শিক্ষার প্রশ্নে স্বাধীনতা বনাম ক্ষমতা
অন্যান্য বিষয়ের মতো শিক্ষাক্ষেত্রেও স্বাধীনতা পরিমানগত। কোন কোন বিষয়ে স্বাধীনতাকে বরদাশত করা হয় না। একবার আমার সঙ্গে এক ভদ্রমহিলার দেখা হয়েছিল যিনি মনে করতেন, কোন বিষয়ই শিশুদেরকে বাধা দেয়া উচিত নয়, যেহেতু শিশুর অন্তর্নিহিত প্রকৃতি আপনা-আপনি বিকাশ লাভ করে। আমি তাঁকে। জিজ্ঞেস করেছিলাম যদি আলপিন ভক্ষণ করে তখন কেমন হবে। খুবই দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতে হচ্ছে ভদ্রমহিলা জবাবে আমাকে কেবল কটুক্তিই করেছিলেন। তা সত্ত্বেও শিশুদের ছেড়ে দেয়া হলে তাড়া শিগগির অথবা দেরিতে আলপিন ভক্ষণ করবে, ঔষদের বোতল থেকে বিষপান করবে, অথবা উচ্চ কোন জানালা থেকে। লাফিয়ে পড়বে, অথবা ও জাতীয় কোন অঘটন ঘটাবে। একটু বয়স বাড়লে পরে বালকেরা সুযোগ পেলেই অপরিষ্কার থাকবে, অতিরিক্ত খাবে, এবং রোগে না ধরা পর্যন্ত ধূমপান করবে, ঠাণ্ডার কাঁপুনি না ধরা পর্যন্ত ভেজা পায়ে কাটাবে আরো-কত কিছু করবে। বয়স্ক লোকেরা যাদের রসিকতা করার ক্ষমতা নেই, সাধারণতঃ তাদেরকে উৎপাত করার কারণেই তারা সে সব করে থাকে। সুতরাং যারা শিক্ষার মধ্যে স্বাধীনতা থাকাটা আবশ্যক মনে করেন, তারা এ-বলতে চান যে শিশুরা যা করতে পছন্দ করে, সারাদিন কেবল তাই করে কাটাবে। কিছু পরিমাণ শৃঙ্খলা এবং শাসন অবশ্যই থাকতে হবে। এখন কথা হলো, তার পরিমাণ এবং কিভাবে তা বাস্তবায়ন করা হবে তাই নিয়ে।
শিক্ষাকে রাষ্ট্র, গির্জা, স্কুলশিক্ষক, পিতামাতা (এমনকি যা সাধারণতঃ খেয়াল করেনা কেউ) শিশুর দৃষ্টিকোণ থেকেও বিচার করা যেতে পারে। এ দৃষ্টিভঙ্গীসমূহের প্রত্যেকটিই খণ্ডিত, প্রত্যকটার মধ্যে অল্পবিস্তর শিক্ষার আদর্শ প্রতিফলিত হয়ে থাকে, আবার তাতে এমনও অনেক উপাদান আছে যা ক্ষতিকর। চলুন আমরা একটা একটা আলাদাভাবে পরীক্ষা করে দেখি এবং এর প্রত্যেকটার পক্ষে বিপক্ষে কি যুক্তি থাকতে পারে তা পর্যালোচনা করি।
আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার একমাত্র শক্তিশালী রূপকার রাষ্ট্রকে নিয়েই আমরা আলোচনা শুরু করব। সাম্প্রতিক কালেই শিক্ষাব্যবস্থায় রাষ্ট্রের আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। মধ্য যুগে, প্রাচীনকালে এ ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল না। রেনেসাঁর পূর্ববর্তী সময়ে কেবলমাত্র গির্জাই শিক্ষাব্যবস্থার রক্ষণাবেক্ষণ করত। সরোবন গির্জার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্যে রেনেসা কলেজ দ্যা ফ্রান্সের মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন করে, উচ্চতর জ্ঞান আহরণের জন্য সযত্ন প্রয়াসের সঞ্চার করে। ইংল্যাণ্ড এবং জার্মানিতে রিফরমেশন আন্দোলনের ফলে বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্যাকরণ শিক্ষার স্কুলসমূহে পোপের প্রভাব হ্রাস করার নিমিত্ত রাষ্ট্রকর্তৃক শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্খা জাগরিত হয়। কিন্তু এ আকাঙ্খ খুব শিগগিরই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। সার্বজনীন বাধ্যতামূলক আধুনিক শিক্ষার আন্দোলন না-হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্র শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের কোন উল্লেখযোগ্য অথবা নিরবচ্ছিন ভূমিকা গ্রহণ করেনি। সে যাহোক এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ পরিচালনার ব্যাপারে অন্যান্য প্রভাবের সম্মিলিত ফলের চাইতে রাষ্ট্রের প্রভাব অধিকতর ব্যাপক এবং সূদুরপ্রসারী।
যে সমস্ত উদ্দেশ্যে সার্বজনীন বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে তা বিভিন্ন রকম। এর শক্তিশালী সমর্থকেরা বিচলিত হয়ে ভেবেছিলেন, লিখতে পড়তে জানা প্রত্যেক মানুষের উচিত, অজ্ঞ জনসাধারণ সভ্য দেশের কলঙ্ক এবং শিক্ষা ব্যতীত গণতন্ত্র অচল। এ সকল উদ্দেশ্যের সঙ্গে অন্যান্য কারণ সংযোজিত হয়ে বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থার দাবিকে আরো বেগবতী করে তুলেছে। পরে দেখা গেলো শিক্ষা বাণিজ্যিক সুবিধা দান করে, শিশু অপরাধ কমায় এবং শিক্ষাব্যবস্থা কদর্য অধিবাসীদের গণ্ডীবদ্ধ করে রাখতে সুযোগ দান করে। যাজক বিরোধীরা রাষ্ট্র পরিচালিত শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে গির্জার প্রভাব ধ্বংস করার সুবিধা দেখতে পেলো। তুলনামূলকভাবে ইংল্যাণ্ড এবং ফ্রান্সে এই প্রভাব অধিকতর সক্রিয় ছিল। বিশেষতঃ ফ্রাঙ্কো প্রাশান যুদ্ধের পরে জাতীয়তাবাদীরা মনে করল যে সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয় শক্তির বৃদ্ধি সাধন করবে। প্রারম্ভে এ সকল এবং আরো কারণ সমূহ গৌণ উদ্দেশ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণের পেছনে যে উদ্দেশ্যটি ছিল প্রধান, তাহলো নিরক্ষরতার প্রতি অপমানজনক ধারণা।
এই ব্যবস্থা যখন একবার দৃঢ়ভাবে প্রবর্তন করা হলো তখন রাষ্ট্র বুঝতে পারলো একে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যায়। শিক্ষার সাহায্যে তরুণদেরকে ভালো এবং খারাপ দু’দিকেই সহজে বাকানো যায়। এর ফলে উন্নততর ভদ্রতার মান প্রতিষ্ঠিত হলে, অপরাধের সংখ্যা কমে গেলো জনসাধারণের জন্য মিলেমিশে কাজ করার সুযোগ দান করল এবং কেন্দ্রের আদেশ শুনবার জন্য সমাজকে অধিকতর আবেদনশীল করে তুলল। শিক্ষা ছাড়া নামেমাত্র গনতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হতে পারে। রাজনৈতিকেরা গণতন্ত্র বলতে এমন একটি সরকার বুঝেন, যে পদ্ধতি অনুসারে জন সাধারন নেতাদেরকে তাদের আশা-আকাক্ষার নিয়ামক মনে করে, নেতাদের ইচ্ছানুসারে স্বেচ্ছায় পরিচালিত হয়। সেকারণে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে নানা রকম পক্ষপাতমূলক উদ্দেশ্যের অনুপ্রবেশ ঘটেছে এ পদ্ধতিতে তরুণদেরকে (যতদূর সম্ভব) প্রচলিত বিধিব্যবস্থাকে শ্রদ্ধা করতে শিক্ষাদান করে। ক্ষমতাসীন সরকারকে ভিত্তিগতভাবে সমালোচনা করার ইচ্ছাকে পরিহার এবং অন্যজাতি ও বিদেশীর সম্পর্কে ঘৃণা এবং সন্দেহ পোষন করার শিক্ষা দান করে। আন্তর্জাতিকতা এবং ব্যক্তিগত বিকাশের বদৌলতে এই ব্যবস্থা জাতীয় ঐক্য এবং সংহতির ভিত্তি সুদৃঢ় করে। ক্ষমতাসীনের অন্যায় চাপের ফলে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের চরম ক্ষতি হয়। প্রচলিত বিশ্বাসের সঙ্গে যার বিশ্বাস খাপ খায়না তাকে কঠোর হস্তে দমন করা হয়। শাসকদের কাছে সুবিধাজনক বলে তারা ঐক্যের ওপর জোর দান করে, যদিও একমাত্র মানসিক অবক্ষয় সাধন না করে তা হাসিল করা যায় না। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থায় ক্ষতির পরিমান এত অধিক যে সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা সামগ্রীকভাবে ভালো করেছে কি খারাপ করেছে সে ব্যাপারে শাণিত প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়।
শিক্ষাব্যবস্থায় গিজার যে দৃষ্টিভঙ্গি, তা বাস্তবে রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে খুব বেশী আলাদা নয়, সে যাহোক উভয়ের মধ্যে এ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য পার্থক্য বর্তমান। গির্জার মতে যাজকদের শিক্ষিত হবার কোন প্রযোজন নেই, রাষ্ট্র কর্তৃক নির্দেশিত হলে তাদেরকে শুধু বিশেষ নির্দেশ দিয়ে থাকে, স্বাধীন অনুসন্ধানে যে সকল বিশ্বাস অযৌক্তিক এবং অসার প্রমাণিত হবে, রাষ্ট্র এবং গির্জা সে-সকল বিশ্বাসের অনুপ্রবেশে আত্ননিয়োগ করে। রাষ্ট্র যারা সংবাদপত্র পড়তে পারে তাদেরকে অতি সহজে দীক্ষিত করে আর গির্জা অশিক্ষিতদেরকেই অনায়াসে দীক্ষিত করে। রাষ্ট্র এবং গিজা উভয়েই স্বাধীন চিন্তার পরিপন্থী। আবার গিজা যা এখন কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলে তারা হয়ে থাকে যে কোন রকম পদ্ধতির প্রতিবন্ধক। যে পদ্ধতি অনুসারে সূদুর অতীতে জেসুইটেরা পথ অতিক্রম শুরু করেছিল সেই পদ্ধতিকে পরিপক্ক এবং পূর্নাঙ্গ বিবেচনা করে একদেশদর্শী ক্ষমতাসীনেরা বর্তমানে নির্দেশ দান করছে। এবং ভবিষ্যতেও করবে।
আধুনিক জগতে স্কুল শিক্ষকদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে বিচার করতে দেয়া হয় না। শিক্ষাবিভাগ কর্তৃক তিনি নিয়োজিত হয়েছেন এবং তিনি শিক্ষা দান করবেন, যদি তিনি আদেশ লজ্ঞান করেন তখন তাঁকে বরখাস্ত করা হবে। এই অর্থনৈতিক অভিপ্রায় ছাড়াও স্কুল শিক্ষক তিনি জানেন না এমন অনেক অবচেতন প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়ে পড়বেন। শৃঙ্খলা রক্ষা করার ব্যাপারে রাষ্ট্র এবং গির্জার চাইতে তাঁর পদক্ষেপ আরো সুস্পষ্ট এবং প্রত্যক্ষ। সরকারিভাবে তার ছাত্রেরা যা জানেনা, তিনি তা জানেন। কিছু পরিমান-শৃঙ্খলা এবং ক্ষমতা ছাড়া একটা ক্লাশকে সুষ্ঠুভাবে চালানো অসম্ভব। কোন বালক আগ্রহ দেখাবার বদলে বিরক্তি দেখালে তাকে শাস্তি দেয়া খুবই সহজ। অধিকন্তু, উত্তম স্কুলশিক্ষকও তার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করেন। তিনি ছাত্রদেরকে যে ধরণের মানুষ করে তুলতে চান, সে ছাঁচে তাদেরকে ঢালাই করবার ইচ্ছা পোষণ করেন। লিটন স্ট্রাচি বলছেন ড. আর্ণলড কোমো হ্রদের পাশে হাঁটবার সময় গভীরভাবে নৈতিক দোষ সম্পর্কে চিন্তা করছেন। তার মতে যে পরিবর্তন ছেলেদের মধ্যে ঘটাতে চান সেগুলোই হলো নৈতিক দোষ। যে-বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে তিনি এ-চিন্তা করেছেন তার মধ্যে ভালোবাসার চেয়ে ক্ষমতাপ্রীতি এই পরিচয় অধিক। এই দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন যুগে বিভিন্নভাবে দেখা গিয়েছে। প্রতারণামূলক আত্মপ্রভাবের দিকে সন্ধানী দৃষ্টি রাখা শিক্ষকের উচিত নয়। এটা আশা করা স্বাভাবিক, তা সত্ত্বেও শিক্ষক যে শিক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে জোরালো মাধ্যম এবং প্রাথমিকভাবে তার কাছে নিশ্চিতভাবে আমাদেরকে প্রগতিশীলতার প্রত্যাশা করতে হবে।
তা ছাড়া স্কুলশিক্ষক তার নিজস্ব স্কুলের কৃতিত্বের আশা করেন। তিনি তাঁর ছেলেদেরকে ক্রীড়াপ্রতিযোগিতা এবং বৃত্তিলাভের জন্য বিশিষ্ট করে তুলতে চান, যার ফলে তাকে সব ছেলের বদলে নির্বাচিত কয়েকটি ভালো ছেলের প্রতি বিশেষ যত্নবান হতে হয়। এতে বিভেদ এবং মর্যাদার প্রশ্ন জড়িয়ে আছে বলে ফল দাঁড়ায় মারাত্মক। অন্যদেরকে ভালো খেলতে দেখার চাইতে নিজে অংশগ্রহণ করে খারাপ খেলা একজন বালকের পক্ষে অধিকতর মঙ্গলজনরক! মি. এইচ, জি ওয়েলস তার লাইফ অব সানডারসন অউনডেল গ্রন্থে দেখিয়েছেন এই মহান স্কুলশিক্ষকেরা কিভাবে মুখ ঘুরিয়ে বসে থেকে গড়পড়তা ছাত্রের মনোবৃত্তি অযত্নে অকর্ষিত রাখে। তিনি প্রধান শিক্ষক হওয়ার পর দেখতে পেলেন যে একমাত্র নির্বাচিত ছেলেরাই গির্জায় গাইতে পারে এবং তাদেরকে ভজন গাইতে শিক্ষা দিয়ে বাকি সকলকে শ্রোতা হিসেবে রাখা হলো। স্যাণ্ডারসন জিদ করতে লাগলেন মধুর হোক না হোক সকলেরই ভজন গাওয়া উচিত। এতে তিনি এমন এক পক্ষপাতমূলক মনোভাবের বিরুদ্ধে মাথা তুলতে চাচ্ছেন যা একজন স্কুলশিক্ষকের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। যিনি তার ছেলেদের চাইতে নিজের কৃতিত্বের জন্য ঢের বেশি লালায়িত। অবশ্য যদি আমরা বিজ্ঞোচিতভাবে কৃতিত্বের বিচার করি, দু’উদ্দেশ্যের মধ্যে তেমন কোন বিরোধ দেখতে পাবোনা। যে স্কুলের ছেলেরা সবচেয়ে বেশি ভালো করেছে, সে স্কুলই সবচেয়ে বেশি কৃতিত্বের দাবীদার। কিন্তু ব্যস্ত পৃথিবীতে দেখা যায় সাফল্য সবসমসয় বেশি প্রয়োজনের অনুপাতের ওপরই নির্ভরশীল। এতে করে দু’উদ্দেশ্যের মধ্যে সংঘাত এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এখন আমি পিতামাতার দৃষ্টিভঙ্গি সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করব। পিতামাতার অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা অনুসারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গীরও বিভিন্নতা ঘটে থাকে। গড়পড়তা মজুরের আকাঙ্খ গড়পড়তা অন্যান্য পেশার ভদ্রলোকের চাইতে ভিন্ন রকম। গড়পড়তা মজুর ঘরে ঝামেলা কমাবার জন্য তার ছেলেমেয়েকে যত শিগগির সম্ভব স্কুলে ভর্তি করে এবং শিগগির তাদেরকে বের করে এনে তাদের আয়ের দ্বারা লাভবান হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে। সম্প্রতি বৃটিশ সরকার শিক্ষাখাতে ব্যয় হ্রাস করার সিদ্ধান্ত করেছে, সে জন্যে প্রস্তাব করা হয়েছ শিশুদের ছ’বছরের আগে স্কুলে যাওয়া অনুচিত এবং তের বছরের পরে স্কুলে থাকতে বাধ্য করা উচিত নয়। এর প্রথম প্রস্তাবটি জনসাধারণের মধ্যে এত বেশি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সঞ্চার করেছে যে প্রস্তাবটিকে নাকচ করতে হয়েছে। জননীদের (সম্প্রতি ভোটাধিকার প্রাপ্ত) দুর্দমনীয় আক্রোশই প্রস্তাবটিকে নাকচ করাতে বাধ্য করেছে। পরবর্তী প্রস্তাব স্কুল ত্যাগ করবার বয়স কমানো জনসাধারণের মধ্যে কোন আপত্তির কারণ হয়ে দেখা দেয়নি। পার্লামেন্টের প্রার্থীদের সভায় যারা যোগদান করেন তারা তাদের উচ্চশিক্ষা সম্বন্ধে বক্তব্যে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে কিন্তু অরাজনৈতিক দিনমজুরেরা (সংখ্যায় যারা গরিষ্ঠ) তাদের ছেলেমেয়েদেরকে যত শিগগির-সম্ভব স্কুল ছাড়িয়ে কাজে নিয়োগ করতে ইচ্ছুক। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তারা মহান ত্যাগ স্বীকার করতেও ইচ্ছুক, কিন্তু আমাদের প্রতিযোগিতামূলক সমাজ ব্যবস্থায়, যে শিক্ষা পদ্ধতি আপনার থেকে ভালো তার চেয়ে অন্য লোকের যে শিক্ষা ব্যবস্থা ভালো গড়পড়তা পিতামাতা ছেলেমেয়েদেরকে সে ব্যবস্থানুসারে শিক্ষিত করে। লেখাপড়ার সাধারণ মানকে অবনমিত করে রাখার পক্ষেও এ পদ্ধতি হয়ত সুবিধাজনক, কিন্তু তাই বলে পেশাদার ব্যক্তিরা মজুরদের ছেলেমেয়ের উচ্চশিক্ষা সুযোগ সুবিধা দান করবে তা আমরা আশা করতে পারিনে। যারা ডাক্তারি শিক্ষা করতে ইচ্ছুক তাদের পিতামাতা যতই দরিদ্র হোকনা কেননা সকলেই যদি ডাক্তার হবার সুযোগ পায়, তাহলে এটা পরিস্কার যে ডাক্তারদের আয় বর্ধিত প্রতিযোগিতা এবং সমাজের মানুষের উন্নততর স্বাস্থ্যের কারণে বর্তমানের তুলনায় অনেক গুন কমে যেত। আইনব্যবসা সিভিল সার্ভিস সবক্ষেত্রে ঐ একই নীতি সমানভাবে প্রযোজ্য। সুতরাং পেশাদার মানুষেরা নিজেদের সন্তানের বেলায় যা ভালো মনে করে, খুব ব্যতিক্রম জনদরদী না হলে, সাধারন মানুষের বেলায় তা ভালো মনে করেনা।
আমাদের প্রতিযোগী সমাজব্যবস্থায় বাবাদের মৌলিক দোষ হলো তারা চায় যে ছেলেরা তাদের গৌরব এবং কৃতিত্বের স্থল হোক। প্রবৃত্তির গভীরে এ দোষ শিকড়িত একমাত্র পৌনঃপুনিক প্রচেষ্টার ফলে তার নিরাময় হতে পারে। অল্প পরিমাণে হলেও এ দোষ থেকে মুক্ত নয় মায়েরা। আমরা প্রবৃত্তিগতভাবে আমাদের সন্তানের সাফল্যে গৌরব এবং ব্যর্থতায় লজ্জাবোধ করি। দুর্ভাগ্যবশতঃ সন্তানের যে সাফল্য আমাদেরকে অহংকারে স্ফীত করে তোলে তা অনেক সময়ই অবাঞ্চিত ধরণের হয়ে থাকে। সভ্যতার শৈশব হতে আজ পর্যন্ত চীন এবং জাপানে পিতামাতারা ধনী বর এবং বধু নির্বাচন করে, নিজেরা তাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্তানের সুখ-সন্তুষ্টি বলি দিয়ে থাকে পাশ্চাত্যদেশে (ফ্রান্সের অংশবিশেষ বাদে) সন্তানেরা বিদ্রোহ ঘোষনা করে তাদেরকে এ দাসত্ব থেকে মুক্ত করে নিয়েছে, কিন্তু তার ফলেও পিতামাতার প্রবৃত্তিতে তেমন বিশেষ পরিবর্তন আসেনি। সুখ কিংবা গুনপনা দুটোর কোনটাই নয়। গড়পড়তা পিতামাতা চায় তাদের সন্তান জাগতিক সাফল্যের অধিকারী হোক। তারা তা চায় একারণে যে এতে করে তারা সন্তান-সন্ততি আত্নীয় স্বজনদের জন্য গর্ব করতে পারে। মুখ্যতঃ এ-আকাঙ্ক্ষার তাগিদেই তারা তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা করে থাকে, রাষ্ট্র গিজা, স্কুলশিক্ষক এবং পিতামাতা যাদের সম্বন্ধে আমরা আলোচনা করছি, ক্ষমতার দ্বারা যদি শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রন হয় তাদের এক বা একাধিক মাধ্যমের ওপর অবশ্যই ক্ষমতা অর্পিত থাকতে হবে। আমরা দেখেছি, এদের কাউকে শিশুর পূর্ণাঙ্গ বিকাশের জন্য পুরোপুরি ভাবে বিশ্বাস করা যায় না; যেহেতু প্রত্যেকে বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্যে শিশুকে গড়ে তুলতে চায় তার সঙ্গে উন্নতির কোন সঙ্গতি নেই। রাষ্ট্র চায় শিশু জাতীয় প্রতি হিংসার জন্য আত্ননিয়োগ করুক এবং প্রচলিত সরকারকে সমর্থন করুক। প্রতিযোগী পৃথিবীতে রাষ্ট্র যেভাবে জাতিকে সম্মানের চেখে দেখে অধিকাংশ সময় স্কুলশিক্ষকরাও স্কুলকে তেমনি শ্রদ্ধান্বিত দৃষ্টিতে দেখে এবং চায় যে সন্তান পরিবারের গৌরব বৃদ্ধি করুক। শিশুর উন্নতি এবং সুখ বিকাশে সম্ভব,এবং আলাদা একজন মানুষ হিসেবে শিশুর নিজেই নিজের লক্ষ্য স্বরূপ, আংশিকভাবে ছাড়া বিভিন্ন বাহ্যিক উদ্দেশ্য তার নিজস্ব লক্ষ্যের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। জীবনকে পরিচালনা করার জন্যে যে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন, দুর্ভাগ্যবশতঃ শিশুর তা নেই। নির্দোষিতার সুযোগে তারা বিভিন্ন মন্দ উদ্দেশ্যের শিকার হয়ে পড়ে। এর ফলে শিক্ষাব্যবস্থায় অসুবিধার সৃষ্টি হওয়ায় তা রাজনৈতিক সমস্যার আকার ধারণ করেছে। কিন্তু শিশুদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কি বলা যায়, প্রথমে তাই আমাদের দেখা উচিত।
অধিকাংশ শিশুর ক্ষেত্রে এটা সত্য যে এমনিতে ছেড়ে দিলে তারা লিখতে পড়তে শিখবে না, পরিবেশের সঙ্গে জীবনকে খাপ খাইয়ে নেয়ার মত করে গড়ে উঠবে না। সেজন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন অপরিহার্য এবং শিশুদেরকেও নিশ্চিতভাবে কিছু পরিমাণ শাসনের আওতায় রাখতে হবে। কোনরকমে শাসনকে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করা যায় না বলে যত কম সম্ভব শাসন করে, কচিকাঁচার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, আকাঙ্খকে শিক্ষার লক্ষ্যে ধাবিত করবার দিকে আমাদের নজর দেয়া উচিত। অনেক সময় যেমন চিন্তা করা হয় তার চেয়ে এ অনেক সহজ পন্থা, কারণ জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক শিশুর স্বাভাবিক আকাঙ্খ। গরিব ছেলেরা যে পণিরের প্রতি আগ্রহ দেখাতে পারবে না তাতে একরকম সত্য কথা এবং শুদ্ধভাবে যে অঙ্ক কষতে পারবে তারও কোন ভরসা নেই। বিশেষ সাইজের একটা বাক্সের দরকার হলে তাকে যদি বৃত্তির পয়সা, জমিয়ে কাঠ এবং পেরেক কেনার কথা বলা হয়, তাহলে তা তার পাটিগণিতের শক্তি বিস্ময়করভাবে বৃদ্ধি করবে।
একটা শিশুকে যখন অঙ্ক কষতে বলা হবে তাতে কোন কিছু অনুমানমূলক থাকা উচিত নয়। একটি ছেলে অঙ্কের পাঠ সম্পর্কে একদা যে বক্তব্য করেছিল তা আমার মনে পড়ে। অভিভাবিকা (গভর্নের্স) তাকে প্রশ্ন দিয়েছিল, একটি ঘোড়ার দাম একটি টাটু গোড়ার তিনগুণ, টাটু ঘোড়ার দাম ২২ পাউণ্ড, ঘোড়ার দাম কত? বালকটি জিজ্ঞেস করল ‘টাটুর দাম কি নীচে ছিল? অভিভাবিকা জবাব দিলো, “তাতে কোন বেশকম হবে না। কিন্তু সহিস বলে তাতে অনেক বেশকম। অনুমানমূলক সত্যকে হৃদয়ঙ্গম করা সাম্প্রতিক ন্যায়শাস্ত্রীয় বিকাশের একটি দিক শিশুরা তা বুঝতে পারবে এমন আশা করা উচিত নয়। সে যাহোক আমার বক্তব্য বিষয় থেকে একটু দূরে সরে এসেছি।
সব শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রহ উপযুক্ত উদ্দীপনার সাহায্যে জাগানো যায় আমি তা মনে করি না। কিছুসংখ্যক শিশুর বুদ্ধিবৃত্তি গড়পড়তা বুদ্ধিরও অনেক নীচে, সেক্ষেত্রে চিকিৎসার প্রয়োজন। বিভিন্ন মানসিক ক্ষমতা সম্পন্ন শিশুদের একশ্রেণীতে মেশানো উচিত নয়। তা করলে বুদ্ধিমান শিশুরা পরিষ্কারভাবে যা বুঝেছে তা বারবার বুঝবার জন্য ক্লান্ত হয়ে পড়বে এবং বোকা শিশু এখনো বুঝতে পারে নি ভেবে নিশ্চিত দুঃখিত হবে। কিন্তু বিষয়বস্তুকে ছাত্রদের বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে ধাতস্থ করে তুলতে হবে। ম্যাকলেকে কেমব্রিজে অঙ্ক শিখতে হয়েছিল, কিন্তু অঙ্ক শেখা যে শুধু সময়ের অপচয় করা তা তার পত্রাবলী থেকে স্পষ্ট জানা যায়। আমাকে গ্রিক এবং ল্যাটিন শিখতে বাধ্য করা হয়েছিল, যে ভাষাতে কথাবার্তা বলা হয় না সে ভাষা শেখা হাস্যকর বলে আমি তা বর্জন করেছিলাম। নিতান্ত প্রয়োজনীয় বিষয় শিক্ষা দেয়ার পর শিশুদের রুচির সঙ্গে পরিচিত হওয়া দরকার এবং শিশুর যাতে আগ্রহ একমাত্র তাই বাড়তে দেয়া উচিত। এতে শিক্ষকদের পরিশ্রম বাড়ে, কেননা বেশি কাজ করলে খুব সহজে ভোতা হয়ে যায়।
ঐতিহ্যাশ্রয়ী পাণ্ডিত্যাভিমানী ব্যক্তি যাদের জ্ঞান বিতরণশীল অথচ যারা জ্ঞান বিতরণ করবার কলা-কৌশল জানেনা, নিজেদের দোষ বুঝতে সক্ষম হয়ে কল্পনা করে কোমলমতি শিশুর শিক্ষার প্রতি স্বভাবতঃই তারা প্রচণ্ড বিরূপ মনোভাব পোষণ করে। একজন মানুষ একটি বিড়াল ছানাকে ইঁদুর ধরতে শিক্ষা দেয়ার ওপর শেখভের একটি সুন্দর গল্প আছে। বিড়ালছানাটা পেছনে দৌড় দিতো না বলে ভয়ানকভাবে মার দিতো। এর ফল দাঁড়ালো বিড়ালটি বড়ো হলে পর ইউঁর দেখে ভয় পেতে লাগলো। শেখভ আরো বলেছেন সেই লোকটিই আমাকে ল্যাটিন শিখিয়েছিল। বিড়াল তার ছানাকে ইঁদুর ধরতে শেখায় কিন্তু ছানার নিজস্ব প্রকৃতি না-জাগা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। বিড়ালছানারা পরে তাদের ইঁদুর ধরার জ্ঞান অর্জন করার ব্যাপারে তাদের মার সঙ্গে একমত হয় বলে কোন শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজন পড়ে না।
জীবনের প্রথম দু অথবা তিনবছর শিক্ষাভিমানী ব্যক্তিদের আইনকে এড়িয়ে যেতে দেবে। বিশেষজ্ঞরা একমত যে ঐ সকল বছরেই আমরা জীবনের সবচেয়ে বেশি জ্ঞান আহরণ করি। প্রত্যেক শিশু নিজের চেষ্টায় কথা বলতে শেখে। কেউ নজর করলে দেখতে পাবে যে শিশুদের কথা বলা আয়ত্ব করতে যে-পরিমাণ চেষ্টা করতে হয় তা সামান্য নয়। শিশু মনোযোগ সহকারে শুনে ঠোঁট সঞ্চালন লক্ষ্য করে, সারাদিন ধ্বনি রপ্ত করার কাজে কাটায়, এ আনন্দিত পরিশ্রমে মনকে কেন্দ্রীভূত করে রাখে। অবশ্য বয়স্ক লোকেরা প্রশংসা করে তার উৎসাহ বৃদ্ধি করে। নতুন পৃথিবী সম্পর্কে ঔৎসুক্য জাগার আগে তাদেরকে তা জানার জন্য শাস্তি দিলে বিপরীত ফল ফলতো। বয়স্ক লোকেরা শিশুদের শুধু প্রশংসা এবং সুযোগ করে দেয়। জীবনের কোন পর্যায়ে এর চেয়ে বেশি কিছুর প্রয়োজন আদৌ আছে কিনা তা রীতিমত সন্দেহজনক।
শিক্ষার জন্য যা প্রয়োজন তা হলো শিশু এবং কোমলমতি তরুণদের জ্ঞান অর্জন করা উচিত-এসত্যটা অনুভব করিয়ে দেয়া! অনেক জ্ঞান অর্জন করা বাঞ্ছনীয় নয় বলে এ-কাজ ভয়ঙ্কর অসুবিধা হয়ে পড়ে। কোন বিষয়ে সামান্য পরিমাণ জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা শিশুদেরকে প্রথমে বিরক্ত করে তুলবে এবং নানা অসুবিধার সৃষ্টি হবে তাদের মধ্যে অনুভব ক্রিয়া জাগাতে! যাহোক এসব অসুবিধা অনতিক্রমনীয় নয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ অঙ্ক শিক্ষার কথা ধরা যেতে পারে। স্যানডারসন আইনড়ল দেখালেন যে তার ছেলে প্রায় সকলেই যন্ত্রপাতি তৈরি করার সম্বন্ধে উৎসাহী। তিনি তাদেরকে অবাধে যন্ত্রপাতি তৈরি করার সুযোগ দিলেন। বাস্তবে যন্ত্রপাতি নির্মাণের কাজ করতে গিয়ে তারা অঙ্কের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারল এবং যে কাজে তাদের তীক্ষ্ণ আগ্রহ, গঠনমূলক সাফল্যের জন্য অঙ্কের প্রয়োজন, সুতরাং তারা অঙ্ক শেখায় মনোযোগী হয়ে পড়ল। এটা ব্যয়বহুল পদ্ধতি এবং শিক্ষকের প্রচুর ধৈর্য এবং দক্ষতার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। যদি ছাত্রদের প্রকৃতিতে আবেদন জাগাতে পারে তাহলে অতিরিক্ত মানসিক প্রচেষ্টা তাদের বিরক্তিকে অনেকাংশে লাঘব করতে সক্ষম হবে। মানুষ এবং প্রাণী উভয়েই স্বাভাবিকভাবে চেষ্টা করে। প্রবৃত্তিগত অনুরাগ সৃষ্টি করার মত চেষ্টা হওয়া চাই। পায়ে কলের চাকা ঘোরানোর চাইতে ফুটবল ম্যাচে অধিকতর প্রচেষ্টার প্রয়োজন, তবু তার একটা শাস্তি এবং অন্যটা আনন্দবিশেষ। মানসিক প্রচেষ্টা যে আনন্দদায়ক করে তোলার জন্য বিশেষ বিশেষ অবস্থার প্রয়োজন। পরবর্তীকালে ছাড়া শিক্ষাব্যবস্থায় এসকল অবস্থা সৃষ্টি করার কোনো প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়নি। এর মধ্যে প্রধান যেগুলো; প্রথমত কোন সমস্যার সমাধান প্রয়োজন, দ্বিতীয়তঃ সমস্যার সমাধান বের করবার আশাবাদী মনোভাব বজায় রাখা। ডেভিড কপার ফিল্ডকে যেভাবে পাটিগণিত শেখানো হয়েছিল সে পদ্ধতি পর্যালোচনা করে দেখুন।
অনুশীলনী শেষ করার পরেও জটিল অঙ্কের আকারে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে পারে। তা আমার জন্য আবিস্কার করা হয়েছিল এবং মি. মাডষ্টেন আমাতে তা মৌখিকভাবে বলতে শুরু করতেন, ‘যদি আমি পনিরের দোকানে গিয়ে ৫০০ ডবল সাইজের গ্লাউচেষ্টার পনির প্রত্যেকটা সাড়ে পাঁচ পেন্স মূল্যে খরদ করি, তাহলে সবগুলোর দাম কতো?” আমি দেখতাম তিনি ব্যাপারটাকে উপভোগ করতেন গোপনে। ডিনারের পূর্বপর্যন্ত এই পনিরের মধ্যে আমি ঝুঁকে পড়ে থাকতাম এবং গায়ে চামড়ায় শ্লেটের লেখা মুছে নিজেকে একজন শ্বেতকায় এবং নিগ্রোর দোআঁশলা সন্তান করে তুলতাম। পনিরের অত্যাচার থেকে সাহায্য করার জন্য এক স্লাইস পাউরুটি পেতাম এবং বাকি সন্ধ্যাটাকে দুঃসহ বলে মনে করতাম।
এই অসুবিধা কাটিয়ে যেতে হলে পড়াবার ঘন্টা হ্রস্ব এবং শিক্ষকদেরকে শিক্ষাদানের কলাকৌশল সম্পর্কে ওয়াকেবহাল করে তুলতে হবে। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এ নিয়ম অনুসৃত হচ্ছে কিন্তু পাবলিক স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষকেরা তা মেনে চলেন না।
শিক্ষার স্বাধীনতার বিভিন্ন দিক রয়েছে। সর্বপ্রথমে শিক্ষা পাওয়া না পাওয়ার স্বাধীনতা আছে। কি শিক্ষা করবে তার স্বাধীনতা আছে এবং পরবর্তীকালের শিক্ষায় মতামতের স্বাধীনতা রয়েছে। শিক্ষা পাওয়া না পাওয়ার স্বাধীনতা অংশতঃ বাল্যকালের সঙ্গে সম্পর্কশীল। দুর্বল এবং অক্ষম যারা নয়, তাদের সকলকে লিখতে পড়তে শিক্ষা দেয়া নিশ্চিতভাবেই প্রয়োজনীয়। কেবলমাত্র সুযোগ সুবিধার বন্দোবস্ত করে এর কতটুকু করা যাবে অভিজ্ঞতাই তা সপ্রমাণ করবে। সুযোগ সুবিধা তাদের শিক্ষার জন্য যথেষ্ঠ হলেও ছেলেদের গ্রহণ করার এত সুযোগ সুবিধাও অবশ্যই থাকতে হবে। প্রয়োজনীয় সুযোগের অভাবে ছেলেদের বেশিরভাগই ঘরে বাইরে খেলাধূলা করাটাকে পছন্দ করে। পরবর্তী পর্যায়ে তরুণদের পছন্দের ওপর শিক্ষাকে ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। দৃষ্টান্তস্বরূপ তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া উচিত কিনা, কেউ যেতে চাইবে এবং কেউ যেতে চাইবে না। কোন প্রবেশিকা পরীক্ষা এরকম ভালো এবং নিখুঁত একটি নির্বাচনী নীতির প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। যারা ভালোভাবে কাজ করে না তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে দেয়া উচিত নয়। যে সকল ধনী যুবক বর্তমানে কলেজে তাদের সময়কে হত্যা করছে তারা অন্যান্যদেরকে নীতিহীন করছে,অকর্মণ্য হওয়ার শিক্ষাই গ্রহণ করছে। আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকবার শর্ত হিসেবে কঠোর পরিশ্রম করার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হলে বুদ্ধিবৃত্তির প্রতি যারা নিস্পৃহ মনোভাব পোষণ করে, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ তাদের কাছে। আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারবে না।
কি শিখতে হবে এ ব্যাপারে যতটুকু স্বাধীনতা বর্তমানে আছে, প্রয়োজন তার অনেক বেশির। ছেলেদের নিজস্ব ইচ্ছানুসারে বিষয় নির্বচন করা উচিত বলে আমি মনে করি। নির্বাচনী পদ্ধতিতে অনেক ঘোরতর দোষ রয়েছে যা অনেকগুলো সম্পর্কহীন বিষয় স্বাধীনভাবে বাছাই করার ভার একজন তরুণের ওপর অর্পণ করে। যদি আমাকে কাল্পনিকভাবে শিক্ষাপদ্ধতি রচনা করার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ দেয়া হয়। আমি বারো বছর পর্যন্ত প্রত্যেক ছেলেকে কিছু পরিমাণ অঙ্ক বিজ্ঞান এবং প্রাচীন সাহিত্য বিষয়ে শিক্ষাদান করব। দু’বছর পরে ছেলের ঝোঁক কোনদিকে, স্পষ্ঠভাবে তার নাগাল পাওয়া যাবে এবং অন্য কোন বিষয়ের প্রতি কোমলপক্ষপাত না থাকলে শিশুর নিজস্ব রুচিই তার প্রবণতার পরিচয় নিরূপণ করবার জন্যে যথেষ্ট হবে। তারপরে আমি আকাঙ্খিত প্রত্যেকটি বালক বালিকাকে চৌদ্দ বছর বয়স থেকে বিশেষ দিকে দক্ষতা অর্জন করার অনুমতি দান করব। প্রথমে দক্ষতা অর্জন করার ক্ষেত্র ব্যাপক এবং প্রসারিত হওয়া উচিত এবং শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সুনির্দিষ্ট পথে পরিচালিত হবে। যে সময়ে এ পদ্ধতি চালু করা সম্ভব ছিল, সকলেই জানে তা অতীত হয়ে গেছে। একজন পরিশ্রমী মানুষ ইতিহাস এবং সাহিত্য সম্পর্কে কিছু জ্ঞান রাখতে পারেন, যার জন্য তার প্রাচীন এবং আধুনিক ভাষাসমূহের ওপর কিছুটা দখল থাকা আবশ্যক হয়ে পড়ে। অথবা তিনি অঙ্কের বিশেষ দিক বিজ্ঞানের দু’একটি শাখা সম্পর্কে ওয়াকেবহাল হতে পারেন। সর্বাঙ্গীন শিক্ষার যে আদর্শ তা বিগত জ্ঞানের উন্নতির ফলে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে।
শিক্ষক এবং ছাত্র উভয়ের জন্য মতামতের স্বাধীনতা বিভিন্ন ধরণের স্বাধীনতার মধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এবং তাতে কোন সীমানা নির্দেশ করার প্রয়োজন পড়েনা। বস্তুতঃপক্ষে মতমতের স্বাধীনতা অনুপস্থিত বলেই এর সমর্থনে কি কি যুক্তি আছে তা আবিষ্কার করা বাঞ্ছনীয় হয়ে দাঁড়ায়।
আমাদের যাবতীয় বিশ্বাসে সংশয় পোষণ করাই হলো মতামতের স্বাধীনতার মৌলিক যুক্তি। যদি আমরা নিশ্চিতভাবে সত্যকে জানতে পারি তাহলে এর জন্য শিক্ষাদান সম্পর্কে কিছু বলা যেতে পারে। ও সকল ব্যাপারে অন্তর্নিহিত যৌক্তিকতার কারণে কোন রকমের ক্ষমতা প্রয়োগ না করেই শিক্ষা দেয়া যেতে পারে। যে লোক গুণের টেবিল সম্পর্কে বিরুদ্ধ মন্তব্য করে তাকে অঙ্ক শিখতে না দেয়ার জন্য একটি আইন করা উচিত। কারণ সত্য এখানে পরিষ্কার এবং জরিমানা করে তা প্রয়োগ করার প্রয়োজন পড়েনা। রাষ্ট্র যখন কোন মতবাদ শিক্ষার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে তখন করে একারণে যে ঐ মতবাদের সমর্থনে উপসংহারস্বরূপ কেনো প্রমাণ অনুপস্থিত। এর ফল হয় সত্যকেও সত্য হিসেবে শিক্ষা না দেয়া। নিউইয়র্ক রাজ্যে আজ পর্যন্ত সাম্যবাদ ভালো-এ শিক্ষা দেয়া বেআইনী। আবার সোভিয়েত রাশিয়ায় সাম্যবাদ খারাপ-এ শিক্ষা দেয় বেআইনী। এ দু’-মতবাদের মধ্যে একটা সত্য এবং অন্যটা মিথ্যা তাতে সন্দেহ নেই; কিন্তু কোনটা তা কেউ জানেনা। আমেরিকা এবং সোভিয়েত রাশিয়া সত্য শিক্ষা দিচ্ছে এবং মিথ্যা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, কিন্তু কেউ সত্তাবে তা করছেনা। কারণ প্রত্যেকে একটা সংশয়মূলক বক্তব্যকে সত্য বলে ধরে নিয়েছে।
এ সত্যবাদিতার মধ্যে যে পার্থক্য এক্ষেত্রে তা গুরুত্বপূর্ণ আমাদের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সত্য বলতে দেবতাদের ধারণাকে বোঝায়, যা আমরা অনুমান করতে পারি, কিন্তু অতো উঁচু লক্ষ্যে পৌঁছুবার আশা রাখতে পারিনে। আমাদের শিক্ষা এমন হওয়া চাই, যাতে করে আমরা সত্যের কাছাকাছি উপনীত হতে পারি এবং তার জন্য আমাদেরকে অবশ্যই সত্যবাদিতা শিক্ষা করতে হবে। প্রমাণপঞ্জীর ওপর নির্ভর করে আমাদের মতামত গঠন করা এবং যতদূর প্রমাণিত হয় ততদূর বিশ্বাস করাকেই আমি সত্যবাদিতা মনে করি! এই সম্ভাবনার পরিমাণ নিশ্চিত সত্যের স্বরূপ নির্ধারণে যে সবসময় ব্যর্থ হবে, সেকারণে পুরণো বিশ্বাসের বিরুদ্ধে আমাদেরকে নতুন প্রমাণকে গ্রহণ করার জন্য সবসময় তৈরি থাকতে হবে। অধিকন্তু, যখন কোন বিশ্বাস অনুসারে কাজ করি তখনই তা আমরা অত্যন্ত সম্ভব বলে মনে করি, কিন্তু নিজেদের বিশ্বাস ভুল কি নির্ভুল সে সম্বন্ধে চিন্তা করি না। বিশ্বাস যদি পাকাঁপোক্ত হয় তাহলে আমাদের উচিত বর্বরোচিত কাজসমূহ এড়িয়ে যাওয়া। বিজ্ঞানের একজন পর্যবেক্ষক তার পর্যবেক্ষন ফল সম্ভাব্য ভ্রান্তি সহকারে বর্ণনা করেন, কিন্তু একজন রাজনৈতিক অথবা একজন ধর্মতত্ত্ববিদ তার মতবাদের সম্ভাব্য ভ্রান্তির কথা বলেছে-কখনো কেউ তা শুনেছে কি? এর কারণ হলো বিজ্ঞানে আমরা সত্যিকার জ্ঞানের কাছাকাছি পৌঁছাই, সে-কারণে একজন মানুষ নিরাপদে বিজ্ঞানের ওপর নির্ভর করতে পারে, কিন্তু যেখানে কিছুই জানা হয়নি সেখানে ভোঁতা অনুমান এবং ইন্দ্রজাল অপরকে আমাদের বিশ্বাসে দীক্ষিত করার পরিচিতি পদ্ধতি। যদি ভিত্তি চিন্তার মধ্যে বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধে ভালো যুক্তি থাকে তাহলে তারা তা শিক্ষা করা বেআইনী ঘোষণা করত না।
কাউকে রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং নৈতিক গোঁড়ামি শিক্ষা দেয়ার অভ্যাস করালে সব রকমের অশুভ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। এ-সম্পর্কে বলতে গেলে যে সকল পেশাদার শিক্ষক সততা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ প্রচেষ্টার সহযোগে শিক্ষাদান করে তা এসকল দোষ থেকে মুক্ত এবং তাদের প্রচেষ্টা ছাত্রদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট নৈতিক এবং মানসিক পরিবর্তনের সূচনা করে। আমি তিনটা উদাহরণের সাহায্যে তা বুঝিয়ে তাদের দিচ্ছি। প্রথমতঃ রাজনীতি সম্পর্কে আমাদের আলোচনা আমেরিকার একজন অর্থনীতির অধ্যাপক যারা অতিরিক্ত ধনী তাদের আরো ধন বৃদ্ধি করার মতবাদ শিক্ষা দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন, যদি তাকে তা করতে না দেয়া হয় তাহলে তিনি হার্ভাডের প্রাক্তন অধ্যাপক এবং বর্তমানে লণ্ডনের অর্থনীতির স্কুলের খ্যাতনামা শিক্ষক মি. লাস্কির মতো যেখানে সুবিধা পাবেন সেখানে গিয়েই তার মত প্রচার করবেন। আমাদের দ্বিতীয় আলোচনা ধর্মপ্রসঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে যারা প্রখ্যাত তাদের অনেকেই খ্রিষ্টধর্মে অবিশ্বাস করেন, কিন্তু তারা তা জনসাধারণের কাছ থেকে গোপন রাখেন, কেননা তা করলে তাদের আয় কমে যাবে। সুতরাং সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয়ে যাদের মতামত খুবই মূল্যবান তাদেরকে নিশ্ৰুপ থাকার দণ্ড ভোগ করতে হয়। আমাদের তৃতীয় আলোচনা নৈতিকতা প্রসঙ্গে। বাস্তবে সব মানুষ তাদের জীবন সম্পর্কে পবিত্র ধারণা পোষণ করে না। যারা পরিষ্কারভাবে গোপন করে রাখে তারা যারা গোপন করেনা তাদের চেয়ে অধম, যেহেতু এ প্রসঙ্গে কপটতার সঙ্গে অপরাধকে যুক্ত করে। কপট ব্যক্তিদের জন্যই শিক্ষকের চাকুরির পথ খোলা। শিক্ষকের পছন্দ এবং চরিত্রের গোঁড়ামির এত ব্যাপক প্রভাব।
ছাত্রদের ওপর কিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় এর ফলে, সে-সম্পর্কে আলোচনা করছি যা আমি নৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক এ দু’পর্যায়ে বিভক্ত করে নেব। মতামতের মধ্যে কোনটাকে গ্রহণ করা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে তরুণের কাছে প্রেরণাদায়ী; তাহলে দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যেতে পারে একজন তরুণ অর্থনীতি পড়ছে, সে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদী, সমাজতন্ত্রবাদী, রক্ষণশীল, স্বাধীন বাণিজ্যবাদী, মুদ্রাস্ফীতিবাদী সকলের মধ্যে বিশ্বাসীদের মত করে বক্তৃতা শুনবে। বিভিন্ন পদ্ধতির ওপর গ্রন্থগুলোর মতামতে বিশ্বাসীদের সঙ্গে পরামর্শ করে তাকে পড়তে উৎসাহিত করা উচিত। তাহলে যুক্তির প্রমাণ যাচাই করতে শিখবে; কোন মতামত যে সম্পূর্ণ সত্য নয় তা জানতে পারবে, পূর্বনির্ধারিত বিশ্বাসে স্বীকৃতি না-দিয়ে সে মানুষকে গুণগত উৎকর্ষের জন্য বিচার করতে শিখবে। ইতিহাসকে শুধু নিজদেশের নয় বিদেশের দৃষ্টিভঙ্গিতেও শিক্ষা দেয়া উচিত। ইংল্যাণ্ডে যদি ফরাসিরা, ফ্রান্সে যদি ইংরেজরা ইতিহাস শিক্ষা দেয় তাহলে দু’দেশের মধ্যে তেমন কোন মতবিরোধ থাকবেনা, কারণ একে অন্যের দৃষ্টিকোণ বুঝতে সক্ষম হবে। এজন্য তরুণের সব প্রশ্নের অবারিত চিন্তা করতে শিক্ষা করা উচিত, যেখানেই নিয়ে যাক না যুক্তির ধাবমানতা ক্ষুণ করা উচিত নয়। জীবিকার্জন শুরু হলে বাস্তব প্রয়োজনের তাগিদে তার এ আগ্রহ মরে যাবে, কিন্তু তার পূর্বপর্যন্ত তাকে স্বাধীন কল্পনা করার আনন্দ অনুভব করতে উৎসাহিত করা উচিত। তরুণদেরকে গোঁড়ামি শিক্ষা দেয়া নৈতিক দিক দিয়েও অত্যন্ত ক্ষতিজনক, তার ফলে সমর্থ শিক্ষকরা কপট হয়ে খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেনা শুধু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দোষ হলো জান্তব প্রবৃত্তির আকারে সহনশীলতাকে বিনষ্ট করতে উৎসাহিত করে। এডমাণ্ড গোজ তার পিতাপুত্র গ্রন্থে বর্ণনা করেছে, তার বাবা আবার বিয়ে করতে যাবার সময় তাকে বলেছিলেন তার শৈশবাবস্থার কথা। বালক এডমাণ্ড দেখলেন যে তার মধ্যে এমন কিছু আছে লজ্জার কারণে তার বাবা মুখ ফুটে বলতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি আতঙ্কিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা তাহলে কি তিনি (Paedo Baptist) তার আগে পর্যন্ত তিনি তাদেরকে মন্দ লোক বলে মনে করে আসছিলেন। সুতরাং ক্যাথলিক স্কুলের ছাত্রেরা বিশ্বাস করে প্রোটেষ্টান্টরা খারাপ, যে কোন ইংরেজি ভাষাভাষী দেশের স্কুলের ছাত্রেরা বিশ্বাস করে ফরাসিরা খারাপ, ফরাসিদেশের ছেলেরা বিশ্বাস করে জার্মানেরা খারাপ এবং জার্মানির ছেলেরা ফরাসিদেরকে খারাপ মনে করে। বুদ্ধিবৃত্তিসম্মত পদ্ধতিতে নির্ভযোগ্য নয় এমন সব মতামতকে শিক্ষা দেয়ার আংশিক দায়িত্ব যখন স্কুল গ্রহণ করে, তখন তা বিরুদ্ধবাদীদের সম্বন্ধে খারাপ ধারণা জন্মিয়ে দিতে বাধ্য হয়। (বাস্তবে অধিকাংশ স্কুল তা করে থাকে) তা না হলে বিবেচনাশক্তিকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে ভাবাবেগ জাগাতে পারেনা। গোঁড়ামির কারণেই শিশুরা কৃপণ, নির্মম এবং কলহপরায়ণ হিসেবে গড়ে ওঠে। যে পর্যন্ত ধর্ম, নৈতিকতা এবং রাজনীতির নির্দিষ্ট মতামতের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা যাবেনা, তখন পর্যন্ত এর থেকে মুক্তিলাভের কোন পথ নেই।
শেষমেষ ব্যক্তির নৈতিকতার ক্ষতি সামাজিক নৈতিকতার অকথিত ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে। যুদ্ধ এবং নির্যাতন সব জায়গায় চলছে এবং তা স্কুলের শিক্ষার কারণেই সহজে সম্ভব হয়ে উঠেছে। ওয়েলিংটন বলতেন, ইটনের খেলার মাঠে ওয়াটালু যুদ্ধ জয়লাভ করেছিল। তিনি অধিকতর নিশ্চিতভাবে বলতে পারতেন ইটনের শ্রেণীকক্ষে ওয়াটালু যুদ্ধজয়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। মাধ্যমিক এবং মাধ্যমিক স্কুল ছাড়া আমাদের গণতান্ত্রিক যুগে ইটনের প্রয়োজনীয়তা নেই। প্রত্যেক দেশে পতাকা দুলিয়ে সম্রাট দিবস ৪টা জুলাইয়ের উৎসব, অফিসার ট্রেনিং কোর্স ইত্যাদি পালন করার মাধ্যমে বালকদেরকে নরহত্যার শিক্ষা দেয়া হয় এবং বালিকাদের মনে এ বিশ্বাস জাগিয়ে দেয়া হয় যে, সকল মানুষ নরহত্যায় নিয়োজিত তারাই সকল শ্রদ্ধার দাবীদার। কর্তৃপক্ষ যদি শিক্ষক এবং ছাত্রদের মতামতের স্বাধীনতা না দেয় তাহলে অধঃপতনের গহ্বর থেকে বালক বালিকারা মুক্তি লাভ করতে পারবেনা। কোনো কিছুকে গণ্ডীবদ্ধ করলে তা সমস্ত দোষের উৎস হয়ে দাঁড়ায়। ধর্মের মত, শিক্ষাবিভাগীয় কর্তারা ছেলেদের পানে মুক্তিকামী আত্নসম্পন্ন মানুষ হিসেবে, দৃষ্টিপাত করেনা, তারা তাদেরকে জাঁকজমকপূর্ণ সামাজিক পরিকল্পনার উপাদান হিসেবে কারখানার ভাবী হাত হিসেবে, যুদ্ধের সঙ্গীন হিসেবে এবং কি হিসেবে যে ভাবেন না তা কল্পনা করা যায় না। প্রত্যেক শিশুকে তার ব্যক্তিত্ব এবং অধিকারসমন্বিত আলাদা লক্ষ্যের অভিসারী না ভেবে যে লোক ভেল্কিবাজীর যন্ত্র, যুদ্ধক্ষেত্রের সৈনিক এবং রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে শুধু ভাবে তার শিক্ষা দান করা উচিত নয়। সমস্ত সামাজিক প্রশ্নে এবং সর্বোপরি শিক্ষাব্যবস্থায় মানুষের ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকেই জ্ঞানের সূচনা।