রাত ন টা।
রহমান সাহেব খেতে এসে দেখেন শারমিন দোতলা থেকে নিচে নামে নি। জমিলার মা বলল, আফা ভাত খাইবেন না।
কেন?
কিছুকন নাই? শরীর খারাপ মনে হয়।
রহমান সাহেব বিস্মিত হলেন। শরীর ভালো থাকুক না-থাকুক, খাবার সময় শারমিন উপস্থিত থাকে। কিছুদিন থেকে তিনি তার ব্যতিক্রম লক্ষ করছেন। রহমান সাহেব নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করলেন। রাতের খাবার সময়টা তিনি বেশ আনন্দে কাটান। ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে হালকা আলাপ করেন শারমিনের সঙ্গে। অফিসের ব্যাপার নিয়েও কথাবার্তা হয়। আজ তিনি একটি জরুরি ব্যাপার নিয়ে শারমিনের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন।
নাই।ক্ষ্যংছড়িতে তিনি একটা রাবার চাষের পরিকল্পনা নিতে চাচ্ছেন। এই বিষয়ে মতামত জানা।
রহমান সাহেব খাওয়া শেষ করে শারমিনের দরজায় টোকা দিলেন।
মা জেগে আছ?
আছি।
শরীর খারাপ নাকি?
হ্যাঁ।
জ্বর?
জবাব না দিয়ে শারমিন দরজা খুলল। রহমান সাহেব চমকে উঠলেন। ফ্যাকাসে মুখ শারমিনের। চোখ লাল হয়ে আছে। মনে হচ্ছে এইমাত্র কেঁদে উঠেছে।
এস আমার ঘরে। গল্প করি।
শারমিন চাদর গায়ে দিয়ে নিঃশব্দে বের হয়ে এল। রহমান সাহেবের মনে হল, মেয়েটি খুব একলা হয়ে পড়েছে। নিঃসঙ্গতার চেয়ে বড়ো কষ্ট তো আর কিছু নেই। এই কষ্টটার ধরন তাঁর মতো আর কেউ জানে না। তারা দু জন নিঃশব্দে রহমান সাহেবের প্রকাণ্ড শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকল।
খাটে পা তুলে আরাম করে বস তো মা।
সঙ্গে তোমার ঝগড়া-টগড়া হয়েছে নাকি?
না, ঝগড়া হবে কেন?
ফিরে যাবার সময় এয়ারপোর্টে তাকে খুব গম্ভীর দেখলাম।
পারিবারিক ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। অনেক রকম ঝামেলা যাচ্ছে ওনাদের। তাঁর মারও অসুখ ছিল।
তুমি কি তাঁকে দেখতে গিয়েছিলে?
ঢাকায় নেই তো উনি। জামালপুরে তাঁর মেয়ের কাছে থাকেন।
রহমান সাহেব সিগারেট ধরালেন। সিগারেট প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। কিছুদিন হল আবার শুরু করেছেন। তাঁর মনে হচ্ছিল, শারমিন সিগারেটের
প্রসঙ্গে কিছু বলবে। কিন্তু সে কিছুই বলল না।
সাব্বির তোমাকে চিঠিপত্র লিখেছে তো?
হ্যাঁ।
জবাব দাও তো তুমি?
হ্যাঁ, দিই। দেবনা কেন?
আমি আজ তার একটা লম্বা চিঠি পেয়েছি। সে দেশে চলে আসছে। এপ্রিলের মাঝামাঝি এসে পড়বে। তোমাকেও নিশ্চয়ই লিখেছে?
হ্যাঁ।
আমি ঠিক করেছি। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তোমাদের বিয়ের ব্যাপারটা চুকিয়ে ফেলব। কী বল তুমি?
শারমিন কিছু বলল না। রহমান সাহেব বললেন, খুব জমকাল একটা উৎসব করতে চাই। তোমার মার শখ ছিল জমকাল উৎসবের।
শারমিন এমনভাবে তাকাচ্ছে, যেন সে কিছু শুনছেন। অন্য কিছু ভাবছে। রহমান সাহেবের মন খারাপ হয়ে গেল। তিনি আশা করেছিলেন বেশ অনেকক্ষণ গল্প গুজব করবেন। মেয়েটি ক্রমেই কি দূরে সরে যাচ্ছে? বিয়ের পর নিশ্চয়ই আরো দূরে যাবে।
শারমিন মৃদুস্বরে বলল, বাবা, তুমি তোমার কোনো কারখানায় একটি চাকরির ব্যবস্থা করতে পারবো?
রহমান সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কার চাকরি?
আমাদের সঙ্গে পড়ত একটা ছেলে। অনেক দিন ধরে চাকরির চেষ্টা করছে। পাশ করবার পর প্রায় দু বছর হয়ে গেল।
রহমান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, যে ছেলে দু বছর চেষ্টা করেও কিছু করতে পারছে না, সে মোটামুটিভাবে এক জন অপদার্থ।
অপদাৰ্থ হবে কেন? দেশের অবস্থা খারাপ।
খারাপ ঠিকই, কিন্তু বুদ্ধিমান ছেলেরা এই খারাপ অবস্থার মধ্যেও গুছিয়ে নিতে পারে।
শারমিন কিছু বলল না। রহমান সাহেব বললেন, ছেলেটিকে পাঠিয়ে দিও আমার কাছে, আমি দেখব। ও কি প্রায়ই আসে নাকি এখানে?
না, প্রায়ই আসবে কেন?
ঠিকানা জান?
না, জানি না।
বলেই শারমিন চমকে উঠল। এই মিথ্যাটা সে কেন বললঃ কোনো দরকার ছিল না তো!
ঠিকানা না জানলে খবর দেবে কি করে?
শারমিন লজ্জিত মুখে বলল, আমি ঠিকানা জানি। রহমান সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
বাবা, আমার মাথা ধরেছে, ঘুমুতে যাই।
শারমিন উঠে দাঁড়াল। তার সত্যি সত্যি মাথা ধরেছে। জ্বর আসছে বোধহয়। রহমান সাহেব বললেন, একটু বস। আদাচা করে দিক, মাথা ব্যথা কমবে। তিনি নিজেই চায়ের কথা বলবার জন্যে উঠে গেলেন। এবং তখনই জানতে পারলেন, আজ বিকেলে মাটি মারা গেছে। খবরটি দিতে গিয়ে জয়নালের মুখের ভাব এ-রকম হল, যেন সে নিজেই মার্টিকে মেরেছে।
আমাকে খবরটা তখন দাও নি কেন?
আপা নিষেধ করেছিলেন। বলেছিলেন ভাত খাওয়ার পরে দিতে।
রহমান সাহেব মার্টিকে দেখতে গেলেন। ঠাণ্ডা মেঝেতে মাটি এলিয়ে পড়ে আছে। তার গায়ে মোটা একটা কম্বল।
মারা গেল কীভাবে?
জানি না। খাওন দিতে গিয়া দেখি এই অবস্থা।
জ্বি-না।
কিছুই বলে নি?
বলেছেন সকাল হইলে মাটি দিতে। বরই গাছের নিচে।
মাটির গায়ে কম্বল দিয়ে রেখেছে কেন?
আমি দেই নাই, আফা দিছেন।
চা— পৰ্ব্ব সমাধা হল নিঃশব্দে। মাটি প্রসঙ্গে কোনো কথাই হল না। শারমিন বলল, বাবা, আমি যাই?
যাও মা, ঘুমাও। আর শোন, ঐ ছেলেটিকে বলবে আমার সঙ্গে দেখা করতে।
দরকার নেই।
দরকার থাকবে না কেন?
যারটা সে-ই করুক। আমার এত মাথাব্যাথা নেই।
এসব কি শারমিনের রাগের কথা? কেন সে রাগ করছে? কার উপর রাগ করছে? শারমিন নিজেই তা বুঝতে পারছে না। সে কি অতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে? সব মেয়েই কি এ-রকম বদলে যায়, না এটা শুধু তার বেলায় হচ্ছে। জানার কোনো উপায় নেই, কাকে সে জিজ্ঞেস করবে?
শারমিনের কোনো বন্ধুবান্ধব নেই। আত্মীয়স্বজন যারা ঢাকায় আছেন, তাদের সঙ্গেও কোনো রকম যোগাযোগ নেই। কেউ কেউ ঈদের দিনে বেড়াতে আসেন। গেটের ভেতর ঢোকার পর থেকেই তাঁরা অস্বস্তি বোধ করতে থাকেন। সেই অস্বস্তি বাড়ি থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত কমে না। এদের অনেককেই শারমিন চেনে না। রহমান সাহেব চেনেন, কিন্তু তিনি বিন্দুমাত্র উচ্ছ্বাস দেখান না। মেয়েকেও কারো বাসায় বেড়াতে যাবার জন্যে বলেন না। যে-কোনো কারণেই হোক, মেয়েকে দূরে সরিয়ে রাখতে চান। তবু মাঝে মাঝে নিতান্ত অপরিচিত এক জন কেউ আসে। অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে কথাবার্তা বলে-যেন দীর্ঘদিনের চেনা। এদের কথার ধরন থেকেই বোঝা যায়-সাহায্যপ্রার্থী।
এক বার দুপুরবেলায় ঘোমটা-পরা এক জন মহিলা এলেন। সঙ্গে চারটা আনারস, দু বোতল আচার। শারমিনকে জড়িয়ে ধরে খানিকক্ষণ কাঁদলেন, আহ গো মা, কত দিন পরে দেখলাম। গায়ের রঙটা একটু ময়লা হয়ে গেছে, আগে সোনার পুতলার মত ছিল। আমাকে চিনছ তুমি?
না।
আমি আটপাড়ার। তোমার আরার মামাতো বোন।
সেই মহিলা খুব আগ্রহ নিয়ে সমস্ত বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখলেন, এবং ঘন ঘন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন। এবং এক সময় জানা গেল। তিনি এসেছেন ছ হাজার টাকার জন্যে। মেয়ের বিয়ে আটকে গেছে। জামাই একটা সাইকেল এবং একটা টু-ব্যাণ্ড রেডিও চায়। বিয়ের কথাবার্তা সব পাকা। এখন এই অল্প কিছু টাকার জন্যে বিয়ে আটকে আছে। শারমিন লজ্জিত স্বরে বলল, আমার কাছে তো এত টাকা থাকে না। আপনি অপেক্ষা করুন, বাবা আসুক। তিনি বিকেলে আসেন।
তোমার কাছে কত টাকা আছে?
আমার কাছে খুব অল্পই আছে, এতে আপনার কাজ হবে না। আপনি বিশ্রাম করুন, বাবা চলে আসবেন।
ভদ্রমহিলা অপেক্ষা করতে লাগলেন। শারমিন সাধ্যমত তাঁর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে চেষ্টা করল। ভালো ব্যবহারের চেষ্টা করাও মুশকিল। তারা দু জন দুই জগতের মানুষ। এই দু জগতের ভেতরে কানো বন্ধন নেই। অল্প সময়ের মধ্যেই শারমিন বিরক্ত হয়ে পড়ল। ভদ্রমহিলা একটির পর একটি আব্দার করেই যাচ্ছেন, ও মা, তোমার তো বাক্সভর্তি শাড়ি। দুই-একটা আমাকে দিও গো মা। পুরানা চাদর আছে? খুব শীত পড়ে আটপাড়ায়। না গেলে বুঝবা না।
সন্ধ্যাবেলা রহমান সাহেব এলেন। টাকার কথা শুনে বললেন, তোমাকে তো মেয়ে বিয়ের জন্যে তিন মাস আগেই চার হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে, বঙ্কর সাহেব এসে নিয়ে গেছেন।
সেই বিয়াটা হয় নাই ভাইজান।
আকদ হওয়া বিয়ে ভেঙে গেছে! বকর সাহেব তো বললেন, আকন্দ হয়ে গেছে। রোসমত আটকে আছে। তিন হাজার টাকা চেয়েছিলেন। আমি দিয়েছিলাম চার হাজার টাকা।
ভদ্রমহিলা কাঁদতে শুরু করলেন। বিশ্ৰী অবস্থা! শারমিন সরে গেল সামনে থেকে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে শুনল বাবা বলছেন, আমার সঙ্গে চাল চালিতে যাবে না। তোমাদের চাল বোঝার ক্ষমতা আমার আছে।
সময় কাটানোই হয়েছে শারমিনের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা। সময় পাহাড়ের মতো বুকের উপর চেপে বসে থাকে। বই পড়া, গান শোনা, এর কোনোটাই এখন আর ভালো লাগে না। ছবি আকা শেখার কথা এক বার মনে হয়েছিল। রং-তুলি কিনে কয়েক দিন খুব রঙ মাখামাখি করা হল, তাও মনে ধরল না। প্রতিটি কাজ এত বিরক্তিকর।
কোনো কোনো দিন একা একা ঘুরতে ইচ্ছা করে। উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে খারাপ লাগে না। সব দিন তো আর তা করা যায় না। পুরানো বান্ধবীদের কারোর ঠিকানা নেই, নয়তো তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেত। অদিতির ঠিকানা ছিল। তাকে পরপর দুটি চিঠি দিয়েছে, জবাব পাওয়া যায় নি। হয়তো এই ঠিকানায় সে এখন থাকে না কিংবা থাকলেও তার জবাব দেবার ইচ্ছা নেই। শারমিন বন্ধুর জন্যে অতীতে কখনো হাত বাড়ায় নি, তার মূল্য দিতে হচ্ছে এখন। হাত বাড়িয়ে কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।
শারমিন জেগে উঠল খুব ভোরে। চোখ বন্ধ করে মনে মনে ভাবতে চেষ্টা করল। আজকের দিনটি কেমন করে কাটান যায়। ইউনিভাসিটিতে গেলে কেমন হয়? পরিচিত কাউকে কি পাওয়া যাবে ইউনিভার্সিটিতে? সম্ভাবনা খুব কম। এই পরিকল্পনাটা বাদ দিতে হল। রফিকদের বাসায় গিয়ে হঠাৎ উপস্থিত হলে কেমন হয়? শাহানা মেয়েটিকে ঐ দিন চমৎকার লেগেছিল। ওর সঙ্গে গল্পগুজব করা যেত। কিন্তু সে নিশ্চয়ই কলেজে। কোন কলেজে পড়ে জিগ্যেস করা হয় নি। জানা থাকলে ঐ কলেজে হাজির হলে মন্দ হত না। শাহানাকে বের করে সিনেমা দেখা যেত, কিংবা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে বসে সময় কাটান যেত।
কিংবা ঐ ম্যাজিশিয়ান আনিসকে এক বার খবর দিয়ে এ বাড়িতে নিয়ে এলে হয়। ছোটখাট একটা উৎসবের মতো করা হবে। ম্যাজিশিয়ান আনিস ম্যাজিক দেখাবে। পরিচিত কিছু মানুষ থাকবে।
চায়ের টেবিলে শারমিন হাসিমুখে বলল, ম্যাজিক তোমার কেমন লাগে বাবা?
কী ম্যাজিক?
ট্রিক্স। রুমাল ভ্যানিশ হয়ে যাবে। শূন্য থেকে তৈরি হবে রক্তগোলাপ।
ভালোই লাগে। হঠাৎ ম্যাজিক প্রসঙ্গ কেন?
আমি এক জন ম্যাজিশিয়ানকে চিনি। তাঁকে আমি বাসায় শো করতে दब्द।
বেশতো, বলবে।
কবে করলে তোমার সুবিধা হয়?
যে-কোনো দিন করতে পার। রবিবারে করা যেতে পারে।
ঠিক আছে বাবা, রবিবার সন্ধ্যায়।
রহমান সাহেব মেয়ের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকালেন। ম্যাজিশিয়ান শ্রেণীর কাউকে তাঁর মেয়ে চেনে, এটা বিশ্বাস করতে তাঁর কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তিনি কিছু বললেন না।
বাবা, তাহলে ঐদিন খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়।
হ্যাঁ, ব্যবস্থা কর।
ঐদিন সব রান্না আমি করব, কী বল?
ভেরি গুড আইডিয়া!
দেশী রান্না, না চাইনিজ? কোনটা চাও তুমি?
মিক্সড় হলে কেমন হয়?
ভালোই হয়।
শারমিনের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। রহমান সাহেবের মনে হল, মাটির শোক শারমিনকে স্পর্শ করে নি। তার জীবনে কি এর চেয়েও কোনো বড়ো শোক আছে?
শারমিন হাসিমুখে বলল, নাশতা খাওয়ার পর আজ সারা দিন আমি ঘুরব।
ভেরি গুড। কোথায় ঘুরবে?
ঠিক নেই কোনো। গাড়ি নিয়ে যাচ্ছ তো?
হুঁ।
তুমি নিজে গাড়ি চালানোটা শিখে নাও না কেন?
আমার ইচ্ছে করে না।
প্রেসক্লাবের সামনে রফিক দাঁড়িয়ে আছে। ছোটখাট একটা ভিড় সেখানে। শারমিন বলল, ড্রাইভার সাহেব, গাড়ি থামান।
ড্রাইভার গাড়ি থামাল।
ঐ কোণায় পার্ক করে রাখুন। তারপর রফিককে ডেকে নিয়ে আসুন। ঐ যে হলুদ পাঞ্জাবি, দড়ির ব্যাগ কাঁধে।
রফিক হাসিমুখে এগিয়ে এল, আরে, কী ব্যাপোর?
তুমি এই ঠাণ্ডায় শুধু একটা পাঞ্জাবি গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ?
ইয়েস ম্যাডাম। বেকারদের শীত লাগে না।
করছ কি এখানে? ভিড় কিসের?
চাকরির দাবিতে অনশন হচ্ছে। তাই দেখছিলাম। নিজেও ঢুকে পড়ব কিনা ভাবছি।
উঠে আসে।
কোথায় যাচ্ছ?
ঠিক নেই।
রফিক উঠে এল। শারমিন বলল, তোমার ঝুলির ভেতর কী আছে?
কিছুই নেই। যাচ্ছি কোথায় আমরা?
কোথাও না। শুধু ঘুরব ঢাকা শহরে। তোমার কোনো কাজ নেই তো?
না। দুপুরবেলা ভাবীর অফিসে যাবার একটা প্ল্যান ছিল, সেটা বাতিল করলাম।
বাতিল করবার দরকার কী? যাবে দুপুরে। আমি বাইরে অপেক্ষা করব। কিংবা আমিও যেতে পারি, তোমার ভাবী যদি রাগ না করেন।
রাগ করবে। কেন? রাগ, হিংসা, দ্বেষ এইসব ভাবীর মধ্যে নাই। শী ইজ এন একসেপশনাল লেডি। তারপর তোমার কী খবর বল।
কোন খবর জানতে চাও?
ভদ্রলোক কবে আসছেন?
এপ্ৰিল।
বিয়েটা হচ্ছে কবে?
মে মাসে।
মহানন্দে আছি।
হু! তোমার কি হিংসা হচ্ছে নাকি?
একটু যে হচ্ছে না তা না। ভালো কথা, তোমার কাছে টাকা পয়সা আছে।
কেন?
দি থাকে, তাহলে এক প্যাকেট দামী সিগারেট কিনে দাও। ফতুর হয়ে গেছি।
শারমিন হেসে বলল, ভিক্ষা?
হ্যাঁ, ভিক্ষা।
ভিক্ষাই যখন চাইছ, তখন ছোট জিনিস চাইছ কেন? বড়ো কিছু চাও।
পাওয়া যাবে না, এমন কিছু আমি চাই না।
দুপুরবেলা তারা দু জন সত্যি সত্যি নীলুর অফিসে উপস্থিত হল। নীলু বেশ অবাক হল। যে মেয়েটির কিছু দিনের মধ্যেই বিয়ে হচ্ছে, সে একটি ছেলের সঙ্গে এমন সহজভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে কীভাবে?
ভাবী কেমন আছেন?
ভালো। তুমি কেমন আছ? তুমি বললাম, রাগ কর নি তো?
হ্যাঁ, খুব রাগ করেছি।
শারমিন হেসে ফেলল। নীলুর মনে হল, এই মেয়েটি বড়ো ভালো। কিছু কিছু মানুষ আছে, যাদের সব সময় কাছের মানুষ মনে হয়। এই মেয়েটি সেই দলের।
শারমিন বলল, আসুন ভাবী, আজ দুপুরে আমরা সবাই মিলে একসঙ্গেচ খাব। নতুন একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট হয়েছে, খুব ভালো খাবার।
আজ তো যেতে পারব না। আমাদের বোর্ড মিটিং আছে। সবাইকে থাকতে হবে। বৎসর শেষ হচ্ছে তো।
আজ তাহলে আপনি খুব ব্যস্ত?
হ্যাঁ। অন্য কোনো দিন সবাই মিলে একসঙ্গে খাব।
তার মানে আপনি এখন আমাদের বিদায় হতে বলছেন?
নীলুহাসতে হাসতে বলল, হ্যাঁ। আজ আমাদের খুব ঝামেলা।
কিন্তু আপনাকে এত খুশি-খুশি লাগছে কেন?
আমার একটা সুখবর আছে।
রফিক অবাক হয়ে বলল, কী সুখবর, প্রমোশন হয়ে গেছে নাকি তোমার? চাকরি তো এক বছরও হয় নি!
নীলু কিছু না বলে অত্যন্ত রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসতে লাগল। সে নিজেও তার সুখবর সম্পর্কে কিছু জানে না। সকালবেলা অফিসে আসতেই সালাম সাহেব বলেছেন, আপনার জন্যে সুখবর আছে। বোর্ড মিটিংয়ের পর জানতে পারবেন। নীলুভয়ে-ভয়ে বলেছে, সুখবরটা কী?
জানবেন, জানবেন। এত ব্যস্ত কেন? দুঃসংবাদ তাড়াতাড়ি শোনা ভালো, কিন্তু সুসংবাদের জন্যে অপেক্ষা করাতেও আনন্দ।
কথাটা ঠিক, নীলুর আনন্দই লাগছে। কী হতে পারে খবরটা? প্রমোশন হবে না। সেটা সম্ভব না। চাকরি এক বছরও হয় নি। কিন্তু এছাড়া আর কী হতে পারে?
শারমিন বাসায় ফিরল সন্ধ্যাবেলা। সমস্তটা দিন বাইরে কেটেছে, কিন্তু এতটুকুও ক্লান্তি লাগছে না। বরং বেশ ঝরঝরে লাগছে।
রহমান সাহেব বাসায় ছিলেন। তিনি অনেক দিন পর শারমিনের উৎফুল্ল চোখ-মুখ দেখলেন। তিনি বললেন, চল মা, বাগানে হাঁটতে হাঁটতে চা খাই।
এই শীতের মধ্যে বাগানে হাঁটতে হাঁটতে চা খাবে কি!
খুব শীত না! চল যাই। চাদর-টাব্দর কিছু গায়ে দিয়ে নাও।
রহমান সাহেব গোলাপঝাড়ের দিকে এগুলেন। এই বাগানের পেছনে অনেক শ্রম এবং অর্থ ব্যয় করা হয়। কিন্তু বাগান প্রাণহীন। প্রচুর গোলাপ গাছ আছে, কিন্তু বেশির ভাগ গাছই ফুল ফোটাতে পারে না। হয়তো মাটি ভালো না। কিংবা মালী ফুলগাছের কিছু জানে না। বাগানে হাঁটতে হাঁটতে রহমান সাহেবের একটু মন খারাপ হল।
কী করলে আজ সারা দিন?
তেমন কিছু না। ঘুরলাম, কেনাকাটা করলাম।
কী, কিনলে?
সুতির শাড়ি কিনেছি দুটি। ঘরে পরার, ফ্যান্সি কিছু না।
ফ্যান্সি কিছু কিনলেই পারতে।
কিনব এক সময়।
রহমান সাহেব হাসিমুখে বললেন, তাড়াতাড়িই কেনা উচিত। উৎসবের দিন তো এগিয়ে আসছে।
শারমিন কিছু বলল না।
শুনেছি, অনেকেই বিয়ের শাড়ি-টাড়ি কোলকাতা থেকে কেনে, তুমি যেতে চাও কোলকাতায়?
না।
আমি আগামী সপ্তাহে যাচ্ছি কোলকাতায়, ইচ্ছা করলে তুমি যেতে পারে।
না অত শখ নেই আমার।
এটা তো শখেরই বয়স। তোমার শখ নেই কেন?
ভেতরে চল বাবা। ঠাণ্ডা লাগছে।
রহমান সাহেব হালকা স্বরে বললেন, একটা কথা খুব পরিষ্কার করে বল শারমিন, সাব্বিরকে বিয়ের ব্যাপারে তোমার মনে কি কোনো দ্বিধা দেখা দিয়েছে?
না, শুধু শুধু দ্বিধা দেখা দেবে কেন?
আজ তার একটি চিঠি পেলাম। তোমার কাছে চিঠি লিখে লিখে নাকি জবাব পাচ্ছে না।
মাঝে মাঝে আমার চিঠি লিখতে ভালো লাগে না। আলসে লাগে।
আজ তাকে চিঠি লিখে দিও।
হ্যাঁ, দেব।
আর ঐ ম্যাজিশিয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল?
না।
রোববারের প্রোগামটা ঠিক আছে?
না।
না, কেন?
এখন আর ইচ্ছা করছে না।
রহমান সাহেব মেয়ের দিকে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে রইলেন। শারমিনকে তিনি বুঝতে পারছেন না। বাবারা হয়তো সবসময় তা পারে না। মারা পারে। শারমিনের মা বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই শারমিনকে বুঝতে পারত। রহমান সাহেব অনেক দিন পর নিজের স্ত্রীর কথা মনে করলেন।