যা ভয় করেছেলম তা-ই হলো, ই সান্নিপাতিক জ্বর
কি করে শহর থেকে বড় ডাক্তার আনা সোম্ভাব হলো, আমি জানি না। বোধায় জমিই খানিকটা বেচতে হলো। দ্যাওর-রা সব ঘেঁকে ধরলে কত্তাকে।গিন্নি আর ননদও দুটো কড়া কথা শুনিয়ে দিলে তাকে। ছেলেই যদি চলে গেল, সম্পত্তি ধুয়ে কি পানি খাবে কত্তা? ছোট দ্যাওর তো কেঁদেই ফেললে। গলা তুলে একটি কথা কুনোদিন সে বলে না কত্তার কাছে, সিদিন কঁদতে কাঁদতে বললে, দু-দিনের মধ্যে শহর থেকে বড় ডাক্তার যদি তুমি না আনো, আমি বিষ খাব বলে দিচ্ছি, এই সংসারের ভাত আমার হারাম হয়ে যাবে।
যা-ই হোক, পরের দিন বৈকালির টেরেনে ডাক্তার এল। ইস্টেশনে মোষের গাড়ি গেয়েছিল, কত্তা ডাক্তারকে নিয়ে বেলা থাকতে থাকতেই বাড়ি এল। হাত-মুখ ধোবে না, কিছু খাবে না, হ্যাট-কোট পরা ডাক্তার সোজা রুগির ঘরে চলে এল। ঘরের বাইরের উসারা থেকে আমরা সব দেখছি। ডাক্তারের বয়েস খুব বেশি লয়, সোন্দর মুখ, ফরশা চেহারা। অনেক রকম করে রুগি দেখলে, তাপর দেখা হয়ে গেলে এমন চুপ করে খানিকক্ষণ বসে থাকলে যি সি দেখে আমার হাত-পা প্যান্টের ভেতর সেঁদিয়ে যেতে লাগল। হ্যাঁ,ই সান্নিপাতিক জ্বরই বটে–এই কথাটি য্যাকন সি উশ্চারণ করলে, মনে হলো আমার কলজেয় যেন একটো কালসাপ ছুবলে দিলে।তাইলে গাঁয়ের অ্যালাপ্যাথি ডাক্তার যা সন্দ করছিল, তা-ই ঠিক? কি হবে অ্যাকন? ই রোগের কি চিকিচ্ছে নাই? শোনলম, ঘরের ভেতর ডাক্তার বলছে, সান্নিপাতিক জ্বরের কুনো চিকিচ্ছে নাই, ই কথা ঠিক লয়। মেয়াদি জ্বর তো-একুশ দিন, আটাশ দিন, কুনো কুনো সোমায় ছাপ্পান্ন দিনও ই জ্বর থাকে, তাপরে ছেড়ে যায়।
জ্বরের মেয়াদের সময়টায় আমরা দেখি রুগির দেহে যেন শক্তি থাকে–জ্বরটা সহ্য করতে পারে। সবচেয়ে দরকার হলো যত্ন আর সেবা। এই দুটোই হলো আসল ওষুধ। মুশকিল হচ্ছে, নাড়ির অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। হজম করার ক্ষমতা থাকে না, নাড়িতে দগদগে ঘা তো! আবার। শক্ত খাবার কিংবা পুষ্টিকর খাবারও কিছু দেওয়া যায় না।
ওষুধ যা দেবার আমি দিচ্ছি, ক’রকম বড়ি থাকবে, মিকশ্চার থাকবে। রুগিকে আপনারা ডাবের জল দেবেন। জল দিয়ে রান্না করা সাগু-বার্লি দেবেন–কখনো বেদানার রস দেবেন, তবে বেশি নয়, পেট খারাপ হয়ে। যেতে পারে। মাঝে মাঝে ঠান্ডা জলে মাথা ধুইয়ে দেবেন।
এইসব বলে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ঘরের চারিদিকে চেয়ে ডাক্তার বললে, রুগির ঘর একবারে আলাদা হবে, যখন-তখন কেউ ঘরে ঢুকবে না। ঘরে বেশি আলো থাকবে না, আবার হাওয়া চলাচল যেন থাকে, দেখবেন–বলতে বলতে ডাক্তার ঘরের বাইরে এসে সবাইকে সাথে নিয়ে চলে গেল। ত্যাকন গিন্নি আমাকে ডেকে বললে, মানুষের সোংসারে ঝড়-বিষ্টি আপদ-বেপদ আসবেই। চিরকাল কারু সুখেও যায় না, দুখেও যায় না। শোনো মেজ বউ, ছেলের দায়িত্ব তোমার আর মহুদার। ঘর-সোংসারের কাজ যা পারবে করবে, না পারলে করবে না।
এইসব দায়িত্ব নিয়ে লেলম আমি আর আমার বেধবা ননদ। উত্তর-দুয়োরি ঘরটোই বাড়ির সবচেয়ে ভালো ঘর। কারুকাজ করা মেহেগোনি-কাঠের একটি দরজা আর ঐ উত্তরেই একটি বড় জানে। ঘরের ভেতরটো একটু আঁদার-আঁদার পুবে জানেলা নাই। দক্ষিণে টানা দেয়াল, কুনো জানেলা নাই, পশ্চিমেও নাই। তবু এই ঘরটিই সবচাইতে ভালো। সেইখানে লতুন করে বিছেনা পাতলম, সব জোগাড়যন্তর। করলম। ফল-পাকুড় ছেলে যা যা খেতে পারে সব আনা হলো। বেদানা-নাশপাতি, নেবু–এইসব ফল এল, ডাবের পাহাড় জমল। সারা বাড়িতে সাড়া-শব্দ নাই, কেউ কথাবার্তা বলতে চায় না। দু-একটা কথা বলে ফিসফিস করে, ছেলেমেয়েরা পয্যন্ত কঁদতে ভয় পেচে। বাড়িতে অ্যাকন ছেলেমেয়ে তো খুব কম লয়, আমার দুটি–পরের খোঁকা আর মেয়েটি, সেজ বউয়ের দুটি খোঁকা আর ভাগ্নেদুটি আছেই। কখনো কখনো কোলের খুঁকি কিংবা সেজ-র ছোট খোঁকাটি চিচকার করে কেঁদে উঠলে চমকে উঠি। দোপরবেলায় সব শুনশান, বাড়ির লোকজন সব ঘরে, কারু মুখে রা নাই। কানে আসত কা কা কাকের ডাক মনে হতো যেন ই জগতের লয়, অন্য কুনো দুনিয়া থেকে কাক ডেকে যেচে। কুরুর কুরুর করে ঘুঘু ডাকত, তাও মনে হতো অন্য কুনো জগৎ থেকে ডাকছে। গা ত্যাকন শিউরে উঠত, মনে হতো এখুনি একবার খোঁকাকে দেখে আসি। মা নাই, এই ফাঁকে কে না জানি কি করছে! মা হাজির থাকলে আজরাইলও কিছু করতে পারবে না ছেলের। ছুটে চলে য্যাতম রুগির ঘরে। আঁদার ঘরে হঠাৎ ঠাওর হতো না খোঁকা কুত্থানে আছে। তাপর আঁদার চোখে সয়ে এলে দেখতে প্যাতম ঘরের এক কোণে বিছেনায় শুয়ে আছে খোঁকা। বিছেনায় যেন মিশে গেয়েছে ছেলে, মুখ শুকনো, শুদু চোখদুটি টকটক করছে। কিছু খাবে বাপ? না। মাথা টিপে দেব? না। যা শুদুই তাতেইনা। কাউকে তো কুনোদিন বেস্ত করতে শেখে নাই। নিজের লেগে কিছুই যি চায় না সে। তবু মাথায় হাত দি। জ্বর অল্পই, কিন্তুক এট্টু না এট্টু লেগেই আছে।
এমনি করে একটি একটি দিন পার হতে লাগল। অ্যাকটো করে দিন যেচে, না অ্যাকটো করে যুগ কেটে যেচে। সকালে সুয্যি উঠে দিন শুরু হলে মনে হচে, এই দিন আর শ্যাষ হবে না, সুয্যি আর ডুববে না। আবার সাঁঝবেলায় আঁদার নেমে রাত অরম্ব হলে মনে হচে, ই রাত বোধায় আর কাটবে না।
সকাল দোপর রেতে রাঁধা আছে, খাওয়া আছে। বাড়ির লোক আসচে-যেচে, খেচে–সবই করছে। জন-মুনিষরাও কাজকম্ম করতে যেচে। তবু মনে হচে সব চুপ, সব থম মেরে আছে। বাড়িতে হাসি নাই, গান নাই, কথা নাই। বাপ-চাচাদের দেখে মনে হচে তারা যি জানে ধরে বেঁচে আছে, ই বড় শরমের কথা। মনে হচে কতো অপরাদই তারা করছে, লুকিয়ে লুকিয়ে চুরি করে অ্যাকনো বেঁচে আছে! বংশের বড় ছেলে, মোলো বছর চলছে, মানুষের মতুন মানুষ হয়ে গেয়েছে, সি ছেলে মরণরোগে পড়ে আছে, তাইলে তারা ক্যানে বেঁচে থাকবে? খানিক বাদে বাদে একজন করে খোঁকার বিছেনার কাচে আসছে, চুপ করে খানিক দাঁড়িয়ে থাকছে, তাপর কথাটি না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যেচে। অ্যাকন দেখছি, ই-বাড়ি উ-বাড়ি থেকেও লোক আসচে খোঁকাকে দেখতে। হিঁদুপাড়া থেকেও লোক আসছে। শুদু যি কত্তাকে তারা চেনে, মান্যিগন্যি করে, সেই লেগেই যি আসচে তা তো নয়, আমার উ ছেলে সারা গাঁয়ের পিয়, সেই লেগেই তারা সব না এসে পারছে না। একদিন কত্তামা-ও পালকি করে এসে দেখে গেল। য্যাতো লোক আসে, ত্যাতো আমার কলজে খামচে খামচে ধরে। তাইলে কি খোঁকা আমার ই দুনিয়ায় থাকবে না?ই তাইলে কি মিত্যুরোগ-ই কি হলো গো! আবার এক-এক সোমায় ভাবি, আমি মা, আমি বাঘিনি, কই, কে নিবে–নিয়ে যাক তো আমার ছেলে আমার ছামনে থেকে!
চিকিচ্ছের কামাই নাই। গাঁয়ের অ্যালাপ্যাথি ডাক্তার পেত্যেক দিনই আসে। তার কাছ থেকে শুনে কত্তা একদিন-দুদিন বাদে বাদে শহরে যায়, বড় ডাক্তারকে জানায় আর ওষুধ-পথ্য নিয়ে বাড়ি আসে। খোঁকা আর ওষুধ খেতে চায় না, পথ্যও কিছু খেতে চায় না। পথ্যই বা কি? ডাবের পানি, সাবু, বার্লি ইসব কি কেউ দিনের পর দিন খেতে পারে! দিনদিন ছেলে শুকিয়ে যেতে লাগল, ঠিক যেন বাঁশপাতা, বিছেনার সাথে মিশে গেয়েছে। অ্যাকন আর উঠে বসতে পারে না, দাঁড়াতে পারে না। পায়খানা-পেশাব খুব কম হয়ে গেল, কিছুই খাওয়া নাই তো, হবে কোথা থেকে? বেশিরভাগ সোমায় চোখ বন্ধ করে রাখে, মনে হয় যেন চোখের পাতা খোলারও খ্যামতা নাই। সারা দিন-রাত ছেলের মাথার কাছে বসে থাকি আর আকাশ-পাতাল ভাবি।তবে কি তাকাবে না-তবে কি থাকবে না? যেদি নাই-ই থাকে, তাইলে আমি বাঁচব কি করে? য্যাতেই বাঁচতে চাই, কি করে বাঁচব? নিজের জান তো তুশ্রু, তামাম দুনিয়া দিলে যেদি খোঁকা বাঁচে, তাইলে তা-ই হোক। আমি বিরলে বসে বাছার মুখ নিরখি—
একুশ দিনের দিন আমার হঠাৎ মনে হলো কত্ত যেন কেমন হয়ে যেচে। শহরে যাবার কথা ছিল, সিদিন সে আর শহরে গেল না, কারও সাওস হলো না তার কাছে যেয়ে একটি কতা বলে। খানিকটা বেলা হলে সে নিজে যেয়ে হেমাপ্যাথি ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে এল। হেঁটো-ধুতি পরা, চাদর-গায়ে সেই বন্ধু ডাক্তারটি রুগির ঘরে এসে দাঁড়াইলে।
তুমি বলেছিলে এ কোনো রোগই নয়, দুটো পুরিয়া দিলেই জ্বর পালাবে। আমি সব ওষুধ বন্ধ করে দিচ্ছি, দাও তোমার পুরিয়া। আমি দু-দিন দেখব, জ্বর যদি না ছাড়ে, খুন করব তোমাকে।
কত্তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি ভয় পেয়ে গ্যালমাই কেমন মুখের চেহারা! হেমাপ্যাথি ডাক্তারও বোধায় ভয় পেয়ে গেল। সে বললে, এসব কি কথা বলচ–রোগব্যাধি নিয়ে এমন কথা কি বলতে আছে। যা-ই হোক, অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে, তবু ওষুধ আমি দিচ্ছি। অন্য কোনো ওষুধ বন্ধ করতে হবে না–একসাথেই সব চলুক।
সেই কথামতো সিদিন থেকে অ্যালাপ্যাথির সাথে হেমাপ্যাথিও চলতে লাগল।
এত কিছুর মদ্যে এক মাহা আশ্চর্য হচে আমাদের গিন্নি। সারা বাড়ির এই-আবস্তায় কারুরি মাথা ঠিক নাই–কেউ অস্থির, কেউ পাথর, হাঁ-চা নাই, গোটা গাঁ যেন পেমাদ গুনছে–ইয়ারই মদ্যে আমাদের গিন্নি যেমনকার তেমনি, সেই পোষ্কার মোটা ধুতিটি পরনে, কপাল পয্যন্ত ঘোমটা। খালি পা, তবু দু-পায়ে এক কণা ধুলো নাই। ঘড়ির কাঁটার মতুন নিজের কাজগুলিন করে যেচে। সিদিন এই পেথম দেখলম, কত্তাকে কাছে ডেকে তার মাথায় হাত দিয়ে আস্তে আস্তে বললে, খোদার ওপর ভরসা রাখো বাবা!
কত্তা কুনো কথা বললে না, শুদু মায়ের মুখের দিকে কেমন করে একবার তাকাইলে, তাপর মাথা হেঁট করেই সিখান থেকে চলে গেল। খোদার ওপর ভরসা যিদিক দিয়েই রাখি না ক্যানে, অ্যাকন আমি জানি, আশা নাই, আর আশা নাই। আমার বুকের ভেতরে তাকিয়ে দেখি, সিখানে কুনো আশা নাই। খোঁকা কি নিজেও সি কথা জানতে পেরেছে? সব খাওয়া ছেড়েছে সে। মাঝে-সাঝে এট্টু পানি চেয়ে খায়, মুখে চাইতে পারে না, চোখের চাউনিতে চায়। ডাবের পানি দিতে গেলে মাথা নাড়ে, শুদু পানিই খাবে। তার মুখের কথা শুনতে গেলে কান পাততে হয় মুখের কাছে। বুকের দু-পাশের পাঁজর একটি একটি করে গোনা যায়, মুখখানি এইটুকুনি, শুদু ডাগর দুটি চোখের চাউনি আগের মতুনই আছে বরং তার রোশনাই যেন আরও বেড়েছে। না, আশা আর করব না। যেদি তাকে যেতেই হয়, তাইলে আর এত কষ্ট ক্যানে তার, তাড়াতাড়িই নিয়ে যাক তাকে আল্লা–আমি আর সইতে পারছি না, পারছি না।
একদিন এই দুনিয়াতেই দেখলম যে বেহেস্তের ছবি– সি কুনোদিন ভুলব না।খোঁকার অসুখ সারা সংসারকে অচল করে দিয়েছে। বাড়িতে যি আরও ছেলেমেয়ে আছে সব ভুলে গেয়েছি আমরা। যারা এট্টু বড় হয়েছে, তারা ভয়ে কথা বলে না, রাগ করে না, বায়না করে না। কিন্তুক কি করে ভুলে গিয়েছেলম যি বাড়িতে আমার একটি ছ-মাসের মেয়ে আছে? সি মেয়ে কার কাছে থাকে, কি খায়,কখন ঘুমোয় সি যেন দেখেও দেখতে পাই না আমি। কখনো এসে জড়িয়ে ধরে। বুকে মুখ রাখে। আমার খেয়াল-ও থাকে না। সিদিন বৈকালবেলায় রুগির ঘরে ঢুকতে যেয়ে দেখি, আমার খুঁকি কখন হামাগুঁড়ি দিয়ে ঘরে ঢুকেচে। অ্যাকন থপ থপ করে একটি-দুটি পা ফেলে হাঁটতে শিখেছে, আবার তাড়াতাড়ি করতে গেলে সাথে সাথে বসে পড়ে হামাগুঁড়ি দিয়ে এগিয়ে যাওয়াও জানে, এমনি চালাক। তা ঘরে ঢুকে দেখি, খুঁকি বড় খোঁকার মাথার কাছে খানিকটা উবুড় হয়ে দাঁড়িয়ে দু-হাত দিয়ে তার মুখে-চোখে থাপড়াইছে। আর হি হি করে হাসছে। খানিকক্ষণ থাপড় মারছে, আবার চুল ধরে টানছে আর হেসেই যেচে। আমি ভাবছি, না জানি খোঁকার চোখে খুঁকির আঙুল ঢুকে যাবে না কি, না কি নোখের আঁচড় লাগবে–কিন্তুক আমি এগুইতে পারলম না। সিখানে দাঁড়িয়েই দেখতে লাগলম–খোঁকা হাসছে, খোঁকা কথা বলছে। খোঁকার ঐ হাসি কতদিন দেখি নাই, যেন আর জন্মে দেখেছেলম খোঁকা হাসছে আর বলছে, বুবু আর মেরো না, আর মেরো না, উঃ খুব লাগছে–য্যাতো সে এইরকম বলছে, খুঁকি ততোই খুশি হয়ে হাসছে আর ভাইকে থাপড়াইছে। খোঁকা আমাকে দেখে নাই, সে বলে যেছে, বুবু, দাঁড়াও, আমার অসুখ করেছে তো, ভালো হই, তোমাকে কতো জায়গায় নিয়ে যাব, তোমাকে কত কি এনে দেব, কতো খেলনা, কতো খাবার দেব
আমি একঠাঁই দাঁড়িয়ে দেখছি, এই ঘরে সুয্যির আলো আসে না। অ্যাকন দেখছি সারা ঘরে আলো। বছরের এই সোমায়টোই উত্তরের জানেলা দিয়ে সামান্য এট্টু রোদ ঘরের মেঝেয় এসে পড়ে, তাতেই যেন সারা ঘর আলো। আমি ত্যাকন এগিয়ে যেয়ে খুঁকিকে কোলে তুলে লেলম। আমাকে দেখে লাজুক হাসি হেসে খোঁকা বললে,দ্যাখো মা, বুড়ি আমাকে কেমন করে মারছে, উঠতেবলছে। চোখ ভরা পানি নিয়ে আমি তাকে একটি কথাও বলতে পারলম না।
দু-দিন কি তিন দিন পর,একুশ দিন পার হয়েছে ত্যাকন, তবে আটাশ দিন হয় নাই, সকাল থেকেই রুগির আবস্তা খুব খারাপ। সিদিন তাকে কুনো খাবার খাওয়ানো গেল না, ওষুধও খাওয়ানো গেল না। ডাকলে। সাড়া নাই, চোখও খুলছে না। সিদিন বাড়ির সব কাজকম্ম বন্ধ রইল। রাঁধা-বাড়ার কাজেও কেউ গেল না। দেখলম গিন্নিও এসে ছেলের শিয়রের কাছে ননদের পাশে বসল। আমি খোঁকার বালিশটোকে সরিয়ে তার মাথা কোলে নিয়ে বসলম।
আর আমি উঠব না। আর বুঝতে বাকি নাই সে আর থাকবে না। গত দু-দিন থেকেই সিকথা বুঝতে পারছি। চোখে আর পানি নাই যি কঁদি, চোখ যেন গলে গেয়েছে, কিছুই ভালো দেখতে পেচি না। না, আর পানি নাই, না, আর কাঁদব না। অ্যাকন যেদি কাঁদি, খোঁকা চলে গেলে কি করব? ত্যাকন যি চোখ ফেটে রক্ত ঝরবে গো! তাই লেগে দু-ফোটা পানি যেদি থাকে তো থাকুক।
বুঝতে পারছি আজ উ যাবে। সারা গাঁ-ও কি তাই জানে? তা নাইলে এত লোক আসছে কোথা থেকে? ঘর ভরে গেল, এগনে ভরে গেল। কিন্তুক সবাইকে দেখছি, কত্তাকে তো কোথাও দেখছি না। তবে কি সে বাড়িতেই নাই? কত্তামার দুই ছেলেকেও দেখছি, সে তাইলে কোথা গেল?
বেলা বাড়ছে, রোদ চড়ছে, ঘরের ভেতর গুমোট গরম, কে ঘরের মানুষদের সরতে বলে? খোঁকার যি অ্যাকন এট্টু বাতাস দরকার। দ্যাওরদের কেউ বোধায় বুঝতে পেরেছে, সে সবাইকে সরিয়ে দিলেকিন্তুক একজন সরছে তো আরও তিনজনা ঘরে ঢুকছে।
দোপরটো যি কেমন করে পেরুইলো তা বলতে পারব না। সিদিন দোপটোই আজরাইল হয়ে এয়েছিল। বুকের ওপর সেই যি বসল আর সরলে না। গোটা জেবন পেরিয়ে যেচে, তবু দোপরটা যেচে না। তবু এক সোমায় সুয্যি পচ্চিমে নামতে লাগল, রোদের ত্যাজ এট্টু মরে এল, আর মনে হতে লাগল দোপরটাও বুক থেকে নেমে যেচে। ত্যাকন আমার মনে শান্তি। খোঁকার তাইলে যাবার সোমায় আসছে। অ্যাকন আর অস্থির হতে নাই। সে শান্তিতে যাক। শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলম, অ্যামন মায়ায় ছেলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে যেন মওত-ও সেই চাউনি দেখতে পেচে। যে নিশ্বেস নিতে এত কষ্ট হচিল খোঁকার, সেই নিশ্বেসও যেন সহজ হয়ে এল। খুব আস্তে আস্তে ফিসফিস করে গিন্নি আমাকে বলছে, মেজ বউ, ছেলের মুখে একটু পানি দাও। কি যি হলো আমার, ক্যানে গো, যাদু কি চলে যেচে? বলে এমন চেঁচিয়ে ওঠলম যি ঘরসুদ্দ লোক চমকে উঠল। গিন্নি আমাকে বললে, চুপ চুপ, ও কি করছ–খোঁকার মুখে পানি দাও। এখন নয়, কাদার অনেক সোমায় পাবে।
আমি ত্যাকন বড় কাঁসার চামচে পানি ঢাললম, খোঁকার মুখ একটু হাঁ করিয়ে পানি দেলম। হ্যাঁ, সবটুকু পানি খেলে সে, আর এক চামচ ঢেলে ফের দিতে গেলম, ইবার কতক খেলে আর কতক কষ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল।
একদম শেষ সোমায়টো আমার কিছুতেই মনে পড়ছে না। কুনোদিন মনে থাকল না। খুব জোরে হিঙুরে উঠে একবার কি নিসে নিয়েছিল? কেউ যেন শুনতে না পায়, শুদু আমি শুনি এমনি করে কি বলেছিল, মা যাই? কিছুতেই মনে পড়ে না। আমার কোলে ছিল মাথা, শুদু দেখলম, কাত হয়ে কোল থেকে গড়িয়ে পড়ল। ঐ শেষ। খোঁকা চলে গেল! বেলা ত্যাখনো খানিকটা ছিল। সারা গাঁয়ের লোক ভেঙে পড়ল বাড়িতে।