্ত হইয়া উঠিতে পারে নাই। তৃতীয়তঃ, পালবাজবংশ উচ্চবর্ণোদ্ভব নয়; বর্ণ-হিসাবে ইহাদের ক্ষত্ৰিয়ত্বের দাবি “রামচরিত” ছাড়া আর কোথাও নাই, এবং তাহা রামপালের পিতা সম্বন্ধে। গোপাল বা ধর্মপাল বা দেবপাল সম্বন্ধে এ দাবি কেহ করে নাই; দশ-বার পুরুষ রাজত্ব করার পর একজন রাজা ও তাঁহার বংশ ক্ষত্ৰিয় বলিয়া পরিগণিত হইবেন ইহা কিছু আশ্চর্য নয়। যাহাই হউক, পালবংশ উচ্চবর্ণোদ্ভভ ছিলেন না বলিয়াই বোধ হয় তাঁহারা বর্ণশাসনের স্মৃতি-সুলভ সুদৃঢ় আচার-বিচার বা স্তরউপস্তরভেদ সম্বন্ধে খুব নিষ্ঠাপরায়ণও ছিলেন না। চতুর্থতঃ, বঙালী সমাজের অধিকাংশ লোকই তখনও বর্ণাশ্রম বহির্ভূত, অল্প সংখ্যক উচ্চশ্রেণীর লোকেরাষ্ট বর্ণাশ্রমের অন্তর্গত ছিল, যদি ও তাহার সীমা ক্রমশই প্রসারিত হইয়া চলিয়াছিল। কিন্তু ক্ৰমবৰ্দ্ধমান সীমার মধ্যে যাহারা আসিয়া অন্তর্ভূক্ত হইতেছিল তাহারা সকলেই আর্যপূর্ব কোম-সমাজের ও সেই সমাজগত সংস্কার ও সংস্কৃতির লোক। ব্রাহ্মণ্য সমাজ-ব্যবস্থা, সংস্কার ও সংস্কৃতি তাহারা মানিয়া লইতেছিল অর্থনৈতিক আধিপত্যের চাপে পড়িয়া। ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিন্যাসের সূত্রের মধ্যে তাহাদের গাঁথিয়া লওয়া খুব সহজ হয় নাই; অন্তত পাল ও চন্দ্ররাষ্ট্র সচেতন ও সক্রিয়ভাবে সেদিকে চেষ্টা কিছু করিয়াছিল বলিয়া তো মনে হয় না, প্রমাণও কিছু নাই। রাষ্ট্রীয় চাপ সেদিকে কিছু ছিল না; রাষ্ট্রের সামাজিক দৃষ্টিও এবিষয়ে উদার ছিল। আমার এই শেষোক্ত অনুমানের সুস্পষ্ট সুনির্দিষ্ট প্রমাণ কিছু নাই, তবে সমসময়িক রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থায় সমাজ-ব্যবস্থার গতি-প্রকৃতি যাহা হওয়া সম্ভব ও স্বাভাবিক তাহাই অনুমানের রূপে ও আকারে ব্যক্ত করিলাম। হিন্দুধর্ম ও সমাজের স্বাঙ্গীকরণক্রিয় আজও যে যুক্তিপদ্ধতি অনুসারে চলিতেছে বিভিন্ন আর্যপূর্ব গোষ্ঠী ও কোম গুলিতে, সেই যুক্তিপদ্ধতিই এই অল্পমানের সাক্ষ্য ও সমর্থক। তাহা ছাড়া, এই অনুমানের পশ্চাতে রহিয়াছে, পরবর্তী যুগের বিশেষভাবে সেন-বর্মণ আমলের বাংলার বর্ণ ও সমাজ-বিন্যাসের ইতিহাস এবং বাংলার মধ্যযুগের ইতিহাস ও সংস্কৃতির সাক্ষ্য।