মাধাই অবশেষে মালবাবুকে আশ্রয় করেছিলো। মালবাবুর নাম গোবিন্দ, তার বয়স মাধাইয়ের চাইতেও কম। পৈতৃক সুবাদে রেল কোম্পানিতে চাকরি। পিতা রেল কোম্পানিতে বড়ো রকমের একটি হেডক্লার্ক ছিলেন। তারও আগে তারও পিতা এই রকমই ছিলেন।কলেজ ছাড়ার পর গোবিন্দ বলেছিলো, সেকলেজের অধ্যাপক হবে। পিতা বললেন, অহহা কী দুর্মতি। তিনি চাকরি থেকে বিদায় নেবার পর নবদ্বীপ এবং পরে বৃন্দাবনে দীক্ষা নিয়েছেন। চেহারাই নয়, ভাষা পর্যন্ত বদলে গেছে তার। আমিষ ত্যাগ করেছেন, এবং শেষ পর্যন্ত দুগ্ধ ও দুগ্ধজাতদের বিরুদ্ধে প্রচার করছেন। ঘৃত মানেই আমিষ এই প্রমাণ করে অধুনা উদ্ভিজ্জ ঘৃতের কারখানা খুলেছেন। তিনি চাকরি করে দিলেন ছেলের, এই স্টেশনটি মনঃপূত হওয়ায় এখানেই বসিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও করলেন। রেল কোম্পানির চাকরি, গোবিন্দর পরিবারে লক্ষ্মীর ঝাঁপির টাকা, প্রয়োজনের নয় শ্রদ্ধার।
কিন্তু গোবিন্দ মালবাবু হয়ে মালবাবুর পক্ষে অনুচিত কাজকর্ম করতে শুরু করলো। এখন হয়েছে কি, রেল কোম্পানির একখানি আইনের পুঁথি আছে মাল চলাচল সম্বন্ধে। গোবিন্দ যখন খোঁজখবর নিয়ে এক সপ্তাহের চেষ্টায় সেটাকে আবিষ্কার করলো তখন কেউ জানতোনা একটি পুঁথির এমন বিরাট শক্তি থাকতে পারে। মাটিতে পাতা দুখানা লোহার উপর দিয়ে প্রকাণ্ড প্রচণ্ড স্পেশ্যালগুলি যেমন গড়িয়ে যায়, তেমনি চললো গোবিন্দর অফিস-পুঁথির লাইনে লাইনে।
সরষের তেলের ম্যানেজার এসেছিলো, আজ চাই গাড়ি।
চাইলেই কি পাওয়া যায়।
ম্যানেজার হেসে বললো, আপনি আমাকে চেনেননা, আমার নাম রামরিঝ দুকানিয়া। আমি–
বাধা দিয়ে গোবিন্দ বললো, দুটি কানই আপনার এখনো আছে, শুনতে পাচ্ছেন না এই আশ্চর্য। গাড়ি পাবেন না। যে ক’খানা আছে আজ আম চালান যাবে।
আম! ছোটোলোকেরা যা চালান দেয়?
আজ্ঞে হ্যাঁ, খেতে যা তিসি-মেশানো সরষের তেলের চাইতে ভালো।
এদিকে-ওদিকের লোকগুলি হেসে উঠলো। দুকানিয়া বাংলা বলতে পারে বটে, কিন্তু তার মারপ্যাঁচ বোঝে না। সে অপমানিত বোধ করে স্টেশনমাস্টারের ঘরে গিয়ে দাঁড়ালো। স্টেশনমাস্টারের ঘরে ডাক পড়লো গোবিন্দর।
গোবিন্দবাবু, দুকানিয়া আমাদের বন্ধুলোক।
গোবিন্দ হো-হো করে হেসে উঠলো।
স্টেশনমাস্টার তার ঔদ্ধত্যে বিরক্ত হলো, কিন্তু গোবিন্দপতার সম্বন্ধে তার একটা ধারণা ছিলো।
গোবিন্দ বললো, দুকানিয়া আমার বন্ধু নয়। নাম শুনেই বুঝতে পারছেন, ওর বংশগৌরবের চূড়ান্ত হচ্ছে দুই-একখানা দোকান। আপনি বুঝবেন না, কারণ আপনি নিজেই কোলম্যান। এরা সাহেব বললেও আমি জানি আপনার পিতাঠাকুর কয়লা কাটতেন কিংবা ও-বস্তুটি ফিরি করতেন।
সাহেব গর্জে উঠলেন, কী বলতে চাও, ছোকরা!তুমি আমাকে ফিরিওয়ালার ছেলে বলছো? তোমাকে আমি নরক দেবো।
সাহেব, আমার পিতাঠাকুর মৃত নন। তাছাড়া এস্টাব্লিশমেন্ট, স্টাফ ও অ্যাপিল তিনটি হেডক্লার্কই আমার পিতাঠাকুরের বন্ধু কিংবা আইনতুতো ভাই। তুমি যে বংশগৌরবে কিছুনার চাইতেও কম তার প্রমাণ এ পর্যন্ত ইলিয়টসাহেব তোমার ছোঁয়া চা স্পর্শ করেনি।
এটা কোলম্যানসাহেবের কোমল প্রাণের একটি দুর্বলতা। গোবিন্দ তার পায়ের কড়ার উপরে দাঁড়িয়েছে এমন মুখভঙ্গি করে কোলম্যান অশ্রাব্য শপথ গ্রহণ করে বললো, তোমার ইলিয়ট নরকে যাক।
তা যাবে, গোবিন্দ উঠে দাঁড়ালো, আপনি তার সম্বন্ধে যে ব্যবস্থা করলেন তাও তাকে জানিয়ে দেবো।
.
দুকানিয়া অবাক হলেও তার বুদ্ধি লোপ পায়নি, সে বললো, বাবুসাহেব, আমরা কিছু ব্যবস্থা করে থাকি।
গোবিন্দ আবার হাসলো, যা শিখিয়েছে সেটা শিখতে বাঙালি দেরি করবে না। তুমি শুনলে অবাক হবে ইতিমধ্যে আমার পিতাঠাকুর সিনথেটিক ঘিয়ের কারবার খুলে দিয়েছেন, আট-দশ লাখ রুপেয়া খাটছে। আর সেই ঘি-ও যাচ্ছে স্রেফ জয়পুর আর বিকানীরে চালান। তুমি আমাকে
কী দেবে? আমার নিজের যা আছে তার ইনকাম ট্যাক্সই ওঠে না আমার মাইনেয়।
দুকানিয়া এবার হতবাক।
কিন্তু আমের ব্যবসায়ীরা করলো মুশকিল। তারা এসে বললো, বাবুসাহেব, কাল থেকে আমাদের গাড়ি লাগবে না।
কেন, আমার বাপের ঠাকুররা?
দুকানিয়া আমাদের সব আম কিনে নিচ্ছে।
উত্তম কথা।
সন্ধ্যার পর কোলম্যান সাহেব স্টেশন পরিক্রমার অজুহাতে এসে বললেন, দ্যাখো গোবিন্দ, তুমি বড়ো ছেলেমানুষ।
আদৌ নয়। লেখাপড়া তোমার চাইতে কম জানি না, আইনগতভাবেও আমি সাবালক। তুমি কি সেকেলে টেনিসন ব্রাউনিংয়ের নামও শুনেছো? তুমি বোধ হয় জানোই না, ইংরেজি সাহিত্য শুধু সেকস্টন ব্লেক নয়। সাহেব, তোমাকে আর কী বলবো, তোমাকে শুধু ইংরেজ পণ্ডিতদের। নামের সমুদ্রে ডুবিয়ে দিতে পারি। তুমি কি ইটন কিংবা হ্যাঁরো কাকে বলে জানো? আ-মরি, অমন মুখ হলো কেন? এখন আর তোমার পক্ষে ইটনে যাওয়া সম্ভব নয়, বাড়িতেই একটু ইংরেজি গ্রামারটা উল্টেপাল্টে দেখো, ইলিয়ট সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে সুবিধা হবে।
বলা বাহুল্য এই কথাগুলি বলছিলো গোবিন্দ তরতাজা ইংরেজিতে এখানে-ওখানে স্মিতহাসি বসিয়ে।
কোলম্যান সরে পড়লো, গোবিন্দ তার পিঠের উপর একরাশ উচ্চ হাসি ছুঁড়ে দিলো। মাধাই সেই ঘরের এক দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলো। সে ইংরেজি না বুঝলেও কোলম্যানের মুখ ও গোবিন্দর হাসি দেখে বুঝতে পেরেছিলো ব্যাপারটা কোলম্যানের পক্ষে খুব সুবিধার হচ্ছে না। পরে আর এক মালবাবুর মুখে শুনে তার শ্রদ্ধা হলো গোবিন্দর উপরে।
.
একদিন গোবিন্দ নিজে থেকেই প্রশ্ন করলো, হ্যাঁ রে মাধাই, তুই অমন মুখ করে থাকিস কেন রে? তোর কি কোনো অসুখ আছে?
না। মাধাই ইতিউতি করে সরে পড়ার চেষ্টা করলো।
তাহলে তোর মনে কষ্ট আছে, আমি তোকে কিছুদিন থেকেই লক্ষ্য করছি।
মাধাই দাঁড়িয়ে মাথা চুলকাতে লাগলো। যে কথা শুনে জয়হরিরাও হাসি-তামাশা করে এমন শিক্ষিত লোকের সামনে কী করে সে কথা বাল যাবে।
কিন্তু সেদিন সন্ধ্যার পর গোবিন্দ যখন তার বাসায় যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, মাধাই ভয়ে ভয়ে কথাটা উত্থাপন করলো।
আচ্ছা বাবু, স্টেশনের সব লোকে খাকি পরে এক আপনি ছাড়া।
হ্যাঁ, তা পরে। খাকি আমি অত্যন্ত ঘৃণা করি।
কেন, বাবু?
গোবিন্দ হাসতে হাসতে বললো, যে রঙের কদর ময়লা ধরা যায় না বলে সে রঙ ভদ্রলোকের পরা উচিত নয়।
না, বাবু। ঝকঝকে কাঁচা খাকিই তো সাহেববাবুরা পরে।
গোবিন্দ একটুকাল চুপ করে থেকে বললো, যুদ্ধটাকে আমি মানুষের কাজ বলে মনে করি না।
যুদ্ধ যদি খারাপই হবে, তবে বাবু, স্টেশনের সব লোক এমন মনমরা কে, তাদের সকলের মুখ ফ্যাকাসে দেখায় কেন্ যুদ্ধের জেল্লা কমায়।
মাধাই কথাটা বলে ফেলেই মনে মনে জিভ কাটলো। এতক্ষণে তার বিদ্যাবুদ্ধির হাঁড়ি ভেঙে গেলো। কিন্তু অবাক করলো গোবিন্দবাবু, উৎসাহ তার চোখ দুটি ঝকঝক করে উঠলো।
তুই লক্ষ্য করেছিস মাধাই, এত অনুভব করেছিস?
মাধাই মাটির দিকে চোখ রেখে রেখে কথা কুড়িয়ে কুড়িয়ে বললো, সব যেন জল জল লাগে, ফাঁকা ফাঁকা লাগে। এ যে কেমন, এ যে বাঁচা না। যুদ্ধ থামে সব যেন আড়ায়ে গেলো।
গোবিন্দ বললো, তোর দেখায় খুব ভুল নেই; এখন বাসায় যাচ্ছি, পরে তোর সঙ্গে কথা বলবো।
একদিন গোবিন্দ মাধাইকে ডেকে স্টেশনের বাইরের আর একটি বাবুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো। সে লোকটি স্থানীয় রেলস্কুলের হেডমাস্টার।
গোবিন্দ বললো, মাস্টারমশাই, আমার কথায় তুমি বিশ্বাস করতে পারোনি, কিন্তু মাধাইকে জিজ্ঞাসা করো, সেও দেখতে পাচ্ছে, নেশা ছুটে যাওয়া মাতালের মতো হয়েছে স্টেশনের
লোকগুলোর অবস্থা, সমস্ত দেশটাতেই এমন অনেক দেখতে পাবে।
মাস্টারমশাই বললো, মাধাই কোনটা চাচ্ছে-নেশা ছাড়া অবস্থাটা, না, আবার নেশা করে ঝুঁদ হতে?
কোনটা চাচ্ছে তা নিজেই একসময়ে ঠিক করবে, আপাতত যুদ্ধটাকেই ওর ভালো লাগছে নেশার জন্য। ও বুঝতে পারছে ঘোরটা কাটার মতো হয়েছে,নীলচে দেখাচ্ছে সবার মুখ। সময়টা অস্বস্তিকর।
সে নিজেই এতসব কথা বলতে পেরেছে নাকি কোনো সময়ে, এই ভেবে বিস্মিত হলো মাধাই। কথাগুলি তার মনের কথা এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
মাধাই একটা কাজ পেলো। যুদ্ধের নেশা ছুটছে, তখন আর এক নেশা ধরিয়ে দিলো গোবিন্দ এবং মাস্টারমশাই। দেখালো, যেন সে নিজের অনুভূতির কথা প্রকাশ করে এই নতুনতর নেশার জন্যে দরখাস্ত করেছিলো। তারা হয়তো তার অনুভূতির কথা শুনে তাকে এই কাজের পক্ষে উপযুক্ত মনে করেছিলো, হয়তোবা হাতের কাছে তাকে না পেলে অন্য কোনো অসন্তুষ্ট আত্মাকে তারা খুঁজে বার করতো, কিংবা কোনো ঘুমন্ত আত্মাকে দুঃস্বপ্নের মধ্যে জাগিয়ে তোলার চেষ্টাও করতো। আর মাধাই নিজের ঐকান্তিক আগ্রহ দিয়ে এটাকে নেশায় পরিণত করলো।
মাধাই প্রথমে নিজের সমশ্রেণীর মধ্যে কথাটা বলে বেড়াতে লাগলো, শেষে সাহস পেয়ে বাবুদের মধ্যে। সময় পাখা মেলে উড়ে যায়। এমন নেশা লাগলো মাধাইয়ের, রান্না করে খাওয়ার সময়টুকুকেও অপব্যয় বলে মনে হয়, কোনো কোনো দিন সে হোটেলেই খেয়ে নেয়। প্রথম প্রথম সে মাস্টারমশাই আর গোবিন্দর কাছে কথা বলা শিখেছিলো, একসময়ে তারও আর দরকার হলো না।
মাধাই বলে, টাকার নেশায় তোমাদের পাগল করে দিছিলো, এবার টাকা গুটায়ে নিবে, নেশাও টুটবি।
জিনিসপত্তর তো আগুন, টাকা না থাকলি তো খাওয়া-পরা বন্ধ।
তোমরা ঠিক পাও নাই, কিন্তু এদেশের বারো আনা লোক এ কয় বছর সেসব বন্ধ করে আছে। কোষ্কার কোন্ দুই রাজা করলো যুদ্ধ আর আমরা হলাম বোকা।
জয়হরি যদি বলে, তুই কী বলিস, যদি তাড়ায়ে দেয়?
দিবি? তা দিউক। রাতারাতি লোক আসেকাজ চালাবের পারবি? পারুক। সারা ভারতের সকলেই যদি কয়, থাকলো কাজ কাম। তাইলে?
তাইলে হয়, কিন্তু সকলেই কি শুনবি? মনিরুদ্দিন পোর্টার হাসতে হাসতে যোগ দেয়।
মাথার ঝাঁকড়া চুলগুলো দুলিয়ে মাধাই বলে, প্রথমে এই স্টেশনে কয়জন রাজী হইছিলো? এখন কয়জন হইছে?
তা হইছে।
কিছুদিন যেতে না যেতে স্টেশনের কর্মচারীরা মিলে রীতিমত সংঘ স্থাপন করলো। সদর থেকে কয়েকজন বক্তা এলো, সংঘমন্ত্রী, সভাপতি ইত্যাদি নির্বাচন হলো। গোবিন্দ বা মাস্টারমশাইয়ের নামও কেউ করলো না। শেষ সারিতে সকলের পেছনে যেখানে তারা তিনজন দাঁড়িয়ে ছিলো মাধাই সেখান থেকে অগ্রসর হতে যাচ্ছিলো, গোবিন্দ ইশারা করে তাকে নিষেধ করলো।
সেই মালবাবু চলে গেছে। বদলি নয়, চাকরি ছেড়ে দিয়ে। মাধাই আরো জানতে পেরেছে যাবার আগে কিছু নগদ টাকা তাদের সংঘকে দিয়ে গেছে গোবিন্দ, আর বলে গেছে মাস্টারমশাইকে, যদি সংঘের কাজ করতে গিয়ে মাধাই কখনো চাকরি খোয়ায়, সে যেন তার কাছে চলে যায়। ঠিকানা রেখে গেছে।
বস্তুত গোবিন্দকে মাধাই চিনতে পারেনি। স্টেশনের আর কেউ পেরেছে কিনা সে খবর মাধাই রাখে না। কিন্তু লোকটির ব্যক্তিত্ব যতই দুরধিগম্য হোক, মিথ্যা নয়। একটি রাত্রির কথা মাধাইয়ের মনে পড়ে-গোবিন্দর বাসায় নিমন্ত্রণ ছিলো মাধাই ও মাস্টারমশাইয়ের। এ সম্বন্ধে প্রথমেই মাধাইয়ের যে প্রশ্ন সেটা হচ্ছে–আচ্ছা, বলল, কী দরকার ছিলো এমন করে মাধাইয়ের সঙ্গে একত্র বসে খাওয়ার, তার সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করার? সেই আহারের আসরে সংঘের কথাও উঠেছিলো।
গোবিন্দর একটা কথায় মাস্টারমশাই হেসে বললো, গোবিন্দ, তুমি কোলম্যানকে যা বলবে তারই কি মহলা দিচ্ছো? দ্বিধাহীন প্রচেষ্টা ছাড়া এমন হয় না তুমি যা করলে।
তোমাকে তো বলেছিসংঘ গঠন করা কত সহজ তাই দেখলাম।সব মানুষের প্রাণের ভিতরে সুখী হওয়ার ইচ্ছা আছে, তার সব চেষ্টায় থাকে নিজের সুখ আহরণের উদ্দেশ্য; এর আর একটা রূপ অন্যকে সুখী হতে দেখলে অসূয়া, ক্রোধ ইত্যাদি। উপর স্তরের বলো, বিদগ্ধ স্তরের বলল, তারা সুখের প্রতিদ্বন্দ্বীকে প্রকাশ্যে ঘৃণা করে না। শ্রমিকরা বিদগ্ধ নয়, তাদের অসূয়া ও ক্রোধকে অতি সহজে খুঁচিয়ে তোলা যায়।
আচ্ছা গোবিন্দ, তোমাকে কি এতদিনের পরে আমাকে নতুন করে চিনতে হবে? এসব বলে তুমি কেন মাধাইয়ের মন ভেঙে দিচ্ছো?
মাধাই শ্রমিকের জাত নয়। তুমি কি লক্ষ্য করেছে, অন্য কোনো শ্রমিক তার জীবনটাকে শূন্য বোধ করছে? সেই কথা বলে বেড়াচ্ছে?
তুমি কী বলতে চাও, বলো তো? মাস্টারমশাই একটা জ্বলন্ত প্রশ্ন গোবিন্দর মুখের সামনে বসিয়ে দিলো।
দ্যাখো মাস্টারমশাই, তোমার বহু অভ্যাসে অর্জিত তর্কশক্তি আমার নেই। কথাটা ঠিক গুছিয়ে বলা আমার পক্ষে সম্ভবও নয়। একটা ঘটনা শোনো। একদিন এক টেলিফোন অফিসে রাত কাটিয়েছিলাম আমি; সারারাত চিন্তাকুল হয়ে থাকলাম-ঘুমের মতো বিষয়কে বিদায় দিতে হলো কার অভিশাপে। নানা যুক্তিতর্ক এলো মনে। অবশেষে স্থির করলাম, ব্যবসাদারের প্রতিযোগিতা ছাড়া আর কিছু নয়। সারারাত পাট, তোষাপাট, বেল ঝাঁঝ করতে লাগলো। তোমার কথামতো তখনো বাইরে থেকে দল গড়ার চেষ্টা করেছিলাম। পরে দেখলাম তারা কেউ রাতজাগা বন্ধ করার পক্ষে নয়, আরো রাত জাগতে চায় আরো টাকা পেলে। তা গুহায় যখন মিসেস পিল্টডাউনকে নিয়ে ঘুমুতাম, তখনো খঙ্গদাত বাঘের উৎপাতে ঘুম হত না, এখন দেখছি তেমনি আছে।
এই তোমার স্বরূপ? তোমাকে আমি চিনি গোবিন্দ।
এটা তোমার গর্ব, আমি নিজেকেই চিনি না। কখন ইউলিসিস, কখন রামচন্দ্র, কখন অশোকের কোন সেনাপতি হয়ে দাঁড়াচ্ছি এ আমি নিজেই বুঝতে পারি না। আমার মন তোমার কোনো ইকুয়েশনে ধরা পড়ে না। আমি সাবালক মানুষ। ঈশ্বরেচ্ছা কিংবা ইতিহাস আমাকে নিয়ন্ত্রিত করে না।
আহার হয়ে গিয়েছিলো। গোবিন্দ তোয়ালেতে হাত মুছে একগোছ চাবি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তার ভৃত্যটি আহার্যের পাত্রগুলি তুলে নিয়ে গেলো। তারপর সে টেবিলে নতুন কাপড় বিছিয়ে কতগুলি ঝকঝকে গ্লাস রেখে গেলো। এরকম ছোটো ছোটো অদ্ভুত চেহারার গ্লাস দিয়ে কী হয় মাধাইয়ের জানা ছিলো না।
গোবিন্দ একটা মদের বোতল নিয়ে ফিরে এলো। সেই ঠাণ্ডা মধুর মদ মাস্টারমশাই ও গোবিন্দ অবিমিশ্র চালাতে লাগলো।
মাস্টারমশাই বললো, অতঃপর তুমি কী করছে, গোবিন্দ?
চাকরি থেকে বিদায় নিচ্ছি।
যদি শুনতে পাই মানস সরোবরের পথে হাঁটতে শুরু করেছে, তাহলে বোধ হয় আমার আশ্চর্য হওয়া উচিত হবে না।
তা হয় না, গোবিন্দ হাসলো, আপাতত একটা সখ চেপেছে মাথায়। ছোটো একটা স্টিমার চাই; পিতাজীর কোম্পানি রাজী হয়েছেন। বলেছি ডাঙার কোল ঘেঁষে ঘেঁষে হংকংটা ঘুরে আসি। তাকে তার উদ্ভিজ্জ ঘিয়ের ব্যবসায়ের কথা বলেছি, খুব প্রচার করে আসবো-যুদ্ধের পর শান্তির অভিযান। অবশ্য পিতাজী এতদিনে বুঝতে পেরেছেন তার ব্যবসায়ে জেলের ভয় আর নেই, সুতরাং আমাকে ম্যানেজার করা যায়।
সঙ্গে কেউ যাচ্ছেন?
শুনতেই চাও? সুধন্যাকে মনে আছে?গোবিন্দ নির্লজ্জের মতো হাসলো।
তার কি এখনো পঞ্চাশ পার হয়নি?
ওটা তোমার বাড়িয়ে বলা। ত্রিশ পেরিয়েছে বটে। গোবিন্দ উদ্দীপ্ত হলো, তোমার মনে আছে মাস্টারমশাই, আমার কিশোর দৃষ্টির সম্মুখে সুধন্যার যৌবনধন্য রূপের পদচারণ? হাঁ করে চেয়ে থাকার জন্যে কতইনা তিরস্কৃত হয়েছি। সেই অগ্নিময়ী এখন আর সে নয়–আর সে জন্যেই মনটা কেমন করে তার জন্যে। আচ্ছা, মাস্টারমশাই, রমণীর অনন্য রূপ আর অসাধারণ কণ্ঠ কি একটিমাত্র পরিবারের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকা উচিত, না তার জন্যে ট্রয়ের যুদ্ধ হওয়াই বাঞ্ছনীয়? আমার তো মনে হয় মহাকবিরা কিছুতেই সহ্য করতে পারেননি হেলেনের মতো মানসকন্যা একটিমাত্র রাজার রানী হয়ে ধীরে ধীরে জরা ও মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হবে।
নারী জাতিকে অবশ্য তুমি সম্পত্তি বলে চিন্তা করছো, গোবিন্দ; তাদের মধ্যে কোহিনুর যারা তাদের জন্যে নাদিরের লোভকেই তুমি তাদের মূল্যের স্বীকৃতি বলে প্রমাণ করতে চাচ্ছো?
না, ঠিক তা নয়। ওই রূপ এবং ওই রুচির মূল্য কী করে দেওয়া যায় তাই ভাবছি। একটি পুরুষ কতটুকু মূল্য দিতে পারে?
মাস্টারমশাই কথা বললো না, তার মুখখানা থমথম করছে।
উত্তর দিলে না? গোবিন্দ বললো।
তাহলে সুধন্যা যাচ্ছেন? বিয়ে করবে তো?
আদৌ না, গোবিন্দ হেসে উঠলো, আমি শুধু জানতে চাই তিনি কেমন অনুভব করলেন জীবনটাকে। দশ বছরে অধ্যাপিকার জীবনে কী কী অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন, তাই শুধু বুঝবার চেষ্টা করবো : ঘটনা নয়, রটনা নয়, শুধুমাত্র তাঁর মন কোথায় কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে প্রতিঘাত করেছে। দীর্ঘ দিন এবং দীর্ঘ সন্ধ্যাগুলি পাশাপাশি ডেকচেয়ারে বসে এমন কিছু নাটক নভেল পড়া যায় না নিঃশব্দে। তখন কথা হবে। তোমাকে অবাক করার জন্যে বলছি না, সুধন্যাকেও এসব বলেছি।
.
গোবিন্দ চলে যাওয়ার পরে একদিন ওভারব্রিজের সিঁড়ির মুখে দেখা হলো মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে, মাধাই বাজার করা ভুলে কথা বলতে বলতে তার বাড়ি পর্যন্ত এসেছে।
ও তো তোমার মতো খেটে খাওয়ার লোক নয়, ওর কথা আলাদা। ধরো পদ্মায় ঝড় উঠেছে, নৌকো টলছে, তখন অন্য সকলে মাটির দিকে ছুটবে; আর দু’একজন হয়তো ছুটে যাবে জলের দিকে, ঝড়ের আঘাতে বড়ো বড়ো ঢেউগুলো যেখানে শাদা ফেনা হয়ে যাচ্ছে সে জায়গাটাই তাদের লক্ষ্য। এমনি এক জাত গোবিন্দর।
আচ্ছা বাবু, আমাকে তিনি খুব ভালোবাসেন, না? কিন্তু আমার কী গুণ আছে?
ভালোবাসার কারণ বলা যায় না। তুমি খুব বেশি করে বাঁচতে চাও, গভীর করে বাঁচতে চাও সেইজন্যে বোধ হয়। তোমাদের স্বভাবে খানিকটা মিল রয়েছে এই একটা জায়গায় অন্তত।
গভীর করে বাঁচা’কথাটা শিখলো মাধাই। তার মনের অব্যক্ত আবেশটি ভাষায় রূপ পেলো।
মানুষের চরিত্র কী করে সৃষ্টি হয় তা বলার চেষ্টা করাও বিড়ম্বনা। মাধাইয়ের জীবনের ঠিক এই জায়গাটায় কিছুদিন ধরে গোবিন্দর সঙ্গে তার আলাপ তার চরিত্রের আত্মপ্রকাশের সহায়তা করেছে। এ পরিচয় তার জীবনের একটি ঘটনা যার কার্যকারণ সম্বন্ধ হয়তো খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু এরকমটা প্রায়ই হয় : চারিদিকের চাপে চরিত্রগুলি পরিবর্তিত হচ্ছে, অস্ফুট কথাগুলি মনের গভীরে গিয়ে হয়তোবা চিন্তার ভিত্তিভূমি রচনা করছে। গোবিন্দও ভূমিষ্ঠ হওয়ামাত্র গোবিন্দ হয়নি। বহু জীবনের ছাপ রয়েছে তার চরিত্রে, যেহেতু সে শিক্ষিত হয়তোবা বহু পুস্তকের ছাপও আছে। পরে একদিন সুধন্যার অধ্যাপিকা-জীবনের অভিজ্ঞতাগুলিও তার চরিত্রকে অন্তত আংশিকভাবে পরিবর্তিত করবে। অথবা ঈশ্বর কিংবা অর্থনীতির ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব তার জীবনকে বিধৃত করে না বলে সে নিজের দায়িত্ব নিজে নিয়ে যতদূর পারে অগ্রসর হবে।
সংঘের কাজকর্মের সঙ্গে যাতে মাধাইয়ের প্রত্যক্ষ যোগ না-থাকে সে ব্যবস্থাই করে গেছে গোবিন্দ। আবার সময় কাটানো কঠিন হলো মাধাইয়ের। একথা ঠিক নয় তার যথেষ্ট সময়, চাকরি ছাড়াও নিজের আহার প্রস্তুতের কাজ রয়েছে, নিজের বেশভূষার ব্যবস্থা করতেও তার খানিকটা সময় যায়। আসলে সে অনুভব করে একটা নেশা ধরেছিলো আর একটা যখন ছাড়ছে, সে নেশাটাও ফিকে হয়ে আসছে। কোনো একটি বিষয়ে মেতে উঠতে না-পারলে যেন শান্তি নেই।
মাস্টারমশাই একদিন তার ঘরে এসে উপস্থিত। মাস্টারমশাই গোবিন্দ নয়। মাধাই আছো?
আজ্ঞে? মাধাই ধন্যর চাইতেও ধন্য হলো। একজন অত বড়ো বিদ্বান প্রধানশিক্ষক তার দরজায় দাঁড়িয়ে।
তুমি তো আজকাল সংঘটার দিকে লক্ষ্য রাখছে না, বাপু।
বাবু–মাধাই লজ্জিত হলো।
নিজের হাতে তৈরি জিনিস তোমার। তুমি একা যা করেছে ওরা পাঁচজনে মিলে তা পারছে না। তেমন বুক দিয়ে পড়ে কাজটা তুলে দিতে কারুকে দেখছিনে। এটা ভালো লাগছেনা বাপু।
আচ্ছা বাবু, আমি যাবো। যদি সংঘের বাবুরা রাগ না করেন, আমি কথাও বলবো।
কিন্তু মাস্টারমশাই চলে যেতেই মাধাই ভাবলো–দূর করো! এ আর ভালো লাগেনা। নিজের কী হলো দেখার সময় নেই, কথা বলতে বলতে গা গরম হয়ে ওঠে, গলা শুকিয়ে যায়।
স্টেশনে গিয়ে শুনলো সংঘের গোলমাল আর কিছু নয়, কলকাতা শহর থেকে কয়েকজন ভদ্রলোক এসে গোপনে গোপনে কাজ করছে, তার ফলে লোকোশেডের শ্রমিকরা একটা আলাদা সংঘ তৈরি করেছে, দলাদলি শুরু হয়েছে। তাদের কেউ পুরনো সংঘের বাবুদের দোষ দিচ্ছে, বাবুদের কেউ কেউ তাদের দোষ দিচ্ছে। মাধাইয়ের অজ্ঞাত অনেক রাজনৈতিক গালি এ-দল ও-দলকে বর্ষণ করছে। মাধাই স্টেশনের চায়ের দোকানের একটা টিনের চেয়ার টেনে নিয়ে বসে বললো, কী হিংসে, কী হিংসে!
তবু মাস্টারমশাইয়ের সম্মান রাখার জন্য সন্ধ্যার পর মাধাই জয়হরিকে সঙ্গে নিয়ে বার হলো।
কোথায় যাবা?
চলল, লোকোশেডের পাড়ায়।
স্টেশনের পশ্চিমে লোকোশেড, আর লোকোশেডের পশ্চিমে ক্লিনার-ফিটার-সান্টার প্রভৃতি কর্মচারীর বাস।
জয়হরি বললো, এমন হাই হুই করে বেড়াতি তোমার কী ভালো লাগে তা বুঝি না, মাধা।
তুমি বুঝবা কেন, স্টেশনের গাড়ি থেকে মাছ চুরি করবা, ধনে লঙ্কা সরাবা। কিন্তুক চুপ করে বসে থাকে কী লাভ? জীবন ফুরায়ে যায়।
ছুটাছুটি করলেও ফুরাবি।
জংধরা এঞ্জিন হয়ে লাভ কী?
শরাব পিয়ো, বেরাদার। জয়হরি বললো।
ওরে আমার হিন্দুস্থানী রে! মাধাই হাসলো। একটু পরে বললো, আজ লোকোশেডের লোকদের কয়ে আসতে হবি, তারা বাঁচে আছে না মরে আছে।
বাঁচে সকলেই, তোমার মতো কেউ জীয়ন্তে মরা না। সুখ আছে, আহ্লাদ আছে, মদ আছে, মিয়েমানুষ আছে। হৈ-হৈ করো, সোডাপানির মতো ছিটেফিটে ওঠো, তা না। কেবল দুঃখকষ্ট ঘোলায়ে তোলে।
আমি কি দুঃখকষ্ট ঘোলায়ে তুলি?
হয়, কষ্ট ভুলে থাকবের দেও না, চিল্লাচিল্লি করো। একদিন কেউ তোমাকে ঐজন্যি মার দিয়ে ঠাণ্ডা করে দিবি।
কথাটা আর এগুলো না। লোকোশেডের খালাসিদের মধ্যে মাতব্বরস্থানীয় আবদুল গনি ফরাজি আসছিলো সেই পথ দিয়ে। সেলাম বিনিময়ের পর আবদুল গনি জিজ্ঞাসা করলো, রাত করে কনে?
আপননদের পাড়ায়।
কী কারণ?
মাধাই বললো, এই একটুক সুখ দুঃখের কথাবাত্তা।
আবদুল গনি এত বয়সেও এমন অদ্ভুত কথা শোনেনি, দোলদুর্গোৎসব, ইদ-মহরম নয় তবু লোকে চলেছে এক পাড়া থেকে আর-এক পাড়ায় সুখদুঃখের কথা বলতে। বৃদ্ধ আনন্দে অধীর হয়ে উঠলো, মাধাইয়ের হাত ধরে বললো, চলো ভাই, চলো।
নিজে সে কোন কাজের ধান্দায় কোথায় যাচ্ছিলো তা-ও ভুলে গেলো।
অল্পকিছু দূরে গিয়ে একটা চায়ের দোকানের সম্মুখে থামলো আবদুল গনি। ভিতরে যারা কোলাহল করছিলো, তাদের কয়েকজনকে আহবান করে আবদুল গনি বললো, ইউনুস, মেহের, ফটিক, দেখ দেখ কারা আসেছে। ইস্টিশনের নোক।
দোকানটায় দেশী মদও বিক্রি হয়। মুড়ি-মুড়কি থেকে চপ কাটলেট নামক একপ্রকার পদার্থ পর্যন্ত।
লম্বা ময়লা দু-চারখানি বেঞ্চ ইতস্তত ছড়ানো। কেরোসিনের লাল আলোয় ইউনুস প্রভৃতি খাওয়াদাওয়া করছিলো, আবদুল গনির ডাক শুনে দোকানের দরজার কাছে উঠে এসে এদের অভ্যর্থনা করলো।
সকলে আসন গ্রহণ করলে আবদুল গনি বললো, এমন খুশির দিন আর হয় না, একটুকু খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করো, অ রজনি!
দোকানের মালিক রজনী বললো, কী ব্যবস্থা, চা, না বড়ো-চা?
স্কুলের হাইবেঞ্চের অনুরূপ একটা লম্বা টেবিলের দু’পাশে এরা মুখোমুখি বসেছিলো। রজনী দু-তিনটে দেশী মদের বোতল ও প্রয়োজন মতো মাটির খুরি রেখে গেলো। কিছু ভোজ্যও এলো।
.
জয়হরি বললো, আনন্দ দিলেন খুব।
পাতেছিও অনেক। এ পক্ষের থেকে ইউনুস বললো।
মাধাই বললো, আপনাদের কাছে আমি আসেছিলাম এসসিওসনের কথা বলতে।
বেশ, ভালো, কন।
আপনাদের মধ্যে এখনো অনেকে মেম্বর হন নাই।
তাইলে তো লজ্জার কথা। তা এদিকেও সেই কোলকেতা শহরের বাবুরা কী বলে, কী কয়। হলে আপনের কাছে মেম্বর হবো। মায়নার দিন আপনে একবার আসবেন। তা দেখেন, দোষও দেওয়া যায় না। সারাদিন খাটনির পর বাসায় আসে খাওয়া শোওয়া ছাড়া আর কিছু মনে থাকে না।
মাধাই সংঘের গুণপনা বর্ণনা করে একটা নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলো, কারো মুখের দিকে চেয়েই সে উৎসাহ পেলো না।
মাধাই বুঝলো সংঘের সভ্য এরা হবে, একদলে থেকে দলে ভারি হওয়ার সুবিধা সম্বন্ধে এরা হুঁশিয়ার কিন্তু সংঘ সম্বন্ধে দীর্ঘকাল আলাপ করতে ভালো লাগবে এমন লোক এরা নয়। ততক্ষণে জয়হরি ও ইউনুস কী একটা কথা নিয়ে চাপা হাসিতে উচ্ছল হয়ে উঠেছে।
আবদুল গনি বললো, হাসতিছো কেন্ তোমরা?
না, তেমন হাসি কই! আমাদের মিস্ত্রিসাহেব ফটিকের কথা একটু কতিছি।
কী কথা ভাই, কী কথা? দুতিনজনে প্রায় সমস্বরে বললো।
ফটিক মিস্ত্রি এবং ইউনুস সান্টারের কোয়ার্টার্স পাশাপাশি। ইউনুস মাঝে মাঝে ফটিকের ঘরের কথা বাইরে টেনে আনে; হাসাহাসি হয়। ফটিক নিঃসন্তান এবং স্ত্রীর উপরে তার মমতা সাধারণের চাইতে বেশি।
ইউনুস বললো, না, তেমন কী। ফটিকের কপালে কালি লাগে আছে। তা জয়হরি কয়, কাজল কীসের।
ফটিক বললো, কী কও তোমরা, কাজল কই? এঞ্জিনের কালি।
আমু তো তাই বলি। জয়হরি কয়, পাশের বাসায় থাকি বলে দোষ ঢাকতিছি। কে দোষ ঢাকার কী আছে? বউ যদি কারুকে কাজল পরায়, দোষ কী?
ফটিক তাড়াতাড়ি কাপড়ের খোঁট তুলে কপাল ঘষতে ঘষতে বললো, আরে এঞ্জিনের কালিও চেনো না; দাঁড়াও তোমাদের দেখাই, মবিলের গন্ধও পাবা।
কপাল ঘষে লাল করে কাপড়ের খোঁটটা চোখের সম্মুখে মেলে দেখলো ফটিক, এতটুকু কালির দাগ কাপড়ে ওঠেনি। এরা কিন্তু ফটিকের মুখের দিকে চেয়ে হাসতে লাগলো। ফটিক ভাবলো কালিটা বোধ হয় গালে লেগে আছে। আবার কাপড়ের খোঁট তুলে সে দুটি গালই ঘষতে লাগলো। এবার সকলেই হো হো করে হেসে উঠলো।
আবদুল গনি বললো, কে ভাই, তোমার মন এমন দুব্বল কেন্? ওরা ঠাট্টা করলো আর তুমি অমন করে মুখ ঘষলা!
ফটিক হাসতে হাসতে বললো, কওয়া যায় না, শালীর অমন সব আছে তুকতাক। কালি লাগায়ে দিলিও অবাক নাই। দেয় মাঝে মাঝে।
হাসি থামলে মাধাই আর একবার চেষ্টা করলো তার বক্তব্যটা উত্থাপন করতে, কিন্তু ততক্ষণে স্ত্রীদের নিয়ে কথা অত্যন্ত জমে উঠেছে।
জয়হরি পরম জ্ঞানীর মতো বললো, তা যা-ই বলল ভাই, ছেলেপুলে না-থাকলে শুধু। কাজলে সোয়ামীকে বউরা আটকাবের পারে না সবসময়।
মেহের বললো, ঠিক, ঠিক।
আবদুল গনি বললো, বিলকুল ঠিক।
মেহের বললো, চাচামিঞা, তোমার সেই কেচ্ছাটা কও।
আবদুল গনি বললো, কেচ্ছা আর কী, সামান্যই এক কথা।
না, না, কও।
আবদুল গনি বললো, তখন আমার যৈবনকাল। পনরো-ষোল বছরে বিয়েসাদি দিয়ে বাপ মনে করছিলো উড়ু উড়ু ছাওয়াল চাষবাসে মন দিবে। দুর! বলে চলে আসলাম। আট বছরের বউ, কালো কিটকিটা, জ্বরে ভোগা, ভাতের জন্যি দিনরাত কাঁদে এমন বউ। আসে এই লোকোশেডে কাম নিলাম। একটু একটু করে কাম শিখলাম। তখনকার দিনে আমি নাম সই করবের পারতাম না, তা চিঠি লেখা। আর চিঠি লেখবো কাকে? বাপ মা বউ কেউই অক্ষর চেনে না। আর বউ! বউ কয় নাকি আট বছরের সেই কালো কিটুকিটা মেয়েকে! দশ বছর বাড়ি যাই নাই, চিঠি দিই নাই। ততদিনে আমি সান্টার হইছি। মন কলো বাড়ি যাওয়া লাগে, বাপ-মা আছে না গেছে কে জানে! হঠাৎ বাপের জন্যি বড়ো কষ্ট হবের লাগলো। বাপ খুশি হবি জানলি–ছাওয়াল সাহেবের এঞ্জিন চালায়। অনেক পথ হাঁটে-হাঁটে যখন গাঁয়ে ঢুকলাম, তখন দেখি, ও মা, এ কী? গাঁয়ে ঢোকার পথে, বুঝছ না, নতুন এক খ্যাডের বাড়ি, ঝকঝকে বালিমাটিতে ভোলা নতুন বাড়ি, এক বর্ষাও পড়ে নাই তার গায়ে এমন, মনে কয় খ্যাড় পোয়াল থিকে ধানের বাসনা উঠবি। দেখি কি, সে বাড়ির দরজায় দাঁড়ায়ে এক কন্যে। কী যে রূপ! বুঝলা না, কটা-ফরসা না, কালো-কোলো, কিন্তুক রূপের বান; মনে কলো, নাকানিচোবানি খাওয়া লাগে তো এমন বানে। কিন্তু কার বাড়ি চিনবের পারলাম না। এ বাড়ি আগে ছিলো না এ পাড়ায়।
তোমার নিজের বউয়ের কী হলো, তার কথা কলে না?
আরে দুর, সেও নাকি এক বউ! আট বছরের মিয়ে বউ হওয়ার কী জানে। কিন্তুক বড়ো কষ্ট পালাম রে। বাড়ির কাছে যায়ে দেখি, বাড়ি নাই, ঘর নাই, চষা ক্ষেত সেখানে। হায় হায় করবের লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞাস করলাম-বাপ কনে, মা কনে? তুমি কেডা?-না, আবদুল গনি সান্টার, এইখানে আমার বাড়ি ছিলো। কেউ কলে, বাড়ি যে ছাড়ে আলে, তোমাক চিনি না, এইখানে যার বাড়ি ছিলো সে উঠে গেছে বড় সড়কের ধারে। ফিরে যায়ে দেখি সেই নতুন খ্যাড়ের বাড়ির দরজায় আমার বুড়া বাপ বসে। বাপ আর ছাওয়াল কাদাকাটা করলাম, মা আর ছাওয়াল কাদাকাটা করলাম, আর দেখি, ভাদুই পদ্মা, থমথম-যৈবন একমিয়ে।-আম্মা!–কী? না, ওই মিয়ে কার? তোমার সেই বেটাবউ কনে গেছে যাক, আমি কৈল ওই মিয়েক ছাড়বো না। কও, সম্মন্দে আটকাবি? আম্মা কয়–আটকাবি নে। সাঁঝকালে দেখি মিয়ে জল আনবের যায়। বুঝলা না, চুল বাঁধেছে, সুর্মা কনে পায়, সুর্মাও দিছে চোখে। সামনে আগায়ে কলাম–মিয়ে, পেরান আমার যায়।নাকী হলো, পোকায় কাটছে? না। তো কী? মিয়ে, তোমার ওই পরীমুখ দেখছি, ওই হাঁটন দেখছি, আর আমি বাঁচবো না। নজ্জা পায়ে সে কলোআমি যে নিকা করছি, ছোটোকালে একজনের সাথে নিকা হইছে। কই-যদি বাঁচে থাকে সে, তালাক দেও। সোভানাল্লা, কয় কী!না–তার কী অন্যাই। আমি দেখবের ভালোনা, সেজন্যি সে চলে গেছে, তাক আমি তালাক দিবের পারবো না। কাঁদেকাটে একছা হলাম, মিয়ের মন গলে না। ভাবলাম রাত্তিরে লুকায়ে পারি তো আরও দু’এক কথা কাটাকাটা করবো। আবদুল গনি হাসতে লাগলো, তার শাদা দাড়িগুলি সুন্দর দেখাতে থাকলো।
সেই মিয়ে?
না বুঝে থাকো, বুঝে কাম নাই।
জয়হরি বললো, আপনার সেই কালো কিটকিটা বউ?
সে-ই।
ইউনুস বললো, আরে কই হ্যাঁয়, লাগাও দুই বোতল আর।
আবার? মেহের প্রশ্ন করলা।
আড্ডা জমেছে আজ।
দোকানীর লোক যথোচিত ব্যবস্থা করলো।
মেহের বললো, আমার বউয়ের কথা আর কয়োনা।বিটি যে এমন ভালোবাসা কনে শিখলো কে জানে। কিন্তুক বড়ো রোগা হয়ে যাতিছে, কী করি বুঝি না।
জয়হরি বললো, ভাত, ভাত, পেট ভরে ভাত খাবের দিয়ো।
পাত্রে পাত্রে মদ পরিবেশন করে ইউনুস বললো, দুনিয়ার সার এই মদ, দুনিয়ার বার ওই মিয়েমানুষ। যদি কামে কাজে থাকবের চাও, যদি ওভারটাইম করবের চাও, একটু একটুক শরাব খাবা, তন্ দুরস্ত। আর যদি মন খারাপ হয়, ভাইসব, মনের মতো মিয়েমানুষ খুঁজে বার। করবা। মনের কথা তাক কয়ে হাল্কা হবা। দুনিয়া-ছাড়া হবা তা নিয়ে।
সেদিনের আড্ডায় সংঘের কথা হলো না। সে বারের মদের পাত্রগুলি নিঃশেষিত হলে আর কিছুকাল হাসাহাসি গালগল্প করে যে যার বাড়ির দিকে চলতে আরম্ভ করলো।
আবদুল গনি প্রথম কথা বলেছিলো, সে-ই শেষ কথা বললো, ভাই, বউ না-থাকতো যদি মক্কায় যাতাম; বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতাম। শালা, এই এঞ্জিন ঠেলে বেড়াতাম না। বাড়ি মানেই তো বউয়ের বাড়ি, কও? মাধাই, আবার আসেন একদিন। কী আনন্দই পালাম, কী আনন্দই দিলেন। যাতেছিলাম ডাল আলু কিনবের। বউ বকে তো চুপ করে থাকে পরে সেই পদ্মায় জল আনার কথা মনে করায়ে দেবো।
আবদুল গনির মাথার চারিদিকে না-হোর্ক, তার মুখে চোখে শাদা দাড়িতে শান্তির কিরণ চকচক করে উঠলো।
আবদুল গনি দলবল নিয়ে লোকোশেডের দিকে হাঁটতে শুরু করলো। একটা ছোটোখাটো চাঁদ উঠে পড়েছিলো, তার বাঁদর রঙের আলো পাথরের টুকরোর অমসৃণ পথে পড়ছে। ইঞ্জিনখানার কালিমাখা এই পুরুষ কয়েকটি তখনো সম্ভবত স্ত্রীদের নিয়েই আলোচনা করছে, তার ফলে তাদের হাসাহাসির শব্দ দূর থেকে কানে আসছে। এরা সুখী কিনা তা নির্ণয় করা কঠিন। সুখের কোনো জাত্যগুণ সহসা চোখে পড়ে না যে তার সংজ্ঞা নির্ধারণ করা যাবে। আত্মা যদি একটি কল্পনামাত্র হয়, সুখ ও দুঃখ তবে একই বিষয় : স্নায়ুর কুঞ্চন-প্রসারণমাত্র। এদের মধ্যে যে স্নায়ু-উৎক্ষেপগুলি আত্মবিস্তার ও আত্মরক্ষণের পক্ষে সহায়ক সেগুলিকে সুখ বলা যেতে পারে। বেঁচে আছি, বেঁচে আছি–এ অনুভবের চাইতে গভীর আর কোন অনুভূতি? মনের এ অবস্থায় রুগ্ন দেহকেও সবল বোধ হয়, প্রাচীন বটের পাশে দাঁড়িয়ে তার মতোই জীর্ণ ত্বকের গভীরে প্রাণস্পন্দিত মনে হয় নিজেকে। তখন সমুদ্র উদধি, সূর্য, বৃক্ষারণ্য, হিমাচল ও প্রাণ সখা হয়। আনন্দ ও হাস্য, পরে করুণার জন্ম। এগুলিকে জীর্ণ বা সংকীর্ণ করতে কোনো অসার্থকতাই যথেষ্ট বিদ্বেষপরায়ণ নয়।
চিন্তা-ভাবনা নির্জন না হলে আসে না। ফিরবার পথে জয়হরি বকতে বকতে চললো। তখন। চিন্তা না করে তার কথায় কান পেতে রাখতেই ভালো লাগলো মাধাইয়ের।
.
কিন্তু মাস্টারমশাই লোকটির ছাত্রদের উপরে অবশ্যই প্রখর দৃষ্টি ছিলো। পরদিন সকালেই সে উপস্থিত হলো।
ও পাড়ায় গিয়েছিলে মাধাই? কথাবার্তা হলো?
কথাবার্তা তেমন না, গল্পসল্প আর কি।
কীসের গল্প, মাধাই?
বলা কি উচিত হবে, ভাবলো মাধাই। মদ আর মেয়েদের কথা কী করে বলা যায় মাস্টারমশাইয়ের মতো লোককে।
বলো মাধাই, মেহনতি মজুরের লজ্জার কী আছে?
বউদের কথা হলো।
মাস্টারমশাই হেসে বললো, পৃথিবীর আধখানা বউরা, তাদের কথা বলতে লজ্জা নেই কিন্তু তার চাইতে বড় কথা, প্রথম দিনেই যারা তোমার সামনেবউদের নিয়ে আলোচনা করেছে তারা তো তোমার বন্ধু। রবিবারে খোঁজ রেখে আবার যেও।
মাধাই কাজে যাবার আগে পোশাক পরছিলো, তখন কথাটা মনে হলো তার। মাস্টারমশাই দু’কথায় আবদুলের সব কথা সমর্থন করেছে, জীবনের সঙ্গে স্ত্রীদের যে যোগটার কথা আবদুল গনি বলেছিলো সেটা তবে মূল্যহীন নয়।
গোবিন্দর কথা মনে হলো, আর সেই সুকন্যা না কী নাম যার সেই মেয়েটির কথা গোবিন্দবাবু কি তাকে সুখী করার জন্যেই চলে গেলো!
স্টেশনের পথে চলতে চলতে মাধাই চিন্তা করলো : তাই হয় বোধ হয়, বেঁচে থাকা তখনই ভালো লাগে যখন আপন একজন থাকে। সংঘের কাজে বিদ্বেষের নেশাটা আর তেমন ধরছে না। বাকিটুকু কর্তব্যের মতো, চাকরির মতো ভারি বোধ হচ্ছে। গোবিন্দবাবু বোধ হয় এ কথা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলো। মাস্টারমশাইয়ের অবশ্য এসবে দৃকপাত নেই, সব সময় অন্যের চিন্তায় ব্যস্ত, যেন সকলকেই পরীক্ষায় পাস করাবে।
কিন্তু মদ? কাজের ছোটোখাটো অনেক অবসরে কথাটা মনে পড়লো। মদ যদি খারাপ জিনিস হয় না, ভদ্রলোক ছি ছি করে ওঠে কেন? মন হাতড়াতে গিয়ে যে দৃশ্যটা সে খুঁজে পেলো সেটা ছি ছি করার মতোই। ধাঙ্গড়পাড়ায় রোজই দেখা যায়, রাস্তার পাশে মরার মতো স্ত্রী-রুষরা পড়ে আছে, মুখের উপর ভনভন করে নীল মাছি উড়ছে। কী কুৎসিত, কী ময়লা!
তবে মদ যে পথে পথে খেতে হবে এমন কথা নয়। সাহেবরা খায়, তারা খানায় পড়ে থাকে না। গোবিন্দবাবুও খান। তাহলেও–
মাধাই ‘তাইলেও’ কথাটা উচ্চারণ করে ফেলো চিন্তা করতে করতে। তাহলেও মদে কী হবে। মাধাই স্বচক্ষে দেখেছে স্পেশ্যাল ট্রেনের কাঁচের জানলা দিয়ে কাঁটা-চামচ, ভোয়ালের ফুল, কাঁচের আলোর সেই স্বর্গরাজ্যে বসে সাহেব-যোদ্ধারা মদ খেতে খেতে চলেছে। তখনো কিন্তু তাদের বসবার ভঙ্গিটিও নির্জীব। মুখের কথা বোলো না, যেন জোর করে কেউ তাদের পাঁচন খাওয়াচ্ছে।
মাস দু-তিন পরে আবার একদিন মাস্টারমশাই এসে বললো, ঘরে আছে মাধাই?
আসেন, প্রণাম হই।
কী হলো, মাধাই?
কই, তেমন কিছু আর কী!
খানিকটা সময় আলোচনা করে মাধাইকে কথার মাঝখানে পরিখা খুঁড়ে শক্ত হয়ে থাকতে দেখে একটু থেমে হাসি হাসি মুখে মাস্টারমশাই বললো, তুমি কি বাঁচতে চাও মাধাই?
আজ মাধাই অত্যন্ত দুঃসাহস প্রকাশ করতে বদ্ধপরিকর। সে বললো, তাই চাই।
বাঁচতে হলে ঘরদোর লাগে, অন্নবস্ত্র লাগে।
তা লাগে।
এখন যা পাচ্ছো তা যথেষ্ট নয়।
তা নয়।
যথেষ্ট পাওয়ার কী উপায়?
ঠিক জানি না, মাস্টারমশাই।
দল বেঁধে দাবি করতে হবে, দর কষাকষি করতে হবে। একসময়ে তুমি টাকার জন্য গোরুকে বিষ দিতে।
মাস্টারমশাই তার সম্বন্ধে কতদূর খবর রাখে জেনে মাধাই বিস্মিত হলো। কিন্তু ধীরভাবে বললল, আর কোনোদিনই কাউকে বিষ দেবো না।
এখনই বলা যায় না।
তা না যাক, টাকাতে সুখ হয় না। আপনার টাকা আমার চেয়ে বেশি।
আমি তোমার চাইতে সুখী কিনা এই তো তোমার প্রশ্ন?
বাবু, তা করা আমার অন্যাই। আমি পারিনে, ভালো লাগে না।
‘পরে একদিন আসবো’ বলে মাস্টারমশাই সেদিনের মতো চলে গেলো। কিন্তু মাধাই মাস্টারমশাইয়ের জন্য অপেক্ষা করলো না। ইতিমধ্যে একদিন লোকোশেড মহল্লায় গিয়ে এমন পরিশ্রম সে করলো যে সে খবর যখন মাস্টারমশাইয়ের কাছে পৌঁছলো তখন সে স্তম্ভিত হলো, কলকাতা শহর থেকে যে শ্রমিকনেতারা এসে পারস্পরিক নেতৃত্বের মহার্ঘতার প্রচার করছিলো তারাও বিপন্ন বোধ করলো সাময়িকভাবে।
কিন্তু ফিরতি পথে মাধাই একটা কাজ করে বসলো, সে খবর কারো কাছে পৌঁছলো না। রজনীর দোকান থেকে এক বোতল মদ কিনে কিছু খেয়ে কিছু সঙ্গে নিয়ে সে বাসার পথ ধরলো। গলা সুড়সুড় করছিলো। প্ল্যাটফর্মে উঠে অন্ধকার জায়গা দেখে আরও খানিকটা গলায় ঢেলে দিলো সে। বাসার কাছাকাছি পৌঁছতে পৌঁছতে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো তার। কিন্তু তার মধ্যেও মন যেন বল পাচ্ছে অনেকদিন পরে। সে সম্মুখের অন্ধকার শূন্যকে লক্ষ্য করে গর্জন করে উঠলো, এই ওপ।
নিজের ঘরের বারান্দায় বসে সে একটা সিগারেট ধরালো। কয়েক টান ধোঁয়া গিলে তার শরীর অস্থির হয়ে উঠলো। শরীরকে সুস্থ করার জন্য বোতলের বাকি মদটুকু সে চুষে চুষে খেলো। তার বোধ হলো সে আর বাঁচবেনা। চোখে জল এলো। অন্ধকারে শায়িত নিজের একটি বিপন্ন প্রাণকে যেন সে দেখতেও পেলো। তার মনে হলো মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হওয়া দরকার। ঘরে ঢুকে মাটিতে বসে বিছানায় মাথা রাখলো সে। দেহ ও মস্তিষ্ক একটি আচ্ছন্নতায় ডুবে যাচ্ছে। আচ্ছন্ন অবস্থায় মাধাই বিছানা থেকে ফসকে মাটিতে শুয়ে পড়লো। মূৰ্ছা ও ঘুমের মাঝামাঝি অবস্থায় সে কখনো কখনো ফোপাতে লাগলো, যেন তার একটি অন্তরাত্মা আছে, এবং সেটা অত্যন্ত ব্যথিত এবং তার চাইতে বেশি ভীত হয়ে কাঁদছে।