১৪. শাস্ত্রানুশীলন, সাহিত্যসাধনা ও সঙ্গীতচর্চা

শাস্ত্রানুশীলন, সাহিত্যসাধনা ও সঙ্গীতচর্চা

অষ্টাদশ শতাব্দীর যে সব পণ্ডিতের নাম আগের এক অধ্যায়ে উল্লেখ করেছি, তাদের সকলেরই টোল বা চতুষ্পাঠী ছিল। এই সকল চতুষ্পাষ্ঠীর মাধ্যমেই তঁরা শাস্ত্রানুশীলন করতেন ও ছাত্রদের নানা শাস্ত্র এবং শব্দ, ব্যাকরণ, কাব্য, অলঙ্কার, ছন্দ প্ৰভৃতি বিষয়ে শিক্ষাদান করতেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই নৈয়ায়িক ও স্মার্ত হিসাবে প্ৰতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। অনেকে বিচিত্র বিধানও দিতেন। যেমন কৃষ্ণানন্দ সার্বভৌম (১৭৭৫-১৮৪০) শারদীয়া পূজার নবমীর দিনই দুর্গ। প্ৰতিমার বিসর্জনের বিধান দিয়েছিলেন। তা থেকেই ‘কৃষ্ণানন্দী দশহরা’ প্ৰবাদ বাক্যে দাঁড়িয়েছে। বরিশাল কলসিকাঠির বিখ্যাত ব্ৰাহ্মণ জমিদারবংশের পৃষ্ঠপোষকতায় যে সকল পণ্ডিত বাকলা সমাজকে উজ্জ্বল করেছিলেন, কৃষ্ণানন্দ ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন দিকপাল। নবদ্বীপে শঙ্কর তর্কবাগীশের কাছে শিক্ষালাভ করে নিজ প্ৰতিভাগুণে তিনি যশস্বী হয়েছিলেন। ভারতের নানা অঞ্চল থেকে ছাত্ররা তার চতুষ্পাঠীতে শিক্ষালাভ করতে আসত।

ত্ৰিবেণীর জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের (১৬৯৪-১৮০৭) কথা আমরা আগেই বলেছি। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এরকম দীর্ঘজীবী ও অসাধারণ পণ্ডিত আর দ্বিতীয় ছিল না। তাঁর মৃত্যুর পূর্বে তাঁকে গঙ্গাজলী করবার জন্য যখন তাকে নিয়ে আসা হয়, তখন তাঁর ছাত্রমণ্ডলী তাঁকে প্রশ্ন করেছিল ‘আপনি তো দীর্ঘকাল ধরে শাস্ত্রাঙ্কুশীলন ও ঈশ্বর সাধনা করলেন, এখন আমাদের বলে যান, ঈশ্বর সাকার না নিরাকার?’ জগন্নাথ উত্তর দিয়েছিল ‘ঈশ্বর নীরাকার’।

অন্যান্য সুত্র থেকেও আমরা অনেক পণ্ডিতের নাম পাই। নবদ্বীপের গোকুলানন্দ বিস্তামণি অষ্টাদশ শতাব্দীর একজন অসাধারণ জ্যোতির্বিদ পণ্ডিত ছিলেন। তিনি দেশীয় প্রথায় একটি উৎকৃষ্ট ঘড়ি তৈরী করেছিলেন, যার সাহায্যে দণ্ড, পল, ইত্যাদির সুক্ষ্মসময় সঠিকভাবে নির্ণয় করা যেত। নবদ্বীপের গোপাল (রামগোপাল) ন্যায়ালঙ্কার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্ৰের সভাপণ্ডিত ছিলেন। রাহা রাজবল্লভ (১৬৯৮-১৭৬৩) যখন তাঁর অষ্টমবর্ষীয়া বিধবা কন্যার বিয়ে দেবার জন্য কৃষ্ণচন্দ্রের মতামত জানবার জন্য কয়েকজন পণ্ডিত পাঠান, তখন তারা গোপালকে তর্কযুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু গোপাল অপকৌশল প্রয়োগ করে বিধবা বিবাহ দেশাচার বিরুদ্ধ বলে প্রচার করে, এবং রাজবল্লাভের চেষ্টা ব্যৰ্থ করে। তিনি ‘আচারনির্ণয়’, ‘উদ্বাহনির্ণয়’, ‘কালনির্ণয়’, ‘শুদ্ধিনির্ণয়’, ‘দায়নির্ণয়’, ‘বিচার নির্ণয়’, ‘তিথিনির্ণয়’, ‘সংক্রান্তিনির্ণয়’, প্ৰভৃতি গ্ৰন্থ রচনা করে গেছেন।

ফরিদপুরের চন্দ্রনারায়ণ ন্যায়পঞ্চানন একজন প্ৰখ্যাত নৈয়ায়িক পণ্ডিত ছিলেন। নিজ শাস্ত্ৰজ্ঞান দ্বারা তিনি নদীয়ার শঙ্কর তর্কবাগীশ, ত্ৰিবেণীর জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন প্রভৃতি পণ্ডিতদের সন্তুষ্ট করেছিলেন। নব্যন্যায়ে তার রচিত ‘চান্দ্রনারায়ণী’ পত্রিকা পণ্ডিতসমাজে প্রচারিত হয়েছিল। এ ছাড়া তিনি ‘কুসুমাঞ্জলি’র টীকা ও ন্যায়সূত্রের বৃত্তি রচনা করেছিলেন।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে পূর্ববঙ্গের বাকুলার একজন বড় পণ্ডিত ছিলেন জগন্নাথ পঞ্চানন। তাঁক্স পাণ্ডিত্যের সুবাদে তাঁর গ্রাম নলচিড়া ‘নিম নবদ্বীপ’ বা অর্ধনবদ্বীপ আখ্যা পেয়েছিল।

২৪ পরগণার খাটুরার অনস্তরাম বিদ্যাবাগীশের অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল স্মৃতি শাস্ত্ৰে। শোভাবাজার রাজবাটিতে তাঁর যথেষ্ট প্ৰতিপত্তি ছিল এবং কলকাতার হাতিবাগানে তিনি একটি টোল খুলেছিলেন। তাঁরই জ্ঞাতি ও ছাত্র ছিলেন। কালীকিঙ্কর তর্কবাগীশ। একবার শোভাবাজার রাজবাটিতে কোনও এক বিচারে জয়লাভ করে তিনি নিজ অধ্যাপক অনন্তরামের সম্মান বৃদ্ধি করেছিলেন।

কৃষ্ণরাম ভট্টাচাৰ্য ছিলেন নদীয়ার মালীপোতার একজন বিখ্যাত শাস্ত্রজ্ঞপণ্ডিত। আসামের আহমবংশীয় নৃপতি রুদ্ৰসিংহ হিন্দু শাস্ত্রাহ্যায়ী ক্রিয়া কলাপাদির (১৬৯৬-১৭১৪) জন্য তাঁকে আহবান করে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং তাঁর কাছ থেকে শক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন। কামাখ্যা মন্দির রক্ষার ভার তার ওপর অৰ্পিত হয়েছিল। সাহিত্যে অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল নদীয়ার বজাপুরের জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের (১৭৭৫-১৮৪৬)। তিনি প্ৰাচ্যতত্ত্ববিদ কোলক্রকের এবং পরে শ্ৰীরামপুর মিশনের ক্যারীর পণ্ডিত ছিলেন। স্বকবি হিসাবেও তিনি সুপরিচিত ছিলেন। ফারসী ভাষাতেও তঁরে দখল ছিল, এবং • তিনি একখানা ফারসী অভিধানও সংকলন করেছিলেন। নৈয়ায়িক হিসাবে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন নদীয়ার রামভদ্র সার্বভৌমের ছাত্র জয়রাম ন্যায়পঞ্চানন। নদীয়ারাজ রামকৃষ্ণ তীর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর রচিত নয়খানা। গ্রন্থের মধ্যে প্ৰসিদ্ধ ‘ন্যায়সিদ্ধান্তমালা’, ‘তত্ত্বচিন্তামণি’, ‘গুণদীধিতিবিবৃতি’, ‘কাব্যপ্ৰকাশতিলক’ ইত্যাদি। কাশীতে অধ্যাপনাকালে তিনি তার পাণ্ডিত্যের, জন্য “জগদগুরু’ আখ্যা লাভ করেছিলেন। নৈয়ায়িক হিসাবে নাম করেছিলেন ত্রিপুরার কালীকচ্ছের দয়ারাম ন্যায়ালঙ্কার। বহু দূরদেশ থেকে ছাত্ররা তাঁর চতুষ্পাঠীতে পড়তে আসত।

