1 of 2

১৪. মধুসূদনের পদোন্নতি

কিছুদিন কেরানীর চাকুরির পর মধুসূদনের একটু পদোন্নতি হয়েছে। তিনি নিযুক্ত হয়েছেন পুলিশ আদালতের দ্বিভাষিকের পদে। বেতনও কিঞ্চিৎ বেশী। কিশোরীচাঁদ মিত্রের বাগান বাটীতেও আর অধিক দিন আশ্রিত হয়ে থাকা ভালো দেখায় না। কিশোরীচাঁদ এবং তাঁর পত্নী যতই খাতির যত্ন করুন, তবু পরের গৃহে কখনো পূর্ণ স্বস্তি পাওয়া যায় না, একটু আড়ষ্ট ভাব থাকেই। হাত থেকে পড়ে হঠাৎ একটি কাচের গেলাস ভগ্ন হলেই মনে হয়, বুঝি কোনো বৃহৎ অপরাধ হলো। গৃহস্বামী তখন যতবার বলেন, কিছু হয়নি, ততই লজ্জা বাড়ে।

কিশোরীচাঁদের জুড়ি গাড়িতেই মধুসূদন অফিস যাতায়াত করেন বটে, কিন্তু দমদম থেকে সেই লালবাজারে পৌঁছোবার জন্য বাটী থেকে বার হতে হয় অনেক আগে। কিশোরীচাঁদ নিয়মনিষ্ঠ মানুষ, ঘড়ি ধরে ঠিক কাঁটায় কাঁটায় দশটায় তিনি দফতরে পৌঁছোতে চান। মধুসূদনের জন্য দেরি হয়ে যায় মাঝে মধ্যেই। পূর্বরাত্রে অত্যধিক সুরা পান করলে পরদিন সকালে আর মধুসূদনের চক্ষু খুলতেই ইচ্ছে করে না। স্নানটান না করেই শেষ মুহূর্তে নাকে মুখে কিছু খাদ্য গুঁজে, কোনোক্রমে ধরা চুড়া চাপিয়ে মধুসূদন নিজ কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন। গৃহদ্বারের বাইরে কিশোরীচাঁদ তখন গাড়ির কৌচের মধ্যে অপেক্ষমান। তিনি অতিশয় ভদ্র, বিরক্তির চিহ্নমাত্র প্রকাশ করেন না, শুধু ওয়েস্ট কোটের পকেট থেকে গার্ড চেন লাগানো ঘড়ি বার করে বারবার দেখেন, তার ভুরুদ্বয়ে উতলা ভাবটি লুকোনো থাকে না। গাড়িতে উঠে মধুসূদন বারবার ক্ষমা প্রার্থনা করেন আর কিশোরীচাঁদ শীতল সভ্যতার সঙ্গে বলেন, না, না, ঠিক আচে, ঠিক আচে, মিঃ ডাট।

এ ছাড়া, প্রায়ই যে সান্ধ্য-আসরটি বসে কিশোরীচাঁদের উদ্যানে, সেখানেও মধুসূদন নিজেকে ঠিক মানিয়ে নিতে পারলেন না। তাঁর স্বভাবটি প্রায় দুরন্ত শিশুর মতন, যে-কোনো সমাবেশেই তিনি চান সকলের দৃষ্টি শুধু তাঁর দিকেই থাকুক, সকলে তাঁর সঙ্গে কথা বলুক। কিন্তু কিশোরীচাঁদের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা প্যারীচাঁদ এবং তাঁর বন্ধুবৰ্গ প্রায়শই গুরুতর বিষয় নিয়ে বাক্যালাপে ব্যাপৃত থাকেন। দেশোদ্ধার, সমাজোদ্ধার ইত্যাদি ব্যাপার মধুসূদনের পছন্দ হয় না। এঁরা বড় নীরস, এঁরা কাব্য বোঝেন না। এঁরা শব্দঝংকারের মাধুর্য আস্বাদন করতে জানেন না। মধুসূদন কখনো কখনো এঁদের সঙ্গে আলোচনায় যোগ দিতে গেলে, এঁরা বিদ্রূপ করেন, তাঁর মতামতের কোনো মূল্য দেন না। হয়তো খৃষ্টান বলেই মধুসূদনকে এঁরা সম্পূর্ণ আপনজন বলে গ্রহণ করতে দ্বিধা করেন। এঁদের সঙ্গ আর ভালো লাগে না। মধুসূদনের। এঁরা সকলেই তাঁর চেয়ে বয়েসে বড়, সেইজন্য খানিকটা ভারিকী ভাব দেখান, কিন্তু মধুসূদন কখনো বয়স্কদের ভারিকীপনা গ্রাহ্য করেননি। এঁরা জানেন না যে এখনকার এই পরাশ্ৰিত, সামান্য চাকুরিজীবী মধুসূদন এককালে এই কলকাতা শহরের বুকেই অহংকারের পদপাতে কাঁপিয়ে তুলতেন।

একদিন মধুসূদন কিশোরীচাঁদকে প্রস্তাব দিলেন যে তিনি এখন পৃথক ভাবে বাড়ি ভাড়া করে থাকতে চান। এ কথা শুনে কিশোরীচাঁদ বিস্মিত, তাঁর পত্নী দুঃখিত হলেন। তাঁরা বারংবার প্রশ্ন করতে লাগলেন, মধুসূদনের কী অসুবিধে হচ্ছে, ব্যবস্থাপনায় কোন ত্রুটি হয়েছে? অপরের বাড়িতে অতিরিক্ত আপ্যায়নও যে অনেক সময় অশান্তির কারণ ঘটায়, একথা বোঝানো ভারি শক্ত। মধুসূদন শুধু বললেন যে, অপর কোনো কারণে নয়, প্রায়ই বিলম্বে আদালতে যাওয়ায় তিনি কিশোরীচাঁদের বিঘ্ন ঘটাচ্ছেন তো বটেই, তাঁর নিজের চাকুরিও এভাবে রাখা দায়। চাকুরি বাঁচাতে হলে তাঁর কর্মস্থলের খুব কাছাকাছি থাকা দরকার।

সেইরকমই ব্যবস্থা হলো। মধুসূদন লালবাজার পুলিশ আদালতের অতি নিকটবর্তী লোয়ার চিৎপুর রোডের ছ নম্বর দ্বিতল গৃহটি ভাড়া নিলেন। এখান থেকে চাকুরি রক্ষা করার কোনো বাধা নেই। তিনি ঘুমিয়ে থাকলেও আদালত চালু হলেই পেয়াদারা এসে তাঁকে ডেকে নিয়ে যায়।

মান্দ্রাজে মধুসূদনের দ্বিতীয়া পত্নী আঁরিয়োত্তা স্বামীসঙ্গ লাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে ছিলেন। তাঁর স্বামী এখন স্বাধীনভাবে পৃথক গৃহে অবস্থান করছেন এই খবর পেয়েই তিনি চলে এলেন কলকাতায়। মান্দ্রাজের সঙ্গে পুরোপুরি সংশ্রব ত্যাগ করে এখানে মধুসূদনের সংসার নতুন ভাবে পাতা হলো।

পিতৃ-সম্পত্তির অধিকার এখনো পাননি মধুসূদন। পিতার কলকাতার বাড়ি, সুন্দরবনের লাট এবং সাগরদাঁড়ির বংশানুক্রমিক গৃহ, সবই এখন আত্মীয়-জ্ঞাতিদের দখলে। তারা মধুসূদনকে বিরাটভাবে মামলায় জড়িয়েছে, মামলা চালাতে গেলে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয় এবং সেজন্য মধুসূদনকে ঋণ করে যেতে হচ্ছে দু হাতে। শেষ পর্যন্ত পিতৃ-সম্পত্তি যদি উদ্ধার করা না যায়, তাহলে মধুসূদনকে অগাধ সলিলে ড়ুবে যেতে হবে।

পুলিশ আদালতে সামান্য দ্বিভাষিকের কাজ করে যে জীবন কাটানো যাবে না তা বুঝেছেন মধুসূদন। তিনি আইন শিক্ষা করতে শুরু করলেন। তিনি দেখেছেন, ইংরেজি জানা আইনজীবীদের প্রচুর উপার্জন। আইন শিক্ষা করলে তিনিও চাকুরি ছেড়ে অনায়াসে স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেন। অর্থ চাই, প্রচুর অর্থ, দু হাতে অর্থ ছড়াতে না পারলে কলকাতার সমাজে স্থান পাওয়া যায় না। যথেচ্ছ অর্থব্যয় করতে না পারলে মধুসূদনের মনেরও স্মৃর্তি হয় না। অভাবে অনটনে তাঁর মন যেন সকুচিত হয়ে যাচ্ছে। নতুন বাড়িতে এসে মধুসূদন কিছুদিনের জন্য কৃচ্ছসাধন করে, জীবনে শৃঙ্খলা এনে, মন দিয়ে চাকুরি এবং আইন শিক্ষা চালিয়ে যেতে লাগলেন। অবসর সময়ে এক পণ্ডিতের কাছে সংস্কৃত চাচাও শুরু করলেন তিনি।

গৌরদাস কার্যোপলক্ষে, কলকাতার বাইরে ছিলেন। ফিরেই পরদিন তিনি এলেন মধুসূদনের চিৎপুরের বাড়িতে।

সে বাড়ির অবস্থা দেখে তিনি স্তম্ভিত!

দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে আছে আদালতের এক পেয়াদা। দ্বিতলের এক কক্ষে আঁরিয়োত্তা ক্ৰন্দন করছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে, অন্য এক কক্ষে একটি আরাম কেদারায় অদ্ভুত ভঙ্গিতে শুয়ে আছেন মধুসূদন, কোমরের নিমের অংশ কেদারার বাইরে ঝুলছে, উধ্বঙ্গি মোচড়ানো। তবে মধুসূদন যে জেগে আছেন, তার প্রমাণ তাঁর হাতের জ্বলন্ত সিগারেট। কক্ষের মেঝেতে গড়াচ্ছে অনেকগুলি বীয়ারের বোতল, একটি ঝোল মাখা দূষিত তোয়ালে মধুসূদনের কণ্ঠে সংলগ্ন রয়েছে।

গৌরদাস ব্যাকুল ভাবে ডাকলেন, মধু, মধু!

মধুসূদন মুখ ফিরিয়ে গৌরদাসকে দেখলেন। একটুও উত্তেজিত হলেন না। নিরুত্তাপ গলায় বললেন, গৌর! হ্যালো, মাই বয়!

বেলা মাত্র এগারোটা, এই সময় মধুসূদনকে এমন নেশাচ্ছন্ন অবস্থায় দেখবেন, গৌরদাস আশাই করেননি। কাছে এগিয়ে এসে তিনি তাঁর প্রাণপ্ৰিয় সুহৃদের বাহু স্পর্শ করে বললেন, এ কী কছিস, মধু!

মধুসূদন বললেন, একটা ফেবার কত্তে পারবি, গৌর? আস্ক দ্যাট উওম্যান টু স্টপ ক্রাইং! প্লীজ!

গৌরদাস বললেন, কী হয়েচে? আমায় সব খুলে বল! আজি মঙ্গলবার, তুই আদালতে যাবিনি? আমি তো ভেবেচিলুম, তোকে বাড়িতে পাবো না। কোর্টে গিয়েই দ্যাকা কর্বো!

মধুসূদন হুংকার দিয়ে বললেন, তোরা আমায় ভেবেচিস কী? না, যাবো না! আই ওয়াজ নট বর্ণ টু বাঁ দা ড্যামনড্‌ ইনটারপ্রেটার অব দ্যাট ড্যামনড্‌ পুলিশ কোর্ট!

অন্য ব্যক্তির কণ্ঠস্বর শুনে আঁরিয়োত্তা এই কক্ষের দ্বারের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। তার বরতনুটি পাতলা, ক্ষীণ, অনেকটা যেন আইভি লতার মতন। মুখখানি কান্নায় কান্নায় রক্তিম।

আঁরিয়োত্তাকে দেখেই মধুসূদন এক লাফে কেদারা ছেড়ে উঠে পত্নীর সামনে জানু পেতে বসে কাতর কণ্ঠে ইংরেজিতে বললেন, আঁরিয়েৎ, আমার প্রিয়তমে, তুমি অশ্রু বর্ষণ করিও না! তোমায় কাঁদিতে দেখিলে আমার হৃদয় ভাঙিয়া যায়!

গৌরদাস বললেন, মধু, তোর ওয়াইফের সঙ্গে আমায় ইনট্রোডিউস করিয়ে দিবিনি?

মধুসূদন বললেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়! আঁরিয়েৎ, এই গৌর, ইহার কথা তোমাকে বহুবার বলিয়াছি! তুমি ইহাকে চক্ষে না দেখিলেও মনে মনে অবশ্যই চিনিতে পরিবে। এই গৌর, ইহার হাতেই আমার জীবন-মরণ নির্ভর!

এই বলেই মধুসূদন একটী বীয়ারের বোতল তুলে অতিশয় তৃষ্ণার্তের মতন দীর্ঘ চুমুক দিতে লাগলেন।

গৌরদাস বিনীতভাবে আঁরিয়োত্তাকে অভিবাদন করে বললেন, মহাশয়া, মধু মিথ্যা বলিতেছে। সে সম্প্রতি আমাদের কথার বাধ্য নহে। আপনি ক্ৰন্দন করিতেছেন কেন? আপনি শক্ত হউন। আপনি আসিয়াছেন, আর চিন্তা নাই। আপনি এবার শক্ত হাতে এই দুরন্ত মানুষটির রাশ ধরিবেন।

আঁরিয়োত্তা ধরা ধরা গলায় বললেন, প্রিয় বন্ধু, আমি এই নগরীতে কাহাকেও চিনি না, আমি অসহায়। ইনি কাহারো কথা শ্রবণ করিবেন না। নিজ শরীরের প্রতি অসম্ভব অত্যাচার করিতেছেন। কিছুতেই সংসারের অর্থ সঙ্কুলান হয় না। কী করিয়া কী করিব, জানি না!

গৌরদাস শুষ্ক মুখে বললেন, নিচে একজন পেয়াদা দণ্ডায়মান রহিয়াছে দেখিলাম। পাওনাদার নাকি?

আঁরিয়োত্তা বললেন, না, আদালত হইতে ডাকিতে আসিয়াছে। উনি যাইবেন না কহিতেছেন!

মধুসূদন ওষ্ঠ থেকে বোতলটি সরিয়ে বললেন, ঐ ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ রাই ইজ এ ড্যামনড স্লো কোচ, উহার সম্মুখে আমি বকবক করিতে আর কোনোদিন যাইব না।

গৌরদাস বললেন, তুই কোর্টের কাজ ছেড়ে দিবি, মধু? এখন এই অবস্থায় তবে তোর চলবে কী করে? বউকে এনিচিস!

মধুসূদন সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বীয়ারের বোতলটি সক্রোধে ছুঁড়ে মারলেন ঘরের এক কোণে। তারপর বললেন, ও, আমি ঐ কেরানীর কর্ম করিলেই তোরা সুখী হইবি? তোরা দুইজনে তাঁহাই চাস? ঠিক আছে, তবে চাপরাসিকে দাঁড়াইতে বল, আমি এখনি যাইব।

সামনের দিকে অগ্রসর হতে গিয়ে ঈষৎ টলে গিয়েও মধুসূদন আবার বললেন, হ্যাঁ, যাইব, তোমাদের খুশী করিবার জন্য আমি দাসত্ব করিব।

গৌরদাস বন্ধুকে ধরে ফেলে বললেন, থাক, থাক, আজ থাক। তোর চক্ষু দুটি লাল, মধু, মুখে গন্ধ ভুরভুর কচ্ছে, এই অবস্থায় কোর্টে কেউ যায়? তুই বরং আজ ছুটি নে। একটা চিঠি পাঠিয়ে দে পেয়াদার হাত দিয়ে!

—চিঠি? কে চিঠি লিখিবে? আমি সব কিছু লিখিতে ভুলিয়া গিয়াছি। আমি মৃত, আমি চলন্ত পেতাত্মা!

—দূর পাগল! আচ্ছা, আমি না হয় চিঠি লিকে দিচ্চি, তুই দস্তখৎ করে দে। নেশার ঘোরে মধুসূদন গৌরদাসকে জড়িয়ে ধরে তাঁর গণ্ডে এক প্রবল চুম্বন দিয়ে পত্নীর উদ্দেশ্যে বললেন, এই দ্যাখো, আঁরিয়েৎ, আমাদের পরিত্রাতা আসিয়াছে, আর কোনো চিন্তা নাই। সঙ্গে কিছু অর্থ আছে কি গৌর? আর কয়েক বোতল বীয়ার আনয়ন করিলে বেশ হয়! কাঁদিও না, আঁরিয়েৎ, বীয়ার পান করো, সব সমস্যা দূরীভূত হইবে।

আদালতে চিঠি পাঠাবার ব্যবস্থা করে গৌরদাস জোর করে মধুসূদনকে ঠেলে দিলেন স্নানের ঘরে। তারপর দাস-দাসীদের ডেকে ঘর পরিষ্কার করালেন। আঁরিয়োত্তা সংসার সম্পর্কে অনভিজ্ঞ এবং স্থানীয় ভাষা না জানায় দাস-দাসীদেরও পরিচালনা করতে পারেন না। গৌরদাস তাদেরও নির্দেশ দিলেন সব রকম।

মধুসূদন ও আঁরিয়োত্তাকে খাদ্য পরিবেশন করা হলো অবিলম্বে। মধুসূদন ছাড়বেন না, গৌরদাসকেও সঙ্গে খেতে হবে। অগত্যা তিনিও খেয়ে নিলেন ওদের সঙ্গে। এরপর দুজনকে ঘুমোতে দেবার জন্য তিনি বিদায় নিতে চান, কিন্তু মধুসূদন গৌরদাসের হাত টেনে ধরে রাখলেন। অনেকদিন পর গৌরদাসের সঙ্গে পাশাপাশি এক শয্যায় শুয়ে থাকার বাসনা হয়েছে তাঁর।

দুই বন্ধুতে শুয়ে শুয়ে অনেক সুখ-দুঃখের কথা হলো। নেশা অনেকখানি কেটে গেছে, তবু মধুসূদনের মনখানি নৈরাশ্যে ভরা।

 

মাদ্রাজ থেকে ফেরবার পর মধুসূদন বাংলা কথা একেবারেই বলতেন না। যেন বাংলা একেবারেই ভুলে গিয়েছিলেন। ইদানীং ইংরেজি শব্দ মিশিয়ে কিছু কিছু বাংলা বলেন। আদালতে তাঁকে আসামীদের বাংলা কথা শুনেই ইংরেজি অনুবাদ করতে হয়, এমনকি হাকিমের নির্দেশে সাক্ষীদের বাংলায় জেরাও করেন তিনি। তবু বাংলার প্রতি তাঁর অবজ্ঞার ভাব এখনো রয়ে গেছে।

আজ আঁরিয়েত্তাকে দেখে গৌরদাস প্রথমে একটু চমকে উঠেছিলেন। মধুসূদন মান্দ্রাজে গিয়ে রেবেকাকে বিবাহ করেছিলেন, তখন গৌরদাসকে অনেক উচ্ছ্বাসপূর্ণ ভাষায় বর্ণনা দিয়েছিলেন নিজের স্ত্রীর–রেবেকাকে উদ্দেশ করে কবিতাও লিখেছেন মধুসূদন, সুতরাং বন্ধুর স্ত্রীর সেই ছবিই অঙ্কিত আছে গৌরদাসের মনে।

কথায় কথায় গৌরদাস একবার জিজ্ঞেস করলেন, মধু, সেই রেবেকার কী হলো? আর তাঁর ছেলেমেয়ে?

মধুসূদন বললেন, সেই নীলকর সাহেবের বেটীর কতা তুই ফের আমায় রিমাইণ্ড করিয়ে দিসনি! আমায় সে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খেয়েচে!

—কিন্তু মধু, আমি তো শুনিচি ম্যাড্রাসের খৃষ্টানরা অধিকাংশই ক্যাথলিক, ওদের মধ্যে কি ডাইভোর্স হয়?

মধুসূদন গৌরদাসের হাত চেপে ধরে বললেন, গৌর, আই ফরবিড ইউ, রেবেকার প্রসঙ্গ আমার কাচে আর কোনোদিন রেইজ করবিনি! নেভার! দ্যাট চ্যাপিটার ইজ ক্লোজড!

–কিন্তু তোর ছেলেমেয়ে? শুনিচি, চারটি ছেলেমেয়ে হয়েছেল?

—গৌর, গৌর! প্লীজ! ও কথা থাক! কেন তুই আমার মনে দুঃখ দিতে চাস? ওদের কতা-আই ওয়ন্ট টু ফরগেট কমপ্লিটলি, আই ওয়ন্ট টু ইরেইজ ফ্রম মাই মেমারি-আঁরিয়েৎ-কে তোর পছন্দ হয়নি? শী ইজ এ ডিয়ার-তুই যতই-দ্য মোর ইউ গেট টু নো হার…

–হেনরিয়েটা সত্যই বড় কোমল ও কমনীয়া।

–হেনরিয়াটা নয়, আঁরিয়েত্তা! শী ইজ এ ফ্রেঞ্চ উওম্যান-রিয়েল ফ্রেঞ্চ, ইউরেশিয়ান নয়।–তুই একটা কাণ্ড দেকালি বটে মধু! একেবারে ফ্রেঞ্চ! এ দেশে অনেকের অনেক রকম কাণ্ডের কথা শুনিচি, কিন্তু আর কোনো নেটিভ কোনো ইউরোপিয়ান লেডিকে বিয়ে করেচে বলে শুনিনি! তুই-ই বোধহয় এদেশে প্রথম।

-গৌর, আরও অনেক বিষয়ে আমার এ দেশে প্রথম হবার কতা ছিল। কিন্তু তার বদলে আমি নেটিভ কোর্টে মুহুরিগরি করচি! আই উইল ডাই, অ্যাজ এ কমন ম্যান!

–অমন কতা কেন বলচিস! তোর অনেক কিচু এখনো বাকি। তোর প্রতি আমাদের কত আশা। তুই নাকি প্যারীচাঁদ মিত্তিরকে বলিচিলি, তুই বাংলায় লিখে ওনাদেরকে টক্কর দিবি?

—আরে দূর দূর!

—বলিসনি অমন কতা?

—আমি মচ্চি টাকার চিন্তায়, ওসব কতা এখন রেকে দে!

—তুই তো এখুন। কিচুই লিকিস না, মধু! ইংরেজিও লিকিস না! বাংলায় একবার চেষ্টা করে দ্যাক না-আজকাল কত ভালো ভালো লোক বাংলায় লিকচ্চেন!

—গৌর, আই ওয়ণ্ট মানি। দেয়ার মাস্ট বী। মোর মানি! দেয়ার মাস্ট বী। মোর মানি! আমার বাপের সম্পত্তি আমায় পেতেই হবে।

—সে তো পাবিই একদিন না একদিন! কিশোরীচাঁদবাবু অনেক চেষ্টা কচ্চেন। কিন্তু তা বলে অন্য কাজকন্ম তুই কিচু করবিনি? দ্যাক, রাধানাথ সিকদারও বাংলা ভুলে গোসলেন, কিন্তু তিনি তো এখন দিব্যি বাংলা লিকচ্চেন! তুই-ও ওঁদের মাসিক পত্রিকায় কিচু লেক না!

—গদ্য! হরিবল! ওঁরা ভয়ানক প্রোজোইক মানুষ। কাব্যের ধার কাচ ঘেঁষেন না। আর কী ডিস্টাস্টিং বাংলা প্রোজ ওঁরা লেকেন! দু-পাঁচ বাক্য দেকালেই গা জ্বলে যায়। তোরা ঐ গদ্য পড়িস কী করে?

—তুই ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগরের লেকা পড়ে দ্যাক! সে বড় ঝংকারাময়, তেমনই সরস!

—সেও তো গদ্য! আমি গদ্যই পছন্দ করি না, তাও আবার বাংলা? ছোঃ।

—মধু, তুই বাংলাকে এমন হেলাছেদা করিসনি! উচ্চশিক্ষিত, প্ৰতিভাবান ব্যক্তিরা বাংলা রচনায় আত্মনিয়োগ করেচেন!

মধুসূদন অসহিষ্ণুভাবে বালিশে চাপড় মারতে মারতে বললেন, রাইট মী অফ! আমাকে দিয়ে কিছুটি হবে না! আমি অপদাৰ্থ! আই অ্যাম এ ফেইলিওর! আমার কতা তোরা ভুলে যা!

-কী হচ্চে, মধু? তুই কি পাগল হয়ে গেলি?

—সরি, আই অ্যাম সরি, গৌর-

-মধু, তোকে একটা কতা বলবো? তুই অ্যাতদিন পর কলকাতায় এলি, আমি ভেবেচিলুম, সারা শহর তোকে মাতায় করে রাকবে! তুই ছিলি আমাদের গ্রহমণ্ডলীর মধ্যে জুপিটার। কিন্তু তুই নিজেকে এমন ভাবে গুটিয়ে রেকিচিস কেন? কোনো রকমে কোটের কাজ চালিয়ে যাচ্চিস, আর সারাক্ষণ বীয়ার খাস!

-আর কী কত্তে হবে?

–সোসাইটিতে তোর একটা স্থান করে নেওয়া দরকার!

—সোসাইটি মানে বড় বড় টাকাওয়ালা লোক। তাদের মধ্যে আমার মতন একটা কোর্টের ক্লার্ক! এ র‍্যাভেন অ্যামংগ দা পীককস? হাঃ-হাঃ-হাঃ।

—তুই র‍্যাভেন কেন হবি, মধু? তুই কবি!

—আমার গায়ের রংটা দেকচিস না? দাঁড়কাককেও হার মানায়!

মধুসূদন ফস করে আর একটি সিগারেট ধরিয়ে বললেন, তুই একটা ট্রাই কবি নাকি? দ্যাক না! গৌরদাস হাত নেড়ে বললেন, না, না, ও জিনিসে আমার ভয় করে! আমার বাবা গড়গড়াই ভালো। সে পাট তো তোর বাড়িতে রাকিসনি?

—ওসব ঝঞ্ঝাট কে রাখে! তুই একটা সিগারেট ট্রাই করে দ্যাক না, ভালো লাগবে।

—না রে, মধু, ঐ কাগজ পুরিয়ে তামাক টানা আমার সহ্য হবে না!

বাহুতে ভর দিয়ে খানিকটা উঠে বসে গৌরদাস আবার বললেন, শোন মধু, আজকাল শুধু টাকাওলা লোকেরাই সমাজের মাতা নয়। আরও কত রকম সামাজিক কাজ হচ্ছে। কত লোক দিকে দিকে স্কুল খুলচেন। কত সাহস করে বিদ্যেসাগরমশাই বিধবাদের বিয়ে দিচ্চেন। ঠাকুরদের বাড়িতে, সিংহদের বাড়িতে বাংলা থিয়েটার হচ্চে, বিদ্যাচচ হচ্চে, আমরা তাতেও তো যোগ দিতে পারি। দ্যাক, ইয়ং বেঙ্গলের দল এই সব কাজে এগিয়ে এসে যোগ দিচ্চেন, কিন্তু আমাদের হিন্দু স্কুলের ব্যাচ, তাদের কারুর ক্লানো আগ্রহ নেই। আমাদের কিছু কি করা উচিত নয় কা এক কাজ করব, মধু?

–কী?

–চল, আজ আমার সঙ্গে যাবি? আজি সন্ধ্যেবেলা বিদ্যেসাগরমশাই এক কায়স্থ বংশের বিধবা মেয়ের বিয়ে দিচ্চেন। চল, আমরা সেখানে যাই। বেশীর ভাগ লোকই এখুনো বিধবার বিয়ে মানতে চাইচে না, টিটকিরি কাটে, এই সময় বিদ্যেসাগর মশাইয়ের পাশে আমাদের দাঁড়ানো উচিত নয়?

মধুসূদন পুরো প্রস্তাবটিকেই একেবারে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, আরে দূর, দূর! ও সব হুজুগে ব্যাপারে। আমি নেই। বিধবার বিয়ে একটা ব্যাপার তাই নিয়ে আমায় আবার মাতা ঘামাতে হবে? ছোঃ! গৌর, তুই আমায় এত অর্ডিনারি মনে করিস?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *