লীলাবতীদের বাড়ি ওয়ারীতে। বাড়ি না বলে দুর্গ বললেও খুব ভুল হবে না। জেলখানার মত উঁচু পাচিলে বাড়ি ঘেরা। গেট নিশ্চিছন্দ্ৰ লোহার। ফাঁক-ফোকর নেই যে ভেতরের কোন দৃশ্য হঠাৎ চোখে পড়বে। এই জাতীয় বাড়ির ভেতরটা সাধারণত অন্য রকম হয়ে থাকে। গেট পেরিয়ে ভেতরে পা দিলেই আধুনিক কেতার বাংলো টাইপ বাড়ি দেখা যায়। লীলাবতীদের বাড়ি সে রকম নয়। নোনা ও শ্যাওলা ধরা পঁচিলের মত বাড়িটাও নোনা ও শ্যাওলা ধরা। ফরিদার মা জাহানারা গত দশ বছর ধরে এই বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি করার পরিকল্পনা করছেন। জাহানারা এমন এক মহিলা যিনি তার সমস্ত প্রতিভা শুধুমাত্র পরিকল্পনাতেই ব্যয় করেন। অর্থ-বিত্তহীন মানুষদের প্রধান বিলাস পরিকল্পনা। জাহানারা বেগমের অর্থবিত্ত দুটাই আছে। বেশি পরিমাণেই আছে। জাহানারার স্বামী ওয়াকিল আহমেদ অর্থ ও বিত্ত দুটোই প্রচুর পরিমাণে রেখে মারা গেছেন। জাহানারা সেই সঞ্চিত অর্থ কিছুই খরচ করতে পারেননি।
মেয়েকে নিয়ে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াবেন এই জাতীয় পরিকল্পনা তাঁর ছিল। এখনো আছে–সেই পরিকল্পনাও বাস্তবায়িত হয়নি।
আজ লীলাবতীর ১৮তম জন্মদিন।
এই জন্মদিন তিনি কিভাবে পালন করবেন তা নিয়ে গত তিনমাস ধরে চিন্তা করেছেন। একটি মেয়ের ১৮তম জন্মদিন খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি ঠিকঠাকমত হোক তিনি মনে-প্ৰাণে তা চেয়েছিলেন। বয়স ১৮ হয়েছে। লীলাবতী ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে পারবে–কাজেই তিনি ভেবেছিলেন মেয়েকে ছোট্ট একটা গাড়ি কিনে দেবেন। সেই গাড়ি শেষ পর্যন্ত কেনা হয়নি। তাঁর রঙ পছন্দ হয়নি। তাঁর পছন্দ লাল রঙ। সেই লাল–রঙের লাল না। সূর্য ডোবার পরে পরে আকাশে যে লাল রঙ দেখা যায়। সেই রঙ। তেমন পাওয়া যায়নি। কোন লাল রঙ তার চোখে লাগল না।
জন্মদিনে বাড়ির ছাদে একটা গানের আসর করবেন–এই পরিকলল্পনাও ছিল। কয়েকজন গায়িকার সঙ্গে যোগাযোগও করেছিলেন। তিনজনের একটা তালিকা করেছিলেন। যেহেতু একক গানের অনুষ্ঠান সেহেতু তিনজনের ভেতর কাকে বলবেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেটা ঠিক করতে পারলেন না। জন্মদিনের অনুষ্ঠান অবশ্যি তার পরেও ভালমত হয়েছে। লীলাবতীর বন্ধুবান্ধবরা ঝাক বেঁধে এসেছে। জাহানারা কখনো কোন অনুষ্ঠানে তার বা তার শ্বশুরবাড়ির কাউকে আসতে বলেন না। তারপরেও অনেকে এসেছে। বাড়ির প্রধান দরজায় লাল-নীল ক্ৰীশমাস বাতি জ্বলছে–নিভাছে। লীলাবতী এই বাতি দেখে মার সঙ্গে খানিকক্ষণ রাগারগি করল। সে মাথা ঝাকিয়ে বলল, মা, আমার কি বিয়ে না-কি? বাতি-ফ্যাতি কেন?
জাহানারা বিরক্ত গলায় বললেন, উৎসবে বাতি জ্বলে। এটা নতুন কিছু না। তুই ও রকম মাথা ঝাকিয়ে কথা বলবি না তো। অসহ্য লাগে।
লীলাবতী বলল, (আবার মাথা ঝাকিয়ে–সে মাথা না বঁকিয়ে কথা বলতে পারে না)। আমার সব কিছুই তোমার অসহ্য লাগে?
জাহানারার মুখে এসে গিয়েছিল বলেন–হ্যাঁ লাগে। শেষ মুহুর্তে নিজেকে সামলালেন। বললেন না। মেয়ের জন্মদিন। এই দিনে কঠিন কঠিন কথা না বলাই ভাল। তবে সত্যি কথা হচ্ছে লীলাবতীর বেশিরভাগ জিনিশই তার অসহ্য লাগছে। বিশেষ করে জন্মদিন উপলক্ষে যে পোশাকটা পরেছে–সেটা তো রীতিমত অশালীন।
জাহানারা বললেন, তুই এটা কি পরেছিস?
লীলাবতী বলল, রাজস্থানী একটা ড্রেস পরেছি মা।
আজকের দিনে রাজস্থানী ড্রেস কেন? এটা কি রাজস্থান? তুই কি রাজস্থানের মরুভূমিতে বাস করছিস?
হ্যাঁ–আমার কাছে বাড়িটাকে রাজস্থানের মরুভূমির মতই লাগছে মা।
সুন্দর দেখে একটা শাড়ি পর। আঠারো বছরের জন্মদিনে সব মেয়েরা শাড়ি পরে। লীলাবতী বলল, আমি পরি না। আমি রাজস্থানী ড্রেস পরি। তা ছাড়া আজ আমি নাচব। শাড়ি পরে নাচব কিভাবে?
জাহানারা মনে মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। তাঁর মনে হল, তার একচল্লিশ বছরের জীবনে তিনি যে কয়টা বড় ভুল করেছিলেন–তার মধ্যে একটা হচ্ছে মেয়েকে নাচ শেখানো। আট বছর বয়সে তিনি নিজে নাচের স্বকুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে
লীলাবতীর বাবা ওয়াকিল আহমেদ সাহেব এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বললেন, দিনরাত বাসায় নূপূরের শব্দ, এইসব কি? নাচ হচ্ছে এক ধরনের লাফালাফি–এর মধ্যে শেখার কি আছে? শিখতে চাইলে গান শিখুক।
জাহানারা বিরক্ত হয়ে বললেন, নাচ যদি লাফালাফি হয় তাহলে তো গানও চিৎকার। গান শিখে তাহলে লাভ কি?
জাহানারা মেয়েকে গান শেখাননি–নাচই শিখিয়েছেন। এখন মনে হচ্ছে তিনি ভুল করেছেন। লীলাবতী হয়ছে দুর্বিনীত, অহংকারী ও জেদী। তার মাথায় কিছু একটা ঢুকলে তা আর বের হয় না। স্থায়ীভাবে বসে যায়। নাচ মেয়ের মাথায় বসে গেছে। এখন তাঁর মনে হয় কাঁটা দিয়ে মাথার ভেতর থেকে জিনিস তোলার ব্যবস্থা থাকলে তিনি তুলে ফেললেন।
লীলাবতীর বন্ধুরা খুব হৈ-চৈ করছে। এদের মধ্যে একজন ম্যাজিশিয়ান আছে যে ম্যাজিক দেখাচ্ছে এবং যা দেখাচ্ছে তার রহস্যই বের হয়ে পড়ছে। তাতে দর্শকদের আনন্দের কোন ঘাটতি হচ্ছে না। দড়ি কাটা খেলার সময় ম্যাজিশিয়ান দড়ি এবং কাচি হাতে উঠে দাঁড়াতেই একজন বলল, দেখুন, আপনার হাতের তালুতে কি? ম্যাজিশিয়ান বলল, কেঁচি।
হাত উপুড় করে দেখান। মনে হচ্ছে আরো কিছু আছে।
আর কিছু নেই, শুধুই কেঁচি।
দেখি না।
না, দেখানো যাবে না।
দেখাতে হবে।
বাধ্য হয়ে ম্যাজিশিয়ান হাত উপুড় করল। দেখা গেল হাতের তালুতে দড়ির একটা ছোট্ট টুকরা লুকানো। চারদিকে আনন্দের বান ডেকে গেল। ম্যাজিকের কৌশল ধরা পড়ে যাচ্ছে এই আনন্দ ম্যাজিকের আনন্দের চেয়েও বেশি।
জাহানারা বারবিকিউ তদারক করছেন। স্টেজ তৈরি হচ্ছে। বারবিকিউ-এর কয়লার আঁচ ঠিক আছে কি-না–— মাংস ঠিকমত ঝলসানো হচ্ছে কি-না। তিনি তাই দেখছেন। বার ঘণ্টা ধরে মাংস সিরকায় ড়ুবিয়ে রাখার কথা–তাঁর ধারণা, বাবুর্চি এই কাজটা করেনি। তিনি ভুরু কুঁচকে একটু পর পর আকাশের দিকে তাকাচ্ছেন। বৃষ্টি এখন বন্ধ হয়েছে, তবে আকাশে মেঘের যেমন আনাগোনা, আবারো শুরু হবে। চুলা নিয়ে হলঘরে চলে যেতে হবে। ঘরের ভেতর বারবাকিউ, এ রকম হ্যাস্যকর কথা কে কবে শুনেছে? গাড়ির হৰ্ণ শুনে তিনি বারান্দা থেকে গাড়ি-বারান্দায় নেমে এলেন। লীলাবতীর বন্ধুবান্ধব কে কে আসছে তিনি দেখে রাখতে চান। লীলাবতীর বন্ধুবান্ধবদের ধরণ পাল্টে যাচ্ছে। এইসব খেয়াল রাখা দরকার। অহংকারী, জেদী ও দুর্বিনীত মেয়েদের মা হওয়া
গাড়ি থেকে সাজ্জাদ নোমছে। সাজ্জাদের সঙ্গের ছেলেটিকে তিনি চেনেন না। অপরিচিত যে কোন মানুষ দেখলে জাহানারার ভুরু কুঁচকে যায়–এবার কুচকালে না। সাজ্জাজের কোন বন্ধু হবে। এ বাড়ির দরজা সাজ্জাদের জন্যে যেমন খোলা–সাজ্জাদের বন্ধুর জন্যেও খোলা।
সাজ্জাদ বলল, কেমন আছেন খালা?
জাহানারা আনন্দিত গলায় বললেন, তুই কেমন আছিস?
খুব ভাল আছি। আপনার কন্যার জন্মদিনে বন্ধু নিয়ে এসেছি–এর নাম আতাহার। বাংলাদেশের সবচে বড় কবি হবার মত প্রতিভা দিয়ে জন্মেছিল–প্রতিভা ঠিকমত কাজ করছে না বলে আজেবাজে জিনিশ লিখে বেড়াচ্ছে। আর আতাহার–এই অসম্ভব রূপবতী মহিলার নাম জাহানারা। আমার দূর সম্পর্কের খালা। তাঁর কন্যা বিখ্যাত নর্তকী লীলাবতী। মায়ের রূপ মেয়ে পুরোপুরি পায়নি, যা পেয়েছে তাও কম না।
জাহানারা বললেন, তুই তো কখনো এক সঙ্গে এতগুলি কথা বলিস না। আজ বললি কি করে?
সাজ্জাদ বলল, আজ গাঁজা খেয়ে এসেছি খালা।
গাঁজা খেয়ে এসেছিস মানে?
বিকট গন্ধ পাচ্ছেন না? এই গন্ধ বিখ্যাত গ্রাসের গন্ধ।
জাহানারার মনটা খারাপ হয়ে গেল। এমন চমৎকার একটা ছেলের এই অদ্ভুত স্বভাব কেন? জন্মদিনের উৎসবে সে গাঁজা খেয়ে আসবে কেন? আর যদি আসেই—বলার দরকার কি?
জাহানারা বললেন, জন্মদিনের খবর তোকে কে দিল?
লীলাবতী কাল রাত দুটার সময় টেলিফোন করে জানিয়েছে। সে না-কি রাজস্থানী নাচ নাচবে। রাজস্থানী নাচ আবার কি কে জানে? কথকফথতের নাম শুনেছি।
জাহানারার কাছে লীলাবতীর রাজস্থানী পোশাক পরে বসে থাকার কারণ স্পষ্ট হল। তবে মনে মনে এক ধরনের তীব্র আংশিকা বোধ করলনে। সাজ্জাদ চমৎকার ছেলে কিন্তু এই ছেলের কাছ থেকে দূরে থাকা সবচে মঙ্গল। এইসব ছেলেদের খুব কাছাকাছি যেতে নেই। এই তথ্য তিনি তার মেয়েকে দিতে চান। কিন্তু ভরসা পান না। সাজ্জাদের ব্যাপারে তার মেয়ের ভেতর এক ধরনের ঘোর কাজ করছে। এই ঘোর হঠাৎ করে কাটাতে গেলে সমস্যা হবে। বড় ধরনের সমস্যা হবে।
জাহানারা বললেন, ভেতরে চলে যাও। লীলাবতী বন্ধুদের সঙ্গে ম্যাজিক দেখছে।
ম্যাজিক হচ্ছে না-কি?
হুঁ।
ভালই হল, অনেকদিন ম্যাজিক দেখি না। খালা যাই তাহলে, ম্যাজিক দেখি গিয়ে।
তারা যখন ভেতরে ঢুকল তখন ম্যাজিকপর্ব শেষ হয়েছে। একটা মেয়ে মূকাভিনয় জাতীয় কিছু করছে। নিশ্চয়ই খুব মজাদার কিছু কারণ সবাই খুব হাসছে। সাজ্জাদকে ঘরে ঢুকতে দেখে লীলাবতী ছুটে এল। মূকাভিনয় থেমে গেল। ছেলেমেয়েরা হাসি হঠাৎ বন্ধ করে দেয়ায় সাজ্জাদের নিজেরই খারাপ লাগছে। একটু পরে ঘরে ঢুকলেই হত।
সাজ্জাদ বলল, তোমার জন্মদিনে এক বন্ধুকে নিয়ে এসেছি।
লীলাবতী আতাহারের দিকে না তাকিয়েই বলল, ভাল করেছেন। আমি ভেবেছিলাম। আপনি আসবেন না।
তুমি তো আসতে বললে?
আমি তো অনেকবারই আসতে বলি, আপনি আসেন না। তারপরে একবার আমি নিজেই গেলাম। আপনি ঘরে থেকেও বলে পাঠালেন, বাসায় নেই–পার্কে বেড়াতে গেছেন।
বুঝলে কি করে ঘরে ছিলাম?
দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম, সে বলল, ভাইয়া ঘরে। আমি আপনাদের বসার ঘরে গিয়ে বসলাম, কাজের মেয়ে কিছুক্ষণ পরে এসে বলল, আপনি পাকে বেড়াতে গেছেন।
সাজ্জাদ হেসে বলল, ঘরে বসে থেকেও অনেক সময় পাকে বেড়ানো যায়। আমার শরীরটা ঘরে ছিল–মন ছিল পার্কে। তুমি নিশ্চয়ই আমার শরীরের সঙ্গে দেখা করতে যাওনি। দেখা করতে গিয়েছিলে মনের সঙ্গে।
লীলাবতী তাকিয়ে আছে। আতাহার লক্ষ্য করছে মেয়েটির চোখে পানি জমতে শুরু করেছে। চোখ পানিতে ভরে উঠতে শুরু করছে। কি আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্য! সে অনেকবার ভেবেছে এই পৃথিবীর অপূর্ব কিছু দৃশ্যের সে একটা তালিকা করবে। যেমন–
১. গরমের দুপুরে মেঝেতে শুধুমাত্র একটা বালিশ পেতে তরুণী শুয়ে ঘুমুচ্ছে। তার মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। ফ্যানের হাওয়ায় মাথার কিছু চুল উড়ছে।
২. বাচ্চা একটা ছেলের হাত থেকে গ্যাস বেলুন ছুটে গেছে। বেলুনটা আকাশে উঠে যাচ্ছে। ছেলেটা হতভম্ব হয়ে বেলুনটার দিকে তাকিয়ে আছে। কান্ন। তার বুকের কাছে জমা হয়ে উঠেছে, এখনো গলার কাছে আসেনি।
৩. প্রেমিক-প্রেমিকা রিকশা করে যাচ্ছে। রিকশার হুড় খোলা। ছেলেটা ক্ৰমাগত বক বক করছে, হাত-পা নাড়ছে, মেয়েটা বসে আছে মাথা নিচু করে। তার ঠোঁটের কোণায় চাপা হাসি।
৪. বাচ্চা মেয়ে মায়ের হাইহিল। পরে হাঁটার চেষ্টা করছে। এঁকেবেঁকে যাচ্ছে।
৫. একটি তরুণীর চোখ ধীরে ধীরে পানিতে ভরে উঠছে। শেষ পর্যন্ত সে অবশ্যি কাঁদবে না। চোখের জল চোখেই শুকিয়ে ফেলবে।
৬. স্ত্রী রাতে স্বামীর জন্যে এক কাপ চা নিয়ে এসেছেন। স্বামী বিস্মিত হয়ে বললেন, চা চাইনি তো? তারপর–অতি আনন্দের সঙ্গে চায়ের কাপের জন্যে হাত বাড়ালেন।…
লীলাবতীর চোখের কোণে জমে ওঠা অশ্রু গাড়িয়ে পড়ল না। চোখেই মিশে গেল। সে আতাহারের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি বসে বসে অরুর পেন্টোমাইম দেখুন, আমি সাজ্জাদ ভাইয়ের সঙ্গে দুটা কথা বলে আসি। অসম্ভব জরুরী।
লীলাবতী সাজ্জাদকে তার নিজের ঘরে নিয়ে এসেছে। ঘরটা প্ৰকাণ্ড। এক কোণায় ছোট্ট খািট। জাহানারা তার ছোট্ট মেয়ের জন্যে অর্ডার দিয়ে ছোঢ় খাট বানিয়েছিলেন। সেই মেয়ে বড় হয়েছে। এই খাটে ঘুমুলে তার পা খানিকটা বের হয়ে থাকে। কিন্তু খাট লীলাবতী বদলাবে না, সে তার ছোট্ট খাটেই এখনো ঘুমায়। ঘরে পাশাপাশি দুটা সোফা। সাজ্জাদ সোফায় বসতে গেল। লীলাবতী বলল, আপনি খাটে বসুন। পা তুলে বসুন।
কেন?
কারণ আমি আপনাকে নাচ দেখাব। আপনি কখনো আমার নোচ দেখেননি। আজ দেখতে হবে। ঘরটা আমি নাচের জন্যে তৈরি করে রেখেছি।
ভাল কথা। তোমার এই ঘরে সিগারেট খাওয়া যায়?
যায়। তবে এখন খেতে পারবেন না। নাচ শেষ হোক, তারপর খাবেন। যতক্ষণ আমি নাচব, এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে।
এই রকম সব কঠিন শর্ত মেনে নাচ দেখাটার কি কোন প্রয়োজন আছে?
হ্যাঁ আছে। আমার অনেক দিনের শখ আপনাকে নাচ দেখাব। কাজেই আপনাকে দেখতে হবে। নাচটা আপনার জন্যে হয়ত জরুরী না, আমরা জন্যে জরুরী।
কেন?
আপনাকে আমি ঠিক বুঝতে পারব না কেন। নাচ হচ্ছে নিবেদন।
সেই নিবেদন তো শরীরের নিবেদন। শরীরের নিবেদন কি স্থূল নিবেদন না?
শরীরের নিবেদন কেন বলছেন? মনের নিবেদন বলতে অসুবিধা কি? মনটা চোখে দেখা যাচ্ছে না। শরীরের ছন্দে আমি প্রকাশ করছি আমার মন।
তাও তো তুমি ঠিকমত প্রকাশ করতে পারছি না। তোমার শরীর তুমি ঢেকে রেখেছ কাপড়ে। ছন্দ ধরার জন্যে তোমার শরীর দেখতে হবে না?
লীলাবতী হতভম্ব হয়ে বলল, আপনি কি বুঝতে পারছেন। আপনি খুব কুৎসিত কথে বলছেন?
কুৎসিত কথা বলছি?
হ্যাঁ।
তাহলে সম্ভবত গাঁজা খেয়ে আসার কারণে বলছি। তোমার এখনো আসার আগে গাঁজা খেয়েছি। যাই হোক, দেখি তোমার নাচ।
আপনাকে কিছু দেখতে হবে না। আপনি চলে যান।
চলে যাব?
অবশ্যই চলে যাবেন। আপনার বন্ধু থাকুক। আপনার জন্যে আপনার বন্ধুকে বাসা থেকে বের করে দেব তা ঠিক হবে না।
লীলাবতী কাঁদছে। সাজ্জাদ সিগারেট টানতে টানতে বের হয়ে এল।
আবার ঝেঁপে বৃষ্টি নেমেছে। জাহানারা বারবিকিউয়ার সরাতে ব্যস্ত। তিনি সাজ্জাদের চলে যাওয়া দেখলেন না।
আতাহার মুগ্ধ হয়ে পেন্টোমাইম দেখছে। অরু মেয়েটা মূকাভিনয় এত সুন্দর করে! আগে সবাই হাসছিল। এখন কেউ হাসছে না। অরু মেয়েটি মূকাভিনয়ের মাধ্যমে একটি দুঃখী মেয়ের জীবন-কাহিনী দেখাচ্ছে।