নব্যন্যায়ের প্রখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন বর্ধমানের সাতগাছিয়ার দুলাল তর্কবাগীশ। তিনি শঙ্কর তর্কবাগীশের প্রতিপক্ষ ছিলেন। তাঁর রচিত। নব্যন্যায়ের বহুতর পত্রিকা নবদ্বীপাদি সমাজে ও বাঙলার বাহিরে প্রচারিত হয়েছিল। তার কৃতী ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন, জগমোহন তর্কসিদ্ধান্ত, জয়রাম তর্কপঞ্চানন, কান্তিচন্দ্ৰ সিদ্ধান্তশেখর, দুৰ্গাদাস তর্কপঞ্চানন প্ৰমুখ। নৈয়ায়িক ও পত্রিকাকার হিসাবে আরও একজন বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন নবদ্বীপের বিশ্বনাথ ন্যায়ালঙ্কার। তিনি রাজা রুষঃচন্দ্রের দানভাজন ছিলেন। সমকালীন প্ৰখ্যাত নৈয়ায়িকগণ তাঁর পত্রিকাসমূহকে প্রামাণিক বলে গণ্য করতেন। বৈদ্যবংশীয় মহারাজা রাজবল্লভ দ্বিজাচারে উপনয়ন-অনুষ্ঠানের জন্য যে সব পণ্ডিতগণের ব্যবস্থাপত্র নিয়েছিলেন, বিশ্বনাথ তাঁদের অন্যতম। এই ব্যবস্থাপত্রের রচনাকাল ১৭৫০ খ্রীস্টাব্দ। বিশ্বনাথের ছেলে কালীপ্রসাদ তর্কালঙ্কারও (১৭৩৯-?) একজন প্ৰখ্যাত নৈয়ায়িক ছিলেন।

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবিদের অন্যতম ছিলেন মথুরেশ। তিনি একবার এক হেয়ালিপূর্ণ শ্লোক আবৃত্তি করে একজন দিগ্বিজয়ী পণ্ডিতকে হারিয়ে মহারাজার কাছ থেকে ‘মহাকবি’ উপাধি পেয়েছিলেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের প্ৰধান সভাপণ্ডিতদের মধ্যে আরও ছিলেন শিবরাম বাচস্পতি। ‘ষড়দর্শনবিৎ’ আখ্যায় তিনি ভূষিত হয়েছিলেন। অনুমানখণ্ডের চর্চা যখন চরমে উঠেছিল, সে সময় তিনি অনাদৃত প্ৰাচীন ন্যায়ের চর্চা পুনজীবিত করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের ‘মধ্যে প্ৰসিদ্ধ ‘গৌতমসূত্ৰবিধি’ ও গদাধর-রচিত মুক্তিবাদের ওপর এক টীকা। রাজা রাজবল্লতের সভায় তিনি আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। শ্ৰীকৃষ্ণ তর্কালঙ্কারের আদি বাড়ি ছিল মালদহে। কিন্তু নবদ্বীপে অধ্যয়ন করতে এসে তিনি নবদ্বীপেই বসবাস করেন। স্মৃতিশাস্ত্রে তার বিশেষ বুৎপত্তি ছিল। তারা প্ৰণাত জীমূতবাহনের দায়ভাগ টীকা ও দায়ক্রমসংগ্রহ’ প্ৰামাণিক গ্ৰন্থ হিসাবে গণ্য হয় ও এখনও নবদ্বীপে পড়ানো হয়। কোলক্ৰক সাহেব তীব্র ‘দায়ক্ৰমসংগ্ৰহ-এর ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন।

স্মার্তপণ্ডিত হিসাবে নদীয়ার রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। শ্ৰীকৃষ্ণ সার্বভৌম। ১৭০৩ খ্রীস্টাব্দে নবদ্বীপাধিপতি রামকৃষ্ণ রায় তাঁকে ভূমিদান করেন, ও রাজা রামজীবনের তিনি সভাপণ্ডিত ছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে প্রসিদ্ধ ‘কৃষ্ণপদামৃত’ (১৭২২), ‘পদাঙ্কদূত’ (১৭২৩), ‘মুকুন্দপদমাধুরী’ ও ‘সিদ্ধান্তচিন্তামণি’। অষ্টাদশ শতাব্দীতে তন্ত্রশস্ত্রে বিশেষ বুৎপত্তি ছিল হুগলী পালপাড়ার হরিহরানন্দনাথ তীৰ্থস্বামীর (১৭৬২-১৮৩২)। তার ‘কুলাবধূত উপাধি ছিল। রাজা রামমোহনের (১৭৭২-১৮৩৩) সঙ্গে তার বিশেষ হৃদ্যতা ছিল, এবং অনেকের মতে তিনি রামমোহনের তন্ত্রশিক্ষার গুরু ছিলেন। তাঁর রচিত ‘কুলাৰ্ণবতন্ত্র’ ও ‘মহনির্বাণতন্ত্র’-দ্বয়ের টাকা তন্ত্রশাস্ত্রে তার অসাধারণ, পাণ্ডিত্যের পরিচয় দেয়।

দুই

পণ্ডিতগণ কর্তৃক শাস্ত্র অনুশীলন ও সংস্কৃত ভাষায় প্রামাণিক টাকা-টিপ্পনী রচনা ছাড়া, অষ্টাদশ শতাব্দী উদ্ভাসিত হয়ে আছে বাংলা সাহিত্যচর্চার আলোকে। সুধীজন, নূতন নূতন কাব্য রচনা করেছিলেন, এবং এ বিষয়ে অনেকেই সমসাময়িক রাজারাজড়াদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। যারা এরূপ পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন রামেশ্বর (চক্রবর্তী) ভট্টাচাৰ্য, ঘনরাম চক্রবর্তী, ভারতচন্দ্ৰ, কবিচন্দ্ৰ, জগন্দ্রাম ও নিত্যানন্দ। রামেশ্বরই ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের সবচেয়ে বড় কবি। তাঁর কথা আমরা আগেই বলেছি।

‘শিবায়ন’ ছাড়াও রামেশ্বর রচনা করেছিলেন একখানা ‘সত্যনারায়ণের পাঁচালী’ ও মহাভারতের শাস্তিপর্ব অবলম্বনে এক কাব্য।

আঠারো শতকের গোড়ার দিকে বিষ্ণুপুররাজ গোপাল সিংহের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন শঙ্কর কবিচন্দ্র। তিনি গোপাল সিংহের (১৭১২-৪৮) সভাকবি ছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে ছিল ‘গোবিন্দমঙ্গল’, ‘কৃষ্ণমঙ্গল’, ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’ প্ৰভৃতি।

সমসাময়িককালে তাঁর কবিখ্যাতির জন্য বর্ধমান-রাজ কীৰ্তিচন্দ্ৰ কতৃক সভাকবির পদে বৃত হয়েছিলেন ঘনরাম চক্রবর্তী। রাজার আদেশে তিনি একখান ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্য রচনায় প্ৰবৃত্ত হন, এবং ১৭১১ খ্রীস্টাব্দে, তা সম্পূৰ্ণ করেন। তিনিও একখানা ‘সত্যনারায়ণের পাঁচালী’ রচনা করেছিলেন।

ঘনরামের কাব্যভাষার উত্তরসূরী হচ্ছেন রায় গুণাকর ভারতচন্দ্ৰ (১৭১২১৭৬০)৷ নানারূপ অদৃষ্টবৈগুণ্যের পর তিনি নদীয়াধিপতি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আশ্রয় পান, এবং তাঁর সভাকবি নিযুক্ত হন। কৃষ্ণচন্দ্রের আদেশে তিনি ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য রচনা করে ‘রায় গুণাকর’ উপাধি পান। তিনি আরও রচনা করেন ‘বিন্যাসুন্দর’, ‘রাসমঞ্জরী’, ‘সত্যপীরের কথা’, ‘নাগাষ্টক’ প্ৰভৃতি গ্ৰন্থ। ভাষার লালিত্য, ও সুষমা ছন্দের নৈপুণ্য ও চরিত্র অঙ্কনের দক্ষতার জন্য তিনি প্ৰসিদ্ধ।

পঞ্চকুটাধিপতি রঘুনাথ সিংহের আদেশে একখানা ‘অদ্ভুত রামায়ণ’ রচনা করেছিলেন বাঁকুড়া জেলার ভুলুই গ্রামের জগন্দ্রাম রায়। মূল অদ্ভুত রামায়ণ-এর नgझ ५८ीव्र (कान् शिश G惠। এতে রামায়ণের সপ্তকাণ্ড ছাড়া পুষ্কর্যাকাণ্ড নামে একটা অতিরিক্ত কাণ্ড আছে। ‘অদ্ভুত রামায়ণ’ ছাড়া তিনি আরও রচনা করেছিলেন ‘দুর্গাপঞ্চরাত্র’, ‘আত্মবোধ’ ইত্যাদি।

নিত্যানন্দ (মিশ্র) চক্রবর্তী মেদিনীপুরের কাশীজোড়াধিপতি রাজনারায়ণের সভাসদ ছিলেন। তিনি রচনা করেছিলেন ‘শীতলামঙ্গল’, ‘ইন্দ্ৰপূজা’, ‘পাণ্ডবপূজা’, ‘বিরাট পূজা’, ‘সীতাপূজা’, ‘লক্ষ্মীমঙ্গল’, ‘কালুরায়ের গীত’ প্ৰভৃতি। তাঁর লেখার মধ্যে বহু ফারসী, হিন্দী ও উর্দু শব্দ আছে। তাঁর লেখাগুলি পাঁচালী আকারে মেদিনীপুরে গীত হত।

বস্তুতঃ বাংলা সাহিত্যের পূর্ববর্তী ধারা অনুযায়ী অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমরা মঙ্গলকাব্য ও অনুবাদ কাব্যের প্রাচুর্যই বেশী পরিমাণে লক্ষ্য করি। শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদে গঙ্গাধর দাস রচনা করেছিলেন তাঁর ‘জগৎমঙ্গল’ কাব্য। শতাব্দীর শেষের দিকে রচিত হয়েছিল তিনখানা ধর্মমঙ্গল কাব্য-মানিক গাঙ্গুলির, রামকান্তের ও গোবিন্দরামের। এ ছাড়া আঠারো শতকেই রচনা করেছিলেন। জীবন ঘোষাল তার ‘মনসামঙ্গল,’ নিধিরাম কবিচন্দ্ৰ তার ‘গোবিন্দমঙ্গল’, নিধিরাম কবিরত্ব তাঁর কালিকামঙ্গল’ ও আনন্দরাম চক্রবর্তী তার ‘পদ্মাপুরাণ’। অনুবাদ সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিলেন রামপ্ৰসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। তার রচিত ‘রামায়ণ’ দ্বারা। এছাড়া আঠারো শতকে রচিত হয়েছিল গঙ্গারাম দাস (দেব -চৌধুরীর) ‘লিবকুশ সংবাদ’, ‘শুক সংবাদ ও ‘মহারাষ্ট্র পুরাণ’, জয়নারায়ণ রায়ের ‘চণ্ডীকার্য’ ও ‘হরিলীলা’, নিধিরাম কবিচন্দ্ৰের সংক্ষিপ্ত ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’ ও ‘দাতাকৰ্ণ’, বনদুর্লভের ‘দুর্গাবিজয়’, ’’ শচীনন্দনের ‘উজ্জলনীলমণি’, রামপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দুর্গাপঞ্চর্যাত্রি, জগৎ নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আত্মবোধ’ ও জয়নারায়ণ ঘোষাল কতৃক পদ্মপুরাণের ‘কাশীখণ্ড’। অনুবাদ সাহিত্যে আরও উল্লেখনীয় সংযোজন হচ্ছে রামগতি সেনের ‘মায়াতিমিরচিন্দ্ৰিকা’, ‘প্ৰবোধচন্দ্ৰোদয়’, ও ‘যোগকল্পলতা’ প্রভৃতি সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদ ও গোলকনাথ দাস কতৃক ইংরেজি ‘Disguise’ নাটকের অনুবাদ। দামোদর মিশ্র রচনা করেছিলেন। একখানা সঙ্গীতের বই, নাম ‘সঙ্গীত দৰ্পণ’, ও রামসিংহ তার ‘রাজমালা’।

তিন

পদাবলী সাহিত্যেও আঠারো শতক বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। শতাব্দীর প্রখ্যাত পদকর্তা ছিলেন গিরিধার। তিনি জয়দেব-রচিত ‘গীতগোবিন্দ’ সর্বপ্রথম বাংলা পদ্যে অনুবাদ করেন (১৭৩৬)। ‘পদকল্পতরু’ নামক বিখ্যাত পদাবলী গ্ৰন্থ এই শতাব্দীতেই সংকলন করেন স্বনামধন্য কীর্তনীয়া বৈষ্ণবদাস (আসল নাম গোকুলানন্দ সেন)। বর্ধমান জেলার বৈদ্যাপুরে তাঁর বাড়ী ছিল। তিনি আরও সংকলন করেছিলেন ‘গুরুকুলপঞ্জিক’। তাঁর রচিত গীতসমূহ এখনও ‘টেঞার ঢপ’ নামে প্ৰসিদ্ধ। আঠারো শতকের একজন বড় পদকর্তা ছিলেন উদ্ধব দাস। তাঁর রচিত শতাধিক পদ পাওয়া যায়। আঠারো শতকের পদকর্তাদের মধ্যে শ্ৰীকৃষ্ণচৈতন্যের মহিমাসুচক শ্রুতিমধুর অনুপ্ৰাসযুক্ত পদরচনায় বিশেষ দক্ষতা ছিল বীরভূমের জোফিলাই নিবাসী জগদানন্দের। শতাব্দীর আর দু’জন দক্ষ পদরচয়িত ছিলেন চন্দ্ৰশেখর (শশিশেখর) ও অকিঞ্চন। অকিঞ্চনের প্রকৃত নাম ছিল ব্রজকিশোর রায়। তিনি বর্ধমানরাজের দেওয়ান ছিলেন। তিনি বেশ উচ্চমানের বহু শুষ্ঠামাসঙ্গীত ও কৃষ্ণ-বিষয়ক গান রচনা করেছিলেন।

চার

অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রখ্যাত পালাগান রচয়িতা ছিলেন শ্ৰীকৃষ্ণকিঙ্কর। তাঁর রচিত মনসামঙ্গল, শীতলামঙ্গল, রাবণ্যপূজা, বরুণপূজা, ইন্দ্ৰপূজা, লঙ্কাপূজা, পঞ্চাননমঙ্গল, দেবী লক্ষ্মীর গীত, সত্যনারায়ণের সাত ভাই, দুঃখীর পাল, শীতলার জন্মপাল, শীতলার জাগরণপালা প্ৰভৃতি পালাগানগুলি এক সময় মেদিনীপুর ও হাওড়া জেলার গ্ৰামাঞ্চলে খুব জনপ্রিয় ছিল।

অষ্টাদশ শতাব্দীর সাহিত্যধারার পাশে আর এক সাহিত্যধারার সৃষ্টি হয়েছিল। এটা হচ্ছে কবিওয়ালাদের গান। এর স্রষ্টা ছিল। রঘুনাথ দাস। শতাব্দীর প্ৰখ্যাত কবিয়ালদের মধ্যে ছিল রাসুন্নুসিংহ (১৭৩৫-১৮০৭) নীলমণি ঠাকুর, গোজলা গুই, নিত্যানন্দ বৈরাগী (১৭৫১–১৮২১), নৃসিংহ রায় (১৭৩৮-১৮০৪), বলাই বৈষ্ণব, ভবানী বণিক, ভোলা ময়রা, এণ্টনী ফিরিঙ্গী (- ১৮৩৭) ও হরু ঠাকুর (১৭৪৯-১৮২৪)।

পাঁচ

সঙ্গীতের ক্ষেত্রে অষ্টাদশ শতাব্দীর বিশেষ অবদান বিষ্ণুপুর ঘরানার উদ্ভব। এটা ধ্রুপদেরই একটা বিশেষ ঘরানা। এই ঘরানার বিশিষ্ট কলাবিৎদের মধ্যে ছিলেন গদাধর চক্রবর্তী, মাধব ভট্টাচাৰ্য, কৃষ্ণমোহন গোস্বামী, নিতাই নাজীর ও বৃন্দাবন নাজীর। অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে রামশঙ্কর ভট্টাচাৰ্য কর্তৃক এই ঘরানার সাংগীতিক খ্যাতি বিশেষভাবে বর্ধিত হয়।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে বাঙলাদেশে টপ্পা গানের গায়ক হিসাবে প্ৰসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। নিধুবাবু বা রামনিধি গুপ্ত। যদিও তাকে বাঙলা দেশে টপ্পা গানের প্রবর্তক বলা হয়, তা হলেও সেটা ঠিক নয়। তাঁর পূর্বে কালী মির্জা বা কালিদাস চট্টোপাধ্যায়ই টপ্পা গানের গায়ক ও রচয়িতা ছিলেন। তবে নিধুবাবুই এটাকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। তার রচিত টপ্পাতেই আধুনিক বাংলা কাব্যের আত্মকেন্দ্ৰিক লৌকিক সুর প্রথম ধ্বনিত হয়।’

শ্যামাসঙ্গীতে হালিশহরের রামপ্ৰসাদ সেন ছিলেন অদ্বিতীয়। তিনি একাধারে শক্তিসাধক, কবি ও গায়ক ছিলেন। প্ৰথম জীবনে তিনি কলকাতায় মুহুরীর চাকরি করতেন। পরে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আশ্রয় লাভ করেন। মহারাজ তাকে একশত বিঘা জমি দান করেন। তিনিও একখানা ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্য রচনা করেন। তাঁর অপর রচনা ‘কালীকীর্তন’। তাঁর কাব্য প্রতিভার জন্য তিনি ‘কবিরঞ্জন’ উপাধি পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সবচেয়ে বেশী প্ৰসিদ্ধ তাঁর রচিত সঙ্গীতের জন্য। তাঁর রচিত গান রামপ্রসাদী সঙ্গীত’ নামে প্ৰসিদ্ধ ও তাঁর গীতি-ভঙ্গী ‘রামপ্রসাদী সুর’ নামে পরিচিত। রামপ্রসাদী গান এক, সময় বাঙলার লোককে মাতিয়ে রেখেছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *