১৪. মানবদেহের ডিজাইন সমস্যা
যারা আড্ডা দিতে পছন্দ করেন তারা নিশ্চয়ই একটা জিনিস লক্ষ্য করেছেন–মানুষ সমালোচনা করতে ভারি পছন্দ করে। পৃথিবীর অনেক মানুষই হচ্ছেন কঠিন সমালোচক, তারা ভালো কিছুর প্রশংসা করা থেকে তার ভেতর থেকে খুঁত বের করে তার নিন্দা করার মাঝে অনেক বেশি আনন্দ খুঁজে পান। যারা খবরের কাগজে লেখালেখি করেন তাদের বেশিরভাগই ছিদ্রান্বেষী এবং নিন্দুক। যে কোনো বিষয়ের দোষ খুঁজে বের করে তারা সেটা নিয়ে হা-হুতাশ করেন। মানুষকে সুযোগ দেয়া হলে তারা কী পরিমাণ সমালোচনা করতে পারে তার একটা উদাহরণ দেয়া যাক।
এই সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে চমকপ্রদ জিনিসটি হচ্ছে মানুষ, আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয় মানবদেহ। মানুষকে যদি এই মানবদেহকে নিয়ে সমালোচনা করতে দেয়া হয় তারা কী থতমত খেয়ে যাবে নাকী সমালোচনা করতে পারবে?
অবশ্যই পারবে, বয়োসন্ধিতে পৌঁছেছে এ রকম একটি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেই সে অবধারিতভাবে মেয়েদের শরীরের ডিজাইনটি নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করবে। সন্তান জন্ম দেয়ার প্রস্তুতি হিসেবে তার দেহ যেভাবে প্রতি মাসে একবার প্রস্তুতি নেয় এবং গর্ভধারণ না হলে প্রস্তুতি পর্বটি যেভাবে পরিত্যাগ করে তার প্রক্রিয়াটি পছন্দ করার কোনো কারণ নেই। একটা বয়সে পৌঁছানোর পর সব মেয়েই পুরুষ এবং নারীর দেহের ডিজাইনের বৈষম্য নিয়ে অভিযোগ করে থাকে।
মেয়েদের অভিযোগ করার আরো বিষয় আছে। শুধুমাত্র মেয়েরা সন্তান ধারণ করতে পারে এবং তাই শুধুমাত্র মেয়েদেরই জন্ম দেয়ার প্রক্রিয়াটির ভেতর দিয়ে যেতে হয়। প্রক্রিয়াটি কষ্টকর এবং আমরা “গর্ভ যন্ত্রণা” বলে সে জন্যে একটি শব্দ পর্যন্ত আবিষ্কার করে রেখেছি।
সন্তান জন্ম দেয়ার প্রক্রিয়াটি খুব যন্ত্রণাদায়ক তার কারণ নবজাতক শিশুর মাথা তুলনামূলকভাবে বড়। মায়ের জন্ম দেয়ার জন্যে তার শরীরে যে পথটুকু রয়েছে, একটা শিশুর মাথা কেন তার থেকে বড় হতে গেল? কেন শিশুর মাথা আরেকটু ছোট হলো না, তাহলেই তো সন্তান জন্ম দেয়ার যন্ত্রণাটুকু মায়েদের সহ্য করার প্রয়োজন হতো না? এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের একটা থিওরি রয়েছে, তারা মনে করেন এক সময়ে শিশুদের মাথা তুলনামূলকভাবে ছোটই ছিল এবং জন্ম দেবার প্রক্রিয়াটি এত যন্ত্রণাদায়ক ছিল না। কিন্তু মানুষ বলতে গেলে হঠাৎ করেই বুদ্ধিমান হয়ে ওঠে, তাই তাদের মস্তিষ্ক হঠাৎ করে বড় হয়ে ওঠে, বিবর্তনের মাধ্যমে মায়ের শরীর সেটার সাথে তাল মিলিয়ে জন্ম দেবার পথটুকু এখনো বড় করে উঠতে পারে নি।
মানবদেহের সমালোচকদের সমালোচনা করার জন্যে সবচেয়ে প্রিয় বস্তু হচ্ছে চোখ। মানুষের চোখের মতো সংবেদনশীল এবং সূক্ষ্ম কিছু কেউ কখনো তৈরি করতে পারবে না, চোখের মতো সুন্দর এবং বুদ্ধিদীপ্ত কিছুর উদাহরণও কেউ দিতে পারবে না, তাহলে মানুষ চোখের সমালোচনা করে কেমন করে? তাদের যুক্তি নেই তা নয়–চোখের রেটিনার দিকে তাকালেই মানুষ একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে যাবে। চোখের লেন্সের ভেতর দিয়ে (14.1 নং ছবি) আলো চোখের পিছনের রেটিনাতে এসে পড়ে। রেটিনার থেকে আলোর সংকেতগুলো নার্ভের ভেতর দিয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছায়। বিজ্ঞানী না হয়েও সবাই অনুমান করতে পারবে যে রেটিনার মাঝে নিশ্চয়ই আলো সংবেদন কোষ রয়েছে। এই কোষ থেকে আলোর সংকেতগুলো মস্তিষ্কে নিয়ে যায় নার্ভ। এখন কথা হচ্ছে, আলো সংবেদন কোষগুলোর সাথে নার্ভের সংযোগটা কীভাবে হওয়া উচিত? আলো সংবেদন কোষগুলো থাকবে উপরে, তার নিচে থাকবে নার্ভ। নার্ভ যদি উপরে থাকে তাহলে সমস্যা দ্বিমুখী; প্রথমত, কোষগুলোর উপর সেগুলো যদি ছড়িয়ে থাকে, তার ভেতর দিয়ে রক্তের প্রবাহ হয় তাহলে সেটা আলোর উপর প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে, আলোকে এই নার্ভগুলো ভেদ করে আলো সংবেদন কোষে পৌঁছাতে হবে। দ্বিতীয়ত, নার্ভগুলোকে একত্র করে সেটাকে রেটিনা ভেদ করে পিছনে পৌঁছাতে হবে। কাজেই কারো যদি চোখকে ভালো করে ডিজাইন করতে হয় তাহলে অবশ্য অবশ্যই তার আলো সংবেদন কোষগুলো রাখতে হবে উপরে, নার্ভগুলো রাখতে হবে নিচে। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, মানুষের চোখে রেটিনার নিচে নয় রেটিনার উপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নার্ভ। সেই নার্ভগুলো একত্র হয়ে একটা বিন্দুতে রেটিনাকে ভেদ করে পিছনে যায়। যে বিন্দুতে সেটা রেটিনাকে ভেদ করে তার নাম অন্ধবিন্দু, কারণ সেখানে আলো পড়লেও কিছু দেখা যায় না। চোখে যে সত্যিই অন্ধ বিন্দু বলে একটা অংশ আছে সেটা খুব সহজ পরীক্ষা করে দেখা যায় (14.2 নং ছবি) এই অংশে আলো পড়লেও সেটি দেখা যায় না ।
মানবদেহের সমালোচকরা তাই চোখের সমালোচনা করেন খুব কড়াভাবে, বিশেষ করে মানুষের চোখের যে ডিজাইন সমস্যা আছে সেই সমস্যাটি কিন্তু কিছু কিছু প্রাণীর চোখে সমাধান করা হয়েছে। যেমন অক্টোপাস বা স্কুইড তাদের চোখে কিন্তু আলো সংবেদন কোষ উপরে নার্ভগুলো নিচে–ঠিক যেমনটি হওয়া উচিত ছিল।
চোখের মতোন এমন চমকপ্রদ একটা জিনিসের সমালোচনা যদি করা হয় তাহলে সমালোচকরা আক্কেল দাঁতের কেন সমালোচনা করবে না? সেটা তারা করতেই পারে কারণ আমরা সবাই কখনো না কখনো এই আক্কেল দাঁতের সমস্যায় ভুগেছি। মানুষের মুখের ভেতর আক্কেল দাঁত ঠিকভাবে গজানোর জায়গা নেই–মুখের এক্সরে নিলে অবধারিতভাবে দেখা যায় সেটা বাঁকা হয়ে বের হচ্ছে, মাড়ি ভেদ করে বের হতে পারছে না এবং এ নিয়ে যন্ত্রণার কোনো শেষ নেই। মানুষ যদি তার আক্কেল দাঁতের মতো সহজ একটা বিষয়ের সমস্যা সমাধান করতে না পারে তাহলে আরো কঠিন কঠিন সমস্যার সমাধান কেমন করে করবে?
কঠিন একটা সমস্যা হতে পারে মানুষের এপেনডিক্স। আমরা সবাই নিশ্চয়ই কখনো না কখনো আমাদের পরিচিত মানুষের এপেন্ডিসাইটিস অপারেশনের কথা শুনেছি। আমাদের বৃহদন্তের শুরুতে ছোট একটা টিউবের মতো এই অংশটার মানুষের শরীরে কোনো কাজই নেই। মাঝে মাঝে হঠাৎ সেটার ইনফেকশান হয়ে যায়, মানুষ যন্ত্রণায় গড়াগড়ি করতে থাকে এবং পেট কেটে সেই এপেন্ডিক্সটাকে ফেলে দেয়া ছাড়া তখন কোনো আর গতি থাকে না। আরো ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটে যখন এপেন্ডিক্সটাতে ইনফেকশান হয়ে সেটা ফেটে যায়, তখন সাথে সাথে অপারেশন না করলে রোগীকে বাঁচানো কষ্টকর হয়ে যায়। যে জিনিসটার কোনোই ব্যবহার নেই–যার একমাত্র কাজ হচ্ছে হঠাৎ করে ইনফেকশান হয়ে মানুষের জীবনে একটা বিপদ ঘটানো, সেটাকে পেটের ভেতর রেখে দেয়ার পিছনে যুক্তি কোথায়? সমালোচকরা যদি এর সমালোচনা করে তাহলে তাদের কী দোষ দেয়া যায়?
মানুষ দু’পায়ে দাঁড়াতে পারে কিন্তু মজার ব্যাপার হলো হিসেব কষে দেখা গেছে মানুষের শরীরের যেটুকু ওজন সেটা তাদের দুই পায়ের হাড়ের সংযোগের জন্যে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। সত্যি কথা বলতে কী, যদি পা দুটি না হয়ে চারটি হতো তাহলে মোটামুটিভাবে ওজনটা ঠিক করে ভাগ করে দেয়া যেত। নিতম্বের যে অংশে পায়ের হাড় এসে সংযোগ দেয় সেই অংশের ক্ষয় মানুষের খুব পরিচিত একটা সমস্যা।
মানুষের হাঁটুর ডিজাইনটাও শরীরের জন্যে পর্যাপ্ত নয়। এখানেও বলা যায় দুটি হাঁটু না হয়ে চারটি হাঁটুতে মানুষের ওজন ছড়িয়ে দিলে হাঁটুর সমস্যা অনেক কম হতো। হাঁটু ছাড়াও কনুই, পায়ের পাতা, পেট এবং বিশেষ করে পুরুষ এবং মহিলাদের মূত্রনালিকে নিয়ে সমালোচকরা অনেক কঠিন কঠিন সমালোচনা করে থাকেন। সেগুলোর সবগুলোকে নিয়ে আলোচনা করলে বিশাল এক মহাভারত লিখতে হবে।
সেই মহাভারত লেখার যে খুব একটা প্রয়োজন আছে তা কিন্তু নয় কারণ সমালোচকদের এই সব সমালোচনাই বিজ্ঞানীরা যে মেনে নিয়েছেন তা কিন্তু নয়। তাদের অনেকেই যুক্তি দেখান যে একটা ডিজাইনকে এত সহজে খারাপ বা ভুল ডিজাইন বলা ঠিক নয়। যেটাকে আপাতদৃষ্টিতে বিচিত্র বা উদ্ভট মনে হয় সেটা কিন্তু কার্যক্ষেত্রে বিচিত্র বা উদ্ভট নাও হতে পারে। যেমন যে মানুষটি জীবনে কখনো বাইসাইকেল দেখে নি তাকে যদি একটা ছোট বাচ্চাদের ট্রাইসাইকেল আর সত্যিকারের বাইসাইকেল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করা হয় কোন ডিজাইনটা ভালো। একেবারে গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায় যে তারা ছোট বাচ্চাদের ট্রাইসাইকেলের ডিজাইনটাকে বেছে নেবে, তারা কল্পনাও করতে পারবে না যে আসলে দুই চাকার বাইসাইকেল অনেক দক্ষ এবং সুশৃঙ্খল যন্ত্র। কাজেই কখনোই একটা ডিজাইনকে এত সহজে খারাপ ডিজাইন বলার আগে সেটাকে আরো অনেক খুঁটিয়ে দেখা দরকার।
প্রচলিত বিশ্বাস যে সবকিছুই এসেছে বিবর্তনের ভেতর দিয়ে। একটা নির্দিষ্ট পরিবেশে টিকে থাকার জন্যে বিবর্তনের ভেতর দিয়ে প্রাণী জগৎ নিজেদের পরিবর্তন করে নিয়েছে কিংবা নিচ্ছে। অনেক জায়গাতেই আমরা রয়েছি পরিবর্তন প্রক্রিয়ার ঠিক মাঝখানে, তাই দেখতে পাচ্ছি আমাদের হিসেব মিলছে না। অনেক সময়েই পরিবেশের সাথে টিকে থাকার জন্যে কোনো একটা সমাধান বলতে গেলে জোর করে চলে এসেছে যেটাকে এখন মনে হয় খাপছাড়া বা অগোছালো।
তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, যারা ধর্ম দিয়ে বিজ্ঞান বোঝার চেষ্টা করেন তারা কিন্তু মানুষের শরীরের ডিজাইনে ত্রুটির বিষয়টি মানতেই চান না, তাদের ধারণা সেটা মেনে নিলে ধর্মটাকে খাটো করে দেখা হয়। তাই তারা এই বিষয় নিয়ে ক্রমাগত চেঁচামেচি করে যাচ্ছেন–বিতর্কটা তাই জমে উঠেছে বেশ ভালোভাবেই।