1 of 2

১৪. রসময় চক্রবর্তীর বাড়িতে

রসময় চক্রবর্তীর বাড়িতে মাটির দেওয়াল ওপরে খাপরার ছাদ। প্রাইমারি স্কুলের রসময় চক্রবর্তীর অবস্থা বোধহয় এবার ফিরবে। তার ছেলে পিতু অর্থাৎ সুপতিকে দেখবার জন্য। এত বেশি ভিড় হচ্ছে যে ভিড় সামলাবার জন্য রসময় চক্রবর্তীকে বাড়ির সামনে কাটাতারের বেড়া তুলতে হয়েছে–লোকজন এখন লাইন দিয়ে ভেতরে ঢোকে এবং দর্শনী এক আনা। পিতুর সঙ্গে কথা বলার জন্য রেট আট আনা, তবলা শুনতে হলে এক টাকা। তাতেও সারা দিন হাজার হাজার মানুষ আসছে। জায়গাটায় ছোটখাটো মেলা বসে গেছে, গজিয়ে উঠেছে চায়ের দোকান, পানের দোকান, মুড়িমশলা, বেলুন। দু-তিনটে হ্যাঁজাক জ্বলছে।

।বড়বাবু আর চিররঞ্জন কিছুক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে দেখলেন। ভিড় থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়িয়ে কথা বলতে লাগলেন নিম্নস্বরে। চিররঞ্জন বললেন, এত লোক যখন আসছে, তখন একটা কিছু ব্যাপার আছে নিশ্চয়ই। লোকে পয়সা দিয়ে দেখছে!

বড়বাবু বললেন, তুমি মাটির মধ্যে একটা গোল ধরনের পাথর পুঁতে রটিয়ে দাও যে সেটা মাটি খুঁড়ে বেরিয়েছে, তুমি স্বপ্নে সেটা জানতে পেরেছ–আর প্রত্যেক দিন একটা গোরু এসে ওই পাথরটার ওপর বাঁট থেকে দুধ দিয়ে যায়–দেখবে তাতেও হাজার হাজার লোক আসবে। পয়সাও দেবে!

কিন্তু লোকজন বলাবলি করছে, জেলার ডি এস পি সাহেবও এসে দেখে গেছেন। বুজরুকি কিছু হলে কি তিনি চলতে দিতেন? ইংরেজ।

ওঃ চিরু, তোমার ইংরেজ-ভক্তির তুলনা নেই! ইংরেজদের মধ্যে বুঝি কুসংস্কার নেই? কত যে আছে, তা ওদের সাহিত্য পড়লেই বোঝা যায়। ইংরেজি ভাষায় ভূতের গল্প নেই? তা ছাড়া আমাদের দেশের লোকদের মধ্যে কুসংস্কার টিকিয়ে রাখায় ওদের স্বার্থ আছে।

আপনি যে দেখছি পুরোপুরি অবিশ্বাস নিয়েই এসেছেন। তবু এত দূর ছুটে এলেন!

বড়বাবু হঠাৎ লাজুক ভাবে হাসলেন। তারপর বললেন, একটা জিনিস বুঝতে পারোনি? আমি বিশ্বাস করতে চাই–তাই তো আমার এত অবিশ্বাস।

রাত বাড়তে থাকলে আস্তে আস্তে ভিড় কমতে লাগল। শেষ দর্শকটি চলে যাবার পর ওঁরা দু’জন এগোলেন বাড়ির দরজার দিকে।

রসময় চক্রবর্তী তখন একগাদা খুচরো পয়সা নিয়ে গুণতে ব্যস্ত, ওঁদের দেখেই চেঁচিয়ে উঠলেন, আর হবে না, আর হবে না, এখন বন্ধ! এখন চলে যাও!

তারপর বড়বাবুর রাশভারী চেহারার দিকে ভালো করে তাকিয়ে একটু থতমত খেয়ে গেলেন। মনে করলেন, বিশেষ কোনও গণ্যমান্য ব্যক্তি এসেছেন বুঝি! রসময় চক্রবর্তী তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পয়সার বাক্সটা উলটে পড়ে গেল। তখন তিনি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে বললেন, আমার ছেলেটাকে মেরে ফেলবে সবাই! আমার ছেলে। বাঁচবে না! আমি পয়সাকড়ি কিচ্ছু চাই না। আমার ছেলেকে বাঁচান! এক মিনিট ছুটি নেই–লোকজন কথা শোনে না, এক মিনিট ওকে বিশ্রাম দেয় না-খাবার পর্যন্ত সময়। পায় না ছেলেটাকেন আমার কপালে এই হল!

বড়বাবু তার কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, আপনার কোনও চিন্তা নেই। আপনার ছেলেকে এখন বিরক্ত করতে চাই না, আপনার সঙ্গেই দুটো কথা বলতে চাই।

রসময় চক্রবর্তী একটু ধাতস্থ হয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কোথা থেকে। আসছেন?

কলকাতা থেকে।

পুরুলিয়ায় ক্ষুদ্র গ্রামে কলকাতা শহরের নাম তখন ম্যাজিকের মতন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে খাঁটি কলকাতার মানুষ সচরাচর গ্রামে পদার্পণ করেনি, তখন দক্ষিণেশ্বরবরানগর ঘুরে আসাই ছিল পল্লিভ্রমণ। সেই কলকাতা থেকে দু’জন সম্ভ্রান্ত চেহারার ব্যক্তি শুধু তার ছেলেকে দেখার জন্যই এসেছেন, এতে রসময় চক্রবর্তী বেশ অভিভূত হয়ে পড়েন। শশব্যস্ত হয়ে বললেন, আপনারা উঠেছেন কোথায়? এই রাত্তিরে ফিরবেন কী করে?

অমরনাথ বললেন, সে জন্য চিন্তা করবেন না, একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

কীসের ব্যবস্থা করবেন? এ পাড়াগাঁ জায়গা, হোটেল বলে তো কিছু নেই—

আমরা গোরুর গাড়িতেই শুয়ে থাকব।

সেও কি হয়! আপনারা শোবেন গোরুর গাড়িতে? এ-গাঁয়ের তা হলে কোনও ইজ্জত থাকবে? দয়া করে আপনারা যদি আমার বাড়িতেই–

রসময় চক্রবর্তী কিছুতেই ছাড়লেন না! তার অতিথিপরায়ণতাই প্রবল হয়ে উঠল। বাড়ির ভেতরে গিয়ে রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করে আবার ফিরে এলেন ঢাকা বারান্দায়। বললেন, নিন স্যার, আপনারা জামাকাপড় ছেড়ে আরাম করে বসুন! যা গরম এ বছর, মা। বসুমতী একেবারে দগ্ধ হচ্ছেন। পুকুর-নালা সব শুকিয়ে গেল!

পিতু অর্থাৎ সুপতির সঙ্গে তখনও কোনও কথা হয়নি। একবার মাত্র তাকে চোখে। দেখা হয়েছে। মস্তবড় একটা কাঁসার থালায় নানা রকম খাদ্যদ্রব্য সাজিয়ে তাকে খাওয়ানো হচ্ছে মহা সমারোহে। যেন সে এ বাড়ির ছেলে নয়, কোনও একজন গণ্যমান্য অতিথি! কদিন আগেও সে নিশ্চয়ই বাপ-মায়ের কাছ থেকে চড়চাপড় খেয়েছে, খিদে পেলে ঘ্যান ঘ্যান করেছে–আজ সে বাড়ির চোখে সম্পূর্ণ অন্য রকম! তার মায়ের ধারণা, ছেলের ওপর কোনও দেবতা ভর করেছে। অপদেবতা কিংবা ভূতে প্রায়ই মানুষের ওপর ভর করে, এ গ্রামেই দু মাস আগে একজন বিবাহিতা রমণীর ওপর ভূতের ভর হয়েছিল, চওরা এসে সর্ষে চালান দিয়ে সেই ভূতকে ছাড়িয়েছে! রসময় চক্রবর্তীর স্ত্রীর জন্ম-জন্মান্তরের সৌভাগ্য যে তার ছেলের ওপর ভূতের বদলে দেবতার ভর হয়েছে। সে দাঁত কিড়মিড় করে না। অলৌকিক ক্ষমতার পরিচয় দেয়।

ছেলেটার বয়স আট-নয় বছর হবে, অসম্ভব রোগা। তাকে একটি নতুন কোরা ধুতি এবং নতুন মখমলের পাঞ্জাবি পরানো হয়েছে, কিন্তু চুলে চিরুনি দেওয়া হয়নি! মাথার চুলগুলো খোঁচা খোঁচা, চোখদুটি অসুস্থ মানুষের মতন ছলছলে। তার খাওয়ার ভঙ্গিও অস্বাভাবিক! সে এক এক রকম খাবারে খামচা মেরে মেরে এক খাবলা তুলে নিয়ে মুখে পুরে দিচ্ছে, সবটা না খেয়েই ছিটিয়ে দিচ্ছে থুথু করে! তার মা এক হাতে পাখার হাওয়া করতে করতে অন্য হাতে তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছেন, খাও বাবা, মানিক আমার, সোনা আমার, একটু খাও! পায়েসটা ভালো লাগছে না? একটু দই খাবে? তোমার জন্য মালপোয়া বানিয়েছি।

রসময় চক্রবর্তী দুটি হুঁকো সেজে এনেছিলেন, বড়বাবু একটি নিয়ে টানতে লাগলেন। চিররঞ্জন ধূমপান করেন না। অনেকক্ষণ ধরে তিনি একটাও কথা বলেননি, সবকিছু দেখে যাচ্ছিলেন চুপচাপ করে। এখন বারান্দার তক্তপোশে বসে তাকিয়ে আছেন বাইরের দিকে। দোকানপাট উঠে গেছে, যতদূর চোখ যায় নিচ্ছিদ্র অন্ধকার! মাঝে মাঝে শিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে–সে-ডাকও যেন অনেকটা ফেউয়ের মতন! একটু আগেই শুনেছেন, এখানে মাঝে মাঝে চিতাবাঘ বেরোয়!

তক্তপোশের ওপরেই রাখা আছে বায়া-তবলা! সেদিকে তাকিয়ে বড়বাবু রসময় চক্রবর্তীকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি নিজে তবলা বাজাতে জানেন?

রসময় বিনীত ভাবে বললেন, আজ্ঞে, একটু একটু! একসময় গানবাজনায় চর্চা করতাম! কুমিরপোতার রাজবাড়িতে ওস্তাদ বাদল খাঁ সাহেব কিছু দিন এসে ছিলেন–

আপনার ছেলে বোধহয় আপনার শুনে শুনেই তবলা শিখেছে!

আজ্ঞে না, শুনে শুনে কি শেখা যায়? এসব যন্তরে হাত না পড়লে আমি নিজেই তো তাকে শিখিয়েছি!

বড়বাবু চমকে উঠে বললেন, আপনি আপনার ছেলেকে তবলা বাজানো শিখিয়েছেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ!

তবে যে খবরের কাগজে লিখেছে, ও জীবনে কখনও তবলা ছুঁয়ে দেখেইনি! হঠাৎ বাজাতে শুরু করেছে!

ওটা ঠিক নয়। আপনার কাছে মিথ্যে কথা বলব কেন?

বড়বাবু বিমূঢ় ভাবে তাকালেন চিররঞ্জনের দিকে। দু’জনে চোখাচোখি হল। এতটা রাস্তা বৃথাই আসা হল তা হলে?

রসময় বললেন, আপনাদের কাছে স্যার লুকোছাপা কিছু নেই। সব খোলাখুলি বলছি। এর মধ্যে একটা কিছু ব্যাপার আছেই। মিস্ত্রি যাকে বলে। আপনারা মানী গুণী লোক, আপনারাই বিচার করে আমাকে বলে দিন। আমি নিজের হাতে আমার ছেলেকে তবলা। শিখিয়েছি। এই একটু ধা ধিন না, না তিন না–মানে একটু দাদরা, কাহারবা আর ত্রিতাল–মানে কোনও রকমে ঠেকা দিতে পারা আর কী! আমার ছেলে কতটুকুনি শিখেছে তা তো আমার বেশি আর কেউ জানে না! আমার কাছ থেকেই তো শিখেছে–আর আমিও তো এর বেশি জানি না। তারপর একদিন কী হল, ওরেঃ বাস রে বাস, ভাবতে গেলে এখনও আমার গায়ে কাঁটা দেয়, আমার হাতের নোম কী রকম খাড়া হয়ে গেছে।

বড়বাবু মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, কী হল একদিন?

কী বলব স্যার আপনাকে। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যাবেলা আমি শুনতে পেলাম পাশের ঘরে তবলার বোলের যেন খই ফুটছে। কোনও ওস্তাদ যেন বসে লহরা বাজাচ্ছে! তাড়াতাড়ি উঁকি মেরে দেখি, ঘরে আর কেউ নেই। আমার ছেলে পিতু! এ-দৃশ্য দেখলে গায়ে কাঁটা দেবে না!

আপনার ছেলে হঠাৎ খুব ভালো তবলা বাজাতে শিখে গেছে, এই তো? এতে খুব বেশি আশ্চর্য হবার কী আছে! ওই বয়সি ছেলের পক্ষে ভালো তবলা বাজানো তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। আগেও দেখা গেছে!

আপনি কী বলছেন স্যার? আশ্চর্য নয়? তবলার বোল কি গাছে ফলে? গুরুর কাছে নাড়া বেঁধে কত সাধ্যসাধনা করে তবে শিখতে হয়। আমার ছেলে কোনও দিন এ গাঁ ছেড়ে বাইরে যায়নি, তার শিক্ষা আমার কাছ–আমিও নিজেও জানি অতি সামান্যই আর আমার ছেলে হঠাৎ এতখানি শিখে ফেলবে–এ কি মুখের কথা? এখন তার বাজনা শুনলে কণ্ঠে মহারাজ কিংবা হীরু গাঙ্গুলি পর্যন্ত অবাক হয়ে যাবেন! আর কী দুর্দান্ত লয়! এত দ্রুত লয়ে বাজাতে পারে যে আঙুল দেখা যায় নাসারা জীবন সাধনা করলেও অনেকে এমনটি পারে না–আপনি নিজের কানে শুনলে, নিজের চোখে দেখলে তবে বুঝতে পারবেন!

আপনি আপনার ছেলেকে সে-দিন কিছু জিজ্ঞেস করেননি!

করেছি বই কী! আমি বললাম, পিতু, তুই বাজাচ্ছিলি এতক্ষণ? আবার বাজা তো দেখি! একী, এ যে অসম্ভব! অসম্ভব! আমার ছেলে কী বলল জানেন? সে বলল, পিতু। কে? আমার নাম বিশ্বেশ্বর! আমি এখানে কেন? ছেলের মুখের ভাবই তখন অন্য রকম। যেন একজন বয়স্ক লোক। আমার গিন্নিও তখন এসে হাজির হয়েছে। সে ছেলের গায়ে হাত দিয়ে বলল, ও পিতু, তুই কী বলছিস কী? ছেলে উত্তর দিল, আমি পিতু নয়, আমি বিশ্বেশ্বর। আমার গিন্নির তখন ধারণা হল, ছেলের ওপর শিবের ভর হয়েছে। গত বছর গাজনের মেলায় ওই ছেলে শিব সেজে নেচেছিল কিনা! শিবের ভর না হলে সে অমন করে তবলা বাজাবে কী করে!

বড়বাবু বললেন, শিবঠাকুর ভালো তবলা বাজাতে জানেন–এমন কথা কখনও শোনা যায়নি। উনি তো ডমরু বাজান–তার সঙ্গে তো বাঁয়া-তবলার মিল নেই। চিরু, তুমি কী বলো?

চিররঞ্জন একাগ্র ভাবে শুনছিলেন। উত্তর না দিয়ে শুধু হাসলেন।

রসময় বললেন, সে কী বলছেন, ঠাকুরদেবতারা সবই পারেন। ওঁদের কাছে তবলাই বা কী আর বেহালাই বা কী! তবে, আমি অবশ্য ঠাকুরদেবতার কথা ভাবিনি। ঠাকুরদেবতারা আমার মতন অভাগার বাড়িতে আসবেনই বা কেন? আমি ছেলেকে আরও অনেক কথা জিজ্ঞেস করলুম। ছেলে বলল, তার নাম বিশ্বেশ্বর হালদার। তার বাড়ি মালদা টাউনে, সেখানে তার বাপের দোতলা বাড়ি। বার বার আমাকে জিজ্ঞেস করতে লাগল, আমি এখানে কেন? আমি এখানে কেন? আমি বুঝতে পারলাম, এ ছেলে জাতিস্মর। দৈবাৎ পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ে গেছে। কোটিতে গুটিক এমনটি হয়।

বড়বাবু সন্দিগ্ধ ভাবে বললেন, বিশ্বেশ্বর হালদার নামে কোনও বিখ্যাত তবলচির নাম তো আমি শুনিনি!

মফসসলে কত ভালো ভালো গুণী লোক পড়ে আছে, কলকাতার লোকরা কি সব খবর রাখে!

আচ্ছা বেশ। আপনি মালদায় আপনার ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিলেন?

তা এখনও যেতে পারিনি। তবে এ-গাঁয়ের একজন তোক মালদায় গিয়ে খবর নিয়ে এসেছে–মালদা টাউনে সত্যিই অনন্ত হালদার নামে তেজারতের কারবারি এক ভদ্রলোক আছে। তেনার দোতলা বাড়ি, বিশ্বেশ্বর নামে এক ছেলে মারা গেছে বছর দশেক আগে।

বড়বাবু একটু বিরক্ত হলেন। কোনও কাজ সুষ্ঠু ভাবে না হলে তার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। এই লোকটি তার ছেলেকে চিড়িয়াখানার জন্তুর মতন টিকিট কেটে মানুষজনকে দেখাচ্ছে। তার কি উচিত ছিল না–প্রথমেই ছেলেকে মালদায় নিয়ে সত্যাসত্য যাচাই করা!

বড়বাবুর ভাবভঙ্গি দেখে রসময় চক্রবর্তী একটু যেন ঘাবড়ে গেলেন। তাড়াতাড়ি বললেন, ছেলেতে ডাকব স্যার? আপনি নিজের চক্ষে দেখবেন?

বড়বাবু বললেন, না, তার দরকার নেই। সে এখন বিশ্রাম করুক। আপনার সঙ্গেই কথা শেষ হয়নি। আমি অকপটে কথাবলা পছন্দ করি। সত্যি কথা বলতে কী, মালদার ব্যাপারটা আমার উড়ো কথা বলে মনে হচ্ছে। তবলা বাজানো কিংবা এ রকম একটা-আধটা উড়ো কথায় কিছুই প্রমাণ হয় না। আপনি বুঝতে পারছেন না, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার!

রসময় এবার উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। খানিকটা তোতলাতে তোতলাতে বললেন, আপনি বিশ্বাস করছেন না? আমি কি মিথ্যে কথা বলছি! এ যে আমারও বুদ্ধির অতীত! ডি এস পি সাহেব এসেছিলেন, তার সঙ্গে ছেলে আমার গড়গড় করে ইংরেজি বলে গেল! এ-গাঁয়ের একটা লোকও ইংরেজি জানে না, আমি নিজেও জানি না! ভাবতে গেলে আমার নিজেরই মাথা ঘোরে!

দুটো শেয়াল বাড়ির কাছ থেকেই ডেকে উঠল, ঘেউ ঘেউ করে তাড়া করে গেল একটা কুকুর। অনেকক্ষণ বাদে উঠেছে একটা ক্ষীণ মতন চাঁদ। সেই চাঁদ আড়াল করে উড়ে গেল একটা প্যাচা। এক দিকের অন্ধকার দিগন্ত থেকে উড়ে এসে কেন সে অন্য দিকের অন্ধকারে উড়ে যায়, তার মানে বোঝা যায় না।

চিররঞ্জন ধড়ফড় করে খাট থেকে নেমে বললেন, এসো খোকা, তুমি এখানে এসে বোসো!

ঘর থেকে বেরিয়ে কখন সুপতি সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে। অবোধ বালকের মতন তার মুখে একটা আঙুল। একদৃষ্টিতে সে চেয়ে আছে আগন্তুক দু’জনের দিকে। সারা দিন ধরে অসংখ্য মানুষজন তাকে দেখে গেছে, এখন সে নিজে দেখছে অন্য মানুষদের।

ছেলেটিকে দেখে চিররঞ্জনের হঠাৎ মনে পড়ল তার নিজের ছেলের কথা। বাদলেরই বয়সি হবে–যদিও স্বাস্থ্য এর ভালো না। ছেলেটির দিকে তাকালে একটু অন্য রকম অনুভূতি হয়ই–ঠিক যেন আর পাঁচজনের মতন না।

রসময় বললেন, আয় পিতু, এঁরা কলকেতা থেকে এয়েছেন। প্রণাম কর!

ছেলেটি প্রণাম করল না, গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বড়বাবু বললেন, থাক, থাক। তারপর উঠে গিয়ে বড়বাবু ছেলেটির একেবারে সামনে গিয়ে শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী?

ছেলেটি চেঁচিয়ে বলল, বিশ্বেশ্বর হালদার! মাই নেম ইজ বিশ্বেশ্বর হালদার! মাই ফাদারস নেম ইজ অনন্ত হালদার!

ছেলেটি এত জোর চেঁচিয়ে উঠল যে শুনে হকচকিয়ে যেতে হয়। কথা বলার সময় সে কারওর চোখের দিকে তাকায় না; মাটির দিকে চেয়ে থাকে। এবং সেই সময় তার শরীর একটু একটু দোলে।

রসময় বললেন, পিতু, বাবা, এনাদের একটু তবলা বাজিয়ে শোনাও তো!

বড়বাবু বললেন, থাক, এখন থাক। এখন দরকার নেই। কিন্তু ছেলেটি পূর্ববৎ চেঁচিয়ে হুকুমের সুরে বলল, মানি! গিভ হিম মানি! আই শ্যাল প্লে তবলা, গিভ হিম মানি!

রসময় বললেন, দেখলেন! দেখলেন? এক অক্ষর ইংরেজি জানার কথা নয়। কোনও দিন পড়েইনি, এ কী করে সম্ভব বলুন!

ছেলেটির ইংরেজি বলার ধরন খুবই অশিক্ষিত গ্রাম্য লোকেরই মতন। এই ইংরেজি জ্ঞানের ওপর গুরুত্ব দেওয়া যায় না। যে-গ্রামে শুধু একটি প্রাইমারি স্কুলই সম্বল সেখানে অধিকাংশ ছেলেই ইংরেজি বলতে পারে না বটে, কিন্তু শিখে নেওয়া এমন কিছু অসম্ভব নয়।

বড়বাবু পকেট থেকে দুটি রুপোর টাকা বের করে রাখলেন তক্তপোশের ওপর। ছেলেটি কাঠের পুতুলের মতন খাড়া ভাবে এগিয়ে এসে খাটে উঠে বসল। তারপর বিনা বাক্যব্যয়ে একটুও দেরি না করে ধাই ধপাধপ করে বাজাতে লাগল তবলা। বড়বাবু সংগীতে অভিজ্ঞ, খানিকটা শুনেই তিনি বুঝতে পারলেন ছেলেটির তবলায় হাত আছে। ঠিকই, খুব একটা উচ্চাঙ্গের বাজনা নয় অবশ্য–তবে অন্য কারওর কাছে না শেখার ব্যাপারটা যদি সত্যি হয়, তা হলে আশ্চর্যই বলতে হবে। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে ছেলেটির ভাবভঙ্গি। তার হাঁটা, তার কথা বলা, তবলাদুটো টেনে নিয়ে বসা–এর মধ্যে শিশুসুলভ কোনও ভাবই নেই। তার ভেতর থেকে যেন একটা অন্য মানুষ তাকে চালাচ্ছে–এ রকম একটা ধারণা হয়ই।

চিররঞ্জন অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন, ফিসফিস করে বললেন, সত্যিই বিস্ময়কর, সত্যিই বিস্ময়কর!

বড়বাবু বললেন, খুব সম্ভব ছেলেটির মৃগী রোগ আছে। ছেলেটি যে অসুস্থ তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

হাত তুলে ছেলেটিকে বাজনা থামাতে বলে বড়বাবু জিজ্ঞেস করলেন, খোকা, তুমি কার কাছে বাজানো শিখেছ?

ছেলেটি বলল, ওস্তাদ দীনেশ সিং যাদব। গুরুর নাম উচ্চারণ করেই সে এক হাত কানে হেঁয়াল–অবিকল পেশাদারদের মতন।

কোথায় থাকেন তিনি?

মালদায়।

রসময় তাড়াতাড়ি জানালেন, আমার ছেলে জীবনে কখনও এ-গ্রামের বাইরে যায়নি।

বড়বাবু রসময়ের দিকে ফিরে বললেন, শুনুন মশাই, আপনার ছেলেকে কালই মালদায় নিয়ে যেতে হবে–আমি সব খরচপত্তর দেব, আপনি রাজি আছেন? তারপর এ-ছেলেকে কলকাতায় নিয়ে যেতে হবে আপনারা সবাই গিয়ে আমার বাড়িতে থাকবেন বড় বড় ডাক্তার এনে দেখাতে হবে একে। আর একটা কথা, আপনার ছেলে জাতিস্মর হোক বা না হোক এ যে অসুস্থ তাতে কোনও সন্দেহ নেই! এর চিকিৎসা না করিয়ে আপনি একে দেখিয়ে পয়সা রোজগার করছেন! আপনার লজ্জা করে না!

রসময় চক্রবর্তী এবার ভেঙে পড়লেন! কান্না-আপ্লুত গলায় বললেন, আমি চাইনি, আমি চাইনি–ছেলে দেখিয়ে পয়সা রোজগার করব–এমন মানুষ আমি না! এই পইতে ছুঁয়ে বলছি, আমার কথা যদি মিথ্যে হয়, আমি মহাপাতকী হব। কী করে যেন ওর কথা রটে গেছে–রোজ হাজার হাজার লোক আসছে দেখতে-ছেলেটাকে এক দণ্ড বিশ্রাম দেয় না।

লোকে দেখছে, তার জন্য পয়সা নিচ্ছেন কেন?

উপায় নেই। পয়সা না নিলে সবাই একসঙ্গে ভিড় করে আসে–আমার বাড়ি ঘরদোর ভেঙে ফেলত! আপনি আমার ছেলেকে বাঁচান। আপনি ওকে যেখানে নিয়ে যেতে বললেন, যাব। আমার ছেলেটা বাঁচুক, আমি একটা পয়সা চাই না!

বড়বাবু ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললেন, খোকা, তোমার নাম বিশ্বেশ্বর বলছ কেন? তোমার নাম তো সুপতি!

ছেলেটি কড়া গলায় বলল, না, আমার নাম বিশ্বেশ্বর!

বড়বাবু এরপর যা করলেন, তাতে সবাই আঁতকে উঠল। বড়বাবু হঠাৎ প্রচণ্ড এক চড় কষালেন ছেলেটির গালে। দারুণ ধমক দিয়ে বললেন, ঠিক করে নাম বলো! ছেলেটি তবুও বলল, বিশ্বেশ্বর। এবার অন্য গালে আর এক চড়।

ছেলেটি কেঁদে ফেলল। এতক্ষণ বাদে সে কনুইয়ের ভাঁজে মুখ গুঁজে শিশুর মতন কাঁদতে লাগল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। অন্যরা স্তব্ধ। বড়বাবুর রুদ্র মূর্তি দেখে কেউ কিছু বলতে সাহস করছে না।

চিররঞ্জন উঠে এসে ছেলেটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলোত লাগলেন। তার কপালে একবার হাত ছুঁইয়ে বললেন, ইস, এর তো দেখছি খুব জ্বর!

রসময় আস্তে আস্তে বললেন, জ্বর নয়, বরাবরই ওর এ রকম–সেই বাচ্চা বয়স থেকেই ওর টেম্পারেচার বেশি থাকে। গায়ে হাত দিলে ছ্যাঁক ছ্যাঁক করে।

বড়বাবু জিজ্ঞেস করলেন, ডাক্তার দেখিয়েছিলেন কখনও?

এখানে ডাক্তার কোথায় পাব। কবরেজমশাই দেখে বলেছেন, ও কিছু নয়, ওর পিত্তির ধাত আছে।

চিররঞ্জন তখন ছেলেটিকে আস্তে আস্তে প্রশ্ন করছেন, তোমার কী হয়েছে বলে তো!

ছেলেটি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, আমি অন্য বাড়িতে ছিলাম!

কোন অন্য বাড়িতে?

অন্য রকম বাড়িতে। আমার অন্য রকম বাবা-মা। আমার দু’জন দিদি ছিল। আমার জামাইবাবু যাত্রায় অ্যাক্টো করতেন। তারপর আমার মায়ের দয়া হল। এই দেখুন না, আমার গায়ে বসন্তের দাগ।

কই তোমার গায়ে তো কোনও বসন্তের দাগ নেই!

ছিল! আমার আগের জন্মে ছিল!

আগের জন্ম? তোমার আগের জন্মের কথা মনে আছে!

সব মনে আছে!

আর কী কী মনে আছে বলো তো!

কেন বলব? মানি! গিভ মি মানি! গিভ মি মানি!

টাকা নিয়ে তুমি কী করবে?

খাব। লুচি খাব! অনেক লুচি খাব!

চিররঞ্জনের ঠোঁটে হাসি ছড়িয়ে গেল। বড়বাবু পকেট থেকে আরও টাকা বার করে চিররঞ্জনকে চোখের ইশারা করলেন। তারপর ছেলেটিকে বললেন, এই নাও, টাকা নিয়ে যাও।

ছেলেটি আসতে চাইছে না, বড়বাবুকে ভয় পাচ্ছে। বড়বাবু মিষ্টি গলায় বললেন, এসো, কোনও ভয় নেই। আর মারব না।

ছেলেটি টাকার দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতন তাকিয়ে এগিয়ে এল এক পা এক পা করে। বড়বাবু খপ করে তার হাত ধরে ফেললেন। খুব আদর মিশিয়ে বললেন, তুমি আমার বাড়িতে যাবে? তোমাকে লুচি খাওয়াব।

ছেলেটি কোনও উত্তর দিল না। সে যেন খুব লজ্জা পেয়েছে।

আগের জন্মে তুমি বুঝি লুচি খেতে ভালোবাসতে?

হ্যাঁ।

আর কী ভালোবাসতে?

নতুন গুড়ের সন্দেশ।

বাঃ! কলকাতায় খুব ভালো ভালো সন্দেশ পাওয়া যায়। যাবে কলকাতায়?

যাব!

তোমার গায়ে তো জ্বর রয়েছে দেখছি। তোমার কষ্ট হচ্ছে না?

না।

আগের জন্মে তুমি কার সঙ্গে তবলা বাজাতে!

জামাইবাবুর সঙ্গে। জামাইবাবুর যাত্রা পার্টিতে।

বড়বাবু ঘাড় ঘুরিয়ে রসময়কে জিজ্ঞেস করলেন, এ কখনও যাত্রা দেখেছে?

আজ্ঞে হ্যাঁ, দু-তিন বার।

বড়বাবু চিররঞ্জনকে বললেন, দিস কুড বি এ ড্রিম! প্রোলন্‌গ্‌ড ড্রিম!

চিররঞ্জন বললেন, এ-জগতের সবকিছু আপনি ব্যাখ্যা করতে পারবেন না। যতই চেষ্টা করুন।

বড়বাবু ছেলেটিকে আবার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার আর কী মনে আছে?

একটা মটরগাড়ি।

মটরগাড়ি?

নীল নীল রং। সামনে দুটো বড় বড় চোখের মতন আলো। ভাপো ভালো করে আওয়াজ হয়!

রসময় বললেন, স্যার স্যার, একথাটা আমিও আগে কখনও ওর মুখে শুনিনি। আমাদের এ-গাঁয়ে কোনও দিন মটরগাড়ি ঢোকেনি।

আপনি একটু চুপ করুন। শোনো খোকা, তুমি সেই গাড়িতে চেপেছিলে?

সেই গাড়িতে চেপেই তো আমি বিয়ে করতে গেলাম।

চিররঞ্জন হো-হো করে হেসে ফেললেন। ওইটুকু ছেলের মুখে বিয়ের কথা শুনলে হাসি পেতে আর দোষ কী! বড়বাবুও হাসি চেপে রেখেছেন। জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বউটি বেশ সুন্দর ছিল?

ছেলেটির মুখে ঠিক নব-বিবাহিত যুবকের মতন লজ্জা। ঘাড় হেলিয়ে জানাল, হ্যাঁ।

তারপর তুমি যখন মরে গেলে, সেই কথা তোমার মনে আছে?

আমার মায়ের দয়া হল। খুব কষ্ট, চোখ খুলতে পারি না। তারপর কারা যেন নিয়ে গেল আমাকে একটা ভাঙা বাড়িতে। বাড়ি না মন্দির, ঠিক মনে নেই। সেখানে একটা নদী আছে। নদী দিয়ে ভাসতে ভাসতে ভাসতে ভাসতে–

ভাসতে ভাসতে কোথায় গেলে?

মেঘের মধ্যে। অনেক মেঘ, তুলো তুলো মেঘ–তারপর আর মনে নেই।

আচ্ছা শোনো। তোমার কোন জীবনটা বেশি ভালো লাগে! এই যে এখানে আছ, এই বাবা-মা, এই বাড়ি–এটা বেশি ভালো লাগে, না আগেরটা?

আগেরটা!

একথা শুনে বড়বাবু যেন খুবই অবাক হয়ে গেলেন। ব্য-ভাবে ফের জিজ্ঞেস করলেন, আগেরটা? তুমি সেই আগের জীবনে ফিরে যেতে চাও?

হ্যাঁ।

কেন? এখানে সবকিছু নতুন, তাও তোমার ভালো লাগে না?

না!

বড়বাবু চিররঞ্জনের দিকে ফিরে বললেন, আমি নিশ্চিত, এ একটা স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে আছে। স্বপ্নের ফিক্সেশান।

চিররঞ্জন সায় দিতে পারলেন না সে কথায়। তিনি বললেন, আমার কিন্তু সবই বিশ্বাস হচ্ছে। অতীতকালটাই সবার চোখে সুন্দর।

কথাবার্তা আর বেশি দূর এগোল না। ছেলেটি অবিলম্বে মাটিতে পড়ে গিয়ে ছটফট করে গোঙাতে লাগল। তার চোখদুটি স্থির, মুখ দিয়ে গাজলা বেরোচ্ছে। তার তড়কা কিংবা মৃগী রোগ আছে ঠিকই। রসময় বললেন, ব্যস্ত হবেন না। এক্ষুনি ঠিক হয়ে যাবে। আমি জল নিয়ে আসছি।

আগেও এ রকম হয়েছে?

প্রায়ই হয়। একটু বাদেই ঠিক হয়ে যায়!

আপনি কি মানুষ? তাও এর চিকিৎসা করাননি, ছেলেটিকে তিলে তিলে মেরে ফেলছেন?

এ-রোগের কি চিকিৎসা হয়?

পরদিন মালদায় যাওয়া হল না। ছেলেটির শরীরের অবস্থা দেখে বড়বাবু তাকে নিয়ে যেতে সাহস পেলেন না। তিনি প্রচুর টাকা দিয়ে সতেরো মাইল দূর থেকে একজন ডাক্তারকে আনতে পাঠালেন। ডাক্তার এসে পুরো একদিন থেকেও কিছুই করতে পারলেন না। ডাক্তারটি সহৃদয়, ছেলেটির প্রতি নিজেও কৌতূহলী হয়েছিলেন, তবু তিনি স্বীকার করলেন যে চিকিৎসা করার ক্ষমতা তার নেই। ছেলেটির রোগ বেশ কঠিন, বিশেষত সর্বক্ষণ তার শরীরে টেম্পারেচার থাকা নাকি সত্যিই ভয়ের ব্যাপার। ওকে শহরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করা দরকার।

এদিকে বাড়ির সামনে হাজার হাজার মানুষের ভিড়। বহু রকমের গুজবে কানপাতা যায় না। রোগীর প্রতি কারওর কোনও সহানুভূতি নেই। সবাই তাকে একবার অন্তত চোখের দেখা দেখতে চায়। ছেলেটির অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। এতদিন সে মোটামুটি চলে ফিরে বেড়াতে পারত, ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে তার অবস্থার আরও অবনতি হল। শোনা গেল, এর আগে সে কোনও প্রকার আলোপাথিক, ওষুধ খায়নি। প্রথম ওষুধ খেয়েই তার রোগলক্ষণ প্রকট হয়ে উঠল, নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইল বিছানায়।

বড়বাবু তখন তাকে কলকাতায় নিয়ে আসতে চাইলেন। রসময় তাতে রাজি, কিন্তু রসময়ের স্ত্রীর তাতে ঘোর আপত্তি। তর্কাতর্কি আর ঝগড়া করে যত সময় কাটতে লাগল, ততই ছেলেটিকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হতে লাগল। শেষ পর্যন্ত বড়বাবু একরকম প্রায় জোর করেই বাবা-মা সমেত ছেলেটিকে নিয়ে এলেন কলকাতায়।

.

সুপতিকে আমি দেখেছিলাম। আমাদের বাড়িতে এসে সে বেঁচেছিল মাত্র দু’দিন। বড়বাবু তার চিকিৎসার সব রকম চেষ্টা করেছিলেন। কল দিয়েছিলেন বিধান রায় মশাইকে। তখন ডঃ অ্যাটকিনসন সাহেবেরও খুব নামডাক, বিধানবাবুর পরামর্শে তাকেও আনা হয়েছিল আমাদের বাড়ি তখন সর্বক্ষণ সরগরম। তবুও বাঁচানো গেল না তাকে। সুপতি মারা যাবার পর কলকাতার সব কাগজে তার ছবি ও জীবনী ছাপা হয়েছিল। থিয়োসফিক্যাল সোসাইটির সদস্যরা রসময় চক্রবর্তীকে আরও একমাস কলকাতায় রেখে নানা রকম প্রশ্নাদি করেছিলেন। সাহেবরাও খুব উৎসাহ দেখিয়ে ছিলেন ঘটনাটি সম্পর্কে।

আমার দেখা সেই প্রথম মৃত্যু। আমারই বয়সি একটি ছেলেকে আমি প্রায় চোখের সামনে মরতে দেখলাম। একজন অজানা, অচেনা, রহস্যময় প্রকৃতির বালক হঠাৎ আমাদের বাড়িতে এসে আমাকে মৃত্যুর অভিজ্ঞতা দিয়ে গেল। আমার মা বলতেন, আমাদের বাড়িতে জল পাওনা ছিল সুপতির, তাই মরার জন্য তাকে আমাদের বাড়িতে আসতে হয়েছিল। আমাদের বাড়িতে আসার পর থেকে সুপতির একবারও জ্ঞান ফেরেনি, আমি তার সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। সর্বক্ষণ সে ভুল বকত। তার বাবা-মায়ের সম্পূর্ণ অচেনা লোকজনের নাম ধরে ডেকে তাদের সঙ্গে কথা বলত। একটা ভাঙা মন্দিরের কথাও ঘুরে ফিরে আসত তার কথায়। সুপতি মারা গিয়েছিল সন্ধ্যাবেলা– আমার স্পষ্ট মনে আছে সেই সময়ের কথা। তাকে রাখা হয়েছিল সূর্যদার ঘরে। আমাদের সে-ঘরে ঢুকতে দেওয়া হত না–মৃত্যুর দৃশ্যও যেন শুধু বড়দের ব্যাপার তাই বাবা আমাকে ওই ঘরের কাছাকাছি দেখলেই বলতেন, বাদল এখানে না, যাও, এখান থেকে যাও! আমি তবু যেতাম না, অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করতাম মৃত্যুকে দেখার। সেই সন্ধ্যাবেলা আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম ঘরের বাইরের দিকে, শিয়রের কাছের জানলার শিকের কাছে। মৃত্যুর আগে সে ফিক ফিক করে হাসছিল আর বলছিল, একটা নদী…মস্ত বড় নদী…ভাসতে ভাসতে ভাসতে ভাসতে…

সেই অজানা অচেনা বালকটির জন্য আমি কেঁদেছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *