বাসা নিয়েছে ফারুক। মাকে সে জানায়নি, ব্যথা পাবেন। ভেবেছে, কিছুদিন পর আস্তে আস্তে সব কিছু জানাবে তাকে, বুঝিয়ে বলবে। আপাতত বলে এসেছে যে, নতুন কাজ পেয়েছে, বাইরে বাইরে থাকতে হবে। তাহমিন, ফারুক যখন মায়ের কাছে, এক রেস্তোরাঁয়। বসে ছিল। ফারুক যখন ফিরে এলো, তখন। উজ্জ্বল চোখ মেলে শুধালো, কি হলো?
মাকে বলে এলাম তাই।
অমন না বলে খোলাখুলি বললেই পারতে। আমি তো নিজেই যেতে চেয়েছিলাম, তুমি মানা করলে। মাকে আমি পায়ে ধরে বুঝিয়ে বলতাম। আমাকে তিনি ঠেলে দিতে পারতেন না। তবু চট করে না বলাই ভালো। কিছুদিন যাৎ, মা দেশে যাবেন বলছিলেন, অনেক দিন যান–বেশ কিছুদিন থাকবেন, ফিরে আসুন, তখন দুজনেই যাব।
আর কী বললেন?
কিছু না।
এমনি করে ধীরে ধীরে সব কিছু গুছিয়ে এনেছে তারা। তাহমিনা সাজিয়েছে তার ছোট্ট সংসার। ফারুক সেই খবরের কাগজেই আছে। তাহমিনা দুটো টিউশানি নিয়েছে। ফারুক বাধা দিয়েছে তাকে, তুমি কী বলো তো? তোমার আবার টিউশানি করবার কী দরকার ছিল?
কেন বসেই তো আছি। তবু দুবেলা কিছু কাজ জুটলো। তাছাড়া কটা টাকা এলে তো আর ফেলনা যাবে না। লাগবে।
এতেই তো বেশ চলছিল মিনু।
তুমি থামো তো। ফারুক আর কিছু বলেনি। সকালে একটা টিউশানি, বিকেলে আর একটা। সকাল বেলা তাহমিনা বেরোয় দীর্ঘ দুটি বেণি করে বুকের ওপর ফিরিয়ে একটা সাদাসিদে শাড়ি পরে। যাবার সময় ফারুককে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। তার আগেই সে চা করে রেখেছে। তারপর দুজনে মিলে চায়ে চুমুক দেয়। কত কতদিন ফারুক অমুযোগ করে, এত ভোরে উঠে সে। বেরিয়ে যায় কিছু তার ভালো লাগে না। তাহমিনা হাসে, বলে, পয়সা জিনিসটে যত খারাপই। হোক, আদতে কিন্তু সবচে জরুরি। সেটা ভুললে চলবে কেন? কোন কোনদিন ফারুকের খুনসুটি সহ্য করতে না পেরে আরো কিছুক্ষণ বসতে হয়। দেরি করতে হয়। খাটে পা ঝুলিয়ে তার এই বাড়তি সোহাগ নিতে ভালোই লাগে।
সকালে ঘণ্টা দেড়েক পড়াতে হয়। ক্লাস এইটে পড়ে মেয়েটি তাকে। তারপর ক্লান্ত হয়ে যখন সে ফেরে তখন বেলা সাড়ে নটা কী দশটা, মুখের স্বল্প প্রসাধন হয় ম্লানতর। একটা তৃপ্তিকর ক্লান্তির ছায়া ছড়িয়ে থাকে সারামুখে। সেই শাড়ি পরেই সংসারের কাজে হাত দেয়। তারপর দুপুর বেলা দুজনে জানালার ধারে উবু হয়ে শুয়ে বই পড়ে। কিংবা তাহমিনা পড়ে, ফারুক শোনে। এমনি। ঘর গুছোঁয়। টবে ফুলের লালন করে। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ও বাড়ির বৌটির সাথে আলাপ করে খুচরো। বিকেলে দুজনে বেরোয় একসাথে। তাহমিনা যাবে টিউশানিতে আর ফারুক তার আপিসে। তাহমিনা এখন গোল করে খোঁপা বাঁধে। সেই চপল বেণি আর নেই। সকালে ছিল আঁটসাঁট, এখন অলস এলিয়ে দেয় শাড়ির ভাঁজ। মুখ সাবানে মেজে শুভ্র করে তোলে। বেরিয়ে হাঁটতে থাকে তারা। নবাবগঞ্জের এদিকে তেমন ভিড় নেই শহরের। কেমন বিরলতার আবহ চারদিকে। বেড়াতে বেড়াতে যখন আকাশ মিহি লাল হয়ে আসে, তখন তারা সেই বাড়ির ফটকের সমুখে যেখানে তাহমিনার বিকেল টুশানি। মেয়েটি ম্যাট্রিক দেবে, পাশ করবে বলে মনে হয় না, তবু চেষ্টা করতে দোষ কী? তাই তাহমিনাকে রাখা। সকালে নাকি আর একজন টিউটর আছেন, তিনি অঙ্ক করান। এখানে সে পড়ায় জিরিয়ে জিরিয়ে। তাড়াহুড়ো করে না।
ফিরে যখন আসে, তখন ঝি রান্নাবান্না শেষ করে রেখেছে। তাকে বিদেয় করে তাহমিনা নিজে খেয়ে নিয়ে বেশ বদলিয়ে যখন স্থির হয় তখন রাত কিছুটা বেড়েছে। ফারুক তখনো আসে নি। সে আসে এগারোটা সাড়ে এগারোটার দিকে আপিস থেকে। কোনদিন একটায়। বলে, সারা দুনিয়ার লোকের সকাল বেলার চা উপভোগ করবার বন্দোবস্ত করে এলুম।
কী লিখলে আজকে?
ফারুক প্রত্যুত্তরে সম্পাদকীয়ের শিরোনামটা জানায়। দুএকটা মজার খবরের কথা বলে খেতে খেতে। তাহমিনা শোনে। তারপর হয়ত, আচ্ছা মিনু, ভোর সকালে কাগজ বেরুবার। নিয়ম কে আবিষ্কার করেছিল বলতে পার?
কী জানি।
যেই বের করুক, ভাল করেনি। কী ট্যাজেডি বলোত? শহরে নিশাচর বলতে এক পাহারাওয়ালা আর খবরের কাগজের লোক।
আর চোর বাটপাড়?
তারাও এ দুদলের মধ্যেই পড়ে।
বলেই ফারুক হেসে ওঠে। একটা সিগারেট ধরায় আয়েস করে।
তাহমিনা বলে, এতই যখন তখন খবরের কাগজে কাজ না করলেই পার? অন্য কোথাও দেখ না।
উঁহু। অন্য কাজে পয়সা আছে, তৃপ্তি নেই। তবু তো সারারাত আমায় থাকতে হয় না। তাহলে যে কী করতে!
কিন্তু সবদিন এমন যায় না। কোনোদিন ফারুক ফেরে, একটু অন্যমনা দেখায়। কী যেন ভাবে, কথা বলে না। বললেও ভাল করে বলে না। তার কাছাকাছি সরে এসে খুব কাছে মুখ রেখে তাহমিনা জিগ্যেস করে, কী হয়েছে তোমার?
কই কিছু নাতো।
তাহমিনার বুক কেঁপে ওঠে। সুন্দরবনের দীর্ঘ অরণ্য যেন বুকের ভেতরে মাথা কুটতে থাকে। তবে চুপ করে রয়েছ কেন?
এমনি।
মিছে কথা। ভাবছ তাই না? কী ভাবছ?
ফারুক তার চোখের দিকে চোখ রেখে আস্তে আস্তে বলে, আমি ভাবছি নে মিনু।
কিন্তু ফারুকও জানে, তাহমিনাও জানে, এ মিছে কথা! ফারুকের মনে এখন দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, ভয়। সে আর তাকাতে পারে না তাহমিনার দিকে। তাহমিনা ওর হাত ধরে স্পর্শ থেকে অনুভব করতে পারে তাব মনের কথা। বলে, তুমি আমাকে ভালোবাসো?
কেন, মিনু?
সত্যি বলো।
এরচেয়ে বেশি কি বলব। তুমি কি জানো না, তোমায় আমি কত ভালোবাসি?
তাহমিনার দুঃখ হয়। খুশি হয় না। ক্ষুণ্ণ হয়। বলে, তাহলে তোমার দ্বিধা কেন?
না, না।
বলে ফারুক দুহাতে ওকে আকর্ষণ করে বুকের উত্তাপে বাধে। তাহমিনা শিথিল স্বরে নিচু পর্দায় উচ্চারণ করে, আমার দিকে তাকাও আমার চোখের দিকে—-আমার জড়িয়ে আসে, কিছুটা অর্থহীন হয়ে আসে তার কথা। কিন্তু বুঝতে পারে ফারুক, কী, ও বলতে চায়। মৃদু গলায় বলে, তুমি আছো, আমি সব ভাবনার ইতি করে দিয়েছি।
তাহমিনা তার সমস্ত শরীর শিথিল করে সাহস সঞ্চারিত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে অনেকক্ষণ।