সকালের আলো হঠাৎ যেন নিভে এল চারপাশে। নতুন কাজে নতুন জায়গায় যাচ্ছি, মনে কত আনন্দ নিয়ে বেরিয়েছিলাম। মনের ভেতরে একটা খোলা ছাতা কে যেন স্প্রিং টিপে বন্ধ করে দিল। ফাদার ও ব্রায়েনের আশঙ্কাই কি তাহলে সত্যি? অমঙ্গলজনক কিছু ঘটতে চলেছে অদূর ভবিষ্যতে?
ফিরে এসে নিজে উঠে বসলাম। কুলিরাও উঠছে লরিতে। অসিতবাবু যেন কেমনভাবে তাকিয়ে আছেন আমার মুখের দিকে। ভেতরের অশান্তি বোধহয় মুখেও ফুটে উঠেছে কিছুটা। কিন্তু উনি বুদ্ধিমান মানুষ, সকলের সামনে কোনও প্রশ্ন করলেন না। বাকি পথ পার হতে লাগল গাড়ি।
মানুষের মন বিষণ্ণ হয়ে থাকতে ভালবাসে না। দুঃসময় কাটিয়ে ওঠার জন্য মনের একটা নিজস্ব স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি আছে। প্রকৃতির যে আশ্চর্য সৌন্দর্যের প্রকাশ দেখতে দেখতে চলেছি তা অচিরেই আশঙ্কার মেঘ কাটিয়ে স্নিগ্ধ প্রফুল্লতা ফিরিয়ে আনল। একটা মজার ঘটনাও ঘটল প্রায় তক্ষুণি।
দু’দিকে ঘন বন, তবে ঝোপঝাড় কম, বড় বড় গাছই বেশি। মাঝখান দিয়ে মোরাম ছাওয়া লাল রাস্তা বেয়ে গাড়ি চলেছে। হঠাৎ ডানদিকের ঢালু জমি থেকে বড় বড় গাছের ফঁক দিয়ে বেরিয়ে এল একটা বিশাল হরিণ। আকারে মোষের বাচ্চার চেয়েও বড়। মাথার দু’দিক দিয়ে শাখা-প্রশাখাওয়ালা গাছের মত শিং উঠেছে। হরিণটা বোধহয় ঢালু জমি বেয়ে দ্রুত নেমে আসছিল, যখন জিপটা দেখতে পেল তখন তার আর গতি সংযত করবার উপায় নেই—হুড়মুড় করে রাস্তায় এসে উঠল। ড্রাইভার ব্রেক কষল প্রাণপণে, খানিকটা চাকা ঘষটে থামল গাড়ি। আমরা হুমড়ি খেয়ে এ ওর গায়ে পড়লাম। মেজকর্তার কপাল ঠুকে গেল উইন্ডস্ক্রিনে।
জলধর পণ্ডা রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠল-বড়শিঙা। বড়শিঙা।
বড়শিঙা হরিণের নাম শুনেছি, ছোটবেলায় পড়েছি শিকারের গল্পে। এই তাহলে সেই।
হরিণটা মুহূর্তের জন্য হকচকিয়ে গিয়ে পথের ঠিক মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে পড়ে তাকিয়ে আছে আমাদের জিপের দিকে। কী সুন্দর তাকে দেখাচ্ছে সকালের রোদ্দুরে! যেন জীবন্ত প্রাণী নয়, যেন অরণ্যের পটভূমিতে আঁকা একখানা ছবি।
তারপরেই হরিণটা সম্বিৎ পেয়ে তড়বড় করে দৌড়ে বাঁদিকের জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল। গাছের গুঁড়ির ফাঁকে তার বাদামি চামড়া আর সাদা ফুটকি চমকে উঠল।
জিপ চলতে শুরু করল আবার। অসিতবাবু বললেন–বড়শিঙা দেখতে পাওয়া খুব ভাগ্যের ব্যাপার। এই প্রাণীরা এত লাজুক যে, মানুষের সাড়া পেলে একেবারে দৌড়ে পালিয়ে যায়। শিং দেখেছেন। যেন ডালপালাওয়ালা একখানা পুরো ঝোপ।
আরও মিনিট পঁয়তাল্লিশ বাদে রামরেখা পৌঁছলাম। যেখানে আমাদের থাকবার তাবু পড়েছে সে পর্যন্ত জিপ বা লরি যাবে না। প্রায় সিকি মাইল দূরে পথের ধারে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকলাম।
কী নিবিড় অরণ্য! আমি কলকাতার অফিসে চাকরি করা নিরীহ মেসপোষ্য জীব, জঙ্গল বলতে দেখেছি শিবপুরের বোট্যানিক্যাল গার্ডেন। এখানে গম্ভীর চেহারার বড় বড় গাছ, নিচে পুটুস, বনতুলসী আর নানারকম উদ্ভিদের ঝোপ। অসিতবাবু আর আমার। একই তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। নিজেদের জিনিসপত্র তাঁবুতে রেখে বেরিয়ে এসে দেখি সামনের ঝোপঝাড় কেটে পরিষ্কার করা উঠোনমত জায়গায় মেজকর্তা আর নির্মলবাবু মাটিতে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। আমাদের দেখে মেজকর্তা বললেন—আসুন, বসে পড়ুন এখানে। ডহরু, এঁদের চা দাও–
অর্থ এবং বড় প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক ক্ষমতা তাক লাগিয়ে দেবার মত। এই পাণ্ডববর্জিত অরণ্যের নিভৃতে দু’দিনে গড়ে তোলা হয়েছে মানুষের থাকবার ব্যবস্থা। এসে পৌঁছবার পনেরো মিনিটের ভেতর হাতে চলে আসছে গরম চায়ের কাপ। কাপ বললে অবশ্য ভুল হবে, আমাদের চা দেওয়া হয়েছে এনামেলের হাতলওয়ালা ছোট মগে। অরণ্যনিবাসে এটাই প্রশস্ত, নইলে চিনেমাটির কাপ দিনে একজন করে রোজ ভাঙবে। কিছুদিন আগে কলকাতায় ‘কিং সলোমনস্ মাইনস্ নামে রাইডার হ্যাগার্ডের সেই বিখ্যাত অ্যাডভেঞ্চার গল্পের ফিল্ম দেখতে গিয়েছিলাম মেট্রো সিনেমায়। তাতে দেখেছিলাম গল্পের নায়ক অ্যালান কোয়াটার মেইন এইরকম এনামেলের মগে চা খাচ্ছে। এখন নিজেকে অনেকটা সেইরকম লাগতে লাগল।
মেজকর্তা বললেন–নির্মলবাবু, আজ আপনার সার্ভে করার জিনিসপত্র সব বের করে গুছিয়ে রাখুন, কাল সকাল থেকে পুরো অঞ্চলের একটা খসড়া ম্যাপ বানাবার কাজ শুরু করে দিন। দক্ষ সহকারী পাবেন না, তবে জলধর আপনার সঙ্গে পিনম্যানের কাজ করতে পারবে, চেন ধরতে পারবে। আর আয়না চমকাবার জন্য একজন কুলি দেব, মালপত্রও সে-ই বইবে।
অসিতবাবু একটু অবাক গলায় বললেন-আয়না চমকানোেটা কী জিনিস? সার্ভেয়ার নির্মলবাবু হেসে বললেন-ওটা আমাদের জরিপের একটা নিজস্ব চালু শব্দ। সব পেশাতেই এমন কিছু শব্দ থাকে। দূরবীন পেতে লুক থু করলেও ঠিক সোজা লাইন সবসময় পাওয়া যায় না, বিশেষ করে জঙ্গলের ভেতর। তখন কেউ একজন দুই বা তিন চেন দূরে মাটিতে দাঁড়িয়ে কিংবা গাছের ওপর উঠে ছোট আয়না হাতে নিয়ে সেটাতে রোদুর প্রতিফলিত করে দেখায়, তাতে কাজের সুবিধে হয়।
কী-একটা পাখি ডাকছে কোথায় বসে। অদ্ভুত ডাকটা। জলধর পণ্ডাকে জিজ্ঞাসা করতে সে বলল—ও তো হরটি পাখি। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত খুব ডাকে, বিকেলের দিকে চুপ করে যায়। এ জঙ্গলে খুব পাখি আছে বাবু, কত ডাক শুনবেন–
এই পাখির ডাক থেমে যাওয়াটাই আসন্ন বিপদের প্রথম লক্ষণ হয়ে দেখা দিল। চা খেয়ে জঙ্গলের মধ্যে একটু ঘুরতে বেরুলাম একা। মেজকর্তা আর নির্মলবাবু মাপজোক শুরু করার উদ্যোগের জন্য রয়ে গেলেন। অসিতবাবু আবার নিয়মিত ডায়েরি লেখেন, তিনি বর্তমান ভ্রমণের ঘটনাটা শুরু করার জন্য সঙ্গে আসতে চাইলেন না। জলধর বলল–একাই বেড়িয়ে আসুন বাবু। এ জঙ্গলের খুব বড় জানোয়ার কিছু নেই। ব্রাহ্মণী নদীর ধারের বন থেকে মাঝে মধ্যে দু-একটা হাতি ছিটকে আসে বটে, কিন্তু সে হল বনে আগুন লেগে ওদের খাবারে টান পড়লে। যান বাবু–
আজ বিকেল অবধি আমার খুব কাজ নেই। সন্ধেবেলা থেকে সারাদিনের হিসেবনিকেশ নিয়ে বসতে হবে। ফলে হালকা মনে বনের মধ্যে ঢুকে পড়লাম।
সম্পূর্ণ পাহাড়ি অঞ্চল। পথ বলে তেমন কিছু নেই, ইদানীং কয়েকদিন কুলিদের যাতায়াতে কোথাও কোথাও আবছা পথরেখা তৈরি হয়েছে বটে, কিন্তু ভাল করে লক্ষ্য না করলে তা বুঝতে পারা যায় না। ঝোপঝাড়ে ঢাকা উঁচু-নিচু জমি, এখানে ওখানে বড় বড় পাথরের চাঁই পড়ে আছে, তাদের কোনও কোনওটার গায়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল বনস্পতি আষ্টেপৃষ্টে শেকড় জড়িয়েছে। মনে হয় সৃষ্টির আদিকাল থেকে এগুলো এখানে পড়ে আছে। এরই একটাতে হেলান দিয়ে বসলাম পা ছড়িয়ে। মাথার ওপরে পত্রপল্লবের চন্দ্রাতপ, সুন্দর ছায়া ছায়া ঠাণ্ডা পরিবেশ। পকেট থেকে একটা ক্যাভেন্ডার্স বের করে ধরালাম। ভাবতে মাঝে মাঝে অবাক লাগছিল। সত্যিই কি আমি—সেই কলকাতার এঁদো গলির মেসে বাস করা আমি—বিহার আর ওড়িশার প্রান্তবর্তী নিবিড় অরণ্যে বসে মৌজ করে সিগারেট খাচ্ছি? কত অদ্ভুত ঘটনাই মানুষের কপালে লেখা থাকে।
আমি যেখানে বসে আছি সেখান থেকে পনেরো কী কুড়ি হাত দূরে সাদা গুড়িওয়ালা বিশাল একটা গাছ দাঁড়িয়ে। কী গাছ তা ঠিক চিনতে পারলাম না। গাছের গোড়ায় হাতির মত অতিকায় একখানা পাথর পড়ে। তার ওধারে বোধহয় কয়েকজন কুলি কাজ করতে করতে মৃদুস্বরে গান গাইছে। সম্ভবত মুণ্ডারি ভাষা, গানের কথা কিছুই ধরতে পারলাম না। কিন্তু সুরটা ভারি আশ্চর্য স্বপ্নময়, শুনলে কী যেন একটা কথা মনে পড়ে যায়। আর–
আর কেমন যেন একটু গা ছমছম করে।
এরকম অদ্ভুত সুর কোথা থেকে পেল বনচারী আদিবাসীরা? যেন পড়ন্ত বেলায় পশ্চিম আকাশে মেঘের গায়ে বদলে বদলে যাওয়া রঙের প্রতিফলন সুর হয়ে ফুটে উঠেছে, যেন কতদিন আগে ভোরবেলার স্বপ্নে এই সুরটা আমি কাকে বাঁশিতে বাজাতে শুনেছি।
যারা গান গাইছিল তারা গান গাইতে গাইতেই দূরে চলে যাচ্ছে।
চারদিক নিস্তব্ধ। হঠাৎ আমার মনে হল—আশ্চর্য তো, আচমকা সমস্ত শব্দ একসঙ্গে। থেমে গেল কী করে? এই তো কিছুক্ষণ আগেও কতরকম পাখি ডাকছিল, তারাই বা চুপ। করে গেল কেন? আমার একটা সিগারেট খেতে যতক্ষণ সময় লেগেছে তারই ভেতর ঘটেছে পরিবর্তনটা। বাতাসও যেন থেমে গিয়েছে। ঝড় আসার আগে প্রকৃতি এইরকম নিঃঝুম আর শান্ত হয়ে যায়। অবশ্য ঝকঝকে সূর্যের আলোয় দিনদুপুরে নিশ্চয়ই ঝড় আসবে না। হয়তো সবটাই আমার মনের বিভ্রম, হয়তো অরণ্যে মাঝে মাঝে এমন অকস্মাৎ নিস্তব্ধতা নামে।
যাই হোক, এরপর আর বেশিক্ষণ সেখানে বসে থাকতে ভাল লাগল না। তাঁবুতে ফিরে এসে দেখি উঠোনমত জায়গাটায় ফোল্ডিং টেবিল পেতে তার ওপর কনটুর ম্যাপ রেখে জোর আলোচনা চলেছে। পাশে দাঁড়িয়ে জলধর পণ্ডা কোনদিক দিয়ে কাজ আরম্ভ করলে ভাল হয়, কোথা দিয়ে কোথায় যাওয়া চলে—এসব বুঝিয়ে দিচ্ছে। অসিতবাবু তাঁবুর ভেতরে বিছানায় আধশোয়া হয়ে লিখছেন। আমাকে দেখে একটু হাসলেন।
দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা হল বাইরে খোলা জায়গায়। মাটিতে বসে শালপাতায় খাওয়া, বেশ বনভোজনের মত ব্যাপার। কিন্তু এখানেও পাখি ডাকছে না, সমস্ত অঞ্চলটাতেই অদ্ভুত শ্বাসরোধী ঘেরাটোপ নামছে যেন। মেজকর্তা আর নির্মলবাবুও কিছু একটা আন্দাজ করেছেন, খেতে খেতে তারাও কেমন একটু অবাক হয়ে চারদিকে তাকাচ্ছেন। ভাল কাণ্ড! ‘পাখি’রা সব গেল কোথায়? জঙ্গলে এমনিতেই পরিবেশ স্তব্ধ, কিন্তু শুধু পাখি না ডাকলে সে স্তব্ধতা যে কতখানি প্রকট হয়ে ওঠে তা বুঝলাম।
তবে আমাদের পাচকের রান্না খুব সুন্দর। গরম খিচুড়ি, সোনামুগ ডালের গন্ধ ভুরভুর করছে। তার সঙ্গে উৎকৃষ্ট গাওয়া ঘি, মুচমুচে করে ভাজা বেগুনি আর ডিমের অমলেট। লরিযাত্রা এবং জঙ্গলে বেড়ানোর শ্রমে দারুণ খিদে পেয়ে গিয়েছিল, অমৃততুল্য খাদ্য ভক্ষণ করতে করতে অন্যদিকে মন দেবার সুযোগ ছিল না।
খাওয়ার পর কিঞ্চিৎ বিশ্রাম করে কর্তারা আবার কাজে বসে গেলেন। অসিতবাবুর ডায়েরি লেখা বাকি ছিল, তিনি ফের লেখা শুরু করলেন। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে পায়চারি করতে লাগলাম। ওপাশে তাঁবুগুলোর পেছনে মাটিতে গর্ত করে উনুন বানিয়ে কুলিরা রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করেছিল। তারা এখন দলবেঁধে খেতে বসেছে। তাদের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি।
পায়চারি করতে করতে হঠাৎ থমকে থেমে গেলাম।
কী সুর গাইছি আমি? এ তো বনের ভেতর বড় পাথরটার ওপাশ থেকে ভেসে আসা সেই অদ্ভুত গান! কখন এ গান শিখলাম আমি? জীবনে গান শিখিনি, তাহলে এই জটিল আর কঠিন সুর গলায় এল কি ভাবে? তাছাড়া মাত্র একবার শুনে কোনও সুর শেখা যায় নাকি? থমকেই রইলাম।
ওপাশে কুলিদের কোলাহল হঠাৎ থেমে গিয়েছে। ওরাই বা চুপ করে গেল কেন? না, একেবারে চুপ করে গিয়েছে, এমন নয়, ওই তো কয়েকজন জলধরকে উত্তেজিত গলায় কী যেন বোঝাচ্ছে। কী বলছে ওরা?
মেজকর্তা একটু বিরক্ত হয়ে ডাকলেন—জলধর! কী হয়েছে? কী বলছে ওরা?
জলধর ডাক শুনে এগিয়ে এসে বলল—কিছু না আঁইজ্ঞা, ওরা সব জংলি লোক, কী জন্য যেন ভয় পেয়েছে। আমি কথা বলে সব ঠিক করে দিচ্ছি—
মেজকর্তা বললেন-ভয় পেয়েছে? ডাকো তো ওদের–
আমাদের কথাবার্তা শুনে অসিতবাবুও তাবু থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তার মুখে। সপ্রশ্ন বিস্ময়। জলধর তিন-চারজন কুলিকে সঙ্গে নিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল। কুলিদের। মুখ শুকিয়ে গিয়েছে, তাদের চেহারায় ভয়ের চিহ্ন। মেজকর্তা জিজ্ঞাসা করলেন কী হয়েছে তোমাদের? কী বলছিলে জলধরকে?
কুলিদের মধ্যে নেতাগোছের লোকটি দুর্বোধ্য ভাষায় কী যেন বলল। মেজকর্তা
বললেন—-ও কী বলছে জলধর?
জলধর বলল—ও বলছে এখানে পাসাং মারার ডাক শোনা গিয়েছে, এখানে কোম্পানি কাজ করতে পারবে না।
—পাসাং মারা আবার কী? কীভাবে কখন সে ডাকল?
জলধর প্রশ্নটা কুলি সর্দারকে বুঝিয়ে দিতে সে আবার দ্রুতবেগে ঝড়ের মত কী বলে গেল। জলধর এদিকে ফিরে বলল—ও বলচে পাসাং মারা খুব খারাপ অপদেবতা, জঙ্গলের মধ্যে যেখানে সে থাকে সেখানে বাইরের কাউকে সে ঢুকতে দেয় না। অমঙ্গল আর মৃত্যুর সুরে সে গান গায়। একটু আগে নাকি এখানে কেউ সেই সুরটা গাইছিল। তাই ওরা ভয় পেয়েছে—
মেজকর্তা অবাক হয়ে বললেন—এখানে? এখানে কেউ গান গাইছিল বটে। কে সে?
গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম—আমি একটা সুর ভাঁজছিলাম ঠিকই, সেটাই হয়তো ওরা শুনতে পেয়েছে। সুরটা সত্যিই একটু কেমন অদ্ভুত মত–
—কেমন সুর সেটা? কোথা থেকে শিখলেন?
—শিখিনি কোথাও। সেটাই মজা। খাওয়ার আগে জঙ্গলের মধ্যে বেড়াতে গিয়ে একটু পাথরের ওপাশে কুলিরা গাইছিল শুনছিলাম। কী করে যেন একবার শুনেই সুরটা মনে থেকে গিয়েছে।
—কোথায় শুনেছেন? কোনদিকে বেড়াতে গিয়েছিলেন?
আমি আঙুল দিয়ে নির্দেশ করে বললাম—ওইদিকে।
জলধর বলল—কিন্তু ওদিকে তো আজ কুলিরা কাজ করেনি।
তার দিকে তাকিয়ে বললাম—তা জানি না, কিন্তু গান আমি স্পষ্ট শুনেছি। হয়ত দু-একজন কুলি এমনি গিয়ে পড়েছিল।
জলধর কী একটা বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে মেজকর্তা দাঁড়িয়ে উঠে বললেন—বেশ, বেশ, ঠিক আছে। ওদের ভয় পেতে বারণ কর। আমি নিজে দেখছি ব্যাপারটা–
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—চলুন তো, কোথায় গান শুনেছিলেন সে জায়গাটা একবার দেখে আসি। জলধর সঙ্গে এসো, নির্মলবাবু আর অসিতবাবুও আসুন। জলধর, তুমি কুলিদের সঙ্গে আসতে বারণ কর। ওরা ভয় পেলে কাজ চালানো মুশকিল। হবে।
অরণ্যে নির্দিষ্ট কোনও পথরেখা নেই তা আগেই বলেছি। এখন আন্দাজে আন্দাজে ওঁদের নিয়ে চললাম। মিনিট সাতেক হেঁটে চিনতে পারলাম জায়গাটা। হ্যাঁ, এই তো এই। পাথরটায় হেলান দিয়ে আমি বসেছিলাম। কিন্তু সামনের সেই বড় গাছটা কই? হাতির আকারের বিশাল পাথরটাই বা গেল কোথায়?
আমার মুখের ভাব দেখে মেজকর্তা বললেন–কী হল আপনার?
বললাম-—এই পাথরটায় হেলান দিয়ে বসেছিলাম তখন। কিন্তু সামনে ওই জায়গাটায় একটা বড় পাথর আর একটা বড় গাছ ছিল, সেদুটো দেখছি না। তারই ওপাশ থেকে গান ভেসে আসছিল। ভেবেছিলাম কুলিরা গাইছে বুঝি–
জলধর বলল-না, এদিকে কুলিরা আজ কাজ করেনি।
নির্মলবাবু বললেন-কিন্তু গাছ বা পাথরের কী হল?
মেজকর্তা বললেন—আসুন তো দেখি–
নাঃ, জায়গাটায় কোনওকালে একটা গাছ দাঁড়িয়ে ছিল এমন মনে হল না। কিন্তু একটা জিনিস দেখে আমাদের সকলেরই বুক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল।
সেখানকার মাটিতে চওড়া, গভীর একটা দাগ। যেন খুব ভারি কোনও জিনিস সেখান দিয়ে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
মেজকর্তা কিছুক্ষণই সেদিকে তাকিয়ে থেকে বললেন—চলুন তো, এ দাগটা কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে দেখি—
বেশিদূর যেতে হল না। দশ-বারো গজ দূরে জঙ্গলের আড়ালে পড়ে রয়েছে বিশাল পাথরটা। যেন এখানেই পড়ে আছে আদিকাল থেকে। [ আমার মনের ভেতর অমঙ্গলের বিষাণ বাজছে। ভাল নয়, ভালো নয়, এ জায়গা ভাল নয়। মনে মনেই ঈশ্বরকে স্মরণ করলাম, প্রার্থনা করলাম যেন বিপদ কেটে গিয়ে তাঁর আশীর্বাদ নেমে আসে। বিশ্বাস, প্রার্থনা আর আশীর্বাদের মূল্য সম্বন্ধে তারানাথের কাছে শোনা তার প্রথম জীবনের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। তার সঙ্গে আলাপের। প্রথম দিকে শোনা গল্পটা। বেশ কিছুদিন আগে শুনেছিলাম বটে, কিন্তু হঠাৎই তার সব খুঁটিনাটি মনে ভেসে উঠল। যেন ছবির মত দেখছি সব।