১৪. বিদায় ভাই

১৪. বিদায় ভাই

‘আমার কাছে তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে। আমার সবচেয়ে প্রশিক্ষিত এবং অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত সেনাদলের অধিনায়কত্ব তোমাকে দিয়েছিলাম। অনেক আগেই তোমার বিশ্বাসঘাতক ভাইয়ের বিরুদ্ধে তোমার বিজয় এবং তার মৃত্যু কিংবা তাকে বন্দী অবস্থায় দেখে আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করতে চেয়েছিলাম। তবে আমি আশা করি নি যে, তুমি তাকে তার সৈন্যসহ ময়দানে মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াতে ছেড়ে দিয়ে আজমির ফিরে আসবে। কেন এটা করলে? দিওয়ান-এ-আমে যারা উপস্থিত হয়েছেন, তাদের মনের ভাবনা মুয়াজ্জম অনুভব করতে পারলো। সন্ধ্যা হওয়া সত্ত্বেও তার বাবা সকল উপদেষ্টা আর সেনাপতিদের এখানে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কেন তার বাবা এভাবে তাকে হেনস্থা করছেন? তাকে অন্তত কাদামাখা পোশাক বদলে আসার সুযোগ দিতে পারতেন। আর এভাবে সমস্ত সভাসদদের সামনে তাকে হাজির করারই বা কি দরকার ছিল? যেন তিনি তাঁর ছেলে নন, লজ্জাজনক কাজ করা কোনো কর্মকর্তা। পাঁচমাস হল তিনি বাইরে কাটিয়েছেন। এমন অবস্থায় যেকোনো বাবা প্রথমে একান্তেই দেখা করার কথা।

সোনার পাতে মোড়া একটা নিচু সিংহাসনে আওরঙ্গজেব পিঠ খাড়া করে গ্র্যানাইট পাথরের মতো মুখ নিয়ে তার সামনে বসেছিলেন। চিবুক উঁচু করে মুয়াজ্জম তার বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, বাবা আমি আপনাকে আমার বার্তাবহের মাধ্যমে জানিয়েছিলাম যে, আমি খুব দ্রুত অগ্রসর হতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু আকবর তার বাদবাকি সেনা আর রাজপুত মিত্রদের নিয়ে বেশ আগেই রওয়ানা দিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। সেজন্য আমি গোলন্দাজ আর রসদবহর ছেড়ে দ্রুতগামী ঘোড়সওয়ার নিয়ে আলাদা দলে ছুটেছিলাম। তবে অনেক দ্রুত ছুটেও তাদের নাগাল পাই নি। আমার অগ্রবর্তী চরেরা তাদের পদক্ষেপ অনুসরণ করছিল, তবে ওরাও আমাদের সব সময় আমাদের দুই-তিনদিন দূরত্বে এগিয়েছিল। আমি ধারণা করেছিলাম, যেহেতু তার গুপ্তচরেরাও আমাদের গতিবিধি লক্ষ করছে, কাজেই যখন আমি আমার সেনাদলকে দুইভাগে বিভক্ত করলাম, তখন এ খবর পেয়ে আমার ভাই হয়তো পেছন ফিরে আমাদের উপর আক্রমণ করবে। কিন্তু সে হুঁশিয়ার হয়ে আমার টোপে পা দিল না।

 ‘তারপরও আমি চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। মূল বাহিনীর জন্য অপেক্ষা করে, তারপর তাদেরক নিয়ে সবাই মিলে তার পেছনে মারাঠা পাহাড়ি অঞ্চলের দিকে এগোলাম। কিন্তু আবহাওয়া বাদ সাধলো। দিনের পর দিন গরম বেড়েই চললো। স্থানীয়রা খুব বিরূপ আর অসন্তুষ্ট ছিল, আমাদেরকে আসতে দেখেই সমস্ত গবাদিপশু আর খাবার-দাবার নিয়ে গ্রাম ছেড়ে পালাতে লাগলো। সুপেয় পরিষ্কার পানি পাওয়া খুব কষ্টকর হয়ে পড়লো। আমার ভাইয়ের সৈন্যরা আর সম্ভবত স্থানীয় লোকজন অনেক কূপের পানিতে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল কিংবা পানির ডোবায় মরা গবাদিপশু ফেলে রেখেছিল। এই দূষিত পানি পান করে আমার দেহরক্ষী দলের অধিনায়ক সাঈদ আজিজ বমি করতে করতে আর কাপড় ময়লা করে মারা যায়। আপনিতো জানেন সে কিরকম বলিষ্ঠ লোক ছিল।

বৃষ্টি শুরু হতেই স্বস্তির বদলে আরো সমস্যা নিয়ে এল। জমিন কর্দমাক্ত হয়ে– যাওয়ায় আমাদের চলার গতি ধীর হয়ে গেল। আমার শিবিরে আহ্নিক জ্বর আর অন্যান্য রোগ ছড়িয়ে পড়লো–হেকিম কিছুই করতে পারলো না। এরপর থেকে আমরা দৈনিক দুই তিন মাইলের বেশি চলতে পারলাম না। এরপর যখন দেখলাম আমার প্রায় অর্ধেক লোক অসুস্থ হয়ে পড়েছে আর অনেকে মারা গেছে, তখন সিদ্ধান্ত নিলাম এরপর আর অনুসরণ চালিয়ে যাওয়াটা অপরিণামদর্শী হবে। প্রাণহানির কথা ছেড়েই দিলাম। এ অবস্থায় আকবর আর মারাঠারা একত্রিত হয়ে উপরি আক্রমণ করলে আমার লোকেরা তা সামলাতে পারবে কি-না সে ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত হতে পারলাম না। কারণ ইতোমধ্যে আমি খবর পেয়েছিলাম যে, মারাঠারাও তার সাথে যোগ দিয়েছে। কাজেই অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমি উত্তরমুখি পিছু ফেরার নির্দেশ দিলাম। জানতাম আপনি আমার উপর অসন্তুষ্ট আর হতাশ হবেন, সেজন্য আমি আগেই রওয়ানা দিলাম যাতে যতদ্রুত সম্ভব ব্যক্তিগতভাবে সমস্তকিছু আপনাকে জানাতে পারি। আমার মূল বাহিনী আগামী মাসের মধ্যেই চলে আসবে। তখন আপনি নিজেই তাদের দুরবস্থা আর কতজন সংখ্যায় কমে গেছে দেখতে পারবেন। আপনার আদেশ পালন করার জন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, তবে আমি দেখতে পেলাম কাজটা অসম্ভব আর বিনা কারণে আমার লোকেরা প্রাণ হারাচ্ছে।

আওরঙ্গজেব স্থির হয়ে বসে রইলেন, তার চেহারা দেখে কিছুই বুঝা যাচ্ছে না কি ভাবছেন। মুয়াজ্জমের হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। তার বাবা কি কিছু অনুমান করতে পেরেছেন? আওরঙ্গজেব মানুষের মনের গভীরে ঢুকে তাদের মনের গূঢ়তম চিন্তাও খুঁড়ে বের করতে পারতেন। তবে সে অত্যন্ত সতর্ক ছিল…কাউকেই তার আসল উদ্দেশ্য বলে নি। তার ফুফুকে একটি শব্দও চিঠি লিখে জানায় নি যাতে আওরঙ্গজেবের সন্দেহ হতে পারে। দক্ষিণে এই দীর্ঘ যাত্রায় হেঁটে চলার সময় প্রত্যেকবার যখন তার রণ হস্তী এপাশ-ওপাশ দুলতো, তখন প্রতি দুলুনির সাথে তার ফুফুর ফিস ফিস করে বলা কথাগুলো তার মাথায় প্রতিধ্বনিতৃ হত। আমার খাতিরে, তোমার নিজের জন্য আর সেই সাথে তোমার নিয়তির কথা ভেবে, বলছি অতি-উৎসাহী হইও না। সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে প্রস্তুতি নিতে থাক আর সেভাবে ভাইয়ের খোঁজেও যাও। আর সে তার কথা পালন করেছিল, কারণ তার নিজের মনেও সে তাই করতে চাইছিল। আকবর বোকা আর নিজের সম্পর্কে তার অত্যধিক উচ্চ ধারণা ছিল। কেন সে ভাবতে পারলো যে, তাই ভাইদের চেয়ে মোগল সিংহাসনে বসার অধিকার। তার বেশি?–তবে আকবর রক্তপিপাসু কিংবা কঠিন মনের মানুষ ছিল না। আসলে সে ঠিক উল্টো ছিল, যদি সে সিংহাসন দখল করতেও চাইতো। তার বিশ্বাসই হয়না যে আকবরের পরিকল্পনা সফল হলে সে তাকে হত্যা করতো আর তিনি নিজেও তার ভাইয়ের হত্যাকারী হতে পারতেন না। তারপর সেই শুষ্ক, শাসরুদ্ধকর গরম, তারপর মৌসুমি বৃষ্টির কারণে সারাক্ষণ ভিজে থাকা–এগুলোই তার অগ্রযাত্রা ধীর হওয়া আর তারপর ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য যথেষ্ট অজুহাত ছিল। এছাড়া তার লোকজন আসলেও ক্লান্ত আর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। মুয়াজ্জমের পেছন থেকে বিচলিত হয়ে কেউ কেশে উঠলো আর তিনি অন্যদের পা ঘষারও শব্দ পেলেন, তবে আওরঙ্গজেব কিছুই বললেন না। অনেকক্ষণ চুপ। থাকাটা তার বাবার একটি কৌশল। তিনি অসংখ্যবার তার বাবাকে এই কৌশল ব্যবহার করতে দেখেছেন…আর এতে লোকজন এত বিচলিত হয়ে পড়ে যে, তারা নিজেরাই নীরবতা ভেঙ্গে উল্টোপাল্টা কিংবা অর্থহীন কোনো কথা মুখ ফস্কে বের করে ফেলে। যার ফলে নিজেকে দোষারোপ করে কিংবা এমন কোনো দুর্বলতা প্রকাশ করে যার সুযোগটি নেন আওরঙ্গজেব। তবে তার বাবা তাকে ভয় দেখাতে পারবেন না। আর যদি তাকে সন্দেহও করেন, কোনো প্রমাণ পাবেন না।

অবশেষে আওরঙ্গজেব সিংহাসনে একটু নড়েচড়ে বসে সামনে ঝুঁকে বললেন, ‘তুমি বলেছ, তোমার ক্ষমতানুযায়ী যথাসাধ্য চেষ্টা করেছ, কিন্তু তা আসলে করনি। যদি তাই করতে তাহলে, যে বিশ্বাসঘাতক নিজেকে আমার ছেলে বলে। দাবি করতো, তাকে জীবিত অথবা মৃত আমার হাতে তুলে দিতে। বরং তুমি আমার মতো দাক্ষিণাত্য ভালোভাবে জানা সত্ত্বেও তাকে আর রাজপুত বিশ্বাসঘাতকদেরকে তোমার হাত এড়িয়ে মারাঠিদের সাথে যোগ দেবার সুযোগ করে দিয়েছ। অভিযান সফল করতে তুমি যথেষ্ট নিশ্চিত এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলে না। আরো খারাপ কি করেছ, আমার অনুমতি না নিয়ে অভিযান ছেড়ে চলে এসেছ। তুমি ছোট একটি যে বার্তা কাসিদের মারফত পাঠিয়েছিলে, তাতেই প্রথম আমি জানতে পারি যে, তোমার বাহিনী নর্মদা নদী পাড় হয়ে উত্তর তীরের দিকে আসছে।

 মুয়াজ্জম আবার বলতে শুরু করলেন, বাবা…’ কিন্তু আওরঙ্গজেব একটি আঙুল তুললেন। এই আঙুলে এখন সব সময় তিনি তৈমুরের বাঘমুখের ভারী আংটিটি পরতেন। আর এটাই একমাত্র রত্ন যা তিনি ব্যবহার করতেন। মোমবাতির আলোয় সোনা চকচক করে উঠলো, তবে তার বাবার কালো চোখের দৃষ্টিতে কোনো ধরনের আবেগ অনুভূতির চিহ্ন নেই। তিনি সরাসরি তার ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। প্রতিরোধ করার জন্য দৃঢ়সংকল্প হলেও, সেই চোখের প্রবল চাউনি এড়াতে না পেরে মুয়াজ্জম চোখ নামিয়ে মেঝের দিকে তাকাতেই, আওরঙ্গজেব বললেন,

 ‘আমি আবার বলছি, তুমি অতি সতর্ক ছিলে। এই ধরনের বৈশিষ্ট্য আমার কোন সেনাপতির মধ্যে আমি সহ্য করতে পারি না, ছেলে হলে তো কোনো কথাই নেই। আমার মনে একটা অনুকূল ধারণা সৃষ্টি করার এটা তোমার জন্য একটা সুযোগ ছিল, কিন্তু তুমি প্রমাণ করেছ যে, একটি সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেবার মতো মেধা কিংবা সাহস তোমার মধ্যে নেই। সাম্রাজ্য শাসন করাতো দূরের কথা।

এই কথাটার মানে কি? তার বাবা কি এতদিন তাকেই তাঁর উত্তরাধিকার মনে করতেন আর এখন মত বদলেছেন? এনিয়ে মুয়াজ্জম আর কিছু চিন্তা করার আগেই আওরঙ্গজেব আবার বলে চললেন, “আমি তোমাকে তোমার বর্তমান অধিনায়কের পদ থেকে সরিয়ে দিচ্ছি আর তোমার সাধারণ মানের যোগ্যতানুযায়ী কম গুরুত্বপূর্ণ পদ দেব। এখন আমি দেখছি একমাত্র উপায় হল আমার অপরাধী ছেলের পেছনে অভিযানের নেতৃত্ব একমাত্র আমাকেই দিতে হবে। এখন তুমি যাও। তোমার ব্যাপারে কিছু একটা সিদ্ধান্ত নেবার পর তোমাকে জানাব।’

যাওয়ার জন্য ঘুরতেই মুয়াজ্জমের মনে হল দেয়ালের গায়ে স্থাপন করা জাফরির পেছনে তিনি এক নজর কারও চোখ কিংবা একটি মুক্তার মৃদু ঝলক দেখতে পেলেন। এখানে বসেই জাফরির ফাঁক দিয়ে রাজপরিবারের মহিলারা দরবারের কার্যকলাপ দেখে থাকেন। তার ফুফু জাহানারা কি তাকে লক্ষ করছিলেন? যদি দেখে থাকেন তাহলে তিনি নিশ্চয়ই জানতে পেরেছেন যে, মুয়াজ্জম ফিসফিস করে বলা তার অনুরোধকে সম্মান দিয়েছে। আকবরকে খুঁজে বের করার অভিযানে তিনি আসলে ধীরগতি ছিলেন।

*

আওরঙ্গজেবের গালের কিনারায় আলতো করে হাত বুলিয়ে উদিপুরী মহল মৃদু হেসে বললেন, আপনার সাথে যেতে পেরে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। আপনি জানেন যখন আপনি আমাকে ফেলে কোথাও যান তখন আমার খুব খারাপ লাগে। এতবছর পার হওয়ার পরও তিনি এখনও যথেষ্ট সুন্দরী। মাঝে মাঝে আওরঙ্গজেব ভাবতেন সাটিনের মত তার নমনীয় দেহ ধরে তিনি যে আনন্দ পান সেটা কি কোনো পাপ আর তার হয়তো ঘন ঘন উদিপুরী মহলের সাথে দেহমিলন করাও ঠিক না। প্রথম যখন তিনি তাকে তার স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, তখন উদিপুরী মহল যেরকম ভালোবাসতেন, এখনও আওরঙ্গজেবের প্রতি তার ভালোবাসা তেমনি উজ্জ্বল আর সেরকমই আন্তরিক। সেজন্যই তিনি তাকে আজমিরে ফেলে রেখে যেতে পারছেন না…এক আল্লাহই জানেন, সামনে যুদ্ধ মোকাবেলা করার সময় তার নিঃশর্ত আর প্রশ্নাতীত ভালোবাসার প্রয়োজন তিনি কতটা অনুভব করেন।

উদিপুরী তার গায়ের সাথে আরো চেপে বসতেই তিনি তার নরম স্তনের ফিতি অনুভব করলেন, তবে এখন দেহমিলনের সময় নয়। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাকে একটি সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে মুয়াজ্জমের অসমাপ্ত অভিযানে বের হতে হবে। তার ছেলেকে ধরে আনতে হবে আর মারাঠিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লাভ করতে হবে। তিনি নিচু হয়ে তার রক্তিম মুখে চুমু খেয়ে বললেন, ‘আমাকে এখন যেতেই হবে। যাওয়ার আগে অনেক কিছু করা বাকি আছে। তবে আমার খুব ভাল লাগে যখন মনে হয় প্রতিদিন বেলাশেষে ফিরে এসে দেখবো হেরেম তাঁবুতে তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করছে।’

 কামরা থেকে বের হয়ে হেরেম মহলের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে তার মাথায় চওড়া ব্যাসের নলের নতুন কামানের কথাটা ঘুরপাক খেতে থাকলো। তাকে নিশ্চিত করতে হবে যে, এগুলো ঠিকমত গাড়িতে তোলা হয়েছে কি-না, নয়তো এগুলোর সামনের নমনীয় অংশ ভেঙ্গে যেতে পারে। জাহানারার কামরার কাছে পৌঁছতেই দেখলেন দরজা খোলা আর একজন পরিচারিকা বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাঁকে দেখে সে বললো, ‘জাহাপনা, আপনার বোন জিজ্ঞেস করেছেন হেরেম থেকে বের হয়ে যাওয়ার আগে তিনি কি আপনার সাথে একবার দেখা করতে পারবেন?

‘অবশ্যই, একথা বলে আওরঙ্গজেব চন্দনকাঠের দরজার মধ্য দিয়ে জাহানারার ঘরের দিকে এগোলেন। সত্যি বলতে কি গত কয়েক সপ্তাহ তিনি তার সাথে একা সাক্ষাৎ করা এড়িয়ে চলছিলেন। আকবরের বিদ্রোহ নিয়ে তিনি আর কোনো কথা বলেন নি, তবে যখনই তার সাথে দেখা হত তিনি লক্ষ করতেন তার মুখ দেখে মনে হত তিনি খুব কষ্টে আছেন, কেমন যেন ভূতুড়ে চেহারা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি বিরক্তবোধ করতেন। আওরঙ্গজেব যা করতে যাচ্ছেন কেন তিনি তার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে চেষ্টা করছেন না, শুধু নিজের যুক্তি নিয়ে বসে আছেন?

জাহানারা একটি বিবর্ণ রঙের শাল গায়ে দিয়ে জানালার ধারে বসেছিলেন। আওরঙ্গজেব ঘরে ঢুকতেই তিনি তার হাতির দাঁতের হাতলওয়ালা লাঠিতে ভর দিয়ে উঠতে চেষ্টা করলেন।

না, না, আমার জন্য ওঠার দরকার নেই।

জাহানারা আবার বসে পড়লেন, তারপর বললেন, এত ব্যস্ততা সত্ত্বেও যে আমার সাথে দেখা করতে এসেছ সেজন্য বেশ ভালো লাগছে। কখন রওয়ানা দিচ্ছ?

 ‘সবকিছু ঠিকঠাক করার পর তিন-চার ঘণ্টার মধ্যেই রওয়ানা দেব।

 ‘দূরে যাচ্ছ, সেজন্য আমি তোমার জন্য দোয়া করবো, তবে একটা ব্যাপার তোমাকে আমার বলা দরকার। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমি অনুভব করছি। যে, আমি কমজোর হয়ে যাচ্ছি।’

 ‘এর মানে কি? আপনি কী অসুস্থ? কেন আমাকে জানান নি? হেকিমকে ডেকে আনাবো?

 জাহানারা মৃদু হেসে মাথা নেড়ে বললেন, আমার তেমন অসুখ হয়নি যা হেকিম ভাল করতে পারে…আমি অসুস্থ নই তবে খুব ক্লান্ত। আওরঙ্গজেব… জীবন নিয়ে আমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। অনেকসময় সকালে ঘুম থেকে ওঠারও শক্তি থাকে না।

‘আপনি যাই বলেন, আমি হেকিমকে পাঠাচ্ছি। তাদের কাছে নিশ্চয়ই এমন দাওয়াই আছে, যা আপনাকে শান্ত করে দেহে শক্তি দিতে পারে। আল্লাহর ইচ্ছায় আমার অভিযান বেশি সময় নেবে না। আর আমি আজমিরে ফিরে এলেই আপনি ভালো হয়ে যাবেন।

হয়তো তাই, তবে আমার মন বলছে আর হয়তো আমাদের এ পৃথিবীতে দেখা হবে না।

আওরঙ্গজেব অনুভব করলেন তার তলপেট খামচে ধরেছে। তাঁর পাশে হাঁটু গেড়ে বসে তিনি তাঁর একহাত ধরলেন। শুষ্ক পাতলা চামড়ার নিচে হাড় মনে হচ্ছে পাখির মতো ভঙ্গুর। তিনি বললেন, ‘বোন, কে কতদিন বাঁচবে আল্লাহ তা কাউকে জানার অনুমতি দেন নি।

 ‘আমি সেটা জানি। তবুও আমার কথা যদি ঠিক হয় সেজন্য বলছি, যদি আর কখনও সুযোগ না পাই, সেজন্য কিছু কথা তোমাকে বলতে চাই। না, আমার কথা থামিয়ে দিও না। তোমাকে শুনতেই হবে, আমার জন্য না হলেও আমাদের মায়ের জন্য, যিনি আমাদের দুজনকেই ভালোবাসতেন। আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, আকবর আর জেবুন্নিসাকে মাফ করে দাও। তোমার মনে খুঁজে দেখ তাদেরকে ক্ষমা করা যায় কি না।

‘আল্লাহর ওয়াস্তে বলছি, তা আমি পারি না। আকবর অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তাকে আমি ক্ষমা করতে পারি না। আর জেবুন্নিসার বিশ্বাসঘাতকতাও উপেক্ষা করতে পারি না।

 ‘তাহলে সেই চক্র আবার ঘুরতে শুরু করছে, যা আর থামান যাবে না। তখত ইয়া তক্তা সিংহাসন কিংবা কফিন–সেটাই তুমি সবসময় ভেবে এসেছ তাই না? বোকার মতো আমি ভেবেছিলাম যে, হয়তো তোমাকে বাধা দিতে পারবো, তবে এটা ছিল আমার দায়িত্ব–সত্যি বলতে কি পবিত্র দায়িত্ব। সবসময় চেষ্টা করে যাব, ঠিক যেরকম আবার আমি তোমাকে মনে করিয়ে দিতে চাচ্ছি যে, মুসলমানদের মত তোমার হিন্দু প্রজাদেরও তোমার উপর দাবি আছে যে, তুমি তাদের প্রতি খেয়াল রাখবে, তাদের নিরাপত্তা দেবে। যদিও আমি জানি তুমি তা শুনবে না। তবে আমি আরেকটি কথা তোমাকে বলতে চাই…আমাদের মধ্যে যতই মতপার্থক্য থাকুক আমি তোমাকে ভালোবাসি। সেই যখন তুমি একটি ছোট্ট ছেলে ছিলে তখন থেকে। তখন তুমি ভাবতে যে প্রতিটা সমস্যার একটাই সমাধান আছে আর তুমি তা জান। আর কেউ যদি তা না শুনতে চাইতো তখন তুমি তোমার মুঠি দিয়ে তার উপর তা চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করতে। আমি দোয়া করি যেন, তুমি এই জীবনে আর পরবর্তী জীবনেও শান্তি পাও।

 জাহানারা একটু সামনে ঝুঁকলেন আর আওরঙ্গজেব অনুভব করলেন তাঁর ঠোঁট তার কপাল একবার স্পর্শ করলো। তার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল, অতি কষ্টে কণ্ঠস্বর সামলিয়ে তিনি ফিস ফিস করে বললেন, ‘দয়া করে আমার কথা বুঝার চেষ্টা করুন। আপনি যে পথের কথা বলতে চাচ্ছেন তা আমি অনুসরণ করতে পারি না–সেটা এজন্য নয় যে, আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার ঘাটতি আছে। শুধু আমার ধর্মীয় বিশ্বাস আর পুরুষ মানুষের জগতের কঠিন বাস্তবতার কারণে আমি এসব করতে বাধ্য হয়েছি।’

 ‘আমি জানি তুমি কি অনুভব করছো, আর কেন। আর কেবল সেই নির্মম অনিবার্যতাই আমাকে দুঃখী করেছে।

 ‘জাহানারা, আমি…’ কুচকাওয়াজের ময়দান থেকে শিঙার আওয়াজ ভেসে এল। তীক্ষ্ণ কানফাটা আওয়াজটি তাঁকে বাঁচিয়ে দিল। তিনি বললেন, “আমি আর থাকতে পারছি না। তবে আমি আমার শ্রেষ্ঠ হেকিমদের পাঠাব আর যতদিন দূরে থাকবো রোজ তোমার জন্য প্রার্থনা করবো যেন তুমি সুস্থ হয়ে ওঠ।’

‘আর আমি তোমার নিরাপত্তা আর সুখের জন্য প্রার্থনা করবো, যেরকম পরিবারের আর সবার সুখশান্তি আর নিরাপত্তা কামনা করে দোয়া চাইবো। আওরঙ্গজেব, ভাই আমার, আল্লাহ তোমার সহায় হোন।

আওরঙ্গজেব তাঁর বোনের বলিরেখাঙ্কিত কপালে চুমু খেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। এক মুহূর্ত ইস্ততত করলেন, তারপর ফিরে তাকাবার ইচ্ছেটা দমন করে দ্রুত কামরা থেকে বের হয়ে হেরেমের মধ্য দিয়ে শেষ মাথায় পৌঁছে সিঁড়ি বেয়ে নেমে উঠানে চলে এলেন। তাঁর প্রিয় হাতিটি একটি নিম গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। এর এঁড়ে যুদ্ধের লাল রঙ করা হয়েছে আর ছাদওয়ালা হাওদা পিঠে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সহিসরা ঘোড়ায় জিন পরাচ্ছিল আর তাঁর দেহরক্ষী দলের বরকন্দাজরা তাদের গাদা বন্দুকে গোলা ভরে সবকিছু পরীক্ষা করছিল। আওরঙ্গজেবের নাকে যুদ্ধের পরিচিত গন্ধ ভেসে এল গা-গরম ঘোড়ার গায়ের গন্ধ, তেল দেওয়া নতুন জিন আর লাগাম, বারুদ আর মানুষের ঘামের গন্ধ। লম্বা একটি দম নিয়ে তিনি স্বস্তির সাথে বিশ্বাস করলেন যে, তিনি তার জগতে ফিরে এসেছেন, যেখানে সিদ্ধান্ত আর কর্মই হচ্ছে শ্রেষ্ঠতর–নির্দিষ্ট আকারহীন, দ্ব্যর্থক আবেগপ্রবণতা নয়।

তিন ঘণ্টা পর যখন প্রধান ফটকের দালানের দোতলা থেকে বুম বুম শব্দে নাকাড়া বেজে উঠলো, তখন আজমিরের উঁচু দেওয়ালের উপরে জালি দেওয়া বেলকনিতে একসাথে দাঁড়িয়ে জাহানারা আর গওহরা তাদের ভাইয়ের হাতির পিঠে করে বাইরে চলে যাওয়া দেখছিলেন। দুর্গের বাইরে অশ্বারোহী আর পদাতিক সেনারা দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। জাহানারা গওহারার এক হাত ধরলেন। যাদেরকে তিনি ভালোবাসেন কতবার তাদের যুদ্ধে যেতে দেখেছেন? কতবার তিনি এর অন্তঃসার শূন্যতা আর অনাবশ্যকতার কথা ভেবেছেন? আওরঙ্গজেবের চলে যাওয়ার শেষ মুহূর্তটি পার হওয়ার সময় তিনি ভাবছিলেন, তিনি কি শেষবারের মতো তাঁর সাথে আরেকবার দেখা করতে আসবেন কিংবা তিনি নিজে তাঁর সাথে দেখা করার চেষ্টা করবেন। কিন্তু তিনি জানেন তাদের দুজনেরই যা যা বলার ছিল বলেছেন। কোনোকিছুতেই ধর্ম, সাম্রাজ্য আর পারিবারিক দায়িত্ব সম্পর্কে তাদের মধ্যে যে মতপার্থক্য রয়েছে তার আর মিল হবে না।

আওরঙ্গজেবের নেতৃত্বে অগ্রবর্তী দল যখন দক্ষিণ দিকে চলতে শুরু করলো, তখন অসময়ের গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়া শুরু হতেই মাটি ভিজে গেল। জাহানারা লাঠিতে ভর দিয়ে একটু ঝুঁকে দেখতে লাগলেন আওরঙ্গজেবের হাতি তাঁকে পিঠে নিয়ে একটি নিচু পাহাড়ের কিনারা ঘুরতেই অবশেষে দৃষ্টির বাইরে চলে গেলেন। অদৃশ্য হাত উঠিয়ে তিনি ফিস ফিস করে বললেন, ‘বিদায়, ভাই… তুমিসহ তোমার লোকজনের উপর শান্তি বর্ষিত হোক।’

*

পেছনে শক্তভাবে হাত বাঁধা আটজন মারাঠি আওরঙ্গজেবের সামনে নতজানু হয়ে বসেছিল। তিনি বললেন, “এরা আমার রসদবাহী গাড়িবহরের লোকজনদের হত্যা করেছে। এদের জন্য একমাত্র শাস্তি হচ্ছে–হাতির পায়ের নিচে পিষে মারা। আর আমি চাই এটা এখুনি করা হোক। আওরঙ্গজেবের কথার সাথে সাথে আটজনের মধ্যে ছয়জন প্রাণভিক্ষা করে কাতরভাবে মিনতি করতে। লাগলো। আরেকজন–যাকে দেখে মনে হচ্ছে বয়সে সবার ছোট, সে চোখ বন্ধ করে ওয়াক ওয়াক করে বমি করার চেষ্টা করতে করতে সামনে পেছনে দুলতে লাগলো। সবশেষের মারাঠি লোকটি চিৎকার করে অবাধ্য হয়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই দুজন সৈন্য লাথি মেরে তাকে মাটিতে ফেলে দিল। তারপরও লম্বাচুলের, মুখে কাটাদাগসহ বলিষ্ঠ গড়নের লোকটি আওরঙ্গজেবের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল। তারপর সে হঠাৎ একদলা হলদে রঙের চটচটে শ্লেষা মুখ থেকে বের করে থুথু করে ফেলতেই কফের দলাটি আওরঙ্গজেবের সবুজ আলখাল্লার একটু উপরে পড়ে ধীরে ধীরে পোশাক বেয়ে নিচে নামতে লাগলো। থুথুর দলাটি আলখাল্লার কাপড়ের গায়ে লম্বা, সরু একটি দাগ রেখে গেল। একজন সৈনিক তার গাদা বন্দুকের কুঁদো তুলতেই আওরঙ্গজেব মাথা নেড়ে বললেন, ‘পরজীবী এই কীটাণুকীটের জন্য তোমার শক্তিক্ষয় করো না, যে কি-না মৃত্যুর এত কাছাকাছি এসেও আল্লাহ আর মানুষের সামনে অপরাধ করছে।

ঝাকড়া চুলের লোকটি চিৎকার করে উঠলো, আপনি আমাদেরকে পরজীবী কীট বলছেন, আপনি নিজে কী? তখনও তার ঠোঁটে থুথু লেগে রয়েছে। ‘একজন ভিনদেশি হামলাকারী ছাড়া আপনি কিছুই না, যে জোর করে আমাদের দেশের উপর নিজের ইচ্ছে চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। যে দেশ আপনার নয়–যে দেশ কখনও আপনার লোকদেরও ছিল না। আপনারা মোগলরা কারা? উত্তরের পর্বতের জংলি এলাকা থেকে আসা একদল দস্যু। চোর যেমন সুযোগ পেলেই চুরি করে, তেমনি আপনারাও চোরের মতো একটি সুযোগ পেয়ে হামলা করেছেন–যাদেরকে সম্ভাজির নেতৃত্বে আমরা এদেশ থেকে উচ্ছেদ করবো।’

আওরঙ্গজেব নিচে লোকটির দিকে তাকালেন। তার ঘাড়ের শক্ত পেশি আর ঘামে ভেজা কপালের ফুলে উঠা শিরাগুলো লক্ষ করলেন। বেদনাদায়কভাবে যখন তার প্রাণ চলে যাচ্ছে, ঠিক তার আগে এমন আবেগ, এমন বিরোধিতা, আর বিশেষ একটি উদ্দেশ্যের প্রতি তার এমন বিশ্বাস–দেখার মতো বিষয় বটে। কি কারণে লোকটি বিশ্বাস করছে যে, সম্ভাজির মতো নেতার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়া যায়? তাঁর গুপ্তচরেরা বলেছে, সে তার বাবার চেয়েও অনেক ভোগবিলাসী আর খুব একটা উদ্যমী নয়? তবে তাঁর গুপ্তচরেরা কি সম্পূর্ণ সত্য কথাটি বলে নি, না-কি তিনি যা শুনতে পছন্দ করেন শুধু সে কথাই বলেছে? সম্ভাজির নিশ্চয়ই বিশেষ কোনো গুণ আছে, আর সেজন্যই সে এমন সাহস যোগচ্ছে আর আত্মবিসর্জন করতে লোককে অনুপ্রাণিত করছে। আর তাই যদি হয়ে থাকে, তবে তাকে ছোট করে দেখা ভুল হবে। তাকে ভালোভাবে জানার জন্য একটা উপায় বের করতে হবে। তিনি ওয়াজিম খানের সাথে কথা বলে তাকে জানাবেন মারাঠি শিবিরে ঢুকে সম্ভাজির সম্পর্কে সবকিছু জানার জন্য আরো চেষ্টা করতে।

 চোখের এককোণ দিয়ে তিনি সেই বিশাল হাতিটিকে এগিয়ে আসতে দেখলেন, এই হাতি দিয়েই অপরাধীদের পিষে মারা হয়। একটি মাত্র মাহুত হাতিটির কাঁধে চড়ে এটাকে চালিয়ে নিয়ে আসছে। মাথা তুলে দেখলেন কয়েক ফুট দূরে তার কয়েকজন লোক একটা গরুর গাড়ি থেকে একটি পাথরের চওড়া টুকরা ধরাধরি করে নামাচ্ছে। এই পাথরের উপর ফেলেই অপরাধীকে হাতির পা দিয়ে পিষে ফেলা হবে। রক্ত শুকিয়ে পাথরটির রঙ বাদামি হয়ে রয়েছে। আর এর চার কোণায় একটি করে লোহার আংটা লাগান রয়েছে। পাথরটি ঠিকজায়গা মতো স্থাপন করার পর আওরঙ্গজেব তার দেহরক্ষী দলের অধিনায়ককে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘ঐ লোকটি!’ যে লোকটি তার গায়ে থুথু ফেলেছিল তাকে দেখালেন। মারাঠি লোকটি হয়তো ভাবছে সে থুথু ফেলেছিল বলে তিনি তার উপর প্রতিশোধ নিচ্ছেন। আসলে তা নয়। লোকটিকে প্রথমে মরার সুযোগ দিয়ে তিনি তার সাহসের প্রশংসা করছিলেন।

 সৈন্যরা দ্রুত লোকটির জামা-কাপড় খুলে ফেললো, সে এখন চুপ করে রয়েছে। তারপর তাকে চিৎ করে পাথরটির উপর শুইয়ে দিয়ে চারটি আংটার সাথে দুই হাতের কব্জি আর পায়ের গোড়ালি বেঁধে দিল। হাতিটি একটি পা তুলতেই এর ছায়া লোকটির উপর পড়লো, তারপর মাহুতের ইশারায় হাতিটি পা ধীরে ধীরে লোকটির শরীরের উপর নামিয়ে আনলো। পেটের নাড়িভূড়ি বের হয়ে যেতেই মারাঠি লোকটি একটি বন্য পশুর মতো আর্তনাদ করে উঠলো। বদ বায়ু আর মানুষের মলের বমি উদ্রেক করা দুর্গন্ধ এড়াতে আওরঙ্গজেব তাঁর পাশে দাঁড়ান তরুণ কোরচির কাছ থেকে একটি কাপড়ের টুকরা নিয়ে নাকে চেপে ধরলেন। কোরচি ছেলেটি হঠাৎ উবু হয়ে মাটিতে বসে পড়লো, তারপর আওরঙ্গজেব শুনতে পেলেন সে বমি করছে, তবে কিছু বললেন না। ছেলেটার বয়স খুব কম। সময় হলে সে জানতে পারবে এই ধরনের কাজ যত খারাপই। হোক না কেন, একজন শাসকের প্রজাদের মনে ভয় জাগাবার জন্য এটা প্রয়োজনীয় আর এভাবেই তার কর্তৃত্ব বজায় রাখতে হবে।

সাতজন মানুষের দেহাবশেষ পাথরের টুকরা থেকে একে একে সরিয়ে মাটিতে ছড়িয়ে রাখা পানি নিরোধক কাপড়ে এনে মুড়ে রাখা হল। তারপর দেহগুলো শিবির থেকে বেশ দূরে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে সেখানে মাটি চাপা দেওয়া হবে। ইতোমধ্যে বাতাসে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল। সবশেষ বন্দীটি ছিল কমবয়সী একটি তরুণ, সৈন্যরা তাকে টেনে দাঁড় করাতেই সে একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত বুড়ো মানুষের মতো ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগলো। একজন সৈন্য অসতর্কভাবে ইস্পাতের ছুরি দিয়ে তরুণটির হাতের বাঁধন কাটতে গিয়ে তার হাতের চামড়াও একটুখানি কেটে গিয়ে তার ডান হাত বেয়ে দরদর করে রক্ত ঝরতে লাগলো। সৈন্যরা তার পোশাক খোলা শুরু করতেই আওরঙ্গজেব এক হাত তুললেন।

তিনি ধীরে ধীরে বললেন, ‘থাম। এর সাথে আমার কিছু কথা আছে। তোমার বয়স কম বলে তোমার মৃত্যু হবে না তা নয়। তবে আমি তোমাকে বাঁচার জন্য একটি সুযোগ দিতে পারি।’

তরুণ মারাঠি ছেলেটি তখনও থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে তাঁর দিকে তাকাল।

সম্ভাজি সম্পর্কে খবরের বিনিময়ে আমি তোমার প্রতি ক্ষমা দেখাতে পারি। আমি সবকিছু জানতে চাই, সে কী খেতে আর পান করতে পছন্দ করে, সেখান থেকে শুরু করে কী দেখলে সে হাসে আর কেমনভাবে তার লোকদের সাথে কথা বলে সবকিছু। এমনভাবে বলবে যেন, আমি মনে করতে পারি যেন তাকে আমি চিনি। যেন আমি তার সাথে তার শিবিরেই আছি। পারবে এটা করতে? হা..হ্যাঁ, পারবো আমি।’

‘তোমার নাম কী?

 ‘সন্তাজি।

 “ঠিক আছে সন্তাজি। আমাকে দেখাও। তবে আমি হয়তো এটা জানতে পারি যে, তুমি কখনও সম্ভাজির সাথে দেখা কর নি। ‘প্রায় দুই বছর আমি তার দেহরক্ষী দলের সদস্য ছিলাম। তারপর বর্ষার ঠিক আগে আমার বড়ভাই বসন্তরোগে মারা যাবার পর আমার বাবার অনুরোধে সম্ভাজি আমাকে বাড়ি ফেরার অনুমতি দেন।

 ‘তোমার বাবা এখন কোথায়?

 “তিনি…তিনি…এখানে মারা যাওয়া দ্বিতীয় ব্যক্তি।

কথাটা আওরঙ্গজেব বিবেচনা করলেন। সন্তাজি এই মাত্র তার বাবার হত্যাকাণ্ড দেখেছে, এরজন্য সে হয়তো এর প্রতিশোধ নিতে চাইবে। কাজেই তাকে ভুল পথে চালিত করতে হবে। অন্যদিকে তার মনে এখন যে আতঙ্ক চলছে, তার বিপরীতে যে আশার আলো তার চোখে দেখা দিয়েছে তাতে সে মনে করছে হয়তো সে হয়তো মরবে না, এতে বুঝা যাচ্ছে সে বাঁচতেই চাইছে।

“ঠিক আছে আমরা দেখবো। প্রত্যেকদিন সেনা কর্মকর্তারা তোমাকে প্রশ্ন করে সবকিছু আমাকে জানাবে। তোমার কথায় যদি আমি সন্তুষ্ট হই তাহলে তোমার বন্দীজীবন সহজ হবে। আর তা নাহলে.. মনে রেখ আজ কি দেখেছ।

আওরঙ্গজেব দ্রুত হেঁটে তাঁর ঘোড়ার কাছে গেলেন, সহিসকে ইশারা করতেই সে ছুটে সামনে এগিয়ে তাঁকে ঘোড়ায় চড়তে সাহায্য করলো। যুবক বয়সে যেরকম একলাফে জিনে চেপে বসতেন এখন আর সেরকম পারেন না। তবে এখনও যথেষ্ট চটপটে আছেন। শিবিরের চৌহদ্দীর চারপাশে পাহারা দেখার জন্য ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করলেন।

 সন্ধ্যায় সর্বাধিনায়কের তাঁবুতে নামাজ শেষ করে উঠে অবাক হয়ে দেখলেন তার কোরচি তাঁবুর পর্দার কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। সে নিশ্চয়ই নিঃশব্দে ঢুকেছিল, তাই তিনি তার আসা শুনতে পান নি। ছেলেটি বললো, জাঁহাপনা, আপনার বোন গওহারা বেগম সাহেবার সচিব ইকবাল করিম এই মাত্র আজমির থেকে একটি জরুরি চিঠি নিয়ে এসেছেন। তিনি চিঠিটা এখুনি আপনার হাতে দিতে চাচ্ছেন।

তিনি বললেন, “ঠিক আছে।’ কথাটা বলার সাথে সাথে ইকবাল করিম তাঁবুর দরজায় এসে চিঠিটা এক হাতে ধরে মাথা নুইয়ে দাঁড়াল। সে নিশ্চয়ই তাঁবুর বাইরেই অপেক্ষা করছিল। সিল মোহরে গওহারার ব্যক্তিগত সিলমোহর– লাফিয়ে উঠা একটি মাছের প্রতিকৃতি দেখা যাচ্ছে। আওরঙ্গজেব সিলমোহর ভেঙ্গে চিঠিটা পড়তে শুরু করলেন। প্রিয় ভাই, আমাদের শ্রদ্ধেয় বোন জাহানারা মারা গেছেন…

কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি শান্তভাবে বললেন, ‘ধন্যবাদ, ইকবাল করিম। তুমি এখন যাও, পরে তোমাকে খবর দেব।’

একা হতেই আওরঙ্গজেবের হাত থেকে চিঠিটা খসে পড়লো তাঁর হাঁটুর উপর। জাহানারার আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া শুরু করতেই তার দুই চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়তে লাগলো। দোয়া পড়তে গিয়ে কি কি উচ্চারণ করছেন তার কিছুই কানে ঢুকছিল না। তাঁর সমস্ত চিন্তা ছিল তাঁর এই বোনের জন্য যাকে তিনি সকল ভাই-বোনের মধ্যে সবেচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। মায়ের মৃত্যুর পর তিনিই তাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। একমাত্র তাঁর মতামতকেই তিনি মূল্য দিতেন। ভবিষ্যৎ নিয়ে তার মনে খুব ভয় ছিল, তাঁকে নিয়ে, পরিবারকে নিয়ে আর সাম্রাজ্যকে নিয়েও তার মনে আতঙ্ক ছিল। মনে হচ্ছিল তিনি বেঁচে থাকার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি এটা তাঁর চোখে দেখেছিলেন, তার কণ্ঠস্বরে শুনেছিলেন। যদি তিনি তাকে একটু সান্ত্বনা, একটু আশা দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা পারেন নি। তার উদ্বেগ দূর করতে হলে তাঁকে নিজের বিবেকের বিরুদ্ধে যেতে হত আর তাঁর বিশ্বাসের সাথে প্রতারণা করা হত। আর সেটা করা কখনও তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

এসব কথা ভেবে তিনি একটু শান্ত হলেন, তারপর এক মুহূর্ত ইতস্তত করার পর গওহারার চিঠিটা তুলে পড়তে শুরু করলেন।

*

আপনি চলে যাওয়ার পর আমাদের বোন দিন দিন আরো দুর্বল হয়ে পড়লেন, ঘর থেকে খুব কম বের হতেন, সারাদিন সেখানে ঝিমুতেন। যখন জেগে থাকতেন তখন সুফিতত্ত্ব, কোরানের বিভিন্ন সূরা আর অনেক সময় তাঁর প্রিয় ফার্সি কবিতা পড়ে সময় কাটাতেন। ক্ষিধে একেবারে কমে গিয়েছিল। আমরা কোনোমতেই তাঁকে ছোট এক বাটি সুরুয়া কিংবা সামান্য ভাতও খাওয়াতে পারতাম না। হেকিম যা বলতেন মনোযোগ দিয়ে সব শুনতেন, মৃদু হেসে সায় দিতেন তারপর হেকিমরা চলে গেলে আবার ঠিক আগের মতোই চলতেন। দশ দিন আগে তিনি খাওয়া-দাওয়া একেবারেই ছেড়ে দেন। আমার চোখের সামনে তিনি শুকিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি আপনাকে লিখে জানাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তিনি কঠোরভাবে আমাকে চিঠি লিখতে নিষেধ করলেন। আপনিতো জানেন, শান্ত হলেও তিনি কিরকম জেদি হতে পারেন।

শেষদিন তাঁর শাসপ্রশাস আসে যায় এমন হচ্ছিল আর নিশাস এত ভাসাভাসা হচ্ছিল যে, তার পরিচারিকা ভোরের আগে আমাকে ডেকে পাঠাল। শেষমুহূর্ত পর্যন্ত অবশ্য জাহানারার জ্ঞান ছিল। খুব ধীরে ধীরে তবে পরিষ্কারভাবে কথা বলে তিনি আমাকে বললেন, আমি যেন অবশ্যই আপনাকে জানাই, আপনার প্রতি তাঁর ভালোবাসা সবসময় অটুট আর নিঃশর্ত ছিল, যদিও আপনার কোন কোনো কাজে তিনি মনে ব্যথা পেয়েছেন। তারপর তাঁকে একটু উত্তেজিত মনে হল। বালিশ থেকে মাথা সামান্য তুলে তিনি আমাদেরকে অনুরোধ করলেন, আমরা যেন আপনাকে অনুরোধ করি পরিবারের সব সদস্যকে একইরকম ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখতে আকবর আর জেবুন্নিসার প্রতি, যাদের জন্য তিনি শেষ আরেক বারের জন্য ক্ষমাভিক্ষা চাচ্ছেন। আর তাদের প্রতিও যাদেরকে তিনি আপনার বৃহত্তর পরিবার মনে করেন–জাতপাত ও সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সেই প্রজাদের প্রতিও। কথাগুলো বলা শেষ করার পর তাঁর অসুস্থ মাথা আবার বালিশে পড়ে গেল আর তারপর পশ্চিমদিকে মুখ করে চেহারায় প্রশান্তি নিয়ে তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেন।

আমাদের বোন একটি চিঠি লিখে অনুরোধ করে যান, তাকে যেন দিল্লিতে খোলা আকাশের নিচে ছেট একটি সমাধিতে দাফন করা হয়। ঠিক যেরকম প্রাচীন মুসলিম অনুশাসনে বলা হয়েছে আর আমাদের পূর্বপুরুষ বাবর যেমন কাবুলে একটি পাহাড়ের ধারে সমাহিত আছেন। তিনি কিছু উইল দ্বারা অর্পিত সম্পত্তি রেখে গেছেন, তবে জানিয়েছেন তার বাকি সব ব্যক্তিগত সম্পদ বিক্রি করে সেই অর্থ দিল্লি আর আগ্রার গরিব হিন্দু-মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে বিলিয়ে দিতে। আমি তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।

কামনা করি আল্লাহ আপনাকে এই শোক সহ্য করার শক্তি দিক আর আমিও আল্লাহর কাছে দোয়া প্রার্থনা করছি আমার দুঃখে শান্তি দিতে। তিনি সব সময় আমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন।

*

আওরঙ্গজেব খুব যত্ন করে চিঠিটা ভাঁজ করলেন। নীরব শোকে কাতর অবস্থায় হাঁটুগেড়ে বসে জাহানারার একটি কথা তাঁর মনে পড়ে গেল। একবার তিনি বলেছিলেন, ভালো এবং মহৎ চরিত্রের মানুষকে হিন্দুরা : ‘একটি মহৎ আত্মা’, নাম দিয়েছিল। সেই শব্দগুলো জাহানারার জন্য একেবারে সঠিক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *