রামায়ণ: সহজ পথরেখা
সব মহাকাব্যই কাব্য কিন্তু সব কাব্য মহাকাব্য নয়। মহাকাব্যের নিরিখ নানা সাহিত্যে নানা সংজ্ঞায় নিরূপিত হয়েছে। তবে, মোটের ওপর বিগত পাঁচ হাজার বছরের বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে দেখি মানুষ কতকগুলি কাব্যকে মহাকাব্য আখ্যা দিয়েছে, যদিও গুণগত মানে এগুলির মূল্য সমান নয়।
কাব্য সম্বন্ধে বরং একটা মোটামুটি ঐকমত্য আছে: যা মানুষকে চিন্তায় এবং/বা আবেগের ভূমিতে আন্দোলিত করে এবং জীবন সম্বন্ধে নতুন করে ভাবতে প্রণোদিত করে, তা-ই উচ্চস্তরের কাব্য। শুধুমাত্র বর্ণনা, বা যে-কোনও রস সৃষ্টি করে যা মানুষকে আপ্লুত করে তাকেও কাব্য আখ্যা দেওয়া হয়, কিন্তু মূল্যের পরিমাপে তার স্থান সাহিত্যে খুব উঁচুতে নয়। কাব্যের আঙ্গিক তার বহিরঙ্গ, যেমন ভাষা, অলঙ্কার, ছন্দ ইত্যাদি। সংস্কৃত সাহিত্য এ-বিষয়ে একটা সুস্থ দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছে, ছন্দোবদ্ধ সৃষ্টিমাত্রকেই কাব্য বলেনি। ধর্মসূত্র, পুরাণ, ছন্দশাস্ত্র, অলংকারগ্রন্থ, কোষগ্রন্থ, এমনকী কিছু কিছু বিজ্ঞানগ্রন্থও ছন্দে রচিত; কিন্তু সংস্কৃত আলংকারিকরা সেগুলিকে কখনওই কাব্য বলেনি। অপর পক্ষে গদ্যে রচিত কাদম্বরী বা হর্ষচরিত-কে কাব্য বলা হয়েছে। কাজেই সংস্কৃতে বিষয়বস্তু বা বহিরঙ্গ দিয়ে কাব্যত্ব বা গদ্যত্ব নির্ণীত হয়নি, ভাব ও রস দিয়েই তা হয়েছে। অবশ্য এ সত্ত্বেও বহু তথাকথিত কাব্য বেশ অপকৃষ্ট রচনা, কষ্ট-কল্পিত, কৃত্রিম, অলংকার-বহুল; চমক সৃষ্টি করাই তাদের উদ্দেশ্য। তবু আঙ্গিকের ঊর্ধ্বে নিরিখের স্থাপনা করা হয়েছিল— এটিও প্রণিধানযোগ্য।
তা হলে প্রশ্ন আসে, মহাকাব্য কীসে মহাকাব্য হয়? সে আলোচনার পূর্বে বলে নেওয়া উচিত, মহাকাব্য প্রধানত দু’ধরনের হয়: আদি মহাকাব্য ও পরবর্তী যুগের মহাকাব্য। বস্তুত এই পরবর্তী যুগের মহাকাব্যও দু’শ্রেণির: চরিত্রগত ভাবে মহাকাব্য ও সংজ্ঞানির্ভর মহাকাব্য। আদি মহাকাব্যের উদাহরণ গিলগামেশ, মহাভারত, রামায়ণ, ইলিয়াড, অডিসি এবং সম্ভবত ঈনীড। গৌণ বা পরবর্তী কালে মহাকাব্যে প্রথম শ্রেণিটিতে পড়ে অশ্বঘোষ ও কালিদাসের কাব্য, মিলটনের মহাকাব্যদ্বয়, দান্তের মহাকাব্যত্রয়ী, গ্যেটের মহাকাব্য, কালেহ্বলা, নীবেলুঙ্গেনলীড, এল সিড, ইত্যাদি। এর দ্বিতীয় বিভাগের অন্তর্গত হল দণ্ডী, ভারবি, মাঘ, শ্রীহর্ষের মহাকাব্য এবং ইয়োরোপে প্রাচীন মহাকাব্যের অনুসরণে কিছু রচনা। আদি মহাকাব্যের পরবর্তী মহাকাব্যগুলিতে ওই প্রাথমিক মহাকাব্যের প্রভাব চোখে পড়ে, যেন আদি মহাকাব্যকে আদর্শ ধরে আরও সংহত পরিপাট্যে এগুলি রচিত। প্রাথমিক মহাকাব্যগুলির রচয়িতা সম্বন্ধে আমরা তাঁদের নাম ছাড়া কিছুই জানি না। গিলগামেশ-এর ক্ষেত্রে তাও জানি না। ব্যাস, বাল্মীকি, হোমারের জীবন, কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে কোনও তথ্যসূত্র কোথাও নেই। নীবেলুঙ্গেনলীড, কালেহ্বলা বা এল সিড সম্বন্ধেও এ কথা খাটে, কিন্তু মিলটন, দান্তে, গ্যেটের জীবনী আমাদের পরিচিত, এঁরা অনেকটা পরের যুগের বলেই হয়তো এঁদের ইতিহাস কিছু জানা যায়। ভারবি, মাঘ সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না, তার কারণ অবশ্য ভারতবর্ষের সুবিদিত ইতিহাসবিমুখতা।
এই দ্বিতীয় শ্রেণির দুই বিভাগের মহাকাব্যেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু যেমন আছে, তেমনই আছে সচেতন ভাবে আঙ্গিক সৌষ্ঠব নির্মাণে কবিদের প্রয়াস, যা প্রথম পর্বের মহাকাব্যে নেই বললেই চলে। তা হলে কী আছে সেই আদি মহাকাব্যগুলিতে যা তাদের এমন অমরত্বে মণ্ডিত করেছে? গিলগামেশ সম্বন্ধে সংক্ষেপে বলা যায়, সেই যুগকে আমরা এত কম চিনি যে, আঙ্গিক উপজীব্যে মিলে যে সাহিত্য নির্মাণ, তার সামাজিক ও মননগত পটভূমিকাটি আমাদের কাছে অপরিচিত। কিন্তু বিষয়বস্তুর গাম্ভীর্য, গভীরতা, মানবিক আবেগ ও আবেদন এবং মৃত্যুকে পরাস্ত করে অমরত্ব লাভ করবার যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা এ মহাকাব্যে প্রতিফলিত হয়েছে তাতে বোঝা যায় কোন গুণে এ গ্রন্থ অমর।
কুষাণ সাম্রাজ্যের শেষ দিকে যে সব ছোট ছোট রাজ্যের উত্থান হচ্ছিল, গোষ্ঠী ও কৌম সংগঠন ভেঙে যে নতুন ‘কুল’ বা বৃহৎ যৌথ পরিবারের উদ্ভব হচ্ছিল এবং এ-দুটিকে অবলম্বন করে সমাজের যে সব সমস্যা দেখা দিচ্ছিল তা বহুলাংশে রামায়ণে প্রতিফলিত। সৌভ্রাত্র্য, দাম্পত্য, অপত্যসম্পর্ক, ক্ষত্রিয় বীরের কর্তব্য, শৌর্য, পিতৃসত্য রক্ষা, বন্ধুবাৎসল্য, বংশমর্যাদা রক্ষার জন্য প্রয়োজনে যুদ্ধ— এ সবই তখনকার রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে বাস্তব সমস্যা। রামায়ণে এগুলি গুরুত্ব পেয়েছে, বিশ্লেষিত হয়েছে। তা ছাড়া, ওই সমাজে বর্ণবিভাজন ক্রমেই কঠোর হয়ে উঠেছিল এবং নারী ও শূদ্রের অবনমন ঘটানোর জন্যে শাস্ত্র রচিত হচ্ছিল; সমাজপতি ও শাস্ত্রকাররা এর অনুকূলে ক্রমেই সক্রিয় হয়ে উঠছিলেন। তিন বর্ণের দাসত্ব শূদ্রের পক্ষে অবশ্য কর্তব্য বলে পরিগণিত হচ্ছিল এবং পাতিব্রাত্য ও শ্বশুরকুলের প্রতি আনুগত্য নারীর পক্ষে ক্রমেই অবশ্য-পালনীয় হয়ে উঠেছিল। সতীত্ব একটি অপরিহার্য গুণ বলে ধরা হত, ফলে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন সন্দেহেও স্ত্রীপরিত্যাগ হল স্বামীর কর্তব্য। মহাকাব্য তো এ সব নিয়েই গঠিত। এরই পরিসরের মধ্যে রাজ্যে নির্লোভ, পিতৃসত্য রক্ষায় অনমনীয় রাম, শুধুমাত্র স্বামীর প্রতি প্রেমে সীতার চোদ্দ বছরের বনবাসের দুঃসহ ক্লেশ সানন্দে স্বীকার করা, অচিরবিবাহিত লক্ষ্মণের জ্যেষ্ঠের জন্য অকুণ্ঠচিত্তে দীর্ঘ নির্বাসন মেনে নেওয়া, হনুমানের রামের প্রতি অবিচলিত আনুগত্য, জটায়ুর বন্ধুকৃত্য করার মধ্যে দিয়ে বিনা দ্বিধায় ধ্রুব মৃত্যু বরণ করা, সুগ্রীবের রামের প্রতি মিত্রতা এবং সে কারণে কষ্ট স্বীকার— এই সব এবং আরও বহুবিধ মানবিক মূল্যবোধের প্রতিফলন দেখি মহাকাব্যটিতে। তা ছাড়া নিসর্গবর্ণনা — বৃক্ষলতা, অরণ্য, পর্বত, নদী, সমুদ্র, উপত্যকা বর্ণনার সঙ্গেই পশু পাখির বর্ণনা, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, রাত্রি, প্রত্যূষ এ সবের যে সুন্দর বর্ণনা তার মধ্যে জীবনের সহজ আনন্দের স্পর্শ আছে। তেমনই মানুষের নানা অবস্থাবিপর্যয়ে যে চিত্তবৈকল্য বা স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ প্রকাশ পায় তারও সুন্দর বর্ণনা এ মহাকাব্য। এই সব উপাদানে সহজেই পাঠক অভিভূত হয়। রাষ্ট্রের সংকট তো বেশি মানুষকে সরাসরি স্পর্শ করে না, বরং তাকে পারিবারিক মূল্যবোধের সংঘাতের সম্মুখীন হতে হয় প্রতিনিয়তই। এই মূল্যবোধগুলি রামায়ণের নানা ঘটনাচক্রের মধ্যে দিয়ে উপস্থাপিত হয়েছে, কাজেই রামায়ণে সাধারণ মানুষ তার সমস্যার চিত্রণ ও সমাধান খুঁজে পেয়েছে; তাই রামায়ণকে ভারতীয় সমাজ সহজে গ্রহণ করেছে আপন স্বল্প পরিসর সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে চিত্তলোকের পথপ্রদর্শন হিসেবে। সেখানে মহাভারতের গতিপথ অনেক জটিল, গভীর তার অনুসন্ধান।