১৪. রাত্রে খেয়ে দেয়ে

রাত্রে খেয়ে দেয়ে অন্যদিনের মত শুয়ে পড়লাম। কিন্তু আমি জানি এই দিনটা অন্যদিনের মত না। মুক্তিবাহিনীরা আজ ক্যাম্পটা আক্রমণ করবে, চারিদিক থেকে তারা এখন এগিয়ে আসছে। অন্ধকার যখন গাঢ় হয়ে উঠবে, পৃথিবীর সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়বে তখন তাদের হাতের মেশিনগান গজে উঠবে। বুলেট ছুটবে গ্রেনেট ফাটবে মর্টার মেশিন গান মানুষের চিৎকার–

আমার নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে যায়, কিছুতেই আর ঘুমাতে পারি না। বিছানায় শুয়ে শুধু এপাশি-ওপাশ করতে থাকি।

ভেবেছিলাম। সারারাতই বুঝি জেগে কাটিয়ে দেব, কিন্তু একসময় চোখে ঘুম নেমে এল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমি যুদ্ধের স্বপ্ন দেখতে থাকি আর একটু পর পর চমকে ঘুম থেকে জেগে উঠতে থাকি। তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ে একটু পর আবার চমকে জেগে উঠি। একবার স্বপ্নে দেখলাম শফিক ভাই মেশিনগান দিয়ে গুলী করছেন আর কাদের তার মাঝে ছুটে যাচ্ছে। আমি বললাম কাদের যাস নে, কাদের মাথা ঘুরিয়ে বলল, কে? কে কথা বলে?

আমি বললাম আমি।

আমি কে?

আমি ইবু।

ইবু! তুই কোথায় ইবু?

এহ তো।

কাদের আমাকে দেখতে পায় না, এদিক সেদিক তাকিয়ে ডাকল, ইকুইবুইবু—

আর ঠিক তখন আমার ঘুম ভেঙে গেল আর আমি শুনলাম বিছানার কাছে জানালার নিচে দাঁড়িয়ে কে যেন নিচু গলায় ডাকছে, ইবু, এই ইবু।

আমি ভয় পাওয়া গলায় বললাম, কে?

আমি। রাশেদ।

রাশেদ! কি হয়েছে?

রাশেদ ফিসফিস করে বলল, বাইরে আসবি একটু? কথা আছে।

কোন শব্দ না করে দরজা খুলে বাইরে যাবার কোন উপায় নেই, আব্বা আম্মা কেউ একজন জেগে উঠবেন। জানালার শিক দুটিজোরে বাকা করে বের হয়ে যাওয়া যায়, আমি সেভাবে বের হয়ে নিচে নেমে এলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে রাশেদ?

একটা ঝামেলা হয়ে গেছে।

কি ঝামেলা?

শফিক ভাইয়ের সাথে আরেকজনের যাবার কথা ছিল।

কার?

আরেকজন মুক্তিযোদ্ধার। সে যেতে পারে নি।

কেন?

জানি না, কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে। মনে হয় রাস্তায় পাহারা খুব বেশি। তাই আমি ঠিক করেছিলাম। আমি যাব।

তুই? তুই? তুই গিয়ে কি করবি?

শফিক ভাইকে সাহায্য করব। সবসময় একজনকে গুলীর বেল্ট ধরতে হয় জানিস না? আমি জানতাম না, তাই চুপ করে রইলাম।

আমি রওনা দিয়েছিলাম। কিন্তু লাশকাটা ঘরের কাছে গিয়ে মনে হল ভিতরে কি যেন নাড়াচাড়া করছে।

শুনে আমার গায়ে কাটা দিয়ে উঠল। সত্যি?

ধুর সত্যি হবে কেমন করে। ভূত বলে কিছু নাই।

তাহলে? তবু ভয় করে। তুই যাবি আমার সাথে? আমি?

গভীর রাতে জানালা গলে বাসা থেকে বের হয়ে ভয়ংকর একটা যুদ্ধে গিয়ে জড়িয়ে পড়া বাচ্চা ছেলেদের কাজ নয়। অন্য কোন সময় হলে আমি কখনোই এটা করতাম না। কিন্তু এখন অন্য ব্যাপার। আমি বললাম, চল যাই।

রাশেদ খানিকক্ষণ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে ফেলল। আমি বললাম, হাসলি কেন?

আমি ভেবেছিলাম তুই রাজি হবি না, তখন আমাকেও যেতে হবে না! এখন আর কোন উপায় নাই, যেতেই হবে।

তুই-তুই— আসলে যেতে চাচ্ছিলি না?

যেতে চাই, আবার চাই না। ভয় করে। কিন্তু শফিক ভাইয়ের সাথে কারো থাকা দরকার। অপারেশান পুরোটা নির্ভর করছে শফিক ভাইয়ের উপর। শফিক ভাইয়ের যদি কিছু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে।

চলে তাহলে যাই।

চল।

গভীর রাতে অন্ধকারে নিজেদের আড়াল করে আমরা রওনা দিলাম। রাশেদ দাবী করে সে পিছন দিয়ে এবং নানারকম গলি দিয়ে নূর মুহম্মদের বেকারীতে পৌঁছে যাবে। অন্য কেউ হলে আমি কখনো তার কথা বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু রাশেদের কথা ভিন্ন। রাশেদ কখনোই বাজে কথা বলে না। আজগুবি এবং অবিশ্বাস্য কথা বলে কিন্তু বাজে কথা বলে না।

শফিক ভাই আমাদের দুজনকে দেখে খুব অবাক হলেন, চারিদিকে অন্ধকার তাই তার মুখটা দেখতে পেলাম না। কিন্তু কথা শুনে মনে হল শুধু অবাক হলেন না কেমন যেন একটু রেগে গেলেন। বললেন, তোমাদের কি মাথা খারাপ হয়েছে এখানে এসেছ? এটা কি বাচ্চাদের খেলা?

রাশেদ বলল, আপনি যদি না চান তাহলে এক্ষুনি চলে যাব। আমরা ভেবেছি একা আপনার অসুবিধা হবে।

তাই বলে তোমরা?

আমরা কি কিছু করতে পারি না? ম্যাপ তৈরি করে দিই নাই? গুলী এনে দিই নাই?

এখন যদি তোমাদের কিছু হয়?

আপনার যদি কিছু হয়?

আমি যুদ্ধ করতে এসেছি। —

আমি বললাম, আমরাও যুদ্ধ করতে এসেছি। এটা আপনার যেরকম দেশআমাদেরও সেরকম দেশ। বলতে দিয়ে আমার গলা কেঁপে গেল।

রাশেদ বলল, আপনি সত্যি সত্যি বলেন আমরা থাকলে আপনার কোন অসুবিধে হবে কি না, আমরা তাহলে এক্ষুনি চলে যাব। এক্ষুনি।

শফিক ভাই খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ঠিক আছে থাক। এদিকে আসি তোমাদের কয়টা জিনিস দেখিয়ে দিই। যদি আমার কিছু হয় তোমরা টুগারটা টেনে ধরে রাখবে যতক্ষণ গুলীর বেল্টাটা শেষ না হয়। তারপর এখন থেকে পালাবে। বুঝেছ?

বুঝেছি।

এখানে আসি, বেসিক কয়টা জিনিস শিখিয়ে দিই।

শফিক ভাই গভীর রাতে নূর মুহম্মদের বেকারীর ছাদে আমাদের লাইট মেশিনগান কেমন করে চালাতে হয় শিখিয়ে দিতে লাগলেন। সারাক্ষণ আমরা ফিসফিস করে নিচু গলায় কথা বলছি, কিন্তু তবু বুঝতে পারি। হঠাৎ করে শফিক ভাই আমাদের সাথে আর বাচ্চা ছেলেদের মত কথা বলছেন না। এমনভাবে আমাদের সাথে কথা বলছেন যেন আমরা তার সমান। যেন আমরাও বড় মানুষ।

সেই অন্ধকার রাতে আমি আর রাশেদ হঠাৎ করে বড় হয়ে গেলাম।

 

আমরা তিনজন চুপচাপ বসে আছি। একটু আগে আকাশে মেঘ ছিল। হঠাৎ করে মেঘ কেটে যাচ্ছে, এখানে সেখানে কয়েকটা তারা দেখা যাচ্ছে। আমরা চুপচাপ বসে আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে আছি। শফিক ভাই হঠাৎ বললেন, যখন গোলাগুলী শুরু হবে তখন তোমরা মাটিতে শুয়ে পড়বে।

ঠিক আছে।

মিলিটারী যখন বুঝতে পারবে আমি এখান থেকে কভার দিচ্ছি তখন এদিকে গুলী করবে। চেষ্টা করবে। আমাকে থামিয়ে দিতে। আমাদের অপারেশনটা শেষ করতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। বেশি সময় দেয়া যাবে না।

কি হবে বেশি সময় দিলে?

ভারি অস্ত্র বের করে আনবে। আর. আর. না হয় অন্য কিছু।

আর, আর, মানে কি?

রিকয়েলসেল রাইফেল। খুব শক্ত জিনিস। দালান কোঠা ট্যাঙ্ক পর্যন্ত ধ্বসিয়ে দেয়।

কতক্ষণ হবে যুদ্ধ?

বেশিক্ষণ না। খুব তাড়াতাড়ি অপারেশান শেষ করতে হবে। সেটাই ভরসা। অস্ত্রগারটা উড়িয়ে দিলেই কাজ কমপ্লিট।

তারপর কি হবে?

তখন আমরা সরে পড়ব। ওই পাশ থেকে আমাদের কভার দেবে।

শফিক ভাই খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বললেন, ভয় লাগছে তোমাদের?

হ্যাঁ। আমার একটু বমি বমি লাগছে।

শফিক ভাই নিচু স্বরে হেসে বললেন, রাত জেগে অভ্যাস নেই তো তাই বমি বমি লাগছে। আর ভয় লাগলে ঘাবড়ে যেও না। এটা ভয়েরই ব্যাপার। ভয় লাগটো স্বাভাবিক। শুধু চেষ্টা করবে। মাথাটা ঠাণ্ডা রাখতে। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।

আমরা চুপ করে রইলাম। শফিক ভাই বললেন, আমি খালি ভাবছি। যখন

তোমাদের আম্মা আব্বা খবর পাবেন তোমরা এখানে তখন তাদের কি অবস্থা হবে?

আমি দুর্বলভাবে বললাম, কি আবার হবে!

আমরা আবার চুপ করে বসে থাকি। সামনে মিলিটারী ক্যাম্পে কোন শব্দ নেই। মনে হয় সবাই ঘুমাচ্ছে, জানেও না একটু পরে তাদের উপর কি বিপদ নেমে আসবে। কি ভয়ানক একটা যুদ্ধ হবে!

আমি ফিসফিস করে বললাম, শফিক ভাই—

কি হল?

আপনার কি ভয় লাগছে?

শফিক ভাই নিচু স্বরে হেসে বললেন, হ্যাঁ ইবু লাগছে। যেখানে ভয় পাওয়ার কথা সেখানে সবাই ভয় পায়। শুধু যারা ক্ষ্যাপা তারা কখনো ভয় পায় না। ভয় পেতে কোন দোষ নেই। কিন্তু ভয় পেয়েও মাথা ঠাণ্ড রেখে কাজ করে যেতে হবে। সেটাই হচ্ছে যাকে বলে বীরত্ব। দেখবে যখন যুদ্ধ শুরু হবে হঠাৎ করে ভয়ের কথা মনে থাকবে না। তখন শুধু কাজ করে যাওয়া। গুলী করে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কভার দেওয়া—

ঠিক এই সময় রাতের অন্ধকার আর নৈঃশব্দকে চৌচির করে খুব কাছে থেকে ট্যাট ট্যাট করে মেশিন গানের গুলীর শব্দ হল। আমি আর রাশেদ ভয় পেয়ে মাথা নিচু করে শুয়ে পড়লাম, শফিক ভাই একটুও নড়লেন না। আস্তে আস্তে বললেন, জামাল। এইটা জামাল।

আবার গুলীর শব্দ হল, প্রথমে ছাড়া ছাড়া তারপর একটানা। বড় বড় কয়টা বিস্ফোরণ হল, শফিক ভাই মাথা বের করে তাকিয়ে থেকে আবার বললেন, ভালই তো ছুঁড়েছে গ্রেনেডটা। এটা রফিক ছাড়া কেউ না। ক্রিকেট খেলার বল করে করে হাতের মাসল কি শক্ত করেছে দেখেছ? এত জোরে জুড়ে যে দেখলে অবাক হয়ে যাবে।

ক্যাম্পের মাঝে হৈ-চৈ শুরু হয়েছে, চিৎকার করে কথা বলছে। লোকজন ছুটাছুটি করছে। আমি বললাম, শফিক ভাই, গুলী করেন। গুলী করেন। —

যত দেরি করে করা যায়। পজিশানটা জানিতে দিতে চাই না। ছাদে বাংকার ওঠার চেষ্টা করলে করব।

বাংকারে কেউ নাই তো?

না। তোমাদের কথা ঠিক।

আমি আর রাশেদ মাথা নিচু করে শুয়ে রইলাম।

রাশেদ সাহস করে একবার মাথা উঁচু করে দেখে আবার মাথা নিচু করে ফেলল।

প্রচণ্ড গুলীর শব্দে কানে তালা লেগে গেল। তার মাঝে আমি মানুষের গলার শব্দ পেলাম, মনে হল কে যেন চিৎকার করে বলল, জয় বাংলা! ইশ, কতদিন পর স্বাধীন বাংলার এই শ্লোগানটা শুনলাম। এত গোলাগুলী হৈ-চৈ তার মাঝেও আমি আমার হৃদপিণ্ডের শব্দ শুনতে পাই, ঢাকের মত শব্দ করছে। মাটিতে মাথা লাগিয়ে আমি মনে মনে বললাম, হেই খোদা, তুমি আমাদের সবাইকে বাঁচিয়ে রাখ। সবাইকে বাঁচিয়ে রাখ বাঁচিয়ে রাখ…

শফিক ভাই বললেন, এক শালা বাংকারে ওঠার চেষ্টা করছে। দেই একটা এখন, দেই–

কানের কাছ থেকে হঠাৎ করে তার মেশিন গান গজে উঠল।

রাশেদ মাথা উঁচু করে বলল, মরেছে? মরেছে?

জানি না। গড়িয়ে পড়ে গেল। কভার নেয়ার জন্যে না গুলী খেয়ে বোঝা গেল না। তোমরা উঠবে না, খবরদার, এখন আমাদের গুলী করবে।

শফিক ভাইয়ের কথা শেষ হবার আগেই আমাদের মাথার উপর দিয়ে শীষ দেয়ার মত শব্দ করে কি জানি ছুটে গেল আর প্রায় সাথে সাথেই গুলীর শব্দ শোনা গেল। নিশ্চয়ই আমাদের গুলী করছে। বুলেট শব্দ থেকে আগে যায়। তাই শব্দটা শোনা যায় পরে। আমি মাটিতে মাথা লাগিয়ে শুয়ে থেকে বললাম, হে খোদা, হে পরম করুণাময় তুমি আমাদের যুদ্ধে জয়ী করে দাও। যুদ্ধে জয়ী করে দাও।

শফিক ভাই ছাড়াছাড়া ভাবে গুলী করতে লাগলেন। ফাঁকা কস্তুজের খুলি ছিটকে ছিটকে বের হতে লাগল, বারুদের গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে এল। তার মাঝে আমি আর রাশেদ ঘাপটি মেরে পড়ে থাকি। রাশেদ চিৎকার করে বলল, কি অবস্থা শফিক ভাই?

ভাল। খুব ভাল। শুয়ে থাক, উঠবে না।

আমরা শুয়ে থেকে এক ভয়ংকর যুদ্ধের সাক্ষী হয়ে রইলাম। যুদ্ধ। যার অর্থ একজন মানুষের অন্য একজন মানুষকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা। ঠাণ্ডামাথায় চিন্তা ভাবনা করে। যেই যুদ্ধ আমাদের করার কথা ছিল না। সেই যুদ্ধে একদিকে পাকিস্তান মিলিটারী। যারা সারা জীবন শুধু এটাই শিখছে কিভাবে মানুষ মারতে হয়। অন্য দিকে শফিক ভাইয়ের মত ছেলেরা যাদের যুদ্ধ করার কথা না এখন স্কুল কলেজে পড়াশোনা করার কথা।

আমাদের মাথার উপর দিয়ে শীষ দেয়ার মত শব্দ করে বুলেট উড়ে যাচ্ছে, দেয়ালে গুলী লেগে কখনো আমাদের উপর চুন ব্যালি খসে পড়ছে, আশে-পাশে চারিদিকে জিনিসপত্র ভেঙে পড়ছে। আমরা তার মাঝে মাথা নিচু করে শুয়ে থেকে বলি, হে খোদা পরম করুণাময়।

ঠিক এরকম সময় শফিক ভাই গুলী খেলেন। আমরা বুঝতে পারিনি, হঠাৎ দেখলাম শফিক ভাই যন্ত্রণার মত একটা শব্দ কেমন যেন গড়িয়ে পিছন দিকে পড়ে গেলেন। আমি ভয় পাওয়া গলায় ডাকলাম, শফিক ভাই, শফিক ভাই।

শফিক ভাই কোন কথা বললেন না।

রাশেদ গড়িয়ে গড়িয়ে শফিক ভাইয়ের কাছে যেতে থাকে। আমিও পিছু পিছু গেলাম। কাছে গিয়ে ডাকলাম, শফিক ভাই—

শফিক ভাই যন্ত্রণার মত শব্দ করে হপাতে হাঁপাতে বললেন, যাও কাভার দাও।

কাভার?

হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি।

আমরা বুঝতে পারলাম শফিক ভাই আমাদের গুলী করতে বলছেন। আমি বললাম, কিন্তু আপনি –

তাড়াতাড়ি।

আমি আর রাশেদ গুড়ি মেরে এস.এম.জি.টার দিকে এগিয়ে যাই। সেটাকে শক্ত করে চেপে রেখে ট্রিগার টেনে ধরলাম, সাথে সাথে ভয়ংকর ককশ শব্দ করে পুরো এস.এম.জি.টা জীবন্ত কোন প্রাণীর মত ঝাকুনি দিয়ে কেঁপে কেঁপে উঠল। ভিতর থেকে গুলী বের হয়ে এল আগুনের হালকার মত।

আরেকটু নিচে, ডান দিকে। শফিক ভাইয়ের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, সিঁড়ির দিকে এইম কর।

আমরা সিঁড়ির দিকে নিশানা করে আবার ট্রিগার টেনে ধরলাম। সাথে সাথে ভয়ংকর শব্দ করে আবার গুলী বের হতে থাকে, থারথার করে কাঁপতে থাকে মেশিন গান। সিঁড়ি বেয়ে একজন উপরে ওঠার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ সে লাফিয়ে সরে গেল।

থাম। এখন থাম।

আমরা থামলাম।

শফিক ভাই আবার একটা কাতর শব্দ করে বললেন, আবার। এখন আবার শুরু কর।

আমি আবার ট্রিগার টেনে ধরলাম। ভয়ংকর শব্দ করে আবার মেশিন গানটা থর থর করে কাঁপতে থাকে। গুলীর বৃষ্টি হতে থাকে তার ভেতর থেকে। প্রচণ্ড দম বন্ধ করা আতংকটা আর নেই। শুধু আতংক নয় দুঃখ কষ্ট ব্যথা কোন কিছু নেই। মাথার মাঝে কেমন জানি ভোতা একটা ভাব। যেন কিছু হলেই আর কিছু আসে যায় না। যেন এর কোন শুরু ছিল না যেন এর কোন শেষ নেই। যেন এখানে এইভাবে ট্রিগরি টেনে ধরে রাখাটাই হচ্ছে আমাদের জীবন। এর বাইরে কিছু ছিল না। কিছু থাকবে না।

থাম। এখন থাম।

আমরা থামলাম। আর ঠিক তখন প্রচণ্ড বিস্ফোরণে চারিদিক আলো হয়ে গেল। আমরা গরম বাতাসের একটা ঝাপটা অনুভব করলাম। মনে হল পুরো বিশ্ব ব্ৰহ্মাণ্ড বুঝি ফেটে চোঁচির হয়ে গেল। একটা বিস্ফোরণ শেষ হতেই আরেকটা, তারপর আরেকটা, তারপর আরেকটা।

শফিক ভাই ক্লান্ত স্বরে বললেন, জব ওয়েলডান।

আপনার কি হয়েছে?

গুলী লেগেছে।

কোথায়?

পায়ে। এস.এম.জি.-তে লেগে ছিটকে এসেছে। ব্রিডিং হচ্ছে। হাড় ভেঙেছে কি না। বুঝতে পারছি না।

শফিক ভাই যন্ত্ৰণার মত শব্দ করে পাটা নড়ানোর চেষ্টা করলেন। পারলেন না। ওঠার চেষ্টা করে ধ্রুপ করে পড়ে গেলেন। কাতর শব্দ করে পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে পায়ের উপর শক্ত করে বাধলেন। তারপর দেয়ালে হেলান দিয়ে ক্লান্ত স্বরে বললেন, কি একটা ঝামেলা!

শফিক ভাই বাইরে তাকালেন। এখনো ছাড়াছাড়া ভাবে বিস্ফোরণ হচ্ছে। চারদিকে আগুন লেগে গেছে, তার মাঝে মানুষজন ছুটাছুটি করছে। চারদিকে চিৎকার হৈ-চৈ। শফিক বাইরে তাকিয়ে থাকতে হঠাৎ কি যেন দেখে চমকে উঠলেন। আমাদের দিকে ঘুরে বললেন, তোমরা যাও। এক্ষুনি যাও।

যাব?

হ্যাঁ, এক্ষুনি। তাড়াতাড়ি যাও।

কিন্তু আপনি।

শফিক ভাই ক্ষিপ্ত স্বরে বললেন, আমার কথা তোমাদের ভাবতে হবে না। তোমরা যাও এক্ষুনি। মিলিটারী আসছে পালাও —

কিন্তু আপনাকে ছেড়ে —

শফিক ভাই বললেন, আমার দায়িত্ব আমি নেব। তোমরা যাও এই মুহূর্তে। রাইট নাও!

কিন্তু –

শফিক ভাই এবারে চিৎকার করে বললেন, তোমরা যাও। দিস ইজ এন অর্ডার।

আমরা উঠে দাঁড়ালাম। কিছু আর ভাবতে পারছি না। কেমন একটা ঘোরের মাঝে বের হয়ে এলাম। চারিদিকে আগুন জ্বলছে। আগুনের শিখায় সবকিছু কেমন যেন অবাস্তব মনে হচ্ছে। মানুষজন চিৎকার করে ছুটাছুটি করছে। একজন মানুষ তার বাচ্চাকে বুকে চেপে ছুটে যাচ্ছে, পিছনে পিছনে তার স্ত্রী! কি ভয়ংকর আতংক তার মুখে।

হঠাৎ আমরা থমকে দাঁড়ালাম। মিলিটারীর একটা দল ছুটে আসছে, সাথে কিছু রাজাকার। আমাদের পাশ কাটিয়ে ছুটে গেল সবগুলি। ওরা নূর মুহম্মদের বেকারীর দিকে ছুটে যাচ্ছে। কিছু একটা কি টের পেয়েছে ওরা?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *