১৪. মণীশকে দেখে ভাস্কর সত্যিকারের অবাক

মণীশকে দেখে ভাস্কর সত্যিকারের অবাক হয়ে গেল। তাকে ভেতরে ডাকতে ভুলে গিয়ে বলল, তুই?

মণীশ বলল, হ্যাঁ চলে এলাম। তুই কোথাও বেরোচ্ছিস নাকি?

সকাল ন-টা, ভাস্কর তখন অফিসে বেরোবার জন্য তৈরি হচ্ছিল। বলল, একটু পরে যাব, আয়।

ভেতরে ঢুকে পরপর ঘরগুলো বন্ধ দেখে মণীশ জিজ্ঞেস করল, বাড়িতে কেউ নেই নাকি? মাসিমা-মেলোমশাই কোথায়?

ওঁরা পুরীতে বেড়াতে গেছেন।

মণীশ প্রফুল্লভাবে বলল, যাক। ভেবেছিলাম হয়তো শুনব, দু-জনেই টেসে গেছেন। বয়েস হয়েছে তো!

ভাস্কর একটু হাসল। মণীশের বরাবরই এ-রকম চমকানো কথা বলার অভ্যেস।

–একা আছিস? বিয়ে করিসনি?

—না! তুই তো শিলং-এ ছিলি এতদিন। আমি খবর পেয়েছিলাম।

—পাবি না কেন? গোপন তো কিছু নয়। আমি শিলং-এ-ই সেটল করব ভাবছি। ভাস্করকে কিছু বলতে হল না, মণীশ নিজেই চলে এল ভাস্করের নিজস্ব ঘরে। নীচু খাটটার ওপর ধপাস করে বসে লম্বা ঠ্যাং দুটো ছড়িয়ে দিল। তারপর এদিক-ওদিক দেখতে লাগল অনেকক্ষণ ধরে। নাকটা কুঁচকে আছে।

কী দেখছিস?

দেখছি, পুরোনোকালের গন্ধ পাওয়া যায় কি না।

-তুই মাত্র তিন বছর ছিলি-না এখানে।

–আমার কাছে এই তিন বছরটাই অনেক লম্বা। চা বানাবারও লোক নেই?

–সকাল বেলা ঠিকে ঝি আমার চা বানিয়ে দিয়ে গেছে। তুই চা খাবি? আমি বানিয়ে দিচ্ছি।

তুই এ-রকম একা আছিস জানলে তোর এখানেই এসে উঠতাম। তোর এই খাটটাতে তো আমি অনেকদিন শুয়েছি।

ভাস্কর একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, তুই কোথায় উঠেছিস তাহলে?

হোটেলে। কাল রাত্রে এসে পৌঁছেচি। আগে থেকে বুক করা ছিল না, ভালো হোটেলগুলোতে জায়গাই পাওয়া যায় না।

বাড়িতে যাসনি এখনও?

না, বাড়িতে কেন যাব? বাড়ির সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক?

একটু থেমে থেকে ভাস্কর বলল, আমি ভাবলাম, এতদিন পরে রিটার্ন অব দা প্রডিগাল সান।

বাড়ি-ফাড়ি আর কিছু নেই আমার জীবনে। কলকাতা শহরটাকে ভালোবাসি, বেশিদিন ছেড়ে থাকলে মন কেমন করে, তাই বেড়াতে এলাম একবার–

মণীশ, তুই এখনও হাই-স্ট্রং হয়ে আছিস।

আমি তো বরাবরই এইরকম।

বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে বরাবরের জন্য কেউ বাইরে চলে যায়? তোর মা ভাই-বোনদের সঙ্গেও দেখা করতে ইচ্ছে করে না?

খুব সংক্ষেপে না বলে মণীশ সিগারেট ধরালো। ভাস্করের ছবিগুলোর দিকে চোখ বোলালো খানিকক্ষণ। তারপর বলল, তোর ইচ্ছে করে না, তোর ভাই-বোনদের সঙ্গে দেখা করতে?

আমার আবার ভাই-বোন কোথায়?

তাহলে? তোর ভাই-বোন নেই, আমারও না-থাকতে পারত। কিংবা মরে যেতে পারত। মোটকথা, ওদের কথা আর আমার মনে পড়ে না।

আমি বিশ্বাস করি না তোর কথা। কোনো মানুষই তার মাকে অন্তত ভুলতে পারে না।

—আমি বিশ্বাস করতে চাই, আমি আমার জন্মের জন্য কারুর কাছে ঋণী নই, কোথাও আমার কোনো বন্ধন নেই, আমি স্বাধীন, আমি নিজের ইচ্ছেমতন বাঁচব কিংবা মরব।

এটা স্বার্থপরের মতন কথা।

হতে পারে। আমি সত্যিই স্বার্থপর। কোনো বাবা-মা-ই পরিকল্পনা করে কোনো সন্তানকে পৃথিবীতে আনে না। তারা এসে যায়। আমি পঙ্গু হতে পারতাম, অন্ধ হতে পারতাম, অল্প বয়েসে মরে যেতে পারতাম।

তুই সুস্থ শরীরে বেঁচে আছিস।

ঠিক তাই। আঠাশ বছর বাপ-মায়ের সঙ্গে কাটিয়েছি। তাদের স্নেহ দেখাবার কিংবা শাসন করবার সুযোগ দিয়েছি। তাই কি যথেষ্ট নয়?

ভাস্কর আরও কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। মুখে ফুটে উঠল সামান্য বিরক্তির ছায়া। মণীশ তার মুখের দিকে খরচোখে চেয়ে আছে।

আর কিছু বলবি না?

আমি তোর সঙ্গে তর্ক করতে যাচ্ছিলাম। বোকার মতন তোকে উপদেশ দিচ্ছিলাম। কিন্তু তোর যা-ইচ্ছে তাই করবি, তাতে আমার কী আসে যায়? শুধু এইটুকু বলতে পারি, তুই কোনোদিন সুখ পাবি না।

সুখ চাহি নাই মহারাজ, জয় চেয়েছিনু…।

শিলং-এ কী করছিস, ব্যাবসা?

হ্যাঁ। প্রথম কিছুদিন ভ্যাগাবণ্ডের মতন ঘুরেছি। তারপর গৌহাটিতে একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। তার পাশে বসে থেকে অ্যাসিস্ট্যান্টগিরি করতাম। তারপর ড্রাইভিং শিখে নিয়ে ট্যাক্সি চালাতে শুরু করলাম। এখন আমার নিজেরই দু-খানা ট্যাক্সি, তা ছাড়া অর্ডার সাপ্লাই শুরু করেছি।

এরপর বাকিজীবনটা শিলং-এর অর্ডার সাপ্লায়ার হয়ে কাটিয়ে দিবি?

উঁহু। বিজনেস আর একটু বাড়লে কলকাতাতেও অফিস খুলব।

তারপর দিল্লিতে অফিস খুলবি। মুম্বইতে অফিস খুলবি। বিরাট একটা শিল্পপতি হয়ে যাবি, তাই না?

সাউণ্ডস রিডিকুলাস? হিন্দি সিনেমা?

মণীশ নিজেই হেসে উঠল। সে বেশ উপভোগ করছে ব্যাপারটা। জুতোেসুদ্ধ পা মাটিতে ঠুকতে ঠুকতে বলল, আমাদের ভারতীয় দর্শনটাই হল ত্যাগের। এটা একেবারে মজ্জায় মজ্জায় মিশে আছে। কেউ যদি হঠাৎ বেশ টাকাপয়সা রোজগার করতে শুরু করেন, অবস্থাপন্ন হয়ে যান—ব্যাপারটা অন্য কারুর পছন্দ হয় না। ঠিক হিংসে নয়, অন্যরা ব্যাপারটা ভালগার মনে করে। মনে করে যে লোকটা আর খাঁটি নেই। আপনি আপনি বড়োলোক হয়ে যাওয়াটা সবাই পছন্দ করে—লটারির টিকিট কিংবা গুপ্তধন পেয়ে—কিন্তু চেষ্টা করে বড়োলোক হওয়াটা কেউ পছন্দ করে না।

তুই তাহলে বড়োলোক হয়েছিস? হতে চলেছি।

হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে মণীশ বলল, কী আজেবাজে ছবি এঁকেছিস? তোর আঁকার হাত খুব খারাপ হয়ে গেছে।

ভাস্কর আহত বোধ করল। মণীশের স্বভাবটা কাঁকড়াবিছের মতন। কাছাকাছি কেউ থাকলে দংশন করবেই। ভাস্করের অভ্যেস আছে, কিন্তু আর সব কিছু সহ্য করলেও ছবির নিন্দে তার গায়ে লাগে। খানিকটা শ্লেষের সঙ্গে বলল, তুই আবার ছবির বোদ্ধা হলি কবে থেকে?

মণীশ হাসতে হাসতে উত্তর দিল, বড়োলোকরাই তো ছবির সমঝদার হয়। এদেশের শিল্পীরা কখনো গরিবদের জন্য ছবি আঁকে?

ভাস্কর উঠে দাঁড়িয়ে ঘড়ি দেখল।

আমাকে তো এবার অফিসে যেতেই হবে।

মণীশ তার হাত ধরে টেনে বলল, আরে বোস।

ভাস্কর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, আমি তোকে চা করে দিচ্ছি। তারপর তুই এখানেই থেকে যেতে পারিস।

বোস না। তোর সঙ্গে গল্প করতেই তো এলাম।

আমি অফিসে গিয়ে ইন্দ্রাণীকে ফোন করে দিচ্ছি। ও যদি চলে আসতে পারে।

মণীশ গম্ভীরভাবে বলল, আমি ইন্দ্রাণীর সঙ্গে দেখা করতে চাই না।

ভয় পাচ্ছিস?

আমি মেয়েছেলে-ফেয়েছেলেদের একদম সহ্য করতে পারি না।

ইন্দ্রাণী মেয়েছেলে নয়। শুধু মেয়ে।

আমার ল্যাঙ্গুয়েজে তোর আপত্তি?

তুই অনেক বদলে গেছিস, মণীশ। স্বা

ভাবিক।

তুই হঠাৎ কলকাতায় এলি কেন?

তোদের জ্বালাতে।

ইন্দ্রাণীকেও?

তোকে তো বললাম, মেয়েদের সম্পর্কে আর আমার কোনো আগ্রহ নেই, ইন্দ্রাণী সম্পর্কেও না।

তোর আসল অভিমানটা কার ওপর? তোর বাবার ওপরে, না ইন্দ্রাণীর ওপরে?

অভিমান? অভিমান তো মেয়েদের হয়। পুরুষমানুষের আবার অভিমান কী? অবশ্য সংস্কৃতে অভিমান মানে অহংকার, সেটা যদি বলিস তো তা আমার নিশ্চয়ই আছে।

কেন লুকোচ্ছিস? আমার কাছে তুই সব কথা খুলে বলতে পারিস না?

বলবার কিছু নেই। আমার বাবার সঙ্গে আমার মতে মিলত না, প্রায়ই ঝগড়া হত, একদিন আমার গায়ে হাত তুলেও ছিলেন, তাই আমি বাড়ি ছেড়ে চলে গেছি। ইন্দ্রাণী সম্পর্কে একসময় আমার দুর্বলতা ছিল, ছেলেমানুষি ব্যাপার, সেটা এখন কেটে গেছে। ব্যাস, এই তো!

না, এ-ই সব নয়। আসলে তুই ভীষণ চাপা। নিজেকে কিছুতেই খুলে ধরতে পারিস না।

খুলে ধরার কী আছে? আমার বাবার সঙ্গে আমার বিরোধটা আদর্শগত। উনি চান সভাবে গরিব হয়ে থাকতে। আমার কাছে সেটা মনে হয় বোকামি। আর সব শুয়োরের বাচ্চারা যে যা পারছে লুটে নিচ্ছে আর আমি সততার নাম করে আঁটি চুষব?

বুঝলাম। এটা তো গেল তোর বাবা সম্বন্ধে। আর ইন্দ্রাণী সম্পর্কে হঠাৎ মন বদলালি কেন?

বিয়ার খাওয়াবি? কাছাকাছি দোকান নেই?

এই সকাল বেলা বিয়ার?

সন্ধ্যে হলে হুইস্কি খেতে চাইতাম।

এসব বুঝি শিলং-এর অভ্যেস?

হ্যাঁ। তা ছাড়া উঠতি বড়োলোক, সাপ্লাইয়ের ব্যাবসা, তার সঙ্গে এটা খুব মানিয়ে যায় না?

তারা নানা ধরনের মেয়ে নিয়ে ফুর্তিও—

ওটা শুধু আমার চলে না।

আমারও অফিসের দিন সকাল বেলা বিয়ার চলে না।

ভাস্কর, আমার কলকাতায় এত বন্ধুবান্ধব ছিল, আমি শুধু তোর কাছেই এসেছি।

তোকে একটা কথা বলব মণীশ? তুই ইন্দ্রাণীকে ভুল বুঝেছিস। তুই আমাকেও ভুল বুঝেছিলি।

কিছুই ভুল বুঝিনি।

ইন্দ্রাণী আমার বোন। ওকে আমি খুব ভালোবাসি ঠিকই কিন্তু সেটা স্নেহেরই আর একটা নাম। এই আমি আমার ছবি ছুঁয়ে বলছি, কিংবা তুই যেকোনো প্রতিজ্ঞা করতে বল, ইন্দ্রাণী সম্পর্কে আমি অন্য কিছু কক্ষনো ভাবিনি।

এক টুকরো মাংস নিয়ে দু-টো কুকুর ঝগড়া করে। আমি কুকুর হলে তোর সঙ্গে ইন্দ্রাণীকে নিয়ে ঝগড়া করতাম।

তুই ওরকমভাবে বলিস না। প্লিজ মণীশ, আমি আন্তরিকভাবে বলছি, তুই ইন্দ্রাণীকে সেই সময়ে বিয়ে করলে আমি সত্যিই খুশি হতাম। এমনকী এখনও।

ব্লাডি ফুল।

মণীশ—

নে চল ওঠ, তুই অফিসে যাবিই যখন, আমিও বেরোই তোর সঙ্গে।

না, তুই থাক। আমি ইন্দ্রাণীকে খবর দিচ্ছি।

খবর পেলেই সে ছুটে আসবে? আলুথালুভাবে? বিরহিণী রাধিকা? কেন, এর মধ্যে সে আর কারুর সঙ্গে প্রেম করতে পারেনি?

ইন্দ্রাণী আর কারুর সঙ্গে মেশে না।

কেন মেশে না? চেহারাটা তো মন্দ নয়, অনেক ছেলের কাছেই অ্যাটট্র্যাকটিভ মনে হবে।

তুই একসময় তো ওকে ভালোবাসতিস। তুই ওর সম্পর্কে এ-রকমভাবে কথা বলতে পারিস।

খারাপ কী বলেছি?

ও এখনও তোকে মনে রেখেছে।

সো হোয়াট? শি ডিজার্ভস আ গুড হাজব্যাণ্ড। অনেকটা তোর মতন কেউ যদি

তুই তো ওর নেচার জানিস। খুব বেশি বাড়ি থেকে বেরোনো কিংবা কোথাও গিয়ে হইচই করা—এসব ঠিক ওর ধাতে নেই। তাহলে আর অন্য কারুর সঙ্গে ওর আলাপ হবে কী করে?

জানি। ও যদি এখনও পর্যন্ত আর কারুর সঙ্গে প্রেম না করে থাকে, তবে তার কারণ আমি নই। তার কারণ তুই।

মণীশ, বিশ্বাস কর, নিজের বুকে হাত দিয়ে বলছি।

শাট আপ! আমি বোকা নই!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *