চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
সক্রেটিসের রহস্য
মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় যে সব ব্যাপারে আপনার মতের মিল হবে না কখনই সেইরকম কিছু দিয়ে শুরু করবেন না। প্রথমেই যে বিষয়ে আপনার মতের মিল হয় তা দিয়েই আরম্ভ করে বার বার সেটাই বলতে থাকুন বারবার জানান মোটামুটি সব ব্যাপারই আপনাদের মত একুই, শুধু উপায় সম্বন্ধে দ্বিমত থাকতে পারে।
অন্য লোকটিকে গোড়াতেই ‘হ্যাঁ’ বলতে দিন। যতদূর সম্ভব তাকে ‘না’ বলতে দেবেন না।
এ ব্যাপারে অধ্যাপক ওভারস্ট্রীট তার বই ‘ইনফ্লুয়েন্সিং হিউম্যান বিহেভিয়ার’-এ বলেছেন যে, ‘না’ কথাটা একবার বললে তাকে কাটানো কঠিন কাজ। কোন লোক না বললে তার সব আত্ম অহমিকাই তাকে ওটাই আঁকড়ে থাকতে বলে। সে হয়তো পরে বুঝতে পারে ‘না’ বলাটা ঠিক হয়নি। তা সত্ত্বেও তার অহমিকাই তাকে তার মত বদলাতে দেয় না। একবার কিছু বললে সে সেটাই আঁকড়ে থাকতে চায়। তাই এটা অত্যন্ত জরুরী যে আমরা কাউকে সায় দেয়াতে পারলেই ভাল।
যারা দক্ষ বক্তা তারা গোড়াতেই বার কযেক ‘হ্যাঁ’ বলাতে পারেন। তিনি এতে তাঁর শ্রোতাদের মানসিক দিক থেকে স্বমতে আনার পথেই নিয়ে আসেন। এটা অনেকটা বিলিয়ার্ড বলের মত। বলটাকে জোরে ধাক্কা মারুন। সেটা একদিকে ধাক্কা খেয়ে সহজেই বিপরীত দিকে চলে যায়।
এতে মনস্তাত্বিক ব্যাপারটা সহজেই বোঝা যায়। কোন লোক যখন ‘না’ বলে, সে ওই ছোট্ট কথাটার চেয়ে অনেক বেশি কিছুই করে। তার সমস্ত শারীরিক যন্ত্রই, স্নায়ু, পেশী–সব কিছুই বাতিল করতে তৈরী থাকে। সাধারণতঃ ক্ষুদ্র হলেও শারীরিক যেসব পরিবর্তন হয় তার কিছু প্রকাশ প্রত্যক্ষও করা যায়। শরীরের সমস্ত রকম অনুভূতিই বাধা দিতে যেন তৈরি হয়ে যায়। অন্যদিকে কেউ ‘হ্যাঁ’ বললে ওই বাধা দেবার ব্যাপারটার অস্তিত্বই থাকে না। সমস্তই শরীরের কোষগুলো গ্রহণ করার জন্য এগুতে চায়। তাই গোড়াতেই ‘হ্যাঁ’ বললে আমরা সহজেই অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেও সফল হতে পারি।
এই ব্যাপারটা–অর্থাৎ এই হ্যাঁ বলা কৌশল খুবই সহজ ব্যাপার। অথচ এটাকে কতটাই বা অবজ্ঞা করা হয়। এতে যেন মনে হয় মানুষ গোড়াতেই যেন অন্যকে ক্রুদ্ধ করে নিজের গুরুত্ব প্রমান করার প্রয়াসী। বিপ্লবীদের সঙ্গে রক্ষণশীলদের কথাবর্তায় গোড়াতেই তারা একে অন্যকে চটিয়ে দেয়। এতে কি ভালো কাজ সমাধা হতে পারে? যদি অবশ্য কিছুটা আনন্দ উপভোগের জন্য করতে চান তাহলে আলাদা কথা। কিন্তু সে যদি এটা করে কিছু করতে চায় তাহলে তাকে মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে একেবারে মূর্খই বলতে হয়!
কোন ছাত্র, ক্রেতা, শিশু, স্বামী বা স্ত্রীকে গোড়াতেই ‘না’ বলতে দিন, দেখবেন হাজার ধৈর্য বা অধ্যবসায়তেও তাকে আর নিজের মতাবলম্বী করতে পারবেন না।
এই ‘হ্যাঁ হ্যাঁ বলার কৌশলে নিউইয়র্কের গ্রীনউইচ সেভিংস ব্যাঙ্কের জেমস এভারসন একজন বিখ্যাত মক্কেলকে হারাতে হারাতে আবার স্বমতে এনেছিলেন।
ঐ ভদ্রলোক ব্যাঙ্কে একটা অ্যাকাউন্ট খুলতে এসেছিলেন। মিঃ এভারসন লিখেছিলেন, আমি তাকে একটা ফরম ভর্তি করতে দিয়েছিলাম। কোন কোন প্রশ্নের তিনি আনন্দেই উত্তর লিখলেন, তবে কয়েকটার উত্তর তিনি কিছুতেই দিতে রাজি হলেন না।
মানবিক সম্পর্ক নিয়ে পড়াশোনা আরম্ভ করার আগে, আমি হয়তো বলতাম যে তিনি যদি ব্যাঙ্ককে এইসব জবাব না দেন তাহলে তার অ্যাকাউন্ট খুলতে আমরা অপারগ। আমি বলতে লজ্জা পাচ্ছি অতীতে এই কাজই আমি করেছি। স্বভাবতই ওই রকম শেষ কথা বলে আমি বেশ আনন্দ পেতাম। আমি তাদের দেখাতাম আসল কর্তা কে আর ব্যাঙ্কের নিয়ম বদলানো যাবে না। কিন্তু ওই ধরনের মনোভাবকে নিশ্চয়ই যে আমাদের সাহায্য করতে চায় সে গ্রহণ করবে না।
‘আমি আজ সকালে ঠিক করলাম একটু বুদ্ধিমানের মত কাজ করব। আমি স্থির করলাম ব্যাঙ্ক কি চায় সে সম্পর্কে কথা না বলে আমাদের মক্কেল কি চান তাই নিয়ে কথা বলব। আর সবার উপরে আমি তাকে ‘হ্যাঁ’ বলাতেই চাইবো একদম গোড়া থেকেই। অতএব আমি তার সঙ্গে একমত হলাম। আমি তাকে জানালাম যে খবর তিনি দিতে অনিচ্ছুক সেগুলো তেমন প্রয়োজন নেই।
যাইহোক আমি বললাম, ধরা যাক আপনার মৃত্যুর পর এই ব্যাঙ্কে টাকা রয়ে গেল। আপনি কি চাইবেন না সে টাকা ব্যাঙ্ক আপনার উত্তরাধিকারীকে দিক?
‘হ্যাঁ, তা অবশ্যই চাইব’, তিনি বললেন।
‘তা বলে কি চাইবেন না। আপনি তার নামটা আমাদের জানাতে, যাতে আমরা দ্রুত কাজ করতে পারি?’
‘আবার তিনি বললেন ‘হ্যাঁ’।
‘তরুণ লোকটির মনোভাব একেবারেই বদলে গেল যখনই তিনি বুঝতে পারলেন খবরগুলো আমরা আমাদের জন্যে চাইছিনা বরং তারই জন্য চাই। ব্যাঙ্ক ত্যাগ করে যাওয়ার সময় শুধু যে সমস্ত খবরই দিলেন তাই না তিনি একটা ট্রাষ্ট অ্যাকউন্টও খুললেন তার মাকে উত্তরাধিকারী করে। আর তার মার সম্বন্ধে স্বইচ্ছাতেই সব খবর দিয়ে দিলেন।
আমি বললাম তাকে হা’ বলাতে পেরে একেবারে গোড়াতেই তিনি সব বিরোধিতা ভুলে গেলেন আর এর পরিসমাপ্তি সুখকরই হলো।
‘আর একটা প্রতিষ্ঠান একজন মক্কেলকে তাদের পণ্য বিক্রী করতে চাইছিলেন’, বলেছেন ওয়েটিংহাউসের একজন সেলসম্যান জোশেফ অ্যালিসন। আমার পূর্বসূরী দশ বছর চেষ্টা করেও কিছু করতে পারেন নি। আমার হাতে যখন ওই এলাকার দায়িত্ব এলো, আমি তিন বছর চেষ্টা চালালাম কিন্তু কোন অর্ডার পেলাম না। শেষ পর্যন্ত তের বছরের চেষ্টায় আমরা তাঁকে কয়েকটা বৈদ্যুতিক যন্ত্র বিক্রি করতে পারলাম। এটা যদি হতে পারে তাহলে আরও কয়েক শ নিশ্চয়ই এবার বিক্রি করতে পারব ভাবলাম।’
তাই পরের সপ্তাহে যখন গেলাম বেশ উচ্চ ধারণাই আমার ছিল। অবশ্য এ ধারণাটা আর রইলো না যে মুহূর্তে তাঁদের চিফ ইঞ্জিনিয়ার আমাকে অভ্যর্থনা করে বললেন : ‘অ্যালিসন, তোমাদের বাকি বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশগুলো আমরা নিতে পারবো না। আমি প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম।
‘কেন? আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম। কেন?’
‘কারণ তোমাদের মোটরগুলো অত্যন্ত গরম হয়ে যায়। আমি হাত রাখতে পারি না।’
‘আমি জানতাম এক্ষেত্রে তর্ক করে কোন লাভ হবে না। এভাবে আগেও চেষ্টা করে দেখেছি, এত কোন কাজ হয় না। অতএব আমি ঠিক করলাম ‘হ্যাঁ হ্যাঁ’ বলে দেখবো।
‘বেশ, মিঃ স্মিথ’, আমি বললাম। আমি আপনার কথা শতকরা একশ ভাগই মেনে নিচ্ছি। ওই মোটরগুলো যদি সত্যিই গরম হয়ে ওঠে কখনই তা কেনা উচিত নয়। আপনি নিশ্চয়ই সেই সব মোটর কিনবেন যেগুলো মোটর তৈরির কানুন অনুযায়ী যে মান নির্দিষ্ট করে বানানো হয়, তাই না?
তিনি স্বীকার করলেন। আর প্রথম হ্যাঁ বললেন।
‘বৈদ্যুতিক মোটর তৈরি সমিতির নিয়ম হলো তাপমাত্রার উপর কোন মোটর ৭২ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। ঠিক কি না?
‘হ্যাঁ’, তিনি স্বীকার করলেন। সেটা ঠিক। তবে তোমাদের মোটর আরও গরম হয়ে যায়।
আমি তার সঙ্গে কোন রকম তর্ক করলাম না। আমি শুধু শুনতে চাইলাম আপনাদের কারখানার ঘর কি রকম গরম?
‘ওহ, তিনি বললেন, প্রায় ৭৫ ডিগ্রী ফারেনহাট।‘
বেশ, আমি বললাম, ঘরের তাপমাত্রা যদি ৭৫ ডিগ্রী হয় আর তার সঙ্গে যদি আরও ৭২ ডিগ্রী যোগ করেন তাহলে মোট দাঁড়ায় ১৪৭ ডিগ্রী ফারেনহাইট। তাহলে ধরুন ১৪৭ ডিগ্রীতে যদি হাত রাখেন তা হলে হাতে প্রচণ্ড গরম লাগবে না?’
আবার তাকে ‘হ্যাঁ’, বলতে হলো।
বেশ, আমি জানালাম, ‘মোটরগুলোয় হাত না দিলেই ভালো হয় না কি?’
‘হ্যাঁ, মনে হচ্ছে তেমার কথাই ঠিক’, তিনি স্বীকার করলেন। আমরা এরপর বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলার পর তিনি সেক্রেটারিকে ডেকে প্রায় আরও ৩৫০০০ হাজার ডলারের অর্ডার ওই মাসের জন্য দিলেন।
‘বহু লক্ষ টাকার ব্যবসা নষ্ট করার পরেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে তর্ক করে কোন ফল লাভ হয়। আসল প্রয়োজন হলো হ্যাঁ বলানো!’
সক্রেটিস ছিলেন এথেন্সের একজন তার্কিক মানুষ। চল্লিশ বছরের টাক মাথা মানুষ হয়েও তিনি উনিশ বছরের একটি মেয়েকে বিয়ে করেন। তা সত্ত্বেও তিনি যা করে গেছেন ইতিহাসে কম মানুষই তা পেরেছেন। তিনিই মানুষের চিন্তাধারায় একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দেন, আর আজ তাঁর মৃত্যুর তেইশ শতাব্দী পরেও তাকে সম্মান জানানো হয় মানবের চিন্তাধারার চরম বিপ্লববাদী পরিবর্তনকারী জ্ঞানী বলে।
তাঁর কৌশলটা কেমন ছিল? তিনি কি সবাইকে বলতেন তারা ভুল করছে? ওহ্ না, সক্রেটিস এরকম করার মানুষ ছিলেন না। তিনি ঢের বেশি কৌশলী ছিলেন। তাঁর পুরো কৌশলের নাম সক্রেটিসের পদ্ধতি। এর মূলে ছিল মানুষকে প্রথমেই ‘হ্যাঁ’, ‘হ্যাঁ’ বলিয়ে নেওয়া। তিনি এমন প্রশ্ন করতেন যাতে তার বিরোধীকে ‘হ্যাঁ’, হ্যাঁ’, বলতে হতো। এরপর ক্রমাগত তিনি তাকে সব স্বীকার করিয়ে নিতেন। বিরোধীরা হা’ বলতে বলতে এমন অবস্থায় আসত যে তারা দেখতে ক’মিনিট আগে তারা যার বিরোধিতা করছিল এখন তাকেই সমর্থন করছে।
এরপর কাউকে সে ভুল করছে আখ্যা দেওয়ার আগে তখন খালি সক্রেটিসের কথাটা মনে রাখা দরকার। চীনাদের বেশ প্রাচীন একটা প্রবাদ আছে : ‘যে শান্তভাবে চলে সে ঢের দূর যায়। পাঁচ হাজার বছরের অভিজ্ঞতাই তাদের এ জ্ঞান দিতে পেরেছে।
অতএব যদি মানুষকে স্বমতে আনতে চান তাহলে পাঁচ নম্বর নিয়ম হলো :
‘অপর ব্যক্তিকে গোড়াতেই ‘হ্যাঁ’ বলিয়ে নিন।‘