মোবারক সাহেবের কুঁড়েঘর
জয়দেবপুর থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে মোবারক সাহেবের একটা কুঁড়েঘর আছে। লোকে বাসাবাড়ি তৈরি করে; তিনি কুঁড়েঘর বানিয়েছেন। আক্ষরিক অর্থেই কুঁড়েঘর। তিনি একর জমি নিয়ে ছোট্ট মাটির ঘর। খড়ের ছাদ।
আধুনিক কুঁড়েঘরের এক ফ্যাশন ইদানীং চালু হয়েছে। মাটির দেয়াল, খড়ের ছাদের ভেতর থাকে কার্পেট। এয়ারকুলার বিজবিজ করে চলে। বাথরুম হয় মার্বেল পাথরের। কুঁড়ে ঘর নিয়ে এক ধরনের রসিকতা।
মোবারক সাহেব তা করেন নি। তার ঘরে বড় একটা চৌকি পাতা। চৌকির উপর হোগলার পাটি–মাথার নিচে দেয়ার জন্যে শক্ত বালিশ। এ বাড়িতে কোনো টেলিফোন নেই। তিনি ইলেকট্রসিটিও আনেন নি। সন্ধ্যার পর হারিকেন জ্বলে।
দর্শনীয় কোনো বাগানও করা হয় নি। কেনার সময় গাছগাছড়া যা ছিল এখনো তাই আছে। তিনি শুধু তাঁর জমিটা কংক্রিটের পিলার এবং শক্ত কাটা তারের বেড়া দিয়ে আলাদা করেছেন। বাড়ির গেটে পাহারাদার আছে।
বছরে দু’একবার শুধু রাত কাটাতে আসেন। রাত নটা-দশটার দিকে এসে ভোরবেলা চলে যান। একাই আসেন। পাহারাদার দু’জন গেটে তালা দিয়ে চলে যায়।
আজ একা আসেন নি। মিতুকে সঙ্গে এনেছেন। পাজেরো জিপ তাদের নামিয়ে চলে গেছে। মোবারক সাহেব গেটের দারোয়ান দু’জনকেও চলে যেতে বলেছেন। তারা এখনো যায় নি। মোবারক সাহেবের মালপত্র ঘরে ঢুকিয়ে গেটে তালা দিয়ে তারা যাবে। রাতটা থাকবে জয়দেবপুরে। ভোরবেলা এসে গেটের তালা খুলবে।
মিতু হকচাকিয়ে গেছে। তার চারদিকে ঘোর অন্ধকার। জোনাকি পোকা জ্বলছে-নিভছে। আলো বলতে জোনাকি পোকার আলো।
মোবারক সাহেব হালকা গলায় বললেন, ভয় লাগছে?
মিতু বলল, না। ভয় লাগার কিছু আছে কি?
সাপ আছে। বর্ষাকাল তো–খুব সাপের উপদ্ৰব।
মোবারক সাহেবের হাতে ছোট একটা পেনসিল টর্চ। টর্চ ছোট হলেও আলো তীব্ৰ। তিনি আলো ফেললেন। ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে রাস্তা। জায়গায় জায়গায় পানি জমে আছে। সেখানে ইট বিছানো। মোবারক সাহেব টর্চ নিভিয়ে ফেললেন–ঘন অন্ধকারে চারদিক ঢেকে গেল।
দারোয়ান দু’জন জিসিনপত্র রেখে চলে এসেছে। কুঁড়েঘরে আলো জ্বেলে এসেছে। জানালা দিয়ে ক্ষীণ আলোর রেশ দেখা যাচ্ছে।
মোবারক সাহেব টৰ্চটা মিতুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, তুমি চলে যাও। আমি ওদের বিদেয় করে আসছি। মোবারক সাহেব ভেবেছিলেন মিতু বলবে–আমার একা যেতে ভয় লাগছে। আমি অপেক্ষা করি। দু’জন একসঙ্গে যাব। মিতু তেমন কিছু বলল না। টর্চ হাতে এগিয়ে গেল।
তিনি দারোয়ানদের বিদেয় করলেন। গোটে তালা দিয়ে চাবি নিজের কাছে নিয়ে নিলেন। পকেটে হাত দিয়ে দেখলেন সিগারেট আছে কিনা। সিগারেট আছে। কয়েকদিন হলো সিগারেট বেশি খাওয়া হচ্ছে। তিনি একটা সিগারেট ধরালেন। আকাশ মেঘলা বলে তারার আলো নেই। চাঁদ উঠবে রাত তিনটার দিকে। কাজেই রাত তিনটা পর্যন্ত এমন ঘন অন্ধকার থাকবে। ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে না। এই অঞ্চলের ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক বিখ্যাত। এরা ডাকা বন্ধ করেছে এর অর্থ হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি শুরু হবে। বৃষ্টি শুরুর আগে আগে ঝিঁঝিঁ পোকা ডাক বন্ধ করে দেয়। জোনাকি পোকারাও তাদের আলো নিভিয়ে ফেলে। জোনাকি পোকারা অবশ্যি তাদের আলো এখনো নিভায় নি। কাজেই বৃষ্টি শুরু হতে একটু দেরি আছে। এইসব তথ্য তিনি তাঁর কুঁড়েঘরে রাত্রি যাপন করে শিখেছেন।
তাঁর শেখার ক্ষমতা ভালো। তিনি দ্রুত শিখতে পারেন। তার পর্যবেক্ষণ শক্তিও ভালো। লেখালেখির ক্ষমতা থাকলে তিনি ভালো লেখক হতে পারতেন।
সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। তবু তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। মেয়েটি ঘরের ভেতর কী করছে কে জানে। তার কি উচিত না উদ্বিগ্ন হয়ে একবার বারান্দায় এসে দাঁড়ানো? মেয়েটি তাঁকে পছন্দ করছে না। কিন্তু একদিন করবে। অবশ্যই করবে। মেয়েটির শরীর তিনি কিনে নিয়েছেন। আত্মা শরীরেই বাস করে। একদিন সেই আত্মাও তিনি কিনতে পারবেন। বেঁচে থাকার জন্যে একটি শুদ্ধ ও সুন্দর আত্মার তাঁর খুব প্রয়োজন।
তিনি আকাশের দিকে তাকালেন–তারা দেখা যাচ্ছে না। বৃষ্টি নামবে। আজ রাতে কোনো এক সময় ঘনবর্ষণ হবে। ঠিক কখন হবে তা বলা যাচ্ছে না। মানুষকে সেই ক্ষমতা দেয়া হয় নি। সেই ক্ষমতা দেয়া হয়েছে মানুষের চেয়ে অনেক নিম্নশ্রেণীর পশুপাখিকে, কীটপতঙ্গকে। গাছদের কি দেয়া হয়েছে? অবশ্যই দেয়া হয়েছে। তার ধারণা, প্রতিটি গাছ জানে কখন বৃষ্টি হবে। তাঁর এই বাগানবাড়ির প্রতিটি গাছ অপেক্ষা করছে…।
সরসর শব্দ করে তাঁর ডান দিকের ঝোপে কী যেন চলে গেল। সাপ হতে পারে। বৃষ্টির আগে আগে তারা জায়গা বদল করে নিচ্ছে। বৃষ্টির পানিতে যখন সাপের গর্ত ভর্তি হয়ে যায় তখন তারা কী করে? তারা নিশ্চয়ই বৃষ্টির পানিতে ডুবে বসে থাকে না?
মোবারক সাহেব ঘরের দিকে এগোলেন। টর্চলাইটটা হাতে থাকলে হতো। অন্ধকারে কোথায় পা ফেলতে কোথায় ফেলছেন কে জানে। এক জায়গায় পানি জমে ছিল। তিনি পানিতে পা ফেলে পায়ের পাতা ভিজিয়ে ফেললেন।
কুঁড়েঘরের বারান্দায় বড়ো বালতি ভর্তি পানি। পানির উপর মগ ভাসছে। একপাশে সাবানদানিতে সাবান। তিনি উঠানে উঠে সহজ স্বরে ডাকলেন, মিতু হারিকেন নিয়ে এস তো।
মিতু হারিকেন হাতে পাশে এসে দাঁড়াল।
মগে করে আমার পায়ে পানি ঢাল। কাঁদায় পা দিয়ে ফেলেছি।
মিতু পানি ঢালছে। মোবারক সাহেব বললেন, আমার বাগানবাড়ি পছন্দ হয়েছে?
হয়েছে।
মনে হচ্ছে না জায়গাটা পৃথিবীর বাইরে?
মিতু জবাব দিল না। মোবারক সাহেব বললেন, আমার মাঝে মাঝে একা থাকতে ইচ্ছা করে, তখন এখানে আসি।
আজ তো একা আসেন নি।
না, আজ অবশ্যি একা আসি নি। এখানে এক রাত্রি যাপন করতে কেমন লাগে তা আমি জানি। দুজনে কেমন লাগে তা জানি না। এই জন্যেই তোমাকে নিয়ে এসেছি। দু’জনে মিলে অন্ধকার দেখব, ইন্টারেস্টিং সব গল্প করব। আমি অসংখ্য অদ্ভুত গল্প জানি। সবচে’ বেশি জানি ভূতের গল্প। ভূতের গল্প তোমার কেমন লাগে?
ভালো লাগে।
মোবারক সাহেবের হাত-মুখ ধোয়া শেষ হয়েছে। তিনি কিছু বলার আগেই মিতু ঘরের ভেতর চলে গেল। তোয়ালে এনে হাতে দিল। তিনি তোয়ালে দিয়ে হাত-পা মুছলেন।
বারান্দায় কিছুক্ষণ বসা যাক কী বল মিতু।
আপনি যা বলবেন তাই হবে। কোথায় বসব? চেয়ার তো নেই।
ঘরের ভেতর মাদুর আছে। তুমি খুঁজে পাবে না, আমি নিয়ে আসছি।
মোবারক সাহেব নিজেই মাদুর এনে বিছিয়ে দিলেন। শান্ত স্বরে বললেন, পুরোপুরি অন্ধকার হলে ভালো লাগত। কিন্তু আলো কিছু রাখতেই হবে–নয়তো সাপ উঠে আসবে। একবার কী হয়েছে শোন–একা একা বারান্দায় বসে আছি। চারদিক অন্ধকার, ঘরের বাতিও নেভানো। পা মেলে বসে অন্ধকার দেখছি। হঠাৎ ভারি কী যেন পায়ের উপর উঠে গেল। পায়ে যে সাপ উঠে গেছে সেটা বুঝতে বুঝতে সাপ নেমে গেল। কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার, কিন্তু মনে হয় অনন্তকাল। তুমি বোস, দাঁড়িয়ে আছ কেন?
মিতু বসল। মোবারক সাহেব বললেন, আরাম করে বোস।
আমি আরাম করেই বসেছি।
তুমি গান জান?
জ্বি না।
ভালো টিচার রেখে গান শেখার ব্যবস্থা করে দেব। তোমার গলা ভালো। গান ভালোই গাইবে। তাছাড়া নাচ-গান এইসব ভালোমতো জানা তোমার নিজের স্বার্থেই দরকার। ছবির জগতের প্রধান নায়িকা নাচ-গান না জানলে চলে? আমি যে একটা ছবি বানাচ্ছি সেটা কি তুমি জান?
জ্বি শুনেছি।
সেই ছবির তুমিই প্রধান নায়িকা এটা শুনেছ?
আঁচ করতে পারছি।
তোমার ভালো লাগছে না?
চারদিকের বিপুল গাঢ় অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে মিতু বলল, ভালো লাগছে। খুব ভালো লাগছে।,