বিভ্রাট
মহাকাশযান বাসলার মহাশূন্যের সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। এখন বাসলার রয়েছে সিরি গ্রহের বন্দর ঘাঁটিতে। আগামী কদিন এই বন্দরটিতে থাকবে মহাকাশযানটি। এই বন্দরে বাসলারের নাবিকেরা বিশ্রাম নেবার সুযোগ পাবে। দীর্ঘ যাত্রায় তারা অনেকটাই ক্লান্ত আর অবসন্ন হয়ে পড়েছে। এ ধরনের অবিরাম যাত্রায় এক ধরনের চাপা উদ্বেগ সবসময় মিশে থাকে। নাবিকদের স্নায়ুর ওপরে যথেষ্ট চাপ পড়ে। তাই মহাশূন্যের কোনো বন্দরের ঘাঁটিতে অবতরণের ঘটনা ঘটলে যানের নাবিকেরা আনন্দিত হয়। তারা এক ধরনের উল্লাস অনুভব করে।
বসলার যানের ক্যাপ্টেন ম্যাকনট তার কেবিনে বসে দূরের একটি ছায়াপথের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য নির্দেশিকা দেখছিলেন। এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করেন জাহাজের প্রধান বেতার কর্মকর্তা বারমান। তার মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। একটা ঘনসবুজ কাগজের টুকরো বাড়িয়ে দেয় ক্যাপ্টেন ম্যাকনটের সামনে।
কিছুক্ষণ আগে এই বার্তাটি এসেছে।
ক্যাপ্টেন সবুজ কাগজের ওপর চোখ বুলালেন। বার্তাটি এসেছে মহাকাশ স্টেশনের প্রধান কেন্দ্র টেরার থেকে। তাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, নতুন কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত বাসলার থাকবে সিরি বন্দরে। আগামী ৭ তারিখে বাসলার পরিদর্শনে আসছেন প্রধান পরিদর্শক রিয়ার এডমিরাল ক্যাসিডি। বার্তাটি পেয়ে ক্যাপ্টেনের মুখ কেমন যেন শুকিয়ে গেলো। তার এই ধরনের ভাবান্তর লক্ষ্য করে বারমান জিজ্ঞেশ করে, কোনো সমস্যা দেখা দিয়েছে নাকি?
ক্যাপ্টেন বললেন, সমস্যা হচ্ছে গিয়ে প্রধান পরিদর্শক এই ক্যাসিডি। তিনি আবার ভীষণ খুঁতখুঁতে স্বভাবের। সন্দেহবাতিকগ্রস্ত। তিনি এসে এই মহাকাশযানের একটা আলপিন পর্যন্ত গুনে দেখবেন। যদি কম হয় তবে তা লগ বইতে লেখা রয়েছে কিনা এবং পূর্বে কেন্দ্রকে জানানো হয়েছিল কিনা তাও যাচাই করবেন। কোনো একটি জিনিশ বেশি হওয়া যাবে না। কম হলেও আবার ঝামেলা। কোনো ধরনের ত্রুটি বিচ্যুতি দেখলেই ক্ষিপ্ত হবেন।
ক্যাপ্টেনের কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে যায় বারমান। তিনি এ ধরনের আচরণ করবেন কেন?
কারণ তার স্বভাবটাই যে হচ্ছে এ ধরনের। এ জন্য সবাই তাকে ভয় পায়। তার পরিদর্শনে আসার কথা শুনলে রীতিমতো তটস্থ হয়ে থাকে।
তাহলে আমাদের এখন করণীয় কি?
হাতে মাত্র আর ৩ দিন সময় রয়েছে। এর মধ্যে আমাদের যানের প্রতিটি জিনিশের তালিকা ধরে মিলিয়ে রাখতে হবে। আমি এখনি এই তালিকার কাজটি শুরু করতে চাই।
ক্যাপ্টেন ম্যাকেট যানের একজন স্ক্রু পাইককে জাহাজের জিনিশগুলোর তালিকার ফাইলটি নিয়ে আসতে বললেন।
পাইক ফাইল নিয়ে আসা মাত্রই ক্যাপ্টেন তার কেবিন থেকে বেরুলেন।
চলো, তালিকা নিয়ে সবকিছু মিলিয়ে দেখি ।
বাসলারের উজ্জ্বল করিডর দিয়ে তারা দুজন এগিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন স্থান থেকে রঙিন আলোর বিচ্ছুরণ হচ্ছে। তাদের পেছনে লেজ নেড়ে আসছে মহাকাশযানের সরকারি কুকুর পিকে। কুকুরটির গলায় ঝুলছে বন্ধনী। তাতে খোদাই করে লেখা রয়েছে, বাসলারের সম্পত্তি।
মহাকাশযানের একেবারে আগার দিকে থেকে জিনিশ মেলানোর কাজ শুরু করলেন ক্যাপ্টেন ম্যাকনট। পাইকের হাতে ধরা রয়েছে তালিকাটি। ক্যাপ্টেন এক এক করে সবকিছু মিলিয়ে দেখে নিচ্ছেন। এক সময় তারা ঢুকলেন জাহাজের পাকশালাতে। তাদের দেখতে পেয়ে প্রধান পাচক ব্রাশাউ এগিয়ে এলো। ক্যাপ্টেন তালিকা থেকে পড়ছেন, ডি-১০৯৭। এনামেলের পাত্র একটি।
ব্লাশার্ড জানাল, ঠিক আছে।
এরপর ক্যাপ্টেন পড়লেন, ডি = ১০৯৮। একটা অফগ। এবার অবাক হলেন ব্লাশার্ড।
অফগ। এ নামে তো এখানে কোনো জিনিশ নেই। কখনও ছিল । আমি তো এ ধরনের নাম এই প্রথম শুনলাম।
ক্যাপ্টেন ম্যাকনট খানিক রেগে গেলেন। বলছো কি? তুমি এ রকমের নামই শোনননি।
ব্লাশার্ড জানায়, ঠিক। আমার কাছে পুরোপুরি অচেনা লাগছে এই নাম।
ক্যাপ্টেন ম্যাকনট তখন প্রধান পাচকের সামনে তালিকাটি খুলে ধরেন।
এইখো এখানে স্পষ্ট লেখা রয়েছে একটা অফগ। আমরা যখন ৪ বছর আগে মহাশূন্যে পাড়ি দেই তখনি এই তালিকাটি প্রস্তুত করা হয়েছিল।
ব্লাশার্ড জানান, তার পাকশালাতে এ নামের কোন জিনিশই আসলে নেই। হয়তো জাহাজের অন্য কারোর বিভাগে রয়েছে।
হতে পারে। বোধ হয় বারমানের বিভাগের হবে। ঠিক আছে, এর মধ্যে বাকিগুলো মিলিয়ে দেখছি। যেমন ধরো কুকুর পিশ্লেকের গলায় একটা কলার আছে। ডি-১০৯৯। এর পরের নম্বরের অফগটাকে আর পাওয়া গেলো না।
ক্যাপ্টেন ম্যাকনট ঢুকলেন বেতারকক্ষে। বারমানকে জিজ্ঞেশ করলেন, রান্নাঘরের তালিকাতে অফগ বলে একটা জিনিশ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো ওটা তোমারই কোনো জিনিশ হবে।
বারমান জানায়, পাকশালাতে হলো ব্লাশাউর্ডের স্থান। ওখানে আমার জিনিশ থাকবে কেন?
থাকতেও তো পারে। তোমার জিনিশও রয়েছে ওখানে। তোমার জিনিশগুলো কী সব অদ্ভুত গোচরে সব নাম। যেমন অপার-পপার, ডিডিন-পিডিন। দেখো গিয়ে এই অগটাও তোমার না হয়ে যায় না।
বারমান প্রতিবাদ করে, বিশ্বেস করুন ক্যাপ্টেন আমি ও নাম জীবনেও শুনিনি।
ম্যাকনট এবার বেশ বিরক্ত। শোনোনি তো কী হয়েছে। এটা অফগন এবারে বানিয়ে ফেললা। ক্যাসিডি এসে যখন তালিকা দেখে জিনিশটাকে খুঁজে পাবে না তখন কী ধরনের অবস্থাটা একবার দাঁড়াবে তা কি তুমি বুঝতে পেরেছে।
বারমানকে এবার খানিকটা অসহায়ের মতো দেখায়। কিন্তু ওই অফগ নামের জিনিশটা যে কী কাজে আসে সেটাই তো আমার জানা নেই।
তুমি যে রকম জানো না আমার তো মনে হয় ক্যাসিডিও তা জানে । সে তো শুধুমাত্র তালিকাটিকে মিলিয়ে দেখবে । তুমি অফগ নামে যা হোক একটা কিছু তৈরি করে দাও। আমি আগামীকাল বিকেলে যেন সবকিছু প্রস্তুত থাকতে দেখি।
বারমানকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ক্যাপ্টেন ম্যাকনট বেরিয়ে গেলেন।
মহাকাশযানসমূহের প্রধান পরিদর্শক রিয়ার এডমিরাল ক্যাসিডি ৭ তারিখের সঠিক সময়টিতে সিরি বন্দরের ঘাঁটিতে অপেক্ষমান বাসলার জাহাজে এসে উপস্থিত হলেন। ক্যাপ্টেন ম্যাকনট তাকে অভ্যর্থনা জানালেন। খুবই সম্প্রতি ধরনের মানুষ এডমিরাল ক্যাসিড় জাহাজে পৌছামাত্র শুরু করে দিলেন পরিদর্শনের কাজ। তিনি বাসলারের আগার দিকে থেকে কাজ শুরু করলেন। ক্যাপ্টেন ম্যাকনটের সাথে জাহাজের উজ্জ্বল করিডর ধরে এগিয়ে চলেছেন।
এড, ক্যাসিডি। তাদের পেছনে পেছনে লেজ নাড়তে নাড়তে আসছে কুকুর পিকে।
কুকুরটিকে দেখতে পেরে ক্রাসিডি আদর করে তার লোমশ পিঠটি চাপড়ে দিলেন। পিশ্লেকের গলার বন্ধনীতে খোদাই করা লেখাগুলো পড়লেন। পিশ্লেক তাকিয়ে রয়েছে জুলজুল করে।
ক্যাসিডি হেসে বললেন, বাঃ বেশ চমৎকার কুকুর তো ।
এডমিরাল ক্যাসিডে প্রথমে ঢুকলেন বো-কেবিনে । তালিকা ধরে ধরে জিনিশগুলো মেলানোর কাজ শুরু করলেন।
কে-১। একটা বড় কম্পাস।
এই যে।
কম্পাসটা কি সঠিকভাবে কাজ করছে?
করছে।
এডমিরাল ক্যাসিডি কেবিনের প্রতিটি জিনিশ এক এক করে দেখলেন। তালিকার সাথে মেলালেন।
এরপর তারা ঢুকলেন পাকমারায়।
ডি-১৪৭। একটা বৈদ্যুতিক চুল্লী।
এই যে। প্রধান পাচক ব্লাশার্ড দেখায়।
ক্যাসিডি জানতে চান, চুল্লীটি কী ঠিকমতো কাজ করছে? ব্লাশার্ড অনুযোগ করেন, চুল্লীটি আকারে বেশ ছোট। আর এই পাকশালার জায়গাটাও ছোট। যথেষ্ট অপরিসর। চাহিদার তুলনায় জায়গা অনেকটাই কম। তাই এখানে ঠিকমতো কাজ করা যায় না। যথেষ্ট অসুবিধে হয়।
এডমিরাল ক্যাসিডি বললেন, বাসলার হচ্ছে মহাশূন্যের একটি যুদ্ধ জাহাজ। কাজেই এর কাজের ধরনটাই হচ্ছে গিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে সবাইকে অবশ্যই কষ্টসহিষ্ণু হতে হবে। এটাকে কোনো বিলাসবহুল যাত্রী জাহাজ ভাবলে তো ভুল করা হবে। আপনারা নিজেদের অভ্যেস পরিবর্তন করুন। মানসিকতাকে বদলে ফেলুন।
এডমিরাল ক্যাসিডির এমন ধারা কথা শুনে ব্লাশার্ভ কিছুটা বিরক্ত হন। ক্যাসিডি তালিকার দিকে ঝুঁকে রয়েছে।
ডি-১৪৮। চুল্লীর সময় নির্ধারক যন্ত্র। সংখ্যা একটি।
ব্লাশার্ড অপ্রসন্ন মুখে বলেন, এই যে জিনিশটা। এবারে তালিকার শেষ দিকটা দেখেন এডমিরাল ক্যাসিডি।
ভি-১০৯৮। অফগ। পরিমাণ একটি।
ব্লাশার্ড এবারে রেগে গেলেন।
আমি এর আগেও অনেকবার জানিয়েছি যে, ওই নামে এখানে কোনো জিনিস নেই। কখনও ছিলো না।
ক্যাপ্টেন ম্যাকেনট চট করে পরিবেশটা সামলে নিলেন। তিনি ভালো করেই জানেন এ ধরনের নেতিবাচক কথা শুনলেই ক্যাসিডি ক্রুদ্ধ হবেন। ক্যাপ্টেন বলে ফেলেন, ওই অফাটা রয়েছে বেতারকক্ষে।
ক্যাসিডি ভ্রু কুঁচকান। তাহলে এটাকে পাকশালার জিনিশপত্রের সাথে দেখানো হলো কেন?
ক্যাপ্টেন ম্যাকনট মোটেই ঘাবড়ে গেলেন না। পরিস্থিতিটাকে সামাল দিতে বললেন, আমাদের যখন মহাশূন্যে যাত্রা শুরু হয়। তখন ওটা ছিল পাকশালাতেই। আর জিনিশটা হলো গিয়ে একটা পোর্টেবল যন্ত্র । সুবিধেমতো যে কোনো জায়গাতে নিয়ে গিয়ে কাজ করা যায়।
তাহলে ওটাকে বেতারকক্ষের জিনিশগুলোর তালিকাতেই রাখা উচিত ছিল। সেটা করেননি কেন?
ক্যাপ্টেন ম্যাকনট বুদ্ধিমান মানুষ। তিনি ভালো ভাবেই জানেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কোনো কথাতে সন্তুষ্ট হন। আমি তো ভেবেছিলাম আপনার অনুমতি পাওয়ার পরেই সেটা করবো।
ক্যাপ্টেন এ কথায় খুশি হলেন ক্যাসিডি।
আত্মতৃপ্ত কণ্ঠে বললেন, ঠিকই ভেবেছেন। এখন আমি এই নামটা তালিকা থেকে বদল করে দিচ্ছি। এই বলে তালিকার ন নম্বর পাতায় অফগ নামটি কেটে দিলেন। তারপর ১৬ নম্বর পাতায় অফগ একটা লিখে স্বাক্ষর করলেন। তালিকা থেকে এরপর পড়লেন ডি-১০৯৯। কলার। ওটা কুকুরটির গলায় ঝোলানো রয়েছে।
কিছুক্ষণ পর মহাকাশযানের বেতারকক্ষে প্রবেশ করলেন এডমিরাল ক্যাসিডি।
ভি-১০৪৮। অফগ একটা।
বারমান দাঁড়িয়ে গেলেন তাকে বেশ অস্থির দেখাচ্ছে। তার চিত্তচাঞ্চল্য হচ্ছে। বারমানের হাতে ধরা ছোট একটি যন্ত্র। যন্ত্রটির সামনের দিকে রঙিন আলো বসানো। নানা ধরনের ডায়াল রয়েছে। জিনিশটাকে দেখতে অনেকটা ফলের রস বের করার গ্রেডিং মেশিনের মতো।
বারমান কয়েকটা সুইচ টিপলেন। তালে তালে রঙিন আলোগুলো জ্বলতে নিভতে লাগল। বারমান আমতা আমতা করে বললেন, স্যার, এই যে সেই যন্ত্রটা।
তাই নাকি! ক্যাসিডি জিনিশটাকে ভালো করে দেখতে লাগলেন। এ ধরনের যন্ত্র তো আগে আর দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। অবশ্য একই জিনিশের কত রকমের ব্যবহার রয়েছে। এই যন্ত্রটা কি সঠিকভাবে কাজ করছে?
করছে। বারমান জানায়।
ক্যাপ্টেন ম্যাকনট বলেন, এই জিনিশটা আমাদের মহাশূন্যযানের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় একটি জিনিশ।
ক্যাসিডি বারমানের দিকে তাকিয়ে বলেন, কী কাজে এটা লাগে?
ক্যাসিডির এই প্রশ্ন শুনে বারমান রীতিমতো ঘাবড়ে যায়। তার মুখ শুকিয়ে আসে। ক্যাপ্টেন ম্যাকনট চটপটে ভাবে বলা শুরু করেন, আসলে এই যন্ত্রটা বিরুদ্ধ মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ক্ষেত্রে আমাদের ভারসাম্য রাখতে যথেষ্ট সাহায্য করে থাকে। এর আলোগুলোর রকমভেদ কোনও নির্দিষ্ট সময়ে কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় মাধ্যাকর্ষণ শক্তির তারতম্যকে বুঝিয়ে দেবে।
বারমান দেখলেন ক্যাসিডি তার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। ভাবলেন এই যন্ত্রটা সম্পর্কে তারও কিছু একটা বলা উচিত।
বুঝলেন স্যার, এই জিনিশটা তৈরি করা হয়েছে ফিনাগল ধ্ৰুবকের তত্ত্বের ওপর নির্ভর করে।
এডমিরাল ক্যাসিডি চেয়ারে বসলেন। তাপর তালিকায় অফগ শব্দটি পাশে টিক চিহ্ন দিলেন। তাপর আবার তালিকা পড়া শুরু করে দিলেন।
জেড-৪৪। স্বয়ংক্রিয় সুইচ বোর্ড।
এভাবে এক এক করে সব জিনিশকে তালিকার সাথে মেলালেন ক্যাসিডি। আর এ কাজটি করলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। এক সময় শেষ হলো পরিদর্শনের কাজ। ক্যাপ্টেন ম্যাকনটের মাঝে এতোক্ষণ পর যেন স্বস্তির ভাব ফিরে এলো। প্রধান পরিদর্শক এডমিরাল ক্যাসিডি মহাকাশযান বাসলারের পরিদর্শন কাজে যথেষ্ট খুশি হয়েছেন। তিনি মহাকাশযান থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
মহাকাশযান বাসলারের নাবিক এবং ক্রুরা কয়েকদিনের জন্য ছুটি পেলো । অবকাশ যাপনের জন্য তারা গেলো শহরে।
ছদিন পরে বারমান প্রবেশ করলো ক্যাপ্টেন ম্যাকনটের কেবিনে । তার হাতে একটি বার্তা। ক্যাপ্টেন বার্তাটি দেখলেন। প্রধান কেন্দ্র টেরার থেকে প্রেরণ করা হয়েছে এই বার্তাটি। সেক্টর কমান্ডার ফোল্ডম্যান নির্দেশ দিয়েছেন, মহাকাশযানের যন্ত্রপাতি নতুন করে সংস্থাপন করার জন্য বাসলারকে ফিরে যেতে হবে। জাহাজটিতে আরো উন্নতমানের শক্তির প্ল্যান্ট বসানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সেই সাথে আরো অত্যাধুনিক কিছু যুক্তি যোগ করা হবে।
বার্তাটি পেয়ে খুশি হলেন ক্যাপ্টেন ম্যাকনট। এ ধরনের কাজে প্রায় এক মাসের মতো সময় লেগে যাবে। বেশ জটিল কাজ। তার মানে হচ্ছে তারা এবার এক মাসের ছুটি পাচ্ছে। এই খবরটা পেলে মহাকাশযানের নাবিকেরা আনন্দিত হবে।
সিরি বন্দর ছেড়ে একদিন প্রধান কেন্দ্রের দিকে যাত্রা শুরু করলো বাসলার। দুসপ্তাহের মতো সময় কেটে গেছে। সিরি বন্দর এখন পেছনে পড়ে আছে।
তার সূর্যটাও সামনের নক্ষত্ৰভরা আকাশে পটভূমিতে উজ্জ্বল চোট একটি বিন্দুর মতো হয়ে গেছে। প্রধান কেন্দ্র টেরায় পৌছাতে আরো এগারো সপ্তাহের পথ বাকি রয়েছে।
টেরাতে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে তারা সবাই দারুণ রকমের উল্লসিত। তাদের বুকে চাপা উত্তেজনা। তারা এখন ফিরে যাচ্ছে টেরায়। কী আনন্দ।
এক সন্ধ্যেবেলায় ক্যাপ্টেন ম্যাকনটের কেবিনে প্রবেশ করলেন বারমান। তাকে খুবই বিমর্ষ দেখাচ্ছে।
কী ব্যাপার। তোমাকে এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন? ক্যাপ্টেন জিজ্ঞেশ করলেন।
ভাবছি আমরা তো এখন টেরায় ফিরে যাচ্ছি যন্ত্রপাতিগুলো সংস্থাপনের জন্য। কিন্তু এর পরিণামটি কী খুব সুখের হবে। আমরা যখন যান ছেড়ে নেমে যাবো তখন প্রধান কেন্দ্র থেকে একদল বিশেষজ্ঞ এসে আমাদের জাহাজে প্রবেশ করবে। আর বিশেষজ্ঞ ব্যাপারটাই এমন যে তা আমাদের জন্যে হচ্ছে উৎকণ্ঠ। উদ্বেগ।
কিন্তু জাহাজের এমন জটিল আর সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতিগুলো সংস্থাপন করার জন্য তো বিশেষজ্ঞ লাগবেই। লোহা লক্কড়ের মিস্ত্রীরা এসে তো আর সেগুলো ঠিক করে দেবে না। ভেবেছেন কি যে কোন একজন বিশেষজ্ঞ এসে অফগের এই ব্যাপারটা মানে আমাদের চাতুরিটাকে অতি সহজেই ধরে ফেলবে।
বারমানের কথাটি শোনামাত্রই ক্যাপ্টেন ম্যাকনট চমকে গেলেন। তাইতো, আমি তো অফগের সেই ব্যাপারটাকে টেরা কেন্দ্রে ফিরে গিয়ে আমরা তো আর বিশেষজ্ঞদের কোনোভাবেই ঠকাতে পারবো না।
এডমিরাল ক্যাসিডি অফগকে বেতারকক্ষের জিনিশের সাথে তালিকাভুক্ত করে গেছেন। বারমানের কাছে এখন সেটাই হচ্ছে গিয়ে বড় সমস্যা। বারমান চিন্তিত ভাবে বলে, আপনিই আমাকে এই ঝামেলার সাথে জড়িয়ে দিয়েছেন। এখন এই সমস্যার সমাধান তো আপনাকেই করে দিতে হবে। বিশেষজ্ঞদের প্রতিবেদনে যেন কোনো প্রতারণার বিষয়ে আবার জড়িয়ে না যাই।
ক্যাপ্টেন ম্যাকনট করিৎকর্মা মানুষ। চট করে সমাধানের পথ দেখালেন।
বুঝলে বারমান, তুমি ওই জিনিশটাকে ভেঙে ডিসটান্ট্রি সেটর যন্ত্রের ভেতরে ফেলে দাও। তাহলে ওর আর কোনো চিহ্ন পর্যন্ত থাকবে না।
কিন্তু আমাদের তালিকা থেকে হিশেবে একটা অফগ তো কম পড়বে।
না, তা আর পড়বে না। আমি টেরা কেন্দ্রের ভেতরে খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি। যে অফগ যন্ত্রটি মহাশূন্যে কাজ করার সময় বিনষ্ট হয়ে গেছে। তাই সেটাকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।
এই বলে ক্যাপ্টেন ম্যাকনট দ্রুত একটি বার্তা প্রস্তুত করলেন।
বার্তাটির ভাষা ছিল এরক, আমাদের মহাশূন্যযান বাসলার যখন হেক্টর মেজর এব মাইনর নামে যমজ দুটো সুর্যের ক্ষেত্র পেরিয়ে যাচ্ছিল সে সময়ে দুটো বিপরীত মাধ্যাকর্ষণের টানে ভি-১০৯৮ অফগটা ভেঙে দু টুকরো হয়ে গেছে। ভাঙা টুকরোগুলোকে জ্বালানি হিশেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
ক্যাপ্টেন ম্যাকনট বার্তাটিকে তুলে দেয় বামানের কাছে। এই বার্তাটি এখনি বেতারে টেরা কেন্দ্রকে জানিয়ে দাও।
দুদিন পর বারমান উৎকণ্ঠিতভাবে ক্যাপ্টেন ম্যাকনটের কেবিনে প্রবেশ করে। তাকে কিছুটা উত্তেজিত দেখাচ্ছে।
কী হয়েছে বারমান। তোমাকে অমন অস্থির লাগছে কেন?
আমাদের কাছে বিশেষ নির্দেশনামা এসেছে।
বারমান ক্যাপ্টেনের কাছে বার্তাটি দেয়।
বার্তাটি ছিল, প্রধান কেন্দ্র টেরার এই নির্দেশ মহাশূন্যের সকল স্টেশনকে রিলে করবে। এটি খুবই জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। মহাশূন্যের সকল মহাকাশযানকে এক্ষুনি নেমে আসার জন্য বলা হচ্ছে। সরাসরি আদেশে যে সকল জাহাজ এখনও উড়ে চলেছে তাদের সবচাইতে কাছের বন্দর নেমে পড়ার জন্য বলা হচ্ছে। পরবর্তী নির্দেশ যথাসময়ে দেয়া হবে ।
বার্তাটি দেখে ক্যাপ্টেন ম্যাকনট বললেন, হয়তো খারাপ কিছু একটা ঘটেছে।
তিনি ইন্টারকমে ডায়াল ঘুরিয়ে ক্রু পাইককে জানালেন, কোথাও একটি বিপদের কারণ ঘটেছে। সকল জাহাজকে অবিলম্বে নেমে আসার জন্য নির্দেশ জারি করা হয়েছে। আমাদেরকেও সবচাইতে কাছের জ্যাকমট্রেড বন্দরে নেমে পড়তে হবে। ঐ বন্দর এখনও ৩ দিনের পথ। এখনি বাসলারের গতি পরিবর্তন করো।
বারমান উদ্বিগ্ন মুখে তাকিয়ে রয়েছেন ক্যাপ্টেন ম্যাকনটের দিকে। কী হয়েছে বলে মনে হয় আপনার?
ঠিক এ ধরনের নির্দেশমালা সাত বছর আগে একবার পেয়েছিলাম। সে সময় জঙ্গলে যাওয়ার পথে স্টারিভাতে ঘটেছিল প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। তখন তার যথার্থ কারণটি খুঁজে বের করার জন্য প্রতিটি উড়ন্ত মহাকাশযানকে জরুরি ভাবে নামিয়ে আনা হয়েছিল।
তারপরও আগে অবশ্য আরও একবার এ রকম অবস্থা ঘটেছিল। তখন ব্লোগান জাহাজের নাবিকেরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল ।
বারগানের উৎকণ্ঠা বেড়েই চলেছে।
কিন্তু এবারে কী ঘটেছে বলে আপনার কাছে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এবার গুরুতর কিছু একটা ঘটেছে।
তবে কি কোনো মহাকাশযুদ্ধ শুরু হতে চলেছে?
কার বিরুদ্ধে? আমাদের বাসলারের বিরুদ্ধে যাওয়ার মতো জাহাজ অন্য কারও নেই। আমার কাছে কিন্তু মনে হচ্ছে একটা প্রযুক্তিতে কোনো সমস্যা। আমরা জ্যানিটেড বন্দরে পৌঁছেই সবকিছু জানতে পারবো। একটু অপেক্ষা করো।
তাদেরকে অবশ্য আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। টেরা কেন্দ্র থেকে মাত্র ৬ ঘন্টার মাঝেই জানিয়ে দেয়া হলো। বেতারকক্ষে টেরা থেকে সেই বার্তাটি আসা মাত্রই বারমান আতঙ্কগ্রস্তের মতো ছুটে এলো ক্যাপ্টেন ম্যাকনেটের কেবিনে।
বারমান শুধু তোতলাচ্ছে। আর বলছে অফগ…অফগ।
কী হয়েছে? এ রকম করছো কেন?
ব্যাপার আসলে হচ্ছে টাইপ করার ভুলের জন্যই এমন বিভ্রাট ঘটেছে। মানে আপনাকে পাঠানো কপিটিতে ভুল টাইপ করা হয়েছে। কথাটি অফগ নয়। আসলে হবে অফ ডগ, মানে কিনা অফিসিয়াল ডগ।
ক্যাপ্টেন ম্যাকনট বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রয়েছেন। তিনি অস্পষ্টভাবে অফ ডগ শব্দটা উচ্চারণ করলেন। এই দেখুন সেই বার্তাটি।
বিস্মিত ক্যাপ্টেন বার্তাটি দেখলেন। প্রধান কেন্দ্র টেরার থেকে বাসলারকে জানানো হচ্ছে। মহাকাশযানের অফিসিয়াল ডগ পিশ্লেক সম্পর্কে তোমাদের প্রতিবেদন ডি-১০৯৮। কোনো পরিস্থিতিতে মাধ্যাকর্ষণের টানে একটা প্রাণীও দু টুকরো হয়ে যেতে পারে তা বিশদভাবে জানাতে বলা হচ্ছে। মহাকাশযানের নাবিকদের কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এ ব্যাপারে তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা জানা যেতে পারে। বিষয়টি খুবই জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ।
বার্তাটি পড়ে কিছুক্ষণ বিমূঢ়ের মতো বসে রইলেন ক্যাপ্টেন ম্যাকনট। বার্তাটি টাইপ করার সময় একটি বিভ্রাটের কারণে তারা এততক্ষণ সাংঘাতিক উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মাঝে সময় অতিবাহিত করেছে। স্নায়ুর ওপর পড়েছে প্রবল চাপ।
মহাকাশযান বাসলার তখন তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে পরবর্তী বন্দরের দিকে।
এরিক ফ্রাঙ্ক রাসেলের কাহিনি অবলম্বনে