সদানন্দ ভাবে : আমি নিজে যে কি সাধনা করছি, আমি নিজে তা জানি না কেন? সাধনার কোন স্তরে আমি পৌঁছেছি, আমার চেয়ে মহেশ চৌধুরী তা বেশি জানে কেন? ব্যাপারখানা কি?
নিজের কাছে ফাঁকি খুব ভালোরকমেই চলে কিনা, সদানন্দ তাই ভাবিয়া পায় না ঠিক কোন্ প্রক্রিয়ায় কি ভাবে কোন সাধনাটা সে কবে করিয়াছে। আসন করিয়া অনেক সময় বসিয়া। থাকিয়াছে বটে, আবার অনেক সময় বসিয়া থাকেও নাই। কিন্তু আসন করিয়া বসিয়া থাকিলেই কি সাধনা হয়, আর কোনো রীতিনীতি নিয়ম-কানুন সাধনের নাই? আসন করিয়া বসিয়াই থাক আর বিছানায় চিৎ হইয়া পড়িয়াই থাক, চিন্তা সে যে একরকম সব সময়েই করে, জীবনের তুচ্ছতম বিষয়টির মধ্যে রহস্যময় দুর্বোধ্যতা আবিষ্কার করা হইতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিরাট রহস্যগুলির ফাঁকি ধরিয়া ফেলা পর্যন্ত নানা ধরনের বিচিত্র চিন্তায় মশগুল হইয়া সে যে দিন কাটাইয়া আসিতেছে, এটা তার খেয়াল হয় না। দিনের পর দিন নিজেকে নূতন চেনায় চিনিয়াছে, আবার নূতন অচেনায় আত্মহারা হইয়া গিয়াছে। এ ব্যাপারটাকে সদানন্দ সাধারণ বাঁচিয়া থাকার পর্যায়েই ফেলে। এক একজন মানুষ থাকে যারা ঘরে বসিয়া এলোেমলো লেখাপড়া করে, আগে শেষ করে দ্বিতীয়ভাগ, তারপর ধরে প্রথমভাগ, জ্ঞান হয়তো তাদের জমা হয় অনেক ডিগ্রিধারী নামকরা জ্ঞানীর চেয়ে বেশি, কিন্তু জ্ঞান বলিয়া কিছু যে তারা সংগ্রহ করিয়াছে, এ ধারণাটাই তাদের মনে আসে না। ধাপে ধাপে সিঁড়ি ভাঙিয়া যেখানে উঠিতে হয়, বাঁশের খুঁটি বাহিয়াও যে সেইখানেই উঠিয়া পড়িয়াছে, উঠিবার পরও অনেকে তা বিশ্বাস করিতে চায় না। সাধু-সন্ন্যাসীর যোগসাধনার বিষয়ে একেবারে অজ্ঞ হইলেও বরং কথা ছিল এসব যে ছেলেখেলা নয়, সদানন্দ তা ভালো করিয়াই জানে। নিজের অজ্ঞাতসারে সাধনার পথে অগ্রসর হইয়া চলা এবং কঠিন ও বিপজ্জনক অবস্থায় আসিয়া পৌঁছানো যে কেমন করিয়া সম্ভব হইতে পারে, কোনোমতেই তার মাথায় ঢুকিতে চায় না।
রাতদুপুরে ঘুম আসে না। অনেকক্ষণ ছটফট করিয়া মহেশ চৌধুরীকে ডাকিয়া পাঠায়।
ভয় করছে প্ৰভু?
প্ৰশ্ন শুনিবামাত্র সদানন্দ টের পায়। এতক্ষণ ভয়ই করিতেছিল বটে। একটা দুর্বোধ্য বীভৎস আতঙ্ক মনের মধ্যে চাপিয়া বসিয়াছে।
তবু সাহস করিয়া সদানন্দ বলে, তুমি ভুল করছ মহেশ। আমি তো কোনোদিন সাধন-ভজন কিছু করি নি।
রাতদুপুরে জেগে বসে এই যে হিসাব করছেন সাধন-ভজন কিছু করেছেন নাকি, এটা কি প্ৰভু?
সদানন্দ অবাক হইয়া চাহিয়া থাকে।
জোড় হাতে সবিনয়ে মহেশ চৌধুরী সদানন্দকে নানারকম উপদেশ দেয়। সদানন্দ নিজে কেন। জানে না সে সাধক? কেন জানিবে! সাধক যে নিজেকে সাধক বলিয়া জানে, সেই জানাটা কি, সদানন্দ কি কখনো ভাবিয়া দেখিয়াছে? অনন্যসাধারণ প্রক্রিয়াগুলি ওই জ্ঞানের জন্ম দেয় আর যতদিন সাধক ওই জ্ঞানকে একেবারে ভুলিয়া যাইতে না পারে, ততদিন সিদ্ধিলাভের কোনো ভরসাই থাকে না। সদানন্দের জানিবার তো কোনো কারণ ঘটে নাই যে সে সাধনা করিতেছে, প্রক্রিয়া সে ঠিক করিয়া গিয়াছে নিজে, ও সব তার কাছে বাঁচিয়া থাকারই অঙ্গস্বরূপ। তাছাড়া, যে রকম সাধনা সে কোনোদিন করে নাই, লোকের কাছে নিজেকে সেইরকম সাধক বলিয়া পরিচিত করার ফলে মনে মনে একটা তার ধারণা জন্মিয়া গিয়াছে যে, সাধনার ব্যাপারে সে ফাঁকিবাজ। আসলে কিন্তু
আমি যে ফাঁকিবাজ তাও দেখছি তুমি জান মহেশ?
ফাঁকিবাজ তো আপনি নন প্রভু!
সদানন্দ চটিয়া বলে, এই বলছ লোককে ফাঁকি দিই, সঙ্গে সঙ্গে আবার বলছ ফাঁকিবাজ নই, তোমার কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারি না মহেশ।
আজ্ঞে, দশজনকে জানিয়েছেন, আপনি সাধু তাতে তো ফাঁকিবাজি কিছু নেই। দশজনের ভালোর জন্য নিজেকে সাধু ঘোষণা করাও সাধু ছাড়া অন্যের দ্বারা হয় না প্রভু। নিজের জন্য তো চান নি, লোকে সাধু ভাবুক, অসাধু ভাবুক, আপনার বয়ে গেল!
সদানন্দ সন্দিগ্ধভাবে মাথা নাড়িয়া বলে, নিজের জন্য চেয়েছিলাম কিনা কে জানে!
না প্ৰভু, না। তাই কি আপনি পারেন?
খানিক পরে প্রকারান্তরে সদানন্দ মহেশ চৌধুরীকে এখানে শুইয়া থাকার অনুরোধ জানায়, কিন্তু মহেশ রাজি হয় না। বলে যে, ভয়কে এড়াইবার চেষ্টা করিলে তো চলিবে না, ভয়কে জয় করিতে হইবে।
মহেশ চৌধুরীর তুলনায় নিজেকে সদানন্দের অপদার্থ মনে হয়।
গভীর হতাশায় মন ভরিয়া যায়, রাগের জ্বালায় দেহের কি যেন সব পুড়িয়া যাইতে থাকে। মহেশ চৌধুরীর বাঁচিয়া থাকার কোনো মানে হয় না, এই ধরনের উদ্ভট চিন্তা অসংখ্য খাপছাড়া কল্পনার আবরণে আসিয়া ভিড় করে। ক্রমে ক্রমে একটা বড় আশ্চর্য ব্যাপার সে লক্ষ করে। মহেশ চৌধুরীর একটা বড় রকম ক্ষতি করার চিন্তাকে প্রশ্রয় দিলেই হঠাৎ নিজেকে যেন তার সুস্থ মনে হইতে থাকে, দেহ মনের একটা যন্ত্রণাদায়ক অসুস্থ অবস্থা যেন চোখের পলকে জুড়াইয়া যায়। যে আতঙ্কময় ফাপরাপর ভাবটা আজকাল তাকে থাকিয়া থাকিয়া আক্ৰমণ করে, আর যেন তার পাত্তাই পাওয়া যায় না। মহেশ চৌধুরীকে মনে মনে হিংসা করিবার সময়টা জাগ্ৰত স্বপ্নের প্রভাব হইতে সে মুক্তি পায়, মাথার ঝিমঝিমানি একেবারে বন্ধ হইয়া যায়। বাতাসে ভাসিয়া বেড়ানোর বদলে হঠাৎ যেন শক্ত মাটিতে দাঁড়াইয়া আছে বলিয়া টের পায়।
মহেশ চৌধুরীকে তীব্রভাবে ঘৃণা করিয়া, দশজনের কাছে তাকে হীন প্রতিপন্ন করার সম্ভব অসম্ভব মতলব আঁটিয়া, আর নিজেকে তার চেয়ে ছোট মনে করার প্রতিক্রিয়ায় জর্জরিত হইয়া গিয়া, সদানন্দ আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। অন্তত তার তাই মনে হয়। ভয়টা যে এড়ানো যায়, রক্ত চলাচল শ্লথ করিয়া দেওয়ার মতো উত্তেজনাবিহীন সর্বগ্রাসী ভয়, তাও কি কম? মহেশ চৌধুরী অবশ্য ভয় এড়ানোর চেষ্টা করিয়াছে, কিন্তু এসব ব্যাপারের সে কি বোঝে, কি দাম আছে তার উপদেশের? সদানন্দকে উপদেশ দিতে আসে, স্পর্ধাও কম নয় লোকটার!
দিন কাটিয়া যায়। মহেশ চৌধুরী শান্ত চোখে সদানন্দের চালচলন আর ভাবভঙ্গি লক্ষ করে। মুখখানা যেন তার দিন দিন অল্পে অল্পে বিষণ্ণ ও গম্ভীর হইয়া উঠিতে থাকে।
একদিন মহেশ চৌধুরী বলে, প্ৰভু?
সদানন্দ একটা শব্দ করে, যেটা জবাব হিসাবে ধরা যায়, আবার অবজ্ঞা হিসাবেও ধরা যায়।
আর এগোতে পারছেন না প্রভু, না?
কিসের এগোতে পারছি না? কে বললে তোমাকে, এগোতে পারছি না?
মহেশ চৌধুরীর চোখ ছলছল করিতে থাকে, এগোতে না পারলে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন, পিছিয়ে আসছেন কেন প্রভু? এখন পিছু হটতে শুরু করলে কি আর উপায় আছে। প্রথমটা একটু ভালো লাগে, কিন্তু দুদিন পরে নিজের হাত-পা কামড়াতে ইচ্ছা হবে। এমন যন্ত্রণা পাবেন, এখন তা ভাবতেও পারবেন না।
তোমার উপদেশ বন্ধ কর তো মহেশ।
উপদেশ নয়, কথাটা মনে পড়িয়ে দিচ্ছি। নিজেই বুঝে দেখুন, কি বিপদ ঘটাচ্ছেন নিজের।
সম্পূৰ্ণ বুঝিতে না পারলেও সদানন্দ কিছু কিছু বুঝিতে পারে। মহেশ চৌধুরীর সম্মুখ হইতে ছুটিয়া পালানোর এরকম জোরালো ইচ্ছা আগে তার হইত না এবং মহেশ চৌধুরীর দিকে চোখ তুলিয়া চাহিবার কাজে এতটা শক্তিক্ষয়ও করিতে হইত না! নূতন একটা অনুভূতি আজকাল তার কাছে ধরা পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে, মানুষের জীবনের ব্যর্থতার অনুভূতি। অনুভূতিটা একেবারে নূতন, এ পর্যন্ত চাপা পড়া সঙ্কেতের মতো কোনোদিন অনুভব করে নাই। মানুষের জীবনের ব্যর্থতার কথা অবশ্য সে অনেক ভাবিয়াছে, মাঝে মাঝে গভীর বিষাদে হৃদয় ভারাক্রান্ত হইয়া উঠিয়াছে, কিন্তু সে যেন ছিল অন্য জিনিস। রোগে শোকে একজন মানুষকে কষ্ট পাইতে দেখিলে সহানুভূতির মধ্যে যে বিষাদ জাগিত, সমস্ত মানুষের জীবনের মূল্যহীনতা জাগাইয়া তুলিত সেই বিষাদ। কিন্তু এখন সে যা অনুভব করে, সেটা যেন ঠিক বিষাদ নয়। মানুষের বাঁচিয়া থাকার কোনো অর্থ নাই, তার নিজের জীবনটা ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে, আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত লোক বাঁচিয়া ছিল, তাহাদের জীবনও ব্যর্থ এবং ভবিষ্যতে যত লোক পৃথিবীতে বাঁচিয়া থাকিবে, তাদের জীবনও ব্যর্থ–কিন্তু তাতে যেন কিছু আসিয়া যায় না। ব্যর্থতার চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর নাই, জীবনের প্রতিকারহীন জীবনব্যাপী ব্যর্থতা। অথচ তাও যেন সদানন্দের কাছে তুচ্ছ হইয়া গিয়াছে। নির্বিকার ভেতা একটা ক্ষোভ শুধু সে অনুভব করে। জ্বর আসিবার আগে শরীর ম্যাজম্যাজ করার মতো এটা কি ভয়ানক কিছুর সূচনা? মহেশ চৌধুরীর আলোচনা এই প্রশ্ন আর ভয় তার মধ্যে জাগাইয়া দেয়।
মহেশ চৌধুরীর ভক্তিশ্রদ্ধা ক্ৰমে ক্ৰমে যেন কমিয়া আসিতে থাকে। জোড় হাতে ছাড়া সদানন্দের সঙ্গে সে একরকম কথাই বলিত না, আজকাল হাত জোড় করিতে ভুলিয়া যায়। প্ৰভু শব্দটাও তার মুখে শোনা যায় কদাচিৎ। মহেশ চৌধুরীর ভক্তি শেষের দিকে সদানন্দকে বিশেষ কিছু তৃপ্তি দিত না, কিন্তু ভক্তির অভাব ঘটায় আজকাল তার ভয়ানক রাগ হয়।
সভায় কথা বলিতে বলিতে হঠাৎ থামিয়া গিয়া সে সকলের মুখের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চাহিয়া দ্যাখে। মহেশ চৌধুরীর মতো অন্য সকলের ভক্তিশ্রদ্ধাও কি কমিয়া গিয়াছে? এতকাল যাদের সে শিশু মনে করিয়া আসিয়াছে, মতামত নিয়া কোনোদিন মাথা ঘামায় নাই, আজকাল তাদের তাকানোর ভঙ্গিতে অনুকম্পা আর অবজ্ঞা আবিষ্কার করিয়া বুকের মধ্যে হঠাৎ তার ধড়াস করিয়া ওঠে। কি করিয়াছে সে? কার কাছে কি অপরাধ করিয়াছে? কার সঙ্গে কিসের বাধ্যবাধকতায় সে আটক পড়িয়া গিয়াছে? দেহবাদী এইসব অপদাৰ্থ মানুষ কেন তাকে সর্বদা ইঙ্গিত করিতেছে, আমরা কাপুরুষ, কিন্তু হে মহাপুরুষ, তোমার চেয়ে কত সুখেই আমরা বাঁচিয়া আছি।
নিছক ভাবপ্রবণতা? যে জিনিসটা চিরদিন সে এড়াইবার চেষ্টা করিয়াছে? বুঝিয়াও সদানন্দ যেন বুঝিতে পারে না। কোটা মনের দুর্বলতা জানিবার পরেও সেটাকে দমন করা যে এমন কঠিন ব্যাপার, এতকাল তার জানা ছিল না। আগে ঘরের কোণে নিজের ছেলেমানুষির কথা ভাবিয়া তার হাসি পাইত, এমন তুচ্ছ একটা বিষয়কে এত বড় করিয়া তুলিয়াছে কেন ভাবিয়া অবাক হইয়া যাইত আজকাল ছেলেমানুষিকে প্রশ্রয় দেওয়ার দুর্ভাবনায় মাথা যেন তার ফাটিয়া যাওয়ার উপক্রম করে। হাত-পা নাড়ায় বাধা দিলে শিশু যেমন ক্ষেপিয়া যায়, ছেলেমানুষিকে উড়াইয়া দিবার। চেষ্টায় ব্যর্থ হইয়া সদানন্দের সেইরকম উন্মাদের মতো আর্তনাদ করিতে ইচ্ছা যায়।
একবার বিপিন আসিয়া বলে, তোর চেহারাটা বড় খারাপ হয়ে গেছে সদা।
সদানন্দ রাগিয়া বলে, গেছে তো গেছে, তোর কি?
বিপিন উদাসভাবে বলে, আমার আবার কি! তুই মরলেই বা আমার কি?
ফিরে যাওয়ার সময় মহেশ চৌধুরীর সঙ্গে বিপিনের দেখা হয়। বিপিন হাসিয়া বলে, সাধুজীকে খেতে দেন না নাকি? মুখের চামড়া যে কুঁচকে যেতে আরম্ভ করেছে মশায়?
মহেশ চৌধুরী বলে, না খেলে কি মুখের চামড়া কুঁচকে যায় ভাই? নিজে কুঁচকে দিচ্ছেন, মুখের চামড়ার কি দোষ! বিষণ্ণভাবে মহেশ চৌধুরী মাথা নাড়ে কত আশা করেছিলাম, সব নষ্ট হয়ে গেল। কি খেলাই যে ভগবান খেলেন। এমন একটা মানুষ আমি আর দেখি নি বিপিনবাবু, অবতার বলা চলত। কি যে হল, নিজেই নিজেকে ধ্বংস করে ফেলেছেন।
বিপিন অবাক হইয়া চাহিয়া থাকে।
মহেশ চৌধুরী আবার বলে, গুরুর নির্দেশ মেনে সারা জীবন প্রাণপাত করে বড় বড় যোগী ঋষি যে স্তরে উঠতে পারেন না, উনি নিজের স্বাভাবিক প্রেরণায় বিনা চেষ্টায় সে স্তরে পৌঁছেছিলেন। এক একবার আমি ভাবি কি জানেন, আমিই ভুল করলাম নাকি? আমি সচেতন করিয়ে দিয়েছি বলে কি বিগড়ে গেলেন? যেমন অবস্থায় ছিলেন সে অবস্থায় থাকলে হয়তো নিজের চেষ্টায় আপনা থেকে সামলে এগিয়ে চলতেন।
মহেশ চৌধুরীর আফসোস দেখিয়া বিপিন আরো অবাক হইয়া যায়। এতকাল লোকটাকে একটু পাগলাটে বলিয়া তার ধারণা ছিল, আজ হঠাৎ যেন ধারণাটা নাড়া খায়। খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া মহেশ চৌধুরী আবার বলে, এসব লোকের প্রচণ্ড তেজ আর শক্তি থাকে। যেই জেনেছেন সাধনার পথে এগোতে হবে, অমনি বিদ্রোহ করে বসেছেন। সামনে এগিয়ে দেবার জন্য আমি একটু আধটু ঠেলা দিয়েছি বলেই বোধহয় রাগ করে পিছু হটতে আরম্ভ করেছেন। কি সর্বনাশটাই আমি করলাম বিপিনবাবু?
যা করেছেন, ভালো উদ্দেশ্যেই তো করেছেন।
তবু আমার ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করাই উচিত ছিল।
দিন দশেক পরে মহেশ চৌধুরী একদিন সকালে বিপিনের আশ্রমে গেল। বিপিন আশ্রমে ছিল না, উমা আর রত্নাবলী মহেশকে আদর করিয়া বসাইল। আজকাল মহেশ চৌধুরীর সম্মান বাড়িয়াছে–মাধবীলতা তার ছেলের বৌ!
রত্নাবলী বলিল, আপনার ওখানে এবার আমাদের থাকবার ব্যবস্থা করে দিন?
মহেশ হাসিয়া বলিল, আমাদের ওখানে কি কারো থাকবার ব্যবস্থা আছে?–গিয়ে থাকতে
হয়।
উমা বলিল, আমাদের যেতে দিতে আপনি আপত্তি করছেন কেন বুঝতে পারি না।
আপত্তি? আপত্তি কিসের! তবে জানেন আপনারা গেলে বিপিনবাবু রাগ করবেন কিনা, তাই আপনাদের নিয়ে যাই নি।
বিপিনবাবু রাগ করবেন বলে ইচ্ছে হলে আমরা কোথাও যেতে পারব না। আমরা কি বিপিনবাবুর কয়েদি নাকি?
উঁহু, তা কেন হবেন। আপনাদের ইচ্ছে হলে আপনারা যেখানে খুশি যাবেন, কিন্তু আমার কি নিয়ে যাওয়া উচিত? সে রকম ইচ্ছেও আপনাদের হয় নি যাওয়ার, হলে আপনারা নিজেরাই যেতেন,
জোর করে যেতেন।
থাকতে দিতে গেলে?
থাকতে দিতাম বৈকি।
রত্নাবলী একটু খোঁচা দিয়া বলিল, কিন্তু বিপিনবাবু যে রাগ করতেন?
মহেশ সহজভাবেই বলিল, রাগ করলে কি আর করতাম বলুন। আমি আপনাদের নিয়ে যাই। নি, আপনারা নিজের ইচ্ছায় গিয়েছেন। তাতেও যদি বিপিনবাবু রাগ করতেন–করতেন!
আপনি আশ্চর্য মানুষ! উমা বলিল।
উচিত অনুচিত জ্ঞানটা আপনার যেন একটু বেশি রকম সূক্ষ্ম। সব ব্যাপারেই কি এমনি করে বিচার করেন? রত্নাবলী জিজ্ঞাসা করিল।
বিবেক বড় কামড়ায় কিনা, বিচার না করে উপায় কি? বিবেকের কামড় এড়বার সহজ উপায় থাকতে জেনেশুনে সাধ করে কামড় খাওয়া কি বোকামি নয়?
জীবনটা একঘেয়ে লাগে না আপনার? রত্নাবলী জিজ্ঞাসা করিল।
কেন, একঘেয়ে লাগবে কেন? সবাই বিচার করে কাজ করে, আমিও করি। অন্য দশজনে নিজের নিজের বুদ্ধি বিবেচনামত কর্তব্য ঠিক করে, আমিও তাই করি। কেউ জেনেশুনে ভুল করে, কেউ বুদ্ধির দোষে ভুল করে, কেউ কেউ আবার করছে কি না করছে গ্রাহ্য করে না। আমি একটু চালাক মানুষ কিনা, তাই সব সময় চেষ্টা করি যাতে ভুল না হয়। তবু আমিও অনেক ভুল করে বসি। আমার যদি একঘেয়ে লাগে, তবে পৃথিবীর সকলেরই একঘেয়ে লাগবে।
আপনিও তবে ভুল করেন?
করি না? মারাত্মক ভুল করে বসি। সাধুজীকে নিয়ে গিয়ে একটা ভুল করেছি।
উমা ও রত্নাবলী দুজনেই একসঙ্গে বলে, বলেন কি!
আজ্ঞে হ্যাঁ! জীবনে এমন ভুল আর করি নি।
উমা আর রত্নাবলী মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।–কিন্তু বিপিনবাবু ওকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন বলেই তো আপনি–
মহেশ চৌধুরী মাথা নাড়িয়া বলিল, না না, তাড়াবেন কেন? দুজনে একটু মনোমালিন্য হয়েছিল, বন্ধু কিনা দুজনে। বিপিনবাবু তাই রাগ করে—যাকগে, কি আর হবে ওসব কথা আলোচনা করে?
ঘণ্টাখানেক পরে বিপিন ফিরিয়া আসিলে মহেশ চৌধুরী তাকে আড়ালে ডাকিয়া নিয়া গেল। তাকে আশ্রমে দেখিয়াই বিপিন অবাক হইয়া গিয়াছিল, প্রস্তাব শুনিয়া তার বিস্ময়ের সীমা রহিল না।
ওকে ফিরিয়ে আনতে বলছেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ। আগের অবস্থায় ফিরে এলে হয়তো আত্মসংবরণ করতে পারবেন।
ও কি ফিরে আসবে?
আসবেন বৈকি।
বিপিন চুপ করিয়া থাকে। মাঝে মাঝে চোখ তুলিয়া তাকায় আর চোখ নামাইয়া নেয়। তারপর হঠাৎ বলে, দেখুন আপনাকে সত্যি কথা বলি। মাঝে মাঝে আমি যে আপনার ওখানে যেতাম, আমার একটা উদ্দেশ্য ছিল। সদা চলে যাওয়ার পর আমার কতগুলি ভারি মুশকিল হয়েছে। তাছাড়া ছেলেবেলা থেকে আমরা বন্ধু, ওকে ছেড়ে থাকতেও কেমন কেমন লাগছে। তাই ভেবেছিলাম, বলে কয়ে আবার ফিরিয়ে আনব। আমি অনেক বলেছি, ও কিন্তু রাজি হয় নি।
মহেশ চৌধুরী বলিল, তা জানি। আমিও ওই রকম অনুমান করছিলাম।
বিপিন চোখ বড় বড় করিয়া চাহিয়া থাকে।
মহেশ চৌধুরী আবার বলিল, এতকাল রাজি হন নি, এবার বললেই রাজি হবেন। এখানে উনি ভয়ানক যন্ত্রণা পাচ্ছেন।