চতুর্দশ পরিচ্ছেদঃ তালিকোট যুদ্ধের সূচনা
খ্রীষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে দাক্ষিণাত্যে পাঁচটি স্বাধীন খণ্ডরাজ্য ছিল। এই পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে বিজয়নগর নামক সর্বপ্রধান রাজ্যটি হিন্দু রাজ্য এবং আহমদনগর, বিদর, বিজাপুর, গোলকুণ্ডা এই চারটি মুসলমান-রাজ্য ছিল। বিজয়নগরের হিন্দু রাজারা বরাবর মুসলমান-রাজ্য চতুষ্টয়ের সহিত মৈত্রী ও সৌহার্দ্য স্থাপন করিয়া দিন দিন প্রতিপত্তি ও সম্ভ্রম বৃদ্ধি করিতেছিলেন। বিজয়নগরের রাজারা সর্বদাই মুসলমানদিগের সন্মান ও সম্ভ্রম রক্ষা করিয়া চলিতেন। সুতরাং এই রাজ্যের হিন্দু-রাজত্ব লোপ করিয়াবার জন্য নিত্য-জয়শীল কোনও মুসলমান বীরপুরুষ কদাপি উদ্যোগী হন নাই। কিছুকাল পরে মুসলমান নরপাল চতুষ্টয়ের মধ্যে ভয়ানক গৃহ-বিবাদের সূচনা হইল। এই গৃহ-বিবাদের পরিণামে দাক্ষিণাত্যের সোলতানেরা পরস্পরের বল ক্ষয় করিয়া কথঞ্চিৎ দুর্বল হইয়া পড়িলেন। এই সময়ে বিজাপুরের সোলতানের সহিত বিজয়নগরের রামরায়ের সংঘর্ষ উপস্থিত হয়। এই সংঘর্ষ লোকক্ষয়কর যুদ্ধে পরিণত হয়। আহমদনগরের সোলতান রাম রায়ের পক্ষ অবলম্বন করতঃ বিজাপুরের দর্প চূর্ণ করিবার জন্য সসৈন্যে যুদ্ধক্ষেত্রে উপনীত হন। বিজয়নগর এবং আহমদনগরের সম্মিলিত বিপুল বাহিনীর বীর্য প্রতাপে বিজাপুরের সোলতান শোচনীয়রূপে পরাজিত হন। এই বিজয় লাভে এবং মুসলমান সোলতানগণের অনৈক্য দর্শনে রাম রায় নিতান্ত স্পর্ধিত, অহঙ্কৃত এবং মুসলমানের সর্বনাশ সাধনে বিশেষ উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন। দাক্ষিণাত্যে মুসলমান ও ইসলামের আধিপত্য এবং প্রভাব নাশ করিবার জন্য বিপুল সৈন্য গঠন করিতে থাকেন। ওলন্দাজ ও পর্তুগীজদিগের সাহায্যে একদল সুদক্ষ গোলন্দাজ সৈন্য গঠন করেন। গোপনে তোপ-কামান ও বন্দুক প্রচুর পরিণামে প্রস্তুত ও সংগ্রহ করিতে থাকেন। বিজয়নগরাধিপতি যে মুসলমান ধ্বংসের জন্য এরূপ দুরাকাঙ্খার বশীভূত হইবেন, দাক্ষিণাত্যে মুসলমান সোলতানেরা কদাপি তাহা স্বপ্নেও চিন্তা করেন নাই। তাঁহারা তখন ঘোরতার গৃহ-বিবাদে লিপ্ত। বিজয়নগরের বিপুল সংখ্যক হিন্দু অধিবাসী, মুসলমানের চিরনির্বাসন ও সবংশে ধ্বংস কল্পনা করিয়া আনন্দে উন্মত্তপ্রায় হইয়া উঠে। তাহাদের উন্মত্ততা পরিশেষে সংহারক মূর্তি পরিগ্রহ করিয়া বিজয়নগরের মুসলমান সংহারে প্রবৃত্ত হয়। বিজয়নগরে নানাদেশীয় কয়েক সহস্র মুসলমান ব্যবসায়-বাণিজ্য উপলক্ষে বাস করিতেন। একদা গভীর রাত্রিতে হিন্দুরা দল বাঁধিয়া তাহাদিগকে সংহার করিতে থাকে। মুসলমানেরা সর্বত্র উৎপীড়িত এবং কিয়দংশ নিহত হইয়া ক্রোধে প্রদীপ্ত অগ্নির ন্যায় জ্বলিয়া উঠে। সকলেই অস্ত্রশস্ত্র ধারণ করিয়া গাজীর বেশে সজ্জিত হন। মুসলমান রমণীরাও তরবারি হস্তে আত্মরক্ষায় প্রবৃত্ত হন। মুসলমানদিগের উদ্দীপ্ত তেজে হিন্দুরা ক্ষণকালের জন্য স্তম্ভিত হইয়া পড়ে। এই সময়ে দুর্গ হইতে দলে দলে সৈন্য আসিয়া মুসলমানদিগকে হত্যা করিতে আরম্ভ করে। সমস্ত নগরবাসী হিন্দু ও হিন্দুসৈন্যের দ্বারা ভীষণভাবে আক্রান্ত হইয়া মুষ্টিমেয় মুসলমান নরনারী সমূলে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। কতিপয় অনিন্দ্যসুন্দরী মুসলমান যুবতীকে বন্দী করিয়া কৃতঘ্ন রাম রায় তাহাদের সতীত্ব নাশে উদ্যত হন। যুবতীরা আত্মহত্যা করিয়া নরাধম পিশাচের হস্ত হইতে ধর্মরক্ষা করেন। অতঃপর মসজিদসমূহ চূর্ণ করিয়া তাহার স্তুপের উপর ত্রিশূল-অঙ্কিত পতাকা উড়াইয়া দিতেও কুণ্ঠিত হন না। এখানে বলা আবশ্যক যে, স্বীয় রাজধানীর মুসলমানদিগকে প্রথমেই আক্রমণ ও ধ্বংস করিবার বাসনা তাঁহার ছিল না। প্রথমতঃ সোলতানগণকে একে একে পরাস্ত করিয়া দাক্ষিণাত্যে হইতে ঐসলামিক শক্তি সম্পূর্ণ ধ্বংস করিতে ও পরে যাবতীয় মুসলমান হত্যা করাই তাঁহার অভীষ্ট ছিল। কিন্তু উন্মত্ত নাগরিক ও উচ্ছৃঙ্খল সৈন্যদিগের উদ্দাম উত্তেজনায় প্রথমতঃ তাঁহার রাজধানীই মুসলমান রক্তে রঞ্জিত হইল।
এই সংবাদ অত্যল্পকাল মধ্যেই মুসলমান রাজ্য চতুষ্টয়ে দাবানল শিখার ন্যায় প্রবেশ করিল। মুসলমান প্রথমে এই নিষ্ঠুর পৈশাচিত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বিশ্বাস করিতে পারিলেন না। পরে সত্যতা অবগত হইয়া বিস্মিত, স্তুম্ভিত ও শোকাকুল হইলেন। অবশেষে রুদ্র মন্ত্রে জেহাদের অগ্নি-সঞ্চারিণী বাণী ঘোষিত হইল। সোলতান চতুষ্টয় মুণ্ডর্ত মধ্যে গৃহ বিবাদ ভুলিয়া ইসলামের সন্মান ও আপনাদের মঙ্গলার্থে ভ্রাতৃভাবে একত্র সম্মিলিত হইয়া রাম রায়কে সমুচিত শিক্ষা প্রদান এবং বিজয়নগরে ইসলামের বিজয় পতাকা প্রোথিতকরণ মানসে পরস্পর পরস্পরের নিকট দূত প্রেরণ করিলেন। মোল্লা মৌলবিগণ সর্বত্র অগ্নিময়ী বক্তৃতায় প্রত্যেক সক্ষম ও সুস্থ মুসলমানকে তরবারি ধারণ করিবার জন্য উদ্ধুদ্ধ করিলেন। দাক্ষিণাত্যের সর্বত্রই মুসলমানদের মধ্যে জেহাদের ভীষণ আন্দোলন আরম্ভ হইল। রাম রায় তাহার পরিণাম ভাবিয়া কম্পিত হইলেও অনন্যগতি হইয়া রাজকোষ নিঃশেষিত করতঃ বিপুল সৈন্য সংগ্রহ করিতে লাগিলেন। দাক্ষিণাত্যবাসী মুসলমানগণ আর্যাবর্তবাসী বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয় স্বজনকে পত্রযোগে পবিত্র জেহাদের জন্য নিমন্ত্রণ করিলেন।
এই সময়ে বিজাপুরের শাহী দরবারের আলীম দাদ খাঁ নামক একজন আমীর বাস করিতেন। ইহার জন্মস্থান প্রাচীন নাসিরাবাদ* জেলার ইউসফশাহী পরগণার শেরমস্ত নামক পল্লীতে। ইহার পিতা একজন বিখ্যাত বীরপুরুষ ছিলেন। ঈসা খাঁর সহিত আলীম দাদ খাঁর বাল্যকাল হইতে বন্ধুতা ছিল। উভয়ে এই মাদ্রাসায় এক ওস্তাদের কাছে শিক্ষাপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন। যৌবনের প্রারম্ভে আলীম দাদ খাঁ বিজাপুরে গমন করেন এবং অল্পদিনের মধ্যেই প্রতিভা বলে রাজ-পরিষদের পদে সমারূঢ় হন। আলীম দাদ খাঁ স্বীয় বাল্যবন্ধু প্রবল প্রতাপশালী স্বাধীন ভূঁইয়াকুল-মণি ঈসা খাঁকে পরমানন্দে জেহাদে যোগদান করিবার জন্য নিন্মলিখিত পত্র প্রেরণ করিলেনঃ
প্রিয়তম সুহৃদ!
করুণাময় বিশ্বপাতা পরমেশ্বরের মহিমা নিত্য জয়যুক্ত হউক। তাঁহার অনন্ত মঙ্গলকর আর্শীবাদের পুণ্য-বারিতে আপনি অভিষিক্ত হউন। আপনার মনুষ্যত্ব এবং ইসলাম-অনুরাগ, বসন্তে কুসুম বিকাশের ন্যায় প্রস্ফুটিত হইয়া পৃথিবী আমোদিত করুক। আপনার বীর্য ও সাহস, বর্ষা-বারিপুষ্ট কলনাদিনী খরগামিনী তটিনীর প্রবাহের ন্যায় জীবনের কর্মক্ষেত্রে প্রবাহিত হউক।
হে বন্ধু! মানব-জীবন বিদ্যুদ্বৎ ক্ষণস্থায়ী হইলেও বিদ্যুৎ যেমন মুণ্ডর্তেই তাহার বিশ্বোজ্জ্বলকারিণী প্রতিভার তীব্র ছটায় জগৎকে উদ্ভাসিত ও চমকিত করিয়া থাকে, আপনিও তেমনি সর্বশক্তিমান আল্লাহতালা এবং তাঁহার প্রেরিত মহাপুরুষের আশীর্বাদে আপনার কর্মোজ্জ্বল জীবনের ধর্মপ্রভায় দিগন্ত আলোকিত করুক।
প্রাণধিক সখে!
বিজয়নগরের বিশ্বাসঘাতক পিশাচ প্রকৃতি পাষণ্ড রাজা রাম রায় এবং হিন্দুগণ, দাক্ষিণাত্য হইতে করুণাময় আল্লাহতালার আদিষ্ট ও অভিলষিত পরম পবিত্র ইসলাম ও মুসলমানকে নেস্তনাবুদ ও যে-বুনিয়াদ করিবার জন্য ভীষণ ও ঘৃণিত ষড়যন্ত্র করিয়াছে। ইতিমধ্যে বিজয়নগরের যাবতীয় মুসলমান নরনারী, বালকবৃদ্ধনির্বিশেষে পাষণ্ড ও ঈশ্বরদ্রোহী কাফেরদিগের হস্তে অতীব শোচনীয়ভাবে নিহত হইয়াছে। যাবতীয় মসজিদ চূর্ণীকৃত এবং অপবিত্র হইয়াছে। খ্রীষ্টানগণ জেরুজালেম অধিকার করিয়া মুসলমানদের প্রতি যেরূপ লোমহর্ষণশর ভীষণ জুলুম ও হত্যাকাণ্ডের অনুষ্ঠান করিয়াছিল, বিজয়নগরের মুসলমানের প্রতি সেইরূপ অত্যাচার হইয়াছে। কৃতঘ্ন রাম রায় ঐসলামিক সোলতানী শক্তি-তরু উৎপাটিত করিয়া ইসলাম ও মুসলমানকে নিরাশ্রম, বিপন্ন ও ধ্বংস করিবার মানসে, বিপুল সেনাবল সংগ্রহ করিতেছে। আমরাও সকলে এই পাষণ্ড কাফের এবং তাহার রাজ্য ও দর্প, ভগ্ন ও চূর্ণ করিবার জন্য বদ্ধ পরিকর হইয়াছি। সোলতান চতুষ্টয় সমস্ত মনোমালিন্য ভুলিয়া ইসলামের দুষমনকে দমন করিবার জন্য প্রস্তুত হইতেছেন। অনেক মুসলমান রমণী এবং শাহজাদী পর্যন্ত অস্ত্রধারণে বদ্ধপরিকর হইয়াছেন। যাবতীয় মুসলমানের হৃদয় রণোচ্ছ্বাসে পূর্ণিমার সমুদ্রের ন্যায় উদ্বেলিত হইয়া উঠিয়াছে। সমগ্র দাণিাত্যে জেহাদের চিত্তোন্মাদিনী গীতিতে প্রতিধ্বনিত হইতেছে। বর্ষাল প্রভাব হ্রাস হইবা মাত্রই আমরা যুদ্ধে অগ্রসর হইব। আশা করি, এই পবিত্র জেহাদ উলপ েআপনার বিজয়ী তরবারি কাফেরশোণিতাসিঞ্চনে দাণিাত্যের ভূমি উর্বরা ও ঔজ্জ্বল্য প্রদর্শনে আকাশমণ্ডলকে প্রভাসিত করিবে। আপনার বীরবাণ্ড বিজয়নগরের দুর্গ-শীর্ষে ইসলামের চন্দ্রকলা-শোভী বিজয়-কেতু উড্ডয়নে নিশ্চয়ই সাহায্য করিবে।
ইতি।
ভবদীয় প্রণয়াস্পদ সখা ও ভ্রাতা
অকিঞ্চন আলিম দাদ।
শেখ ইয়াকুব নামক একজন সৈনিক পুরুষ এই পত্র ও অন্যান্য কতিপয় মূল্যবান উপহারসহ দাক্ষিণাত্য হইতে খিজিরপুরে ঈসা খাঁ মসনদ-ই-আলীর নিকট প্রেরিত হইল।